বাঙালির চরিত্র বুঝতে আমার নিজের জীবনে যা ঘটেছে, সেটা জানলেই যথেষ্ট। আমার মতো বাঙালি, যে কিনা বিদেশের যশ খ্যাতি ফেলে দেশে ফেরার জন্য আকুল, যে কিনা পশ্চিমবঙ্গে বাস করতে শুরু করেছিল, আজ সে দু বাংলা থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে ইংরেজিতে ব্লগ লিখছে, ফ্রিথট ব্লগ। ফ্রিথট বা মুক্তচিন্তার অভাব বাংলায়, তাই বলে এর অভাব তো পৃথিবীর সর্বত্র নেই। বিদেশি লোকেরা বিস্তর প্রশংসা করছে, দিশি লোক মুখ ফিরিয়ে আছে। বাঙালির কাকঁড়া-চরিত্র আজও ভয়াবহ আকারেই বিরাজ করছে। সেদিন ভাষা দিবসে একটা কবিতা লিখলাম, শুনুন।
আজ ভাষা দিবস।
ঘরে আমি আর আমার বেড়াল,
আর কেউ নেই। কোথাও যাবার নেই সারাদিন।
না আমার, না বেড়ালের। আজ তোমরা গান গাও, আজ নাচো।
ভাষার উৎসব করো, স্বরবর্ণে সাজাও শহর,
ব্যঞ্জনবর্ণে শরীর।
কবিতা পড়তে পড়তে চোখের জল ফেলো। গান গাইতে গাইতে
শহিদ মিনারের দিকে হাঁটো। যত ফুল আছে দেশে,
মিনারের পাদদেশে দাও। ভাষাকে ধন্য করো।
আজ তোমাদের দিন।
তোমরা এক একজন সৈনিক ভাষার কসম খেয়
বড় বড় প্রস্তুতি নাও আগামীর, নিতে হয়, এই দিনে এমনই নিয়ম।
এ দিন আমার নয়। ছিল কোনও একদিন আমার দিন।
আমার ভাষা থেকে আমাকে তাড়িয়েছ আজ দেড়যুগ হল,
ভাষার ত্রিসীমানা থেকে আমাকে বিদেয় করেছ দেড়যুগ হল।
অন্য ভাষাকে অনুচ্চারিত রেখে, অন্য দেশকে অস্বীকার করে,
তোমাদের বন্ধ দরজার সামনে অপেক্ষা করছি অনেক বছর,
দরজা কিন্তু কেউ খুলছো না।
আমি যে দাঁড়িয়ে আছি, দেখছ, কিন্তু কোথাও বলছো না দেখছো
যেন দেশটা তোমাদের একার,
যেন তোমাদের একার ভাষা, যে ভাষায় আমি কথা বলি।
যে ভাষায় লিখি, তা আমার নয়, তোমাদের, তোমাদের একার।
যে ভাষায় আমার শৈশব কৈশোর, যে ভাষায় যৌবন,
যে ভাষায় স্বপ্ন দেখি, আমার নয়, কখনও ছিল না, তোমাদের সব।
ভাষাকে যেন আমি যত বাসি, তার চেয়ে বেশি ভালোবাসো
বা বেসেছিলে কোনওদিন!
আজ ভাষা দিবস,
আমিও ভাষার উৎসব করবো আজ।
তোমাদের ওই ভাষায় একটি শব্দও আমি উচ্চারণ করবো না আজ,
একটি শব্দ কোথাও লিখবো না আজ,
আজ উৎসব করবো কোনও স্বপ্ন না দেখে,
আজ শুধু বেড়ালের সঙ্গে কথা বলবো, বেড়ালের ভাষায়।
বাঙালির বোরখা
ষাটের দশকের শেষ দিকে আমি বিদ্যাময়ী ইস্কুলে পড়ি। ময়মনসিংহ শহরের সবচেয়ে নামকরা মেয়েদের ইস্কুল। হাজারো ছাত্রী, কিন্তু কেউই কখনও বোরখা পরতো না। কোনো ছাত্রী তো নয়ই, কোনও শিক্ষিকাও নয়। বোরখার কোনও চলই ছিল না। খুব পদানসীন মৌলবী পরিবারের বয়স্ক মহিলারা বাইরে বেরোলে রিকসায় শাড়ি পেঁচিয়ে নিত। ওদেরও পরার বোরখা ছিল না। সত্তরের দশকে আমি ওই শহরেই রেসিডেন্সি য়াল মডেল ইস্কুলে পড়ি। সারাইস্কুলে একটি মেয়েই বোরখা পরতো। তখন বোরখা কিনতে পাওয়া যেত না। পরতে চাইলে কাপড় কিনে বানিয়ে নিতে হত। মেয়েটির বোরখাও কাপড় কিনে বানিয়ে নেওয়া। তার মৌলবী-বাবা জোর করে তাকে বোরখা পরাতো। মেয়েটি আমাদের ক্লাসেই পড়তো। নাম ছিল হ্যাপি। লম্বা টিংটিঙে মেয়ে। আমিও ছিলাম হ্যাপির মতো লম্বা টিংটিঙে। হ্যাপি তার বোরখাটা ইস্কুলের গেটের কাছে এসেই খুলে ফেলতো, বোরখাটাকে বইখাতার ব্যাগে ঢুকিয়ে তবেই ইস্কুলে ঢুকতো। সে যে বোরখা পরে ইস্কুলে আসে তা কাউকে জানতে দিতে চাইতো না। কিন্তু খবরটা একদিন ঠিকই জানাজানি হয়ে যায়। জানাজানি হওয়ার পর ইস্কু লের মেয়েরা সবাই হ্যাপিকে নিয়ে হাসাহাসি করতো। হ্যাপি ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসতো বোরখা পরার লজ্জায়। সঙ্গে আবার পড়াশোনা ভালো না করার লজ্জাও ছিল। আমি ভালো ছাত্রী হলেও সবার সঙ্গেই মিশতাম। হ্যাপির সঙ্গেও। হ্যাপি খুব অসভ্য অসভ্য গালি জানতো। ক্লাসের অন্য মেয়েরা হ্যাপির মতো অত গালি জানতো না। আমি তো আগে কোনওদিন শুনিনি ওসব গালি। হ্যাপি যখন ক্লাস নাইনে বা টেন-এ, তখন তার বাবা জোর করে তার বিয়ে দিতে চাইছিল। হ্যাপি তার হবু-স্বামীর কথা বলতো আর তার বাপ মা তুলে গালিগালাজ করতো। আমি অবাক হয়ে ওসব শুনতাম। ক্লাসের সবচেয়ে ডাকাবুকো মুখ-খারাপ মেয়ে কিনা বোরখা পরে। আর আমরা যারা কোনও গালি জানি না, আমরা যারা সরল সোজা ভালোমানুষ, তারা কোনওদিন বোরখার কথা কল্পনাও করিনি। বোরখা একটা হাস্যকর পোশাক ছিল ষাট আর সত্তর দশক জুড়ে। দুএকজন যারা পরতে বাধ্য হতো, তারা লজ্জায় রাস্তাঘাটে মাটির সঙ্গে মিশে থাকতো।
আশির দশকের শেষ দিকে শাড়ির ওপর একটা বাড়তি ওড়নার মতো কাপড় পরা শুরু হয়েছিল। নব্বই দশকের শুরুতেও তাই ছিল। একটা বদ হাওয়া টের পাচ্ছিলাম, প্রাণপণে রুখতে চাইছিলাম সেই বদ হাওয়া। সমাজের ইসলামীকরণ এবং নারীবিরোধী ইসলামী আইনের প্রতিবাদ করেছিলাম। সে কারণে আমাকেই তাড়িয়ে দেওয়া হল দেশ থেকে। চুরানব্বই থেকে দেশের বাইরে। নির্বাসন জীবনে দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে সব খবর রাখার সুযোগ হতো না। হঠাৎ সেদিন, এই বছর দুয়েক আগে, চমকে উঠেছি কিছু ছবি দেখে। আমাদের ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ঘটে যাওয়া রজত জয়ন্তী উৎসবের ছবি, যে উৎসবে আমার প্রচুর সহপাঠী গিয়েছিল, সবাই এখন দেশ বিদেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। ছবিগুলোর সামনে আমি হতভম্ব, হতাশ বসে থেকেছি সারাদিন। প্রায় সব সহপাঠী মেয়ের মাথায় হিজাব, কালো কাপড়ে কপাল অবধি ঢাকা, অত সুন্দর চুলগুলো সব লুকিয়ে ফেলেছে। আর প্রায় সব সহপাঠী ছেলের মুখে দাড়ি নয়তো মাথায় টুপি, কপালে মেঝেয় কপাল ঠুকে নামাজ পড়ার কালো দাগ। এই ছেলেমেয়েগুলো পুরো আশির দশক জুড়ে আমার সঙ্গে ডাক্তারি পড়েছে, কোনওদিন কাউকে এক রাকাত নামাজ পড়তে দেখিনি, কোনওদিন কাউকে আল্লাহর নাম মুখে নিতে শুনিনি। এমন আধুনিক সব চিকিৎসাবিজ্ঞানী কি না হয়ে উঠেছে পাঁড় ধর্মান্ধ? কে এই বিজ্ঞানীদেরও মাথার খুলি খুলে গোবর ভরে দিয়েছে। তবে কি সেই বদ হাওয়া, যেটিকে রুখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রুখতে দেওয়া হয়নি, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল বিষাক্ত ভাইরাস, যুক্তি বুদ্ধি চিন্তাশক্তি লোপ পাইয়ে দেওয়ার ভাইরাস? যদি ডাক্তারদেরই এই হাল, কল্পনা করতে পারি আর সব সাধারণ মানুষ এখন ধর্মান্ধতার কোন স্তরে পোঁচেছে। পোঁচেছে না বলে সম্ভবত তাদের কোন স্তরে পোঁছোনো হয়েছে বলা ভালো। আজ দেশ থেকে একজন জানালো, মিতা হকের বক্তব্য নিয়ে দেশে নাকি হুলস্থুল কাণ্ড হচ্ছে। ইউটিউবে কিছুক্ষণ আগে শুনলাম ওঁর কথা। চলতে ফিরতে রাস্তাঘাটে বাজারে অফিসে যেখানেই যত মেয়েদের চোখে পড়ে, প্রায় সবারই পরনে নাকি থাকে কালো বোরখা, শুধু চোখদুটো খোলা, যেন হোঁচট না খায়! প্রায় সবাই তবে চলমান কয়েদি! সবারই গায়ে মস্ত কালো সতীত্ব বন্ধনী! মিতা হক যা বলতে চেয়েছেন, তা হল, নিজেদের সংস্কৃতিকে সম্মান করো, আরবের ধর্ম গ্রহণ করেছো, কিন্তু আরবের পোশাক-সংস্কৃতি তোমাকে গ্রহণ করতে হবে কেন!