বাংলাদেশের যে হিন্দুরা বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে চমৎকার বাস করছে, তারা অনেকেই পশ্চিমবঙ্গে একআধখানা বাড়ি বানিয়ে রেখেছে। দেশে ঘুরতে গেলে বাংলাদেশ আর ভারত দুটোই ঘুরে আসে। সে না হয় এলো, কিন্তু বিদেশ বিভুয়ে বাঙালি না হলেও, অন্তত হিন্দু হওয়ার দৌলতে যেন পশ্চিমবঙ্গের দাদারা একটু খাতির টাতির করেন, তার চেষ্টা তারা নিরন্তর করে গেলেও খাতির ওই বাংলাদেশের গরিব মুসলমানদের থেকেই বেশি জোটে। দেশি লোকের খাতির। শ্রমিক শ্রেণীর হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে দেশে ভাই ভাই না হতে পারলেও বিদেশে কিন্তু অনেকটা ভাই ভাইই।
বেশির ভাগ বাঙালি বিদেশের যে জায়গায় বাস করে, তাকে কুয়ো বলা চলে। রীতিমত কুয়োর ব্যাংএর জীবন! তুলনায় বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গ পুকুর। মুক্তচি ন্তার চর্চা কিছুটা হলেও কেউ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু নদী বা সমুদ্র? না, তার কোনও আভাস নেই। হাতে গোনা দুএকজন পাওয়া যাবে খুঁজলে, যাদের সমুদ্রে সাঁতার।
একসময় তিরিশ চল্লিশের দশকের উপন্যাস আর প্রবন্ধ পড়ে মনে হত, ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালিই সেরা বুদ্ধিজীবী। হয়তো ঠিকই। হয়তো তা-ই ছিল তখন। বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, পশ্চিমবঙ্গে সমাজতান্ত্রিক চেতনা, বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের আধুনিক মনন, মানুষের জন্য কাব্য, সঙ্গীত, সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথের অগাধ ভাণ্ডার, সব কিছু বাংলাকে কী ভীষণই না সমৃদ্ধ করেছিল। আজ অন্নদাশংকর, শিবনারায়ণ রায়, আর অম্লান দত্তের মৃত্যুর পর মনীষীর আকাল দেখি পশ্চিমবঙ্গে। যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেন, লেখকের বই নিষিদ্ধ করতে পরামর্শ দেন। তাঁদের বেশির ভাগ হয় সিপিএম বুদ্ধিজীবী, নয়তো তৃণমুলী বুদ্ধিজীবী, ওদিকে বাংলাদেশে প্রায় সব বুদ্ধিজীবীই আওয়ামি লীগ বুদ্ধিজীবী, নয়তো বিএনপি বুদ্ধিজীবী, নয়তো জামাতি ইসলামি বুদ্ধিজীবী… কেউই এখন আর নিরপেক্ষ মত প্রকাশ করতে পারেন না। সবাই এখন, যা বললে তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলের লাভ হবে, তাই বলেন। দলের স্বার্থে বাক স্বাধীনতার বি রুদ্ধেও বলেন প্রচুর। আমার পাঁচটা বই বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কোনও বুদ্ধিজীবী আমার বই নিষিদ্ধর বিপক্ষে একটি কথাও উচ্চারণ করতে পারেননি, কারণ সব রাজনৈতিক দলই আমাকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের, যে কোনও কারণেই হোক, ধারণা হয়েছে, আমার দেশে ফেরার অধিকার, আমার লেখার অধিকার, আমার কথা বলার অধিকার লংঘন না করলে দল জনপ্রিয়তা হারাবে।
আরও ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে। পঁচিশ জন বুদ্ধিজীবী তৎকালীন মু খ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বলেছে আমার দ্বিখণ্ডিত নিষিদ্ধ করতে হবে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বুদ্ধিজীবীদের প্রস্তাব ফেলতে পারেননি, তিনি বই নিষিদ্ধ করেছেন। পৃথিবীর কোথাও এমন ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেনি। সব দেশেই লেখকরা লেখকদের মত প্রকাশের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেন। লেখকের বইনিষিদ্ধ করার জন্য আদালতেও যান না, রাজা মন্ত্রীর কাছেও দৌড়ান না। কিন্তু বাংলায়, পূর্ব আর পশ্চিম বাংলায় এই ঘটনা ঘটেছে। একটা সমাজ সচেতন, নারীবাদী, মানববাদী লেখককে কেউ সহ্যই করতে পারছে না। অথচ তার বই কিন্তু সেই পঁচিশ বছর ধরে মানুষ পড়েই যাচ্ছে। জনপ্রিয়তা নষ্ট করার জন্য দুই বাংলার সাহিত্য জগত তাকে নিষিদ্ধ করেছে, তার লেখা ছাপানোই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র চারিদিকে।
পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের চেয়ে অসহিষ্ণুতায় আরও এগিয়ে আছে। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তাই দেখেছি। বাংলাদেশে চার লক্ষ লোকের জমায়েত হয়েছিল আমার বিরুদ্ধে, প্রায় প্রতিদিনই দশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার লোকের মিছিল হত আমার ফাঁসির জন্য। হরতাল ডাকা হত। গাড়ি ঘোড়া অফিস আদালত বন্ধ করা হত শুধু আমাকে মেরে ফেলার দাবিতে। সেই অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়েছে। অন্য লোকেরা আমার বিরুদ্ধে অন্যায় করেছে, সে কারণে শাস্তি দেওয়াহয়েছে আমাকে। অত্যন্ত অন্যায় কাজ আমাকে দেশ থেকে তাড়ানো। পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়েছে আমার বিরুদ্ধে লক্ষ লোকের মিছিল হয়েছে বলে? না, হায়দারাবাদে আমাকে কটা মৌলবাদী আক্রমণ করেছিল বলে, আর পার্ক সার্কাসের গলি থেকে কয়েকশ মানুষ বেরিয়ে বদমাইশি করেছিল বলে। প্রায় কিছু না ঘটতেই শাস্তি দেওয়া। হল আমাকে, মশা মারতে কামান দাগানোও হল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে জন্মের মতো আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। রাজনীতিকরা মুহুর্মুহু অন্যায় করেন, প্রায় সব দেশেই। কিন্তু সুস্থ সচেতন মুক্তচিন্তক বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করেন অন্যায়ের। বাংলার বেলায় উল্টো। পুরোনো আমলের রাজকবিদের মতো আজকালকার সাহিত্যিকরা রাজার বদ মাইশিতে মাথা নেড়ে সায় দেন। বিবেক লোপ পেয়েছে বাঙালির। শুধু দুটো পয়সা, দুটো পুরস্কারএর লোভে নিজের সম্মান, মান, মর্যাদা, বোধবুদ্ধি বিক্রি করে দিতে দ্বিধা করেন না। রাজনীতিকদের চরিত্র নষ্ট হলে কোনও সমাজ নষ্ট হয় না, সমাজ নষ্ট হয় যখন শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র নষ্ট হয়।