বিজয় উৎসব করার বাংলাদেশের কোনও প্রয়োজন আছে কি? আমার কিন্তু মনে হয় না। আসলে ঠিক কিসের বিরুদ্ধে বিজয়? পাকিস্তান আর বাংলাদেশের নীতি আর আদর্শ তো এক! সত্যিকার বিরোধ বলে কি কিছু আছে আর? পাকিস্তানের ওপর নয়, বরং বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের রাগ একাত্তরের মিত্রশক্তি ভারতের ওপর। বিজয় দিবস করে খামোকাই নিজের সঙ্গে প্রতারণা না করলেই কি নয়! ১৬ ডিসেম্ব রে নয়, বাংলাদেশ বরং ১৪ই আগস্টে উৎসব করুক। পাকিস্তানের জন্মোৎসব করুক ঘটা করে। পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে মিশে রীতিমত জাঁকালো উৎসব। মুসলমানের উৎসব। বিধর্মীদের থেকে মুসলমানদের আলাদা করার ঐতিহাসিক উৎসব। বিজয় উৎসব।
বাঙালি নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই
পৃথিবীর এত জায়গায় বাঙালির উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছিল পৃথিবীর সর্বত্র বুঝি বাঙালি আছে। আইসল্যাণ্ডে বাঙালি আছে কি না জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার আইস ল্যাণ্ডের প্রকাশককে। বলেছিলেন, নেই। সে বহুকাল আগের কথা। এর মধ্যে হয়তো বসত শুরু করে দিয়েছে। ইওরোপ আমেরিকায় প্রচুর বাঙালি। যে করেই হোক পাঁচিল টপকেছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ লোকেরা লটারি জিতে, নয়তো নানারকম ফন্দি ফিকির করে হাজির হয় বিদেশে, তারপর অবৈধ ভাবে বছরের পর বছর থেকে যেতে যেতে একসময় বৈধের ছাড়পত্র জুটিয়ে ফেলে। ভারতের বাঙালিদের রাজনৈতিক আশ্রয় জোটে না, যেহেতু দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো রাজনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি তারা হয়না। মূলত পড়াশোনার উদ্দেশ্যে যায় বিদেশে, বা কোনও কাজ নিয়ে, তারপর আর দেশে ফেরে না, পাকাপাকিভাবে বাস করতে থাকে বিদেশে। ভারতের বাঙালিরা নিজেদের বলে, ভারতীয়। আর বাংলাদেশের বাঙালিরা নিজেদের বলে, বাঙালি। দুই অঞ্চলের বাঙালিতে মেশামেশির চল নেই। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে যা হয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ বাঙালি তুলনামূলকভাবে গরিব, শ্রমিক শ্রেণীর লোক। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বেশির ভাগই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, ভালো চাকরি করা বা ব্যবসা করা লোক। টাকা পয়সা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির পকেটে ঢের বেশি। তবে দুই বাঙালিই একইরকম কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ঘটা করে পুজো আঠা,ঈদ রোজা কায় কেউ কারও চেয়ে কম যায় না। অবিজ্ঞান, অন্ধত্ব, অজ্ঞতা দ্বারা কারা বেশি আচ্ছন্ন, এসবের বিচার হলে দুদলেরই একশয় একশ নম্বর জোটে।
বাঙালি কবি সাহিত্যকরা হামেশাই বাঙালির পরব উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে বিদেশ যান। আমিও যাই খুব, তবে বিদেশি সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, মানবাধিকার গোষ্ঠী বা সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা আমন্ত্রিত হয়ে। একবারই জীবনে বাঙালির আমন্ত্রণে, প্রথমে কিছুতেই রাজি না হয়ে, শেষে সম্মেলনের কর্তারা হাতে পায়ে ধরায় নিমরাজি হয়ে, গিয়েছিলাম। বঙ্গ সম্মেলনে। নিউইয়র্কের মেডিসন স্কোয়ারে অনুষ্ঠান হল। পনেরো হাজার বাঙালি হিন্দু বুড়ো বুড়ি, মধ্যবয়সী, কাচ্চা বাচ্চা। দেশের গান-বাজনা শুনতে এসেছে, দেশি নাচ দেখতে এসেছে, সেখানে পড়লাম কি-না কবিতা আমেরিকার বিদেশ নীতির সমালোচনা করে। এক দল চিৎকার করে উঠলো, তারা আমেরিকার সমালোচনা শুনতে চায় না, আমেরিকা তাদের খাওয়ায় পরায়, আমেরিকা ইরাকে আফগানিস্তানে যা করছে, উচিত কাজ করছে, মুসলমানদের মেরে শেষ করে দেওয়াই উচিত। ব্যস। আমাকে মঞ্চ থেকে নেমে পড়তে হল কবিতা শেষ না করেই। বাঙালি সভ্য শিক্ষিত দেশে বাস করছে, কিন্তু মন মানসিকতা উন্নত হচ্ছে কি না, ছোট একটা হুগলি, বা কলকাতা বা দুর্গাপুর বানিয়ে ওরা বেশ দিব্যি আছে। ভুতের মতো টাকা রোজগার করো, পছন্দের রাজনৈতিক দলকে টাকা পাঠাও, দেখে শুনে একটা অ্যাপ টমেন্ট কিনে দরজায় তালা লাগিয়ে চলে এসো, বছরে একবার দেশ থেকে ঘুরে এসো, আর এদিকে ও বড় গাড়ি কিনেছে তো ওকে আরও বড় গাড়ি কিনে দেখিয়ে দাও। মুক্ত চিন্তার চর্চা? নৈব নৈব চ। আজকাল দেখি বাঙালি লেখক শিল্পীরা, চাঁদা তুলে বিদেশের বাঙালিরা ঘরোয়া যেসব অনুষ্ঠান করে, ওসবে গান গেয়ে বা কবিতা পড়ে চাঁদার কিছু ভাগ নিজের পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়ে এসে নিজেদের নামের আগে বেশ আন্তর্জাতিক শব্দটা লাগিয়ে ফেলেন, নয়তো নামের শেষে বিদেশ ফেরত।
ইওরোপ আমেরিকায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা সদাই মুখিয়ে থাকে সাহেবদের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য। ওদিকে বাংলাদেশের বাঙালির জীবনে সাহেবদের আনাগোনা একেবারে নেই বললেই চলে। সাদা কারও সঙ্গে ওঠাবসা যদি থাকে, সে শ্রমিক শ্রেণীর সাদা। ট্যাক্সি চালাচ্ছে, পান বিড়ির দোকান শুরু করেছে, ভাত মাছের দোকান বা দেশ থেকে আসা মুড়ি, মশলা, তেল, শুঁটকি, পটল কুমড়ো, আর বরফ-মাছের দোকান। দিয়েছে, নয়তো রাস্তায় ফুল ফল বিক্রি করছে। এগুলোর বাইরে যে জীবন নেই তা নয়। অনেক বাংলাদেশের বাঙালি খেটে খুটে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও হয়েছে, বিরাট ধনীও হয়েছে। বাংলাদেশের বড়লোক বাঙালিরা তাদের ছেলেমেয়েদের আজকাল বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পাঠায়। শ্রমিক শ্রেণীর বাঙালির কেউ কেউ আবার পত্রিকা ছাপাচ্ছে। এক নিউইয়র্কেই তো দশ বারোটা বাংলা দৈনিক। সবগুলোর মালিক আর সম্পাদক বাংলাদেশের বাঙালি। বেশির ভাগই অর্ধশিক্ষিত। সব পত্রিকার চুলের। ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বাংলাদেশের পত্রিকার খবরগুলোর পুনর্মুদ্রণ। এসব বাং লা-পত্রিকা ব্যবসায় কলকাতার বাঙালি নেই। তারা বাঙালির চেয়েও বেশি ইণ্ডিয়ান। নিজের বাঙালি পরিচয় নিয়ে অনেকেরই বড় কুণ্ঠা। গৌতম দত্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বিদেশে গিয়েছে, কবিতা লেখার বিস্তর চেষ্টা করে। সে তার নিজের নাম পাল্টে গ্যারি ডাট রেখেছে। এ নাম নাকি বিদেশিদের পক্ষে উচ্চারণ করা সুবিধে। সাদা আমেরিকানদের সুবিধে হবে এমন কিছুর জন্য অনেকে নিজের সত্যিকার না মটাকেই বিসর্জন দিয়ে দেয়। আমার বোনের মেয়ের নাম রেখেছিলাম স্রোতস্বিনী ভালোবাসা। সে তার নামটাকে ঘৃণা করে, কারণ বিদেশিদের নাকি তার নাম উচ্চারণ করতে কষ্ট হয়। এখন সে নিজের নাম রেখেছে আশা, ওদের সুবিধের জন্য। ওদের মধ্যে কেউ কি বাঙালির উচ্চারণের সুবিধের কথা ভেবে নিজের নাম পাল্টে ফেলেছে? না, এরকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুনিনি।