এই ধর্মান্ধদের দুধ কলাখাইয়ে বড় করেছে দেশের ধুরন্ধর রাজনীতিকরা। কাউকে কাউকে তো সংসদ সদস্য, এমনকী মন্ত্রীও বানিয়েছিল। আমি ইসলাম ধ্বংস করে ফেলেছি অথবা ফেলবো, ঠিক এরকম একটা অবস্থায় নাকি ছিল ইসলাম। এক গরিব দেশের এক নিরীহ গোবেচারা মেয়ে, ডাক্তারি করে, আর মাঝে মাঝে লেখালেখি করে, সে নাকি ১৪০০ বছর ধরে টিকে থাকা কোটি কোটি লোকের অন্ধত্বকে কলমের একটা খোঁচা মেরে দূর করে দিয়েছে! এই ক্ষমতাটা যদি সত্যিই আমার থাকতো, আমার চেয়ে সুখী কেউ হতো না।
আমার বিরুদ্ধে বিরাট বিরাট মিছিল, লং মার্চ, সভা, হরতাল নির্বিঘ্নে হয়েছে। না বাধা দিয়েছে সরকার, না আপত্তি করেছে বুদ্ধিজীবীরা। সেদিন যদি একশটা লোকও আমার পক্ষে মুখ খুলতে, আমার পাশে দাঁড়াতো, আমাকে নির্বাসনদণ্ড দিতে পারতো না সরকার।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখছি। এখন নাস্তিক ব্লগারদের ধরে ধরে জবাই করছে। ধর্মের খুনীরা। বুদ্ধিজীবীরা কি ওদের নাস্তিকতা অস্বীকার করে বলবেন তওবা তওবা ওরা নাস্তিক নয়, নাকি সেই আগের মতো বলবেন, এসব নাস্তিকদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, ওদের ঝামেলা ওরাই সামলাক! ইতিহাস থেকে যদি শিক্ষা নিতে হয়, এখনই সময়। বুদ্ধিজীবীদের স্বার্থপরতা, ঈর্ষার শিকার আমি হয়েছি। মুক্তচিন্তক এই তরুণ ব্লগারদের যেন না হতে হয়। আজ দেশের মানুষের মুখ বুজে থাকা অথবা ধর্মব্যবসায়ীদের লম্ফঝম্ফের দোষ নাস্তিকদের দেওয়া মানে দেশের একশ বছর পেছনে ঠেলে দেওয়া। আমাকে তাড়িয়ে যেমন দেশকে একশ বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। হয়নি? না হলে আশির দশকে জাতীয় পত্র-পত্রিকায় ধর্মের এবং মুহম্মদের অবাধ সমালোচনা করে যে লেখাগুলো আমি লিখেছি, তাতে এক নদী জল মিশিয়ে তরল করলেও আজ সেসব লেখা ছাপানোর কল্পনা অবধি কেউ করতে পারে না কেন? ধর্মের সমালোচনা না করে তুমি সভ্য হতে চাও? এই বিজ্ঞানের যুগে ধর্মের মতো আজগুবি রূপকথাকে সত্য বলে মেনে, স্বঘোষিত সব ঠগবাজ পয়গম্বরকে পথ প্রদর্শক বলে মেনে তুমি কচু সভ্য হবে। তোমার সভ্য হওয়া চুলোয় যাক, ইসলা মের আসল চেহারা চোখ খুলে যারা দেখতে পেয়েছে, যারা বেরিয়ে এসেছে, সেই আলোকিত তরুণ তরুণীদের গায়ে যদি আঁচড় লাগে আজ, এর দায় ওই চোখ বন্ধ করে রাখা অন্ধদের চেয়েও বেশি সব বুঝেও না বোঝার ভান করা বুদ্ধিজীবীদের, অদূরদর্শী রাজনীতিকদের আর ক্ষমতার আসনে বসা এক পাল মুই যেন কী হনুরে দের।
বাংলাদেশের বিজয় দিবস
আজ ১৬ই ডিসেম্বর। বাংলাদেশের বিজয় দিবস।
১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নমাস যুদ্ধ করে জিতেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। ভারত সাহায্য করেছিল যুদ্ধে জিততে। ওই সা হায্যটা না করলে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব হত বলে আমার মনে হয় না। বাংলাদেশের জন্ম আমাদের বুঝিয়েছিল, ভারত ভাগ যাঁরা করেছিলেন, দূরদৃষ্টির তাঁদের খুব অভাব ছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই, হোক না তারা বাস করছে হাজার মাইল দূরে, হোক না তাদের ভাষা আর সংস্কৃতি আলাদা, যেহেতু ধর্মটা এক, বিরোধটা হবে না। ভূল ভাবনা। ভারত ভাগ হওয়ার পর পরই বিরোধ শুরু হয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শোষণ করতে শুরু করলো পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের। নিজেদের ভাষাও চাপিয়ে দিতে চাইলো। আরবের ধনী মুসলমানরা যেমন এশিয়া বা আফ্রিকার গরীব মুসলমানদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, মানুষ বলে মনে করে না, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা ঠিক তেমন করতো, বাঙা লিদের মানুষ বলে মনে করতো না। পূর্ব পাকিস্তান ফসল ফলাতো, খেতো পশ্চিম পাকিস্তান। পুবের ব্যবসাটা বাণিজ্যটা ফলটা সুফলটা পশ্চিমের পেটে। এ কদিন আর সয়! মুসলমানে মুসলমানে যুদ্ধ হল। শেষে, বাঙালি একটা দেশ পেলো। ভীষণ আবেগে দেশটাকে একেবারে ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ইত্যাদি চমৎকার শব্দে ভূষিত করলো। কজন মানুষ ওই শব্দগুলোর মানে বুঝতো তখন? এখনই বা কতজন বোঝে? বোঝেনি বলেই তো চল্লিশ বছরের মধ্যেই দেশটা একটা ছোটখাটো পাকিস্তান হয়ে বসে আছে। ইসলামে থিকথিক করছে দেশ। টুপিতে দাড়িতে, হিজাবে বোরখায়, মসজিদে মাজারে চারদিক ছেয়ে গেছে। মানুষ সামনে এগোয়, বাংলাদেশ পিছোলো। চল্লিশ বছরে যা পার্থক্য ছিল বাংলাদেশে আর পাকিস্তানে, তার প্রায় সবই ঘুচিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমান তালে মৌলবাদের চাষ হচ্ছে দুদেশের মাটিতে। বাংলাদেশ মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রমাণ করতে, যে, মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যাপারটা ভুল ছিল না, ঠিকই ছিল। দেশের সংবিধান বদলে গেছে। পাকিস্তানি সেনাদের আদেশে উপদেশে যে বাঙালিরা বাঙালির গলা কাটতো একা ত্তরে, পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চায়নি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খুব বেশি বছর যায়নি, দেশের তারা মন্ত্রী হয়েছে, দেশ চালিয়েছে। আমার মতো গণতন্ত্রে সমাজতন্ত্রে সমতায় সততায় বিশ্বাসী একজন লেখককে দেশ থেকে দিব্যি তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কিছু ধর্মীয় মৌলবাদীকে খুশি করার জন্য। যারা তাড়ালো, যারা আজও দেশে ঢুকতে দিচ্ছে নাআমাকে, সেই রাষ্ট্রনায়িকারা ওপরে যা-ই বলুক, ভেতরে ভেতরে নিজেরাও কিন্তু মৌলবাদী কম নয়।