দেশটার কথা ভাবলে সব কিছু মিলিয়ে ঘেন্না ছাড়া আর কিছুর উদ্রেক হত না আমার। এমন সময় একদিন দেখি কিছু লোক টুইটারে আমাকে বাংলাদেশের খবর দিচ্ছে। ঢাকার শাহবাগে লোক জমায়েত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাইছে, খবরটি জানি কি না জানতেও চাইল কেউ কেউ। উত্তর দিইনি। বাংলাদেশে আমার উৎসাহ নেই, ফাঁসিতেও নেই। ওই দেশে কারও ফাঁসি চাওয়া হচ্ছে শুনলে মনে পড়ে তিরানব্বই-চুরান্নবই সালে কী করে লক্ষ লোকের জমায়েত হত শহরে, মিছিল হত, আমার ফাঁসি চাওয়া হত। সেই সব ভয়ংকর দিনগুলোর কথা ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না? কেউ আমার ভেতরে এক ফোঁটা আগ্রহ তৈরি করতে পারেনি শাহবাগের জনসমাগম নিয়ে। মিশরের তাহরির স্কোয়ারেও লক্ষ লোক জমেছিল, ওরা ভোট দিয়ে মুসলিম মৌলবাদীদের জিতিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে– মানেই মৌলবাদের বিরুদ্ধে নয়। আর মৌলবাদের বিরুদ্ধে– মানেই ধর্ম নিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজমের পক্ষে নয়, ধর্মভিত্তিক আইন তুলে দেওয়ার পক্ষে নয়। বাংলাদেশের আন্দোলন নিয়ে কিছু লিখছি না বলে কেউ কেউ আমাকে আবার তিরস্কারও করতে শুরু করে। কারো অনুযোগে অভিযোগে তিরস্কারে আমার কিছু যায় আসে না। নতুন প্রজন্ম, যারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাইছে, তারা কী করবে ফাঁসি দেওয়া হয়ে গেলে, শুনি? এই প্রশ্নের ভালো কোনও উত্তর পাইনা কারও কাছ থেকে। চল্লিশ বছর আগে কিছু লোক কিছু দোষ করেছিল, কিছু লোককে মেরেছিল, কিছু মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল, তার প্রতিশোধ নেবে নতুন প্রজন্ম। আসলে লেখক শিল্পীদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত লিখেছে, ছবি বানিয়েছে, নাটক করেছে, যে, বাংলাদেশের আজকালকার ছেলেমেয়েরা দুনিয়ার নব্বইভাগ ইতিহাস না জানলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা ভালো জানে।
আমার আগ্রহ সৃষ্টি হল সেদিন, যেদিন শাহবাগের কয়েকজনকে দেখলাম, জামাতি ইসলামি দলটির নিষিদ্ধকরণ চাইছে। আমি সমর্থন করে লিখলাম। যদিও আমি সব রকম নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে, কিন্তু এই নিষিদ্ধকরণ মেনে নেওয়ার কারণ, জামাতি ইসলামি কাগজে কলমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল হলেও এটি মূলত একটি সন্ত্রাসী দল। কাউকে পছন্দ হল না তো মেরে কেটে পঙ্গু বানিয়ে রাখলো, কারও মত তাদের মতের থেকে ভিন্ন হলে জবাই করে ফেলো, ধর্মের নামে বহু বছর যাবৎ যা খুশি করছে ওরা। ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠছে আজকাল।
লিখবো না লিখবো না করেও অনেকগুলো ব্লগ লেখা হয়ে গেল শাহবাগ নিয়ে। এই লেখাগুলোর প্রথম দিকে হতাশা থাকলেও ধীরে ধীরে আশা এসেছে। স্বপ্ন এসে চমৎকার সাজিয়েছে ঘরদোর। কিন্তু দিন দিন যে সব খবর পাচ্ছি, তাতে মনে হয় না বাংলাদেশের ধর্মমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে অদুর ভবিষ্যতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবেন কথা দিয়েছেন, কিন্তু রাষ্ট্রকে ধর্মের কবল থেকে মুক্ত করার তাঁর কোনও ইচ্ছে আছে বলে মনে হয় না। জামাতি ইসলামির সন্ত্রাসীরা মুক্তচিন্তক তরুণ তরুণীদের গলা কাটছে, আর ওই কূপমণ্ডুকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টে দেশের প্রধানমন্ত্রী মুক্তচিন্তকদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন শাস্তি দেবেন বলে। ইতিমধ্যেই ওদের ব্লগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কেউ যেন না পড়তে পারে ইসলাম বা মুহম্মদের সমালোচনা। অশিক্ষিত ধর্মব্যবসায়ীদের মতো প্রধানমন্ত্রীও ধর্মব্যবসায় মাতেন, দেখতে বড় বিচ্ছিরি লাগে। ঘেন্না লাগে।
আমার বেলাতেও ঠিক এমন করেছিলেন খালেদা জিয়া নামের আরেক প্রধানম স্ত্রী। দেশ জুড়ে ধর্মীয় মৌলবাদীরা তাণ্ডব করছে আমাকে ফাঁসি দেবে বলে, আর প্র ধানমন্ত্রী ওই কূপমণ্ডুকদের খুশি করতে আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করলেন, আমাকে শাস্তি দিলেন, দেশ থেকে আমাকে বের করে দিলেন, আমার বই নিষিদ্ধ করলেন। আজ কুড়ি বছর পর সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এক রানি গিয়ে আরেক রানি আসে, এক রাজা গিয়ে আরেক রাজা আসে। তবে সব রানিরই, সব রাজারই চরিত্র এক। এঁরা আর যার ভালো চান, দেশের ভালো চান না। দেশের ভালো চাইলে দেশকে ধর্মের বিষ গিলিয়ে এঁরা দেশের সর্বনাশ করতেন না।
বাংলাদেশ ২
আজ বাংলাদেশে নাস্তিক ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের শাস্তির দাবীতে লং মার্চ ডাকছে এক পাল মুখ আর এক পাল খুনী।
ঠিক এরাই অথবা এদের বাপ দাদারা ২০ বছর আগে একই রকম লং মার্চ ডেকেছিল আমার শাস্তির দাবিতে, সারা দেশ থেকে লোক এসেছিল মানিকমিয়া এভি ন্যতে, তিন লক্ষ লোকের সভা। কী চাই? তসলিমার ফাঁসি চাই। তসলিমা নাস্তিক। ওর ফাঁসি না হলে ইসলাম বাঁচবে না। দেশ জুড়ে কী ভীষণ তাণ্ডব চালিয়েছিল এরা। আর এদের সঙ্গে তাল মিলিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসা চরম এক মূর্খ মহিলা। মুখদের কলে দেশ পড়লে এ-ই হয়, যা হয়েছে আজ দেশ।
বেশির ভাগ শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী বিদ্বজ্জন তখন কী করেছেন? দূর থেকে দেখেছেন আমার ওপর আক্রমণ হচ্ছে। হয় মুখ বুজে থেকেছেন নয়তো বলেছেন, এসব তসলিমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
সারাদেশের ধর্মান্ধরা আমাকে জবাই করতে আসছে আমার লেখা পছন্দ হয় না বলে। আর এ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার? গুণীজনদের বক্তব্য, দেশে কোনও মৌলবাদী নেই। আমি নাকি ইচ্ছে করেই ঝামেলা পাকিয়েছি। আমার ঝামেলা আমাকেই সামলাতে হবে, সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না।