কলকাতায় আমি তখন পাকাপাকিভাবে বাস করছি। একসময় আমার সঙ্গে সখ্য থাকলেও বই নিষিদ্ধ করার পর রীতিমত ব্রাহ্মণের মতো আচরণ শুরু করলেন, আমার মতোনমশুদ্রর ছায়াও আর মাড়ালেন না। বই মুক্তির পর তো আরও নয়। ভেবেছিলাম বুদ্ধবাবু হয়তো একদিন নিজের ভুল বুঝতে পারবেন। কিন্তু ভুল ভাবনা। হায়দারা বাদি মুসলিম মৌলবাদীরা আমায় আক্রমণ করার পরদিন থেকেই তিনি নতুন নকশা আঁকতে শুরু করেছিলেন। আমি জানিনা সেই নকশা আঁকায় মোট কজন বুদ্ধিজীবী তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি নিরীহ, নির্যাতিত, নির্বাসিত মানুষ। রাজনীতির প্যাঁচ কোনওদিনই ঠিক বুঝতে পারি না। ২০০৭-এর আগস্টে আক্রান্ত হলাম, সেই আগস্টেই কলকাতার মৌলবাদী নেতারা হায়দারাবাদের মৌলবাদী নেতাদের ডেকে এনে কলকাতার ধর্মতলায় রাস্তা বন্ধ করে বিশাল এক জনসভা করলেন, আমার মাথার দাম ঘোষণা করার জনসভা। কেউ আমার মাথাটা কেটে নিয়ে গেলে তাকে আনলিমিটেড অ্যামাউন্ট টাকা দেওয়া হবে। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন পুলিশের বড় কর্মকর্তারা। সেদিনের সেই মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের কাউকে বেআইনি ফতোয়া জারি করার জন্য গ্রেপ্তার করা তো হয়ইনি, বরং বেশ সম্মানই করা হয়েছিল। তখন থেকেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পুলিশের বড় বড় কর্তাদের পাঠাতে শুরু করলেন আমার বাড়িতে, কী, কলকাতা থেকে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে, পারলে দেশ থেকে আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে। কেন বেরোতে হবে? আমি কলকাতায় বাস করলে কলকাতার মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, তাই।
এদিকে নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর আর রিজওয়ান নিয়ে রাজ্যে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। মুসল মানরা সিপিআইএমএর ওপর ক্ষেপে আগুন হয়ে আছে। নভেম্বরের একুশ তারিখে পার্ক সার্কাসের গলি থেকে কিছু লোক বেরিয়ে গাড়ি পোড়াতে শুরু করলো, পুলিশকে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করলো। কেন রাগ? নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরে মুসলমান মেরেছো কেন, রিজওয়া নকে মেরেছো কেন, তাই রাগ। হঠাৎ সারাদিন পর কে একটা হাতে লেখা একটা কাগজ উঁচু করে ধরলো, ওতে লেখা তসলিমা গো ব্যাক। ব্যস, আমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল জয়পুর। টিকিট মুখ্যমন্ত্রী আগেই কেটে রেখেছিলেন। ওয়ান ওয়ে টিকিট। তারপর শত চেষ্টা করেও আর পশ্চিমবঙ্গে পা দিতে পারিনি। আমার বাড়ি ঘর, বেড়াল, বন্ধু– সব কলকাতায়। বাংলাদেশ থেকেও আমাকে তাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়ানোটা বাংলাদেশের চেয়েও নিষ্ঠুর আর মর্মান্তিক। আজও পশ্চিম বঙ্গের ত্রিসীমানায় যাওয়া আমার জন্য নিষিদ্ধ। মমতা বন্দোপাধ্যায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কোনও কিছু না মানলেও এটা মানেন যে তসলিমার জায়গা পশ্চিমবঙ্গে নেই। আমার ক্ষেত্রে তিনি বুদ্ধদেবের পদাঙ্ক খুব নিখুঁতভাবে অনুসরণ করে চলেছেন।
রুশদিকে একবেলার জন্য কলকাতায় আসতে না দেওয়ার পেছনে ওই একই কারণ। রাজ্য নষ্ট হয়ে গেছে। রাজ্য নষ্ট করার জন্য দায়ী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি যদি সেদিন আমার বই নিষিদ্ধ না করতেন, আমাকে জন্মের মতো না তাড়াতেন আমার কলকাতার বাড়িঘর থেকে, তাহলে আজ নিশ্চিতই রুশদি কলকাতায় যেতে পারতেন। তাঁর ওই একদিনের অনুষ্ঠানে কলকাতা ভ্রমণে কোনও বাধা আসতো না।
বুদ্ধবাবুই মৌলবাদীকে শক্তি এবং সাহস জুগিয়েছেন। আজ তারা তাই এয়ারপোর্ট অবধি চলে যেতে পারে এবং একইভাবে ওই রকম কাগজ নিয়ে, রুশদি গো ব্যাক। কারণ তারা জেনে গেছে, তারা যা চায়, তাই তাদের পাইয়ে দেওয়া হয়। এবং অনেক ক্ষেত্রে চাওয়ার আগেই প্রাপ্তি চলে আসে। আজ যে বুদ্ধবাবু বলছেন তিনি রুশদিকে আসতে দিতেন ক্ষমতায় থাকলে। মিথ্যে কথা। অথবা দিতে চাইলেও তার মৌলবাদী ফ্রাংকেনস্টাইন রুশদিকে সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দিত, রায়ট বাধাতো। ওই ফ্রাংকেনস্টা ইনই যেমন বুদ্ধবাবু-সহ তাঁর পুরো দলকে ভোটে হারিয়েছে, তসলিমাকে তাড়িয়ে একটি বাড়তি ভোটও যেমন জোটেনি, ঠিক তেমনই হত।
আজ শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখছি অসহিষ্ণুতা। কা শ্মীরের মুফতি ফতোয়া দিলেন মেয়েরা গান গাইতে পারবে না। তামিলনাড়ুতে কমল হাসানের ছবি দেখানো চলবে না। আর্ট গ্যালারিতে নড় ছবি রাখা যাবে না। অসহিষ্ণ তাকে প্রশ্রয় দিতে দিতে এমন হয়েছে যে অসহিষ্ণুতা এখন মাথায় উঠে বসেছে। একবার যদি মাথায় উঠতে দিয়েছো, একবার যদি আপোস করেছো বর্বরতার সঙ্গে, তাহলে বাকি জীবন আপোস করে যেতেই হবে। বর্বরতা এমনই জিনিস, একবার একে মাথায় উঠতে দিলে আর নামাতে পারবে না। দোষ বর্বরতার নয়, দোষ তোমার, বর্বরতাকে তুমি জেনে শুনেই ডেকে এনেছো। জেনে শুনে তুমিই বিষ পান করেছে। এখন মৃত্যুর সময় অন্তত নিজের ভুলগুলো স্বীকার করো।
বাংলাদেশ ১
কুড়ি বছরের নির্বাসিত জীবনে দেশের খুব একটা খবর রাখিনি, দুএকজন আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কদাচিৎ কথা হতো। রাজনীতির খবরে মোটেও উৎসাহ ছিল না আমার। বাবা মা মারা যাওয়ার পর ব্যক্তিগত যোগাযোগও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ ক্রমে ক্রমে একটা দূরের দেশে পরিণত হয়। দেশে যে বাড়ি ঘর ছিল আমার, ফেলে আসা জিনিসপত্তর, ওসবেরও আর কোনও খবরাখবর পরিবারের কেউ আমাকে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ওই দেশ, ওই সমাজ, ওই পরিবারের প্রতি বিবমিষা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। আমার এত যে গুণমুগ্ধ পাঠক পাঠিকা, প্রকাশক, সম্পাদক, তাদের চিহ্ন এই কুড়ি বছরে, সত্যি বলতে কী, দেখতে পাইনি। প্রকাশক রয়্যালটি দেয় না, জাল বইয়ে বাজার ছেয়ে থাকে, একের পর এক সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করছে, এসবের প্রতিবাদও কেউ করেনি। সম্পাদকরা ঘুরতো লেখা চাইতে, তাদেরও আর টিকিটি দেখিনি। সরকার আমাকে তাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশ যেন মুহূর্তে সরকারের গোলাম বনে গেল। সরকার যাকে পছন্দ করছে না, তাকে পছন্দ করার কোনও অধিকার তখন যেন আর কারোর নেই। এমন ভণ্ড ভীতু সমাজ আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। বছর বছর সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি, দেশে ফিরতে চাই, মার অসুখ, বাবার অসুখ। কিছুতেই বর্বর সরকারগুলোর সায় পাইনি। আমার জন্য দেশের দরজা বন্ধ। যেন দরজাটা ওদের বাপের সম্পত্তি। হঠাৎ হঠাৎ বাংলাদেশের পত্রিকায় বিকৃত করে আমার ভুল ভাল খবর ছাপাহত। পত্র পত্রিকাগুলো গত কুড়ি বছরে আমাকে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা তো কম করেনি। কিন্তু বিকৃত করে ছাপানো খবরগুলো যে কোনও কারণেই হোক বন্ধ করেনি, সম্ভবত যারা ভুলছে না। আমাকে, তারা যেন ঘৃণাটা অন্তত করতে পারে, সেকারণে। সেই হঠাৎ হঠাৎ খবর গুলোর তলায় দেখতে পেতাম মানুষের, বিশেষ করে নতুন ছেলেমেয়েদের মন্তব্য। নোংরা কুৎসিত সব মন্তব্য। পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতো। এখনকার তরুণ তরুণী জঘন্য ভাষায় গালাগালি করছে আমাকে, আমাকে না পড়েই, না বিচার করেই, না ভেবেই! এরা কি চেনে আমাকে? জানে আমাকে? আমার লেখা কোনওদিন পড়েছে? না, এরা কারও লেখা পড়ে না। এরা হয়তো কোনও বদমাশদের মুখে আমার নাম শুনেছে, আর বদনাম শুনেছে। এরাই দেশের ভবিষ্যৎ, এরাই নতুন প্রজন্ম। এক গাদা অন্ধত্ব, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, মুখতা, নির্বুদ্ধিতাই শুধু দেখলাম। ঘেন্না লাগলো। হ্যাঁ ঘেন্না। একটিও প্রাণী নেই, যার বোধ বুদ্ধি আছে, বিবেক আছে? সেই লক্ষ লক্ষ লোক কোথায় যারা গোগ্রাসে আমার বই পড়তো, আমার লেখা ভালোবাসতো? সেই সব লেখকই বা কোথায়, যারা আমার লেখার হুবহু নকল করে নারীবাদী লেখা শুরু করেছে বাংলাদেশে? সবাই হাওয়ায় উবে গেছে, শুধু জ্বলজ্বল করছে এক থোকা নতুন প্রজন্ম নামক অন্ধকার।