তরুণ তেজপাল নিশ্চয়ই স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে ভারতবর্ষে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর লোকের কোনও অভাব নেই। যৌন অপরাধ করার পরও তাঁর সমর্থক আর অনুরাগীর সংখ্যা কিছুমাত্র কমেনি। পুরুষ বলেই অবশ্য কমেনি। ধর্ষণের সঙ্গে পৌরুষের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। ধর্ষণ আইনের চোখে হয়তো অপরাধ, নারীবিরোধী সমাজের চোখে এখনও এটি অপরাধ নয়, এটি এখনও পুরুষের অধিকার। সে কারণেই তেজপালের বিরুদ্ধে সমাজের বড় নেতারা, বড় রাজনৈতিক দল, নারীবাদী বা মানবাধিকার গোষ্ঠী একযোগে প্রতিবাদী হচ্ছে না। তেজপাল বড় সাংবাদিক, বড় বুদ্ধিজীবী– এসব বলে বলে, তাঁর যৌন নির্যাতনের অপরাধকে একটু ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার জন্য যেন একরকম আহ্বান জানানোহচ্ছে। কিন্তু কথা হল, যে লোকেরা বিনা অনুমতিতে কোনও মেয়ের যৌনাঙ্গে আঙুল ঢোকাতে পারে, তারা কিন্তু কোনও একদিন জোর খাঁটিয়ে মেয়েদের যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢোকাতে পারে। কাকে বিশ্বাস করবে মেয়েরা?
ধর্ষণের বিরুদ্ধে ধর্ষিতাকে দোষ দেওয়ার প্রবণতা এখনও যায়নি। এখনও ধর্ষিতা মেয়েটিকেই প্রশ্ন করা হচ্ছে লিফটে একবার তেজপাল দ্বারা যৌন হেনস্থার শিকার হওয়ার পরও কেন ও তেজপালের সঙ্গেই দ্বিতীয়বার লিফটে চড়লো। এর কারণ তো খুব সহজ, মেয়েটা তার চাকরি বাঁচাতে চেয়েছে। ধর্ষিতা হয়ে নয়, ধর্ষিতা না হয়ে চাকরি বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। ধর্ষণের জন্য কোনও ধর্ষকের লিফটের দরকার হয় না। ধর্ষকরা সহজে ধরা পড়বে না এমন যে কোনও জায়গায় ধর্ষণ করে। যদি দ্বিতীয়বার মেয়েটি না চড়তো লিফটে, তাহলে কি তাকে দোষ দেওয়া হতো না? ঠিকই হতো, যারা তাকে আজ দোষ দিচ্ছে লিফটে চড়ার জন্য, তারাই বলতে কী ব্যাপার তেহেলকার সম্পাদক তোমাকে যৌন হেনস্থা করার পরও তুমি তেহেলকায় দিব্যি চাকরি করে যাচ্ছো, নিশ্চয়ই তোমার সায় ছিল ওই যৌন হেনস্থায়!
তেজপাল বেশ স্পষ্ট করেই তাঁর ইমেইলে লিখেছেন যে মেয়েটির অসম্মতি তেই মেয়েটির যৌনাঙ্গে তিনি আঙুল ঢুকিয়েছেন। ইমেইল প্রচারিত হওয়ার পরও মেয়েটিকে দোষী বানানো হচ্ছে। সমাজ, সত্যি বলতে কী, ভীষণরকম নারীবিদ্বেষী। এই সমাজে সব শ্রেণীর পুরুষেরাই সব শ্রেণীর মেয়েদের যৌনাঙ্গে যা ইচ্ছে তাই ঢুকিয়ে বিকৃত আনন্দ পায়, মেয়েদের এতে সায় আছে কী নেই, তা অনেকেই মনে করে না, দেখা সবার আগে প্রয়োজন। দিল্লি বাসের অসভ্য অশিক্ষিত সেই ধর্ষক দের সঙ্গে দিল্লির সভ্য শিক্ষিত তরুণ তেজপালের পার্থক্য খুব বেশি নেই। ওদের। মতো তরুণ তেজপালও মেয়েদের যৌনবস্তু হিসেবে মনে করেন। ঘূণী করতে হলে দিল্লি বাসের ধর্ষকদের চেয়ে তরুণ তেজপালকেই বেশি করা উচিত। কারণ তিনি জেনে বুঝে অপরাধটি করেছেন। দিল্লি বাসের ধর্ষকরা নারীবাদের ওপর কোনও বই পড়েনি। নারীরা যে মানুষ, নারীরা যে যৌন বস্তু নয়, এ তাদের কেউ শেখায়নি। কিন্তু তরুণ তেজপাল সব জেনেও, নারী-পুরুষের বৈষম্য যে কোনও সভ্য সমাজে থাকা উচিত নয়, পুরুষের যে অধিকার নেই নারীর বিনা অনুমতিতে নারীকে স্পর্শ করার, তা বুঝেও, জোর করে এক নারীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করতে চেয়েছেন। তরুণ তেজপালের নিশ্চিতই এক জ্ঞানপাপী।
এখনকার অফিসআদালতে তথাকথিত সভ্য শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা মেয়ে-সহক র্মীদের যৌন হেনস্থা করে চলেছে, এ সকলেই জানে, এ থেকে মেয়েদের বাঁচানোর জন্যও তেজপালের শাস্তি জরুরি। তেজপালের মতো অগুণতি যৌন হেনস্থাকারীর টনক নড়বে। বুঝবে. এত নিশ্চিন্তে হেনস্থা চালিয়ে যাওয়া যাবে না, ধরা পড়লে সর্বনাশ। অবশ্য আমরা সকলেই জানি যে, শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে কখনও কোনও অপরাধকে কমানো যায়নি সমাজে। আসলে তরুণ তেজপাল যে চোখে মেয়েদের যৌনবস্তু হিসেবে দেখেন, পুরুষের সেই দেখার চোখটা যতদিন পাকাপাকি ভাবে বন্ধ। না হয় বা অন্ধ না হয়, ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা ইত্যাদি কমবে না।
আমার আত্মজীবনীতে লিখেছিলাম, বাংলাদেশের বয়স্ক এক নামী লেখক আমাকে ছলে কৌশলে দূরের এক শহরে নিয়ে গিয়ে এক ঘরে ঘুমোবার ব্যবস্থা করেছিলেন। লেখকটি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন, এই আশঙ্কায় সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি। এই ঘটনা লেখার পর লোকে ওই লেখককে দোষ না দিয়ে আমাকে দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের এক বড় লেখকের যৌন হেনস্থা করার খবর যেদিন বলি, ওখানেও একই অবস্থা হয়েছিল। লোকে যৌন হেনস্থাকারী লেখককে দোষ না দিয়ে আমাকে দোষ দিয়েছিল। ওঁদের ছি ছি না করে আমাকে ছি ছি করেছিল। যেন ওঁরা কেউ নন, অন্যায়টা বা অপরাধটা আমি করেছি। জানি সাধারণ লোকেরা বড় লেখক বুদ্ধিজীবীদের দেবতা বলে মনে করে। তাঁদের পক্ষে যে কোনও দুঃসময়ে দাঁড়ায়। আমি নিজে কিন্তু বানের জলে ভেসে আসা মেয়ে নই, বা এক্স ওয়াই জেড নই। দেশ বিদেশের অনেক পুরস্কার পাওয়া জনপ্রিয় লেখক, কিন্তু যত বড় লেখকই আমি হই না কেন, আমি মেয়ে, আমি মেয়ে বলেই কেউ আমার পাশে দাঁড়ায়নি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেশিরভাগই লোকই বিশ্বাস করে যৌন হেনস্থা করার অধিকার পুরুষের আছে, এবং পুরুষের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করার অধিকার। কোনও মেয়ের নেই, বিশেষ করে সে পুরুষ যদি নামী দামী কোনও পুরুষ হয়। সমাজটা আসলে শুধু পুরুষের নয়, সমাজটা নারী বিদ্বেষী নারীবিরোধী পুরুষের।
বর্বরতাকে একবার প্রশ্রয় দিয়েছো কী মরেছো
রুশদিকে কলকাতায় আসতে দেওয়া হয়নি, এ নিয়ে মড়া-কান্না শুরু হয়ে গেছে চারদিকে। যারা এখন কেঁদে কেটে বুক ভাসাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই মুখ বুজে ছিল অথবা বই নিষেধাজ্ঞার পক্ষে কথা বলেছিল, যখন ২০০৩ সালে আমার দ্বিখণ্ডিত বইটি মুসলমা নদের অনুভূতিতে আঘাত লাগবে কারণ দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। মুসলমানরা রাস্তায় নামেনি, বই নিষিদ্ধ করার দাবি করেনি। কিন্তু তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আগ বাড়িয়ে বইটি নিষিদ্ধ করেছিলেন। তাঁর মাথা থেকেই বই নিষিদ্ধের কুবুদ্ধিটা বেরিয়েছিল। তিনি অবশ্য বলেছিলেন, ২৫ জন বুদ্ধিজীবী নাকি আমার দ্বিখণ্ডিত নিষিদ্ধ করার জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বোঝা উচিত ছিল, যারা লেখকের বই নিষিদ্ধ করার আবদার করেন, তারা আর যাই হোন না কেন, বুদ্ধিজীবী নন। বই নিষিদ্ধ করার পেছনে যে কারণগুলো দাঁড় করানো হয়েছিল, সেসব যে নেহাতই ভিত্তিহীন আর হাস্যকর, তা বই নিষিদ্ধ হওয়ার দুবছর পর কলকাতা হাইকোর্টই বলে দিয়েছে, বইটিকে মুক্তিও দিয়েছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কী দায় পড়েছিল মুসলমানদের মনের আঘাত বাঁচাতে গণতন্ত্রের সব চেয়ে বড় শর্ত বাক স্বাধীনতার ওপর খড়্গহস্ত হওয়ার?