আমার নির্বাসন ওঁদের চেয়ে আলাদা। মকবুল ফিদা হোসেনকে ভারত সরকার। দেশ থেকে বের করে দেয়নি। আমাকে বাংলাদেশ সরকার দেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং কুড়ি বছর হলো, আজো দেশে ফিরতে দিচ্ছে না। মকবুল ফিদা হোসেনকে উল্টে ভারত সরকার অনেক অনুরোধ করেছিল দেশে ফেরার জন্য। কিন্তু তিনি কাতারের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন, দেশে ফেরেননি।
১৫. আপনি বিয়ে বিরোধী। অথচ আপনি আগে বিয়ে করেছেন। তখন বোঝেননি বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের অসারতার কথা?
উত্তর: না। তখন বুঝিনি। তখন বুঝিনি বলেই তো বিয়ে করেছিলাম। আমি কি জন্ম থেকেই একজন সর্বজ্ঞানী মানুষ? আমি তো ঠকতে ঠকতে, সইতে সইতে, ভুগতে ভুগতে যা শেখার শিখেছি। অন্যের জীবন থেকেও শেখা যায়, অন্যের অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা অনেক শিখি। তবে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার কোনও তুলনা হয় না। বিয়ে করেছিলাম বলেই তো বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের অসারতা বুঝেছি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিয়েটা যে ভীষণ কুৎসিত একটা প্রভু দাসীর সম্পর্ককে মুখ বুজে বয়ে বেড়ানো, তা বিয়ে না করলে অত হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারতাম না। যে সমাজে নারীর সমানাধিকার আছে, সে সমাজে বিয়েটা কেউ করতে চাইলে করতেই পারে।
১৬. সংসার বলতে কী বোঝেন?
উত্তর: সংসার বলতে সংসারই বুঝি। চিরকাল আমি আমার একার সংসারই করেছি। আমার এখনকার সংসারটি আমার আর আমার বেড়ালের। আমি খুব সংসারী মানুষ। বাড়িঘর গোছানো, সাজানো, নিজে বাজার করা, বাগান করা, রান্নাবান্না করা, বন্ধুদের নেমন্তন্ন করা, হৈ চৈ করে খাওয়া, আড্ডা দেওয়া, এসব তো আছেই, আর যখন একা, নীরবতা শুয়ে থাকে পাশে, তখন ভাবি, লিখি, পড়ি। এই সময়টা আমার খুব প্রিয়। প্রিয় আরও এ কারণে, যে, আমার ভাবার, লেখার, পড়ার জন্য যে নৈঃশব্দ্য প্রয়োজন, যে নির্জনতা প্রয়োজন তা আমি চমৎকার পেয়ে যাই। কেউ চিৎকার করার। নেই, কোনও কিছু দাবি করার, আদেশ করার, উপদেশ দেওয়ার, ধমক দেওয়ার কেউ নেই। দাদাগিরি বা স্বামীগিরি দেখানোর কেউ নেই এখানে। এই না থাকাটা সংসারে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
সংসারটা হচ্ছে স্বাধীনতা আর নিরাপত্তা। এ দুটো যদি না থাকে, তবে সে সংসার সংসার নয়। শুধুই সন্ত্রাস।
১৭. শাহবাগ আন্দোলনকে কী চোখে দেখেন?
উত্তর: বিশাল এক ব্যাপার ঘটিয়েছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম। আমি তো রীতিমত মুগ্ধ। নো কান্ট্রি ফর উইমেন নামে যে ফ্রি হট ব্লগ লিখি আমি, ওতে অন্তত পনেরো ষোলোটা ব্লগ লিখেছি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সেকুলার আন্দোলন নিয়ে। বেশ কিছু বক্তৃতা ছিল আমার গত দুতিন মাসে, ইওরোপিয়ান পার্লামেন্টে, বেলজিয়ান পার্লামেন্টে, কানাডায়, ফ্রান্সে, আয়ারল্যাণ্ডে– এই আন্দোলন নিয়ে বলেছি। দেশ নিয়ে হতাশা ছাড়া আর কিছুই তো ছিল না। শাহবাগ একটু আশা জাগিয়েছে। একটা ট্রেণ্ড তৈরি তো হলো অন্তত। মানুষ দেখিয়ে দিল প্রয়োজনে লক্ষ লক্ষ লোক পথে নেমে ধর্মীয় বর্বরতার প্রতিবাদ করতে জানে। এর আগে তোমুখ বুজে থাকাটাই ছিল নিয়ম। কথা না বলাটাই ছিল রীতি। ভয় পাওয়াটাই ছিল সংস্কৃতি।
তবে শাহবাগ আন্দোলনের সবকিছুকেই যে একশয় একশ নম্বর দিয়েছি, তা নয়। আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। মৃত্যুদণ্ডের কোনও দাবি আমি মেনে নিইনি। তবে মৌলবাদ বিরোধী ওদের যে আন্দোলন, তা ভীষণভাবে সমর্থন করেছি।
১৮. আগামী প্রজন্মের কাছে কী হিসেবে চিহ্নিত হতে আপনার ভালো লাগবে? একজন লেখক হিসেব নাকি একজন অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে?
উত্তর: আগামী প্রজন্ম তো ভেড়া নয় যে সবাই এক পথেই যাবে। কারও কবি হিসেবে, কারও লেখক হিসেবে আমাকে ভালো লাগতে পারে, কারও অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে, কারও শুধু মানুষটাকে, তার আপোসহীন সংগ্রামটাকে হয়তো ভালো লাগবে, কারও কারও ভালো লাগবে তার সততা আর নিষ্ঠাকে। কত মানুষ কত রকম ভাবে চিহ্নিত করতে পারে আমাকে। কোনও লেখকই নয়, বলবে কেউ। কেউ কেউ চিহ্নিত করবে নাস্তিক হিসেবে। অথবা, হয়তো ভুলেই যাবে আমাকে। কী হবে ভবিষ্যতে তা নিয়ে আমি চিন্তিত নই মোটেও। আমাকে মনে রাখুক বা আমাকে ভুলে যাক, একই কথা। কবে যেন একটা কবিতা লিখেছিলাম, অমরত্ব নামে। অমরত্ব নেবে? অজস্র অমরত্ব আমার পড়ার টেবিলে, বইয়ের আলমারিতে, বিছানায়, বালিশের তলায়..ঘর থেকে বেরোলে অমরত্ব আমার ব্যাগে, আমার প্যান্টের পকেটে, আমার শাটে, চুলে.. কী করে কবে যে অমরত্ব আমার খোঁজ পেয়েছিল। অমরত্ব নেবে নাও, যত খুশি। অমরত্বের কাঁটা এমন বেঁধে যে সারারাত ঘুমোতে পারিনা। যতটুকু আছে সব কেউ নিয়ে নিলে কিছুটা নিস্তার পাই। অমরত্বে বিশ্বাস নেই আমার।
পয়লা বৈশাখের উৎসব দুই বাংলায় একই দিনে হোক
পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের উৎসব বেশি ঘটা করে হয়, কিন্তু উগ্রপন্থী বাঙালি মুসলমানরা বাংলাদেশ থেকে বাঙালি সংস্কৃতি প্রায় ধ্বংস করে দিয়ে আরবীয় সংস্কৃতি আমদানি করছে বলে ভবিষ্যতে আদৌ এই ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি উৎ সবটি বাংলাদেশে পালন করা সম্ভব হবে কি না আমার সন্দেহ। এমনিতে বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের তারিখ বদলে দিয়েছে এরশাদ সরকার। ১৪ই এপ্রিল তারিখটিতে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ পালন করার সরকারি আদেশ জারি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুরা যা পালন করছে, তা থেকে যেন একটু বদল হলেই মুসলমানিত্বটা ভালো বজায় থাকে। কী আর বলবো, মুখতার কোনও কুল কিনারা নেই! পাকিস্তানি শাসকরা চাইতো বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতিতে বিভেদ বাড়ুক। ওরা বিভেদ না বাড়াতে পারলেও বাংলাদেশে ওদের যে অনুসারীদের ওরা রেখে গেছে, তারাই বিভেদ বাড়াচ্ছে এখন। তারাই বাংলা ক্যালেণ্ডারকে মুসলমানের ক্যালেণ্ডার বানিয়েছে। বাংলা ক্যালেণ্ডারের পেছনে মোগল সম্রাট আকবরের অবদান ছিল বলে। আকবরের ধর্মের কিন্তু কোনও অবদান ছিল না। কেবল কৃষিকাজের, কেবল ফসলের, কেবল খাজনা আদায়ের হিসেব রাখতে হিজরি ক্যালেণ্ডারের বদলে বাংলা ক্যালেণ্ডার সুবিধে বলেই ওই ক্যালেণ্ডারের সূচনা করা হয়েছিল। আমার নানি চৈত্র সংক্রান্তি তে তেতো রাঁধতেন। নানি রাঁধতেন, কারণ নানির মা রাঁধতেন। নানির মা রাঁধতেন, কারণ নানির মার মা রাঁধতেন। নানির মার মা রাঁধতেন, কারণ নানির মার মার মা রাঁধতেন। চৈত্র সংক্রান্তিতে আমার খালারা বা মামিরা কিন্তু এখন আর তেতো খাবার রাঁধেন না, তেতো খাবার খানও না। চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রামে গ্রামে চড়ক পুজো হত। আমার দাদারা বাঁশবন পার হয়ে চড়ক পুজো দেখতে যেতো। ওখানে বাঁশ– দড়ির খেলা দেখতো হাঁ করে। ওই দিনই লোকনাথ পঞ্জিকা কিনতো সবাই। আমার দাদারাও। বৈশাখের প্রথম দিনে নানারকম মাটির কাজ, বেতের কাজ, কাঠের কাজ, শোলার কাজের মেলা বসতো। পশ্চিমবঙ্গে একই দিনে বৈশাখের উৎসব হত। বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সব বাঙালিই বৈশাখের উৎসবে অংশ নিত। নানারকম খেলা প্রতিযোগিতা হত গ্রামে, নৌকা বাইচ, কুস্তি, লাঠি খেলা, এসব।