কলকাতার মুসলিম মৌলবাদীরা জানেও না কী গল্প নিয়ে আমার সিরিয়াল, সর কারের আদর আর আসকারা পেয়ে তারাও ক্যামেরার সামনে বাক স্বাধীনতা বিরোধী আর নারী বিরোধী অগণতান্ত্রিক কথা বলতে দ্বিধা করে না। কোনও ধর্মীয় মৌলবাদীই মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। রাজনীতিকরা ভোটের জন্য মানুষ খুনও করতে পারে। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের এই নীরবতার কারণ কী? হিন্দু মৌলবাদীরা অন্যায় করলে তাঁরা তো ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতিবাদ করতে। এম এফ হোসেনকে হেনস্থা করার বিরুদ্ধে কোন বুদ্ধিজীবী লেখেননি বা প্রতিবাদ করেননি? এমনকী মুসলিম মৌলবাদী রা কোনও অন্যায় দাবি জানালেও একেবারেই যে মুখ বুজে থাকেন তা নয়। সালমান রুশদির বিরুদ্ধে কেউ কিছু উচ্চারণ করুক, কোনও লেখক বুদ্ধিজীবী মুখ বুজে থাকবেন না। সালমান রুশদি সাহিত্যের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন, আমিও পেয়েছি। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার আনন্দ একবার নয়, দুবার পেয়েছি। সঙ্গে আছে। অজস্র মানবাধিকার পুরস্কার। পাহক তাহলে কেন? সালমান রুশদি ইংরেজীতে লেখেন বলে, ধনী বলে, পাশ্চাত্যে বাস করেন বলে? তাকে দুরের নক্ষত্র বলে মনে হয় বলে! নাকি সালমান রুশদি পুরুষ বলে, পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করেন না বলে, নারীবাদী নন বলে, সমাজ বদলানোর জন্য অঙ্গীকার করেননি বলে? কিছু তো একটা হবেই। তা না হলে তাঁর ওপর আক্রমণ হলে ভারতের বিদ্বজ্জন প্রতিবাদে মুখর, আমার বেলায় নীরব কেন? সেদিন উত্তর প্রদেশের সরকার আমার বিরুদ্ধে একটা মামলা করে বসলো। কেন? কার কী ক্ষতি আমি করেছি? আমি দোষী, কারণ আমি। লিখেছি যে ফতোয়াবাজরা লেখকের মাথার দাম ঘোষণা করে, তারা বাক স্বাধীন তায় বিশ্বাস করে না। এই সত্য কথাটি লেখার জন্য আমার আট বছরের জেল হতে পারে। আমাকে এখন নিজেকে বাঁচাতে আদালতে দৌড়োতে হচ্ছে।
মুসলিম মৌলবাদীরা দোষ দিচ্ছে আমি ইসলাম ধ্বংস করেছি। পুরুষতন্ত্রের ধারক বাহকরা বলছে আমি সমাজের ঐতিহ্য নষ্ট করেছি, অর্থাৎ পুরুষতন্ত্রের সর্বনাশ করেছি। ধর্ম আর পুরুষতন্ত্র টিকিয়ে রাখার মাতব্বররাই সমাজের মাতব্বর, তাদের বাণিজ্যে কেউ ফাটল ধরানোর চেষ্টা করলে তাকে কি কেউ আর জ্যান্ত রাখবে? আমাকে হত্যা করার জন্য শুধু মৌলবাদীরা নয়, অসৎ রাজনীতিকরাও, নষ্ট রাজ নীতির ছাতার তলায় বাস করা নষ্ট বুদ্ধিজীবীরাও, স্বার্থান্ধ লেখকরাও ওত পেতে থাকেন।
একা একজন মানুষের সততা, সাহস, আদর্শ আর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিকট শক্তি। মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা ভবিষ্যতে হয়তো খুঁড়ে বের করবে উপমহাদেশে ঘটে যাওয়া কলঙ্কের এই ইতিহাস। তারা হয়তো পাশে দাঁড়াবে আমার। আমি আর তখন একা থাকবো না, এখন যেমন একা। সেই ভবিষ্যতে আমি বেঁচে না থাকলেও আমি বেঁচে থাকবো। অন্তত এইটুকুই আজ আমার সান্ত্বনা। এই স্বার্থান্ধ। অসুস্থ অকৃতজ্ঞ সমাজ থেকে আমি আর কিছু আশাও করি না।
পঞ্চাশ!
কাল একটা পত্রিকা থেকে একজন সাংবাদিক আমাকে ফোন করে পঞ্চাশ হওয়ার পর জীবন কেমন বোধ হচ্ছে জানতে চাইলেন। পঞ্চাশ নিয়েই একটা স্টোরি লিখছেন কাগজে। নিজেই বললেন, আগে বলা হত, চল্লিশে জীবন শুরু হয়, এখন বলা হয় পঞ্চাশে জীবন শুরু হয়। আপনিও নিশ্চয়ই তাই মনে করেন?
আমি জানি ওপাশ থেকে হ্যাঁ উত্তরের আশা নিয়ে বসেছিলেন সাংবাদিক। আমার না শুনে বেশ অবাক হলেন। তাঁর চমকানোর শব্দও যেন ফোনে পাওয়া গেল। আমি যা বললাম তা হল, পঞ্চাশের পর জীবন শুরু হয়, এ নিতান্তই বয়স হওয়ার ফলে যে একটা চরম হতাশা আসে, সেটার সান্ত্বনা। পঞ্চাশে বরং জীবন শেষ হওয়ার শুরু। মানুষের গড় আয়ু খুব বেশি নয়। অনেক কচ্ছপও আমাদের চেয়ে বেশি বাঁচে। খুব সৌভাগ্যবান হলে আশি বা তার ওপরে বাঁচে মানুষ, তা না হলে পঞ্চাশ থেকেই সা ধারণত কঠিন অসুখগুলো ধরতে শুরু করে। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যানসার। আমার পরিবারে আছে হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়বেটিস, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, কিডনি ফেইলুর, ক্যানসার। আমাকে এর মধ্যেই হাই ব্লাড প্রেশারে ধরেছে, আর সেদিন। ডেঙ্গু বয়ে আনলো হাই ব্লাড সুগার। এ দুটোর টেনশন তো আছেই, তার ওপর আছে। শরীরের কোথাও আবার ক্যানসার হচ্ছে না তো চুপচাপ?– এই দুশ্চিন্তা। কয়েক মাস আগে আমার ছোটদার প্যানক্রিয়াস ক্যানসার ধরা পড়েছে। ওর বানসার সত্যি বলতে কী ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছে আমাকে। মার হয়েছিল ক্যানসার, ছোটদার হলো, তাহলে কি আমারও হবে ওই রোগ! আমারও জিনে ঘাপটি মেরে আছে কোনও মন্সটার? মা বেঁচেছিলেন সাতান্ন বছর বয়স অবধি, বাবা মারা গেলেন সাতষট্টি বছর বয়সে। দাদার একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল ষাটে পা দিয়ে। আমাদের বেঁচে থাকা ওই পঞ্চাশ ষাটের খুব বেশি ওপরে যাবে না। তারপরও ভেবেছিলাম, একবার জেনোম সিকোয়ান্সিং করবো। কোটি টাকার ব্যাপার। জেনোম সিকোয়েন্সিং করবো শুনে এক বন্ধু বললো, মরার হাজার রকম কারণ থাকতে পারে, শুধু কি আর জেনেটিক ডিজিজে লোকে মরে! অ্যাকসিডেন্টে মরছে না মানুষ। তা ঠিক। এত আকাশে আকাশে উড়ি, কবে যে প্লেন ক্রাশ করবে কে জানে! ওই সিকোয়েন্সিংএর উৎসাহ তারপর আর পাইনি। সব ক্যানসারই তো জেনেটিক নয়, আমার মার আর ছোটদার ক্যানসার জেনেটিক বলে অনেক ডাক্তারই মনে করেন না। মনে না করলেও নিজের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে সেদিন লিভার হাসপাতালে গিয়ে কোলনোস্কপি করে এলাম। কোলন। ঠিক আছে। কোলন ঠিক আছে কিন্তু অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো ঠিক আছে কিনা কে বলবে, কিন্তু ওই প্রতি অঙ্গের টেস্ট করতে দৌড়োবো, এত উদ্যম আমার নেই। এমনিতে আমি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার লোক নই। যত পারা যায়, ডাক্তার এড়িয়ে চলি। সারা বছর কেবল যাবো যাবো করি, যাই না। নিজে ডাক্তার বলে, সম্ভবত এই হয়, ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে অত কাঠখড় পোড়াতে ইচ্ছে করে না। অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নাও, যাও, টাকা দাও, লাইনে দাঁড়াও, অপেক্ষা করো। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে ওই টাকা দেওয়াটা বা অপেক্ষা করাটা থেকে বেঁচে যেতাম সবসময়। ওসব আগে কখনও করতে হয়নি। এখনও করতে ইচ্ছে করে না। আর রোগ দেখতে গিয়ে আমার সঙ্গে এদেশের কোনও ডাক্তার তো ডাক্তারী ভাষায় কথা বলেন না। আমি বরং ডাক্তারী ভাষায় প্রশ্ন ঐশ্ন করলে ডাক্তাররা ভাবেন, আমি সম্ভবত বেজায় শিক্ষিত কোনও রোগী, অথবা ইন্টারনেটে রোগ শোক সম্পর্কে পড়ে জ্ঞান অর্জন করেছি। নিজে ডাক্তার, এ কথাটামুখ ফুটে কাউকে বলি না। আজ কুড়ি বছর ডাক্তারি করি না। অত বছর ডাক্তারি না করলো নিজেকে ডাক্তার বলতে অস্বস্তি হয়। এদিকে ডাক্তার তো দিয়েই যাচ্ছেন অ্যাডভাইজ, হাঁটাটা যেন হয়। ওই আধঘন্টা হাঁটার কথা ভাবলেই শরীরে আলসেমির চাদর জড়াই। এই অঞ্চলে হাঁটতে বড় অনিচ্ছে আমার। ইওরোপ আমেরিকায় কিন্তু এই অনিচ্ছেটা হয় না। পরিবেশ খুব বড় একটাব্যাপার বটে। জীবন যে কোনও সময় ফুরোবে, এই সত্যটা আগের চেয়ে এখন বেশি ভাবি বলেই, পজিটিভ একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করছি, আমি আগের মতো সময় নষ্ট করি না। টুয়েনটিজ আর থার্টিজ গর্দভের মতো সময় প্রচুর নষ্ট করেছি। তখনও এই বোধোদয়টা হয়নি যে সময় কম জীবনের। জানতাম, কিন্তু সে জ্ঞানটাকে আমি থিওরিটিক্যাল জ্ঞান বলবো। সত্যিকার বোধোদয় হওয়ার জন্য ওই বয়সে পা দেওয়া চাই। চল্লিশেও যে খুব হয়েছিল বোধোদয়, তা বলবো না। পঞ্চাশে এসে হঠাৎ যেন নড়ে চড়ে বসেছি। প্রচুর পড়ছি, লিখছি। আজে বাজে কাজে সময় নষ্ট করি না। এমনকি রাতের ওই সাত আট ঘণ্টার ঘুমটাকেও অহেতুক আর সময় নষ্ট বলে মনে হয়। খুব লাইকমাইণ্ডেড এবং ইন্টারেস্টিং লোক না হলে কারও সঙ্গে আড্ডাও আজকাল আর দিই না। আর কিছুদিন পর ভাবছি একা বেরিয়ে পড়বো পৃথিবীর পথে। যে দেশগুলো দেখা হয়নি, অথচ দেখার খুব ইচ্ছে, দেখবো। জীবনকে অর্থপূর্ণ যতটা করতে পারি, করবো। জীবনকে যতটা সমৃদ্ধ করতে পারি, করবো। সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, সাজি কি না আগের চেয়ে বেশি।