দেশকে ধর্ষণমুক্ত করতে গেলে সরকারকে প্রচুর কাজ করতে হয়। প্রচুর পরি শ্রম। তার চেয়ে ধর্ষককে ফাঁসি দেওয়ার মতো সহজ কাজ আর কিছু নেই। জনগণও খুশি হয়। তখনকার মতো সব সমস্যাকে চমৎকার ধামাচাপা দেওয়া যায়। সরকার এভাবেই মানুষকে বোকা বানায়। মানুষ বুদ্ধিমান হয়ে গেলে বেজায় মুশকিল। তখন যে কাজগুলো করলে সমাজের সত্যিকার ভালো হয়, সে কাজগুলোর দাবি সরাসরি সরকারের কাছে করে বসবে বুদ্ধিমান মানুষেরা। ওদের দাবি মেনে সমাজকে সবার জন্য নিরাপদ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লে ভোট জোটানোর মতলব আঁটবে কে? একে ল্যাং মারা, ওকে দেশছাড়া করা, গণ্ডা গণ্ডা গুণ্ডা পোষা আর যুগের পর যুগ গদিতে বসে থাকার ফন্দি আঁটার সময় কোথায় তখন সরকারের?
নিষিদ্ধ
তার লেখা, তার ভাবনা, তার সবকিছুকে তো নিষিদ্ধ করেছেই, গোটা মানুষটাকেই নিষিদ্ধ করেছে এই উপমহাদেশ। আমি আমার কথা বলছি। আমার মনে হয় না পৃথিবীতে আর কোনও লেখক এমন আছে, যার সৃষ্টিকে শুধু নয়, তাকেও গোটা সমাজ আর গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা এমন প্রবলভাবে অস্বীকার করেছে। লেখক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী সবাই চোখ বুজে থাকেন, কান বন্ধ করে রাখেন, মুখে কুলুপ এঁটে রাখেন, যখন আমার বিরুদ্ধে সরকার কোনও অন্যায় সিদ্ধান্ত নেয়। এ দেখে আসছি আজ কুড়ি বছর। বাংলাদেশ থেকে একজন জনপ্রিয় নারীবাদী লেখককে যখন তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, দেশের সব লোক চুপচাপ উপভোগ করেছিল সেই জঘন্য অন্যায়। কেউ কোনও কথা বলেনি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা আর প্রকাশনী সংস্থা যারা আমার লেখা ছাপানোর জন্য উন্মাদ ছিল, তারাও আমার নাম নিমেষে বাতিলের খাতায় লিখে ফেললো। সরকারের অন্যায়ে সেদিন জনগণ তাদের পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিল। নীরবতাকে আমি সমর্থন বলেই মনে করি। সরকারের বদল হল, নতুন সরকার যে কিনা আগের সরকারের পান থেকে চুন খসলেই চুলির মুঠি ধরে গালাগালি করতো, সেই সরকারও আগের সরকারের অন্য কিছুর সঙ্গে নয়, শুধু তসলিমা বিরোধী। যাবতীয় অনৈতিক এবং বেআইনী সিদ্ধান্তর সঙ্গে একমত হলো। বাংলাদেশে একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ হয়েছে, মুক্ত চিন্তক বলে বড়াই করা মানুষেরা চুপ করে। থেকেছে। বাংলাদেশে আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না আজ কুড়ি বছর, মানবাধিকারের জন্য লড়াই করা সৈন্য সামন্তও কোনও দিন এ নিয়ে একটি প্রশ্ন পর্যন্ত করেনি। তসলিমার বিরুদ্ধে যে কোনও অন্যায়ই, যে কোনও অবিচারই, যে কোনও নোংরামোই, যে কোনও মিথ্যেই, যে কোনও ঘৃণ্য পদক্ষেপই সমাজের সকল স্তরের, সকল মানের, সকল ক্ষেত্রের লোকেরা নিঃশব্দে মেনে নেয়। শুধু নিজের দেশে নয়, পাশের দেশেও আমি ব্রাত্য। ভারতও বারবার প্রমাণ করছে, বাংলাদেশের মতো ভারতও ডুবে আছে। একই অন্ধকারে, আর কিছুর ক্ষেত্রে না হলেও অন্তত আমার ক্ষেত্রে। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমার লেখা একটি মেগাসিরিয়াল টিভিতে সম্প্রচার হওয়ার আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। উনিশে ডিসেম্বর মহাসমারোহে মেগাসিরিয়ালটি দেখানো হবে। পুরো পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে মেগাসিরিয়ালের বিজ্ঞাপন, টিভিতে খানিক বাদে বাদেই বলা হচ্ছে মেগাসিরিয়াল প্রচারের কথা। মূলত অত্যাচারিত নিপীড়িত মেয়েদের সং গ্রামের কাহিনীই আমি লিখেছি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এতকাল পর সাহসী মেয়েদের গল্প সিরিয়ালে দেখবে বলে। কিন্তু টিভি চ্যানেলে আচমকা চড়াও হলো পুলিশ, হুমকি দিল, সিরিয়াল দেখানো চলবে না। কেন চলবে না, গণ্ডগোল হতে পারে, আগুন জ্বলতে পারে। এই সিরিয়ালটি ক খ গ ঘ ঙদের লেখা হলে আপত্তি ছিল না, আপত্তি গল্প নিয়ে নয়, গল্পের প্রধান চরিত্রে কলকাতার তিনটে হিন্দু মেয়ে যারা পণপ্রথা, শিশুপাচার, ধর্ষণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করে। আপত্তি লেখকের নাম নিয়ে। সিরিয়ালের সুটিং কয়েক বছর আগেই শুরু হয়েছিল, কোটি টাকা খরচ করেছে চ্যানেল, আর এ কিনা দেখানো চলবে না কারণ সিরিয়ালের লেখক তসলিমা বলে! তসলিমা নামটি এখন ভারতের ভোট ব্যাংক রাজনীতির কাজে যখন তখন ব্যবহৃত হয়। ব্যবহার করে ভারতের সব রাজনৈতিক দল। সব দলই গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে তসলিমা নাসরিন নামের মানুষটিকে থাপ্পর দাও ঘুষি দাও লাথি দাও, তাহলে ভোট পাবে অজ্ঞ অশিক্ষিত মুসলমানদের। রাজনীতিকরা বুঝে গেছেন, তসলিমার পক্ষে উপমহাদেশের কোনও রাজনৈতিক দল নেই, কোনও লেখক-বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী নেই, কোনও মানবাধিকার বা নারী অধিকার গোষ্ঠী নেই– একে যা ইচ্ছে তাই করো, এর বই নিষিদ্ধ করো, এর টিভি সিরিয়াল বন্ধ করো, একে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দাও, এর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার মামলা করো, একে দেশ থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করো, একে বিষ খাইয়ে মারো, এর বিরুদ্ধে বস্তা বস্তা মিথ্যে বলো, কেউ কোনও টু শব্দ করবে না। জনগণ বসে বসে উপভোগ করবে একজন লেখকের ওপর, শুধু একজন লেখকের ওপরই ঘটতে থাকা জঘন্য অন্যায় অত্যাচার। এই যে এত বড় একটা মেগা সিরিয়াল যে সিরিয়ালটি এক দশকের চেয়েও বেশি সময় চলতে পারতো, পুরো মাফিয়া কায়দায় বন্ধ করে দিল পশ্চিমবঙ্গের সরকার, তা চোখের সামনে দেখেও পশ্চিমবঙ্গের শুধু নয়, পুরো ভারতেরই সমস্ত মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক দল চুপ। গণতন্ত্রের আর বাক স্বা ধীনতার বিরুদ্ধে এত নোংরা আঘাত কে কবে দেখেছে! সময় সুযোগ মতো ইসলামী মৌলবাদীদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে সরকারের জুড়ি নেই। তসলিমাকে তারা যাতাঁকলে পিষবে, দোষটা ফেলবে মুসলিম মৌলবাদীদের ওপর। হিন্দু রাজনীতিকরা নিরীহ তসলিমা আর এক পাল মুখ মৌলবাদীদের নিয়ে খুব সহজেই এই খেলাটা খেলেন। তসলিমার গায়ে কারা কবে ইসলাম বিরোধী তকমা লাগিয়েছিল, সেই তকমাটিই এখন তাঁদের অস্ত্র। তসলিমা নারীর অধিকারের পক্ষে, বা মানবাধিকারের সমর্থনে কী বলছে, সেটি দেখার বিষয় নয় আর, তসলিমা তার মানববাদী লেখালেখির জন্য কত পুরস্কার পেলো সারা বিশ্বে, সেটিও বিষয় নয়, তসলিমা ইসলাম-বিরোধী লেখা লিখেছে, সুতরাং মুসলমানরা তসলিমার বই ছাপা হোক চায় না, বইয়ের উদ্বোধন হোক চায় না, তসলিমা এ রাজ্যে থাকুক্ষ চায় না– এসব বলে অর্থাৎ মুসলমানের দোহাই দিয়ে মুসলমান গোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিকে বাঁচানোর ভাব দেখিয়ে সরকার আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে, আমার বই নিষিদ্ধ করে, কলকাতা বইমেলায় আমার বইয়ের উদ্বোধন বন্ধ করে দেয়, আমার লেখা ছাপালে কোনও পত্রিকাই আর সরকারি বিজ্ঞাপন পাবে না এই হুমকি দেয়, আমার সিরিয়াল দেখালে টিভি চ্যানেলে আগুন জ্বলবে বলে শাসিয়ে যায়। ভারতের মুসলিম মৌলবাদীদের কেউ জিজ্ঞেস করুক, আমার বই পড়েছে কি না। না, তারা কেউ আমার বই পড়েনি। আমার কোন বইয়ের কোন বাক্য তাদের অনুভূতিকে আঘাত করেছে, দেখাতে বলুক কেউ। না, তারা দেখাতে পারবে না, কারণ তারা জানে না আমি কোথায় কী লিখেছি। মৌলবা দীরা সাহিত্যের, সমাজ পরিবর্তনের, মানবাধিকারের, নারী স্বাধীনতার বই পড়ে না। পড়লে ওরা মৌলবাদী হতো না। ওরা শুধু শুনেছে আর্মি ইসলাম ধ্বংস করে দিয়েছি। কার কাছে শুনেছে, কে বলেছে তাও তারা ঠিক বলতে পারবে না। আসলে তারাই সবচেয়ে বড় ইসলাম বিরোধী যারা মনে করে ইসলাম এতই ভঙ্গুর আর এতই দুর্বল। যে কারও লেখায় বা কথায় ইসলাম ধ্বংস হয়ে যায়।