পাকিস্তানের মেয়ে মালালা ইউসুফজাই সেদিন ইওরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় মানবাধিকার পুরস্কার (সাখারভ) পেলো। মালালা সাহসী এবং বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে। ওর পুরস্কার পাওয়ায় আমি বেশ খুশি। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমও মালালার পুরস্কার পাওয়ায় এত খুশি যে খবরটার ব্যাপক প্রচার করেছে। মালালা যে সাখারভ পুরস্কারটি এ বছর পেয়েছে, সেই পুরস্কারটিই আমি পেয়েছিলাম ১৯৯৪ সালে। গত কুড়ি বছরে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম কিন্তু একটি অক্ষরও খরচ করেনি। নিজের দেশের মেয়ের পুরস্কার নিয়ে। ফরাসী সরকারের দেওয়া মানবাধিকার পু রস্কার বা সিমোন দ্য বুর্ভেয়ার পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্ট রেট– আমার কোনও সম্মান বা পুরস্কার পাওয়ার দিকে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ফিরে তাকায়নি। সবচেয়ে হাস্যকর ঘটনা ঘটায় বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো। আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও আজ অবধি কোনও রাষ্ট্রদুত উপস্থিত থাকেননি আমাকে সম্মানিত করার কোনও অনুষ্ঠানে। ইওরোপ আমেরিকা কাউকে বড় কোনও সম্মান দিলে তার দেশের রাষ্ট্রদূতকে আমন্ত্রণ জানায় সম্মান-বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য। এই সেদিন বেলজিয়ামের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স, আর্টস এণ্ড লিটারেচার থেকেও যখন অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছি, অ্যাকাডেমির প্রেসিডেন্ট যথারীতি আমার দেশের রা ষ্ট্রদূতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যথারীতি রাষ্ট্রদূত অনুপস্থিত। প্রেসিডেন্ট সম্ভবত অনুমান করেছেন রাষ্ট্রদূত লোকটা ছোটলোক। সবচেয়ে বেশি ছোটলোকি করেছিলেন কুড়ি বছর আগে বেলজিয়ামে যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তিনি, বিশাল একটা চিঠি লিখেছিলেন ইওরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্টের কাছে, কাকুতি মিনতি করে ছিলেন আমাকে যেন সাখারভ পুরস্কারটি কিছুতেই না দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট আমাকে রাষ্ট্রদূতের চিঠিটি পড়তে দিয়েছিলেন, আর ফেরত নেননি। পরদিন ঘটা করে আমাকে সাখারভ পুরস্কার দিয়েছিলেন।
প্রতিবারই যখন সম্মানিত হয়েছি, লজ্জা হয়েছে দেশটির জন্য। আজও হয়। আমার বাবা যখন মৃত্যুশয্যায়, প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে আমি অনেক অনুরোধ করেছি লাম আমাকে যেন অন্তত দুদিনের জন্য হলেও দেশে যেতে দেন তিনি। আমার বাবা কী যে ব্যাকুল ছিলেন আমাকে একটিবার দেখার জন্য। দিনের পর দিন কেঁদেছেন। হাসিনা আমাকে দেননি দেশে যেতে হয় তিনি নিজের বাবা ছাড়া আর কারোর বাবাকে মর্যাদা দেন না, নয় তিনি নিজের বাবাকে সত্যিকার ভালোবাসেন না, বাবা নিয়ে রাজনীতি করতে ভালোবাসেন। নিজের বাবাকে ভালবাসলে কেউ এভাবে অন্যের বাবাকে বঞ্চিত করেন না, বিশেষ করে যখন কোনও বাবা তাঁর কন্যাকে একবার শেষবারের মতো দেখতে চান। কন্যার হাত একবার শেষবারের মতো স্পর্শ করার জন্য মৃত্যুশয্যায় যখন কাঁদেন, তাঁকে কোনও শত্রুও বলে না, না।
জীবনে মৌলবাদীদের অত্যাচার অনেক সয়েছি, ওদের জারি করা ফতোয়া, মামলা, ওদের হরতাল, মিছিল। কিছুই আমাকে এত দুঃখ দেয়নি যত দিয়েছে আমার অসুস্থ বাবার কাছে আমাকে একটিবারের জন্য যেতে না দেওয়ার কুৎসিত সরকারি সিদ্ধান্ত। আমাকে মৌলবাদীরা দেশ থেকে তাড়ায়নি, তাড়িয়েছে সরকার। বাংলাদে শের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পার্থক্য প্রায় নেই বললেই চলে, বাংলাদেশ থেকে যেভাবে তাড়ানো হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ থেকেও ঠিক সেভাবেই তাড়ানো হয়েছে, ওই একই কারণে, ধর্মীয় মৌলবাদীদের মুখে হাসি ফোঁটাতে।
কিছু দূরদৃষ্টিহীন স্বার্থপর রাজনীতিকের কারণে আজ আমি নির্বাসিত। একজন আপাদমস্তক বাঙালি লেখকের আজ বাংলায় ঠাঁই নেই। বাংলা ভাষা থেকে সহস্র মাইল দূরে বসে বাংলার মানুষের জন্য আমাকে বাংলা ভাষায় বই লিখতে হচ্ছে। কী জঘন্য, কী নির্মম, কী ভয়ংকর এই শাস্তি! কী অপরাধ আমার? নিজের মত প্রকাশ করেছিলাম বলে, যেহেতু আমার মত কিছু মূর্খ, ধর্মান্ধ, আর নারীবিদ্বেষী লোকের মতের চেয়ে ভিন্ন?
তারপরও ভালোবাসার মরণ হয় না। মা নেই, বাবা নেই। যাঁরা ভালোবাসতেন, তাঁরা কেউ নেই। শামসুর রাহমান নেই, কে এম সোবহান, কবীর চৌধুরী, রশীদ করীম, ওয়াহিদুল হক নেই, দেশটা খাঁ খাঁ করছে। তারপরও দেশের জন্য, দেশে ফেলে আসা সেই নদীটা, সেই ইস্কুলঘরটা, শৈশবের সেই উঠোনটা, খেলার সেই মাঠটা, মার লাগানো সেই কামিনী গাছটা, সেই নারকেল, সেই কামরাঙা, সেই পেয়ারা গাছটার জন্য মন কেমন করে। কেউ নেই, কিছু নেই, সব বদলে গেছে, দেশ আর সেই দেশ নেই, কিন্তু তারপরও দেশ শব্দটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর একটা কষ্ট টের পাই। এই কষ্টটার আমি কোনও অনুবাদ জানি না।
অনেকে জিজ্ঞেস করে, ইওরোপের নাগরিক হয়েও, আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও কেন আমি দিল্লিতে বা ভারতে থাকি। আমি বলি, এখানে থাকি, এখানকার গাছগুলোর নাম জানি বলে। যারা প্রশ্ন করে, জানি না তারা ঠিক বুঝতে পারে কি না কী বলছি। এই শাল, সেগুন গাছ, এই কৃষ্ণচূড়া, এই শিমুল, এই কাঁঠালিচাপা আমি শৈশব থেকে চিনি। এই গাছগুলো যখন দেখি, মনে হয় বুঝি দেশে আছি। হিন্দি আমার ভাষা নয়, কিন্তু এই ভাষাটির ভেতর সংস্কৃত শব্দগুলো বাংলার মতো। শোনায়, সে কারণেই কি ইওরোপ আমেরিকায় না থেকে এখানে থাকি। আর এই যে কদিন পর পরই যমুনার পাড়ে যাচ্ছি, সে কেন? কী আছে ওই নদীটায়। একদিন পাড়ে দাঁড়িয়েই এক চেনা ভদ্রলোককে বলেছিলাম, জানো, আমার দেশেও একটা নদী আছে, নদীটার নাম যমুনা। ভদ্রলোক বললেন, কিন্তু ওই নদী আর এই নদী তো এক নয়। বললাম, তাতে কী! নাম তো এক।