শুধু জন্মের সময় শরীরে ছোট একটা পুরুষাঙ্গ ছিল না বলে কত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমার দাদারা পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মেছে, দুনিয়া দেখেছে, কিন্তু লেখার ক্ষমতা নেই বলে কিছুই লিখতে পারেনি। হয়তো অন্য খাতে খাঁটিয়েছে অভিজ্ঞতা। লেখার হাত থাকলেও অভিজ্ঞতার অভাবে অনেক সময় আমি মন খারাপ করে বসে থাকি। সেদিন খুব ইচ্ছে হয়েছিল কনস্ট্রাকশান ওয়ার্কারদের নিয়ে, ট্রেড ইউনিয়নি স্টদের নিয়ে বড় একটা উপন্যাস লিখি। কিন্তু ওদের জীবন পুরুষ হয়ে বিচরণ করলে যতটা দেখা সম্ভব, মেয়ে হয়ে ততটা সম্ভব নয়। বাইরের পৃথিবীর প্রায় সবখানেই, প্রায় সবজায়গায় মেয়েরা অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাঞ্ছিত। যা কিছুই ঘটুক, পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্ম নিইনি বলে আমার কিন্তু দুঃখ হয় না, বরং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। কারণ পুরু ষশাসিত সমাজে ওই ছোট্ট অঙ্গটা থাকা খুব ভয়ংকর, রীতিমত মাথা নষ্ট করে দেয়, নীতিবোধ বলে, বিচারবোধ বলে প্রায় কিছু থাকে না, ভাবার-চিন্তা করার শক্তি লোপ পাইয়ে দেয়, নিজেকে ঈশ্বরের মতো বড় বলে মনে হয়, মুখতা আর মূঢ়তার মুকুট পরেই বসে থাকা হয় কেবল। পুরুষ হয়ে জন্মালে আমি আর দশটা পুরুষের মতো হতাম না এ কথা নিশ্চয় করে কী করে বলবো, নাও যদি হতাম, পুরুষ জাতটা তো আমার জাত হতো, যে জাতের বেশির ভাগই অবিবেচক, কূপমণ্ডুক! হয়তো অনেকে বলবে বেশির ভাগ পুরুষই ভালো, সমানাধিকারে বিশ্বাস করে, শুধু হাতে গোণা কজন পুরুষই করে না। তাই যদি হয়, বেশির ভাগ পুরুষই যদি সমানাধিকারে বিশ্বাস করে, তবে সমাজে সমানাধিকারের আজও দেখা নেই কেন? কে বাধা দেয়? বেশির ভাগ পুরুষই যদি পুরুষতন্ত্র বিরোধী, তবে আজো কেন এত বহাল তবিয়তে, এত জাঁকিয়ে, সমাজ জুড়ে বৈষম্যের মূল অপশক্তি পুরুষতন্ত্র টিকে আছে?
দেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়?
দেশ বলতে ঠিক কী বোঝায় সম্ভবত আমি এখন আর জানি না। আজ কুড়ি বছর দেশের বাইরে। আজ কুড়ি বছর নিজের দেশে প্রবেশ করার এবং বাস করার অধিকার আমার নেই। আমার নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করছে, যারাই ক্ষমতায় আসছে, তারাই। আমাকে হেনস্থা করা, অপমান করা, অপদস্থ করা, অসম্মান করা, আমাকে গলা-ধাক্কা দেওয়া, লাথি দেওয়া, ঘরবার করা যত সহজ, তত আর কাউকে যে সহজ নয়, তা ক্ষমতায় যারা বসে থাকে, তারা বেশ ভালো জানে। আমি কি কোনও অন্যায় করেছি, মানুষ খুন করেছি, চুরি ডাকাতি করেছি? কারও কিছু লুট করেছি, কাউকে সর্বস্বান্ত করেছি? না, তা করিনি। রাজনীতি করেছি, নিজের সুবিধে চেয়েছি, লোক ঠকিয়েছি? না, তাও নয়। তবে কী করেছি যে যার শাস্তি চিরকালের নির্বাসন? কী। করেছি যে হাসিনা খালেদা তত্ত্বাবধায়ক– সব সরকারের বেলায় আমাকে আমার নিজের দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না এই একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়? কোনও একটি বিষয়ে, সব রাজনীতিবিদদের কোনও সিদ্ধান্তে কি এমন চমৎকার মিল পাওয়া যায়? কোনও একটি মানুষের বিরুদ্ধে চরম অন্যায় করে কি কোনও সরকার এমন পার পেয়ে যায়? কোনও একটি মানুষের ওপর নির্যাতন হচ্ছে দেখেও দেশের সব মানুষ। কি এমন মুখ বুজে থাকে, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ? এমন অদ্ভুত কাণ্ড সম্ভ বত ইতিহাসে নেই। কোনও লেখকের এত বই কোনও দেশের কোনও সরকার নিষিদ্ধ করেনি। লেখকদের নির্বাসনে পাঠানো হয়, তবে সরকার বদল হলে লেখকেরা আবার ফিরে যায় নিজের দেশে। আমি নিজের দেশে ফিরতে পারি না। কারণ আমার দেশে সরকার বদল হয়, সরকারের বদমাইশি বদল হয়না। আমার দেশের সব সরকার। মনে করে, দেশটা তাদের বাপের সম্পত্তি। সুতরাং তাদের বাপের সম্পত্তিতে পা দেওয়ার কোনও অধিকার আমার নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রী বিদেশে এলে তাঁকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, তসলিমাকে কেন দেশে যেতে দিচ্ছেন না? সঙ্গে সঙ্গে তিনি উত্তর দেন, ওর তো দেশে যেতে কোনও বাধা নেই, ও যাচ্ছে না কেন? পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন তিনি মিথ্যে বলছেন। তিনি নিশ্চয়ই ভালো করেই জানেন যে বাংলাদেশের সমস্ত দূতাবাসকে সরকার থেকে কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে যে আমার বাংলাদেশ-পাসপোর্ট যেন নবায়ন করা না হয় এবং আমার ইওরোপের পাসপোর্টে যেন বাংলাদেশের। ভিসা দেওয়া না হয়। বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো থেকে দেশের মন্ত্রণালয়ে আমার। পাসপোর্ট নবায়ন করার ভুরি ভুরি দরখাস্ত পাঠানো হয়েছে প্রায় দুযুগ যাবৎ, উত্তরে জুটেছে না অথবা নৈঃশব্দ্য। প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং যাবতীয় সকল মন্ত্রীই জানেন ভ্যালিড পাসপোর্ট বা ভিসা ছাড়া দেশের পথে রওনা হওয়া কোনও জাহাজে বা উড়োজাহাজে উঠতে আমি পারবো না, দেশের মাটিতে পা রাখা তো দূরের কথা। মিথ্যে বলার কী প্রয়োজন! সরাসরি বলেই দিতে পারেন, আমরা ওকে দেশে ঢুকতে দিচ্ছি না, দেবোও না। কারণ আমরা যা খুশি তাই করার লোক। এ নিয়ে বিরোধী দল কোনও প্রশ্ন করবে না, দেশের জনগণও রা-শব্দ করবে না, তবে আর ওর নাগরিক অধিকার নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা কেন হবে।
আমি চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়েছি। ডাক্তারি করেছি দেশের সরকারি হাসপাতাল গুলোয়। ছোটবেলা থেকে লেখালেখির অভ্যেস, তাই ডাক্তারির পাশাপাশি ওটি চালিয়ে গেছি। মানুষের ওপর মানুষের নির্যাতন দেখে কষ্ট পেতাম, মানুষের দুঃখ দুর্দশা ঘোচাতে চাইতাম; লিখতাম– যেন সমাজ থেকে কুসংস্কার আর অন্ধত্ব দূর হয়, মানুষ যেন বিজ্ঞানমনস্ক হয়, আলোকিত হয়, যেন কারোর মনে হিংসে, ঘৃণা, ভয় আর না থাকে, যেন মানুষ মানুষকে সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। লিখেছি, বই প্রচণ্ড জনপ্রিয়ও হয়েছে, কিন্তু জনপ্রিয় বইগুলোই সরকার নিষিদ্ধ করতে শুরু করলো। এক সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অন্য সরকারও বই নিষিদ্ধ করেছে। নিষেধাজ্ঞা ব্যাপারটি বড় সংক্রামক। একবার নিষিদ্ধ করে যদি দেখা যায় কোনও প্রতিবাদ হচ্ছে না, তখন নিষিদ্ধ করাটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়ায়। আমার বইগুলো যেন সরকারের খেলনার মতো| খেলনা নিয়ে যা খুশি করেছে, ভেঙেছে, ছুঁড়েছে, মাস্তি করেছে। খালেদা সরকার লজ্জা নিষিদ্ধ করেছে, লজ্জা ছিল সা ম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি মানবিক দলিল। আমার মেয়েবেলা নামের বইটি, যেটি হাসিনা সরকার নিষিদ্ধ করেছে, সেটি বাংলা সাহিত্যের বড় পুরস্কার আনন্দ পুরস্কার ছাড়াও বেশ কিছু বিদেশি পুরস্কার এবং বিস্তর প্রশংসা পেয়েছে। তারপর একে একে আমার আত্মজীবনীর বিভিন্ন খন্ড উতল হাওয়া, ক, সেইসব অন্ধকার নিষিদ্ধ হয়েছে। কেউ আপত্তি করেনি বই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে। নাৎসিরা জার্মানীতে বই পুড়িয়েছিল। সেই বই পোড়ানোর দিনটি এখনও ইতিহাসের কালো একটি দিন। একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ সরকার কি সেই বীভৎস নাৎসি দের মতোই আচরণ করেনি। মুশকিল হচ্ছে বেশির ভাগ সরকারই সাহিত্যের কিছু জানে না, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কেও তাদের কোনও জ্ঞান নেই। অথবা আছে জ্ঞান, কিন্তু পরোয়া করে না। জনগণের সেবক গদিতে বসার সুযোগ পেলে শাসক বনে যায়, শোষক বনতেও খুব একটা সময় নেয় না।