বাবা ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। আবার ঘাড় ধরে ফেরত নিয়ে এসে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন। কিন্তু তখন আর ছোটদার পড়াশোনায় মন নেই। মাধ্য মিকে কয়েকটা স্টার নিয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করা ছেলে উচ্চমাধ্যমিক যেন তেন ভাবে পাশ করে অল্প বয়সে চাকরি করতে শুরু করলো। ছোটদার সঙ্গে তখন আমার সখ্য ছিল খুব। আমার ইস্কুল-কলেজের রিক্সাভাড়া থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে ওকে দুটাকা তিন টাকা দিতাম। গল্পের বই পড়ে শোনাতাম। ছোটদার জন্য মায়া হত খুব। ছোটদার জীবনটা ছিল ভীষণ স্ট্রাগলের আবার অ্যাডভেঞ্চারেরও, যেসব আমরা কল্পনা করতে পারতাম না ওই বয়সে। হঠাৎ করে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া, বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা, এসব সিনেমায় ঘটতে দেখতাম, আর দেখতাম ছোটদার জীবনে। নিয়ম নীতির বাইরে বেরোনো, কাউকে তোয়াক্কা না করা, এমনকী বাবার মতো ভয়ংকর মানুষকে ভয়। না পাওয়া, ছোটদার কাছ থেকেই শেখা। সেই যে গিটার এনেছিল বাড়িতে প্রথম, এরপর বাড়িতে বড়দার জন্য বেহালা ঢুকেছিল, আমার জন্য একটা হাওয়াইন গিটার ঢুকেছিল, ছোটবোনের জন্য হারমোনিয়াম। ছোটদা দরজাটা খুলেদিয়েছিল, যে দরজা দিয়ে বাইরের পৃথিবীটা ঢুকেছিল বাড়িতে। কাউকে না কাউকে দরজা খুলতে তো হয়ই প্রথম।
আজ এই যে আমি অসাম্প্রদায়িক, সে কি এমনি এমনি? আকাশ থেকে অসাম্প্রদায়িকতার জ্ঞান বুদ্ধি আমার ওপর ঝরেছে? না, তা ঝরেনি। সেও ছোটদার কারণে। যখন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রেম হওয়া বা বিয়ে হওয়ার প্রচলন সমাজে ছিল না, তখন ছোটদা নির্দ্বিধায় প্রেম করতো হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে। তার ট্রাঙ্ক ভরা থাকতো প্রেমের চিঠিতে। সুযোগ পেলে সেগুলো পড়তাম, আর বিস্ময়-চাখে দেখতাম নিষেধের দেওয়াল ডিঙোনো ছোটদাকে। হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করার পর ছোটদা বাড়ির লোকদের লুকিয়ে লুকিয়ে বউকে পুজোর শাড়ি কিনে দিত, পুজোর সময় বউকে তার বাপের বাড়িতে নিয়ে যেতো যেন পুজো করতে পারে। আমাদের বাড়িতে মা ছাড়া কেউ নামাজ রোজা করতো না। কিন্তু তাই বলে যে সবাই অসাম্প্রদায়িক ছিল ভেতরে ভেতরে তা নয়। আমি অসাম্প্রদায়িক, এ কথাটা মুখে বলা সহজ, কাজে প্রমাণ করা সহজ নয়। যুদ্ধের সময় নারায়ণ নামের একটা হিন্দু ছেলেকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে জীবন বাঁচি য়েছিলেন বাবা। আর ছোটদা প্রচণ্ড হিন্দু-বিরোধী মুসলমান সমাজে জন্ম নিয়ে একটা হিন্দু মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করে নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিল যে সে অসা ম্প্রদায়িক। ছোটবেলায় এ দুটো ঘটনা চোখের সামনে না দেখলে হয়তো লজ্জা নামের অসাম্প্রদায়িক বইটি লেখা আমার হতো না। আজ পৃথিবীর তিরিশটি ভাষায় অনূদিত লজ্জা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অন্যতম একটি গ্রন্থ। জীবনে কত মহীরূহর বীজ যে সেই শৈশবেই নিজের অজান্তেই বপন করা হয়ে যায়। ছোটদানা থাকলে, আমি আজ যা, অসাম্প্রদায়িক, অকুতোভয়, আপোসহীন, তা হয়তো হতে পারতাম না।
সেই যে ছোটদার জন্য মায়া হতে শুরু করেছিল ছোটবেলায়, সেই মায়াটা কখনও চলে যায়নি। বড়দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, আমি ডাক্তারি পাশ করেছি, ছোটবোন। মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছে। আমাদের চাকরি বাকরি পাওয়া কঠিন ছিল না।
বড় অসহায় চোখে ছোটদার জীবনযুদ্ধ দেখতে হতো আমাদের। একসময় অবশ্য ছোটদা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেল। বাবার সঙ্গেও ভাব হয়ে গেল। বাবা উজাড় করে। দিতেন। অভাব চলে গিয়েছিল ছোটদার। কিন্তু ছোটদার জন্য মায়াটা কিন্তু আমাদের সবারই থেকে গিয়েছিল।
কত কিছুই না ক্ষমা করে দিয়েছি। যখন সতেরো বছর বয়স আমার, নিচের পাটির দুটো মোলার দাঁতে একটু ব্যথা হচ্ছিল। ব্যস, ছোটদাতার এক দাঁতের ডাক্তারী পড়া বন্ধুর কাছে আমাকে নিয়ে গিয়ে বললো, জুয়েল, ওর দুটো দাঁত ফেলে দাও তো! ছোটদাই দেখিয়ে দিল কোন দুটো দাঁত ফেলতে হবে। সতেরো বছর বয়সে দুটো দাঁত খামোকা হারিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। অনেক বছর পর আমি বুঝতে পেরেছি, আমার দাঁত ফেলার সিদ্ধান্ত ছোটদা ভুল নিয়েছিল। কিছু বলিনি, মনে মনে ক্ষমা করে দিয়েছি। ছোটদা তো আর জেনে বুঝে ও কাজটা করেনি। ভেবেছিল, যে কোনও দাঁতে যেই না ব্যথা হবে, অমনি ওটাউপড়ে তুলে ফেলাই মঙ্গলজনক। মাথা ব্যথা হলে যেমন মাথাটা কেটে ফেলে দিতে হয়না, দাঁত ব্যথা হলেও দাঁত ফেলে দিতে হয় না। ছোটদা অনেক সময় বড় সরল, বড় নিরীহ ছিল। বাইরে থেকে সবাই তা বুঝতো না।
সিনেমার পোকা ছিলাম আমি ছোটবেলায়। একসময় সিনে-পত্রিকাগুলোতে লিখতে শুরু করলাম। বাড়িতে সিনে-পত্রিকা ঢোকার কোনও নিয়ম ছিল না। ওসব ছাইপাঁশ কিনছি বা পড়ছি জানলে বাবা হাড় গুঁড়ো করে দেবেন। মুশকিল আসান করতো ছোটদা। ছোটদা ওসব পত্রিকা বাড়িতে আনতো। আমার প্রথম লেখা কোনও একটা সিনে-পত্রি কাতেই প্রথম ছাপা হয়েছিল। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সিনেমার পত্র-পত্রিকাই ছিল সাহিত্যের পত্র পত্রিকা। ওসবেই ছোটগল্প উপন্যাস কবিতা এসব ছাপা হত। সেসময় ছোটদা আবার চিত্রালী পাঠক পাঠিকা চলচ্চিত্র সমিতির কেউ একজন হয়ে উঠলো। সিনেমার হিরোদের ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে নিয়ে আসতো অনুষ্ঠান করাতে। বিচিত্র সব বিষয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেল্লার ক্ষমতা ছোটদার ছিল। এই গুণ সবার থাকে না। মানুষ অসম্ভব ভালোও বাসতো ছোটদাকে। সেই ছোটবেলাতেই দেখেছি, কত বন্ধু যে ছিল ছোটদার। নানান বয়সী বন্ধু। দ্বিগুণ বয়সী কারও সঙ্গে মিশছে, আবার হাঁটুর বয়সী কারও সঙ্গে। যে কারও সঙ্গে মিশতে পারতো ছোটদা। যে কোনও দলের সঙ্গে। যে কোনও মানসিকতার মানুষের সঙ্গে, বড় বিজ্ঞানী থেকে রাস্তার ভিখিরি, সবার সঙ্গে। জানিনা সবারই মায়া হতো কি না ছোটদার জন্য। সংসারের ব্ল্যাকশিপদের জন্য ঘরে বাইরে সবারই কিছু না কিছু ভালোবাসা, লক্ষ করেছি, থাকেই।