নির্বাসন আমাকে আমার সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। নানির ঋণ শোধ করতে দিচ্ছে না। মা বাবার ঋণ শোধ করতে দেয়নি। যাদের ভালোবাসি, তাদের সবার। কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে আমাকে নির্বাসন, আমার সেই শৈশব-কৈশোরের জীবন থেকে লক্ষ যোজন দূরে। যেন ভুলে যাই সব। কিন্তু আমি তো ভুলতে কাউকে পারি না। ছোট যে একটা বেলি ফুলের গাছ ছিল উঠোনে, সেটাকেও তো আজও ভুলতে পারিনি।
ছোটদার গল্প
বাবা বুনোহাতি নন, বাঘভালুক নন, ভুতপ্রেত নন, কিন্তু বাবার ভয়ে আমরা তটস্থ থাকতাম। বাবা একটা জগত চাইতেন, যেখানে কেউ কোনও ভুল ত্রুটি করতে পারে না।
ছেলে মেয়েরা সারাদিন এবং সারারাত পড়ার টেবিলে বসে থাকে, বইয়ের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত মুখস্ত করে ফেলে। নাওয়া খাওয়া, পেচ্ছাব পায়খানা, ঘুম নিদ্রা ইত্যাদিতে অতি সামান্য সময় ব্যয় করে, যতটুকু না হলেই নয়। জ্ঞান বর্ষণ করতেন সংস্কৃত শ্লোক আওড়ে, ছাত্ৰানাম অধ্যয়নম তপঃ। বড় বড় মাঠ ছিল বাড়ির সামনে, সেসব মাঠে খেলতে নামার স্বাধীনতা শৈশব কৈশোরে আমাদের ছিল না। বাবা ভাবতেন, ছেলে মেয়েরা বিলেত পাশ করা বড় বড় ডাক্তার হবে। ও হতে গেলে খেলাধুলা, হাসি তামাশা, আড্ডা গুলতানি সব জন্মের পর থেকেই নিষিদ্ধ করে দিতে হয়। পড়ালেখা ছাড়া আর সব কাজকেই বাবা বাজে কাজ বলে মনে করতেন। নিজে ছিলেন নামকরা ডাক্তার। ভালো ডাক্তার। অবিশ্বাস্য মনোবল আর অধ্যবসায়ের কারণে এক গহীন গ্রামের ছেলে শহরের বড় ডাক্তার বলতে পারে। না, আজ আমি আমার বাবার গল্প বলবো না। আজ বলবো ছোটদার গল্প। ছোটদা আমাদের বাড়িতে প্রথম বিপ্লব করেছিল। বাবার পায়ের আওয়াজ পেলে প্যান্টে পেচ্ছাব করে দিত বড়দা। সেখানে কি না ছোটদা বাবাকে দিয়ে নিজের জন্য একটা গিটার কিনিয়ে নিয়েছিল। আজও আমার ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে, কী করে তা সম্ভব হয়েছিল। ছোটদার কারণে আমাদের বাড়িতে প্রথম কোনও বাদ্যযন্ত্র এলো।
বই খাতা কলম পেনসিলের বাইরে প্রথম একটা জিনিস কিনলেন বাবা। হিমালয় নাড়িয়েছিল ছোটদা। এরপর এলো ক্রিকেটের ব্যাট বল। ছোটদা নেমে পড়লো রাস্তায়, ৬৯এর গণআন্দোলন তখন তুঙ্গে, পুলিশের গুলি চলছে, কাফু চলছে, ওসবের মধ্যে। বাবা জানলে পিঠের চামড়া তুলে ফেলবে, জানার পরও। ছোটদার কাণ্ড দেখে ভয় লাগতো। ভাবতাম, যে কোনো সময় ছোটদা বুঝি পুলিশের গুলি খেয়ে মরবে।
গিটার তো হলো, এরপর ছোটদা বাড়িতে আরও একটা জিনিস নিয়ে এলো, যেটাও আনা সম্ভব বলে কেউ কল্পনা করতে পারেনি। শহর টই টই করে ঘুরে বেড়ানো ছেলে ছোটদা। ছোটদার পক্ষেই সম্ভব ছিল। বিরাট একটা অ্যালসেসিয়ান কুকুর নিয়ে বাড়ি এলো ছোটদা। কুকুরের নাম রকেট। রকেট খেলা দেখায়, সোফায় ঘুমোয়, হ্যাঁণ্ডসেক করে। এক বিদেশি পাত্রী দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। যাওয়ার সময় তার কুকুরটা দিয়ে গেছে ছোটদাকে। আমাদের কাছে তখনও পোষা কুকুর মানে, যে কুকুর সারাদিন শেকল বাঁধা থাকে, রাতে খুলে দেওয়া হয় চোর তাড়ানোর জন্য। ছোটদার কারণেই একটা অ্যালসে সিয়ান দেখা হল। ওই অ্যালসেসিয়ানটা বাড়িতে থাকাতে ওর ওপর বড় মায়া জন্মেছিল! এই যে এখন আমি প্রাণী জগতের সব পশুপাখির অধিকার নিয়ে কথা বলি, বা বাড়িতে বেড়াল কুকুর পুষি, তার শুরুটা ওই রকেট, ওই অ্যালসেসিয়ানটাই করে দিয়েছিল। এখন যে কুকুরই পুযি, তার নাম রকেট রাখি। মনে আছে ছোটদার ওই রকেটটা যেদিন মারা গিয়েছিল, জন্মের কাঁদা কেঁদেছিলাম। এরপর ছোটদা আরও দুটো ভয়ংকর নিষিদ্ধ কাজে নিজেকে জড়িয়েছিল। এক, রাজনীতি করা। দ্বিতীয়, প্রেম করা। ছাত্র ইউনিয়ন করে বেড়াতো। প্রেম করে বেড়াতো। বাড়িতে কারও এসব করা তো দুরের কথা, কল্পনা কারও সাহস হয়নি। ছোটদার চেয়ে বেশি বয়সী বড়দা তখনও প্রেম করার কথা ভাবতেও পারতো না। সবচেয়ে সাহসী কাজ বড়দার পক্ষে যেটা করা সম্ভব হয়েছিল, তা হলো ঘরের কোনে বসে প্রেমের পদ্য লেখা। ছোটদাই ছোট ছোট রেভুলুশনগুলো করতো। একসময় সে পালিয়ে গিয়ে বিয়েও করে ফেললো। সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। ছেলে বিয়ে করেছে। কোথায় বাবা ভেবেছিলেন, বড়দার চেয়ে মাথায়-ভালো পড়াশো নায়-ভালো ছোটদা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র হবে, আর নাক-টিপলে-দুধ-বেরোয়-ছেলে, সে কিনা করেছে বিয়ে, তাও আবার হিন্দু মেয়েকে! বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। বাড়িতে এনে শেকলে বেঁধে ছোটদাকে কয়েকদিন ধরে পেটালেন, কিন্তু লাভ হলো না কিছু। ছোটদা কিছুতেই তার কলেজের সহপাঠিনীকে, যাকে ফট করে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করেছিল, ছাড়েনি।
এই কাণ্ডগুলো ছোটদার মতো না বড়দা পারতো, না আমি পারতাম, না আমার ছোটবোন পারতো। ছোটদাই পেরেছিল। বিপ্লবী ছোটদা। বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা সে-ই বাঁধতো। তারপর যে সব বিপ্লব বাড়িতে ঘটিয়েছিলাম আমরা ভাইবোনেরা, সে ছোটদাকে দেখে শিখেই। আড়ষ্টতা, ভয়, দ্বিধা ছোটদাই কাটিয়ে দিয়েছিল। আমিও এক সময় প্রেম করতে শুরু করলাম ছোটদার মতো, আমিও কাউকে না জানিয়ে ফট করে একদিন বিয়ে করে বসলাম ছোটদার মতো। আমার ছোটবোনও তাই করলো। শুধু বঙ্গাটা একটু বেশি ভীতু ছিল বলে বাবার মারের ভয়ে না পেরেছে কারও সঙ্গে প্রেম করতে, না করতে পেরেছে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে বিয়ে।