ছোটবেলায় যে কত রকমের মাছ খেতাম। সব মাছের নাম মনেও নেই। ভালো লাগতো ইলিশ চিংড়ি কই রই মাগুর খেতে। চিংড়িকে অবশ্য মাছ বলা যাবে না, কিন্তু চিংড়ি মাছ নয়, ভাবলে কেমন যেন দুঃখ লাগে। রুই ছিল তখন মাছের রাজা। এখন যেমন বারোয়ারি হয়ে গেছে, তেমন ছিল না। সত্যি বলতে, গত কয়েক বছর যে। মাছকে আমি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলি, সে হলো রুই। কলকাতায় থাকাকালীন রুইএর ওপর এই অনীহাটা আমার জন্ম নিয়েছে। যেদিকে যাই, যেখানে তাকাই, শুধু রুই, রুই আর রুই। খেতে খেতে রুইয়ের স্বাদ একসময় বিচ্ছিরি লাগতে শুরু করলো। মনে। হতে লাগলো যেন ঘাস খাচ্ছি। কলকাতায় যদুবাজার, গড়িয়াহাট, আর মানিকতলা থেকে কত রকমের যে মাছ কিনতাম আমি। এত বিচিত্র মাছ দেশের বাজারেও হয়তো দেখিনি। অবশ্য দেশের বাজারে কদিন আর গেছি। আমাদের সময় মেয়েদের মাছের বাজারে যাওয়ার চল ছিল না। মাগুর নামটা যদিও আমার ভালো লাগে না, মুগুর মুগুর লাগে শুনতে, কিন্তু খেতে ভালো লাগতো, বিশেষ করে মা যখন ধনে পাতা আর টমেটো দিয়ে মাছের পাতলা ঝোল করতো। একবার কী একটা কবিতায় আমি মাগুর মাছের নাম উল্লেখ করেছিলাম, তাই নিয়ে কিছু কবি নাক সিঁটকেছিল। কবিতায় মাগুর কেন আসবে, ইলিশ আসতে পারে, চিতল আসতে পারে। মাগুর শব্দটা নাকি কবিতাকে নষ্ট করে দেয়। ওদের কথায় আমি কিন্তু আমার এই কবিতা থেকে মাগুর মাছ বাদ দিইনি। ভেটকি শব্দটা বড় বিচ্ছিরি লাগতো। কলকাতায় তাই ভেটকি আমি প্রথম প্রথম একেবারেই কিনতাম না। রেস্তোরাঁয় আর বন্ধুদের বাড়িতে খেতে খেতে একসময় টনক নড়লো, বাহ, এ তো বেশ সুস্বাদু মাছ হে। এরপর থেকে ভেটকি কেনা শুরু হলো আমার। এখনও কিনি। কলকাতার লোকেরা, খুব অবাক হতাম, রূপচাঁদা মাছকে কেন পমফ্রেট বলে। ফরাসি ভাষায় আলুভাজাকে পমফ্রেট বলে। পমফ্রেট নামটা কোত্থেকে এলো হদিস করতে গিয়ে দেখলাম, এসেছে প্যামফ্লেট থেকে। পর্তুগিজ ভাষায় কোনও কোনও মাছকে প্যামো বলে। সেই প্যামোটাই সম্ভবত উৎস। পমফ্রেট সমুদ্রের মাছ। সমুদ্রের মাছ, জানি না কেন, নদী আর পুকুরের মাছের মতো সুস্বাদু হয় না। নাকি মিঠেপানির মাছ খেতে খেতে আমাদের জিভটাই মিঠেমিঠে হয়ে গেছে। রূপচাঁদা নামটা আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু সমুদ্রের মাছ বলেই হয়তো খেতে কখনই খুব ভালো লাগেনি। ঠিকমনে নেইমা কী করে রূপচাঁদা রান্না করতো। ভাজতো বোধহয়। ভাজলে অবশ্য অনেক বিস্বাদ জিনিসেও স্বাদ চলে আসে।
মানি আর না মানি, আমরা আমাদের শৈশব-কৈশোরকে সারা জীবন সঙ্গে নিয়ে বেড়াই। বড় হই, কিন্তু বড় হই না। নানির বাড়িতে পিঁড়ি পেতে বসে বা মেঝেয় মাদুর বিছিয়ে যে খাবারগুলো খেতাম, সেগুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার এখনও। মাটির চুলোয় ফুকনি খুঁকে শুকনো ডাল পাতা জ্বালিয়ে মা যা রান্না করতো, সেই রান্নাই এখন অবধি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রান্না। আজকালকার অত্যাধুনিক ইলেকট্রিক স্টোভে, ওভেনে, গ্যাসে রান্না করা খাবার খেয়েছি, কিছুই মার ওই মাটির চুলোর রান্নাকে ডিঙোতে পারেনি। এ কি মাকে ভালোবাসি বলে বলি? না, মাকে কোথায় আর ভালোবাসলাম! মা তো ভালোবাসা না পেতে না পেতেই একদিন চিরকালের জন্য চলে গেল। বড় অভিমান ছিল মার। একটা কী ভীষণ দুঃখের জীবনই না কাটিয়েছে মা। আমার বোনটাও। অনেকটা মায়ের মতোই জীবন ওর। বোনটা দেখতে মায়ের মতো নয়, আমি দেখতে অবিকল মা। কিন্তু আমার জীবনটা মায়ের জীবনের চেয়ে অন্যরকম। সংসারে দুঃখ কষ্ট সওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছি আমি, কিন্তু মা যেমন নিজেকে বাঁচাতে পারেনি, বোনটাও পারেনি।
মার নানারকম গুণ ছিল, কিন্তু মার গুণগুলোকে কখনো গুণ বলে মনে হতো না। মা বলেই সম্ভবত। মাদের আমরা মা বলে মনে করি, ঠিক মানুষ বলে মনে করি না। মাদের গুণগুলো দেখি, কিন্তু না দেখার মতো করে দেখি। রান্না ছাড়াও নানির অসাধারণ সব গুণ আছে। কিন্তু কজন নানিকে সেসব বলেছে, নানির ছেলেমেয়েরা কেউ কি তার প্রশংসা করেছে কখনও? আমার মনে হয় না। মা যে বেঁচে থাকতে তার অজস্র গুণের জন্য একটিও প্রশংসা বাক্য শোনেনি সে আমি জানি। মা না হয় আজ আর নেই। নানি তো আছে। যে নানির রান্না করা বোয়াল মাছের ঝোলের মতো ঝোল না হলে দাদা বোয়াল মাছ খায় না, সেই নানিকে কদিন দাদা দেখতে গেছে? এক শহরেই তো থাকে। কদিন নানির শিয়রের কাছে বসে পুরোনোদিনের গল্প করেছে? সম্ভবত একদিনও নয়। যদি গিয়ে থাকে কখনও, নিজের কোনও স্বার্থে গিয়েছে। নানি হয়তো আর বেশিদিন নেই। দেশ থেকে ফোন এলে বুক কাঁপে এই বুঝি শুনবো নানি আর নেই। আমাদের। ছোটবেলাটা নানির বাড়িতে কেটেছে। দাদাকে যখন জন্ম দিয়েছিল মা, মা তখন অল্প বয়সী কিশোরী। মার পক্ষে একা ছেলে বড় করা সম্ভব ছিল না। নানি সাহায্য করতো। এখন দাদার সময় নেই নানির কাছে যাওয়ার। আমি যদি দেশে থাকতাম, আমি নিশ্চয়ই নানিকে খুব ঘন ঘন দেখতে যেতাম। মানুষের থাকা আর না থাকার মধ্যে পার্থক্যটা আমি খুব ভালো করে জানি এখন। মা ছিল, মা নেই। বাবা ছিল, বাবাও নেই। পর পর বেশ কিছু খালা মামা, যাদের কাছে ছোটবেলায় মানুষ হয়েছি, চলে গেছে। নানি। এখনও আছে। হীরের মতো বেঁচে আছে। যতদিন নানি আছে, তার থাকার উৎসবটা তো হওয়া চাই। সারা জীবন কেবল দিয়েছে নানি, নানিকে দেবার কেউ নেই। মেয়েদের জীবনটা যেন কেবল দিতে দিতে নিঃস্ব হওয়ার জন্যই, নিঃস্ব হতে হতে মরে যাওয়ার জন্যই। যেন কিছু পাওয়ার জন্য নয়। নানির মস্তিষ্ক এখনো সতেজ, এখনও স্মৃতিশক্তি ভালো। কিন্তু হলে কী হবে, বাড়ি ভর্তি মানুষ, শুধু নানির ঘরটায় কারও আনাগোনা নেই। সবাই অপেক্ষা করছে নানির মৃত্যুর। মানুষ উদার হতে পারে ঠিক, তার চেয়ে শতগুণ বেশি নিষ্ঠুর হতে পারে।