গত পরশু কয়েক লক্ষ লোককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আমি ইসলাম বিরোধী সুতরাং আমাকে শাস্তি পেতে হবে। আমাকে আল্লাহ শাস্তি দেবেন, এটা এরা বিশ্বাস করে না। আমি ইসলাম মানি না বলে এরা আমাকে শাস্তি দিতে চাইছে, আল্লাহর শাস্তির ওপর ভরসা করছে না। আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি এদের আস্থা থাকলে হাশরের ময়দানে আল্লাহর হাতে আমার বিচারের ভার ছেড়ে দিত এরা। আল্লাহর বিচারে আস্থা নেই বলেই উলেমারা আমার বিচার চাইছে, আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে অথবা মেরে ফেলে। একটি গণতান্ত্রিক দলও একবারও বলেনি, উলেমারা অন্যায় আবদার করছে। কারও সাধ্য নেই উলেমাদের কথার ওপর কথা বলে এই ভারতবর্ষে। আমি একা, আর ওদিকে কয়েক লক্ষ উলেমা আর মুসলিম মৌলবাদী। সরকার বা রাজনৈতিক দল কার পক্ষ নেবে? সহজেই অনুমান করা যায়। এত যে বলা হয় বিজেপি আমাকে সমর্থন করে, কোথায় বিজেপি! আমার কোনো দুঃসময়ে বিজেপি আমাকে সমর্থন করেনি বরং বিরোধিতা করেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমাকে যখন রাজস্থানে পাঠিয়ে দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার, রাজস্থানের বিজেপি সরকার আমাকে ছয় ঘণ্টাও থাকতে দেয়নি রাজস্থানে। ভোর হওয়ার আগেই আমাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়েছে এই বলে যে আমি রাজস্থানে আছি জানলে রাজস্থানের মুসলমানরা খুব রাগ করবে। মুসলমানের ভোট বিজেপিও চায়। বিজেপিতে মুসলমান সদস্যের সংখ্যাও অনেক। কেন্দ্রে বিজেপি থাকাকালীন তো আমাকে দুই হাজার সালে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, কারণ বোম্বের মুসলমান মৌলবাদীরা আমার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল। শেষ পর্যন্ত ইসলাম সম্পর্কে একটি শব্দ উচ্চারণ করব না এই মর্মে মুচলেকা দেওয়ার পর আমাকে মাত্র তিন দিনের ভিসা দিয়েছিল বিজেপি সরকার শুধু কলকাতা থেকে আনন্দ পুরস্কার আনার জন্য। নির্বাচন আসছে, আমার ওপর আক্রমণ বাড়ছে। আমার সিরিয়াল বন্ধ হয়ে গেল। মামলা জারি করা হলো। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো। এফ আই আর হলো। এখন দেশ ছাড়ার ফতোয়া। শুধু তাই নয়, সন্ত্রাসীরা তো ওতপেতে আছে আমাকে প্রাণে মেরে ফেল্লার জন্য। মেরে ফেললেই নাকি বেহেস্ত। এত সহজে বেহে স্তের টিকিট কে পায়। এ যাত্রা বেঁচে যেতে পারব কি না জানি না। একজন মানবতন্ত্রী লেখককে হতে হলো উপমহাদেশের রাজনীতির ফুটবল। তাকে লাত্থালাত্থি করবে রাজনীতিকরা, এক জায়গা থেকে লাথি মেরে আরেক জায়গায় পাঠিয়ে দেবে। সেই জায়গা থেকেও আবার কেউ লাথি মারবে। এতে নাকি ভোট নিশ্চিত হয়। জনগণের অন্ন বস্ত্রের জন্য, স্বাস্থ্য শিক্ষার জন্য, সন্ত্রাসমুক্ত দুর্নীতিমুক্ত দেশের জন্য রাজনীতিটা আর নয়। কাকে ফাঁসি দিলে কার ভোট জুটবে, কাকে দেশে ঢুকতে না দিলে, কাকে দেশ থেকে বের করলে, কাকে অত্যাচার করলে, কার অনিষ্ট করলে কত ভোট জুটবে সেই হিসেবই করে রাজনীতিকরা। কোনো ভালো কাজ করে নয়, মন্দ কাজ করে, অন্যায় করে, অন্যের ওপর অত্যাচার করে এরা ভোট পাওয়ার ফন্দি আঁটে। উপ মহাদেশের এই গণতন্ত্রের করুণ দশা দেখে চোখে জল আসে। এ কি গণতন্ত্র নাকি মাফিয়ারাজ?
ছোট একটা বেলি ফুলের গাছ ছিল উঠোনে
সেদিন বোয়াল মাছ কিনলাম। বোয়াল মাছ হয় আমি খুবই কম কিনেছি জীবনে অথবা প্রথম কিনলাম। খাইনি তা নয়। ছোটবেলায় খেয়েছি। বাবা কিনতো। বোয়াল নামটা আমার পছন্দ হত না বলে খেতে তেমন ইচ্ছে করতো না। স্বাদটাও খুব কিছু আহামরি ছিল না। বড়বেলায় তাই আর শখ করে বোয়াল কিনিনি। কিন্তু সেদিন বোয়ালটা কিনলাম সম্ভবত এই কারণে যে ছোটদা কিছুদিন আগে বোয়ালের গল্প বলছিল। বলছিল, সপ্তা-দু-সপ্তাআগে নাকি দেশের বাড়িতে বোয়াল রান্না হয়েছিল, কারণ দাদার। খুব বোয়ালের মাথা খাওয়ার শখ হয়েছিল। খেতে গিয়ে দাদী চেঁচামেচি করেছে, কী, রান্না ভালো হয়নি। পরদিন আবারও বোয়াল রান্না হল, দাদা সেদিনও রাগ করলো। দাদার এক কথা, ঝোলটা শুধু ঘন নয়, একটু আঠা আঠাও হতে হবে, নানি রান্না করলে ঠিক যেমন হতো। এখন নানি কী করে রান্না করতো তা বৌদি বা বাড়িতে আর যারা রান্না করে, তাদের জানার কোনও কারণ নেই। আর ঠিক ওরকম আঠা আঠা ঝোল যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ দাদা ভাত মুখে দেবে না। এর নাম কী? স্মৃতিকাতরতা? পাগলামো? যে নামেই ডাকি না কেন, ভেতরে ভেতরে বুঝি, আমারও হয় এমন। দাদা রাগ করতে পারে, আবদার করতে পারে, তার বাড়ি ভর্তি লোক। আমার তো সেরকম নয়। গোটা বাড়িতে আমি একা। কুড়ি বছর আগে, দেশ ছেড়ে, দেশের মানুষজন ছেড়ে, যখন সম্পূর্ণ একটা নতুন পরিবেশের মধ্যে এসে পড়েছিলাম, আমাকে একা বাজার করতে হতো, একা রান্না করতে হতো, অথচ রান্নাটাই কোনওদিন আমার শেখা হয়নি। দেশে। সেই সময় কাঁচা হাতে রান্না করতাম, শুধু লক্ষ্য রাখতাম, মার রান্নার মতো হচ্ছে কী না। মার রান্নায় যে স্বাদ হতো, আমার রান্নায় সেই স্বাদ না আসা পর্যন্ত নিজের রান্নাকে কোনওদিন ভালো রান্না বলিনি। সেই যে শুরু হয়েছিল, এখনও তাই চলছে। ছোটবোনের বেলাতেও দেখেছি ওই একই, রান্না যদি করে, মার মতো রান্না তার করা চাই। আমার চেয়ে ঢের বেশি ও জানে মার স্বাদের কাছাকাছি স্বাদ আনতে। ওর বাড়িতে কদিন থাকলে ওজন আমার দুতিন কিলো বাড়বেই। জিভে কী করে এত কাল আগের স্বাদটা লেগে থাকে জানি না। আসলে জিভের ব্যাপার তো নয়, এ মস্তিষ্কের ব্যাপার। মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষগুলোয় কী করে যে সব গাঁথা হয়ে থাকে। দাদার ওই আঠা আঠা ঝোলের বোয়াল মাছের মাথা খাওয়ার ছেলেমানুষী আবদারকে ঠিক দোষ দিতে পারি না। সেদিন বোয়াল কিনে আমিও তো ঠিক ওই আঠা আঠা ঝোলটাই বানাতে চেষ্টা করেছি।