এই কেয়ামত-বিশ্বাসীদের আমার নিতান্তই শিশু বলে মনে হয়। শিশু-আর্মি যেমন ভয় পেতাম, এরাও ঠিক সেরকম ভয় পায়। বিজ্ঞান সম্পর্কে আমিও ছোট বেলায় তত জানতাম না। এরা বড়বেলাতেও জানে না। শরীরটা বড় হয়েছে বটে, তবে এরা পৃথিবী কেন, পৃথিবী কী, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কবে থেকে, বিবর্তন কী, এসব কিছুই জানতে জানতে বেড়ে ওঠেনি। অজ্ঞতা আর অবিজ্ঞানের সঙ্গে এদের গভীর বসবাস। তারপরও অবশ্য বেশ সুখে শান্তিতেই এরা বাস করছে। সুখ শান্তি বড় জটিল জিনিস। অনেকটা মাছের মতো। কেউ হাত বাড়ানোর আগেই পেয়ে যায়, কেউ বঁড়শি হাতে সারাদিন বসে থাকে, মাছের দেখা মেলে না।
গণতন্ত্রের করুণ দশা
বাংলাদেশের কারো সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করি, দেশের কী অবস্থা। বেশির ভাগই বলে, যেমন চলছিল তেমন। কেউ কেউ বলে, সংঘর্ষ খুন হরতাল লেগেই আছে। মাঝে মাঝে বুঝি না, কী করে দেশটা চলছে। অল্প কিছু রাজনীতিক আর ধনীদের হাতে দেশ। তাদের যা মন চায়, তাই তারা করছে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ দুর্দশা নিয়ে ভাববার সময় খুব বেশি কারোর নেই। শুনেছি খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি করা। হয়েছে, গৃহবন্দি করে বা বন্দি করে কোনো সমস্যার কি সত্যিকারের সমাধান হয়। খালেদা জিয়া যদি সন্ত্রাসের পথ দেখিয়ে থাকেন, তবে তার অন্ধ অনুচরেরা সেই সন্ত্রাসের পথেই যাবেন, খালেদা জিয়া বন্দি থাকুন বা নাই থাকুন। পয়গম্বরদের। ক্ষেত্রে এমন হয়, তারা বাঁচুন বা মরুন, তার অনুসারীরা তার মতকে বংশ পরম্পরায় অনুসরণ করে যায়। বেশির ভাগ মানুষই যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে পথ চলে না। ওপরওয়ালা বা ওপরতলার লোক যা যা আদেশ করে, অক্ষরে অক্ষরে সেই আদেশ মেনেই তারা চলে। এভাবে চলতে চলতে মস্তিষ্কের ভেতরে চিন্তা করার, যুক্তি দিয়ে বিচার করার যে কোষগুলো আছে, সেগুলো শেষ অবধি অকেজোই হয়ে যায়। দীর্ঘকাল যে কোনো কিছুকে অকেজো বসিয়ে রাখলে এমনই হয়। কিন্তু এটিই শেষ কথা নয়, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে কিন্তু যুক্তিহীন মানুষগুলো যুক্তি বুদ্ধি ঠিকই খাটাচ্ছে, শুধু একটি দুটি ক্ষেত্রে একেবারেই যুক্তি বুদ্ধির বালাই নেই, বুদ্ধির মুক্তির কোনো ব্যবস্থাই ওতে নেই। কম্পার্টমেন্টালাইজেশন একেই বলে। মস্তিষ্কের এক কোঠার সঙ্গে মস্তিষ্কের আরেক কোঠার কোনো সম্পর্ক থাকে না।
গত পরশু কয়েক লক্ষ উলেমা ভারতের উত্তরপ্রদেশের এক দরগায় গিয়েছিল, প্রতিবছরেই যায়, কোনো একটা পীরের জন্মোৎসব মহা ঘটা করে করে। সেখানেই এক মুসলিম মৌলবাদী নেতা কয়েক লক্ষ উলেমাকে জিজ্ঞেস করল, তারা রাজি আছে কি না তসলিমাকে ভারত থেকে বের করে দিতে। সকলেই হাত তুলে তাদের সমর্থন জানিয়েছে।
সরকার তাদের দাবি না মানলে তারা জানিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট অবধি যাবে। আমাকে শহর থেকে বা রাজ্য থেকে বা দেশ থেকে বের করে দেওয়া নতুন নয়। বাংলাদেশ প্রথম শুরু করেছে এই অন্যায়টি। এরপর এটি সংক্রামক হয়ে গেছে। অন্যায় অত্যাচার দুর্নীতি দুঃশাসন খুব সংক্রামক। একবার তুমি লাথি খেলে তুমি ক্রমাগতই লাথি খাবে। এক শাসক তোমাকে এক ঘরে করে পার পেয়ে গেলে বাকি
শাসকও তোমাকে একঘরে করে পার পেতে চাইবে। ভারতের ভোট ব্যাংক রাজনী তিতে খেলার জন্য তসলিমা নামে একটা ট্রাম্প কার্ড বানানো হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। এই কার্ডটা সবারই হাতের মুঠোয় অথবা বুক পকেটে। মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্য অন্য কার্ড তো খেলাই হয়, তসলিমা কার্ডও খেলা হয়। তসলিমা কার্ড খেলতে হয় তসলিমাকে মেরে ধরে গৃহবন্দি করে তার বিরুদ্ধে মিথ্যে বদনাম ছড়িয়ে, তার বই নিষিদ্ধ করে, তার সিরিয়াল বন্ধ করে, তাকে দেশছাড়া করে। এটি করে মুসলমানদের তারা বুঝিয়ে দেয় যে তারা তসলিমাকে ঘৃণা করে। কে কত বেশি ঘৃণা করতে পারে তসলিমাকে, তার প্রতিযোগিতা চলে। যে যত বেশি ঘৃণা করতে পারবে, যে যত কষে লাথি দিতে পারবে তসলিমাকে, যে তাকে যত দ্রুত টেনে নিয়ে আবর্জনায় ফেলে আসতে পারবে, যে যত ভোগাতে পারবে তাকে, সে তত বেশি মুসলমানের ভোট পাবে। বাংলাদেশেও এই খেলা চলে। খালেদা জিয়া আমাকে দেশ থেকে বের করেছেন তো হাসিনা আমাকে দেশে ফিরতে দেবেন না। তসলিমাকে ঘৃণা করার প্রতিযোগিতা চলে দুই নেত্রীতে। কী যে বীভৎস এই প্রতিযোগিতা! গণতন্ত্রকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে গণতন্ত্র নিয়ে বড়াই করতে কারওর লজ্জা হয় না।
কয়েক লক্ষ উলেমা ঘোষণা করেছে, তসলিমাকে দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, তা না হলে সর্বনাশ। তসলিমার দোষ কী! তসলিমা এক ফতোয়াবাজকে ফতোয়া বাজ বলেছে, বলেছে যারা ফতোয়া দেয়, মানুষের মাথার মূল্য ঘোষণা করে, তারা মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করে না। কিন্তু উলেমারা ফতোয়াকে দোষের বলে মনে করে না, তারা মাথার মূল্য ঘোষণা করাটাকেও দোষের বলে মনে করে না। তারা মনে করে, এ আমার দোষ আমি ইসলামী ফতোয়া মানছি না, ইসলামে যা বিধান আছে তা অমান্য করে কার সাধ্য! এই ফতোয়ার বিরুদ্ধে যে যাই বলুক, কোনো রাজনৈতিক দল কোনো কথা বলবে না। কারণ তারা বিশ্বাস করে, উলেমাদের এই গণতন্ত্রবিরোধী, বাকস্বাধীনতা বিরোধী ফতোয়াকে যে সমর্থন জানাবে সামনের নির্বাচনে সে জিতবে। সামনে লোকসভা নির্বাচন। এখন থেকেই ভোটে জেতার ছলাকলা চলছে। উত্তর প্রদেশের সরকার এর মধ্যেই আমার বিরুদ্ধে একটা মামলা দায়ের করে ফেলেছে। উলেমাদের এই তসলিমা হঠাও-এ সমর্থন জানিয়ে উত্তরপ্রদেশের সরকার কেন্দ্রের সরকারকে জানিয়ে দেবে তসলিমাকে যেন দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়। আমাকে মেরে ফেললে দুটো মুসলিম ভোট পাওয়া যাবে বলে যদি তাদের বিশ্বাস হয়, আমার মনে হয় না আমাকে মেরে ফেলতে কেউ দ্বিধা করবে। পশ্চিমবঙ্গে থেকে সিপিএম আমাকে তাড়িয়েছে ভোটের জন্য, তৃণমূল আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না সেও ভোটের জন্য। আখেরে ভোট কিন্তু কারও জোটে না। কারণ তসলিমা ভোটের জন্য কোনো বিষয় নয়। বিষয় হলে আমাকে তাড়িয়ে সিপিএম ভোট পেতো মুসলমানের। তা তো পায়নি, বরং গোহারা হেরেছে। তারপরও দলগুলো বিশ্বাস করবে না যে তসলিমা কার্ড খেলে ভোটে জেতা যায় না। আর মুসলমানরা এত বোকা নয় যে, তসলিমা কার্ড খেললেই তারা এক পাল ভেড়ার মতো দল বেঁধে ভোট দিয়ে আসবে। কিন্তু মুসলমানদের যারা ভেড়া বলে ভাবে, তারাই আসলে তসলিমা কার্ড খেলে। এদের, এই মুসলিম তোষণকারীদের অবশ্য মুসলিমদের বন্ধু বলে ভাবা হয়। কেউ কেউ বলে, ইমামদের ভাতা দিয়ে, মসজিদ-মাদ্রাসা তৈরি করে, মুসলমানদের অন্ধকারে রাখার, মৌলবাদী বানাবার, অকেজো বানাবার সব ব্যবস্থাই করে রেখেছে। কেউ আবার বলে, মুসলিমদের জন্য বাড়তি সুযোগ-সুবিধে দিয়ে এরা আসলে হিন্দু মৌলবাদী তৈরিতে সাহায্য করছে। দুটোই সত্যি।