শ– আমার বাড়িটা কিন্তু আপনাকে ছাড়তে হবে।
ত–মানে? বাড়ি ছাড়ার প্রশ্ন উঠছে কেন?
শ–আসলে কী জানেন, খুব বেশি ভাড়া দেবে, এমন একজনকে পেয়েছি। তাঁকে কথাও দিয়েছি। এখন সামনের মাসেই সেই ভাড়াটেকে দিতে হবে বাড়ি।
ত– এরকম বললে তো হয় না। আমার তো কোনও একটা অ্যাপার্টমেন্ট পেতে হবে আগে। তা না হলে কোথায় যাবো।
শ– আপনি যদি এ মাসের মধ্যেই বাড়িটা ছেড়ে দেন, ভালো হয়। আপনার। অনেক বন্ধু আছে। তাদের খুঁজতে বলুন বাড়ি।
ত–ঠিক আছে, আমি বাড়ি খুঁজতে থাকি। পেলে আমি নিশ্চয়ই চলে যাবো।
শ– বুঝলেন তো, যে কম ভাড়ায় আপনি থাকছেন, এরকম ফ্ল্যাটে এত কম ভাড়ায় কেউ থাকে না।
ত– কত টাকা ভাড়া চাইছেন? যদি আমি দিই তত টাকা, তাহলে তো নিশ্চয়ই আমাকে বাড়ি ছাড়তে বলবেন না।
শ– এ বাড়ির ভাড়া পঞ্চাশ হাজার টাকা। তবে আপনার জন্য পঁয়তাল্লিশে রাজি হতে পারি।
চমকে উঠি। এত টাকা ভাড়া হয় নাকি! কুড়ি হাজার থেকে লাফিয়ে পঁয়তাল্লিশ হাজার! কখনও শুনিনি এমন।
ত– ভাড়া, যতদূর জানি, এক দুহাজার করে বাড়ানো হয়। এভাবে দ্বিগুণের বেশি কেউ কি বাড়ায়?
শ– আমাকে বাড়াতে হবে। আর কোনও উপায় নেই আমার। একজন যখন অত টাকায় ভাড়া নেবে বলেছে, তখন তো বসে থাকতে পারি না। কালই দেখতে আসবে বাড়ি।
ত– তা দেখুন। কিন্তু আমাকে আপনার সময় দিতে হবে, যতক্ষণ না আমি কোনও জায়গা পাচ্ছি।
শ– খুব হারি। ঠিক আছে?
এর কিছুদিন পর আবারও শর্মিলার ফোন। ওই একই কথা। বাড়ি ছাড়ুন। আবারও ফোন। প্রায়ই ফোন। প্রায় প্রতিদিন ফোন। বাড়ি ছাড়ুন।
.
বিনীত গোয়েল এক সময় খুব সমীহ করে কথা বলতেন। এখন ফোন করেন, তবে কণ্ঠস্বর বিনীত নয়, ভাষাও ভিন্ন, স্বর এবং সুর দুই-ই পাল্টে গেছে।
বি– আপনাকে কোথাও তো চলে যেতে হবে।
ত– মানে?
বি– শহরের অবস্থা খুব খারাপ। কিছুদিন বাইরে কোথাও থেকে আসুন।
ত–শহর তো ঠিক আগের মতোই। কিছুই তো দেখছি না অন্যরকম।
বি– বড় মিছিল বেরোবে আপনার বিরুদ্ধে।
ত– সে কারণে শহর ছাড়তে হবে কেন? অনেকের বিরুদ্ধে তো মিছিল বেরোয়, তারা কি তাই বলে শহর ছেড়ে চলে যায়?
বি– দেখুন, আপনার ভালোর জন্য বলছি। আপনি কি চান না আপনাকে আমরা নিরাপত্তা দিই? চারদিকে গণ্ডগোল শুরু হলে আমরা কিন্তু আপনাকে নিরাপত্তা দিতে পারবো না। নিরাপত্তা ছাড়া শহরে কী করে থাকবেন।
. অন্ধকার আমাকে গ্রাস করতে থাকে।
কলকাতা শাসন করছে মৌলবাদীরা!
রুশদিকে কলকাতায় আসতে দেওয়া হবে না। খবরটি যখন শুনলাম, সত্যি বলতে কি, আমি অবাক হইনি। অবাক হবো কেন, আমাকেও তো আসতে দেওয়া হয় না, শুধু কলকাতায় নয়, পুরো পশ্চিমবঙ্গেই আমার পা রাখা নিষেধ। সেই যে ২০০৭ সালে আমাকে তাড়ানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে, আজও আমি নিষিদ্ধ সেই রাজ্যে। শুধু আমার উপস্থিতিই নয়, আমার বইয়ের উপস্থিতিও নিষিদ্ধ। গত বছর কলকাতা বইমেলায় আমার বই নির্বাসন-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল করে দিয়েছে পশ্চি মবঙ্গ সরকার। যে মানুষের বাক স্বাধীনতার ওপর পঁচিশ বছর ধরে হামলা হচ্ছে, দুর্বিষহ নির্বাসন-জীবন যাপন করতে যে বাধ্য হচ্ছে, বাংলায় লিখেও বাংলায় যার ঠাঁই নেই, সাত-আটটি মাথার-দাম যার মাথার ওপর, শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে যাকে, সে কেন এক লেখককে কলকাতার সাহিত্যক-বৈঠকে উপস্থিত হতে বাধা দেওয়ায় চমকে উঠবে।
অবাক হইনি, কিন্তু রুশদিকে কলকাতার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া। তীব্র প্রতিবাদ করছি। প্রতিবাদ করেছি মকবুল ফিদা হুসেন, এ কে রামানুজন, জেমস লেইন, রহিন মিস্ত্রি, কমল হাসান-এর মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর যখন আঘাত এসেছে। যখনই ধর্মীয় মৌলবাদীরা কোনও কিছুর দাবি করে, সে দাবি যতই অন্যায় দাবি হোক, সরকারের মধ্যে তা-ই মেনে নেওয়ার একটা প্রবল প্রবণতা লক্ষ করেছি। অনেক সময় মৌলবাদীরা অখুশি হতে পারে বা ঝামেলা পাকাতে পারে এই ভয়ে আগ বাড়িয়ে সরকার-পক্ষ থেকে অনেক অযৌক্তিক এবং অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমার দ্বিখণ্ডিত বইটি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০৩ সালে যদি কিছু হয় ভয়ে নিষিদ্ধ করেছিলেন। রুশদিকে কলকাতায় আসতে বাধা দেওয়ার পেছনে সরকারের ওই যদি কিছুর ভয়ই কাজ করেছে।
কিন্তু এসব আর কতদিন? আর কতদিন মৌলবাদীদের, বিশেষ করে মুসলিম মৌ লবাদীদের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকবে সরকার, আর কতদিন ওদের অন্যায় আবদার মাথা নত করে মেনে নেবে? ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ, ভারত বাংলাদেশও নয়, পাকিস্তানও নয়, ওসব দেশের নড়বড়ে নাম কা ওয়াস্তে গণতন্ত্রের মত ভারতের গণতন্ত্র নয়। ভারত শিল্পে, শক্তিতে, শিক্ষায়, স্থিতিতে আজ উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভারত কেন নিজেকে মুসলিম মৌলবাদীদের স্বর্গরাজ্য হতে দিচ্ছে। হাতে গোণা কিছু মুসলিম মৌলবাদীকে খুশি করার জন্য অথবা ওদের ভয়ে আজ ভারতের সংবিধানকে (১৯ক ধারা) অপমান করতে দ্বিধা করছেন না, দেশকে হাজার বছর পেছনে ঠেলে দিতে আপত্তি করছেন না নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। এর ফলে গোটা মুসলিম সম্প্রদায়, আর গোটা ইসলামই যে অসহিষ্ণ বলে প্রমাণিত হয়ে গেল, তার দায় কে নেবে! কেবল নির্বাচনে জেতার হিসেব। দেশ গোল্লায় যাক, দেশের ভবিষ্যৎ গোল্লায় যাক, আমার নির্বাচনে জেতা চাই। প্রগতিবিরোধী, নারীবিরোধী, অর্বাচীন, অগণতান্ত্রিক, অশিক্ষিত, অসুস্থ, অসভ্য মৌলবাদীদের দাবি মেনে নিয়ে যারা আজ সভ্য শিক্ষিত প্রগতিশীল শিল্পী সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনতা হরণ কাছে, মৌলবাদীদের শক্তি এবং সাহস বাড়াচ্ছে, তারা দেশের এবং দশের শত্রু, এ কথা আমি বলতে পারি, জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বলতে পারি।
কেয়ামত
বয়স যখন আমার পাঁচ, তখন প্রথম শুনলাম দজ্জালের কথা। দজ্জাল আসছে কাল বা পরশু। এ মাসে, অথবা দুমাস বাদে। দজ্জাল এক একচোখা বীভৎস দানব। হাতের তলোয়ার হাওয়ায় ঘোরাবে আর কেটে ছিঁড়ে মানুষকে রক্তাক্ত করবে যতক্ষণ না তাকে আল্লাহ বলে না মানা হবে। ছোট-বড় সবাই আমাকে বলে দিল, দজ্জাল আমার ঈমান নষ্ট করার চেষ্টা করবে, কিন্তু আমি যেন তার মিঠে কথায় বা তেতো কথায় না ভুলি। যেন আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে না যায়, যে দজ্জালই স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। আমাকে দজ্জাল শত টুকরোয় কাটুক, তবু যেন অনড় থাকি। একটু নড়চড় হলেই কপালে দোযখ।