সে মানুষ আরও বলেছিলেন– এই মিথ্যা ধ্বংস হোক। যতদিন পর্যন্ত নারী-জাতি নির্যাতিত, যতদিন পর্যন্ত অত্যাচারী শ্রেণী বর্তমান, যতদিন পুঁজি ও শেয়ারের ওপর থাকছে ব্যক্তিগত মালিকানা, আর যতদিন ভূরিভোজিরা বাড়তি শস্যের জোরে ক্ষুধার্তদের গোলামি খতে বেঁধে রাখছে, ততদিন পর্যন্ত যারা সকলের জন্য স্বাধীনতা ও সাম্যের কথা বলে, সেই মিথ্যাবাদিরা নিপাত যাক। চাই নিপীড়িত নারীজাতির স্বাধীনতা ও সমান অধিকার চাই অত্যাচারীর বিরুদ্ধে পুঁজিপতির বিরুদ্ধে, চোরাবাজারী কুলাকের বিরুদ্ধে লড়াই।‘ (প্রাভদা ৬ নভেম্বর, ১৯৬৯)
পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, সে মানুষ বলেছিলেন–‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র শুধু গালভরা কথার, জমকালো বুলির, সাড়ম্বর প্রতিশ্রুতির আর স্বাধীনতা ও সাম্যের বড় বড় ধ্বনির গণতন্ত্র। কিন্তু কাজের বেলায় এই গণতন্ত্র মেয়েদের স্বাধীনতা-হীনতা ও অসাম্য, মেহনতী ও শোষিতের স্বাধীনতা-হীনতা ও অসাম্যকে আড়াল করে। ধ্বংস হোক এই জঘন্য মিথ্যা ! অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের মধ্যে, শোষক ও শোষিতের মধ্যে কখনও সাম্য হতে পারে না, নেই, হবে না। যতক্ষণ না পুরুষের আইনগত বিশেষ সুবিধা থেকে মেয়েরা স্বাধীনতা পাচ্ছে, যতক্ষণ পুঁজির কবল থেকে শ্রমিকের, এবং পুঁজিপতি, জমিদার ও বণিকের জোয়াল থেকে মেহনতী কৃষকের স্বাধীনতা না থাকছে, ততক্ষণ প্রকৃত ‘স্বাধীনতা’ হতে পারে না, নেই, হবে না।‘ (প্রাগুক্ত)
পৃথিবীর কিছু অসভ্য ও উন্মাদ মানুষ আজ সেই প্ৰণম্যকে পায়ের তলায় ফেলে নৃত্য করছে। প্রাচুর্য ও জৌলুসের মোহে অন্ধ উন্মাদের আজ সেই মহান মানুষের ভাস্কর্য ছড়ে ফেলে দিচ্ছে। গলায় দড়ি বেঁধে ওরা নামিয়ে ফেলছে সকল সন্মানিত স্মৃতি। ওরা ‘সমতাকে’ ছুঁড়ে নামাচ্ছে, ওরা ‘স্বাধীনতা’ নামাচ্ছে। ভুলুষ্ঠিত লেনিন, আপনি বলেছিলেন, ‘মেয়েদের সামাজিক জীবনের প্রত্যেকটি জাগরণ ও ক্রিয়াকলাপকে সাহায্য করা চাই যাতে তারা তাদের কুপমণ্ডুক, আত্মকেন্দ্রিক, ঘরোয়া ও সাংসারিক মনস্তত্ত্বের সঙ্কীর্ণতা ছাড়িয়ে উঠতে পারে। ভলাদিমির ইলিচ লেনিন, আপনি বলেছিলেন–দিয়াবতী মাসিমার মত মিউমিউ করা চলবে না, কথা বলা চাই জোর গলায়, যোদ্ধাদের মত, কথা চলা চাই পরিষ্কার করে। দেখিয়ে দিন যে আপনারা লড়াই করতে পারেন।‘ (ডঃ ক্লারা সেৎকিনের ‘আমার স্মৃতিতে লেনিন’)
আমরা তো লড়াই করতে শিখছিলাম মহামতি লেনিন। যে পুঁজিবাদ নারীকে ‘সাংসারিক বাঁদিগিরি’-তে ঠেলে দেয়, যে পুঁজিবাদ নারীকে ‘গণিকাবৃত্তি’-তে ঠেলে দেয়—আমরা সেই পুঁজিবাদের বিপক্ষে কথা বলছিলাম। ‘ঘরোয়া দাসত্ব’ থেকে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছিলাম, একই আদর্শ সামনে রেখে আমরা আপনার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলাম, আমরা বিশ্বাস করেছিলাম— ‘মেয়েদের দাবিয়ে রাখছে, শ্বাসরুদ্ধ করছে, বিমূঢ় করছে, হীন করে রাখছে খুঁদে সাংসারিক গৃহস্থালি, বেঁধে রাখছে তাকে পাকশালায় তার শিশুপালন-ঘরে, অমানুষিক রকমের অনুৎপাদক, তুচ্ছ, পিত্তি-জ্বালানো, মন ভোতা করা, হাড়-গুড়ানো কাজে অপচয় হচ্ছে তার শ্রম।‘ আমরা এই শৃঙ্খল থেকে নারীর মুক্তির স্বপ্ন দেখছিলাম। আমাদের সব স্বপ্ন, সব সাধ সব স্বাধীনতার গলায় দড়ি বেঁধে হেঁচকা টানে টানছে উন্মাদ শাসকেরা আর তাদের অসংখ্য লোভাতুর অনুসারী।
একদা সমাজতন্ত্র নামে পৃথিবীর কোনও কোনও দেশে একপ্রকার রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি ছিল। সমাজতন্ত্র এখন বিপর্যন্ত, বিকলাঙ্গ—এতে সভ্যতা ও মানবতার ক্ষতি কতটুকু হয়েছে, এতে তৃতীয় বিশ্বের ওপর সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের আশঙ্কা কতটা ভয়াবহ হল, তা হিসেব করে দেখিনি; কেবল একথা স্পষ্ট জানি নারীর বড় ক্ষতি হল। নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার জন্য কল্যাণকর একটি নীতি বা আদর্শের নির্মম মৃত্যু হল।
এখন ধুলোয় লুটোচ্ছে লেনিন, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। এখন চুড়ো থেকে খসিয়ে ফেলা হচ্ছে তার আপাদমস্তক। নারীকে পণ্য করবার বিরুদ্ধে, নারীর গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে, নারীর ক্ষুদ্র তুচ্ছ সাংসারিক দাসত্বের বিরুদ্ধে ইতিহাসে যে কণ্ঠটি সবচেয়ে সোচ্চার ছিল সে লেনিনের কণ্ঠস্বর, যে হাতটি সবচেয়ে কর্মঠ ছিল, সে লেনিনের হাত। অপদার্থ মানুষেরা আজ সেই ইতিহাসকে দলিত করছে—এতে ক্ষতি কার কত জানি না,তবে নারীর ক্ষতি সবচেয়ে বেশি।
আমরা, নারীরা আজ পতিত লেনিনের জন্য, পতিত আদর্শের জন্য, পতিত সাম্যের জন্য শোকস্তব্ধ মাথা নত করছি।
৭০. ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
সভ্যতার শুরু থেকে সমাজ ও ধর্ম মানুষকে পরিচালিত করেছে, আর সমাজ ও ধর্মের পরিচালক হিসেবে যুগে যুগে পুরুষরাই কর্তৃত্ব করেছে। সমাজ ও রাষ্ট্র তো বটেই, নারীকে সবচেয়ে বেশি অমর্যাদা করেছে ধর্ম। কোনও ধর্মের আশ্রয়ে নারীর ওপর অত্যাচার যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন কিছুটা সহনীয় করে বিধিনিষেধ আরোপ করবার জন্য নতুন ধর্মের আহ্বান আসে। বৌদ্ধ ধর্মের শুরুতে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচবার তাগিদে লক্ষ লক্ষ নারী ভিক্ষুণী সংঘে আশ্রয় নিয়েছিল। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী আগুস্ট বেবেল তার উওম্যান ইন দ্য পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার গ্রন্থে লিখেছেন–খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব হলে অন্য সব দুর্ভাগাদের মত নারীরাও তাদের দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য এই ধর্মের প্রতি খুব আগ্রহী ও অনুরক্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু খ্রিস্টধর্ম নারীর জীবন থেকে দুর্দশা দূর করতে পারেনি। এই ধর্ম নারীকে পুরুষের বশবর্তী হয়ে থাকতে বাধ্য করল। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল বলেছেন– ‘জেসাস ক্রাইস্ট নারীর অধিকার বলতে কিছু দেননি। দাসীবৃত্তি ছাড়া নারীর আর কোনও কাজই সমাজে ও ধর্মে নির্দেশিত হয়নি।‘