কিন্তু মুফতি ইজহারুল ইসলামের দুর্ভাগ্য এই যে, দেশের সরকার প্রধান এখন একজন মহিলা। কোনও কোনও বিজ্ঞ আলেমের তোয়াক্কা না করেই দেশের অধিকাংশ জনগণ এই মহিলাকেই নির্বাচিত করেছে।
মুফতি ইজহারুল ইসলাম যুক্তি দিয়েছেন, যেমন পুরুষরাই মহিলাদের তত্ত্বাবধায়ক শাসক, কারণ আল্লাহ তাঁদের এককে অপরের উপর (পুরুষকে নারীর উপর) প্রাধান্য দান করেছেন এবং এ কারণে যে, পুরুষরাই (নারীদের জন্যে) তাদের অর্থ সম্পদ ব্যয় করেন। (সূরা নিসা আয়াত ৩০)
আর যখন তোমাদের দুষ্টু লোকেরা আমীর শাসক আর মালদার ব্যক্তিরা কৃপণ হবে এবং তোমাদের যাবতীয় কার্যাবলি নারীদের হাতে সোপর্দ হবে, তখন এ পৃথিবীর পেট তার পিঠের তুলনায় (অর্থাৎ দুনিয়াতে না থাকাই) তোমাদের জন্য উত্তম হবে (তিরমিজি শরীফ, ২য় খণ্ড, ৫২ পৃষ্ঠা)
পুরুষরা যখন মহিলাদের আনুগত্য স্বীকার করবে তখন তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। (মুসতাদরক আল হাকীম ২৯১ পৃঃ ৪ৰ্থ খণ্ড)
উদ্ধৃত অংশগুলোকে যুক্তি হিসেবে দেখিয়ে মুফতি বলেছেন–ইসলামের এইসব মৌলিক বিধানগুলোর আলোকে রাষ্ট্রপ্রধান ও নামাজের ইমাম হওয়া উভয়টি সমানভাবেই মহিলাদের জন্য হারাম। শরিয়তের পরিভাষায় নামাজ পরিচালনা ও দেশ পরিচালনা উভয়টিকেই ইমামত বলা হয়। এই ইমামত কখনও পুরুষ ছাড়া নারীদের জন্যে বৈধ নয়। নামাজের ইমামতিতে পেশ মসল্লায় যেমন কোনও মহিলা দাঁড়িয়ে গেলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া মুসল্লীদের জন্য ফরজ ঠিক তেমনিভাবে রাষ্ট্র নামক বড় মসজিদের পেশ মসল্লায় কোনও মহিলা অধিষ্ঠিতা হয়ে গেলে তাকেও সরিয়ে দেওয়া সমস্ত মুসলিম জনসাধারণের জন্য ফরজ। খোদাদ্রোহিত না করে বি এন পি দেশ পরিচালনা করলে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়, তবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহিলা আমরা কখনও মেনে নিতে পারি না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম, পীর মোর্শেদ মাশায়েখ ও ইসলামি বুদ্ধিজীবিসহ সর্বস্তরের মুসলিম জনসাধারণের কর্তব্য হল মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দেশে যাবতীয় নারী নেতৃত্বের অবসান ঘটিয়ে একটি সত্যিকারের ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় জানমাল দিয়ে অংশগ্রহণ করা। তাহলে মূল কথাটি এই দাঁড়ায় যে, দেশে একটি হারাম নেতৃত্ব বিরাজমান। আজ পুরো একটি দেশের ইমামতি করছে নারী, এ হিসেবে নামাজের ইমামতি করা নেহাত তুচ্ছ ব্যাপার, দেশ পরিচালনা করছে নারী, একইভাবে দেশের মসজিদগুলোয় নামাজ পরিচালনার দায়িত্বও নারী নিতে পারে, গত মিলাদুন্নবীতে প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের পুরুষ ও নারী এক কাতারে দাঁড়িয়ে এবং বসে মিলাদ পড়েছে, এমন দৃশ্য এর আগে কল্পনাতীত ছিল, কল্পনার অতীত ঘটনাগুলোই এখন ঘটছে, ঘটবে। হারাম-হালালের সংজ্ঞাও সেই সঙ্গে পাল্টাচ্ছে।
নারী এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। পুরুষরা মহিলাদের আনুগত্য স্বীকার করায় মঙ্গল ছাড়া অমঙ্গল কিছু হয়নি। ওইসব ধ্যান-ধারণা এখন অমূলক, অচল, অযৌক্তিক। দেশের মানুষ ধর্মকে অন্তরে স্থান দিতে চায়, শাসন ব্যবস্থায় নয়, শরিয়তকে পুঁথির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চায়, শরিয়ত যদি উঠে এসে রাষ্ট্রনীতিতে আসন গাড়ে তবে জনগণ এত বোকা নয় যে এতে তাদের সমূহ বিপদের আশঙ্কা তারা করবে না। আশঙ্কা করে বলেই দেশের আশি ভাগ মানুষ ধর্মভীরু হয়েও আশি ভাগ ভোট কোনও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ভাগে পড়ে না। পড়ে শরিয়ত বিরোধী মহিলা নেতৃত্বের দিকে। শরিয়ত-এর কথা বলে জনগণকে বোকা বানাবার দিন ক্রমে শেষ হয়ে আসছে। তারা এখন নিজেরাই নিজেদের মঙ্গলের জন্য নীতি তৈরি করতে পারে, শরিয়তের সাহায্য ছাড়াই।
তারা ধর্মকে হেলা করছে না, কিন্তু শরিয়তকে মানছে না, তবে কেন এ-ই ধরে নিচ্ছি না যে ধর্ম আসলে চৌদ্দশ বছর আগের নানাবিধ তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতা ও তাবৎ আরবীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার উর্ধের্ব উঠে এমন এক স্তরে পৌঁছেছে যে, সততা ও মহত্ত্বের কথা ছাড়া বাকি অসততা ও অধর্মকে বর্জন করবার ক্ষমতা অর্জন করেছে মানুষ। এই সচেতন মানুষই এক সময় বিদ্যমান সকল শরিয়তি আইন বাতিল করে রাষ্ট্রে, সমাজে ও জীবনে কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে।
৬৯. স্মৃতিতে লেনিন
পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, সে মানুষ ধনী ও দরিদ্রের, নারী ও পুরুষের কোনও অসাম্য দেখতে চাননি। পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, প্রাতঃকালে স্মরণযোগ্য মানুষ–সে মানুষ বলেছিলেন–‘নারী-শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য শুধু নারীদের আনুষ্ঠানিক সমতা নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার জন্যও সংগ্রাম। প্রধান কর্তব্য হল মেয়েদের সামাজিক উৎপাদনশীল শ্রমে আকর্ষণ, ‘গার্হস্থ্য বাঁদিগিরি’ থেকে তাদের উদ্ধার, রান্নাঘর ও শিশুঘরের চিরন্তন আবহাওয়ার কাছে বিদঘুটে ও হীন আত্মসমপণ থেকে মুক্তি।‘ (প্রাভদা ৮ মার্চ, ১৯৯০)
পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, সে মানুষ বলেছিলেন–‘পৃথিবীর সমস্ত পুঁজিবাদী, বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রেই শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, স্বাধীনতা—এই সব জাকালো কথার সঙ্গে সঙ্গেই পুরুষদের জন্য বিশেষ সুবিধা, মেয়েদের জন্য হীনতা ও লাঞ্ছনার সব আইন অনুসারে জড়িয়ে থাকা নারীদের প্রতি আসাম্যের অভূতপূর্ব রকমের পৈশাচিক, জঘন্য রকমের নোংরা, পাশবিক রকমের কদর্য সব বিধি।‘