৪ ম্রিরিদা নাইত আতিক মরক্কোর কবি। ম্রিরিদা ছিলেন আজিলাল শহরের একজন গণিকা। চমৎকার গান গাইতেন তিনি, তার এই গানের খ্যাতি ছিল খুব। বাড়ির অভ্যাগতদের গান শোনাতেন ম্রিরিদা। তিনি গান লিখতেন পাহাড়ের সাদাসিধে মেয়েদের জীবনযাপন নিয়ে। যুদ্ধের পর, ম্রিরিদার তখন তিরিশ বছরও হয়নি তাকে আর গণিকালয়ে, মাকদাজে, এবং তার গ্রামের বাড়ি মরক্কোর এটলাস পাহাড়ের তাসাউকেও পাওয়া যায়নি। ১৯৫৯ সালে রেলে ইয়লোগ নামের একজন ফরাসী সৈনিক (যাঁর সঙ্গে ম্রিরিদার ভাল বন্ধুত্ব ছিল) তার কবিতার ফরাসী অনুবাদ প্রকাশ করেন।
ম্রিরিদার একটি কবিতার নাম ‘ধোঁয়ার মত’। কবিতাটি এরকম–পরিত্যক্ত মেয়েদের তুমি রক্ষা করো লাললা হালিমা (একজন মুসলমান সন্ন্যাসীর নাম লাললা হালিমা, তিনি অবিবাহিত মা’দের আশ্রয় দিতেন।)/কাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো কৃপালু ঈশ্বর? এই আমি, আমি কোনও পুরুষকে কখনও বিশ্বাস করব না তাদের প্রতিজ্ঞা ধোঁয়া এবং হাওয়ার মত/গোশাবক নিয়ে যখন চরাতে যাই মাঠ/সঙ্গীতজ্ঞের ছেলেটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল/একটা খচ্চরও কিন্তু অধিক পিপাসার্ত না হলে/অধিক জলও আর পান করে না।/সৈনিক লোকটি তার গুণের পদক নিয়ে দিব্যি বেঁচে থাকে/যতটা সে পেতে চায়, পেয়ে যায় অনেকের মত/শুধু ওই খচ্চরটি তৃষ্ণার্ত না হলে/কিছুতেই জল পান করতে চায় না/দশজন যুবক/দশজন বিপত্নীক/দশজন প্রৌঢ়/সবাই দিয়েছে আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি/কেউ কথা রাখেনি তাদের/তাদের সকল তৃষ্ণ মিটিয়েছি আমি/আর তারা পুনর্বার পান করতে গিয়েছে অন্য কোথাও/ককে তুমি বিশ্বাস করবে, কৃপাময় ঈশ্বর আমার / এই আমি, আমি কোনও পুরুষের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি না/তাদের সকল অঙ্গীকার ধোয়ার মত/ধোয়ার মত/ধোঁয়ার মত।
৫. কবি এডিথ সোডারগ্রাঁ ১৮৯২ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গে জন্মেছেন। সেখানে তার বাবা-মা সুইডিশভাষী জনগণকে নিয়ে একটি বিশাল দল গড়ে তোলেন। রাশিয়ার বিপ্লবের পর, এডিথ ও তার মা রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ফিনল্যান্ডে আশ্রয় নেন, সেখানে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তাদের দিন কাটে। হেলসিঙ্কিতে তার কবিতা প্রথম প্রকাশিত হবার পর হাতেগোনা ক’জন সমালোচক ছাড়া সবাই এর নিন্দ করে। এসময় এডিথ বিষম একা হয়ে পড়েন, কেবল তরুণ বিপ্লবী লেখিকা হ্যাঁগার অলসেন ছাড়া তাকে কেউ সঙ্গ দেয়নি। এই হ্যাঁগারই তরুণ ফিনিশ কবিদের কাছে এডিথের কবিতা পৌঁছে দেন। ১৯২৩ সালে যক্ষ্মা রোগে ভুগে এবং না খেতে পেয়ে কবি এডিথ সোডারগ্রা মারা যান। তার মৃত্যুর পর ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনে তিনি সুইডিশ কবিতার একজন সংস্কারক হিসেবে অভিনন্দিত হন এবং তার খ্যাতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।
এডিথ সোডারগ্রাঁর একটি কবিতার নাম—‘দুঃখ’ । সুখের কোনও সঙ্গীত নেই, সুখের কোনও ভাবনা নেই, সুখের কিছু নেই/সুখকে স্পর্শ করলে সুখ ভেঙে যায়, নষ্ট হয়/গহন ঘুমের মধ্যে ভোরের গুঞ্জনে ভেসে সুখ আসে/গাঢ় নীল ভাবনার ওপর তুলো মেঘের মত উড়ে যায় সুখ/ সুখ হল দুপুরের পোড়া রোদে ঘুমিয়ে থাকার অবারিত মাঠ/সুখের কোনও শক্তি নেই, সে কেবল ঘুমোয় এবং বেঁচে থাকে/ আর কিছুই জানে না, কিচ্ছু না…/তুমি কি দুঃখকে চেন? সে তার বজমুঠিসহ কিরকম শক্তিমান এবং বিশাল?/তুমি কি দুঃখকে বোঝ? সে তার রক্তাভ চোখ এবং চোখের জলসহ আশান্বিত হাসে/আমাদের যা যা প্রয়োজন, দুঃখ সকলি দেয়/মৃত্যুকুঠুরীর চাবি দেয়/সে দরজার দিকে ঠেলে দেয় আমাদের দ্বিধান্বিত দেহ/ …সে লোভী মেয়েমানুষের গলার অলঙ্কার খামচে ধরে/সে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে যখন পুরুষ তার ভালবাসা ফেলে রেখে চলে যায়…/সে মুক্তো এবং ফুল দেয়, সে গান এবং স্বপ্ন দেয়/ সে আমাদের সহজ চুম্বন দেয়, সকলই অদৃশ্য চুম্বন/সে আমাদের একটি কেবল চুম্বন দেয়, যেটি সত্যি/ সে আমাদের আশ্চর্য একটি হৃদয় এবং প্রচণ্ড আকাঙক্ষা দেয়/সে দেয় জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন/ভালবাসা, একাকীত্ব এবং মৃত্যুর সাদা মুখ ।
৬ রানী এলিজাবেথও (১৫৩৩-১৬০৩) কবিতা লিখেছেন। লিখেছেন–আমার কাছ থেকে আশা করা হয় অনেক কিছুই/অথচ আমার দ্বারা কোনও কিছু করা হয় না/রানী এলিজাবেথ তো বন্দিনী।
বন্দিনী কে নয়? জুয়ানা, ম্ৰিরিদা দেলমিরা, জুলিয়া, এডিথ কে নয়? গণিকা, গৃহিণী, ভিখিরি থেকে শুরু করে ইংলন্ডের রাণীও বন্দিনী। রাণী? যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই!
৫৮. শব্দের অপচয়
সাহিত্য করতে এসে ভালর চেয়ে আমার মন্দ কিছু কম হয়নি। অবশ্য সকল মন্দ অতিক্রম করে । যাবার সাহস আমার ছিল বলে সম্ভবত এখনও বেঁচে আছি, এবং বেশ স্পর্ধা করে এও বলতে পারি যে বেঁচে থাকব।
আমার বাবা, মা বরাবরাই আমার ওপর খুব অসন্তুষ্ট। আমার প্রতাপশালী বাবা কবিতার চেয়ে স্ট্যাটিক্স ডিনামিক্সের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাতেন, মেডিসিন সার্জারি মুখস্ত হলে আমার জন্য বুড়ি ভরে আঙুর আপেল কিনে আনতেন। আমার ধর্মান্ধ মা কবিতার চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন নামাজ রোজা। বিকেলটা অনর্থক লেখালেখিতে নষ্ট না করে কোরানের কিছু আয়াত পড়তে বলতেন।
একটি সাদা কাগজে কবিতা লিখে আমার বড় ভাইকে একদিন পড়তে দিয়েছিলাম। বড় ভাই বললেন—কাগজ দিয়ে এরোপ্লেন বানাতে জানিস? এই দেখ। বলে কাগজটিকে ভাঁজ করে এরোপ্লেন বানিয়ে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন।