হঠাৎই নিবু নিবু হয়ে গেছে আলোটা। শাসা অপারেট করেছে বাইরের সান শিল্ড। এবার সরাসরি উৎসের দিকে তাকানো যায়। একদম ছোট, একবিন্দু…আরো একটা নক্ষত্র। এর কোনো মাত্রাই বোঝা যায় না, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা-কিছুই না। ফ্লয়েড কিছুই করতে পারবে না এখন। কারো কিছু করার নেই। সামনের নক্ষত্রটাকে সূর্যের চেয়ে চারগুণ বড় দেখায় এখান থেকে।
শাসা দারুণ কাজ করেছে শিল্ডগুলো নামিয়ে দিয়ে। এক মুহূর্ত পরেই সেই ছোট্ট তারাটি বিস্ফোরিত হলো। কালো ফিল্টার থাকা সত্ত্বেও খালি চোখে দেখা অসম্ভব। কিন্তু আলোর আসল বিচ্ছুরণ মাত্র এক সেকেন্ডের কয়েক ভাগের একভাগ সময় স্থায়ী হয়। তারপর বৃহস্পতি…অথবা এককালে যেটা বৃহস্পতি ছিল সেটা আবার ছড়াতে শুরু করে।
বড় হচ্ছে। এর আগে যেমন ছিল তারচে বড় হচ্ছে। খুব দ্রুত আলোর ঝলক হারিয়ে যেতে যেতে সূর্যের মতো নিষ্প্রভ হয়ে যায় এক সময়। এবার ফ্লয়েড বোঝে যে এটা এক ফাঁপা গোলক। এর ভিতরের তারাটাকে দেখা যাচ্ছে এখনো।
খুব দ্রুত সে একটা হিসাব করে ফেলল মনে মনে। শিপটা বৃহস্পতি থেকে এক আলোক মিনিট থেকেও দূরে। সেই বিস্ফোরিত শেলটা এখন প্রান্তে উজ্জ্বল আংটির আকার নেয়। সেটা এর মধ্যেই দখল করেছে সামনের আকাশের চারভাগের একভাগ। তার মানে এটা তাদের দিকে এমন একটা গতি নিয়ে…মাই গড!-আলোর গতির প্রায় অর্ধেক গতিতে! একটু পরই শিপকে গিলে নেবে।
শাসার প্রথম ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলেনি। কোনো কোনো সময় মন হার মেনে নেয়। সামনে থেকে সবকিছু বাদ দিয়ে নিজের ধ্বংসটাকে দেখে আশ্চর্য চোখে। যে লোক তার উপর আসতে থাকা জলোচ্ছ্বাস অথবা ঝড়ের চোখের দেখা পায় সে আর পালিয়ে বেড়ানোর কোনো চেষ্টাই করে না। সে শুধু তার চোখের দেয়া খবরটাকে অবিশ্বাস করে। তার জন্য এ খবর আসছে! ঠিক এ ব্যাপারটাই ঘটছে কয়েকজনের ক্ষেত্রে।
প্রত্যাশা অনুযায়ী তানিয়াই প্রথমে কথা বলল, কয়েকটা অর্ডার করল যার ফলে ভ্যাসিলি আর ফ্লয়েড দৌড় শুরু করেছে ব্রিজের দিকে।
এবার আমরা কী করব? মেয়েটা প্রশ্ন করল তারা একত্র হওয়ার পর।
এখন আর পালানোর পথ নেই-ভাবল ফ্লয়েড। বিশ্রী ব্যাপারগুলোকে ঠেকানো যেতেও পারে।
শিপের মোটা অংশ অন করা হয়েছে। সে বলল, সেটাকে কি বাদ দেয়া দরকার না, যাতে আমরা আরো দ্রুত সরে যেতে পারি? আর রেডিয়েশন শিল্ড হিসেবে কাজ করবে এটা, যদি ছেড়ে দিই। আমাদের বাড়তি সব ফেলে দিতে হবে।
ভ্যাসিলির আঙুলগুলো কন্ট্রোল প্যানেলের উপর উড়ে চলেছে এর মধ্যেই।
ঠিক, উডি। দেরি করে ফেলেছি অনেক, তবু গামা আর এক্স রে-কে একটু হলেও ঠেকিয়ে রাখা চাই। কিন্তু আরো ধীর গতির নিউট্রন আর আলফাও আছে। আর খোদা জানে কী কী…
আলোর ধারাগুলো লিওনভের গায়ে লেগে পিছলে গেল, কারণ অক্ষ বরাবর শিপটা ঘুরেছে। এবার পুরো শিপ কুঁচকে গিয়ে শুধু রেডিয়েশন শিল্ডের আশপাশে জমা হয়, যাতে ভিতরের মানুষগুলোর কাছে রেডিয়েশন না পৌঁছতে পারে।
আমরা কি আসলেই শক ওয়েভ অনুভব করতে পারব? শিউরে উঠছে ফ্লয়েড নিজে নিজেই। নাকি গ্যাসগুলো আমাদের কাছে আসতে আসতে একেবারে মৃদু হয়ে যাবে? কোনো বাহ্যিক প্রভাবই থাকবে না? ক্যামেরায় যা দেখা যাচ্ছে তাতে আংটিটা সামনের পুরো আকাশের দখলদার। কিন্তু দ্রুত মিলিয়ে যাবে। কিছু কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্রকে এর মাঝদিয়ে দেখা যাচ্ছে। আমরা বেঁচে যাব। বেঁচে যাব। আমরা গ্রহরাজকে নিজের চোখে শেষ হয়ে যেতে দেখেছি। এবং বেঁচে আছি এখনো।
এখন ক্যামেরায় শুধু অনেক অনেক তারা দেখা যাচ্ছে। সব স্বাভাবিক, শুধু একটা নতুন তারা লাখগুণ বড়। সেই বৃহস্পতি আগুনের বুদ্বুদ মিলিয়ে গেছে তাদের কাছে আসার আগেই। দারুণভাবে বেঁচে গেল মরণফাঁদের হাত থেকে। এতদূর থেকে শুধু শিপের জিনিসপত্রগুলো রেকর্ড করেছে এ ঘটনার পুরোটা।
আস্তে আস্তে শিপের উত্তেজনা থিতিয়ে আসে; যেন এমন ঘটনা সব সময়ই হয়। সবাই হাসাহাসি আর ভোতা ঠাট্টা নিয়ে মেতে পড়ে। ফ্লয়েড মন খারাপ করে তাদের দিকে তাকায়, বেঁচে যাওয়ার অসীম আনন্দের বাইরে মনের কোথায় যেন এক টুকরো কাঁচ বিঁধছে।
বিশাল আর অসাধারণ কিছু একটা শেষ হয়ে গেল। বৃহস্পতি তার সব অমীমাংসীত চির অজানা রহস্য, সব রূপ, সব সম্পদ, সবটুকু অস্তিত্ব নিয়ে শেষ হয়ে গেল চিরতরে! সব দেবতার পিতা তার অসাধারণত্ব আর ক্ষমতাকে সাথে নিয়ে হারিয়ে গেছে।
পরিস্থিতির উপর অন্যদৃষ্টি ফেলার সময় এখন। তারা বৃহস্পতি হারিয়ে কী পেল?
তানিয়া প্রতিটা মুহূর্তকে ঠিকমতো বিচার করে চলে। সব মনোযোগ যেন সে একাই নিয়ে নিয়েছে।
ভ্যাসিলি, কোনো ক্ষতি?
তেমন কিছু না। একটা ক্যামেরা জ্বলেছে, সব রেডিয়েশন মিটার স্বাভাবিক। কোনোটাই বিপদসীমার কাছে নেই।
ক্যাথেরিনা, আমাদের সম্পূর্ণ ক্ষতির বর্ণনা বের কর। আমরা মনে হয় ভাগ্যবান…যদি আরো চমক না থেকে থাকে। এখন অবশ্যই একটা ধন্যবাদ পাওনা হয়েছে ডেভিড বোম্যানের, এবং তোমারও, হেউড। কী হল, বুঝেছ কিছু?
শুধু এটুকুই, বৃহস্পতি এখন একটা সূর্য।
আমি সব সময় ভাবতাম এটা সূর্য হওয়ার মতো যথেষ্ট বড় না। একবার কে যেন বলেছিল, বৃহস্পতি হল ব্যর্থ সূর্য।