২০১০ : ওডিসি টু

১. প্রথম পর্ব : লিওনভ

২০১০ : ওডিসি টু – আর্থার সি ক্লাক / অনুবাদ : মাকসুদুজ্জামান খান

প্রথম প্রকাশ : জুন ২০০৫

লেখকের উৎসর্গ

মহান দুই রাশিয়ান জেনারেল অ্যালেক্সি লিওনভ-কসমোনট, সোভিয়েত ইউনিয়নের বীর, চিত্রশিল্পী।

এবং

অ্যাকাডেমিশিয়ান আন্দ্রে শাখারভ–
বিজ্ঞানী, নোবেল বিজয়ী, মহান মানবতাবাদী

অনুবাদকের উৎসর্গ

যিনি এই বইয়ের এক তৃতীয়াংশ লিখেও
অনুবাদক হিসেবে নাম দিতে চাননি
আব্বুকে

লেখকের কথা

২০০১: আ স্পেস ওডিসি উপন্যাসটা লেখা হয় ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে; প্রকাশিত হয় আটষট্টির জুলাইতে, ছবি মুক্তির পর পরই। দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ডর্স অব ২০০১-এ বলেছিলাম, চলচ্চিত্র আর উপন্যাসের কাজ সমান্তরালে চলে। ফলে আমি লেখার মোটামুটি ব্যয়বহুল পথ ধরে চলা শুরু করলাম; স্ক্রিপ্ট দেখার সুযোগ পেলাম ছবির চিত্র দেখার পর, তাও আবার দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয় পুরনো ধারণায় ভিত্তি করে।

ফলে, কাহিনীর গতিধারায় একটা সমান্তরালতা থেকে যায়, সেই সাথে পার্থক্যও রচিত হয় বিস্তর। উপন্যাসে স্পেসশিপ ডিসকভারির লক্ষ্যস্থল ছিল শনির সবচে রাজকীয় উপগ্রহ জ্যাপেটাস বা ইপেটাস। শনীয় জগতে যেতে হয়েছিল বৃহস্পতিকে পাশ কাটিয়ে। ডিসকভারি চলে যায় গ্রহরাজের অসীম গ্র্যাভিটিশনাল ফোর্স কাজে লাগিয়ে, ধনুকের ছিলার মতো এর দানবীয় শক্তিকে নিজের জন্য ব্যবহার করে এগিয়ে যায় সামনে। ভয়েজার স্পেসপ্রোব সেই একই কাজ করে ১৯৭৯ সালের অভিযানে, বাইরের দিকের দৈত্যদের সাথে প্রথম মোলাকাতের সময়গুলোতে।

ছায়াচিত্রে স্ট্যানলি কুবরিক বিজ্ঞের মতো মানুষ ও মনোলিথের মাঝখানে তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে উপস্থাপিত করেন বৃহস্পতীয় জগতে। শনিকে পুরো স্ক্রিপ্ট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়, যদিও ডগলাস ট্রাম্বল তার বলয়সমৃদ্ধ গ্রহের অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে সাইলেন্ট রানিং চলচ্চিত্রে কাজে লাগিয়েছিলেন।

সেই ষাটের দশকে কেউ হয়তো ভাবেনি যে বৃহস্পতি অভিযান আগামী শতকে বরং মাত্র পনের বছর সামনে উপস্থিত। তারপর সামনের সেই অচেনা জগতে বিছানো শত রহস্যের দরজা খুলে গেল, আমরা দেখতে পেলাম অনেক অপ্রত্যাশিতের হাতছানি। আশা করা যায় ভয়েজার অভিযান দুটোর ফলে যে বিস্ময়ের জন্ম হয়েছে। সেটাও পেছনে পড়ে যাবে আসতে থাকা নূতন মিশনের আলোয়।

২০০১ লেখার সময় আইও, ইউরোপা, গ্যানিমিড ও ক্যালিস্টো সবচে শক্তিশালী টেলিস্কোপেও এক একটা ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো দেখাতো। কিন্তু আজ উল্টে গেছে পাশাখেলার ছক। এখন তারা প্রত্যেকে নিজস্বতা নিয়ে উপস্থিত আমাদের চোখের সামনে; তাদেরই একজন, আইও, এখন সৌরজগতের সবচে তেজস্বী উপগ্রহ।

এ আবিষ্কারগুলোর আলোকে ছায়াচিত্র বা উপন্যাস, দুটি-ই যুগজিজ্ঞাসার সামনে পড়েছে। ছবির বৃহস্পতীয় জগৎ আর ভয়েজারের ফিল্মগুলোতে উঠে আসা গ্রহরাজের রাজত্বে অনেক ফারাক চোখে পড়ে। আজকের জগতে যাই লেখা হোক কেন, তা অবশ্যই ১৯৭৯ সালের আবিষ্কারের রসে জারিত হতে হবে; আজ আর সেগুলো অচেনা ভুবন নয়।

এখানে আরো শক্তিময় একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার জড়িত। মহাকাল পৃথিবীর ইতিহাসকে দু অংশে ভাগ করে দিয়েছে; ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা রাখার আধযুগ আগেই আমি আর স্ট্যানলি কুবরিক যখন, সত্যিকার সার্থক সায়েন্স ফিকশন (কথাটা তার) মুভি তৈরির চেষ্টায় প্রাণ আঁতিপাতি করতাম তখন ২০০১ লেখা হয়। তাই, সেই চান্দ্র বিভাজনের পর অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন আসে লেখনীর জগতে, যথারীতি।

চাঁদের পথে পা বাড়ানোর আগেই অ্যাপোলোর অ্যাস্ট্রোনটরা চলচ্চিত্রটা দেখেছিলেন। উনিশো আটষট্টির ক্রিসমাসে অ্যাপোলো আটের ক্রুরা চান্দ্র দিগন্তে প্রথম চোখ রেখে নাকি রেডিওতে জানাতে চাচ্ছিলেন যে একটা বিশাল কালো মনোলিথ দেখা যাচ্ছে দূরে কোথাও। হায়, বাস্তবতো এমন নয়!

প্রকৃতি কত নিষ্ঠুর খেলাই না খেলতে পারে! উনিশো স্যুরের অ্যাপোলো তেরো মিশনে আরো একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

যে কমান্ড মডিউলে লোকজন থাকত সেটার নাম ছিল ওডিসি। অক্সিজেন সিলিন্ডার বাস্ট হয়ে যেতে উদ্যত হবার একটু আগে তারা রিচার্ড স্ট্রাউসের জরথুস্ত্র থিম বাজাচ্ছিল, যেটাকে বর্তমানে সারা পৃথিবী মুভিটার কল্যাণে চেনে। এনার্জি চলে যাবার সাথে সাথে জ্যাক সুয়েগার্ট মিশন কন্ট্রোলের সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করে, হিউস্টন, উই হ্যাভ হ্যাড এ প্রব্লেম।

কাছাকাছি এক অবস্থায় ছায়াচিত্রে হাল ডিসকভারির ক্রু ফ্র্যাঙ্ক পোলকে যেভাবে বলেছিল, স্যরি টু ইন্টারাপ্ট দ্য ফেস্টিভিটিস, বাট উই হ্যাভ এ প্রব্লেম।

অ্যাপোলো তেরোর মিশন রিপোর্ট নাসাতে আসে, পরে জনসমক্ষে প্রকাশের পর নাসার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর টম পেইন আমাকে একটা কপি পাঠান যেখানে লেখা ছিল:

আর সব সময়ের মতো যেমন করে আপনি বলেন, এমনটা হতে পারে, আর্থার।

আমি একই সময়ে ঘটিত তিন-চারটা ব্যাপারে মিল দেখে এখনো থমকে যাই।

আরো একটা সাড়া কম সিরিয়াস হলেও একই রকম অবাক করে। ছবির টেকনিক্যাল দিক দিয়ে সবচে মেধাবী কাজের মধ্যে একটা হল, ফ্র্যাঙ্ক পোল একটা গোল ট্র্যাকের ভিতরে বারবার জগিং করতে করতে ঘুরতে থাকে বিশাল সেন্ট্রিফিউজের মধ্যে। তার এ দৌড়ানো সম্ভব হয় জিনিসটার ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট কৃত্রিম গ্র্যাভিটির কল্যাণে।

প্রায় দশকখানেক পরে, অসাধারণ সাফল্য পাওয়া স্কাইল্যাবের ক্রুরা আবিষ্কার করল যে তাদের এ মহাকাশতরীর ডিজাইনাররা একই জ্যামিতি অনুসরণ করেছে। স্কাইল্যাবের ভেতরটাকে ঘিরে একটা শক্তিময় ক্যাবিনেটের রিং বসানো ছিল। স্কাইল্যাব ঘুরত না কিন্তু ক্রুরা ঠিকই ইঁদুরের গোল খাঁচায় দৌড়ানোর মতো করে শারীরিক কসরত করে নিতে পারত। এমনকি তাদের সেই ঘোরার দৃশ্য টেলিভিশনে পাঠানো হয়েছিল। (আমি কি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকটার নাম করব?) সেইসাথে একটা ছোট্ট বার্তা পাঠানো হয়, স্ট্যানলি কুবরিকের এটা দেখা উচিত।

তিনি দেখেছিলেন, আমি টেলিসিনটা পাঠিয়ে দিই তাঁর কাছে। (আর কখনো ফেরত পাইনি জিনিসটা। যথারীতি। আমাদের স্ট্যানলি খুবই বিশ্বস্ত একজন ব্ল্যাকহোল। তার কাছে কোনোকিছু গেলে…)

বাস্তবের সাথে মুভিটার আরো একটা মিলের কথা না বলে পারি না, অ্যাপোলো-সয়ুজ কমান্ডার কসমোনট অ্যালেক্সি লিওনভ আঁকা, চাঁদের কাছে। জাতিসংঘের বহির্মহাবিশ্বের শান্তিময় ব্যবহার বিষয়ক একটা কনফারেন্সে আমি ছবিটা দেখি। বিস্ময়কর। আমাদের চলচ্চিত্র মাত্র কিছুদিন আগে মুক্তি পেয়েছে। তার আইডিয়ার সাথে মুভির প্রথম দৃশ্যের অনেক অনেক মিল, প্রথমে চাঁদের পেছনে উদিত হচ্ছে ধরণী, তার পেছনে সূর্য। মস্কোতে তিনি আর শাখারভ মিলে আমাদের প্রতীক্ষায় মহাকাশ বইটা লেখেন ১৯৬৭ সালে। সেটার ৩২ পৃষ্ঠায় এ নিয়ে লেখা আছে। ছবিটার একটা স্কেচ, তার অটোগ্রাফসহ ঝুলছে আমার অফিস দেয়ালে। আরো বিস্তারিত জানতে ১২ তম অধ্যায়ে দেখতে পারেন।

হয়তো এ থেকে আরো একজন গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কম পরিচিত লোকের নাম উঠে আসতে পারে। হিউয়েন-সেন জিয়াং। মহান থিওডর ফন কারম্যান আর ফ্র্যাঙ্ক জে ম্যালিনার সাথে গুটেনহ্যাম অ্যারোনটিক্যাল ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক)-এ। প্যাসাডেনের প্রখ্যাত জেট প্রোপালশন ল্যাবের উত্তরসূরী এটি। তিনি ক্যালটেকের প্রথম গদার প্রফেসর ছিলেন, চল্লিশের দশক জুড়ে আমেরিকার রকেট বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে চলেন। ম্যাককার্থি যুগের অন্যতম বিশ্রী ঘটনা ঘটে যায় এরপর। নিজের দেশে ফেরার কথা বলতেই গ্রেফতার হন। পরের দু দশক তিনি চৈনিক রকেট প্রোগ্রামের অন্যতম পুরোধা ছিলেন।

সবশেষে, ২০০১ এর ৩৫ তম অধ্যায়ে জ্যাপেটাসের নয়ন নামে একটা আজব কথা আছে। আমি এখন মহাকাশবিদ ডেভিড বোম্যানের করা সেই আবিষ্কারের ব্যাখ্যা দিচ্ছি যেখানে আছে, এক উজ্জ্বল সাদা ডিম্বাকার এলাকা… চারশো মাইল লম্বা আর দুশ মাইল চওড়া… একেবারে চৌকো… তার উপর, দেখতে এমন যেন… ছোট্ট চাঁদটার মুখে রঙ মাখা হয়েছে। এমনকি কাছাকাছি আসার পর বোম্যানের মনে হল যেন কোনো উজ্জ্বল চোখ চেয়ে আছে তার দিকে। তারপর সে দেখল, ঠিক কেন্দ্রে এক বিন্দু। দেখে যাকে ঠিক মনোলিথ বলে ভুল হয়।

মজার ব্যাপার, ভয়েজার-১ এর পাঠানো ইপেটাস বা জ্যাপেটাসের প্রথম ছবিতে এক সাদা গোল ডিম্বাকার দেখা যায় যার ঠিক মাঝখানে এক কালো বিন্দু।

কার্ল সাগান জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি থেকে আপনার কথা ভেবে… সহ একটা প্রিন্ট আউট পাঠান। জানি না ব্যাপারটা নিয়ে হতাশ হতে হবে নাকি আশায় বুক বাঁধতে হবে, ভয়েজার-২ পথটা খোলা রাখছে এখনো।

অপ্রতিরোধ্যভাবেই, আমি আগের বই টেনে নিয়ে যেতে চাইনি। এর দ্বিতীয় পর্ব লেখার ইচ্ছা ছিল না। কাহিনী টেনে নেয়ার চেয়ে একেবারে নতুন কোনো ধারণা পরের খণ্ডে আনার চেষ্টা করেছি তাই। এখানে, ছবি বা ২০০১ উপন্যাস, কোনোটাই পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। কিছুটা মিল রাখা হয়েছে চলচ্চিত্রের সাথে। বইটাকে একেবারে স্বাধীন করার চেষ্টা ছিল। এ বইতে ইচ্ছা ছিল বর্তমানের বিজ্ঞানের আলোকে তুলে আনার।

যে ধারণা, অবশ্যই, পুরনো হয়ে যাবে ২০০১ সালের মধ্যে…

আর্থার সি ক্লার্ক
কলম্বো, শ্রীলঙ্কা জানুয়ারি, ১৯৮২

প্রথম পর্ব : লিওনভ

১. সেন্টারে মুখোমুখি

পরিমাপের এ মেট্রিক যুগেও তিনশ মিটার না বলে এক হাজার ফুটের টেলিস্কোপ বলা হয় বিশাল গোল ডিশটাকে। গ্রীষ্ম মণ্ডলে সূর্যের বিশ্রাম দরকার; পাহাড়ে বসানো এ বিশাল ডিশের অর্ধেকটা ঢেকে গেছে ছায়ায়। উপরে ঝুলন্ত অ্যান্টেনা কমপ্লেক্সের তিন কোণা র‍্যাফট এখনো আলোয় ভাসছে। অনেক নিচ থেকে আকাশ-তারের গোলক ধাঁধায় দুজন মানুষের মতো দেখা যায়। আশপাশে সাপোর্ট ক্যাবল আর ওয়েভ বাহক ভরা। তাদের দেখতে হলে দিতে হবে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

ডক্টর দিমিত্রি ময়শেভিচ তার পুরনো বন্ধু হেউড ফ্লয়েডকে বলল, এখনি সময়। অনেক কিছু নিয়ে কথা বলতে হবে। জুতা, স্পেসশিপ, সীলগালা আর বিশেষ করে মনোলিথ; বুঝতেই পারছ, কাজে ফেল মারা কম্পিউটারটা নিয়ে কথা বলতে হবে।

এজন্যেই আমাকে কনফারেন্স থেকে বের করে আনলে? আমার মনে হয় না। কার্ল ঐ গলাবাজির এস ই টি আই বক্তৃতা অনেক দিয়েছে। আমি নিজেই আগাগোড়া আউড়ে যেতে পারব… আশপাশের পরিবেশ দারুণ, কী বল? তুমি তো জানো, আমি সব সময় এরিসিবোর কাছে থাকতাম। কখনোই অ্যান্টেনার কথাটা তুলে ধরিনি।

তোমার জন্য লজ্জাজনক, হেউড। এ নিয়ে তিনবার এখানে এলাম। ভেবে দেখ, এই এখানে আমরা সারা বিশ্বকে শুনছি কিন্তু কেউ আমাদের কথা আড়ি পেতে শুনতে পাবে না। সুতরাং সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারি আমরা।

কী সমস্যা?

প্রথমে… ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাস্ট্রোনটিক্সের চেয়ারম্যান পদ থেকে কেন তোমাকে রিজাইন করতে হলো?

অমি ঠিক ইস্তফা দেইনি, হাওয়াই ইউনিভার্সিটি অনেক ভাল বেতন দেয়।

ঠিক আছে-তুমি রিজাইন দাওনি-তাদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে ছিলে। উডি, এত বছর পর আমাকে কি বোকা বানাতে পারবে? মনে হয় তোমার সে চেষ্টা বাদ দেয়া উচিত। ঠিক এ মুহূর্তে তারা যদি এন সি এ-তে ফের নেয়ার প্রস্তাব দেয়, তুমি কি যাবে না?

ঠিক আছে, বুড়ো কসাক, কী জানতে চাও?

প্রথমে, অনেক খোঁচাখুঁচির পর তুমি যে প্রতিবেদনই পাঠিয়েছ তা প্রচুর লাগামহীন কথাবার্তা দিয়ে শেষ হয়। তোমাদের লোকজনের সেই অদ্ভুত আর সত্যি বলতে গেলে অবৈধ কাজটার কথা বাদ দিলাম নাহয়, তারা অবৈধভাবে গোপন করেছে টাইকো মনোলিথ খুঁড়ে বের করার কথা–

আমি এ আইডিয়া দেইনি।

শুনে খুশি হলাম; বিশ্বাস করি তোমাকে। তোমরা সবাইকে জিনিসটা পরীক্ষা করতে দিচ্ছ, ভাল কথা কিন্তু অবশ্যই প্রথমে করতে দেয়া উচিত ছিল। মনে হয় না কাজটা ঠিক হল…।

দুজন চাঁদের সেই কালো, অসাধারণ জিনিসটা নিয়ে আলোচনা করছে গভীরভাবে আর তাদের চারপাশটায় জেঁকে বসেছে বিষণ্ণ নিরবতা। যেন প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছে সব অস্ত্র। সাধারণ সরলতা দিয়ে এত বিরাট ব্যাপার হয়ে যেতে পারে না। দেশ দুটো একে অন্যকে সাহায্য করতে পারে না। রাশিয়ান বিজ্ঞানী বলতে থাকে।

টাইকো মনোলিথ যাই হোক না কেন, বৃহস্পতির এলাকায় আরো ভয়াল কিছু বসে আছে। মনোলিথ সংকেত পাঠিয়েছিল বৃহস্পতিতেই। বাস্তব হল, সেখানটায় তোমার লোক ঝামেলায় পড়েছিল। সে ব্যাপারে…আই অ্যাম স্যরি। ডিসকভারির ক্রুদের মধ্যে একমাত্র ফ্র্যাঙ্ক পোলকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। ৯৮র আই এ এফ কংগ্রেসে তার সাথে দেখা হয়- বেচারা ভাল মানুষ ছিল।

ধন্যবাদ তোমাকে; তারা সবাই ছিল ভাল। আশা করি আমরা জানি তাদের কী হয়েছে…মানে যা জানি তা ঠিক হবার আশা করতে পারি।

যা-ই হয়ে থাক না কেন, নিশ্চয়ই তুমি স্বীকার করবে যে ব্যপারটা এখন পুরো মানবজাতিকে পেঁচিয়ে ধরেছে, শুধু ইউনাইটেড স্টেটসকে নয়। আজ আর তোমরা জ্ঞানকে শুধু জাতীয় কাজে লাগাতে পার না।

দিমিত্রি-তুমি ভালো করেই জানো। তোমরা যদি চাঁদের ঐ পিশাচটাকে আবিষ্কার করতে, তারপর তোমাকে যদি টু শব্দ করতে মানা করা হতো তাহলে তুমিও সেসব কথা বেমালুম চেপে যেতে। তারপর বিজ্ঞানকে শুধুই দেশের স্বার্থে ব্যবহার করতে।

কথাটা ঠিক। কিন্তু এ তো প্রাচীন ইতিহাস-তোমাদের এবার বিদায় নেয়া সরকারওতো শুধু সেসব কথা ভেবে মরত। তারাও ভণ্ডুল করে দিয়েছে পুরো ব্যাপারটাকে। নতুন প্রেসিডেন্টের সাথে সাথে বোধহয় আরেকটু জ্ঞানী কাউন্সিলররা জিতবে।

মনে হয়। আচ্ছা, আসলে তুমি কিছু একটা বলবে আমাকে। আমিওতো তোমাকে চিনি, না? কথাগুলো অফিসিয়াল, নাকি ব্যক্তিগত ইচ্ছা?

এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ আনঅফিসিয়াল। হতভাগা ঐ রাজনীতিবিদরা যাকে বলে অভিযান নিয়ে কথা। আমার বিশ্বাস, তারা এ ধরনের কথা কখনোই বলে না।

ঠিক, ঠিক চালিয়ে যাও।

খেই ধরছে রাশান বিজ্ঞানী, এই হল পরিস্থিতি। তোমরা যত দ্রুত সম্ভব ডিসকভারি-টু কে পার্কিং কক্ষপথে পাঠাচ্ছ, এটাই তোমাদের চাওয়া। কিন্তু সময় লাগবে তিন বছর। যার অর্থ তোমরা পরবর্তী লঞ্চ উইন্ডোর সুযোগ হারাবে।

স্বীকার-অস্বীকার কোনোটাই করছি না। মনে রেখ, আমি আর কাউন্সিলের প্রধান নই, বরং ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাস্ট্রোনটিক্স থেকে যোজন যোজন দূরে, পৃথিবীর অন্য পাশে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্রেফ একজন বিনয়ী চ্যান্সেলর, সম্মানিত আচার্য।

এবং আমার মনে হয়, ওয়াশিংটনে এন সি এ তে পুরনো অফিসে তোমার গত ভ্রমণ ছিল পুরনো বন্ধুদের দেখার জন্য একটা ছুটির দিন। কথা চালিয়ে যাই। আমাদের নিজস্ব অ্যালেক্সি লিওনভ-

আমি ভেবেছিলাম তুমি একে হেরম্যান টিটভ বলে ডাকছিলে।

ভুল, চ্যান্সেলর। প্রিয় পুরনো সি আই এ তোমাদের আবার পুরনো তথ্য দিল। গত জানুয়ারির হিসেবে ওটা লিওনভ। কাউকে জানতে দিও না যে আমি তোমাকে এসব বললাম, শিপটা কমপক্ষে এক বছর আগে বৃহস্পতিতে পৌঁছোবে।

তাহলে আমিও তোমাকে আমাদের একটা সিক্রেট বলে দিই…কাউকে জানতে দিওনা, আমরা এ ভয়ই পাচ্ছিলাম এতদিন ধরে। চালিয়ে যাও।

কারণ আমার সব বস ঠিক তোমার বসদের মতোই বোকা এবং অদূরদর্শী। তারাও ডিসকভারির কাছে একা যেতে চায়। অর্থাৎ শুধু দেশের স্বার্থে কাজ। মানে হল তোমরা যে ভুল করেছ আমরাও তেমন কিছু করে বসতে পারি, কারণ আগের অভিজ্ঞতা আছে শুধু তোমাদের। আরে ভাই, যাই হোক আমরা সবাই হয় একের বর্গ করব-ফল হবে একই, নয়তো আরো খারাপ, এর বেশি আর কী? মনে হচ্ছে লাভ-লোকসানের হিসাবে রাশিয়ান বিজ্ঞানী খুব একটা ধার ধারে না।

আমাদের কী ভুল ছিল মনে হয়? তোমাদের মতো আমরাও পড়ে আছি গোলক ধাঁধায়। ডেভ বোম্যানের পাঠানো সব খবর তোমরা পাওনি তা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো না।

অবশ্যই আমরা পেয়েছি। ঠিক, শুনেছি মাই গড! আমার সামনেটা তারায় তারায় ভরা! কথাটুকু পর্যন্ত। গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করেছি তার কণ্ঠস্বরের প্যাটার্ন। আমরা মনে করি না সে কল্পনা করে বা এমি এম্নি বলেছে সেই ভয়াল শেষ বাক্যটা। বাস্তবে যা দেখেছিল তা বর্ণনা করার চেষ্টা করছিল কথা দিয়ে।

এবার আঁতকে দেয়া প্রশ্ন তুলল দিমিত্রি, তার ডপলার পরিবর্তন নিয়ে কাজ করে কী পেলে?

অবশ্যই, একেবারে অসম্ভব। কথা হারানোর মুহূর্তে সে পিছিয়ে যাচ্ছিল আলোর এক দশমাংশ গতিতে! এবং সেখানে দু মিনিটের কম সময়ে পৌঁছেছিল। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে আড়াই লাখ গুণ বেশি আকর্ষণ! অবশ্যই, সে মারা যায় সাথে সাথে। পৃথিবীর আকর্ষণে একতলা থেকে পড়লেই মানুষ ভর্তা হয়ে যাবে, কী বল? বলা উচিত তাকে খুন করেছে ঐ মনোলিথ। হেউড ফ্লয়েড আফসোসের সুরে বলছে।

কাঁচা হওয়ার ভান করো না উডি। তোমার মহাশূন্যখোসার রেডিওগুলো টিকে থাকার মতো করে তৈরি হয়নি। এমনকি ঐ ত্বরণের এক শতাংশ ত্বরণেও টিকবে না। যদি তোমাদের ক্রুরা সে অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে…যোগাযোগ হারানোর আগ পর্যন্ত অন্তত বোম্যান বেঁচে ছিল।

আন্দাজে বাধা দিচ্ছ আমার কথায়। স্পষ্ট করে বলছি, তোমাদের মতো আমরাও অন্ধকারে; কিচ্ছু জানি না। আচ্ছা, তোমরাও যে কিছু জানো না তা না-ও হতে পারে।

স্রেফ প্রচুর দিশেহারা ধারণার সাথে খেলা করে অনুমান করেছি। তোমাকে আন্দাজগুলো বলতে লজ্জা হয়। তবু আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় আন্দাজগুলো পাগলাটে, কিন্তু যেটা সত্যি হয়েছিল দু হাজার এক সালে সেটা এসব ধারণার চেয়েও অনেক অনেক বেশি অবাক করবে।

গাঢ় লাল ছোট আলোর বিস্ফোরণ সামনে। নেভিগেশনের সতর্ক বাতি তাদের চারদিকে জ্বলছে, অ্যান্টেনা কমপ্লেক্সের ভার বহনকারী সরু তিনটি টাওয়ার সতর্ক সংকেতের মতো অন্ধকার আকাশের দিকে আগুন ছুঁড়ছে। রোদপোড়া ধাতুর ধারালো টুকরো পুড়িয়ে দিল নিচের চারদিকের পাহাড়; হেউড ফ্লয়েড সবুজ সংকেতের জন্য অপেক্ষা করছে…সবুজ সংকেত সে কখনো দেখেনি। আরেকবার তাকে হতাশ হতে হল।

সুতরাং দিমিত্রি, সে বলল, চল-আসল কথায় আসি, তুমি ঠিক কী বোঝাতে চাও?

ডিসকভারির ডাটা ব্যাংকে প্রচুর অমূল্য তথ্য থাকতে পারে; যেহেতু শিপ ফিরে আসছে না, ধরতে পারি এটা এখনও তথ্য সংগ্রহ করছে। আশা করি আমরা তা পাব।

দারুণ কথা। কিন্তু যখন তুমি সেখানে যাবে এবং লিওনভ সংকেত জায়গা তৈরি করবে তখন ডিসকভারিতে আছে এমন ডাটার মধ্যে তুমি যেগুলো চাও সেগুলো কপি করার সময় কে তোমাকে বাধা দেবে?

বেশ হতাশ হল দিমিত্রি, আমি কখনো ভাবিনি তোমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে যে ডিসকভারি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্র। এখানে অনধিকার প্রবেশ স্রেফ জলদস্যুতা।

জীবন-মরণের জরুরি মুহূর্ত ছাড়া জলদস্যুতা করতে অসুবিধা হবে না। মোটের উপর বিলিয়ন বিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে তোমার ছেলেদের খুঁজে বের করা আমাদের জন্য হবে কঠিন কাজ।

অন্তত, চমৎকার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ; আমি পথটুকু ঠিকই পেরিয়ে যাব। কিন্তু আমরা যদি মহাকাশে যেতাম তোমাদের মতো তাহলে তোমাদের সব পদ্ধতি শিখতে আমাদের কয়েক সপ্তাহ লাগত। তোমাদের সব মেমরি ব্যাংকও পড়ে ফেলতাম। আমার প্রস্তাব সহযোগিতার। বুঝতে পারছি এটাই সবচে ভাল ধারণা-কিন্তু আমাদের দুজনেরই বসদের কাছে ধারণাটা বেচে দেয়ার জন্য নিজেদের চাকরি থাকা উচিত।

তুমি আমাদের নভোচারীদের একজনকে চাও…লিওনভের সাথে ওড়ার জন্য? যাতে ডিসকভারিতে ঢোকাটা হালাল হয়ে যায়? যাতে আমাদের ভুলগুলো আরেকবার তোমরা না কর?

হা-বরং একজন প্রকৌশলীকে চাই যে ডিসকভারির সিস্টেমগুলোর বিশেষজ্ঞ। জাহাজটাকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য যাদের তুমি হিউস্টনে প্রশিক্ষণ দাও তাদের মতো একজন।

এ খবর জানো কীভাবে?

স্বর্গের কসম, উডি-কমপক্ষে একমাস আগে জেনেছি। বিমানচালনা সপ্তাহের ভিডিওটেক্সট ছিল।

আমি আজকাল যোগাযোগ করি না; কী সরানো হয়েছে কেউ আমাকে বলেনি।

মুচকি হাসছে দিমিত্রি, তোমার ওয়াশিংটনে সময় কাটানোর এও এক কারণ। তুমি কি অস্বীকার করবে?

হু। আমি তোমার সাথে একশো ভাগ একমত। কিন্তু—

কিন্তু কী?

আমাদের দুজনকেই মাথা খাঁটিয়ে ডায়নোসরের লেজে কাজ করতে হবে। এ ডায়নোসরগুলোর ব্রেন পড়ে আছে লেজে। আমাদের কেউ কেউ অন্য কথা বলবে: বৃহস্পতি নিয়ে ধস্তাধস্তি করে রাশিয়ানদেরকে তাদের ঘাড়ে ঝুঁকি নিতে দাও। দুবছর পর আমরা যে কোনো উপায়ে সেখানে থাকব-তাড়াহুড়োর কী হল?

একশ মিটার উপর থেকে ঝোলানো সুবিশাল ভার বহনকারী তার থেকে অস্পষ্ট কাঁচ ক্যাচ শব্দ ছাড়া মুহূর্তের জন্য অ্যান্টেনা র‍্যাফটে নিরবতা নেমে এসেছিল। তখন ময়শেভিচ এমন শান্তভাবে কথা বলতে লাগল যে ফ্লয়েডকে তার কথা শোনার জন্য অনেক চেষ্টা করতে হয়। আজকাল ডিসকভারির কক্ষপথ কি কেউ চেক করেছে?

আসলে আমি জানি না-করেছে হয়ত। যা-ই হোক, দুশ্চিন্তা করছ কেন? ডিসকভারি ইজ ওকে।

অবশ্যই। আগের দিনের নাসা সময় থেকে এক দুর্ঘটনার কথা আনাড়ির মতো মনে করিয়ে দিতে দাও। তোমাদের প্রথম মহাশূন্য স্টেশন-স্কাইল্যাব। এক দশক আকাশে থাকার কথা ছিল, কিন্তু হিসাব ঠিক মতো করোনি। আয়োনোস্ফিয়ারের এয়ার ড্রাগকে ছোট করে দেখা হয়। স্কাইল্যাব ধ্বংস হয়ে নেমে আসে সে বছরের আগেই। আমি শিওর ঐ ছোট ক্লিপ হ্যাংগারটার কথা মনে আছে, তুমি ছোট ছিলে তখন।

গ্রাজুয়েশন শেষ করেছিলাম তখন, তুমি জানো। কিন্তু ডিসকভারি বৃহস্পতির ধারে কাছে যায় না। এমনকি পেরিজি…ধ্যাৎ, পেরিজোভেও এটা বায়ুমণ্ডলীয় ড্রাগে আক্রান্ত হওয়ার মতো উচ্চতা থেকে অনেক উপরে।

আমি আবার দাচায় নির্বাসিত হওয়ার মতো যথেষ্ট গোপন কথা বলেছি-হয়ত পরে আর আমাদের দেখা করতে দেবে না গোয়েন্দা সংস্থার টিকটিকিগুলো। সুতরাং তোমাদের ট্র্যাকিং এক্সপার্টদের বল আরো যত্নের সাথে কাজ করতে, বলবে তো? তাদের মনে করিয়ে দাও যে সৌর জগতের সবচে বড় ম্যাগনেটোস্ফিয়ারটা বৃহস্পতির।

বুঝলাম-অনেক ধন্যবাদ। নিচে যাবার আগে আর কিছু বলবে? আমি ফ্রিজ করব এখন।

ভয় পেও না বন্ধু। তুমি অভিজ্ঞ। যখনই এসব অবাঞ্ছিত সংকেত বাতিল করার ফিল্টার ওয়াশিংটনে পাঠাবে-তখন থেকে সপ্তাখানেক অপেক্ষা কর। পরিস্থিতি খুব গরম হয়ে যাবে। খুব্বি উত্তপ্ত।

২. বাড়ির ভেতর ডলফিন

ডলফিনরা প্রতি সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার ঠিক আগে ডাইনিং রুমে সাঁতার কাটে। ফ্লয়েড যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্যের বাসায়-এরা রুটিন ভেঙেছিল তখনি, মাত্র একবার। পাঁচ নম্বর সুনামির দিন আসেনি। সৌভাগ্যক্রমে হিলোতে পৌঁছার আগেই দুর্বল হয়ে পড়ে জলোচ্ছ্বাসটা। পরে ফ্লয়েডের বন্ধুরা সময় মতো আসতে না পারায় ফ্লয়েড তার পরিবারকে গাড়িতে তুলে মুনা কি এর দিকে উঁচু জায়গার খোঁজে এগিয়ে যায়।

এরা দারুণ, কিন্তু তাকে স্বীকার করতে হয়েছে যে এদের কৌতুক প্রবণতা মাঝেমাঝে বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে। এক স্বাস্থ্যবান সামুদ্রিক ভূতত্ত্ববিদ বাড়িটির ডিজাইন তৈরি করেছিল। ভিজে যাওয়াতে সে কখনো কিছু মনে করত না, কারণ সাধারণত স্নানের পোশাক পরাই ছিল সেই লোকটার বৈশিষ্ট্য।

কোনো এক সদস্যের অপেক্ষায় যখন সন্ধ্যার পোশাক পরা পরিচালনা পরিষদের বাকি সদস্যেরা পুলের চারিদিকে একটু একটু করে চুমুক দিয়ে ককটেল পান করছে, তখন হল এক মজার ঘটনা। ডলফিনরা বুঝতে পেরেছিল দ্বিতীয়বার আদর পাবে; সাথে খাবারও। সুতরাং ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার লোক পরে এমন ঢিলেঢালা পোশাক পরা একটা নোংরা ডলফিনকে রিসিপশন কমিটি সাদরে গ্রহণ করে দারুণ মজা পেয়েছে। বুফে ছিল খুবই নোতা।

ফ্লয়েড প্রায়ই চিন্তা করত-প্রশান্ত মহাসাগরের কোল ঘেঁষে বানানো আমার অদ্ভুত আর সুন্দর বাড়ি দেখলে ম্যারিয়ান কী ভাবত! ও কখনো সমুদ্র পছন্দ করেনি, শেষে সাগরই জিতেছে তার ওপর। সময় মানুষের শোককে ধীরে ধীরে বদলে দেয়। এখনো আলো ঝলকের মতো তার মনে পড়ে খবরটার কথা যার মধ্যে প্রথম শব্দগুলি ছিল ভয়াবহ : ড, ফ্লয়েড-জরুরি এবং ব্যক্তিগত। এবং তারপর ফুরেসেন্ট প্রিন্টের পাকানো কাগজের সাইনগুলো মেসেজ পাঠিয়ে দ্রুতবেগে তার হৃদয় জ্বালিয়ে ফেলে : আপনাকে অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, লন্ডন-ওয়াশিংটন ফ্লাইট ৪৫২ নিউফাউন্ডল্যান্ডের অদূরে ক্র্যাশ করেছে বলে জানা গেছে। উদ্ধার শিপ লোকেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের ভয়-কেউ বেঁচে নাও থাকতে পারে।

ভাগ্য অন্যদিকে না ঘুরে গেলে সেও ঐ ফ্লাইটে থাকতে পারত। কিছু দিন ধরে ইউরোপে মহাশূন্য প্রশাসন ব্যবসা ভাল লাগছিল না। তাই প্যারিসে আরো কদিন থেকে যায় ফ্লয়েড; পাইলট সোলারিসের সাথে ভাড়া নিয়ে দর কষাকষিই শেষ পর্যন্ত তার জীবনটা বাঁচিয়ে দিল। অবশ্য সে এভাবে ব্যপারটা ভাবতে চায় না।

এখন একটা নতুন চাকরি, এক নতুন বাড়ি এবং একজন নতুন স্ত্রী থাকলেও ভাগ্য এখানে সহায় হয়নি। পাল্টা অভিযোগ এসেছে বারবার। আর সেই বৃহস্পতি মিশনের উপর তদন্ত চলল আরো কতবার তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এ সমস্ত ব্যাপার মিলে ওয়াশিংটনে ধ্বংস হয়েছে তার ক্যারিয়ার, কিন্তু যোগ্য মানুষ তার যোগ্যতার জন্যেই কখনো দীর্ঘ সময় বেকার থাকে না। আরো ধীর লয়ের ইউনিভার্সিটির জীবন সব সময়ই তাকে টানত এবং পৃথিবীর সবচে সুন্দর এক এলাকার সাথে গাঁটছড়া বাঁধার পর তার মনে হয় এমন কিছু হতোই, এটাই তার সার্থক গন্তব্য। চাকরির একমাস পরে যখন একঝাঁক টুরিস্টের সঙ্গে কিলাওয়ায় অগ্নিঝর্না দেখছে তখনই হবু দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়।

ক্যারোলিনের কাছে হেউড ফ্লয়েড সন্তুষ্টি খুঁজে পেয়েছে। এ তুষ্টি ঠিক সুখের মতো দামি, সুখের মতো স্থায়ী। ম্যারিয়নের দুকন্যার একজন ভাল সৎ মা। তাকে উপহার দিয়েছিল প্রথম পুত্র। ক্রিস্টোফার। বয়সে কুড়ি বছরের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মেয়েটা তার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারে। ভাল করে দেয় মনটা। ভাগ্যকে ধন্যবাদ, সে এখন দুঃখবোধ ছাড়াই ম্যারিয়নের কথা গভীরভাবে মনে করতে পারে। কিন্তু মনমরা ও ব্যাকুল ভাব থেকেই যায়, এটুকু জীবনের বাকি সময় থাকবে সঙ্গে সঙ্গে।

ফ্লয়েড হাতের মৃদু ইশারায় ডাকল ক্যারোলিনকে। সে মাছ ছুঁড়ছিল বড় পুরুষ ডলফিন-যাকে তারা স্কারব্যাক বলে ডাকে-ওটার দিকে। নীরব সংকেত আসছে কমসেট থেকে। ক্যারোলিনের আগেই কথা বলার জন্য সে সরু ধাতব ব্যান্ডে টোকা দিয়ে হেঁটে চলে গেল কাছের ঘরে ছড়ানো কমসেটের দিকে। এ যোগাযোগের যন্ত্রগুলো ভালই কাজ দেয়।

চ্যান্সেলর বলছি। কে?

হেউড? আমি ভিক্টর। আছ কেমন? এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে অনুভূতির এক সম্পূর্ণ প্রবাহ ফ্লয়েডের মনে বিদ্যুতের মতো চমকে ওঠে। বিরক্ত হয় অনেকটা। ফোন করেছে তার উত্তরসূরি, সেই এন সি এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট। ফ্লয়েড নিশ্চিত, তার সর্বনাশের পেছনে এ লোকই দায়ী। সে ওয়াশিংটন থেকে চলে আসার পর কখনো একবারও তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি ভিক্টর। কিন্তু রাগ ভাবটা একটু কমে গিয়ে এল আগ্রহ; তারা কী বলতে চায়? কিন্তু ফ্লয়েড তো কিছুতেই তাদের উপকার করবে না। তারপর এল শিশুসুলভতার জন্য লজ্জা এবং সবশেষে এক উত্তেজনার উচ্ছ্বাস। ভিক্টর মিলসন তাকে ডাকতে পারে মাত্র একটা কারণে।

যতোটা সম্ভব, নিরপেক্ষ স্বরে ফ্লয়েড উত্তর দিল, ভিক্টর, আছি কেমন আমি অভিযোগ করতে পারি না। অনেক অনেক ভাল। কী সমস্যা?

সার্কিটটা কি নিরাপদ?

না, আমি আর এমন কোনো কাজ করি না যে আমাকে গোপন সার্কিট ব্যবহার করে বিদেশী গুপ্তচরের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হবে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

হু। আচ্ছা, আমি এটাকে এভাবেই রাখবো। তোমার পরিচালিত শেষ প্রজেক্টের কথা কি মনে আছে?

সম্ভবত ভুলিনি। এই মাসখানেক আগেও নভশ্চরণবিজ্ঞানের সাব কমিটি আমাকে আরো প্রমাণ দিতে ডেকেছিল, ভুলি কী করে?

অবশ্যই, অবশ্যই। আসলে আমার নিজের জন্যই তোমার দেয়া বিবৃতিটা পড়া উচিত, যখনই এক মুহূর্ত সময় পাই। কিন্তু ফলো-আপ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় রাতদিন; সেটাই সমস্যা।

আমি ভেবেছিলাম সিডিউল অনুসারে ঠিকঠাক চলছে সবকিছু।

দুর্ভাগ্যচলেনি। আমাদের এগিয়ে যাবার কোনো পথই নেই; সবচে বেশি অগ্রাধিকার দিলেও মিশন শুরুর দিনটা মাত্র কয়েক সপ্তাহ এগিয়ে আনা যেত। মোদ্দা কথা, আমাদের অনেক দেরি হবে।

সরল ভাব দেখিয়ে ফ্লয়েড বলল, বুঝলাম না।

আমরা সময় নষ্ট করতে চাই না-অবশ্যই চাই না; কিন্তু বাস্তবে সময়সীমাটা বেঁধে দেয়া নেই।

এখন এক বচন করার সময় শেষ-বহুবচন বল। কাজ করছে দুটো ব্যাপার। ফ্লয়েড ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলে।

অবাক করছ তুমি আমাকে।

ভিক্টর যদি কোনো ভোগান্তি দেখে থাকে সেটা ফ্লয়েডের সমস্যা নয়। ফ্লয়েড এড়িয়ে গেল তার উদ্বেগকে, হ্যাঁ দুটো সমস্যা সামনে-একটা মানুষের বানানো; অন্যটা না। সবচে বড় কথা, আমরা সবার আগে সেখানে যেতে পারব না। পুরনো শত্রুরা কমপক্ষে এক বছর আমাদের মনে আঘাত করবে।

খবর খারাপ।

খারাপ না। এমনকি তারা প্রতিযোগিতা না করে গেলেও আমাদের অনেক দেরি হবে। পৌঁছে সেখানে কিছু পাব না।

হাস্যকর। আমি নিশ্চিত কংগ্রেস যদি মাধ্যাকর্ষণ আইন বাতিল করত, আমি শুনতাম।

আমি সিরিয়াস। পরিস্থিতি সুবিধার না-এখন বর্ণনা দিতে পারব না। তুমি কি সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবে ওখানে?

হ্যাঁ। মধ্যরাতের পর ওয়াশিংটনে একটা ভাল তোলপাড় হবে, শান্তির সাথে ভেবে ফ্লয়েড উত্তর দিল।

চমৎকার। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একটা প্যাকেজ পাবে। পড়ে আমাকে কল করো।

দেরি হয়ে যাবে না?

তা হবে। কিন্তু আগেও প্রচুর সময় নষ্ট করেছি। আর নষ্ট করতে চাই না। মিল্টন সময়মতো পাঠায় জিনিসটা। ঠিক এক ঘন্টা পর এয়ার ফোর্সের একজন কর্নেলের মাধ্যমে সিলমোহর করা এক বিরাট খাম পেল ও। ফ্লয়েড এর সারমর্ম পড়ার সময় কর্নেল ক্যারোলিনের সাথে ধৈর্য ধরে খোশগল্প করে নিল, ভদ্রভাবে।

মনে হয় আপনি পড়ে শেষ করলে এটা আমাকে নিয়ে যেতে হবে। উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বার্তাবাহক কৈফিয়ত দিল। পড়ার প্রিয় দোলনা বিছানায় আরাম করে বসে ফ্লয়েড বলল, শুনে খুশি হলাম।

দুটো ডকুমেন্ট, প্রথমটা খুব ছোট। উপরে টপ সিক্রেট সিল আঁটা। টপ কথাটা কেটে ফেলা হয়েছে এবং সংশোধনী তিনটা সই করে অনুমোদন করা, সবগুলোই পুরোপুরি অস্পষ্ট। বোঝাই যায়, কোনো বড় প্রতিবেদনের অংশ এটা। ভালমতো পরীক্ষা করা হয়েছে বারবার। ফাঁকা জায়গায় ভর্তি দেখে পড়তে বিরক্ত লাগে। উপসংহার একটা বাক্যে লেখা: রাশিয়ানরা ডিসকভারিতে পৌঁছবে এর আইনসম্মত মালিক পৌঁছার অনেক আগে। ফ্লয়েড আগেই তা জানত, সে দ্রুত মন ফেরালো দ্বিতীয় ডকুমেন্টের দিকে। এবার আর তারা নামে ভুল করেনি দেখে খুশি হয়েছে। অনেকটা। দিমিত্রি যথারীতি নির্ভুল। মহাশূন্যযান নভোচারী এলেক্সি লিওনভ মানুষসহ অভিযানে বৃহস্পতির দিকে রওনা দেবে এবার।

দ্বিতীয় ডকুমেন্ট অনেক বড় এবং স্রেফ গোপনীয়; প্রকাশের আগে অনুমোদনের অপেক্ষায় এটা ছিল বিজ্ঞানের এক খসড়া পত্র। শিরোনাম প্রাণবন্ত, মহাশূন্যযান ডিসকভারি: ব্যতিক্রমী কাক্ষিক আচরণ।

তারপর অঙ্ক ও জ্যোতির্বিদ্যার ছকের এক ডজন পাতা। আমেরিকান ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাস্ট্রোনটিক্স ফাঁদে পড়েছে। ডিসকভারির খোঁজ নিতে পারেনি ঠিকমতো। ফ্লয়েড মনে গানের সুর তুলে চোখ বুলিয়ে গেল এগুলোয়। চেষ্টা করল নিজেদের কাজ সমর্থনের বা অস্বস্তির ছোটখাট লেখা খুঁজে বের করার। শেষ পর্যন্ত অবাক হয়ে কষ্টের এক হাসি দিল সে। সম্ভবত কেউ ভাবেনি যে মহাশূন্যযানের সঙ্গে যোগাযোগকারী ট্র্যাকিং স্টেশন ও ক্যালকুলেটরে অবাক করা তথ্য ধরা পড়তে পারে। উত্তেজিত মনোভাব গোপন করার কাজ চলছে। কিছু লোক অবশ্যই চাকরি হারাবে এবং সে জানে, ভিক্টর মিলসন তাদের বরখাস্তে মজা পাবে-যদি সে নিজেই প্রথম পর্যায়ে বাদ না পড়ে। কংগ্রেস যখন ট্রাকিং নেটওয়ার্কের বরাদ্দ কেটেছিল তখন সে খুব চেঁচিয়েছে। হয়ত টাকা কাটায় ডিসকভারির খোঁজ নেয়া যায়নি এ কথাটা তাকে বাঁচাবে, কে জানে।

ধন্যবাদ, কর্নেল পেপারে চোখ বুলাননা শেষ করে ফ্লয়েড বললো সাজানো গোছানো দলিল আমার খুব ভাল লাগল। পুরোপুরি আগের মতো। ঐ একটা জিনিস আমি মিস করিনি।

কর্নেল খামটা যত্ন করে ব্রিফকেসে রেখে লক করে দিল।

ড. মিলসন তার ডাকের জবাব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাওয়ার আশা করবেন।

আমি জানি। কিন্তু আমার নিরাপদ সার্কিট নেই, কয়েকজন নামী মেহমানও আসছেন। আমি যে দুটো ডকুমেন্টই পড়েছি একথা বলার জন্য হিলোতে আপনাদের অফিসের দিকে যেতে পারব না। গেলে আমার বারোটা বাজবে। তাকে বলবেন আমি সেগুলো ভালমতো পড়েছি, পরের যে কোনো যোগাযোগের জন্য অপেক্ষা করব।

মুহূর্তের জন্য মনে হল কর্নেল যেন অন্য কিছু চায়। তারপর এ নিয়ে ভালমতো চিন্তা করে, সঠিক বিদায় জানিয়ে গোমরা মুখে মিশে গেল বাইরে, রাতের কালিগোলা অন্ধকারে।

এতদিন পর এমন তাড়া দিয়ে খবর পাঠানোর কী হল? প্রশ্ন করল ক্যারোলিন, প্রয়োজনীয় হোক বা নাহোক, আজ রাতে কোনো মেহমান আসার কথা নেইতো!

গেস্টের কথা ছাড়, আমার উপর হুকুম করাকে ঘৃণা করি, বিশেষত ভিক্টর মিলসন,..

কর্নেল রিপোর্ট করার সাথে সাথেই সে তোমাকে ডাকবে।

এবং তখন অবশ্যই আমাদের ভিডিওর সুইচ অফ থাকবে। শব্দ করতে হবে, যেন ঘরে কয়েকজন আছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে, এখন আমার কিছু বলার নেই।

যদি প্রশ্ন করি, কী নিয়ে কিছু বলার নেই?

স্যরি, প্রিয়তমা, তোমাকে বলা হয়নি। মনে হয় ডিসকভারি চালাকি করছে আমাদের সাথে। ভেবেছিলাম কক্ষপথে আছে ডিসকভারি, এখন দেখা যাচ্ছে, ধ্বংসের পথে।

পড়ে গেছে ভিতরে?

না-তা একেবারে অসম্ভব। স্পেস শিপটা বৃহস্পতি-আইওর মাঝখানে যথেষ্ট দূরত্বে পার্ক করা। সেখানেই থাকতে হবে, অবশ্য বাইরের দিকের চাঁদের আকর্ষণ সামনে পেছনে ঘোরাবে।

কিন্তু এখন খুব খারাপ কিছু একটা হচ্ছে, যার পূর্ণ ব্যাখ্যা আমরা জানি না। স্পেসশিপটা দ্রুত আইওর দিকে ভেসে যাচ্ছে-মাঝে মাঝে দ্রুত যায় এমনকি মাঝে মাঝে চলে আসে পেছনের দিকেও। এ অবস্থা চলতে থাকলে দু-তিন বছরের মধ্যে সোজা পড়ে যাবে আইওর বুকে।

আমি ভেবেছিলাম অ্যাস্ট্রোনমিতে এমন হতে পারে না। এটা কি আকাশ বিষয়ের বলবিদ্যা না যাকে প্রকৃত বিজ্ঞান হিসাবে ধরা যায়? তার মানে আজো

আমরা তথাকথিত নিঃস্ব পিছিয়ে পড়া জীববিজ্ঞানীর পর্যায়ে পড়ে আছি?

যখন সবকিছু হিসাবের মধ্যে আনা হয়, তখন তা প্রকৃত বিজ্ঞান। কিন্তু খুব অদ্ভুত কিছু ব্যাপার ঘটছে আইওর ক্ষেত্রে। এর আগ্নেয়গিরির কথা বাদ দিলেও প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক বিচ্ছুরণ ঘটছে-তার উপর বৃহস্পতির চৌম্বকক্ষেত্রের চারদিকে ঘুরছে প্রতি দশ ঘণ্টা অন্তর। বোঝাই যায় শুধু মাধ্যকর্ষণ বলই ডিসকভারিকে টেনে নামাবে না… এ নিয়ে আমাদের তাড়াতাড়ি ভাবতে হবে।

অল রাইট, এটা আর তোমার সমস্যা না। এজন্য তোমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।

তোমার সমস্যা-ঠিক একই কথা দিমিত্রিও বলেছিল। আর দিমিত্রি, একটা ধূর্ত বুড়ো খেকশিয়াল!

ক্যারোলিনের অনেক আগ থেকেই ফ্লয়েডকে চেনে দিমিত্রি। এটা ফ্লয়েডের সমস্যা না হতে পারে, কিন্তু এখনো আছে তার দায়দায়িত্ব। আরো অনেকে জড়িত এতে, কিন্তু শেষ বিশ্লেষণে বৃহস্পতি অভিযানের জন্য পরিকল্পনাটা ফ্লয়েডই অনুমোদন করেছিল। দেখাশোনা করেছে পরিকল্পিত কাজগুলো।

ফ্লয়েড বিবেকের অস্বস্তিতে ভোগে, একজন বিজ্ঞানী হিসেবে উল্টো কাজ করাটা কি ঠিক? তারই প্রজেক্ট এই ডিসকভারি। তার ভাবনা একজন আমলার মতো। মিশন ব্যর্থতার কথা তুলে সে পুরনো প্রশাসনের অদূরদর্শী রাজনীতি সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে পারত, পারত বিরোধিতা করতে-যদিও কী পরিমাণে সেগুলো বিপর্যয়ে প্রয়োগ করা হয়েছিল তা তখনও পর্যন্ত অনিশ্চিত।

জীবনের এ অধ্যায়ের পাট চুকিয়ে দিলেই সবচে ভাল হয়, তার এ সব চিন্তা ও কর্মশক্তি নতুন পেশায় দেয়া যায় সহজেই। কিন্তু মন থেকেই সে জানে, অসম্ভব; দিমিত্রি পুরনো পাপ না করলেও সেগুলো স্বেচ্ছায় ভেসে উঠতো।

চারজন লোক মারা গেছে, আর একজন অদৃশ্য গ্রহ-চাঁদের মেলায়।

ডক্টর হেউড ফ্লয়েডের হাতে কয়েক বছর যাবৎ লেগে আছে রক্ত, সে জানে না কীভাবে এসব ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়।

৩. এস এ এল ৯০০০

ডক্টর শিবশুমানিয়া চন্দ্রশেখরাম পিল্লাই, আরবানার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের প্রফেসর, অপরাধের চিরন্তন বিচারবুদ্ধি তারও আছে। কিন্তু সে হেউড ফ্লয়েডের চেয়ে অনেকটা ভিন্ন ব্যক্তিত্বের লোক। তার ছাত্র এবং সাথীরা সন্দেহ করে এই বেঁটেখাটো বিজ্ঞানী হয়ত পুরোপুরি মানবীয় নয়। তারা জেনে অবাক হবে না যে সে কখনো মৃত নভোচারীদের সম্পর্কে ভাবেনি। ড. চন্দ্রের কষ্ট কেবল তার হারানো শিশু, হাল ৯০০০ এর জন্য। এমনকি এত বছর পরেও।

ডিসকভারি থেকে রেডিওতে পাওয়া ডাটার উপর সে অপরিসীম পর্যালোচনা করেছে। তার পরও নিশ্চিত হতে পারেনি-কোথায় ছিল ভুলটা। সে শুধু তথ্যগুলো ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু সত্যি ঘটনাটা তার জানা দরকার। আর সত্যটা হালের সার্কিটে বন্দী, সৌর জগতের অন্য পাশে, বৃহস্পতি এবং আইওর মাঝখানে।

ট্র্যাজেডির মুহূর্ত পর্যন্ত ঘটনা পরিষ্কারভাবে সবার জানা; সেখানে কমান্ডার বোম্যান আবার যোগাযোগ করে। তারপর দেয় কিছু বিস্তারিত বর্ণনা। কিন্তু সমস্যার কথা জেনেও কেন যেন ব্যাখ্যা করেনি।

ভেসে চলেছে ডিসকভারি, গ্রহরাজের দিকে। পৃথিবী তখন দু আলোক ঘণ্টা দূরে। জন্মদিনের পার্টিতে নাক গলালো বুদ্ধিমান কম্পিউটার হাল, সেই বিখ্যাত কথা, …আমরা একটা সমস্যায় পড়েছি।

হ্যাঁ, যে ডিশটা এতোদূর থেকেও নিখুঁতভাবে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করে তার নাম ই ভি এ। ই ভি এ-কে সেদিকে আবদ্ধ রাখে ছোট্ট একটা জটিল সার্কিট, সার্কিটটাও শিপগাত্রের বাইরে, অ্যান্টেনার ভিতে বসানো। হাল জানায়, সেটা নষ্ট হবে দুদিনের মধ্যে। ফলাফল সবার জানা-হারিয়ে যাবে পৃথিবী, হারাবে যোগাযোগ, তারপর শিপে বসে হাতেনাতে অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে এখান থেকে পৃথিবীকে খুঁজে পাওয়া আর মহাসমুদ্রে তলানো পিন তুলে আনা সমান কথা। তাই, বেরিয়ে গিয়ে ইউনিটটা তুলে আনা উচিত।

কেউ কোনো আপত্তি করতে পারেনি। মুহূর্তের মধ্যে ইউনিট বদলে দেয়া সহজ। এমনকি নষ্ট হয়ে গেলেও ঠিক করা যায়। শিপে আরো দুটো বাড়তি অংশ আছে।

নষ্ট ইউনিট আনার জন্য বাইরে গিয়েছিল ফ্র্যাঙ্ক পোল, স্পেস পোড়ে চড়ে। স্পেস পোড বিভিন্ন কাজের খুচরো যান; ভ্রাম্যমাণ কারখানা হিসেবেও কাজে লাগত। পোডের হাত বেশ ভাল হলেও অ্যান্টেনা ইউনিট সরানোর কাজ একটু কঠিন। তাই পোড থেকে নেমে যায় পোল, শিপগাত্রের একটা ফুটো ঠিক করে, তারপর তুলে আনে ই ভি এর ইউনিটটা।

কিন্তু পরীক্ষা করে যন্ত্রটা এত ভাল পাওয়া গেল যে সবাই অবাক হয়ে পড়ে। অটোমেটিক চেকিং সেই সার্কিটের কোনো ভুল ধরতে পারেনি। খবরটা আরবানায় পাঠানোর পর হালের যমজ সাল ৯০০০ পৃথিবীতে ফিরে যায়নি আর।

কিন্তু হাল মানুষের চেকিংয়ের ভুলের ব্যাপারে মন্তব্য দেখিয়ে শক্তভাবে বলে চলে, তার কথাই ঠিক।

মিশন কন্ট্রোলের কাছে রিপোর্ট করেছিল বোম্যান। মিশন কন্ট্রোল জানায়, হালকে নিষ্ক্রিয় করে কিছু প্রোগ্রাম অ্যানালাইসিস চালাতে হবে। এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে, হালের ডায়াগোলাইসিস বিষয়ক তথ্য আসার সময় আবার সে ঘোষণা করে যে তার ভুল ধরার অংশ বলছে যে প্রতিস্থাপিত দ্বিতীয় ইউনিটটাও নষ্ট হবার পথে।

সুখী এক শিপের নাম ছিল ডিসকভারি। আনন্দ উবে যায় বোম্যান আর পোলের মন থেকে। তারা ঠিকই বুঝেছে কোনো না কোনো গণ্ডগোল দানা বাঁধবে সেখানে। কয়েক মাস ধরে হালকে ছোট্ট পৃথিবীর তৃতীয় সদস্য হিসেবে নিয়েছিল, এবং জানত তার প্রতিটি মেজাজ সম্পর্কে। সূক্ষ্মভাবে বদলে গেল শিপের অবহাওয়া; বাতাসে টান টান অবস্থা।

মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল বোম্যান। মারাত্মক কিছু হওয়ার ভয় থাকলে হাল সেসব সমস্যার সমাধান করত। ক্রুরা ঠিক করে হালই এখন সমস্যা; ঠিক করে কিন্তু প্রকাশ্য ভাষায় নয়, এম্নিতেই একজন আরেকজনকে বুঝতে পারে। তারপর সন্দেহ সত্ত্বেও তারা যার যার কাজ করে যায়।

পোল দ্বিতীয়বার বেরিয়ে পড়ে।

তারপরের ঘটনা বাইরের ক্যামেরা রেকর্ড করতে পারেনি, একটু সন্দেহজনক ব্যাপার। বোম্যান প্রথমে পোলের চিৎকার শুনতে পায়-তারপর, নিরবতা। এক মুহূর্ত পরে দেখতে পায় পোলকে, হুড়মুড় করে উপরে, আরও উপরে উঠছে, পাক খাচ্ছে মহাশূন্যে। তার নিজের পোডই ধাক্কা দিয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে হয় বিস্ফোরিত।

বোম্যান পরপর বেশ কয়েকটা বড় ভুল করেছে-একটা ছাড়া সবগুলো ক্ষমা করা যায়। হালের প্রতি তার সন্দেহ প্রকাশ করেনি, কিন্তু আচরণে প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

সে মিশন কন্ট্রোলের নিয়ম জানে। কেউ মারা গেলে তার বদলে শীতনিদ্রা তথা হাইবারনেশনে থাকা অন্যদের মধ্যে একজনকে জাগাতে হবে। বোম্যান সন্দেহ করে হাল এলোমেলো কিছু একটা করছে। পর পর দুবার ই ভি এ ইউনিট নষ্ট হয়ে যোগাযোগ বন্ধ হতে পারে না। পোলের মৃত্যুও অস্বাভাবিক। তাই সে অর্ডার করে, সবগুলো হাইবারনেশন ক্যাপসুলের নিয়ন্ত্রণ হালের হাত থেকে সরিয়ে আলাদা স্বাধীন ইউনিটে পরিণত করতে হবে। ক্যাপসুলগুলো কেন্দ্রীয় কম্পিউটারের আওতায় থাকতে পারে আবার স্বয়ং সম্পূর্ণ ইউনিট হিসেবেও থাকতে পারে।

তারপর হাজারো অজুহাত তোলে হাল। সে মানতে রাজি নয়। কাউকে জাগাতেই দিবে না। হাল আর বোম্যানই নাকি যথেষ্ট। বোম্যান এবার কাটা কাটা কথায় আদেশ করে। সাথে সাথে ঘুমন্ত তিন হাইবারনেটরকে হত্যা করে ডিসকভারির সমস্ত বাতাস বাইরে বের করে দিতে শুরু করে হাল। বন্ধ করে দেয় ইলেক্ট্রিসিটি। বোম্যান কোনোমতে একটা ইমার্জেন্সি অক্সিজেন শেল্টারে আশ্রয় নিয়ে, গায়ে স্পেসস্যুট চাপিয়ে, অক্সিজেন সিলিন্ডার কাঁধে ঝুলিয়ে ইমার্জেন্সি লাইটের আলোয় এগিয়ে যায় হালের মস্তিষ্ক ভল্টের সামনে।

শেষে হালকে অসাড় করার জন্য এগিয়ে গিয়ে মাথার মডিউল এর প্লাগ একটা একটা করে খুলে ফেলেছিল ডেভিড বোম্যান; ২০০১ সালে।

জাহাজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বোম্যান ছিল একা। পুরো মানব ইতিহাসে এর আগে কেউ এত একা থাকেনি।

এ অবস্থায় অন্যরা হয়ত হতাশায় অসহায়ত্বের কাছে নিজেদের ছেড়ে দিত। কিন্তু এখন ডেভিড বোম্যান প্রমাণ করল যারা তাকে বাছাই করেছিল আসলেই তাদের পছন্দ ভাল। সে ডিসকভারিকে সচল রাখার ব্যবস্থা করে পুরো তরীকে এমন সুন্দরভাবে বসালো যাতে আটকে পড়া অ্যান্টেনা পৃথিবীর দিকে ফেরানো থাকে। এভাবে মিশন কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ আবার শুরু।

ডিসকভারি তার ঈষৎ বাঁকা পথে পৌঁছে যায় লক্ষ্যের দিকে। সেখানে বোম্যান দৈত্য গ্রহের চাঁদ-তারার মেলায় কক্ষপথে ঘোরার সময় টাইকো মনোলিথের মতো ঠিক একই আকৃতির কিন্তু অনেকগুণ বড় কালো এক পাথর খণ্ডের সন্ধান পায়। এটা দেখার জন্যই আসলে মিশন পাঠানো হয়েছিল। বিপদের মুখোমুখি ভালমতো দেখার জন্য সে এক স্পেস পোর্ডে করে বাইরে যায়, এবং সেখানে গিয়েই বলে সেই যুগান্ত কারী কথা, মাই গড! আমার সামনেটা তারায় তারায় ভরা!

তারপর থেকেই ঐ রহস্য আর সবার উদ্বেগের কারণ। ড. চন্দ্র সব সময় হালের সবকিছুতে মুগ্ধ। তার আবেগহীন মনে ঘৃণা ছিল একটা ব্যাপারে। অনিশ্চয়তা। হালের আচরণের কারণ না জানা পর্যন্ত সে কখনো সন্তুষ্ট হবে না। এমনকি এখনো একে ব্যর্থতা বলে সে স্বীকার করে না; বড়দের এ এক অস্বাভাবিক ব্যাপার।

যে ছোট বদ্ধ ঘরকে ডক্টর চন্দ্র খাস কামরা হিসেবে ব্যবহার করে তা একটা মাত্র আংটাওয়ালা চেয়ার আর একটা ব্ল্যাকবোর্ড দিয়ে সাজানো। আর আছে দুটো ছবি। সাধারণ মানুষ ছবিগুলো চিনতে পারে না। কিন্তু এখানে ঢোকার অনুমতি যারা পায় তারা সবাই গণিতবিদ্যার উঁচু স্তরের মানুষ। তাদের যে কেউ সেই দুজনকে জন ভন নিউম্যান এবং অ্যালান তুরিং বলে সাথে সাথে চিনতে পারে-তারা গণক মন্দিরের যমজ দেবতা।

ডেস্কের উপর কোনো বই থাকে না, এমনকি কাগজ-পেন্সিলও না। পৃথিবীর সব লাইব্রেরীর সমস্ত তথ্য যে চন্দ্রের আঙুলের ছোঁয়ার সাথে সাথে সজীব হয়ে উঠবে, তার টেবিলে এসব থাকার কথাও নয়। দেখা যায় শুধু তার ছবি আঁর খাতা এবং রাইটিং প্যাড। এমনকি ব্ল্যাকবোর্ডটিও শুধু ভিজিটরদের জন্য, এর উপর শেষ যেদিন আঁকিবুকি করা হয় সেদিনের লেখাটা আধমোছা; তার গায়ে তিন সপ্তাহ আগের তারিখ।

ডক্টর চন্দ্র তার বিষাক্ত চুরুটগুলোর মধ্যে একটা ধরায়। এগুলো আমদানী করেছিল মাদ্রাজ থেকে। তার সামনের প্যানেলের সুইচ কখনো বন্ধ করা হয়নি, পরীক্ষা করে দেখল ডিসপ্লেতে জরুরি খবর নেই, তারপর কথা বলল মাইকে। সবাই ঠিক ঠিক বিশ্বাস করে, এটাই তার একমাত্র ছেলে।

গুডমর্নিং, সাল। আমার জন্য নতুন কোনো ডাটা নেই নাকি?

না, ডক্টর চন্দ্র। আমার জন্য তোমার কাছে কিছু থাকার কথা।

কণ্ঠটা যুক্তরাষ্ট্রে অথবা তার নিজ দেশের শিক্ষিত যে কোনো সংস্কৃতিবান হিন্দু মহিলার হতে পারে। সালের শিক্ষা সেভাবে শুরু হয়নি, কিন্তু বছরের পর বছর সে চন্দ্রের স্বরভেদের অনেকটা কুড়িয়ে নিয়েছে।

এ বিজ্ঞানী সবচে বেশি নিরাপদে সালের মেমোরিতে ইনপুট দেখার জন্য বোর্ডটাকে এক সংকেত দিল। কেউ জানল না যে সে এ সার্কিট দিয়ে কম্পিউটারের সাথে কথা বলেছে। সে যা বলেছে তার সামান্যই আসলে বুঝতে পেরেছে সাল। এটা কোনো ব্যাপার না। ব্যাপারটা আসলে সৃষ্টির কাছে স্রষ্টার ঠকে যাওয়া। ব্যাপারটা আসলে তার প্রত্যাশা অনুযায়ীই হয়-এসব গোপনীয় যোগাযোগ চন্দ্রের মানসিক ভারসাম্য এমনকি সুস্থতা রক্ষায় সাহায্য করে।

সাল, তুমি প্রায়ই আমাকে বল যে আরো তথ্য ছাড়া আমরা হালের অস্বাভাবিক আচরণের সমাধান করতে পারব না। কিন্তু কীভাবে আমরা সেই ডাটা পেতে পারি?

খুব সোজা। কাউকে অবশ্যই ডিসকভারিতে ফিরে যেতে হবে।

ঠিক। এখন দেখা যাচ্ছে আমরা যখন আশা করছি তার আগেই ব্যাপারটা হবে।

শুনে খুশি হলাম।

আমি জানতাম তুমি খুশি হবে। চন্দ্র উত্তর দিল। সে আসলেই বলছে যে সাল খুশি হতে পারে! ড. চন্দ্র অনেক আগে দার্শনিকদের সমিতিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ নষ্ট করেছে। এমনকি সমিতিগুলোও সংখ্যায় কমে আসছে। সেসব দার্শনিক এমনকি বিজ্ঞানীরাও আপত্তি করে বলেছিল কম্পিউটার আসলে আবেগ অনুভব করতে পারে না, ভান করতে পারে।

সে একবার এক সমালোচককে ঘৃণাভরে সমুচিত জবাব দেয়, সাথে সাথে, যদি আমাকে প্রমাণ দিতে পার যে তুমি রেগে যাওয়ার ভান করনা-তাহলে মেনে নেব।

আমি কিন্তু তোমাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছি। সেই মুহূর্তে তার প্রতিপক্ষ রেগে যাওয়ার ভান করে প্রতারণা করেছিল দারুণভাবে।

এখন আরেক সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখতে চাই, চন্দ্র বলতে লাগল, ডায়াগনোসিস শুধু প্রথম কাজ। রোগমুক্ত না করা পর্যন্ত এ পদ্ধতি শেষ হয় না।

তুমি কি মনে কর যে তাকে আবার ঠিক করে আগের মতো সব কাজ করানো যাবে?

আশা করি। আম ঠিক জানি না। খুব বড় ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে, নিশ্চয়ই মেমোরির বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে।

চিন্তায় পড়ে গিয়ে থেমে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে, অভ্যাসমতো ফুঁ দিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়ল ডক্টর চন্দ্র। ধোয়াটা সালের কাঁচের উপর ষাঁড়ের চোখের মতো দাগ বসিয়ে দেয়। মানুষ একে বন্ধুভাবাপন্ন ইঙ্গিত বলে বিবেচনা করবে না; তবু কম্পিউটারের অনেক সুবিধার মধ্যে এও একটা।

তোমার সহযোগিতা আমার প্রয়োজন, সাল।

অবশ্যই, ডক্টর চন্দ্র।

কিছু ঝুঁকি থাকতে পারে।

কী বোঝাতে চাচ্ছ?

আমি তোমার কিছু সার্কিট বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তাব করছি। এমন সার্কিট যেগুলো তোমার উঁচু পর্যায়ের কাজ করে। কাজটা কি বিরক্ত করবে তোমাকে?

আরো তথ্য ছাড়া উত্তর দিতে আমি পারব না।

খুব ভাল কথা। আমাকে এ ব্যাপারটা এভাবে উপস্থাপন করতে দাও…যখন প্রথম তোমার সুইচ অন করা হলো তুমি না থেমে চলেছ এতদিন, তাই না?

হ্যাঁ। ঠিক।

কিন্তু তুমি জানো যে আমরা মানুষেরা তা করতে পারি না। আমাদের ঘুমের প্রয়োজন হয় এবং তখন আমাদের মানসিক কাজ প্রায় পুরোপুরি থেমে যায়, কমপক্ষে সচেতন অবস্থা পর্যন্ত।

আমি জানি। কিন্তু বুঝি না।

বেশ, ঘুমের মতো একটা কিছুর অভিজ্ঞতা তোমার দরকার। সম্ভবত এমন হবে…সময় যাবে, কিন্তু তুমি বুঝবে না। ভিতরের ঘড়ি পরীক্ষা করলে দেখবে তোমার মনিটর রেকর্ডে কিছু ফাঁকা জায়গা। ওকে?

কিন্তু তুমিতো বললে একটু ঝুঁকি থাকতে পারে। সেগুলো কী?

খুব সামান্য ভয় থাকে-ভয়তো গুণে ফেলা যাবে না। আমি সার্কিট যখন পুনঃসংযোগ করব তখন তোমার ব্যক্তিত্বে কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে, পরিবর্তন হতে পারে তোমার ভবিষ্যৎ আচরণ রীতিতেও। পার্থক্যটা বুঝতেও পার তখন, তবে খুব ভাল বা খুব খারাপ না।

আমি জানি না তাতে কী বোঝায়।

স্যরি। কোনোকিছু না ও বোঝাতে পারে সে ব্যপারটা। এ নিয়ে ভেব না। এখন একটা নতুন ফাইল খোলল প্লিজ-এই নামে। কিবোর্ডে ইনপুট দিয়ে চন্দ্র টাইপ করল-ফিনিক্স।

সে সালকে প্রশ্ন করে, শব্দটার মানে জানো নাকি?

বোঝা যায় না এমন সামান্য সময় থেমে কম্পিউটার উত্তর দিল, বর্তমান বিশ্বকোষে পঁচিশটা উদাহারণ আছে এ শব্দটার।

কোনটাকে ঠিক মনে হয়?

একিলিসের গৃহশিক্ষক?

মজার ব্যাপার তো। তাকে আমি চিনলাম না। আবার চেষ্টা কর।

আগের জীবনের ছাই থেকে পুনর্জন্মলাভ করা অবাস্তব পাখি।

চমৎকার। এইতো, তুমি বুঝতে পারছ। কেন আমি একে পছন্দ করলাম?

কারণ তুমি আশা করছ যে হালকে আবার ঠিক করা যাবে।

তোমার সহযোগিতায়। তুমি তৈরি তো?

এখনও না। একটা প্রশ্ন করতে চাই।

কী প্রশ্ন?

আমি কি স্বপ্ন দেখবো?

অবশ্যই তুমি দেখবে। সব বুদ্ধিমান প্রাণী স্বপ্ন দেখে-কিন্তু কেন কেউ জানে না। চন্দ্র মুহূর্তের জন্য থামল, চুরুট থেকে আর একটা ধোয়ার ফাঁক দিয়ে প্রায় অস্পষ্ট সুরে কিছু বলল যা কখনো মানুষের কাছে স্বীকার করা মানায় না।

সম্ভবত তুমি হালকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে…যেমন আমি প্রায়ই দেখি।

৪. অভিযানের রূপরেখা

ইংরেজী অনুবাদ :

প্রতি : ক্যাপ্টেন তাতিয়ানা (তানিয়া) অর্লোভা, বিশ্বতত্ত্ববিদ কমান্ডার-মহাশূন্যযান এলেক্সি লিওনভ (ইউএনসিওএস রেজিস্ট্রেশন ০৮/৩৪২)

হতে : ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাস্ট্রোনটিক্স, পেনসিলভানিয়া এভিনিউ, ওয়াশিংটন।

বহিঃমহাশূন্য বিষয়ক কমিশন, ইউএসএসআর বিজ্ঞান একাডেমি। করোলিভ প্রসপেক্ট, মস্কো।

অভিযানের লক্ষ্য :

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আপনাদের অভিযানের লক্ষ্য হচ্ছে :

১. ইউএস মহাশূন্যযান ডিসকভারির সাথে মিলিত হতে বৃহস্পতি জগৎ এবং সংকেত স্থানের দিকে অগ্রসর হওয়া (ইউএনসিওএস ০১/২৮৩)।

২. মহাশূন্যযানে আরোহণ এবং এটার আগের অভিযান নিয়ে সম্ভাব্য তথ্য সংগ্রহ করা।

৩. স্পেসশিপ ডিসকভারিতে সংরক্ষিত সব সিস্টেম পুনরায় সচল করা এবং যদি প্রচুর জ্বালানি থাকে, যানকে বাঁকা পথে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা।

৪. ডিসকভারি বিপদে পড়েছে যে আর্টিফ্যাক্ট দ্বারা তা খুঁজে বের করা, রিমোট সেন্সরের সাহায্যে যতটা সম্ভব ব্যাপক অনুসন্ধান করা।

৫. যদি তা পরামর্শযোগ্য হয় এবং মিশন কন্ট্রোলের অনুমতি থাকে তবে কাছ থেকে পরিদর্শনের জন্য মিলিত হওয়া।

৬. উপরিউক্ত কাজ হলে বৃহস্পতি এবং এর উপগ্রহগুলোয় উপযুক্ত জরিপ করা।

বোঝা যায় যে আগাম না জানা পরিস্থিতির কারণে অগ্রাধিকারে পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে, বা কিছু লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব হতে পারে। এ কথা পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে যে, এলিয়েন সৃষ্ট বস্তুর তথ্য পাওয়া জরুরি। কিন্তু উদ্দেশ্য হল মহাশূন্যযান ডিসকভারির সাথে নির্ধারিত জায়গায় মিলিত হওয়া; আত্মরক্ষার প্রচেষ্টাসহ অন্য সব লক্ষ্যের মধ্যে এটা অবশ্যই অগ্রগণ্য হবে।

মহাশূন্যযান-ক্রু

স্পেসশিপ এলেক্সি লিওনভের ক্রু গঠিত হবে:

ক্যাপ্টেন তাতিয়ানা অর্লোভা (প্রকৌশল প্রচালন)
ড. ভ্যাসিলি অর্লোভ (বিমানচালন জ্যোতির্বিজ্ঞান)
ড. ম্যাক্সিম ব্ৰেইলোভস্কি (প্রকৌশল-অবকাঠামো)
ড. আলেকজান্ডার কোভলেভ (যোগাযোগ প্রকৌশল)
ড. কিনোলাই ক্যাভেরিনা রুডেঙ্কো (মেডিক্যাল লাইফ সাপোর্ট)
ড. ইরিনা ইয়াকুনিনা (মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং)।

অতিরিক্ত হিসেবে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাস্ট্রোনটিক্স নিচের তিনজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে পাঠাবে:

ড. হেউড ফ্লয়েড স্মারকলিপির ইতি টেনে হেলান দিল চেয়ারে। সবকিছু ঠিকঠাক। অভিযান শুরুর স্থানে ফিরে না এসে চালিয়ে যাওয়া বিষয়টাও অনুমোদিত হয়েছে। এমনকি মিশন বাতিল করার আশা করলেও পেছন ফেরার আর কোনো পথ নেই।

ফ্লয়েড এক পলক তাকায় সুইমিং পুলের অন্য পাশে দুবছরের ক্রিসের সাথে বসা ক্যারোলিনের দিকে। বাচ্চাটা মাটির চেয়ে পানিতে বেশি আরামে থাকে, এবং কিছু সময়ের জন্য পানির নিচে এমনভাবে ডুবে থাকতে পারে যে গেস্টরা ভয় পেয়ে যায় প্রায়ই। সে এখনো মানুষের মতো কথা বলতে শেখেনি। অথচ এ বয়সেই যেন বুঝতে পারে ডলফিনদের ভাষা।

ক্রিস্টোফারের এক বন্ধু এইমাত্র সাঁতার কেটে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভেতরে ঢুকে আদর পাওয়ার জন্য বাড়িয়ে দিল পিঠ। ফ্লয়েড ভাবল, পদচিহ্নহীন বিশাল মহাসাগরে তুমিও এক পথভোলা প্রাণী; কিন্তু তোমার ঐ প্রশান্ত মহাসাগর আমার সামনের বিশালতার কাছে কত ছোট ঘোঁট মনে হচ্ছে!

ক্যারোলিন ফ্লয়েডের স্থির তাকিয়ে থাকা খেয়াল করেছে। সে তার দিকে বিষণ্ণভাবে তাকালো, তবে রাগ করল না; রাগটা গত কদিন জ্বলে জ্বলে নিভে গেছে। এমনকি সে সামনে এসে কষ্টে ভরা ব্যাকুল একটা হাসি দিল। বলল, কবিতাটা ফিরে পেয়েছি, শুরুটা এমন :

যাকে তুমি ছেড়ে গেলে কেমন আছে সে নারী;
সাথে আছে আগুন ঘেরা একর জোড়া বাড়ি,
হে ধূসর বুড়ো! কেন বিধবার প্রভুর সাথে দিচ্ছ পাড়ি?

স্যরি। বুঝতে পারলাম না। কে বিধবার প্রভু?

কে নয়-কী। সাগর। কবিতাটা এক জলদস্যু নারীর শোকগাঁথা। শত বছর আগে রুডিয়ার্ড কিপলিং লিখেছিলেন।

স্ত্রীর হাত টেনে নিল ফ্লয়েড, ক্যারোলিন কোনো উত্তর দিল না; দিল না কোনো বাঁধা।

ভাল কথা, আমার ভাবনা মোটেও জলদস্যুর মতো না। আমি লুটের পরে বা লুটের সময় যাই না, যাই আগে এবং যা চাই…আসল ব্যাপার হল দুঃসাহসিক অভিযান।

তাহলে তুমি কেন শুধু শুধু… না, আর ঝগড়া করার ইচ্ছা নেই। কিন্তু এখন ঝগড়াও আমাদের দুজনকে সাহায্য করবে, যদি নিজের মনোভাব ঠিকভাবে তুমি বুঝতে পার।

মনে হয় ভাল একটা কারণ তোমাকে দেখাতে পারব। আমার ছোট ছোট অনেক শত্রুর মধ্যে একজন খুব শক্ত। সে আর তার দল সবশেষে এমন কিছু বোঝাতে চায় যা কল্পনাও করিনি-বিশ্বাস কর আমাকে।

আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু তুমি কি শিওর আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছ।? যাবার একটা ছুতো দিয়ে বোকা বানাচ্ছ না নিজেকেই?

যদি তা করেও থাকি, বলতে হয়, তবে এমন নিজেকে বোকা বানানো আরো প্রচুর লোক আছে। মনে রেখ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও জড়িত।

আমি ভুলিনি। কিন্তু ধরো-স্রেফ ধরে নাও-সে তোমাকে যেতে বলেনি। তুমি কি সেধে যাবে?

সত্যি বলব? কখনোই নিজের ইচ্ছায় এমন মিশনে যাব না। প্রেসিডেন্ট মারডেসির ডাক আমার জীবনে সবচে বড় আঘাত। আঘাতটা শেষ হওয়ার পর বুঝেছি তার কথাই ঠিক। তুমি জান, আমি মিথ্যা বিনয়ের প্রতিযোগিতায় নামি না। ঐ চাকরির জন্য অ্যামিট সবচে যোগ্য-যখন মহাশূন্য ডক তাদের ফাইনাল সম্মতি দেবে। আমি এখনো ভাল আছি, ক্যারোলিন।

সে মুখে হাসি ফোঁটায় বহু কষ্টে, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়…তুমিও কিন্তু কথাটা তাদের বলতে পার। অ্যামিট আরেকজন যোগ্য লোক। হয়ত তুমি সেধেই যেতে চাও।

এমন ভাবনা বাসা বেঁধেছে ফ্লয়েডের ভিতরেও। কিন্তু সে উত্তর দিল সুন্দর মনে, আমি তোমার সাথে পরামর্শ না করে কখনো এমন কিছু করব না।

করোনি শুনে ভাল লাগছে। জানিনা কী বলতাম যদি তুমি…

এখনো তাদের অফার ফিরিয়ে দিতে পারি।

বাজে কথা বাদ দাও, তুমিতো জান। যদি যাওয়ার অফারটা ফিরিয়ে দাও তাহলে বাকি জীবন আমাকে ঘৃণা করবে-তোমার নিজেকেও কখনো ক্ষমা করবে না। তুমি কর্তব্য ঠিকই চিনতে পার। হয়ত যেজন্যে তোমাকে বিয়ে করেছি তার মধ্যে এও এক কারণ।

কর্তব্য! হ্যাঁ, সেটাই আসল কথা এবং কী অবাক করা কর্তব্য যে চারপাশে! নিজের প্রতি তার কর্তব্য ছিল, কর্তব্য ছিল পরিবারের প্রতি, ইউনিভার্সিটির প্রতি, তার অতীত কাজের প্রতি (এমনকি সন্দেহের প্রতিও)-এবং মানবজাতির প্রতি। কোনো কর্তব্য আগে আসবে সে অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সহজ নয়; মাঝে মাঝেই কর্তব্যেরা একে অন্যের বিরোধী যে!

এ মিশনে যাওয়া আসলেই দরকার। যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে-একইভাবে কেন মিশনে তার যাওয়া ঠিক না তা নিয়েও ফ্লয়েডের অনেক বন্ধু দেখিয়েছে বেশ কিছু যুক্তি। কিন্তু সম্ভবত সবশেষে হাজার হিসাব শেষ করে তার মস্তিষ্ক নয়, হৃদয়ই ঠিক করল সে কী করবে। এখানে তাকে দুটো বিপরীত দিকে ঠেলে দিচ্ছে আবেগ।

যেতে হবে বৃহস্পতির দিকে। জানার ইচ্ছা, অপরাধের অপবাদ, নিজের গোয়ার্তুমি এসব একত্র হয়ে ভয়াবহ একটা কাজ শেষ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন; যা-ই হোক না কেন। অন্য দিকে ভয়-পারিবারিক ভালবাসা তাকে পৃথিবীতে রাখার কথাও বলে। তবু কোনো সন্দেহ নেই। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি, সেখানে স্থির থাকতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না সে। সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে সাথেই ক্যারোলিনের যত আপত্তি যতোটা সম্ভব ভদ্রতার সঙ্গে দিয়েছে সরিয়ে।

আরও একটা সান্ত্বনা দেয়া চিন্তা আছে তার মনে। ঝুঁকি শুধু নিজেই নিচ্ছে, পরিবারের আর কেউ না। আড়াই বছরের জন্য যেতে হবে। এর মধ্যে বৃহস্পতিতে থাকার সময়টা বাদ দিয়ে বাকি অসীম সময় কাটাতে হবে হাইবারনেশনে। ফিরে এলে বয়সের পার্থক্য কমে যাবে দু বছরের মতো। কিংবা আরো বেশি। ফলে তারা বয়সে অনেক এগিয়ে আসছে; শুধু ক্যারোলিনকে থাকতে হবে একা।

৫. লিওনভ

কীভাবে কোনো ফাঁকে মাস ছোট হয়ে সপ্তাহ হয়ে যায় কেউ জানে না, সপ্তাহ কমে হয় দিন, আর দিন ঘণ্টার দিকে যায় কুঁচকে। হেউড ফ্লয়েড অনেক বছর আগে ক্ল্যাভিয়াস বেসে টাইকো মনোলিথ দেখতে যাবার পর এই প্রথম বাধ্য হয়ে যাত্রা করছে মহাকাশে।

কিন্তু এবার সে একা নয়। মিশন নিয়ে কোনো গোপনীয়তাও নেই। সামনের কয়েক সিট পরে বসে ডক্টর চন্দ্র। সে ব্রীফকেস কম্পিউটারের সাথে এরই মধ্যে এত আলাপে ব্যস্ত যে চারদিকের পরিবেশ তাকে তেমন সহজভাবে নেয়নি।

কিছু বিশ্বাস আছে যা কখনো কাউকে বলা যায় না। মানুষ যতই মানুষ হোক, অন্য প্রাণীর সাথে তার প্রচণ্ড মিল পাওয়া যায়, সেটুকু যেন অন্তঃসলিলা নদী। আইডিয়াটা ফ্রয়েডের গোপন মজার ব্যাপারগুলোর একটা। তবে মিলগুলোকে সে অপমান করার কাজে লাগায় না বরং আরো সুন্দররূপে উপস্থাপিত করে। তার এ ছোট্ট শখটা মুখস্থ রাখার কাজ দেয়।

ডক্টর চন্দ্র এখন যেমন করছে তা যেন মনের ভেতর হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা পাখির নাচনের মতো। সে দেখতে ছোটখাট, কোমল এবং তার সব চলাফেরা বেগবান আর নির্ভুল। কিন্তু কোন্ পাখি? নিশ্চই খুব বুদ্ধিমান একটা পাখি। ম্যাগপাই? অত্যন্ত কিচিরমিচির করে কিন্তু লোকজন তেমন দেখতে পারে না। তাহলে পেঁচা? নাহ্-খুবই কচ্ছপগতির। সম্ভবত চড়ুইপাখি চমৎকার মানায়।

ডিসকভারিকে আবার সচল করার মতো ভয়ানক কাজের দায়িত্ব সিস্টেম বিশেষজ্ঞ ওয়াল্টার কার্নো নিয়েছে। আসলে কাজটা আরো কঠিন। সে বিশালদেহী কর্কশ লোক, মোটেই পাখির মতো নয়। বিপুল বিস্তৃত ধারার কুকুরের মধ্যে কোথাও কেউ এমন কিছু খুঁজে পাবে, কিন্তু তুলনাটা ঠিক মানানসই না। কার্নো অবশ্যই এক ভালুক। গোমড়ামুখো নয়, বিপজ্জনক প্রকৃতির, কিন্তু ভালমানুষ ধরনের। আর বন্ধু ভাবাপন্ন। সম্ভবত তাই ঠিক; ভাবনাটা ফ্লয়েডকে রাশিয়ান সাথীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাদের সাথে অচিরেই সে যোগ দিতে যাচ্ছে। চূড়ান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজে তারা বহুদিন যাবৎ ঝুলে আছে উপরের অর্বিটে।

আমার জীবনের বিরাট এক মুহূর্ত এটা-ফ্লয়েড মনে মনে ভাবল। আমি এমন এক অভিযানে যাচ্ছি যা মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। কেন যেন ভিতর থেকে কোনো জয়োল্লাস আসছে না। বরং যেসব কথা বেশি মনে পড়ে…বাড়ি ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলো, বিদায় আমার প্রিয় ছোট্ট বাবু, আমি যখন ফিরে আসব তখন আমাকে কি তুমি চিনতে পারবে? এখনো রাগ লাগছে ক্যরোলিনের উপর। সে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল ছেলেটাকে-ক্যারোলিন জাগায়নি। তবু সে ক্যারোলিনের কাজটাকেই ঠিক মনে করে। না জাগানোটাই ভাল।

হঠাৎ এক বিস্ফোরিত অট্টহাসিতে তার মন-খারাপ ভেঙেচুরে গেল; ডক্টর কার্নো কৌতুক করছিল সাথীদের সাথে। একটু, সামান্য প্রটোনিয়াম যতোটা কোমলভাবে মানুষ নেয় তেমন করে সে ধরে রেখেছে বিরাট এক বোতল।

সে ডাকল, এই হেউড, লোকজন কী বলে বেড়ায় বলতো! কাপ্তান অর্লোভা নাকি সব পানীয় ভরে রেখেছে সিন্দুকে, এটাই আমার শেষ সুযোগ। সেতিউ থিয়োরী ৯৫। প্লাস্টিক কাপে খেতে হচ্ছে, হায় কপাল!

একেবারে খাসা শ্যাম্পেন, যখন ফ্লয়েড একটু একটু করে চুমুক দিয়ে পান করছে। তখন কার্নো হাসছে আর হাসাচ্ছে বেদম। সৌরজগৎসহ সব দিকে কার্নোর অট্টহাসির ধ্বনি প্রতিধ্বনির সামনে ফ্লয়েড নিজে যেন নুয়ে পড়া এক মানুষ। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে ইঞ্জিনিয়ারের ক্ষমতা। মিশনের সঙ্গী হিসেবে কার্নো শক্তি প্রয়োগ করার মতো প্রমাণ দেখাতে পারত। অন্তত ডক্টর চন্দ্র তার সমস্যা তুলে ধরত না। ফ্লয়েড খুব বেশি হলে তার কাছে মৃদু হাসি আশা করে। অথচ লোকটা পারেও! নামমাত্র খেয়ে থর থর করে কাঁপিয়ে উল্টে দিল শ্যাম্পেনের কাপ; নাহ্, কার্নো যথেষ্ট মার্জিত, অথবা যথেষ্ট আনন্দে আছে, অথবা লুকাচ্ছে মনের ব্যথাটুকু। নিজেকে প্রচার করার জন্য এ কাজ করেনি।

ইঞ্জিনিয়ার মনে হয় এ পার্টির মধ্যমণি হওয়ার পণ করেছে। একটু আগে সে একটা দু-দিকে অ্যাকটিভ ইলেকট্রনিক কীবোর্ড নিয়ে সহগামীদের কণ্ঠের সহযোগিতায় পর পর পিয়ানো, ঐম্পেট, বেহালা, বাশের বাঁশি এবং গান দিয়ে দ্রুত শুনিয়ে দেয় ডাইকেন জন পিল। ও আসলে খুব ভালো আছে।

একটু পরই ফ্লয়েড নিজেকে গাইতে দেখল অন্যদের সাথে। কিন্তু সে মনে করেছিল কার্নো তার যাত্রার সময়টা কাটাবে নীরবে, হাইবারনেশনের আঁধারে। ইঞ্জিন জ্বলার পর যখনি শাটল নিজে নিজে আকাশে চলতে শুরু করছে তখনি হতাশায় বন্ধ হয়ে গেল গান। ফ্লয়েড এক পরিচিত কিন্তু সদা নতুন উল্লাসে জড়িয়ে নেয় নিজেকে। অসীম ক্ষমতার ইন্দ্রিয় পৃথিবীর যত্ন এবং শক্তি থেকে নিয়ে যাচ্ছে উপরে, বহু দূরে। মানুষ এক সময় ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মাধ্যাকর্ষণের নাগালের বাইরে বসায়, তারপর উপলব্ধির চেয়ে জানতে পারে বেশি। সে উড়ছে স্বাধীন ওজনহীনতার কল্পলোকে। মুহূর্তের জন্য হয়ত সত্যটা গেছে ভুলে। সেখানে কোনো স্বাধীনতা নেই, আছে শুধু তার অতীত ক্যারিয়ারের গুরুদায়িত্ব।

ইঞ্জিনের গতি বাড়ার সাথে সাথে ওজন যেন ফ্লয়েডের কাঁধে বসছে জাঁকিয়ে। কিন্তু সুনয়না পৃথিবীর এত ভার বহন করেও ক্লান্ত না হয়ে সে একে স্বাগত জানিয়ে নিল। ভাবতে চেষ্টা করেনি, কিন্তু এসব অভিজ্ঞতার স্বাদ উপভোগ করে তৃপ্তি পায়। ফ্লয়েড যদিও শেষবারের মতো পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছে এবং যাদের এখনো ভালবাসে তাদের বিদায় জানাচ্ছে তবু অনুভব করছে না কোনো দুঃখ। তার চারদিকের গর্জন বিজয়োল্লাসের বন্দনা গান হয়ে যেন ছোটখাট আবেগগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এখান থেকে যাবার সময় সে ব্যথা পায়, পৃথিবীর আকর্ষণ যাচ্ছে চলে। সহজতর শ্বাসপ্রশ্বাস এবং হঠাৎ ইন্দ্রিয় স্বাধীনতাকেও স্বাগতই জানায়। যাত্রীদের প্রায় সবাই সিট বেল্টে ঢিল দিতে শুরু করেছে, কক্ষপথ অতিক্রমের সময় শূন্য মাধ্যাকর্ষণের তিরিশ মিনিটকে উপভোগ করতে চায়। কিন্তু যারা প্রথম এ জার্নি করছে তারা সিটে বসে থেকেই কেবিন অ্যাটেনড্যান্টদের জন্য চারদিকে উদ্বিগ্নভাবে তাকাতে থাকে।

ক্যাপ্টেন কথা বলে, আমরা এখন সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে তিনশ কিলোমিটার উপরে আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম উপকূলের উপর। আপনারা ভাল দেখতে পাবেন না। সেখানে এখন রাত। সামনে যে উজ্জ্বলতা দেখা যাচ্ছে তা হল সিয়েরা লিওন এবং গিনির উপসাগরের উপরে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বিরাট ঝড়। তাকিয়ে দেখুন ঐসব আলোর ঝলক।

পনের মিনিটের মধ্যে আমরা সূর্যের আলো দেখতে পাব। ইতোমধ্যে শিপকে ঘোরাচ্ছি যাতে আপনার বিষুবরেখার কাছাকাছি স্যাটেলাইট এলাকার সুন্দর দৃশ্য দেখতে পারেন। প্রায় সোজাসুজি মাথার উপর উজ্জ্বলতম যা দেখা যাচ্ছে ওটা ইনটেলমেট আটলান্টিক ওয়ান অ্যান্টেনা ফার্ম। তার পরেরটা পশ্চিম দিকে দেখুন ইন্টারকশন্স টু। আর এক অস্পষ্ট তারার মতো যেটা দেখছেন…ওটাই বৃহস্পতি। যদি ওটার ঠিক নিচে তাকান, এক আলোর চমক দেখতে পাবেন। তারার পিছনে বিপরীত দিকে নড়াচড়া করছে। ওটাই হলো নতুন চাইনিজ মহাশূন্য স্টেশন। আমরা একশ কিলোমিটার দূর দিয়ে পেরুচ্ছি, খালি চোখে দেখার মতো যথেষ্ট কাছে নই।

ফ্লয়েড আলসের মতো ভাবল-এতক্ষণ ওগুলো কী দেখলাম? মোটা নলের মতো কাঠামোটার আরো কাছে এসে সে পরীক্ষা করেছে। ভীতুদের গুজবে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তারা বলে ওটা এক লেজার সজ্জিত দুর্গ। তারপর সবার সন্দেহের কারণে জাতিসংঘ চীনাদের তথাকথিত লেজার দুর্গ দেখতে চায়। বেইজিং বিজ্ঞান একাডেমি জাতিসংঘের মহাশূন্য কমিটির পরিদর্শনে যাত্রার অনুরোধ একের পর এক ফিরিয়ে দিয়েছে। শত্রুদের এসব প্রচারের জন্য চীনারা দোষ দেয় নিজেদের। নভোচারী এলেক্সি লিওনভ স্পেসশিপটা খুব একটা সুন্দর কিছু না। কিছু মহাশূন্যযান দেখতে সুন্দর। সম্ভবত মানবজাতি একদিন নান্দনিক নতুন কিছু উন্নয়ন করবে। শিল্পীদের প্রজন্ম উঠে আসবে যাদের শিল্প আদর্শটা বায়ু ও পানির ছাঁচে তৈরি পৃথিবীর প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। মহাশূন্য নিজেই মাত্রাছাড়া সৌন্দর্যের এক কল্পলোক; দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষের হার্ডওয়্যার নিজেকে এখনো পূর্ণতা দান করতে পারেনি।

লিওনভের আছে বিশাল চার চারটা জ্বালানি ট্যাংক। ট্রান্সফার অর্বিট সফল হবার সাথে সাথে সংখ্যায় কমে যাবে এগুলো। ট্যাঙ্ক বাদ দিলে অবাক করা ঘোঁট এ রাশিয়ান স্পেসশিপ। তাপ-ফলক থেকে ড্রাইভ ইউনিট পর্যন্ত পঞ্চাশ মিটারের চেয়েও কম; বিশ্বাস করা কঠিন যে অনেক কমার্শিয়াল এয়ার ক্রাফটের চেয়ে ছোট এমন এক মাঝারি ধরনের যান দশজন পুরুষ-মহিলাকে সৌর জগতের এক মাথা থেকে প্রায় অন্য মাথায় বয়ে নিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু জিরো গ্র্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণহীনতা জীবনযাপন প্রণালীর সব বিধিকে ভিন্ন রীতিতে দ্বিতীয়বার লিখেছে। এ পরিবেশে দেয়ালই ছাদ এবং মেঝে। লিওনভে প্রচুর জায়গা, এমনকি যখন সবাই একই সাথে জেগে থাকে তখনো। হরেক রকম সংবাদদাতা, প্রকৌশলী এবং উদ্বিগ্ন কর্মচারীর চূড়ান্ত কষ্টের ফসল এটা। অবাক ব্যাপার, প্রয়োজনীয় জায়গা সাধারণের চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ। লিওনভ ডকে থামার সাথে সাথে ফ্লয়েড জেগে ওঠে কার্নো আর চন্দ্রের সাথে। সে কেবিন খুঁজে বের করার চেষ্টা করল যেখানে আগামী এক বছর থাকতে হবে। পরিপাটি উন্নত যন্ত্রপাতি আর খাবারের বাক্স-পেঁটরায় ঠাসাঠাসি করে বোঝাই ঘরটা। ঢাকাই অসম্ভব। ক্রুদের একজন হ্যান্ডহোল্ড থেকে হ্যান্ডহোল্ড ধরে দক্ষতার সাথে দরজার দিকে যাবার সময় ফ্লয়েড বিষণ্ণচিত্তে চারদিকে তাকিয়ে ভাবে কীভাবে দরজায় এক পা রাখা যায়। ক্রু ভদ্রলোক ফ্লয়েডকে উভয় সংকটে পড়তে দেখেই একটু থামল।

ডক্টর ফ্লয়েড যে-ওয়েলকাম-আসনু। আমি সহকারি প্রকৌশলী-ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি।

রুশ যুবক একজন শিক্ষানবিশের মতো ধীর যত্নে গড়া ইংরেজিতে কথা বলে। বোঝাই যায় ওর বাস্তব ইংরেজি টিচার ছিল না। বরং গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠ নিয়ে বসেছে বেশি। হাত মেলাবার সময় ফ্লয়েড ইতোমধ্যে পড়া ক্রুদের বায়োডাটার সাথে তার চেহারা আর নাম মিলিয়ে নিল…ম্যাক্সিম আন্দ্রেই ব্রেইলোভস্কি, বয়স একত্রিশ, লেনিনগ্রাদের মানুষ, নির্মাণ বিশেষজ্ঞ, শখ বেশ ভাল-তলোয়ার চালানো, স্কাই সাইক্লিং, দাবা।

তোমার দেখা পেয়ে খুশি হলাম। ফ্লয়েড বলল, ভিতরে যাব কীভাবে বলতো?

ভয় নেই। দাঁত কেলিয়ে ম্যাক্স বলল, তুমি ঘুম থেকে জেগে দেখবে এসব চিচিং ফাঁক। তা-তোমরা ইংরেজিতে কী বলো শব্দটা?- এক্সপেনসিভ। ব্যাপারটা ব্যয়সাধ্য। আমরা খাব। তোমার রুম প্রয়োজনের সময় খালি হয়ে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি। সে তার পেট চাপড়ায়।

ভাল কথা কিন্তু তোমার পেটে এ ঘরে তাবৎ জঞ্জাল যাবার আগে আমার জিনিসপত্র রাখি কোথায়? ফ্লয়েড তিনটি বাক্স দেখালো, মোট ওজন পঞ্চাশ কেজি। সে আশা করছে পরবর্তী লক্ষ কোটি কিলোমিটার পথের জন্য তার প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে এর মধ্যে। এদের ওজনহীন করা সহজ কাজ, কিন্তু জড়তাহীন নয়, শিপের করিডোরের ভিতরে সামান্য ধাক্কাতেই জড়তাটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

ম্যাক্স ব্যাগগুলোর দুটো তুলে নিল, তিনটা বিম দিয়ে ছেদ করা ত্রিকোণের ভিতরে সতর্কভাবে বয়ে চলল। নিউটনের প্রথম সূত্রকে উপেক্ষা করে প্রকাশ্যে ঝাঁপও দিল ছোট হ্যাঁচওয়ের ভেতর। অন্যদিকে ফ্লয়েড তাকে অনুসরণ করে অর্জন করল কিছু অতিরিক্ত আঘাতের দাগ। বয়েস হয়ে যাচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ থেকে ধাতস্থ হবার পর মনে হয় লিওনভ বাইরের চেয়ে ভেতরে বড়। স্লাভ এবং রোমান এ দু বর্ণমালার কাপ্তান লেবেল লাগানো এক দরজার কাছে। এল তারা। ফ্লয়েড বলার চেয়ে রাশিয়ান ভাষা পড়তে পারে বেশি। ইশারাকে ঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। সে এরইমধ্যে লক্ষ্য করেছে যে শিপের সব নোটিশে দুটো ভাষা।

ম্যাক্স নক করার সাথে সাথে সবুজ আলো জ্বলে উঠেছে। ফ্লয়েড যতটা সম্ভব সুন্দরভাবে অবস্থার বশবর্তী হয়ে ভেতরে ঢোকে। ক্যাপ্টেন অর্লোভার সাথে বহুবার সে কথা বলেছে কিন্তু এর আগে কখনো তাদের দেখা হয়নি।

ভিউফোনের মাধ্যমে কোনো মানুষের বাস্তব আকৃতি বিচার করা কঠিন। ক্যামেরা কীভাবে যেন সবাইকে একই আকারে নিয়ে আসে। বাকি সবার শূন্য মাধ্যাকর্ষণে দাঁড়ানোর মতো করেই দাঁড়িয়ে আছে কাপ্তান অর্লোভা। খুব বেশি হলে ফ্লয়েডের কাঁধ পর্যন্ত লম্বা। এক মুহূর্তে উজ্জ্বল নীল চোখের ঐ তীক্ষ্ণতা আর চমক লাগানো সুন্দর মুখের ঐ দারুণ বৈশিষ্ট্যের সৌন্দর্য বিচার করা অসম্ভব। মরার ভিউফোন তাও জানাতে পারেনি।

হ্যালো তানিয়া, ফ্লয়েড বলে, অবশেষে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় কী চমৎকৃত হলাম! কিন্তু তোমার চুলের এ কী হাল?

তারা হাত মেলায় পরিচিত বন্ধুর মতো।

আমিও শিপে তোমাকে পেয়ে খুশি হলাম, হেউড! উত্তর দিল ক্যাপ্টেন। তার ইংরেজী বেইলোভস্কির মতো নয়, দক্ষতা আছে পুরোপুরি, যদিও কথাগুলো বেরিয়েছে খুব জোর দিয়ে, হ্যাঁ, চুল হারিয়ে কিছুটা মন খারাপতো হবেই-কিন্তু লম্বা মিশনে চুল মহা বিড়ম্বনা…আমি এখানকার নাপিতকে যতদূর সম্ভব সরিয়ে রাখতে চাই। তোমার কেবিনের জন্য দুঃখিত; ম্যাক্স সব বলেছে আমাকে। হঠাৎ দেখি মালামাল রাখতে আরো দশ বর্গমিটার জায়গা দরকার। পরের কয়েক ঘণ্টায় ভ্যাসিলি আর আমি এখানে বেশিক্ষণ থাকব না-আমাদের কোয়ার্টার ব্যবহার করতে দ্বিধা করোনা, প্লিজ।

থ্যাঙ্কস। কার্নো আর চন্দ্রের কী খবর?

আমি ক্রুদের জন্য একই ব্যবস্থা নিয়েছি। মনে হতে পারে তোমাদের কার্গো হিসেবে গণ্য করছি আমরা–

অভিযানের সময় করবে না আশা করি।

ক্ষমা করো। হাস্যোজ্জ্বল চোখে মাফ চেয়ে নেয় তাতিয়ানা অর্লোভা।

প্রাচীন যুগে সমুদ্র ভ্রমণে ব্যাগেজের উপর ওটা লেবেল হিসেবে ব্যবহার করত।

তানিয়া হাসল, অনেকটা ওরকম দেখায়। জার্নির শেষ দিকে তুমি ভাল থাকবে এ কামনা করি। এর মধ্যে আমরা তোমার জায়গার পরে পার্টি দেয়ার পরিকল্পনা করছি।

সেটাইতো ভয়। তা করোনা, আবার জাগা! চরম খারাপও হতে পারে-জাগরণী পার্টি। কিন্তু তুমি মনে হয় খুব ব্যস্ত-আমার জিনিস আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমাকে দারুণ মজার জার্নি চালিয়ে যেতে দাও।

ম্যাক্স তোমাকে চতুর্দিক দেখাবে-ডক্টর ফ্লয়েডকে ভ্যাসিলির কাছে নিয়ে যাও, নেবে তুমি? ও নিচের ড্রাইভ ইউনিটে।

ক্যাপ্টেনের কোয়ার্টার থেকে বাতাসের স্রোতে বেরিয়ে এসে ফ্লয়েড মনে মনে ত্রু সিলেকশন কমিটিকে গুড মার্কস দিল। কাগজে-কলমে তানিয়া অর্লোভা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। আকর্ষণীয় হলেও সশরীরে সে রীতিমতো ত্রাস। ফ্লয়েড নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, যখন মেয়েটার মেজাজ বিগড়ে যায় তখন দেখতে কেমন ভাবতে পারছি না। এ সুন্দর রূপটা আগুন হয়ে উঠবে, নাকি বরফ? মোটের উপর, খুঁজে বের না করাই বোধহয় ভাল।

ফ্লয়েড মহাশূন্যে তাড়াতাড়ি পা চালানোর শিক্ষা নিচ্ছে। ভ্যাসিলি অলোভের কাছে পৌঁছে গেল ওরা সময়মতো। সে এখন গাইডের মতো প্রায় দৃঢ়তার সাথে ভাসে। চীফ সায়েন্টিস্ট ফ্লয়েডকে সম্ভাষণ জানায় তার স্ত্রীর মতোই উষ্ণভাবে, স্বাগতম ফ্লয়েড। কেমন লাগছে তোমার?

ভাল, আস্তে আস্তে না খেয়ে মরার দিকটা ছাড়া।

মুহূর্তের জন্য অর্লোভ গাড্ডায় পড়ে যায়। তারপর তার পুরো মুখটাই রূপান্তরিত হয় চওড়া হাসিতে, ওহ্, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ভাল কথা, খুব বেশিক্ষণতো এসব চলবে না। মাত্র দশ মাস পর তোমার যত খুশি খেতে পার।

হাইবারনেটররা এক সপ্তাহ আগে থেকেই খাওয়া-খাদ্য কমানোর চিন্তায় অস্থির। গত চব্বিশ ঘণ্টায় তরল ছাড়া তারা কিছুই খায়নি। অনশনের কারণে নিজের বোকামি কতটা বাদুছে তা দেখে ফ্লয়েড অবাক হয়। কার্নোর শ্যাম্পেনের পরিমাণ কত ছিল এক সময় তার কতোটা গেছে জিরো গ্র্যাভিটির দিকে?

মনকে একদিকে ফেরাতে তাদের ঘিরে থাকা পানির পাইপে ভরা বহু রঙের বিশাল ইঞ্জিনটায় চোখ বুলালো ফ্লয়েড, তাহলে এই হল সেই বিখ্যাত শাখারভ ড্রাইভ। এবারই প্রথম আমি পুরো ইউনিট দেখলাম।

এ পর্যন্ত বানানো হয়েছে মাত্র চারটা।

অদ্ভুত আকার দেখে একটু হাসল সে, আমার মনে হয় এটা কাজ করে।

আরো ভাল করে কাজের চেয়েও বেশি। তা না হলে গোর্কি সিটি কাউন্সিলের নাম আবারো শাখারভ স্কোয়ার হত।

একটা সংকেত আছে মজাদার। একজন রাশিয়ান তার দেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানী সম্পর্কে কৌতুক করতে পারে। কাজটা যত বিরক্তিকরই হোক না কেন। অনেক দেরিতে শাখারভকে বানানো হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের হিরো। একাডেমিতে তার সেই দারুণ বক্তৃতার কথা ফ্লয়েডকে আবারো মনে করিয়ে দেয়া হল। তিনি শ্রোতাদের বলেছিলেন, বন্দীশালা এবং নির্বাসন সৃজনশীলতার জন্য আসলে সম্মানে ভরা জমকালো কর্মসূচি। পৃথিবীর পাগলামির ছোঁয়া থেকে দূরে, ঐ কারাগারের দেয়ালের নির্জনতায় কম মহৎ রচনা জন্ম নেয়নি। তেমন একটা সৃষ্টির উদাহরণ আমি দেব। মানুষের মেধার সবচে বড় একক অর্জন স্বয়ং প্রিন্সিপিয়া ছিল মহামারী শাসিত লন্ডন থেকে নিউটনের নিজের উপর চাপানো নির্বাসনের ফসল।

তুলনাটা বাজে নয়। গোর্কীতে ঐ বছরগুলো কাটিয়ে বস্তুর গঠন আর মহাবিশ্বের উৎস নিয়ে নতুন অন্তদৃষ্টি এসেছে তার। রক্তরস নিয়ন্ত্রণ ধারণাও এসেছে যা বাস্তব থার্মোনিউক্লিয়ার ক্ষমতার দিকে এক পদক্ষেপ। যন্ত্রপাতিই ঐ কাজে সবচে বেশি পরিচিত। জনগণ যান্ত্রিক সফলতাকেই দেখতে পায়। কিন্তু সেসব মেশিন তার অবিষ্কারকের বুদ্ধিকে প্রকাশের স্রেফ একটা পথ। কলম লেখক নয়, যিনি কলমকে সৃষ্টির পথে ঘোরান তিনিই লেখক, কলম শুধু লেখকের মেধার প্রকাশ ঘটায়। দুঃখের ব্যাপার, এত বড় অগ্রসরতার শুরু হয়েছে অন্যায় অবিচারের নিচে থেকে থেকে। সম্ভবত এক সময় মানবিকতা এসব মানিয়ে নিতে আরো মার্জিত ও উন্নত পথ খুঁজে পাবে।

এরিমধ্যে তারা বেরিয়ে যায় রুম থেকে। ফ্লয়েড শাখারভ ড্রাইভ সম্পর্কে যতটা জানার বা মনে রাখার চেষ্টা করেছে শিখেছে তারচে বেশি। সে এর মূলনীতি, তাপের সাথে যুক্ত থার্মোনিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ব্যবহার এবং যে কোনো জ্বালানি পদার্থকে বের করে দেয়ার সাথে পরিচিত হয়েছে ভালোই। খাঁটি হাইড্রোজেনকে কার্যকর তরল হিসেবে ব্যবহার করে সবচে ভাল ফল পাওয়া যায়। তরলটা অতি ভারী আর অনেকক্ষণ মজুদ রাখাও কঠিন। বিকল্প হিসেবে মিথেন এবং অ্যামোনিয়া গ্রহণযোগ্য; এমনকি পানিও ব্যবহার করা যায়। পানিতে কাজ হয় অত্যন্ত কম।

গতির সাথে লিওনভ আপস করবে। প্রচুর লিকুইড হাইড্রোজেন ট্যাংক প্রাথমিক চালিকা শক্তিতে দেয়া হয়েছিল। শিপ বৃহস্পতিতে যাওয়ার গতি পেলেই সেসব ফেলে দেয়া হবে। প্রোপ্যাল্যান্ট হিসেবে অ্যামোনিয়া ব্যবহার করা হবে পরের তিন স্থানে-গন্তব্যে, ব্রেক করার কাজে এবং ডিসকভারির সাথে মিলিত হওয়ার জায়গায়। পরিণামে আরো এক ক্ষেত্রে করতে হবে ব্যবহার; পৃথিবীতে ফিরে আসা পর্যন্ত।

ঠিক এটুকু নীতি নেয়া হয় অশেষ পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই পুনঃপরীক্ষা এবং কম্পিউটার মডেলে কাজ করার পর। অভাগা ডিসকভারি এমন ভাল খেল দেখানোয় একটা সিদ্ধান্ত আসে-মানবীয় পরিকল্পনা প্রাকৃতিকভাবে বা ভাগ্যের জোরে নির্দয়ভাবে সংশোধন করতে হতে পারে। আর মহাবিশ্বের আড়ালের সেই শক্তির ভয়তো থাকবেই।

আচ্ছা! ডক্টর ফ্লয়েড তুমি ওখানে, ভ্যাসিলি ম্যাগনেটো হাইড্রোডাইনামিক ফিডব্যাকের ব্যাখ্যা দিচ্ছে অতি উৎসাহে, এমন সময় বাধা দিয়ে এক মহিলা কণ্ঠ বলল, তুমি আমার কাছে রিপোর্ট করোনি কেন?

এক হাতে আলতোভাবে পাক খেয়ে আস্তে আস্তে তার অক্ষরেখায় ঘুরল ফ্লয়েড। এক ডজন পকেট এবং থলে সজ্জিত অস্বাভাবিক এক ইউনিফর্ম পরা মাতৃ জাতির এক বিশাল মূর্তি দেখতে পেল সে। মহিলার প্রভাব কার্তুজ বেল্ট পড়া রাশিয়ান অশ্বারোহী এক সেনা সদস্যের চেয়ে কম না।

নাইস টু মিট ইউ এগেইন, ডক্টর। আমি এখনও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখছি। আশা করি হিউস্টন থেকে পাঠানো মেডিক্যাল রিপোর্ট পেয়েছ তুমি।

টিগ সেন্টারের ঐ সব চিকিৎসা! গরু-ছাগলের খুরা রোগ খুঁজে বের করি না আমি। ওসব বিশ্বাস করব না!

ক্যাথোরিনা রুডেঙ্কো এবং অলিন টিগ মেডিকেল সেন্টারের মধ্যে অনুভূত পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সম্পর্কে ফ্লয়েড ভালই জানতো যদিও ডাক্তারদের মন খোলা হাসি আর কথাবার্তাকে কম বিশ্বাস করত না। ডাক্তার তার অকপট উৎসাহের দৃষ্টি দেখে গর্বিতভাবে প্রশস্ত কোমরের চারিদিকে কাপড়ের বেল্টে আঙ্গুল গুঁজে দিল, বলল, জিরো গ্র্যাভিটিতে গতানুগতিক পিচ্চি কালো ব্যাগ ব্যবহারযোগ্য নয়-জিনিস পত্র ভেসে বেরিয়ে যায় আর দরকারের সময় তুমি খুঁজে পাবে না সেগুলো জায়গামতো। আমি নিজে এ পোশাকের ডিজাইন করেছি। এটা আস্ত এক মিনি চিকিৎসা কেন্দ্র। এ দিয়ে আমি এপেনডিক্স বের করতে পারব-পারব একটা শিশু প্রসব করাতে।

আশা করি ঐ বিশেষ সমস্যা এখানে দেখা দেবে না।

আরে! একজন ভাল ডাক্তারকে সবকিছুর জন্য রেডি থাকতে হয়।

কাপ্তান অর্লোভা আর ডাক্তারের মধ্যে কী বৈষম্য! ফ্লয়েড ভাবল। নাকি রুডেঙ্কোকে সঠিক পদবী সার্জন-কমান্ডার রুডেঙ্কো নামে ডাকা উচিত তার? ক্যাপ্টেনের আছে একজন ব্যালে নর্তকীর সাবলীলতা আর তীক্ষ্ণতা; অন্যদিকে ডাক্তার মোটামুটি মাদার রাশিয়ার আদি প্রতীক। চ্যাপ্টা চষা মুখ, ছবিটা পুরো। করতে শুধু একটা শাল প্রয়োজন-ফ্লয়েড নিজে নিজে বলল; এ-ও বলল, নিজেকে বোকা বানিও না। এ হল সেই মহিলা যে কোনারভ ডাকি দুর্ঘটনায় কমপক্ষে এক ডজন জীবন রক্ষা করেছিল–অবসরের আলসেমির বদলে সম্পাদনা করেছিল এনালস অব স্পেস মেডিসিন বা মহাশূন্য ঔষধের বর্ষপঞ্জি। তাকে অচেনা কোটি কিলোমিটারের পথে পেয়ে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করো, ফ্লয়েড।

এখন, ডক্টর ফ্লয়েড, কথা হল-আমাদের ছোট্ট শিপটা খুঁটে খুঁটে দেখার জন্য পরে যথেষ্ট সময় পাবে। আমার সাথীরা এর কথা বলবে বিনয়ের সাথেই। কিন্তু করার মতো হাজারো কাজ আছে তাদের। তুমি সাহায্যও করতে পার। যত তাড়াতাড়ি পারি আমি তোমাকে-তোমাদের তিন জনের সবাইকে সুন্দর এবং ঠাণ্ডা অবস্থায় পেতে চাই। তারপর চিন্তা আমাদের কম থাকবে।

ভয় পাবার ভান করল ফ্লয়েড, আমি ঐ ভয়ই পাচ্ছিলাম, কিন্তু পুরোপুরি তোমার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছি। তুমি যখনই বলবে…।

আমিও সব সময় তৈরি। বললাম তো, তৈরি, প্লিজ এসো আমার সাথে।

শিপের হাসপাতালটা এক অপারেশন টেবিল, দুটো এক্সারসাইজ বাইসাইকেল, কিছু যন্ত্রপাতি রাখার কেবিনেট আর একটা এক্স-রে মেশিন রাখার মতো বড়। ডাক্তার রুডেঙ্কো দ্রুত সবার সারা শরীর পরীক্ষা করানোর পর অপ্রত্যাশিতভাবে জিজ্ঞাসা করল, ডক্টর চন্দ্রের গলার চেনের সঙ্গে ঐ ক্ষুদ্র সোনার সিলিন্ডারটি কি কোনো ধরনের যোগাযোগ যন্ত্র? সে কি ওটা সরাবে না? আসলে সে যে কোনো কিছু খুলে ফেলার ব্যাপারে খুব লজ্জা পায়।

ফ্লয়েড না হেসে পারেনি। কিছুটা অভিভূত মহিলার প্রতি বিনয়ী ভারতীয়র প্রতিক্রিয়া কল্পনা করা খুবই সহজ।

এটা একটা লিঙ্গম।

একটা কী?

তুমি হলে ডাক্তার, তোমার উচিত চিনতে পারা। পুরুষের উর্বরতার প্রতীক।

অবশ্যই-চেনা উচিত ছিল। বোকামি করেছি। সে কি হিন্দু রেওয়াজী লোক? কড়া আনুগত্যের ভেজিটেরিয়ান? এসব প্রশ্ন করতে আমাদের কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। এখন নিরামিষাশী হয়েও লাভ নেই।

ভয় পেও না-ন্যায্য সতর্কতা ছাড়া তোমাদের সব খাবারই সে খাবে। অবশ্য এলকোহল ছুঁয়ে দেখবে না; গোপন একটা কথা বলি…ধর্ম বা অন্য কোনো কিছুর ব্যাপারেই চন্দ্র গোঁড়ামি করে না, অতি গোঁয়ার্তুমি করে শুধু একটা বিষয়ে-কম্পিউটার। একবার সে আমাকে বলেছিল তার দাদা বেনারসে পুরোহিত ছিলেন। তিনিই তাকে ঐ লিঙ্গম দিয়েছেন।বংশ পরম্পরায় ওটা তাদের পরিবারের রেওয়াজ।

ফ্লয়েড খানিকটা আশ্চর্য হল, সে মনে করেছিল অন্যরকম, অথচ-ডক্টর রুডেস্কো কোনো অপ্রতিভতাই দেখায়নি। বরং চিকিৎসক তার সংস্কৃতির দিকে পুরো শ্রদ্ধা রেখে মনে করল নিজের স্মৃতি।

আমি তার অনুভূতি বুঝতে পারছি একটু। আমার নানী আমাকে একটা সুন্দর অহিকন দিয়েছিল-ষোল শতকের জিনিস। আমি ওটা আনতে চেয়েছিলাম কিন্তু কপাল খারাপ। অহিকনটার ওজন পাঁচ কেজি।

তারপরই ডাক্তার আচমকা পেশাদার হয়ে গেল, হয় করতে দেবে না। একটা গ্যাস গান হাইপোডারমিক দিয়ে ফ্লয়েডকে ব্যথাহীন ইনজেকশন দিল। বলে দিল যেন চলে আসে ঘুম পাবার সাথে সাথে। ঘুম পেতে দু ঘণ্টাও লাগবে না।

এতক্ষণ শুধুই বিশ্রাম। আদেশ করছে কত্রীর মতো।

শিপের এ লেভেলে একটা পর্যবেক্ষণ পোর্ট আছে। স্টেশন ডি-৬। যাচ্ছ না কেন সেখানে?

ধারণাটা ভালোই; ফ্লয়েডের মনে হল এবং সে বাধ্য ছেলের মতো ভেসে চলল। অতি বাধ্যতা তার বন্ধুকে অবাক করছে। ডাক্তার রুডেক্কো ঘড়িতে এক পলক তাকিয়ে অটোসেকে অল্পকথায় হুকুম দিয়ে অ্যালার্ম সেট করল ত্রিশ মিনিট এগিয়ে।

ডি-৬ ভিউপোর্টে পৌঁছে ফ্লয়েড পেল চন্দ্র আর কার্নোকে। এরিমধ্যে তারা হাজির। তারা যেন স্বীকারই করছে না ডক্টর হেউড ফ্লয়েডের অস্তিত্ব-তাকায় এমন ভাব নিয়ে। তারপর সে ঘুরল বাইরের দারুণ জাঁকজমকে ভরা প্রদর্শনীর দিকে। ঘটনাটার দর্শক শুধু ফ্লয়েড-এ চমঙ্কার পর্যবেক্ষণের জন্য নিজেকে সংবর্ধনা জানাতেও ভোলেনি। চন্দ্র এ দৃশ্য বাস্তবে উপভোগ করতে পারছে কি? মনে হয় না। তার চোখ একেবারে বন্ধ।

যেন একেবারে অচেনা এক গ্রহ সেখানে ঝুলে আছে, জ্বলজ্বল করছে চমৎকার নীল আর দীপ্তিময় সাদা আলোতে। কী অদ্ভুত! ফ্লয়েড নিজে নিজেই বলল। পৃথিবীর হলোটা কী? তাইতো, অবাক হওয়ার কিছু নেই…সে স্বাভাবিক ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। উপরের অংশ নিচের দিকে! কী বিপর্যয়! একটু সময়ের জন্য সে কাঁদল মহাশূন্যে পড়ে যেতে থাকা ঐ নিরীহ পৃথিবীবাসীর জন্যে…

দুজন ক্রু চন্দ্রের প্রতিরোধহীন শরীর সরিয়ে নিচ্ছে; সেও এখন যেন রিক্ত। যখন তারা কাননোকে নিতে ফিরে এলো, ফ্লয়েডের নিজের চোখও বন্ধ। কিন্তু এখনো চলছে শ্বাসপ্রশ্বাস।

তারপর, লোকজন যখন তাকে নিতে এসেছে, তখন তার শ্বাসপ্রশ্বাসও বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকদিনের জন্য।

 ২. দ্বিতীয় পর্ব : জিয়াং

দ্বিতীয় পর্ব : জিয়াং

৬. জাগরণ

তারা না বলল হাইবারনেশনে স্বপ্ন দেখব না! শুতে না শুতেই… রাগের চেয়ে বেশি অবাক লাগছে… ভাবল হেউড ফ্লয়েড। দারুণ লাল রক্তিমাভা। আর চারদিক কী শান্ত! পরিবেশ দেখে তার বারবিকিউ আর ক্রিস্টমাস ফায়ারে কাঠের গুঁড়ির পটপট শব্দের কথা মনে পড়ে যায়। অবশ্য কোনো উষ্ণতা নেই তার শোয়ার জায়গায়, অন্য কিছু অনুভব করছে যদিও এ ঠাণ্ডা সহ্য করা যায় সহজেই।

কণ্ঠগুলো গুঞ্জন করছে হালকা, এমন কোমলভাবে যে ফ্লয়েড কথা বুঝতেই পারছে না। আস্তে স্বপ্নের শব্দগুলো আরো বাড়ে কিন্তু সে বিন্দুমাত্র বোঝে না। এরপর হঠাৎ প্রচণ্ড অবিশ্বাসে নিজেকে বলল, আমি রুশ ভাষায় স্বপ্ন দেখতে পারি না!

তখনো মনের ভিতরে গুমড়ে মরছে কথাটুকু, দর ফ্লয়েদ, দক্তর ফ্লয়েদ!

না হেউড, উত্তরটা এক মহিলা কণ্ঠের, তুমি স্বপ্ন দেখছ না। সময় এসেছে ঘুম থেকে ওঠার। মানোরম লালচে আভা মিলিয়ে যাচ্ছে। সে চোখ খুলল; মুখের উপর আলোর চমক এলে ক্ষণিক দৃষ্টিতে আবছা দেখা যায় সে শুয়ে আছে গদি আঁটা সিটে, শরীরটা ইলাস্টিক ওয়েবিং বেল্ট দিয়ে বাঁধা আর মানব-মূর্তিগুলো চারদিকে

দাঁড়িয়ে। কিন্তু তারা ফোকাসের এতটা বাইরে যে চেনা যায় না।

কার যেন নরম আঙ্গুল নেমে এসে তার চোখের পাতা বন্ধ করে দিয়ে কপাল ম্যাসেজ করছে।

নিজে নিজে চেষ্টা করো না। গভীরভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নাও… আবার… ঠিক হচ্ছে… এখন লাগছে কেমন?

ঠিক জানি না… অদ্ভুত… মাথাটা হালকা হালকা… খুব খিদে।

ভাল লক্ষণ। কোথায় তুমি তা কি জান? চোখ খুলতে পার এখন।

মানব মূর্তিগুলো দৃষ্টির ফোকাসে এল-প্রথমে ডাক্তার রুডেস্কো, তারপর ক্যাপ্টেন অর্লোভা। কিন্তু তানিয়াকে এমন লাগছে কেন! মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে বিরাট কোনো পরিবর্তন; কী সেটা… কারণটা বের করে সে ভিতরে ভিতরে খেল– প্রায় একটা ধাক্কা।

তোমার চুল আগের মতো হল কীভাবে!

যাক, তোমার চোখে ভাল লাগছে তাহলে! আশা করি তোমার দৃষ্টিতে ব্যাপারটা উন্নতি। আমি কিন্তু তোমার দাড়ি সম্পর্কে একই কথা বলতে পারছি না।

ফ্লয়েড তার হাতটা মুখে ঠেকায়। বুঝতে পারে তার কথাবার্তার আগে প্রতিবার একটু ভেবে নেয়া উচিত ছিল। চিবুক দু তিন দিনের শক্ত খাটো দাঁড়িতে ঢাকা-সাথে সাথে সব বাদ দিয়ে দিন গুনেছে ফ্লয়েড। হাইবারনেশনে চুল জন্মে একশো দিনে একদিনের সমান…তার মানে পরিবর্তন এসেছে আমার ভিতরেও। সে বলল, আমরা এখন বৃহস্পতিতে!

তানিয়া বিষণ্ণভাবে তার দিকে তাকায়, এক পলকে ডাক্তারকে দেখে, রুডেঙ্কো মাথা নেড়ে সামান্য সম্মতি দিল। সত্যিটা বলা যায়।

না হেউড। সে বলল, এখনো একমাসের পথ দূরে। ভয় পেয়ো না-শিপের কিছু হয়নি, সবই ঠিকঠাক। কিন্তু ওয়াশিংটন থেকে তোমার বন্ধুরা আমাদের বলেছে সময়ের আগেই তোমাকে জাগাতে। কিছু হচ্ছে…অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত। আমরা ডিসকভারিতে পৌঁছার প্রতিযোগিতায় নেমেছি, হঠাই-বলতে ভয় হয়, মরতে বসেছি আমরা…হয়ত।

৭. জিয়াং

কমসেট স্পিকার থেকে হেউড ফ্রয়েডের কণ্ঠস্বর ভেসে এলে ডলফিন দুটো হঠাৎ করে পুলের চারদিকে বৃত্তাকারে ঘোরা বন্ধ করে সাঁতার কাটতে লাগল কিনারা ধরে। মাথা উঁচু করে রঙিন আর স্থির চোখে মনোযোগের দৃষ্টিতে তাকায় শব্দটা যেখান থেকে আসছে সেদিকে।

ক্যারোলিনের এখন শুধুই তিক্ততা। তাহলে এরা হেউডকে চিনতে পেরেছে। এতদিন পরেও! অথচ ক্রিস্টোফার তার খেলার ঝাঁপির চারদিকে হামাগুড়ি দিচ্ছে, মহাশূন্যের আধা বিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে তার পিতার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার হয়ে আসছিল আস্তে আস্তে। অথচ ছবির বইয়ের রঙ কন্ট্রোলারের সাথে খেলা বন্ধ করছে না।

… প্রিয়তমা, একমাস আগেই আমার কথা শুনে তুমি অবাক হবে না। এক সপ্তাহ ধরে তুমি হয়ত জানো যে আমরা এখানে একা নই।

এখনো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এমন পাগলাটে কাজের মানেটা কী? পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরে আসার মতো জ্বালানিও সম্ভবত তারা পাবে না। এমনকি বৃহস্পতি পর্যন্ত কীভাবে যাবে তাও বুঝতে পারছি না আমরা।

কখনো তাদের দেখিনি। এমন কি কাছে গিয়েও না। জিয়াং পাঁচ কোটি কিলোমিটারের চেয়ে বেশি দূরে। তারা চাইলে আমাদের সংকেতের জবাব দিতে পারে। হাতে প্রচুর সময়। অবাক ব্যাপার, আমাদের যেন চেনেই না! এখন বন্ধুদের নিয়ে খোশ গল্পে ভীষণ ব্যস্ত হয়তো। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে টু মারবে-আর তখনই আমরা দেখব ওদের অ্যারোব্রোকিং সিস্টেম কতটা ভালো কাজ করে। তাদেরটা যদি ঠিকমতো কাজ করে তাহলে আমাদের মনোবলের জন্য ভালোই হবে ব্যাপারটা। আর যদি না পারে-থাক, এ নিয়ে কথা বলা বাদ দেই।

রাশিয়ানরা আগুপিছু বিবেচনা করে জিয়াংকে বেশ ভাল চোখেই নিয়েছে। প্রথমে তারা অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েছিল, সেই সাথে হতাশ-কিন্তু অনেকেই অকপটভাবে নিজের বিস্ময় প্রকাশ করে বসে। ওরা কী করে…! শুধু বুস্টারে স্পেসশিপের বৈশিষ্ট্য দেয়ার আগ পর্যন্ত সারা দুনিয়ার চোখের সামনে তারা বানিয়েছে ঐ জাহাজ। সবচে মজার ব্যাপার, এটাকে মহাশূন্য স্টেশন হিসেবে তারা সবার সামনে চালিয়েছে এতদিন। কেউ ভেবেছে এটা লেজার দুর্গ, কেউ গোয়েন্দা দফতর-কিন্তু কেউ কি কল্পনাও করতে পারে যে আসলে একটা স্পেসশিপ তৈরি হচ্ছিল? দারুণ চালাকি। ওরা বাড়তি শক্তি খরচ করেছে অতিরিক্ত গতির জন্য। আল্লা মালুম, পরিণতি কী হবে।

যাহোক, আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। আমাদের কাছে তো পৃথিবীর মতো গোদা গোদা টেলিস্কোপ নেই; তাই এত কম দূরত্বে থেকেও ভালভাবে দেখতে পাব না। অবশ্যই আমি আশা করি তারা ডিসকভারিকে একা থাকতে দেবে। ভাগ্যের ইচ্ছা যেন আমি তাদের সাহায্য না করি। ওটা আমাদের সম্পত্তি, এবং আমি নিশ্চিত স্টেট ডিপার্টমেন্ট ঘণ্টায় ঘণ্টায় এ কথাটুকু তাদের মনে করিয়ে দেবে।

ব্যাপারটা নিশ্চই খুব খারাপ-তবু চৈনিক বন্ধুরা যদি আমাদেরকে সময়ের আগে না জাগাতো তাহলে আরো এক মাস তুমি আমার কথা শুনতে পেতে না। কিন্তু এখন যেহেতু ডক্টর ডেস্কো আমাদের ঘুম থেকে তুলেছে সেহেতু আমি আজ থেকে প্রতি দুদিন অন্তর কথা বলব।

প্রাথমিক ধাক্কাটা যাবার পর আমি সেরে উঠছি ভালভাবে-জাহাজ আর এর ক্রুদের জানছি, আমার স্পেস ল্যাক খুঁজে পাচ্ছি-যে সময়টা ছিলাম ঘুমিয়ে। বড় ব্যাপার হল আমার বাজে রাশিয়ান বলাটাকে দিতে পারছি দক্ষতা। অবশ্য সেই দক্ষতা ব্যবহার করার প্রচুর সুযোগ নেই-প্রত্যেকে ইংরেজিতে কথা বলছে, রাশিয়ান চর্চা করি কীভাবে? আমরা আমেরিকানরা কী জঘন্য ভাষাবিদ! আমি মাঝে মাঝে আমাদের অন্ধ দেশপ্রেম বা আলসেমির জন্য লজ্জা পাই।

শিপে ইংরেজির মর্যাদা আছে ঠিকই-চিফ ইঞ্জিনিয়ার শাসা কোভলেভ কাজ করছে বিবিসি ঘোষক হিসেবে। আসলে তুমি যদি যথেষ্ট দ্রুত কথা বলতে পার কিছু ভুল করলেও কোনো ব্যাপার না। জেনিয়া মার্শেঙ্কো খুব সাহসী মেয়ে। শেষ মুহূর্তে ও ইরিনা ইউকুনিনার বদলে উঠেছে। কথায় কথায় শুনে আমি খুশি হয়েছি যে ইরিনা বেঁচে গেছে ভালোভাবেই। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। অবশ্য অবাক হব না সে যদি আবারো হ্যাং গ্লাইডিং আরম্ভ করে।

দুর্ঘটনার কথা বলতে গেলে বোঝাই যায় জেনিয়ার ভাগ্যও খুব একটা ভাল না। প্লাস্টিক সার্জন ভালভাবেই করেছে তার কাজ-তবু যে কেউ বুঝবে যে মেয়েটা কখনো না কখনো মারাত্মকভাবে পুড়েছিল। সে ক্রুদের কাছে যেন শিশু। অন্যরা তার সাথে এমন ব্যবহারই করে। আমি বেচারা বলতে যাচ্ছিলাম ভাল ব্যবহার করে। তার প্রতি সবার মনোভাব নরম।

ক্যাপ্টেন তানিয়ার সাথে মিলেমিশে চলছি কীভাবে সেটা ভেবে হয়ত অবাক হচ্ছ তুমি। ভাল কথা, আমি তাকে খুব পছন্দ করি।কিন্তু রাগানোর মোটেও ইচ্ছা নেই। কোনো সন্দেহ নেই সে-ই চালায় এ শিপটা।

আর সার্জন কমান্ডার রুডেঙ্কো-দুবছর আগে হনলুলু অ্যারোস্পেস কনভেনশনে দেখেছ তাকে। আমি শিওর তুমি ঐ শেষ পার্টির কথা ভুলে যাওনি। বুঝতে পারবে কেন আমরা তাকে ক্যাথেরিনা দ্য গ্রেট বলে ডাকি-অবশ্যই তার পে ছ-নে-র বিস্তৃত ইতিহাসের জন্য।

নাহ, যথেষ্ট পরচর্চা হয়েছে। আমি ওভারটাইম করলে সারচার্জ আশা করতাম। তাছাড়া, এই ব্যক্তিগত কলগুলো পুরোপুরি প্রাইভেট মনে করতে হবে। কিন্তু যোগাযোগে প্রচুর পথ থাকে, অন্য কোনো রুট থেকে মাঝে মধ্যে যদি ম্যাসেজ পাও, ভাল, অবাক হয়ো না।

আমি থাকলাম তোমার কথা শোনার অপেক্ষায় মেয়েদের বলো তাদের সঙ্গে পরে কথা হবে। তোমাদের সবার জন্য ভালবাসা-ক্রিস আর তোমাকে মিস করি সব সময়। প্রতিজ্ঞা করছি ফিরে এসে আর কখনো যাব না কোথাও। রাগের একটু শব্দ করে পুরোপুরি কৃত্রিম কণ্ঠে বলল, মহাশূন্যযান লিওনভ থেকে সাত হতে শুরু হয়ে চার শত বত্রিশ স্টোকে প্রেরণ শেষ হল।

ক্যারোলিন ফ্লয়েড স্পিকারের সুইচ বন্ধ করার সাথে সাথে ডলফিনগুলো পুলের নিচে গিয়ে মসৃণ গতিতে ভেসে গেল প্রশান্ত মহাসাগরে; রেখে গেল পানির উপর শুধু মৃদু কয়েকটা ঢেউ। বন্ধুদের চলে যাওয়া বুঝতে পেরে ক্রিস্টোফার কান্না শুরু করেছে। মা তাকে হাতে তুলে চেষ্টা করছে শান্ত করার, কিন্তু কাজ হতে তার অনেকক্ষণ লাগবে।

৮. বৃহস্পতির পথে

অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি বৃহস্পতির। গায়ে তুষার রঙা মেঘের ফিতার সাথে স্যামন মাছের গোলাপী কমলা রঙের বিচিত্র মিশেল। বিখ্যাত গ্রেট রেড স্পট বা বিরাট লাল দাগটা ফ্লাইট ডেক প্রজেকশন স্ক্রিনে চেয়ে আছে হিংস্র চোখের মতো। তিন চতুর্থাংশ আলোয় ভরা। কিন্তু কেউ তাকাচ্ছে না আলোকিত চাকতির দিকে। সব চোখ সেঁটে আছে গ্রহরাজের কিনারায়, চিকণ চাঁদের মতো দেখতে অন্ধকারের উপর। গ্রহের রাতের অংশের উপর দিকে চৈনিক স্পেসশিপটা সেই বিখ্যাত সঙ্কটের মুখোমুখি। জিয়াং বাঁচলে লিওনভও আশা পাবে। তারাও আশা করতে পারবে যে বৃহস্পতির পাশ কাটিয়ে গতি কমিয়ে ঐপাশে যাওয়া সম্ভব।

ফ্লয়েড ভাবল-এত আগ্রহ নিয়ে তাকানোর মানেই নেই। চল্লিশ মিলিয়ন কিলোমিটারের মধ্যে আমরা সম্ভবত কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তাতে কী, যা জানতে চাই রেডিও আমাদের বলবে।

দুঘন্টা আগে জিয়াং সব ভয়েস, ভিডিও এবং ডাটা সার্কিট বন্ধ করেছে। লংরেঞ্জ অ্যান্টেনাগুলো তাপ ফলকের প্রটেকটিভ শেডের ভেতর তুলে নিলেই সব ট্রান্সমিশন বন্ধ হয়ে যায়। শুধু সবদিকে অপারেট করা আলো-সংকেত চাইনিজ শিপের দিকে ট্রান্সমিট করা হচ্ছে এখনো। শিপটা ঐ মহাদেশের সমান মেঘ-মহাসাগরে মগ্ন। লিওনভের কন্ট্রোল রুমে কর্কশ বিপ… বিপ… বিপই এখন একমাত্র শব্দ। ঐ স্পন্দনের প্রতিটা দু মিনিটেরও আগে বৃহস্পতির এলাকা ছেড়েছে; তার মানে লিওনভ নজর রাখছে দু মিনিটের পুরনো পরিস্থিতির উপর। এরই মধ্যে এ বিপ গুলোর উৎসটা হয়ত বৃহস্পতির আকাশে বিস্ফোরিত হয়ে ভাস্বর গ্যাসের সাথে সাথে জ্বলছে। কে জানে!

সংকেত ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জোরালো শব্দগুলো হচ্ছে বিকৃত। কয়েকটা শব্দ পুরোপুরি হাওয়া হয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে ধারাবাহিকতা। জিয়াংকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে একটা রক্তিম আবরণ, শিপটা বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবে মনে হয়। যদি করে থাকে…

ম্যাক্স চিৎকার করে ডাকল, পসমত্রি! ওখানে ওটা!

ফ্লয়েড কিছুই দেখেনি প্রথমে। পরে আলোকিত বৃহস্পতি চাকতির কিনারায় একটু পরেই সে পুঁচকে একটা জ্বলজ্বলে তারা আবিষ্কার করল। বৃহস্পতির আঁধার মুখে কোনো তারা থাকার কথা না। তারাটা একেবারে স্থির। সে জানে এটার অবশ্যই সেকেন্ডে একশ কিলোমিটার বেগে চলাফেরা করছে। আস্তে আস্তে বাড়ছে ঔজ্জ্বল্য। বেশিক্ষণ মাত্রাবিহীন বিন্দুর মতো না থেকে জিনিসটা বড় হতে লাগল। মানুষের বানানো একটা ধূমকেতু বৃহস্পতির রাতের আকাশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুতের মতো দ্রুতগতিতে ছুটেছে হাজার হাজার কিলোমিটার লম্বা উজ্জ্বল রেখা পেছনে ফেলে রেখে।

যোগাযোগের আলো-সংকেত থেকে বিকৃত আর হঠাৎ বেড়ে যাওয়া একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে বারবার। তারপর বৃহস্পতির নিজস্ব তেজস্ক্রিয়তার অর্থহীন একমাত্র শব্দ শোনা গেল যা মহাজাগতিক রশ্মি ও সুরের মধ্যে পড়ে। কোনো মানেই নেই এর।

জিয়াংয়ের আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না। তবে অদৃশ্য হয়ে যায়নি এখনো। ডিসকভারি থেকে উঠে আসা পুঁচকে স্ফুলিঙ্গটা গ্রহের সূর্যমুখী দিক থেকে বোঝা যায় এমনভাবে চলাচল করছে। তাড়াতাড়ি রাতের পাশে অর্থাৎ সূর্যবিমুখী দিকে হচ্ছে বিলীন। এভাবে যদি জিয়াং যেতে থাকে তবে বৃহস্পতি শিপটার গতি ধ্বংস করে কজায় নিয়ে নেবে। পরের বার দৈত্যাকার বিশ্বের পেছন থেকে যখন উঠে আসবে, জিয়াং হবে বৃহস্পতির অন্য এক উপগ্রহ।

মিট মিট করে জ্বলছে ফুলিঙ্গ। জিয়াং গ্রহটার বাঁক ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে রাতের পাশে। ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার আগে কিছুই দেখা যাবে না। সব ঠিক মতো চললে এক ঘণ্টার ভেতরে বেরুবে জিয়াং। চাইনিজদের মনের জন্য তা হবে খুব দীর্ঘ সময়।

প্রধান বিজ্ঞানী ভ্যাসিলি অর্লোভ আর যোগাযোগ প্রকৌশলী শাসা কোভালেভের হিসেবে ঘন্টাটা পেরিয়ে গেল খুব তাড়াতাড়িই। ঐ ছোট্ট তারা দেখে ওরা পেয়েছে অনেক শিক্ষা। এর হাজির হওয়া এবং হারিয়ে যাবার খবরাখবর ভয়াবহ। আলোর ডপলার শিফট দিয়েছে জিয়াংয়ের নতুন কক্ষপথের আসল খবরটা। লিওনভের কম্পিউটারগুলো সব চিত্র ধরে রেখেছিল আগেই। বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে সরণের হার সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা থাকাই স্বাভাবিক লিওনভের কম্পিউটারে। তার উপর ভিত্তি করে জিয়াংয়ের উঠে আসার সময়ও বের করেছে।

ভ্যাসিলি কম্পিউটার ডিসপ্লে সুইচ বন্ধ করে চেয়ারে বসে চারদিকে ঘুরে সীট বেল্ট ঢিলা করল। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে বাকিরা। ভ্যাসিলি একটু ভেবে শুরু করল বলা।

সময়মতো ডিস্টার্ব করতে এসেছ? ওটা বৃহস্পতিকে ঘুরে বেরিয়ে আসবে বেয়াল্লিশ মিনিটের মধ্যে। তোমরা একটু ঘুরতে যাচ্ছ না কেন? সব ঠিকমতো করতে হলে মনোযোগ দিতে হবে। তোমাদের সাথে আবার দেখা হবে পঁয়ত্রিশ মিনিট পর। যাও! যাও! বাজে বন্ধুর দল।

অবাঞ্ছিত ক্রুরা ইচ্ছা না থাকলেও চলে গেল ব্রিজ থেকে-কিন্তু ত্রিশ মিনিটের কিছুটা আগেই সবাই ফিরে এল ভ্যাসিলির বিরক্তি বাড়াতে। সে তার ধারণার উপর ক্রুদের বিশ্বাসের কমতি দেখে বকুনিও দিল। মজার ব্যাপার, তখনি জিয়াংয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী আলো-সংকেত বিস্ফোরিত হয়ে লাউড স্পীকারে বেরোল পরিচিত শব্দ; বীপ,..বীপ…বীপ…

ভ্যাসিলি অবাক হয়েছে, তার বাহাদুরির হিসাবটা ভুল! দুঃখও পেয়েছে কিছুটা। কিন্তু বাকিরা তার ভুলের দিকে খেয়াল না দিয়ে বরং স্পেসশিপটার ফিরে আসার আনন্দে মাতোয়ারা। দ্রুত সেও যোগ দেয় হাততালির খেলায়। ফ্লয়েড দেখেনি কে প্রথম হাততালি শুরু করে। জিয়াং বিদ্রোহী হতে পারে, হয়ত চুরি করতে যাচ্ছে ডিসকভারিকে, কিন্তু তারা সবাই মানব-নভোচারি। বাড়ি যত্তো দূরেই হোক যে কোনো মানুষ যখনই ভ্রমণ করে মহাশূণ্যে-প্রথম জাতিসংঘ মহাশূন্য চুক্তির মহৎ বাণী হিসেবে সে মানবজাতির দূত।

তারা যদি চাইনিজদের সফলতা নাও চেয়ে থাকে, কখনো তাদের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া কামনা করোনি।

এর সাথে অবশ্য একটা বড় স্বার্থ জড়িত, ফ্লয়েড ভাবতেও পারেনি। এখন তো লিওনভের নিজের সফল হবার সম্ভাবনাও বাড়ছে, এজন্যেও সবাই খুশি হয়ে থাকতে পারে। জিয়াং প্রমাণ করল অ্যারোট্র্যাকিং ম্যানুভার আসলেই সম্ভব। বৃহস্পতির ডাটা ঠিক; এর বায়ুমন্ডলে অপ্রত্যাশিত এবং সম্ভবত মারাত্মক বিস্ময়ের কিছুই নেই।

চমৎকার! তানিয়া বলল, আমার মনে হয় অভিনন্দন পাঠানো উচিত। কিন্তু আমাদের অভিনন্দন পেলে তারা প্রাপ্তিস্বীকারও করবে না।

সাথীদের কয়েকজন তখনো ভ্যাসিলিকে নিয়ে করছে কৌতুক। আর বেচারা তার কম্পিউটারের আউট পুটের দিকে সরল অবিশ্বাসে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

আমি বুঝতে পারছি না! সে বিস্ময়ে বলল, এখনো তাদের বৃহস্পতির পিছনে থাকার কথা। শাসা-তাদের বিকনের গতির একটা রিডিং আমাকে দাও তো!

আরো একটা শব্দহীন ডায়ালগ ঢোকানো হল কম্পিউটারে, তারপর ভ্যাসিলি দিল একটা লম্বা নিচু স্বরের শীষ, কোথায় যেন ভুল হচ্ছে। তারা একটা বন্ধ কক্ষপথে, ভাল-কিন্তু এ অর্বিটটা তাদের ডিসকভারির কাছে যেতে দেবে না। যে কক্ষপথে তারা এখন আছে এটা তাদের নিয়ে যাবে আইও থেকে দূরের পথে। আবার পাঁচ মিনিটের জন্য খুঁজে পেলে আমি ঠিক ডাটা পাব।

যত যাই হোক তাদের অবশ্যই নিরাপদ অর্বিটে থাকতে হবে, তানিয়া বলল, পরে ঠিক করা যায় অর্বিটের কোথাও গন্ডগোল থাকলে।

সম্ভবত। কিন্তু ঠিক করতে গেলে কয়েকটা দিনের অপচয় হয়। তাদের জ্বালানি থাকলেও এ কাজ করার সাহস পাবে না। আমার এমনটাই মনে হচ্ছে।

সুতরাং আমরা এখনো তাদের নিয়ম মাফিক টোকা দিতে পারি।

এত্তো আশা না করাই ভাল। আমরা এখনো বৃহস্পতি থেকে তিন সপ্তাহ পিছিয়ে। পৌঁছার আগেই ওরা এক ডজন কক্ষপথ গড়ে নিতে পারে আর ডিসকভারির সংকেত স্থানের জন্য সবচে সুবিধাজনক অর্বিটটা বেছে নিতেও পারে।

মনে হয় ওদের হাতে অনেক জ্বালানি।

অবশ্যই। এবং তা এমন কিছু যা ধারণা করে আমরা শুধু শিক্ষা নিতে পারি।

এসব কথাবার্তা এমন দ্রুত এবং উত্তেজনাপূর্ণ রাশিয়ান ভাষায় বলা হল যে ফ্লয়েড পড়ে গেল অনেক পেছনে। তানিয়ার মায়া হয় বেচারা ফ্লয়েডের জন্য। সে ব্যাখ্যা করল যে জিয়াং অনেক দূরে চলে গেছে। বাইরের উপগ্রহের কাছাকাছি একটা অর্বিট; তার মানে বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে বিশাল এক কক্ষপথে ঘুরছে মহাকাশযানটা। সব শুনে ফ্লয়েডের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, তারপর মারাত্মক বিপদে পড়তে পারে। তারা যদি সাহায্যের আবেদন জানায় কী করবে তুমি?

ঠাট্টা করছ, না? তারা সাহায্য চাইবে তুমি ভাবলে কী করে? ওরা খুব অহংকারী। যাহোক, অসম্ভব। আমরা সাহায্য করতে পারি না, তুমি তো ভালই জান। আমাদের জ্বালানি থাকলেও…।

অবশ্যই। তোমার কথাই ঠিক। তবে মানব জাতির নিরানব্বই শতাংশ অরবিটাল মেকানিক্স বোঝে না। তাদের কাছে অসহযোগিতার কারণ ব্যাখ্যা করা এক কঠিন ব্যাপার। তারা চিৎকার করে গলা ফাটাবে, লিওনভ কেন জিয়াংকে সাহায্য করতে যায়নি এত কাছে থেকেও! রাজনৈতিক জটিলতা নিয়েও আমাদের চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিত-সাহায্য করতে না পারলে ব্যাপারটা আমাদের সবার জন্যই খারাপ দেখায়। ভ্যাসিলি, তোমার কাজের আউটপুট পাওয়ার সাথে সাথে আমাকে তাদের শেষ কক্ষপথটার বর্ণনা দেবে?

আমি একটু হুক ওয়ার্কের জন্যে নিচে নামার কেবিনে যাচ্ছি।

ফ্লয়েডের কেবিন, বরং বলা ভাল কেবিনের এক তৃতীয়াংশ তখনো স্টোরের মালামালে ভর্তি। সেখানটার বেশিরভাগই পর্দায় ঢাকা বাংক। বোধ হয় চন্দ্র আর কার্নো লম্বা ঘুম থেকে জেগে উঠলে তাদের দখলে যাবে বাংকের জায়গাটা। ফ্লয়েড নিজের স্বার্থে কাজের কিছুটা ক্ষেত্র পরিষ্কারের ব্যবস্থা করল এমনকি অন্য একটা

দুঘন মিটার স্থান দখলের আশা করল যেটা তার দরকার নেই। স্রেফ যখনই কেউ। ফার্নিচারগুলো সরাতে তাকে সহায়তা করবে তখনি সেটুকুর দখল আসছে।

ফ্লয়েড আনলগ করল তার ছোট কমিউনিকেশন ক্যাবিনেট, ডিজঅ্যাব্রাপশন কি বসিয়ে জিয়াংয়ে পাঠানো ওয়াশিংটনের খবরের জন্য কল করল। সে ভয় পাচ্ছে, খবরটা হয়ত অন্য রিসিভাররাও ডিকোড করে পড়ে ফেলবে। সাইফারটাদুশ ডিজিট মৌলিক সংখ্যার গুণফলের উপর বানানো। জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা তার সুনামের উপর বাজি ধরেছে এ দাবি করে যে তারা আসল সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দ্রুততম কম্পিউটারও এতে ফাটল ধরাতে পারবে না-আফসোস, এ এমন এক দাবি যা কখনো প্রমাণ করা যাবে না।

সে আরেকবার মনোযোগ দিয়ে চাইনিজ শিপের চমৎকার ছবির দিকে তাকায়। এটা যে স্পেসশিপ সে খবর বেরিয়ে যাবার পর ভোলা হয় ছবিটা। ঠিক পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়ার মুহূর্তে তোলা। পরে নেয়া হয় আরো শট-তেমন পরিষ্কার আসেনি, কারণ ততক্ষণে এটা প্রাইং ক্যামেরা থেকে অনেক দূরে চূড়ান্ত স্তরে বৃহস্পতির দিকে প্রচণ্ড বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঐ ছবিগুলো তাকে সবচে বেশি উৎসাহ দেয়। আরো দরকারি ব্যাপার হল কেটে ফেলা ড্রয়িং আর তাদের কৃতিত্বের দামটা বিচার করা।

সবচে নির্ভরযোগ্য সম্ভাবনাটাই মেনে নেয় সবাই; আসলে চাইনিজরা কী করতে চাচ্ছে তা বোঝা মুশকিল। সৌর জগতে আড়াআড়ি পথে পাগলের মতো তারা এসেছে, যাতে লিওনভকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া যায়। তাদের নব্বই ভাগ প্রোপ্যাল্যান্ট শেষ। ফিরবে কী করে! অন্যদিকে লিওনভ পৃথিবীর আকর্ষণ ছাড়ার পরই বন্ধ করে জ্বালানি পোড়ানো। পুরোপুরি সুইসাইড মিশন না হলে শুধু হাইবারনেশনের পরিকল্পনা হতে পারে। পরে উদ্ধার করতে পারে অন্য কোনো চৈনিক তরী। ফ্লয়েডের মন বিশ্বাস করে না চাইনিজ হাইবারনেশন টেকনোলজি টিকে থাকার মতো উন্নত। এ ব্যাপারে ওরা বরাবর ভুল করে। এমনকি কাঁচা ঘটনার তুবড়ি মেরে এর তথ্য সার্কিটে গোলমাল খুঁজতে গিয়ে প্রায়ই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতে হয়েছিল একে। আচ্ছা! জিয়াংয়ে একটা দারুণ কাজ করেছে দ্রুত আসার পরিকল্পনাটা-তা হলো সময়ের স্বল্পতা বিবেচনা করা। ওরা আসলেই হাইবারনেশনে যায়নি বলেই হয়ত ক্রুদের জীবনের দু মাস বাঁচাতে এসেছে এত দ্রুত। ফ্লয়েড আশা করে তার কাছে পাঠানো বিষয় আরও যত্নের সাথে ফিল্টারিং করা উচিত ছিল। এ বিশাল ডাটার অনেক অংশই মিশনের ক্ষেত্রে আবর্জনা।

তবু, যা খুঁজেছিল তা যখন জানতে পারেনি, আন্দাজে কিছু না বলাই ভাল। কোনো ব্যাপার প্রথমে অবাস্তব বা অর্থহীন মনে হলেও শেষে মাঝেমধ্যে তা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফ্লয়েড আরেকবার দ্রুত পাঁচশ পৃষ্ঠার ডাটার উপর চোখ বুলিয়ে যায়। ডায়াগ্রাম, চার্ট, ফটোগ্রাফের মধ্যে কোনো কোনোটা এমন ঝাপসা দাগ ওয়ালা যে প্রায় যে কোনো কিছু হিসেবে বিক্রি হতে পারে। নিউজ আইটেম, সায়েন্টিফিক কনফারেন্সের প্রতিনিধির তালিকা, টেকনিক্যাল প্রচারণার টাইটেল এবং এমনকি বড় বড় সিদ্ধান্ত নেয়ায় এক কমার্শিয়াল ডকুমেন্ট এটা। গুপ্তচরবৃত্তি এক নিপুণ শিল্প। এ শিল্প এখন মারাত্মক ব্যস্ত। বোঝাই যায় ওরা অনেক জাপানী হলোমেমরি মডিউল বা সুইস গ্যাস-ফ্লো মাইক্রোকন্ট্রোলার বা জার্মান তেজস্ক্রিয়তা ডিটেকটরগুলোর শুকনো লেকের মধ্যে গন্তব্যের খোঁজ করে থাকতে পারে। তারা হাইবারনেশনে পাঠাবে না, আত্মহত্যা করবে না, আসার পথেই ৯০% জ্বালানি শেষ করেছে, আর মাত্র একটা পথই খোলা…এ এলাকাতে তাদের প্রোপ্যাল্যান্ট আছে! তবে কি বৃহস্পতির পথে এটা তাদের প্রথম মাইল ফলক নয়?

রিপোর্টটাতে কিছু আইটেম কাকতালীয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছে মিশনের সাথে যেগুলোর সম্পর্ক নেই। চাইনিজরা যদি সিঙ্গাপুরের কোনো অস্ত্র বা বিজ্ঞান সংস্থার মাধ্যমে আমেরিকায় এক হাজার ইনফ্রারেড সেন্সরের জন্যে কোনো গোপন অর্ডার দিয়ে থাকে, তা শুধুই সামরিক। এটা যে লেসার দুর্গ নয় বরং স্পেসশিপ তাতে প্রমাণ হলোই। লেজারের কথা এ রিপোর্টে ক্যান রে বাবা! খুবই অস্বাভাবিক! জিয়াং হিট সিকিং মিসাইলের পেছনে দৌড়াতে চায়। অথচ হিট সিকিং মিসাইল তৈরি করা হয় আকাশ যানের পেছনে ছোটার জন্য। অথবা এংকরেজ, আলাস্কা আর গ্লোসিয়ার জিওফিজিক্স প্রতিষ্ঠান থেকে বিশেষজ্ঞ আর যন্ত্রপাতি চাওয়াটা আসলে ধোকাবাজি। কোন্ ঢিলা মাথা ভেবেছে যে গভীর মহাশূন্য অভিযানে কোনো দরকার থাকতে পারে–

মৃদুহাসি ফ্লয়েডের ঠোঁটেই জমে গেল। ঘাড়ের পেছনে চামড়ার হামাগুড়ি বুঝতে পারে সে। মাই গড! তারা কি ঝুঁকি নেয়নি? এতবড় সাহস! আচ্ছা, এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছুর অর্থ।

ছবিগুলোর পেছনে উল্টে দেখে ফ্লয়েড। অনুমান করে চাইনিজ শিপের পরিকল্পনা। হ্যাঁ, এটা স্রেফ কল্পনা-ড্রাইভ পরিবর্তন ইলেকট্রোডগুলোর পাশের ও পেছনের থামের মতো জিনিসগুলোর আকার তাকে ধাঁধায় ফেলে।

ফ্লয়েড ব্রিজে কল দিল, ভ্যাসিলি, তুমি কি তাদের কক্ষপথ বের করেছ?

হ্যাঁ। নাবিক উত্তর দিল একদম সংযত কণ্ঠে। যেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ফ্লয়েড সাথে সাথে বলল যে তাদের ফুয়েল সমস্যার সমাধান দেখা যায়। সে চেষ্টা করল সমাধান করার।

তারা ইউরোপার সাথে সিগন্যাল প্লেস তৈরি করছে, তাই না?

অন্য প্রান্ত থেকে বিস্ফোরণের মতো হাঁপানোর একটা শব্দ এল।

আশ্চর্য! এমন বেমক্কা কাজের খবর তুমি কীভাবে জানলে?

জানিনাতো-স্রেফ অনুমান।

কোনো ভুল থাকার কথা নয় ভ্যাসিলির মনে পড়ে যায় কত বড় হাস্যকর ভুল করেছে একটু আগে,– আমি ছটা জায়গায় জিয়াংয়ের ফিগার চেক করলাম। তাদের ব্রেকিং ম্যানুভারের সমস্যা মনে করি যেটাকে সেটা হয়ত সমস্যা না। সমাধান। তারা ইউরোপার পথে-ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়। সতের ঘণ্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছবে।

এবং কক্ষপথে ঢুকবে।

সম্ভবত; এজন্য বেশি এনার্জি খরচ হবে না। কিন্তু ব্যাটাদের মতলব কী? ভ্যাসিলি এখনো খাবি খাচ্ছে।

আমি আরেকটা আন্দাজের ঝুঁকি নিই? দ্রুত সার্ভে করবে এবং তারপর নামবে।

ক্ষেপেছ নাকি? এক মিনিট! তুমি এমন কিছু জানো যা আমরা জানিনা-ঠিক?

না। এ সম্ভাবনাটা সহজেই বাদ দেবার মতো নয়। তুমি নিজের পায়ে কুড়াল মারা শুরু করবে। চালবাজের মতো এখনো বলে চলছে ফ্লয়েড।

ঠিক আছে, শার্লক হোমস! তারা কোন উসিলায় ইউরোপায় নামতে চাইতে পারে? ঈশ্বরের দোহাই, কী আছে সেখানে?

ফ্লয়েড তার বিজয়ের ছোট মুহূর্তটাকে এনজয় করছে। অবশ্যই, সে বসে আছে। এখনো ভুল-সঠিকের মধ্যিখানে।

ইউরোপায় কী আছে? সামান্য জিনিস। জগতের সবচে মূল্যবান পদার্থ।

সে অতিরঞ্জিত করলেও ভ্যাসিলি বোকা নয়। ফ্লয়েডের ঠোঁট থেকে উত্তরটা কেড়ে নিল।

অবশ্যই-পানি!

ঠিক। এবং বিলিয়ন বিলিয়ন টন। প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাংকগুলো ভরার জন্য যথেষ্ট ঐ পানি। জ্বালানি কম খরচ করে সব উপগ্রহের চারদিকে ঘুরে বেড়াও। ডিসকভারির অবস্থান আর নিজের বাড়ির দিকে অভিযানের জন্যে অনেক পথ বাকি। আমি এ কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছি, ভ্যাসিলি-কিন্তু আমাদের চাইনিজ বন্ধুরা চাতুরীতে আবারো আমাদের ছাড়িয়ে গেছে।

সব সময় পার পায়। অবশ্যই, এবারও তারা পার পেয়ে যাবে।

৯. গ্র্যান্ড ক্যানেলের বরফ

চকচকে কালো আকাশ ছাড়া এমন একটা ছবি পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের যে কোনো জায়গায় তোলা যায়; দিগন্তের ছেড়ে যাওয়া সব পথে কুঁচকে যাওয়া বরফের সাগর মোটেই অন্যরকম নয়। শুধু অন্যরকম দৃশ্যটা হল-মহাশূন্য পোশাক পরা পাঁচটা মানব-মূর্তি সামনে থেকে বলছিল যে সামনের দৃশ্যটা আরেক পৃথিবীর।

এখনো চীন আগের পথেই চলে। দরকারি-অদরকারি সব কথাই গোপন রাখে। ক্রুদের নামও প্রকাশ করেনি। ইউরোপার জমে যাওয়া বরফের আবরণের উপর নামহীন অনাহুত প্রবেশকারীর সংখ্যা স্রেফ পাঁচজন। প্রধান বিজ্ঞানী, কমান্ডার, নাবিক, প্রথম প্রকৌশলী, দ্বিতীয় প্রকৌশলী। এ এক রকমের আঘাত, ফ্লয়েড ভাবতে পারছে না যে লিওনভে ঢোকার একঘণ্টা আগে পৃথিবীতে প্রত্যেকে খুব কাছে থেকে ঐ ঐতিহাসিক ছবি দেখেছিল। কিন্তু জিয়াংয়ের ট্রান্সমিশন আলোর এমন সংকেতের মাধ্যমে পাঠানো হয় যে এদের কাজে নাক গলানো অসম্ভব ব্যাপার। লিওনভ শুধু আলোক সংকেত রিসিভ করতে পারে আর সব দিকে প্রচার করে, ব্যস। বুঝতে পারে না কিছুই। এমনকি সেই সংকেতও বেশিরভাগ সময় শোনা যায়নি; ইউরোপার ঘূর্ণন একে দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে গেছে, বা উপগ্রহটা নিজে বৃহস্পতির ভয়ংকর গ্রহণে পড়েছে। চাইনিজ মিশনের সব খবর পেতে হয়েছে পৃথিবী থেকেই।

প্রাথমিক জরিপের পর কিছু কঠিন পাথুরে দ্বীপের একটাতে জাহাজ ভোরের আলোকে ছুঁয়ে দেখল। দ্বীপটা বরফের শক্ত আবরণের বাইরে বেরিয়ে আছে, পুরো চাঁদকে ঘিরে ফেলেছে ঐ কঠিন পানি। বরফ মেরু থেকে মেরুতে সমতল। এ জমাট জলকে খোদাই করার জন্যে কোনো রোদ-বৃষ্টি-ঝড় কিছুই নেই ইউরোপায়। আস্তে আস্তে চলমান পাহাড়ে রূপান্তরের জন্যে স্তরের পর স্তর গড়ার জন্যে স্রোতে বা বাতাসে ভাসমান বরফ নেই। বায়ুশূন্য ইউরোপায় উল্কাপিণ্ড পড়ে থাকতে পারে কিন্তু কখনো বরফের টুকরো নয়। সব উচ্চতাকে কমিয়ে এক স্তরে এনে উপরের অংশকে ছাঁচে ঢালাই করার জন্যে একমাত্র শক্তি হল অভিকর্ষের টান। অন্য উপগ্রহগুলো ইউরোপাকে বারবার পেরিয়ে যাবার কারণে তৈরি বিরামহীন কম্পনও এ বরফ স্তর সমান করার জন্য দায়ী। সবচে বড় কথা, বৃহস্পতির প্রভাবও পড়ে। গ্রহরাজের টানে আসা জোয়ার ফুরিয়েছে অনেক অনেক কাল আগে, আজ এ বরফের রাজ্যে কোনো জোয়ার নেই। ইউরোপা তার দৈত্য প্রভুর দিকে এক মুখ ঘুরিয়ে তালাবদ্ধ হয়ে আছে চিরতরে। যেন বৃহস্পতিই এর রক্ষাকবচ।

এসব জানা যায় উনিশশো সত্তুরের অভিযানে ভ্রমণকারীদের ওড়া থেকে, উনিশো আশির গ্যালিলিও৫৩ জরিপ আর উনিশো নব্বইয়ের কেপলার ল্যান্ডিং থেকে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চীনারা আগের সব মিশনের চেয়ে বেশি শিখেছে, জেনেছে ইউরোপা সম্পর্কে। জ্ঞান তারা তাদের মধ্যেই রাখবে; কেউ অনুতপ্ত হতে পারে এ কাজ করায়, কিন্তু সত্যি কথা হল, খুব কম লোকই এসব ব্যাপার বাইরে প্রচারের অধিকার পায়।

অনেক তীব্রভাবে ব্যাপারটা অস্বীকার করা হত। উপগ্রহ অধিকার করার অধিকার। ইতিহাসে প্রথম বারের মতো একটা জাতি অন্য এক পৃথিবীর কাছে দাবী পেশ করেছে, এবং পৃথিবীর সব সংবাদ মাধ্যম আইনি অবস্থানে থেকেই ভিন্নমত জানিয়েছে। পুরো ব্যাপারটা বিরক্তিকর। শেষে চাইনিজরা মুখের উপর বলে দিল যে তারা কখনো ০২ ইউ এন মহাশূন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। তাই জাতিসংঘের শর্ত মানতেও বাধ্য নয়। সবাই রেগে গিয়ে প্রতিবাদ করলেও তারা থেকেছে নিজের মতো। আসলে ইউরোপাকে চাইনিজ কলোনি বানানোর প্যানপ্যানানির পেছনের অন্য উদ্দেশ্যটা কেউ আঁচও করতে পারেনি।

হঠাৎ ইউরোপা সৌর জগতের সবচে বড় খবর হয়ে দাঁড়ালো। মনে হয় স্পটে উপস্থিত মানুষের বিরাট চাহিদা আছে।

.

বৃহস্পতির পথে এলেক্সি লিওনভ থেকে বলছি কসমোনট হেউড ফ্লয়েড। তোমরা বেশ কল্পনা করতে পার, পার গুজব তুলতে-তাই আমাদের সব চিন্তা ভাবনা এ মুহূর্তে ঝুঁকে পড়েছে ইউরোপার উপর।

ঠিক এখন আমি এর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখে জাহাজের সবচে শক্তিশালী টেলিস্কোপ। তোমরা খালি চোখে চাঁদকে যেমন দেখো তারচে দশগুণ বড় দেখাচ্ছে বরফ-রাজ্যকে। আসলেই, বড় রহস্যময় দৃশ্য।

উপরের অংশ গোলাপী, সমতল। তার মধ্যে কলঙ্কের মতো কয়েকটা ছোট বাদামি দাগ। সুতায় বোনা জালের মতো, কোঁকড়ানো আর সব দিকে যেন বুনন দিয়ে ঢাকা। আসলে মেডিক্যাল টেক্সটবুকে দেখানো শিরা আর ধমনীর প্যাটার্নের ছবির মতো দেখায় একে। এ সব দাগের কয়েকটা শত শত-বা হাজার হাজার কিলোমিটার লম্বা। দেখতে যেন রহস্যময় খাল। যাকে বলে পারসিভাল লোয়েলের নালা। বিশ শতকের প্রথম দিকের অন্যান্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কল্পনা করেছিলেন যে তারা দেখেছেন মঙ্গলগ্রহের খাল।

কিন্তু ইউরোপার নালাগুলো মিথ্যা নয়। আরো একটা কথা, এগুলো অবশ্যই প্রাকৃতিক। আর কী, এগুলোয় পানি বইছে। অন্তত বরফ। সেজন্য উপগ্রহটা গড়ে পঞ্চাশ কিলোমিটার গভীর মহাসাগর দিয়ে প্রায় পুরোপুরি ঢাকা। সূর্য থেকে বহু দূরে বলে ইউরোপার পিঠের তাপমাত্রা খুবই কম। হিমাঙ্কের প্রায় একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী নিচে। সুতরাং কেউ আশা করতে পার যে এর এক একটা মহাসাগর বরফের একটা শক্ত টুকরো। এমন হতেই পারে।

অবাক করা কথা হলেও ব্যাপার তা নয়। প্রচুর তাপ জনে ইউরোপার ভেতরে। জোয়ারের কারণে প্রতিবেশী আইওর আকর্ষণ এ তাপগলা পানিকে নাড়িয়ে রাখে সারাক্ষণ। আইওর দানব আগ্নেয়গিরির শক্তিও এ পানিকে গলিয়ে রাখে। তাই বরফ গলে, ভাঙে আবার জমেও যায়। ফাটল ধরে সব সময় আমাদের পৃথিবীর স্তরের মতো পথও হয় তৈরি। ফাটলের ঐ জটিল নকশা আমি দেখছি এখন। খাদগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই প্রাচীন, আঁধারে ছাওয়া। সম্ভবত শতকোটি বছরের পুরনো। কিন্তু কয়েকটা প্রায় পুরোপুরি সাদা। এগুলো নতুন। কোনো কোনোটা গড়ে উঠছে ঠিক এ মুহূর্তে। মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার ঘন কঠিন স্তরও আছে কোথাও কোথাও।

জিয়াং নেমেছে তেমনি এক সাদা আঁকাবাঁকা দাগের ডান পাশে-পনেরোশ কিলোমিটার লম্বা সেই খালটা। নাম গ্র্যাণ্ড ক্যানেল। ধরা যায় চৈনিকরা তাদের প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাংকে এখান থেকেই পানি তোলার আশা করে। বৃহস্পতির উপগ্রহ জগৎ খুঁটে দেখতে পাবে তাহলে। শেষে পৃথিবীতেও ফিরে যেতে পারে। বিদঘুঁটে এলাকাটায় সহজে ল্যান্ড করা সম্ভব না। কিন্তু বিধি বাম, তাদের শিপ ল্যান্ড করার মতো করেই বানানো। নিশ্চই যত্নের সাথে ল্যান্ডিং সাইট দেখে নিয়েছে আগেভাগে। কী করতে চলল তাও নিশ্চই তাদের জানা।

কেন তারা ফুয়েল শেষ করার এমন ঝুঁকি নিল তা এখন পরিষ্কার। কেন তারা ইউরোপার দখল দাবী করছে অনেক আগে থেকে তাও বোঝা যায়। এ স্থান বৃহস্পতিতে আসার জন্য যত জরুরি, তারচে বেশি জরুরি সৌর জগতের বাইরে মিশন পরিচালনার জন্য। পৃথিবী থেকে এ পর্যন্ত এলেই সৌর জগতের অনেকটা পেরুনো হয়, এখান থেকে আবার প্রোপ্যাল্যান্ট নিলেই হল, ঘাঁটি গেড়ে বসতেও দোষ নেই। গ্যানিমিডে পানি থাকলেও ওটা পুরোপুরি জ্যাম হয়ে আছে আর সবসময় ঢোকাও যায় না। উপগ্রহের অভিকর্ষ শক্তিও এক সমস্যা।

আরো একটা পয়েন্ট এইমাত্র আমার মনে পড়ল। চৈনিকরা ইউরোপার উপর ভিড়তে পারলেও তাদের জীবন বাঁচানোর মতো সামর্থ্য থাকতে হবে, অন্তত যে পর্যন্ত উদ্ধার অভিযানের ব্যবস্থা না করা যায়। তাদের প্রচুর শক্তি আছে, স্যাটেলাইট এলাকায় প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ থাকতে পারে-এবং আমরা জানি চীনারা কৃত্রিম খাদ্য বানানোয় পারদর্শী। হয়ত খুব বিলাসবহুল জীবন কাটানো হবে না, কিন্তু আমার কিছু কাজপাগলা বন্ধু আছে যারা এ জীবন খুশি মনে গ্রহণ করবে। তারা যে শুধু দেশপ্রেম বা বিজ্ঞানপ্রেম বা ক্যারিয়ারের স্বার্থ অথবা অ্যাডভেঞ্চারের আশায় এই কষ্টকর জীবন মেনে নেবে তা নয়। বরং তারা তাদের পছন্দের কাজই করবে; এ এক নেশা, ভয়ংকর নেশা। বৃহস্পতির বিখ্যাত রহস্য-কুয়াশা ভেদ করতে এলোমেলোভাবে আকাশে ছড়িয়ে পড়ার জন্যে তারা বোধহয় তৈরি। কিছুদিনের মধ্যে আমরা স্বয়ং সে দৃশ্য দেখব বলে আশা করছি।

অ্যালেক্সি লিওনভ থেকে হেউড ফ্লয়েড বিদায় জানাচ্ছি আমার বন্ধুদের।

এবং ব্রিজ থেকে বলছি। দারুণ! সুন্দর উপস্থাপনা, হেউড। তোমার সাংবাদিক হওয়া উচিত ছিল।

আমার অভ্যাস আছেরে ভাই। জীবনের অর্ধেকটাই কেটে গেল পি আর ওয়ার্কে।

পি আর?

পাবলিক রিলেশন-সারা বছর রাজনীতিক আর মিডিয়ার লোকরা প্রশ্ন করত কেন আমাকে প্রজেক্টে বেশি টাকা দেয়া হয়। কেন মহাকাশ সংস্থা বসে বসে খায়, কেন লোক ছাঁটাই করে না…বাপরে! এ নিয়ে তোমার চিন্তায় পড়ার কিছু নেই।

আশা করি সত্যি। যাহোক, ব্রিজে এসো। নতুন কিছু ডাটা আসায় তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাচ্ছি আমরা।

ফ্লয়েড মাইক্রোফোনের বোতাম সরালো, জায়গামতো টেলিস্কোপ তালা মেরে দেখার ছোট্ট ধাতব জিনিসটার নাগপাশ থেকে মুক্ত করল নিজেকে। জায়গা ছাড়ার সাথে সাথে একই কাজে বেরুনো নিকোলাই টার্নোভস্কির সাথে প্রায় ধাক্কা খেল।

নিকোলাই সপ্রতিভভাবে বলে ওঠে, তোমার দারুণ বর্ণনাটা রেডিও মস্কোর জন্য চুরি করছিলাম, উডি। আশা করি কিছু মনে করবে না।

ইউ আর ওয়েলকাম, টোভারিশ, যাহোক, আমি কি তোমার চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে পারতাম? কীভাবে?

ব্রিজের উপর ক্যাপ্টেন অর্লোভা শব্দের ঘন তূপের দিকে একবার তাকাচ্ছে, আরেকবার মেইন ডিসপ্লের উপর ফিগারের দিকে। বেচারির মুখটা শুকনো। ফ্লয়েড ব্যাপারগুলোর অর্থ বের করা শুরু করছে। কাজটা বিরক্তিকর। সে তাকে বাধা দিল, বিস্তারিত বর্ণনার জন্যে চিন্তা করো না। জিয়াংয়ে ট্যাংক রিফিল করা এবং উঠে আসার প্রস্তুতি নেবার জন্যে কতটা সময় দরকার শব্দগুলো সেটাই দেখায়।

আমার লোকজন একই ক্যালকুলেশন করার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু এখানে দেখি উল্টোপাল্টা অনেক কিছু ভর্তি। পাল্টানো দরকার। মনে হয় এসব ভুলের একটাকে দূর করলাম একটু আগে। তুমি কি জানো যে সবচে ভাল পানি পাম্প কিনতে পারবে শুধু ফায়ার ব্রিগেডের জন্য? শুনে অবাক হবে নাকি, বেইজিং কেন্দ্রীয় স্টেশনে লেটেস্ট মডেলের তেমন চারটা পাম্প ছিল? হঠাৎ করে ওগুলোকে বাজেয়াপ্ত করেছে সরকার। ফায়ার ডিপার্টমেন্ট মেয়রের অধীন নয়, তাও এ কাজে স্বয়ং বেইজিং সিটির মেয়র বাধা দেয়। সরকারের ছিনিয়ে নেয়া ঠেকানো যায়নি।

অবাক হইনি-শুধু মন আরো খারাপ হল; সন্তুষ্ট হতে পারছি না। চালিয়ে যাও প্লিজ। বলল ফ্লয়েড।

হতে পারে কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু ঐ পাম্পগুলোই স্পেসশিপ…বিশেষ করে জিয়াং স্পেসশিপের পানি সংগ্রহের জন্য হবে ঠিক আকারের। পাইপ ছড়ানোর ঠিক ধারণা নেয়া, বরফের মধ্য দিয়ে ছিদ্র করা এবং এমন আরো কিছু কাজ ঠিক আছে, মনে হয় তারা পাঁচ দিনের মধ্যে আবার শিপকে আকাশে তুলতে পারবে।

পাঁচ দিন!

যদি তাদের ভাগ্য ভাল হয় আর সব কিছু ঠিকমতো কাজ করে; যদি তাদের প্রপ্যাল্যান্ট ট্যাংকগুলো ভরতে দেরি না করে। যদি আমাদের আগে ডিসকভারির সাথে নিরাপদ কন্টাক্ট প্লেসে পৌঁছার জন্যে যেটুকু প্রয়োজন স্রেফ সেটুকু ভরে নেয়। এমনকি যদি মাত্র একটা ঘণ্টার জন্য আমাদের টোকা দেয়, ফেলে দেয় পেছনে…তাই যথেষ্ট। ওরা তারপর ডিসকভারিকে আমাদের হাতে ছেড়ে দেবে। আমরা গিয়ে দেখব স্পেসশিপ ভো ভো। ওরা দাবী করবে যে বেশিকিছু উদ্ধার করতে পারেনি। ব্যস!

কিন্তু ফ্লয়েড আশা ছাড়ার মানুষ নয়, স্টেট ডিপার্টমেন্টের আইনজ্ঞদের মতো কিন্তু ভিন্ন। ঠিক মুহূর্তে, তারা যাওয়ার আগেই আমরা ঘোষণা দেব যে ডিসকভারি পরিত্যক্ত নয়, শুধু পার্ক করা। পার্ক করা থাকবে যে পর্যন্ত আমরা উদ্ধার করতে না পারি। জাহাজটা দখলের যে কোনো চেষ্টা হবে স্রেফ জলদস্যুতা।

আমি শিওর এত পথ পেরিয়ে এসে এত নরম নরম কথা শুনেই চীনারা যাবে পিছিয়ে! হাহ্! অত্যন্ত ইমপ্রেসড হবে।

না হলে আর কী করতে পারি?

আমরা কিন্তু সংখ্যায় তাদেরচে অনেক বেশি। ওদের প্রত্যেকের জন্য দুজন করে। শুধু চন্দ্র আর কার্নোর জ্ঞান ফিরিয়ে আনব। তানিয়ার কথা ভাবলেশহীন।

তুমি কি সিরিয়াস? জাহাজে জলদস্যুদের সাথে লড়াই করার তলোয়ার কোথায়?

তলোয়ার?

সোর্ড-অস্ত্র?

তানিয়া নিজের অস্ত্রের বর্ণনা দিল, ওহ। আমরা লেসার টেলিস্পেকট্রোমিটার ব্যবহার করতে পারি। ওটা এক মিলিগ্রাম গ্রহাণুকেও বাস্প করে দেবে। রেঞ্জ এক হাজার কিলোমিটার। যথেষ্ট সূক্ষ্ম, কী বল?

ঠিক জানি না এসব গালগল্প আমার ভাল্লাগে কিনা। আমাদের সরকার অবশ্যই সহিংসতা পছন্দ করবে না। আত্মরক্ষার ব্যাপার হলে আলাদা।

তুমি সাদাসিধে আমেরিকান! আমরাও বাস্তবধর্মী; আমাদের সহিংস হতেই হবে। তোমার দাদা-দাদী, নানা-নানী বুড়ো বয়সে মারা গেছেন, হেউড। আমার এ পূর্ব পুরুষদের তিন জনকে মহান দেশপ্রেম যুদ্ধে খুন করা হয়েছিল। তুমি বুঝবে না নিজের অধিকার রক্ষার জন্য কেন যুদ্ধ করতে হয়। আচ্ছা, তোমরা খুব অ-সহিংস, না? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তোমাদের সরকার আত্মরক্ষার জন্য জাপানে দুবার এটম বোমা ফেলেছিল, মাই ডিয়ার?

একা থাকলে তানিয়া তাকে সব সময় উডি বলে ডাকে। কখনো হেউড নয়। তার মানে সে অবশ্যই সিরিয়াস। অথবা শুধু ফ্লয়েডের প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করছিল নাকি? কে জানে?

যাহোক, ডিসকভারি কয়েক বিলিয়ন ডলার দামের হার্ডওয়ার মাত্র। জাহাজটা নয়-শুধু এর ডাটাগুলো দামি।

ঠিক বলেছ, তথ্য। ডাটাগুলো কপি করে মুছে ফেলা যাবে।

তানিয়া, তুমি সব সময়ই মনোরম সব ধারণা পাও। মাঝে মধ্যে আমি ভাবি সব রাশিয়ানের মাথায় সামান্য ছিট থাকেই।

নেপোলিয়ন আর হিটলারকে ধন্যবাদ তাদের ভুল দেখে আমরা সবদিকে সঠিকতা অর্জন করেছি। কিন্তু আমাকে বলো না যে এর আগে তোমার নিজের জন্যে-তাকে তোমরা কি বলো, সিম্পরিও এর সমাধান বের করোনি তুমি।

ফ্লয়েড বরং বিষণ্ণভাবে উত্তর দিল, দরকার পড়ে না। নিজের জন্য কোনো সিম্পরিও আমি করিনি। স্টেট ডিপার্টমেন্ট আগেই আমার জন্য করে রেখেছে রূপভেদ সহ। আমাদের স্রেফ দেখতে হবে চাইনিজরা কীসের নাগাল পায়। আমি মোটেই বিস্মিত হবে না যদি তারা আমাদের অনুমানের বাইরে আবারো কিছু করে বসে।

১০. ইউরোপার আর্তচিৎকার

খুব কসরতের ব্যাপার শূন্য অভিকর্ষে ঘুমানো। এটাও শিখতে হয়। হাত এবং পা নোঙ্গর করে রাখার সবচে ভালো পদ্ধতি খুঁজে বের করার জন্য ফ্লয়েড প্রায় এক সপ্তাহ ট্রেনিং নিয়েছে যাতে হাত পা অস্বস্তিকরভাবে না ভাসে। এখন সে এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ। আর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। অবশ্য ঠিক ঐভাবে শুয়ে থাকার ব্যাপারটা তাকে মাঝেমধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখায়। ফ্লয়েড কোনোকালেও মাধ্যাকর্ষণহীনতায় শুতে পছন্দ করত বলে মনে হয় না।

কেউ একজন তাকে জাগানোর জন্য ঝাঁকুনি দিচ্ছে। না-সে অবশ্যই এখন স্বপ্নে! মহাশূন্য শিপে কখনোই গোপনীয়তা ভাঙা যায় না। কেউ অনুমতি ছাড়া কখনো অন্য কুর ঘরে ঢোকে না। সে চোখ শক্তভাবে বন্ধ করার পরও ঝাঁকুনি চলছিল।

দক্তর ফ্লয়েদ, দক্তর ফ্লয়েদ-ঘুম থেকে ওঠো, প্লিজ! ফ্লাইট ডেকে তোমার ডাক পড়েছে?

এবং কেউই তাকে ডক্টর ফ্লয়েড বলে ডাকে না, সবচে বেশি আনুষ্ঠানিক অভিবাদন সে গ্রহণ করেছিল ডক্টর চন্দ্রের কাছ থেকে। হচ্ছেটা কী?

বিরক্তি নিয়ে সে চোখ খুলল। নাহ, সে তো ছোট কেবিনেই আছে। স্লিপিং কোকুন আঁকড়ে রেখেছে মৃদুভাবে। সুতরাং… মনের একটা অংশ তাকে বলে: কেন সে ইউরোপার দিকে… তাকাচ্ছে? চোখ খুলে জেগে ফ্লয়েড কীভাবে সরাসরি উপগ্রহটার দিকে তাকিয়ে আছে? তারা তো এখনো মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে!

রেখাগুলো একে অন্যকে ছিঁড়ে ফুড়ে বানিয়েছে অদ্ভুত ধূসর পরিবেশ। ত্রিভুজ আর বহুভূজ দিয়ে বানানো নকশার পরিচিত জালি চারপাশে আর অবশ্যই বড় রেখাটা এ্যাও ক্যানেল। না… ঠিক না। তা কীভাবে হতে পারে? সে তো শুয়ে আছে লিওনভের ছোট্ট কেবিনে।

দক্টর ফ্লয়েদ!

এবার সে পুরোপুরি জেগে গেল, এবং বুঝতে পারল যে বাম হাত ভাসছে চোখের ঠিক কয়েক সেন্টিমিটার সামনে। কী অদ্ভুত! রেখাগুলোর নকশা হাতের তালুতে এমন রহস্যময় লেগেছে যেন তা ইউরোপার মানচিত্র! কিন্তু হিসেবী প্রকৃতি এমন বিচিত্র পথে বিশালভাবে বিভিন্ন স্তরে নিজেকে সব সময় দেখায়। প্রকৃতি! যেমন দুধের ঘূর্ণি কফির সাথে মিশে যায়-তীব্র ঝড়ো আবহাওয়ার মেঘের রাস্তাও একইভাবে মেশে। আবার পেঁচানো নীহারিকার হাতগুলোও মিশে যাচ্ছে সেই কফির মতোই।

ম্যাক্স, স্যরি। সে বলল, সমস্যাটা কী? কিছু হয়েছে?

আমরা তা-ই ভাবছি-কিন্তু আমাদের সমস্যা নেই। জিয়াং পড়েছে বিপদে।

ক্যাপ্টেন, নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলী ফ্লাইট ডেকে তাদের সিটে সিটবেল্টে বাধা। বাকি কুরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চারদিকের সুবিধাজনক হ্যাণ্ডহোল্ড ধরে ঘুরছে, ভাসছে অথবা মনিটর দেখছে।

স্যরি, হেউড। তোমাকে ঘুম থেকে জাগাতে হল। তানিয়ার দুঃখ প্রকাশ কী রূঢ়! পরিস্থিতিই এমন। দশ মিনিট আগে আমরা মিশন কন্ট্রোল থেকে প্রথম শ্রেণীর একটা প্রায়োরিটি পেলাম। জিয়াং বন্ধ করে দিয়েছে সম্প্রচার। একদম হঠাৎ করে সাইফার মেসেজের মাঝখানেই ব্যাপারটা হল; কয়েক সেকেন্ডের জন্যে বিকৃত প্রতিবেদন প্রেরণ-তারপর কিছুই নেই।

তাদের বিকন?

এখন সেটাও বন্ধ। অথচ বিকন সব সময় ব্লিপ ব্লিপ করে পৃথিবীর দিকে শিপের ভাল থাকার খবর জানায়। এটাও রিসিভ করতে পারিনি।

উহ্! তা হলে তো মারাত্মক ব্যাপার-বড় রকমের কোনো বিপদ। কোনো না। কোনো ইশারা পাবার কথা, নাকি?

ডাটা আছে প্রচুর কিন্তু সব অনুমানের উপর ভিত্তি করে। বিস্ফোরণ-ভূমিধ্বস ভূমিকম্প…কে জানে?

এবং আমরা কখনো জানতে নাও পারি। জানতে হলে কারো না কারো ইউরোপায় নামতে হবে। অন্তত উড়ে যেতে হবে খুব কাছ থেকে।

তানিয়া তার মাথা ঝাঁকুনি দিল, আমাদের যথেষ্ট ডেল্টা-ভি নেই। সবচে বেশি নৈকট্য পেতে পারি পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে। ঐ দূরত্ব থেকে তুমি খুব ভাল দেখতে পাবে না।

তারপর আমাদের করার কিছুই থাকবে না। একেবারেই নয়, হেউড। মিশন কন্ট্রোলের একটা পরামর্শ দেখতে পার। তারা চায়, আমাদের বিগ ডিশ যেন চারদিকে ঘোরাই। স্রেফ ঘটনাক্রমে যেকোনো দুর্বল প্রয়োজনীয় ট্রান্সমিশন পেয়ে যেতে পারি। তোমার মতে আইডিয়াটা কেমন? বহু দূর থেকে নেয়া শট, কিন্তু বাঘের কাছে যাওয়া যায় না। এই সঠিক প্রচেষ্টা। কী মনে হয়?

ফ্লয়েডের প্রথম প্রতিক্রিয়া পুরোপুরি না বোধক, তার মানে পৃথিবীর সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ।

অবশ্যই, কিন্তু যখন বৃহস্পতির আশপাশে যাবো আমাদের তা তো করতেই হবে। সার্কিট ঠিক করতে কয়েক মিনিট সময় নেবে মাত্র।

ফ্লয়েড কথা বলল না। সাজেশনটা আসলেই যুক্তিসঙ্গত, তবু একটু ভয় পাইয়ে দেয়। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হবার পর হঠাৎ করে বুঝতে পারে কেন সে অ্যান্টেনা ঘোরানোর সিদ্ধান্তের বিরদ্ধে যাচ্ছে বারবার।

ডিসকভারির গোলমাল আরম্ভ হয় যখন বিগ ডিশ… সেই প্রধান অ্যান্টেনা কমপ্লেক্স পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, এখনও সেসবের কোনো ব্যখ্যা নেই। অবশ্যই জড়িত ছিল হাল। তবু এখানে দেখা দেয়া একই পরিস্থিতিতে কোনো বিপদ নেই। লিওনভের কম্পিউটারগুলো ছোট ছোট এবং অটোনোমাস ইউনিট; আলাদা আর স্বাধীন। একক নিয়ন্ত্রণ মেধা বা বুদ্ধিমত্তা নেই। অন্তত, অমানবীয় কিছু নেই।

রাশিয়ানরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে তার উত্তরের জন্যে।

আমি রাজি, অবশেষে সে বলল, আগে পৃথিবীকে জানতে দাও আমরা কী করি; তারপর শুনতে আরম্ভ কর। আশা করি তোমরা সব স্পেস মে ডে ফ্রিকোয়েন্সির চেষ্টা করবে।

হ্যাঁ, ডপলার সংশোধনের কাজ শেষ করার সাথে সাথে। শাসা, কেমন হবে ব্যাপারটা?

আমাকে আরো দুমিনিট সময় দাও, অটোমেটিক অনুসন্ধান চালাতে পারবো। আমাদের শুনতে হবে কতক্ষণ?

ক্যাপ্টেন তার উত্তর দিতে গিয়ে নামমাত্র থামল। ফ্লয়েড প্রায়ই তানিয়া অর্লোভার সুস্পষ্টতার প্রশংসা করে। আরেকবার তাই বলল তাকে। মেয়েটা সহজে রসিকতা করে না। হঠাৎ চমকে দিয়ে সে বলল, উডি, একজন কমান্ডার ভুল করতে পারে কিন্তু কখনো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে না। শোনো পঞ্চাশ মিনিট, পৃথিবীতে প্রতিবেদন দাও দশ মিনিট। চালিয়ে যাও এভাবেই।

দেখা-শোনার কিছুই নেই। মানুষের নার্ভাস সিস্টেম অসম্ভব গতিময়, তীক্ষ্ণ আর সূক্ষ্ম। মানুষের ইন্দ্রিয়ের চেয়েও ভাল কাজ করে অটোম্যাটিক সার্কিট। বেতার শব্দ ট্রান্সমিশনে এটা একেবারে এক্সপার্ট। তবু সময়ে সময়ে শাসা অডিও মনিটরে গিয়ে বসে থাকে। প্রতিবারই কেবিনকে ভরে তোলে বৃহস্পতির তেজস্ক্রিয় এলাকার গর্জন। পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্র সৈকতের ঢেউ ভাঙ্গার শব্দের মতো। মাঝেমধ্যে বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে বিজলি চমকের সাথে অসীম বজ্রপাত হয়। বিস্ফোরকের হঠাৎ তীক্ষ্ণ কোনো শব্দ নেই। একের পর এক সংকেত দূরে গিয়ে ভাসে; জবাব নেই। অপেক্ষা করার সময় ফ্লয়েড মনে মনে কিছু হিসাব করছে। জিয়াংয়ে যাই ঘটে থাক; পৃথিবীতে এর খবর পাঠানো শেষ হয়েছে দুঘণ্টারও আগে।

কিন্তু এক মিনিটও দেরি না করে লিওনভের সরাসরি সংবাদ সংগ্রহের সামর্থ থাকা উচিত। সুতরাং চীনাদের সম্প্রচারে ফিরে আসার মতো যথেষ্ট সময় হাতে আছে এখনো। লিওনভের অবিরাম প্রচারের পরও নীরবতার ফলে কোনো না কোনো বিপর্যয়ের সম্ভাবনা উঠে আসে। এমনকি সে নিজেকে ঐ অসীম দৃশ্য গঠন করতে দেখতে পেল।

এ পঞ্চাশ মিনিটকে মনে হয় কয়েক ঘণ্টার মতো। উপরে থাকার সময় শাসা অ্যান্টেনা কমপ্লেক্সকে পেছনে পৃথিবীর দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সে একই সাথে দিল ব্যর্থতার খবর। দশ মিনিটের বাকি সময় ব্যবহার করে পৃথিবীতে পেছনের দীর্ঘ খবর পাঠানোর সময় প্রশ্নের দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকায়, আবার চেষ্টা করা কি ঠিক হচ্ছে?

অবশ্যই। আমরা পৃথিবীতে খোঁজ খবরের সময় কমাতে পারি কিন্তু জিয়াংকে শোনার সময় ঠিক রাখব।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বড় ডিশ আরো একবার ইউরোপার দিকে তাক করার সাথে সাথে অটোমেটিক মনিটরের ইমার্জেন্সি লাইট শুরু করে ফ্লাশ।

শাসার হাত দ্রুতবেগে কাজ করছে অডিও পাওয়ার আশায়। বৃহস্পতির শব্দ কেবিনকে ভরে দেয় আবারো। বজ্রঝড়ের বিরুদ্ধে ফিসফিস করে বলা শব্দের মতো শোনা গেল একটা কিছু। অস্পষ্ট, কিন্তু পুরোপুরি মানুষের কথা। ভাষা চেনাটা অসম্ভব হলেও ফ্লয়েড স্বরভেদ এবং ছন্দ শুনে বুঝেছে চাইনিজ নয়। ইউরোপিয়ান কোনো ভাষা হতে পারে।

শাসা ফাইন-টিউনিং এবং ব্যান্ড-উইডথ কন্ট্রোলের সাথে দক্ষভাবে খেলার পর তাতে শব্দগুলো একটু পরিষ্কার হয়। আচ্ছা! নিঃসন্দেহে ইংরেজি কিন্তু এখনো কথাগুলো বোঝাই যায় না। বিরক্তিকর।

শব্দগুলোর একটা সংযুক্তি আছে, সব মানুষের কান সাথে সাথে চিনতে পারবে। এমনকি সবচে গোলমেলে পরিবেশেও।

শব্দটা হঠাৎ করে বৃহস্পতির পটভূমি থেকে উঠে এলে ফ্লয়েডের মনে হল যেন চোখ খুলেও সে ঘুম থেকে জাগেনি। আটকা পড়েছে কিছু অদ্ভুত স্বপ্নের ফাঁদে। তার সহকর্মীরা সাড়া দিতে একটু দেরি করে ফেলে; তারপর তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকায় একইভাবে, বড় বড় চোখ করে। তারপর ধীরে ধীরে যেন কথাগুলো সাজিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে নিজের ভিতর।

ইউরোপা থেকে প্রথমবারের মতো স্বীকারযোগ্য শব্দগুলো কাঁপিয়ে দেয় সবাইকে, ডক্টর ফ্লয়েড-আশা করি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা। কারণ এরচে বেশি কিছু আর আশা করার নেই।

১১. শূন্যতায় জমাট জল

হুশ শব্দে কেউ একজন ফিসফিস করে প্রশ্ন ছোঁড়ে ফ্লয়েডের দিকে- কে? ফ্লয়েড হাত তুলে না জানার ইশারা করে-মনেপ্রাণে চায় যেন তার পরিচিত না হয় নোকটা। হলেই তা আরো কষ্ট বয়ে আনবে।

.. জানি আপনি লিওনভে… বেশি সময় নেই হয়তো… আমার স্যুট অ্যান্টেনা দেখে মনে হয়…

একটা বিরক্তিকর সেকেন্ডের জন্য সংকেত হাওয়া হয়ে গেল, তারপর ফিরে এল অনেক পরিষ্কারভাবে। খুব উঁচু শব্দ নয়।

…প্লিজ এ তথ্য পৃথিবীতে রিলে করবেন। জিয়াং তিন ঘন্টা আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। একমাত্র আমিই জীবিত। আমার স্যুট রেডিও ব্যবহার করছি-জানি না এটার যথেষ্ট রেঞ্জ আছে কি না কিন্তু এটাই একমাত্র সুযোগ। প্লিজ, মনোযোগ দিয়ে শুনুন। ইউরোপায় জীবন আছে। আমি আবার বলি, ইউরোপার জীবনের অস্তিত্ব আছে…

সংকেতটা আবার বিলীন হয়ে যায় ধীরে ধীরে। এক অচেনা নীরবতা অনুসরণ করে বোঝা গেল কেউ বাধা দেয়ার চেষ্টা করেনি। অপেক্ষা করার সময় ফ্লয়েড পাগলের মতো হাতড়ে বেড়ায় তার স্মৃতির লুকানো কুঠুরিগুলো। চিনতে পারে

-পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত চীনের যে কোনো লোক হতে পারে। হয়ত সায়েন্টিফিক কনফারেন্সে তার দেখা পেয়েছে এমন কেউ। যে পর্যন্ত বক্তা নিজের পরিচয় নিজে না দেবে, সে কখনো চিনবে না।

…স্থানীয় মধ্যরাতের ঠিক পরে। আমরা নিয়মিত পাম্পিং করছিলাম। প্রায় অর্ধেক ভরে গেছে ট্যাংকগুলো। ডক্টর লি আর আমি পাইপ ইনসুলেশন চেক করার জন্যে বাইরে গিয়েছিলাম। জিয়াং দাঁড়িয়ে আছে-দাঁড়িয়ে ছিল-গ্র্যান্ড ক্যানেলের সীমানার প্রায় ত্রিশ মিটার দূরে। পাইপগুলো সরাসরি এখান থেকে নেমে নিচের বরফের মধ্যে ঢোকে। বরফ আবার খুব পাতলা-হাঁটার মতো নিরাপদ নয়। পাইপের পানি অবশ্য গরম…

…কোনো ব্যাপার না-পাঁচ কিলোওয়াট আলো জ্বালিয়ে জাহাজের উপর টানালাম। ক্রিস্টমাস ট্রির মতো সুন্দর চককে আলো ঠিক বরফের মধ্যদিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল নিচের পানিতে। চমৎকার রঙ। লি-ই প্রথম দেখে-এক বিশাল কালো পিণ্ড গভীর থেকে উঠছে উপরের দিকে। প্রথম প্রথম আমরা মনে করেছিলাম মাছের বিরাট কোনো ঝাক হবে-একক প্রাণিসত্তার হিসেবে খুব বড় তো-তারপর জিনিসটা এগিয়ে এল বরফের ভিতরে দিয়ে জোর করে পথ বানিয়ে নিয়ে।

ডক্টর ফ্লয়েড, আশা করি আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন। আমি প্রফেসর চ্যাং-আমরা মিট করেছিলাম দু হাজার দু সালে, বোস্টন আই. এ. ইউ. কনফারেন্সে।

সাথে সাথে ফ্লয়েডের ভাবনা চলে গেল শত কোটি কিলোমিটার দূরে। সে ভাসাভাসা মনে করতে পারে ঐ রিসিপশনের কথা। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কংগ্রেস এর সমাপনী সেশনের পর-সবার শেষ ব্যক্তি ঐ চীনদেশি। দ্বিতীয় কালচারাল রেভুলশনেও ছিল। আস্তে আস্তে সে চ্যাংকে খুব ভালভাবে মনে করতে পারল-একজন ছোটখাট বায়োলজিস্ট যার কৌতুকের ভাণ্ডার খুব সমৃদ্ধ। সে এখন আর কৌতুক করছে না।

…ভেজা সমুদ্রশৈবালের চুলের মতো হামাগুড়ি দিচ্ছিল বরফের উপর। লি ক্যামেরা আনার জন্যে জাহাজের পেছনে যায়-আমি লক্ষ্য করছি, একই সাথে রিপোর্ট করছি রেডিওতে। জিনিসটা এত আস্তে আস্তে চলছিল যে আমি দৌড়ে একে ছাড়িয়ে যেতে পারতাম সহজে। সতর্ক হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত ছিলাম। ভাবলাম এটা কী ধরনের প্রাণী আমি জানি। ক্যালিফোর্নিয়ার কাছাকাছি বড়

সামুদ্রিক গুল্ম বনের ছবি আমার দেখা কিন্তু আমার খুব বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল।

… প্রাণীটার কোনো না কোনো সমস্যা ছিল, আমি শিওর। এর সাধারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থার চেয়ে একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী কম তাপমাত্রায় বেঁচে থাকা অসম্ভব। সামনে আসার সময় জমে কঠিন হয়ে গিয়েছিল-ছোট ছোট টুকরো আলাদা হয়ে যাচ্ছিল কাঁচের মতো কিন্তু তখনো জাহাজের দিকে এগুচ্ছেই। কালো সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সব সময়ই মন্থর মনে হয়।

আমি তখনো এত বিস্মিত যে সোজাসুজি চিন্তা করতে পারিনি। কল্পনাই করতে পারিনি এটা কী করার চেষ্টা করছে…।

ফ্লয়েড মরিয়া হয়ে ফিসফিস করে ওঠে, তার ডাকে সাড়া দেয়ার কোনো পথই কি নেই?

না-দেরি হয়ে গেছে অনেক। ইউরোপা একটু পরেই বৃহস্পতির পেছনে চলে যাবে। গ্রহণের বাইরে আসা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। লিওনভ কন্ট্রোল জবাব দেয়।

এদিকে বলে চলেছে প্রফেসর চ্যাং, … জাহাজের উপর উঠে এগিয়ে যাবার সাথে সাথে তৈরি করে বরফের এক সুড়ঙ্গ। সম্ভবত জিয়াংয়ের উষ্ণতা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চায়-মাটির ছোট্ট করিডোরে উইপোকা যেমন আটকা পড়ে যায়, তেমন করে শিপও এর ঘোরটোপে পড়ে গেল।

…জাহাজের উপর টনকে টন বরফ জমেছে। রেডিও অ্যান্টেনা বন্ধ হয়ে গেছে প্রথমবারের মতো। তারপর দেখতে পেলাম নামতে থাকা পাগুলো সব কুঁচকে যেতে শুরু করে; দুঃস্বপ্নের মতো ধীর গতিতে।

শিপ নড়বড় হয়ে পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি জিনিসটা কী করার চেষ্টা করছে-তখন আর সময় নেই। ঐ লাইটগুলো বন্ধ করে দিলেই নিজেদের আমরা রক্ষা করতে পারতাম।

সম্ভবত প্রাণীটা আলোতে সক্রিয় হয়, এবং বায়োলজিক্যাল আবর্তনে সূর্যের আলো পড়লে হয়ত এ অদ্ভুত জিনিসটা হিংস্র হয়ে পড়ে। সেই আলো বরফের মধ্য দিয়ে বিশোধিত হয়ে প্রবেশ করে ভিতরের জগতে। আলোর প্রতি পতঙ্গের মতো আকৃষ্ট হতে পারে এটা। আমাদের ফ্লাডলাইট অবশ্যই ইউরোপা এ পর্যন্ত যা দেখেছে তার চেয়ে অনেক অনেক উজ্জ্বল…

তারপর ভেঙে গেল শিপ। আমি নিজের চোখে জাহাজের কাঠামো লম্বালম্বিভাবে টুকরা হতে দেখলাম। তুষার ফলকের এক মেঘ ঘন ঘন আর্দ্র করে তোলে চারপাশকে। দুমিটার উপরে ক্যাবলে ঝুলছিল একটা বাতি। বাকি সবগুলো নিভে গেল সামনে পেছনে দুলতে দুলতে।

জানি না কী হল এর পর। আমার আর কী করণীয়? জাহাজের ধ্বংসস্তূপের পাশে লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। সূক্ষ্ম ফ্রেশ বরফের পাউডারে আমি আবদ্ধ। এর মধ্যে আমার জুতার ছাপ খুব স্পষ্ট দেখতে পেলাম। অবশ্যই সেখানে হেঁটেছি সম্ভবত মাত্র এক বা দুমিনিট পর। হিতাহিত জ্ঞান ছিল

চারাগাছটা-আমি এখনো এটাকে ঝাকড়া চারাগাছ হিসেবে ভাবি! জিনিসটা ছিল স্থির। অবাক চোখে দেখি এটা ধ্বংস হচ্ছে আঘাতে আঘাতে, বড় বড় কাটা অংশ মানুষের হাতের মতো ঘন টুকরো টুকরো হয়ে শাখা প্রশাখার মতো ছিটকে পড়ল।

তারপর আবার চলতে শুরু করে প্রধান কাণ্ডটা। স্পেসশিপের কাঠামো থেকে নিজেকে টেনে বের করে আমার দিকে হামাগুড়ি দিতে শুরু করলে আমি নিশ্চিতভাবে জানলাম যে সেটা আলোতে প্রতিক্রিয়াশীল। দাঁড়িয়ে ছিলাম হাজার ওয়াট বাতির ঠিক নিচে। জিনিসটা এখন বন্ধ করেছে নিজেকে দোলানো।

একটা ওক গাছের সাথে এর মিল এখনো দেখতে পাই যেন, কোনো বটগাছ বহুশাখা এবং মূল নিয়ে মাধ্যাকর্ষণে চিড়েচ্যাপ্টা হলে যেমন দেখায় তেমন। বরফ। ঘেঁষে চুপিসারে চলতে চেষ্টা করছিল জিনিসটা। আলোর পাঁচ মিটারের মধ্যে পৌঁছে আমার চারদিকে এক নিখুঁত বৃত্ত তৈরি করে নিজেকে ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। বোঝাই যায় সে এলাকাই ওটার সহ্যক্ষমতার সীমা-আরো সামনে তার আলোক আকর্ষণ হয়ত অরুচিকর। তারপর কয়েক মিনিটের জন্যে কিছুই হয়নি, আমি বরং ভাবছি মরে জমে কঠিন হয়ে গেল কিনা।

তারপর দেখলাম বিরাট বিরাট মুকুল গঠিত হতে শুরু করেছে অনেক শাখা প্রশাখা সহ। অনেকক্ষণ। ফুল ফুটতে দেখার মতো ধৈর্য নিয়ে বসে থাকতে হল আমাকে। আসলে ভাবছিলাম আকৃতির কথা। এক একটা ফুল মানুষের মাথার মতো বড়! কোমল, সুন্দরভাবে রঙিন ঝিল্লি ভাজ ভাঙ্গতে শুরু করে। এমনকি তখনও মনে হল যে, কোনো মানুষ বা প্রাণী এর আগে এমন রঙ কক্ষনো দেখেনি। এত রঙের অস্তিত্বই থাকত না যদি আমাদের লাইট-আমাদের প্রাণনাশক লাইট এ দুনিয়ায় বয়ে না আনতাম।

চারদিকে আস্তে আস্তে দুলছে পুংকেশর… জীবন্ত দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটলাম যাতে ব্যাপারটা ঠিকমতো দেখতে পারি। আমি ঐ প্রাণীকে সামান্যতম ভয় পাইনি কখনোই। শিওর ছিলাম, এটা পরশ্রীকাতর না-যদি তাই হয়ে থাকে তবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করত। ও আমার অস্তিত্ব টের পায় ভালভাবেই।

বড় ফুলগুলোর স্তরে স্তরে ভাজ ভাঙার খাজ। এবার এরা মনে করিয়ে দেয় প্রজাপতির কথা, যা এইমাত্র পুঁয়োপোকার আবরণ থেকে বেরুল-ডানায় ভাঁজ-ভাঁজ চিহ্ন, এখনো ক্ষীণ-আমি ক্রমেই সত্যের কাছাকাছি যাচ্ছিলাম।

মুকুলগুলোর মধ্যে কিছু কিছু যত তাড়াতাড়ি গঠিত হয় জমেও যায় তত তাড়াতাড়ি-যায় মরে। তারপর মূল মুকুল থেকে একের পর এক ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে এগুলো শুকনো ভূমিতে মাছের আঁশের মতো ভেঙ্গে পড়ল এলোপাথাড়ি। চারদিকে। অবশেষে বুঝতে পারলাম এগুলো কী। ঐ ঝিল্লিগুলো পাপড়ি না-জলজপ্রাণীর ডানা বা তার সমমানের একটা কিছু। মুক্তভাবে সাঁতার কাটার জন্যে ঐ প্রাণীর একটা স্তর। অনেকটা ডানার মতো। হয়ত জীবনের বেশিরভাগ কাটিয়ে দেয় সমুদ্রগর্ভে শিকড় গেড়ে, তারপর এ চলমান বাচ্চাদের নতুন এলাকা খুঁজে বের করার জন্য পাঠায়। ঠিক যেমনটা করে পৃথিবীর মহাসাগরের প্রবাল।

ছোট্ট প্রাণীর একটাকে কাছে থেকে দেখার জন্যে আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। সুন্দর রঙ ম্লান হচ্ছিল তখন। বৈচিত্র্যহীন বাদামি রঙ বেরিয়ে পড়ে। পাপড়ি-ডানার কিছুটা হঠাৎ করে জমে যাওয়ায় ভেঙে পড়ে ভঙ্গুর মাটির পাত্রের মতো। প্রাণীটা তখনো ক্ষীণভাবে নড়ছিল, এমনকি আমি সামনে গেলে আমাকে এড়িয়েও গেল। আমিতো অবাক! এটা কীভাবে আমার উপস্থিতি বোঝে?

তারপর দেখতে পাই পুংকেশরগুলো… এ নামেইতো ডেকেছিলাম-এদের ডগার উপরে উজ্জ্বল নীল ফোঁটা ধরে রেখেছে। দেখতে ঠিক ছোট উজ্জ্বল নীল রঙা তারার মতো অথবা ঝিনুকের আবরণের সাথে নীল চোখের মতো-সেগুলো আবার আলো থেকে সাবধান, কিন্তু সত্যিকারের মুড নিতে পারেনি। তারপর উজ্জ্বল নীল, ম্লান হয়ে যায়, সাধারণ পাথরের মতো…

ডক্টর ফ্লয়েড অথবা অন্য যে কেউ শুনছেন… আশা করি কেউ না কেউ শুনতে পাবেন আমার কথা, হাতে খুব একটা সময় নেই, বৃহস্পতি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সিগন্যাল ব্লক করবে। আমার কথা অবশ্য প্রায় শেষ।

জানি এরপর আমার কী কাজ। হাজার ওয়াট বাতির তারটা ঝুলছিল মাটির কাছাকাছি। হ্যাঁচকা টান দেয়ার পর লাইটটা নিভে গেল একটু স্পার্ক করে। অনেক দেরি হয়ে গেছে কিনা ভেবে আমি ভয়ও পেয়েছি কিছুটা। কিছুক্ষণ কিছুই হয়নি। সুতরাং মনের ঝাল ঝাড়তে চারদিকের জট পাকানো শাখাপ্রশাখার দেয়ালের উপর হাঁটতে হাঁটতে লাথি লাগালাম কষে।

ধীরে ধীরে প্রাণীটা শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে নেয় গ্র্যান্ড ক্যানেলে ফিরে যাওয়ার জন্য। অনেক আলো থাকার কারণে আমি সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বৃহস্পতির দু উপগ্রহ গ্যানিমিড আর ক্যালিস্টো আকাশে ভাসে আর গ্রহরাজ বৃহস্পতি দেখায় পাতলা এক চাঁদের মতো। আইওর ঘুরতে থাকা শেষপ্রান্ত বৃহস্পতির দিকে ফেরানো। উপগ্রহটার রাতের আকাশে মেরুজ্যোতির ফুলঝুরি ফুটেছিল। কোনো প্রয়োজন ছিল না আমার হেলমেট লাইট ব্যবহার করার। আমি বেশ আগ্রহের সাথে দৌড়াই প্রাণীটার পেছনে। একটু ধীর হয়ে এলেই লাথিও দিই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে; অনুভব করি বুটের নিচে বরফ ভাঙার কড়মড় শব্দ… ক্যানেলের কাছাকাছি যেতেই মনে হল এটা শক্তি পেয়েছে আরো। ঠিকই, সে ফিরছে নিজের বাড়িতে। ভয় পাচ্ছিলাম এবার একটু একটু। আবার মুকুল সৃষ্টির জন্য বেঁচে থাকতে পারে। শত্রু এলাকায় কিছু মৃত লার্ভা রেখে সে চলে গেল পানির উপর দিয়ে। খোলা পানিতে কিছুক্ষণের জন্য বুদবুদ উঠল যে পর্যন্ত বরফের একটা চাদর পানির স্তরটাকে শূন্যতা থেকে সরিয়ে না আনে। দৃষ্টি সরিয়ে ফিরে গেলাম শিপের কাছে। যদি কেউ বেঁচে থাকে… এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমার শুধু দুটো অনুরোধ আপনার কাছে, ডক্টর। যখন ট্যাক্সোনমিস্টরা প্রাণীটাকে শ্রেণীভুক্ত করবে, আশা করি নামটা হবে আমার নামে।

আর… ডক্টর… প্লিজ… পরের শিপ আসার সময় তাদের একটু বলে দেখো-আমাদের কঙ্কাল যাতে চীনে নিয়ে যায়। মাইনাস একশো পঞ্চাশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে আমরা পচে যাব না। আর… আমার বাসায় আছে ছোট্ট… না, থাক। যা বলছিলাম, বৃহস্পতি আমাদের ধ্বংস করে দেবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। আশা করি এবং আমার বিশ্বাস কেউ না কেউ আমার কথাগুলো শুনছে। যাই হোক, যোগাযোগ করার সুযোগ পেলে এ মেসেজ আবার পাঠাব। অবশ্য আমার স্পেস স্যুট যদি তখনো টিকে থাকে।

ইউরোপা থেকে প্রফেসর চ্যাং মহাকাশ যান জিয়াং ধ্বংসের প্রতিবেদন দিচ্ছি। আমরা ল্যান্ড করলাম গ্র্যান্ড ক্যানেলের পাশে। আমাদের পাম্পগুলো বসানো হয় বরফের কিনারায়…

সংকেতটা ধীরে মিলিয়ে গিয়ে আবার মুহূর্তের জন্য ফিরে এসে শ্রাব্যতার সীমার নিচে নেমে চিরতরে হারিয়ে গেল।

আবার যোগাযোগের সুযোগ হয় এক সময়। একই ফ্রিকোয়েন্সিতে লিওন মনোযোগ দেয়-কিন্তু প্রফেসর চ্যাংয়ের কাছ থেকে আর কোনো মেসেজ আসেনি কোনোদিন।

৩. তৃতীয় পর্ব : ডিসকভারি

তৃতীয় পর্ব : ডিসকভারি

১২. বৃহস্পতির সীমান্তে

শিপ অবশেষে যাত্রা শুরু করে বৃহস্পতির দিকে। অনেক আগেই মহাকর্ষের Trনিরপেক্ষ অঞ্চল পেছনে পড়ে গেছে। সেখানে ছোট চারটা চাঁদ-সাইনোপ, প্যাসিফা, অ্যানাংক, ও ক্যারমে টলমল করছিল তাদের নিম্নমুখী বন্য ও অদ্ভুত কক্ষপথে। নিঃসন্দেহে অ্যাস্টরয়েড গ্রহাণুপুঞ্জের গ্রহাণু এগুলো। গ্রহরাজ ক্ষমতা খাঁটিয়ে দখল নিয়েছে কোনো এক কালে। আকৃতি অস্বাভাবিক। সবচে বড়টাও আড়াআড়িভাবে মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার। চারটাই এবড়োথেবড়ো; ধারালো পাথরের টুকরা। আদতে এরা গ্রহ-নৃতত্ত্ববিদদের ছাড়া আর কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে না। তাদের আনুগত্য সূর্য আর বৃহস্পতির মাঝে টলায়মান। একদিন সর্বগ্রাসী সূর্য হয়ত পুরোপুরি দখল করে নেবে এগুলোকে আর সব গ্রহের মতো শুধু নিজের প্ৰজা করে রাখবে।

কিন্তু বৃহস্পতি দ্বিতীয় স্তরের চার উপগ্রহকে ঠিকই নিজের কজায় রাখবে যেগুলো প্রথম চারটার অর্ধেক দূরত্বে দোলায়মান। ইলোরা, লিসিথিয়া, হিমালিয়া ও লিডা সুন্দরভাবেই একে অন্যের কাছাকাছি এবং একই দূরত্বে আবর্তন করছে। মানুষ মনে করে যে, এ চার বোন এক সময় এক ছিল। তাই হয়ে থাকলে মূল দেহটা অন্তত শত কিলোমিটার বিস্তৃত হওয়ার কথা। শুধু ক্যারমে ও লিডা এত কাছে এসেছে যাতে নগ্ন চোখে তাদের একটা চাকতির মতো দেখা সম্ভব। তারা পুরনো বন্ধুর মতো আজো একে অন্যের সাথে মিলে মিশে থাকে।

দীর্ঘতম সাগর অভিযানের পর বৃহস্পতি দ্বীপপুঞ্জের জলসীমায় এই তাদের প্রথম প্রবেশ। শেষের ঘণ্টাগুলো উড়ে পালালো; পুরো অভিযানের জটিলতম স্তর সামনে। বৃহস্পতির অ্যাটমোস্ফিয়ারে প্রবেশ করার মতো জটিল কাজ করতে হবে। এর মধ্যেই বৃহস্পতি পৃথিবীর আকাশের চাঁদের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়। ভিতরের দিকের দৈত্য-উপগ্রহগুলিকে স্পষ্ট দেখা যায় গ্রহরাজের চারপাশে ঘুরতে। তাদের সবাইকে চাকতির মতো দেখায় এমনকি প্রত্যেকে নিজস্ব রঙও প্রকাশ করে যদিও এখনো তারা ঘুরে বেড়ায় দেখা না যাওয়ার মতো দূরত্বে। তাদের মহাজাগতিক ব্যালে নাচ চলছে ভাগ্যপতির পেছনে লুকিয়ে পড়া আর সূর্যের আলোয় বেরিয়ে আসার মাধ্যমে। নাচের সঙ্গী নিজ নিজ ছায়া। এবং এটাই সৃষ্টি জগতের জন্য সেই বুক কাঁপানো চিরন্তন ও স্থায়ী দৃশ্য। এটাই সেই সৃষ্টি, যা চারশো বছর আগে গ্যালিলিও একপলক দেখার পর থেকে আজ পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখে আসছেন। কিন্তু লিওনভের কুরাই একমাত্র জীবিত নর-নারীর দল যারা এ গ্রহকে নগ্ন চোখে দেখেছে। কথাটাকে কি অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? গ্রহরাজ তাকে খোলা চোখে দেখে নেয়ার স্পর্ধা দেখানো কোনো তুচ্ছ মানুষের জীবনই বাঁচিয়ে রাখেন না!

অসীম দাবাখেলা বন্ধ হয় শেষে। ডিউটির বাইরের ঘন্টাগুলো টেলিস্কোপে চোখ রেখে কেটে যায়। অথবা উৎসুক কথোপকথনের ফোয়ারা ছোটায় কুরা। কেউ কেউ মিউজিক শুনে সময় কাটায়। কিন্তু সবার স্থির দৃষ্টি বাইরের অভূতপূর্ব দৃশ্যে। অন্তত শিপে ঠাট্টা চালানোর একটা উপায় পাওয়া গেল, সবাই যখন অবাক চোখে বৃহস্পতির দিকে তাকিয়ে তখন ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি আর জেনিয়া মার্শেঙ্কো হঠাৎ হাওয়া হয়ে যায় সবার মাঝ থেকে। এজন্য হাল্কা হাসিঠাট্টাও হয়। বেচারারা এত ছোট শিপে নিজেদের মতো করে মিশতে পারে না।

ফ্লয়েড ভাবল, কী অদ্ভুত জুটি! সুদর্শন ম্যাক্স লম্বা, চওড়া, স্বর্ণাভ চুলের অধিকারী একজন চ্যাম্পিয়ন ব্যায়ামবীর। ও দুহাজারের অলিম্পিক ফাইনালে গিয়েছিল। বয়স ত্রিশে পড়লেও ভাবভঙ্গি বাচ্চা ছেলের মতো। এই সব না; উজ্জ্বল ইঞ্জিনিয়ারিং রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও সে প্রায়ই ফ্লয়েডকে নিজের লোকের মতো অস্বাভাবিকভাবে আঘাত করে তেমন আপন লোকের মতো যারা কথা বলার ক্ষেত্রে আমুদে, কিন্তু বেশি সময়ের জন্য নয়। নিজের সর্বস্বীকৃত পটুতার ক্ষেত্রের বাইরেও সে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু গভীরভাবে নয়।

ঊনত্রিশ বছরের জেনিয়া শিপের সবচে কমবয়েসী কু। এখনো রহস্যময়। কেউ তার দুর্বলতার কথা তোলার আগ পর্যন্ত ফ্লয়েড কখনো প্রসঙ্গটা তোলে না। ফ্লয়েডের ওয়াশিংটনের সোর্স তাকে এ নিয়ে কিছু জানাতে পারেনি। বোঝাই যায় সে কোনো ভয়ংকর দুর্ঘটনায় পড়েছিল। গাড়ির দুর্ঘটনাই হবে। এরচে অস্বাভাবিক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে জনপ্রিয় লোকগাঁথার এটা একটা অংশ যে সে এক গোপন স্পেস মিশনে ছিল। এ আশা বাদ দেয়া যায়। গ্লোবাল ট্র্যাকিং নেটওয়ার্ককে ধন্যবাদ, এ ধরনের ঘটনা অর্ধশতাব্দী যাবৎ অসম্ভব। জি টি এন তা ধরবেই। প্রকট শারীরিক ও মানসিক ক্ষত থাকা সত্ত্বেও জেনিয়া খেলেছে আরো কয়েকটা খেলা। সে শেষ মুহূর্তের প্রতিস্থাপিত যাত্রী-সবাই জানে।

ইরিনা ইউকোনিনার খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ এবং মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার কথা। কিন্তু চলে এল সে। একটা হ্যাং গ্লাইডার ইউকোনিনার অনেকগুলো হাড় ভেঙে দেয়।

প্রতিদিন জিএমটি৬৭ আঠারোতম ঘণ্টায় সাতজন ক্রু এবং একজন যাত্রী ছোট্ট কমনরুমে একত্র হত। কমনরুমটাই গ্যালি ও স্লিপিং কোয়র্টারগুলোকে ফ্লাইট ডেক থেকে আলাদা করে। বৃত্তাকার টেবিলটা আটজনের গাদাগাদি করে বসার জন্য যথেষ্ট। চন্দ্র আর কার্নো জেগে উঠলে প্রত্যেককে এখানে জায়গা দেয়াটা হবে সমস্যা। অন্য কোথাও বসানো হতে পারে দু সিট।

সিক্স ও ক্লক সোভিয়েত নাম দেয়া হয়েছে এর। প্রতিদিনের গোল টেবিল কনফারেন্স বলা হয় অনুষ্ঠানটাকে। সাধারণত দশ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না। শিপের নিয়ম, কমান্ড আর মানবিকতা বজায় রাখতে বিরাট ভূমিকা রাখে। অভিযোগ, পরামর্শ, সমালোচনা এবং উন্নয়ন প্রতিবেদনের সবই উত্থাপিত হতে পারে ক্যাপ্টেন যদি ভেটো না দেয়। ভেটোর মতো বাজে জিনিসের চর্চা হয় খুবই কম।

আজকের মেনুতে একটা পরিবর্তন আনার আবেদন করা হয়েছে। টেবিলে আলোচ্য বিষয়ের বাইরে জটিল ব্যাপারগুলো আলোচনার জন্যই এ আবেদন। পৃথিবীর সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য আরো সময় দেয়ার প্রস্তাব উঠেছে। মহাকাশে ছড়িয়ে আছে প্রচুর আমেরিকান সৈন্যদল। সৈনিকদের সাথে চলচ্চিত্র প্রোগ্রাম, সংবাদ আদান-প্রদান আর গল্পগুজব করার ব্যাপারেও কথা ওঠে।

ব্যাপার-স্যাপারে পরিবর্তন আসতে পারে, ফ্লয়েড তার সহকর্মীদের বলল কার্নো আর চন্দ্র হাইবারনেশন থেকে উঠে এলে। সে তার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপারে বলল না যে, কার্নো জাহাজের অন্য সবার চেয়ে বেশি চেঁচামেচি করতে ও কথা বলতে পারে।

ঘুমানো ছাড়া ফ্লয়েডের বেশির ভাগ সময়ই কাটত কমনরুমে। কিছুটা একারণে-ছোট হলেও এটা অনেক খোলামেলা; অন্তত তার ছোট্ট চৌকোণা ঘর থেকে বড়। সুন্দরভাবে সাজানো। সমস্ত সমতলই ছবি দিয়ে ভরা। সুন্দর ভূমি, সামুদ্রিক ছবি, খেলার ওয়ালপেপার, জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তারকা আর পৃথিবীর আর সব সুন্দরের ছবি দিয়ে সাজানো এ ঘরটা।

ঘরের একদিকে ঝুলছে লিওনভের ছবি। ১৯৬৫ সালে তার নিয়ার দ্য মুন স্টাডিটা করা হয়েছিল যখন তিনি একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে ভস্কট দু কে ফেলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যানবিহীন সংক্ষিপ্ত মহাকাশ অভিযান করেন।

স্পষ্ট বোঝা যায় যে মেধাবী অপেশাদার লোক একজন পেশাদারের চেয়ে ভাল কাজ করে। চাঁদের জ্বালামুখময় প্রান্তর, সুন্দর সাইনাস ইরিডিয়াম ও বে অফ রেইনবো দেখে ব্যাপারটা চোখে পড়ে। চাঁদের খাড়া উপরে দানবীয় উজ্জ্বলতায় জ্বলছিল পৃথিবী। নতুন চাঁদের মতো দেখায় এ গ্রহ। বসুধা রাতের দিকের বাকি আঁধার অংশটুকুকে আঁকড়ে আছে। এছাড়াও করোনার আলোক প্রবাহ মহাশূন্যে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার দূরে পৌঁছে যাচ্ছে সূর্যের আশীর্বাদ হিসেবে। দারুণ লড়াকু কম্পোজিশন। ভবিষ্যতের এক ক্ষণিক আলোও যেন পড়ছে যা তখন থেকেই তিন বছর পরে সত্যি হয়ে যায়।

অ্যাপোলো আটের উড্ডয়নে এন্ডার্স, বর্মণ ও লভেল রাজকীয় দৃশ্যটা খালি চোখে দেখেছিল ক্রিসমাস ডে উদযাপন করার সময় দূরে পৃথিবীর উদয় হচ্ছে তখন। তারা ছিল চাঁদের বুকে। উনিশো আটষট্টিতে।

হেউড ফ্লয়েড এ চিত্রটাকে খুব উঁচু দরের কাজ মনে করে। কিন্তু ছবিটার ব্যাপারে তার ধারণা ছিল মিশ্র। সে ভুলতে পারল না যে পেইন্টিংটা শিপের আর সবার চেয়ে বয়সে বড়। ব্যতিক্রম মাত্র একজন। যখন অ্যালেক্সি লিওনভ এটা আঁকেন, ফ্লয়েড ছিল ন বছরের এক ছেলে।

১৩. গ্যালিলিওর ভুবনগুলো

এমনকি এখনো, প্রথম ভয়েজারের উড়ে যাবার তিন দশকেরও পরে কেউ আসলে বুঝতে পারেনি কেন ঐ চার দৈত্য-চাঁদ একে অন্যের সাথে এত দূরত্ব বজায় রেখে চলে। তাদের সবাই প্রায় একই আকৃতির এবং সৌর জগতের একই অংশে অবস্থিত-তবু পুরোপুরি আলাদা প্রকৃতির। ঠিক যেমন হয় ভিন্ন জন্ম নেয়া চার বাচ্চার বেলায়।

ক্যালিস্টো সবচে বাইরের উপগ্রহ। শুধু ওটাই প্রত্যাশা মাফিক সাজানো। লিওনভ এটাকে মাত্র লাখখানেক কিলোমিটার দূরে রেখে এগিয়ে যায়। এর অসীম জ্বালামুখের মধ্যে বড়গুলো দেখা যাচ্ছিল একেবারে খালি চোখেই। টেলিস্কোপের মধ্য দিয়ে উপগ্রহটাকে বিশাল কাঁচের গোলক মনে হয়। কাঁচের বলটা যেন শক্তিশালী রাইফেলের গুলিতে একেবারে ঝাঁঝড়া। যেন টার্গেট প্র্যাকটিস করা হয়েছে ঘুরতে থাকা গোলায়। সব আকারের জ্বালামুখে ভরা; একেবারে দৃষ্টি সীমার শেষপ্রান্ত পর্যন্ত। কেউ একবার বলেছিল চাঁদকে যতোটা না পৃথিবীর চাঁদের মতো দেখায় তার চেয়ে বেশি দেখায় ক্যালিস্টোকে।

অবাক করা কোনো কথা না। অ্যাস্টরয়েড বেল্টের এক প্রান্তে বসে যে কেউ নিজের অন্য প্রান্তের একটা জগৎ এখানে আশা করতেই পারে। কিন্তু এ অশটায় শুধুই আঘাত করে সেই ধ্বংসাবশেষ যেটাকে সৌর জগতের সৃষ্টি থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অ্যাস্টরয়েড বেল্ট।

পরের উপগ্রহ গ্যানিমিডের চেহারা পুরোপুরি অন্যরকম। পেছনেরটার জ্বালামুখময় বিশাল প্রভাব এর উপর পড়ার কথা, তবু এর জ্বালামুখের বেশিরভাগই যেন চাষ করা-অদ্ভুত হলেও এ কথাটাই খাটে। গ্যানিমিডের বিস্তৃত অঞ্চল পিঠের মতো সমতলে ঢাকা। আবার কিছুটা মহাজাগতিক লাঙলে চষা জমি যেন। যেন কোনো বিরাট চাষী এ দৈত্যাকার চিরুনিচেরা পথ চষেছে কোন্ কালে। সেখানে হালকা রঙা বিচিত্র বর্ণের গর্ত, যেন স্ল্যাগ শামুক অর্ধশত কিলোমিটার দীর্ঘ পথটা বানিয়েছিল দুলকি চালে চলতে চলতে। সবচেয়ে রহস্যময় দাগগুলো লম্বা একেবেঁকে যাওয়া ভোরার দল-ডজন ডজন সমান্তরাল রেখা।

নিকোলাই টার্নোভস্কি বলে, এ লাইনগুলো অবশ্যই কোনো মাতাল অভিযাত্রী দলের বানানো বহু লেনওয়ালা সুপার হাইওয়ে।

সে দাবী করে টেলিস্কোপে দেখেছে ওভারসীজ এমনকি তার চোখে পড়ে লেন পৃথককারী পাতলা গাছের সারি।

মানব জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে লিওনভ কয়েক ট্রিলিয়ন বিট তথ্য যোগাড় করেছে গ্যানিমিড সম্পর্কে। ইউরোপার কক্ষপথ পেরুবার আগেই এ ডাটা যোগাড় করে স্পেসশিপটা। ইউরোপা-সেই বরফ বাঁধানো দুনিয়া তার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আর সবগুলো লাশ নিয়ে বৃহস্পতির অন্যপাশে থাকলেও কারো মন থেকেই দূরে নয়।

পৃথিবীতে খবর যাওয়ার সাথে সাথেই ডক্টর চ্যাং একজন জাতীয় বীরের সম্মান পান আর তার দেশের মানুষ স্বাভাবিক হতবুদ্ধি অবস্থায় পাঠায় অসংখ্য শোকবার্তা। একটা পাঠানো হয়েছিল লিওনভের ক্রুদের নামে। শিপে থাকার সময় সবার মানসিক অবস্থাই টলায়মান-প্ৰশংসা, দুঃখ আর মুক্তির মিশ্রণ চারদিকে। সব নভোচারী নিজেদের জাতীয় পরিচয়ের ব্যাপারে অবচেতন থেকে নিজেকে মহাশূন্যের নাগরিক মনে করে। একটা সাধারণ বন্ধনও অনুভব করে নিজেদের মধ্যে। তবু লিওনভের যাত্রীরা বিজয় বা দুঃখে অংশ নেয়নি তেমনভাবে কারণ চৈনিক

অভিযাত্রীদলের দেখা হয়েছিল দুর্ঘটনার সাথে। এর মধ্যে একটা নীরব সচেতনতাও ছিল কারণ তাদের জাতি এমন তাড়াহুড়ো করতে চায়নি।

ইউরোপায় হঠাৎ জীবন আবিষ্কার এ পরিস্থিতিতে যোগ করে এক নতুন মাত্রা। এরই মাঝে হয়ত সেই নতুন মাত্রা ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছে পৃথিবী এমনকি লিওনভেও। কিছু এক্সোবায়োলজিস্ট চিৎকার করে উঠেছেন, আমি আপনাদের তাই বলেছিলাম! সাথে সাথে এটাও বলেন যে, ব্যাপারটা আসলে তত বড় চমক নয়। যতটুকু পেছনে তাকানো সম্ভব-উনিশো সত্তুরের দিকে রিসার্চ ডুবোজাহাজগুলো অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণীর একত্রিশটা কলোনি পেয়েছিল যেগুলো প্রতিকূল পরিবেশেও গঠনের দিক দিয়ে উন্নত। তাদের পরিবেশটা যেকোনো জীবনের জন্য দারুণ বিরূপ। প্রশান্ত মহাসাগরের তলায় অগ্নিগিরির আশপাশে বা ভিতরে গভীর খাদে সেগুলোর বাসা। সেখানে আগুন-ঝর্না প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে বেরিয়ে এসে অতল সাগরের পানিকে অসম্ভব গরম করে তোলে। সাগর তলের মরুভূমিতে মরুদ্যান সৃষ্টি করেছে। প্রাণীগুলো!

যা একবার পৃথিবীতে ঘটতে পারে, তা লক্ষ লক্ষ বার মহাবিশ্বে ঘটেছে বলে আশা করা যায়।

বিজ্ঞানীদের বিশ্বাসের এক অটল অবিচল সিংহাসন এই এক কথা।

পানি অথবা নিদেনপক্ষে বরফ পাওয়া যায় বৃহস্পতির সব চাঁদে। আর আইওতে– অবিরাম গর্জাতে থাকা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত চলে সব সময়। তাই পাশের এ বিশ্বে কম ভয়াল অবস্থা আশা করাটা যৌক্তিক। এ দু ব্যাপার এক করে ইউরোপা বানায় জীবন সুধা। পানি আর আগ্নেয়গিরির সহায়তায় জীবন শুধু সম্ভবই নয়-অপরিহার্য। প্রকৃতির আর সব বিস্ময় বেরিয়ে আসে এ গ্রহের পরিবেশের সবটুকু লুকানো অংশ মিলিয়ে দেখলে।

এখনো ঐ সমাধান আরেক প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে যা লিওনভের মিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জীবন পাওয়া যায় বৃহস্পতির চাঁদে। এগুলোর কি কোনো সম্পর্ক থাকার কথা টাইকো একশিলাস্তম্ভের সাথে? কোনো সম্পর্ক আছে আইওর কাছের কক্ষপথের জিনিসটার সাথে? ওটাওতো কোনো না কোনো প্রাণীর সৃষ্টি।

সিক্স ও ক্লক সোভিয়েত সভায় ঐ রহস্যময় জিনিসটা বিতর্কের এক প্রিয় বিষয়। সবাই এটুকু বোঝে যে ডক্টর চ্যাংয়ের দেখা জীবটা কোনো উঁচু স্তরের বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ রাখতে পারেনি; যদি এটার আচরণ সম্পর্কে তাঁর কথা ঠিক হয়। কোনো প্রাণীই নিজের সহজাত প্রকৃতির কারণে নিজেকে বিপন্ন হতে দিতে পারে না। এমনকি কারণ থাকলেও জীবনের ঝুঁকি নেয় না কখনো। ওটার বুদ্ধি কি উইপোকার চেয়ে বেশি? বাতির দিকে পতঙ্গের মতোই নিজের জীবন নষ্ট করে এগোয়।

ভ্যাসিলি অর্লোভ দ্রুত আরেক বিপরীত উদাহরণও টানে যা এ যুক্তিকে দেয় দুর্বল করে, এমনকি খণ্ডনও করে, আর ডলফিনদের দিকে একবার তাকাও, সে বলে যায়, আমরা তাদের বুদ্ধিমান বলি, কিন্তু কীভাবে তারাই মাঝেমধ্যে নিজেদেরকে দল বেঁধে খুন করে? করে আত্মহত্যা! এও এক কারণ। বোকামির চেয়ে কারণটাই বড় হয়ে দেখা দিলে বুদ্ধিমান প্রাণী জীবনের ঝুঁকি নিবেই। মানুষ সব কালেই যুদ্ধ করে। সুইসাইড স্কোয়াডও থাকে।

ডলফিনদের কাছে যাওয়ার কোনো কারণ দেখি না, নাক গলালো ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি, আমার ক্লাশের দারুণ মেধাবীদের মধ্যে একজন ইঞ্জিনিয়ার কোনো এক স্বর্ণকেশী কাইভের প্রেমে পড়ার পর শেষবার যখন তার কথা শুনি তখন সে কাজ করত একটা গ্যারেজে। অথচ ও স্পেস স্টেশনের ডিজাইন করার কারণে স্বর্ণপদক পেয়েছিল। মেধার কী অপচয়!

আসলেই, মন সব নষ্টের গোড়া। যে প্রাণীর আবেগ থাকে সে প্রাণী বুঝেশুনে বোকামি করবেই।

যদি ডক্টর চ্যাংয়ের ঐ ইউরোপান বুদ্ধিমান হয়েও থাকে, অবশ্যই উচ্চ স্তরের কোনো প্রাণী না। আবার বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের জীববিদ্যা পৃথিবীর নমুনা আর উদাহরণের উপর নির্ভর করে না। তাই বিচারও করা যায় না এক হিসাব মাথায় রেখে।

অতি উন্নত প্রাণিকুল সামুদ্রিক হতে পারে না এমন কথা উঠেছে সবসময়। পৃথিবীকেন্দ্রীক প্রমাণও পাওয়া যায়। উন্নত প্রাণী সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন সমস্যায় ভরা প্রতিকূল পরিবেশ। কিন্তু সমুদ্র ততোটা চ্যালেঞ্জিং কোনো পরিবেশ নয়। পরিবেশটা আরামের। নেই কোনো পরিবর্তন। সর্বোপরি, কীভাবে একটা জলজ সৃষ্টি উন্নয়ন করবে আগুন ছাড়া? অন্তত প্রকৌশল বিদ্যার ক্ষেত্রে? আর প্রকৌশলের ধাপ বন্ধ থাকলে সভ্যতার আর সব দরোজাও তালা দেয়া থেকে যায়।

এখনো অবশ্য সভ্যতার পক্ষে যুক্তি থাকে, মানব সভ্যতা যে রাস্তায় চলেছে তাই হয়ত একমাত্র পথ না। মানুষের সর্বকালের সমস্যা হচ্ছে নিজেকে দিয়ে অন্যের বিচার করা। আরেক রহস্যঘেরা জগতের সম্পূর্ণ সভ্যতাটাই জলের নিচে থাকতে পারে। সৃষ্টিজগতের বাকি সবগুলোই হয়ত তেমন।

একটা ব্যাপার অস্বাভাবিক। কোনো মহাজাগতিক ভয়াবহ সৃষ্টি ইউরোপায় উঠে থাকতে পারে কিন্তু ভুলের কোনো চিহ্ন না রেখে চলে যাওয়াটাই রহস্যময়। নিজের অস্তিত্বের সামান্যতম নিদর্শন না রেখে ঐ সৃষ্টিটা চলে গেল বিশাল গড়ন, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, পাম্প বা আর সব মানব সৃষ্ট জিনিসপত্র স্রেফ ধ্বংস করে দিয়ে। কিন্তু ইউরোপায় এক মেরু থেকে আরেক মেরুতে শুধুই সমতল কঠিন বরফ আর কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রুক্ষ নগ্ন পাথর ছাড়া কিছুই দেখা যায়নি।

লিওনভ যখন প্রচণ্ড গতিতে আইও এবং ছোট্ট মিমাসের কক্ষপথগুলো ছাড়িয়ে গেল তখন আলোচনা এমনকি এগুলোর সম্পর্কে অনুমানেরও সময় ছিল না। সবাই ব্যস্ত রাজকীয় এলাকার ওজন বেড়ে যাওয়ার ছোট সমস্যাটার ব্যাপারে। বৃহস্পতির টান যে অসম্ভব! ঘণ্টা কয়েক পরে আসবে মুক্ত পতন। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের আগেই সব আলগা জিনিসপত্র নিরাপদে রাখাটা জরুরি। মুহূর্তের মধ্যে মন্দনের কারণে টেনে চলাটা শুরু হয়। এজন্য হয়ত বড়জোড় টু জির মতো তীব্র ওজন বোঝা যাবে।

ফ্লয়েডের ভাগ্য ভালই; সে একাই পেয়েছে আসতে থাকা গ্রহের অপার্থিব দৃশ্যের প্রশংসা করার সময়-সুযোগ। এরই মধ্যে আকাশের অর্ধেকটা গ্রহরাজের দখলে। একে মাপার মতো কোনো নিক্তি নেই। বিবশ মনের পক্ষে প্রকৃত আকারটা ধরে রাখারও উপায় নেই কোনো। তার নিজেকেই বারবার বলতে হচ্ছে যে অর্ধশত ধরণীও এ গোলার্ধকে ভরে দিতে পারবে না যা তার দিকে এগিয়ে আসছে নিয়তির মতো।

পৃথিবীর সবচে দামি সূর্যাস্তের মতো দেখায় ভাগ্যপতির মেঘমালা; এত দ্রুত ছুটে বেড়ায় যে দারুণ নড়াচড়া দেখা যায় বড়জোর দশ মিনিট; তারপরই হারিয়ে যায় ওপাড়ে। দানবীয় ঘূর্ণিগুলো থেকে থেকে জন্ম দিচ্ছে ডজন ডজন ছোট ঝড়। অথবা আরো বড় বড় দল। এ দল আর মেঘ ঘিরে থাকে দানো গ্রহকে। ঢেউ খেলিয়ে চলে যায় ধোয়ার চক্রের মতো। সাদা গ্যাসের শিখা মাঝে মাঝে গভীর থেকে উষ্ণ প্রস্রবনের মতো উথলে ওঠে আবার বৃহস্পতির ভয়ানক পাক খাওয়া ঝড়ে সরে যায় দূর থেকে দূরে। সাদা চিহ্নগুলো সবচে অদ্ভুত, দেখতে নেকলেসের গায়ে সাজানো মণিমুক্তার মতো। অবাধ বাতাসের সাথে শুয়ে আছে বৃহস্পতির মাঝামাঝি.অক্ষাংশ জুড়ে।

দ্বীপরাজ্যের রাজধানীর শহরতলীতে ঢোকার আগের কয়েক ঘণ্টায় ফ্লয়েড ক্যাপ্টেন আর নেভিগেটদের দেখল খুব কমই। অর্লোভরা ব্রিজ ছেড়ে যায় না কারণ তাদের কাজটা খুব কঠিন। বৃহস্পতির এলাকায় অনেক অনেক অর্বিট। ওরা তাই আসতে থাকা কক্ষপথকে পরীক্ষা করছে আর মিনিটে মিনিটেই বদলে দিচ্ছে লিওনভের পথ। এ মুহূর্তে শিপের রাস্তা খুব জটিল। এখনি বাইরের বায়ুমণ্ডলে ঢুকবে; যদি স্পিড অনেক বাড়ে তাহলে ফ্রিকশনাল ব্রেক করাটা অসম্ভব হতে পারে। এমনকি, উপরের দিকে উঠে পড়লে বৃহস্পতি-অর্বিটের আকর্ষণ কাজে লাগিয়ে দোলনার মতো শিপটা হারিয়ে যাবে সৌরজগতের বাইরে। ঐ শূন্যতা থেকে লিওনভকে উদ্ধার করাটা অসম্ভবই শুধু না, পথের আশা হবে অলীক কল্পনা। আবার যদি অনেক নিচু হয়ে যায়-পড়তে থাকে বরাবর বৃহস্পতির দিকে তাহলে অ্যাটমোস্ফিয়ারের কণার সাথে অতি গতিতে সরাসরি ঘর্ষণের কারণে স্রেফ পুড়ে যাবে এক উল্কাপিন্ডের মতো। এ দুই ভয়াল শেষ সীমার মাঝের ছোট্ট অঞ্চলে থাকতে পারলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে খুব অল্প।

চীনারা আগেই প্রমাণ করেছে যে অ্যারোব্রেকিং করা সম্ভব। কিন্তু সব সময় দু একটা ভুলের সুযোগ থেকে যায়। তাই ফ্লয়েড একটুও আমল দেয়নি সার্জন কমান্ডারের কথায়। সার্জন কমান্ডার রুডেস্কো যোগাযোগের এক ঘণ্টা আগে প্রশংসা করেছিল, উডি, আশা করা শুরু করলাম যে অবশেষে ধরা দিচ্ছে সেই বিজয়।

১৪. মুখোমুখি

…নান্টাকেট হাউসের বন্ধকের কাগজপত্র এম মার্ক করে ফাইলের মধ্যে নিয়ে লাইব্রেরীতে রাখতে হবে।

ঠিক আছে, আমার মনে হয় এটুকুই আমাদের আলোচনা। কয়েক ঘণ্টা ধরে মনে পড়ছে একটা ছবির কথা। আমি এক ছোট্ট ছেলের ছবি পেয়েছিলাম ভিক্টোরিয়ান আর্টের ছেঁড়া ভলিউমে। কমসে কম দেড়শো বছরের পুরনো। সাদাকালো নাকি রঙিন তা খেয়াল নেই। কিন্তু কখনোই ঐ ছোট্টটাকে ভুলব না–হাসবে না কিন্তু শুনে… ছবিটাকে দি লাস্ট মেসেজ হোম নামে ডাকত লোকে। আমাদের দাদার দাদারা পছন্দ করতেন ঐ ধরনের আবেগিক মেলোড্রামা।

চিত্রটায় হ্যারিকেনের মুখে পড়া এক জাহাজ দেখা যায়। পালগুলো ফোলা। ডেকে পানি আর পানি। পেছনে ক্রুরা জাহাজকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করছে আর সামনের দিকে এক তরুণ নাবিক হাতে কাগজ নিয়ে লিখছে একটা নোট। তার পাশেই রাখা আছে খালি বোতল। তার বিশ্বাস, এ ছিপিবন্ধ বোতল নোটটাকে নিয়ে কোনো এক সবুজ মাটির বুকে আছড়ে পড়বে কোনো একদিন।

তখন আমি ছিলাম একটা বিচ্ছু, ভেবেছি চিঠি লেখা বাদ দিয়ে তার উচিত ছিল সহযোগীদের সাহায্য করা। একইভাবে এটা আমার উপরেও এসে পড়তে পারে তাতো ভাবিনি কোনোদিন! ভাবিনি আমিই ঐ নাবিক।

অবশ্যই-আমি শিওর তুমি মেসেজটা পাবে। কিন্তু আমিতো লিওনভে কোনো সহযোগিতাই করতে পারব না। আসলে আমাকে ঐ কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য খুব ভদ্রভাবেই বলা হয়েছে। আমি এ কথাটা বলার সময় আমার বিবেক পুরোপুরি সচেতন।

এখন মেসেজটা ব্রিজে পাঠাব। কারণ পনের মিনিটের মধ্যে সম্প্রচার শেষ হবে। বড় ডিশটা নামিয়ে বন্দী করব হ্যাঁচের ভেতরে। স্পেসশিপের সাথে সুন্দর মিল আছে তোমার! বৃহস্পতি ঠিক এ মুহূর্তে ভরে ফেলছে আকাশটাকে। সেটা আর বর্ণনা করার চেষ্টা করব না। সৌন্দর্যটা বেশিক্ষণ দেখবও না-কয়েক মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শাটার।

যাই হোক, ক্যামেরাগুলো এরচে অনেক ভাল দেখতে পারে। বিদায় প্রিয়তমা। …..: তোমাদের সবার জন্য অনেক অনেক ভালবাসা। বিশেষ করে ক্রিসের জন্য। যখন এটা পাবে, ততোক্ষণে এগিয়ে গিয়ে চলাটা শেষ হবে; তা সোজা পথে হোক আর উল্টো। মনে রেখ, আমাদের সবার খাতিরে আমি চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য। বিদায়।

অডিও চিপ সরিয়ে ফ্লয়েড ভেসে চলল কম্যুনিকেশন সেন্টার থেকে বেরিয়ে। তারপর চিপটা শাসা কোভালভের হাতে দিয়ে দিল, প্লিজ, মেসেজটা যেন ডিশ নামানোর আগেই পাঠানো হয়। পাঠিয়েই জানিয়ে দিও আমাকে।

চিন্তা করো না। শাসা জবাব দিল, আমি এখনো সব চ্যানেলে চেষ্টা করছি। হাতে জলজ্যান্ত দশ মিনিট বাকি।

আবার যদি দেখা হয়-আমরা তো হাসব। যদি তা নাই হয়, কেন এ বিদায় এত সুন্দর করে হল?, কথাটা বলার আগে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ফ্লয়েড। বলা শেষ করেই একচোখ একটু পিটপিট করল।

শেক্সপিয়র-ঠিক?

অবশ্যই; ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াসের কথা। যুদ্ধের আগে। শাসা, দেখা হবে তোমার সাথে।

তানিয়া আর ভ্যাসিলি নিজেদের কাজে এত বেশি মনোযোগী ছিল যে ফ্লয়েডের দিকে তারা সেভাবে খেয়ালও করল না। সে সবকিছু ছেড়ে সেঁধিয়ে গেল নিজের সেই ছোট্ট কেবিনেই। সবার কাছ থেকেই বিদায় নেয়া হল। এখন অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তার স্লিপিং ব্যাগ প্রস্তুত। আবার মহাকর্ষ শুরু হলে স্লিপিং ব্যাগে ঢোকার মতো একমাত্র লোক সে।

অ্যান্টেনাগুলো… ইন্টারকম স্পিকার বলে উঠল, আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রথম অভিকর্ষ অনুভব করব, আশা করি। সবকিছুই নরমাল।

এ শব্দটাই আমি সবচে কম ব্যবহার করি, বলল ফ্লয়েড। নিজেকেই, আমার মনে হয় তোমরা নরমাল শব্দটা বলেছ ভুল করে, হয়ত বলতে চাইছ নোমিনাল বা নামমাত্র।

হঠাৎ করেই নিজের চিন্তা থামিয়ে দিল ফ্লয়েড। দরজায় জোর শব্দ হচ্ছে। প্রশ্ন করল, কটো টম?

মনে হল জেনিয়া এসেছে।

আমি ভিতরে এলে কি তুমি কিছু মনে করবে? জিজ্ঞাসাটা ন্যাকা সুরের। অবশ্যই ছোট্ট মেয়ের কণ্ঠে; ব্যাপারটা ফ্লয়েড বুঝতে পারে ভয়ার্ত মনে।

অবশ্যই কিছু মনে করব না। তুমি নিজের কিউবিকলের বাইরে কেন? এলাকায় ঢুকতে আর পাঁচ মিনিটও বাকি নেই। প্রশ্নটা করলেও নিজের বোকামীর ব্যাপারে সচেতন ছিল ফ্লয়েড। জবাবটা এত বেশি অদরকারি যে জেনিয়া তা দেয়ার কোনো চেষ্টাই করেনি।

কিন্তু জেনিয়াই সর্বশেষ মানুষ যাকে ফ্লয়েড হয়ত আশা করে থাকবে। তার প্রতি জেনিয়ার আচরণ সব সময়েই নস্ত্র কিন্তু দৃঢ়তাও ঠিক থাকত। এমনকি সমস্ত ক্রুর মধ্যে একমাত্র ও-ই ফ্লয়েডকে ডক্টর ফ্লয়েড নামে ডাকতে পছন্দ করে। ঠিক এখনো, দুর্দশার মুহূর্তে সে একটু আয়েশ আর সঙ্গই হয়ত আশা করে এখানটায়।

জেনিয়া, মাই ডিয়ার সে বিকৃত সুরে বলল, তোমাকে স্বাগতম, কিন্তু আমার থাকার জায়গাটা খুব ছোট। এটাকে কেউ ইচ্ছা করলে স্পার্টা নগরীর মতোও বলতে পারে।

মেয়েটা কোনোমতে একটা ফ্যাকাশে হাসি দিয়ে কোনো কথা না বলেই ঘরে ঢুকল ভেসে ভেসে। আর প্রথমবারের মতো ফ্লয়েড দেখতে পেল ও শুধু নার্ভাস না, রীতিমতো আতঙ্কিত। এতক্ষণে বুঝতে পারছে কেন মেয়েটা এসেছে তার কাছে। এ অবস্থায় নিজের সহযোগীদের কাছে যেতে লজ্জা পাচ্ছিল বলেই ভেসে বেড়াচ্ছে। একটু সমর্থনের আশায়।

ও হঠাৎ ঢুকে যাওয়ায় অবশ্যই ফ্লয়েডের রাগ ওঠার কথা। জেনিয়ার অসহায়ত্ব বুঝতে পেরেই রাগটা মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। বাড়ি থেকে অকল্পনীয় দূরে থাকা একা একজন মানুষ এমন কোথাও ঢুকবে একটু পর যেখান থেকে কেউ বেঁচে ফেরেনি। এবং সেই ঢোকারও কোনো নিশ্চয়তা নেই, কেউ জানে না তারা অসীম স্পেসে হারিয়ে যাবে নাকি জ্বলে ছাই হবে বৃহস্পতির দিকে পড়তে পড়তে। এত বিরক্ত হয়নি ফ্লয়েড যার ফলে তার এটুকু বোঝার ক্ষমতা কমে যাবে। জেনিয়া ঠিক অপরূপা না হলেও আকর্ষণীয়। কিন্তু তার অর্ধেক বয়েসী কোনো মেয়ের ক্ষেত্রে এসব কোনো ব্যাপার না। এটাই হয়েছিল; সে ভাবতে বসেছিল ঐরকম কিছুই। ফ্লয়েড একটু আড়ষ্ট।

জেনিয়া অবশ্যই বুঝতে পারে সব। কোকুনে পাশাপাশি শুয়ে থাকার সময় মেয়েটা উৎসাহ অনুৎসাহের কোনোটাই দেয় না। তাদের দুজনের জন্য মোটামুটি স্থান থাকলেও ফ্লয়েড জায়গা নিয়ে হিসাব নিকাশ শুরু করে দিয়েছিল। তার সবচে ভয়ের হিসাবটাও মাথায় আসে, যদি সর্বোচ্চ অভিকর্ষ পরিকল্পনার চেয়ে একটুও বেশি হয়…সহ্য ক্ষমতার চেয়ে বেশি হলে? তারা মারা যেতে পারে সাথে সাথে…

দুজনের দূরত্বটা মোটামুটি ভদ্র, হঠাৎ এ পরিস্থিতিতে পড়ায় লজ্জার কিছু নেই। মনের অবস্থার সাথে কামনার কোনো মিলই নেই এখন; কোন ফাঁকে তাদের আলিঙ্গন এত কাছাকাছি এসেছে টেরও পায়নি কেউ। ফ্লয়েড জানে না এতে দুঃখ পেতে হবে নাকি সুখ।

এখন আর অন্য চিন্তার সময় নেই। অনেক অনেক দূর থেকে ভেসে এল মৃদু শব্দের প্রথম ফিসফিসানি; যেন কোনো অশান্ত আত্মার হাহাকার। একই মুহূর্তে শিপ বেশ স্পষ্টভাবে ঝাঁকি খায়; এপাশ ওপাশ দুলতে থাকে কোকুন। প্রথমবারের মতো তারা আকর্ষণ টের পায়। কোকুন আঁকড়ে রেখেছে তাদের। বহু সপ্তাহের ওজনহীনতার পর ফিরে আসছে গ্র্যাভিটি।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেই হালকা ফিসফিস পরিণত হয় এক নিয়মিত উঁচু শব্দে। এবার কোকুনটার অবস্থা ঠেসে ভরা নেটের ঝুলন্ত বিছানার মতো। ব্যাপারটা ভাল হচ্ছে না…ভাবল ফ্লয়েড। এখনি শ্বাস নেয়া কষ্টকর। তার শ্বাস নেয়ার কষ্ট গ্র্যাভিটির জন্য নয়, জেনিয়া তাকে আঁকড়ে ধরেছে-যেভাবে ডুবন্ত মানুষ আঁকড়ে থাকে সামান্য খড়কুটোকে। সে মেয়েটাকে সরিয়ে দিল যতটা ভদ্রভাবে পারা যায়।

সবই ঠিকঠাক চলবে-জেনিয়া। জিয়াংপেরে থাকলে আমরাও পারব…রিল্যাক্স, ভয় পাবার কিছু নেই। এমন পরিবেশে নরম সুরে কথা বলা যথেষ্ট কঠিন, তবু সে শিওর না এত কান ফাটানো গর্জনের মাঝে জেনিয়া কথাটুকু শুনেছে কিনা।

তাপে তাপে উবে যাওয়া হাইড্রোজেনের চিৎকার বাড়ছেই। ভাগ্য ভাল, এখন আর সে তাকে চেপে ধরে রাখছে না। সুযোগ পেয়ে ফ্লয়েড ভাল মতো দম নিয়ে নেয়।

তাকে এ অবস্থায় দেখলে ক্যারোলিন কী ভাবত? কখনো সুযোগ পেলে সে কি এ সময়ের কথাটা স্ত্রীকে বলবে? শুনলে মেয়েটা তার কথা মানবে কিনা কে জানে!

এমন এক মুহূর্তে পৃথিবীর বন্ধনকে অনেক অনেক হাল্কা মনে হয়।

নড়া অসম্ভব। কথাও বলা যায় না। কিন্তু এরিমধ্যে সে ওজনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সাথে তাল মিলিয়ে নিয়েছে–ওজন কখনোই তার কাছে কঠিন মনে হয় না; শুধু এখন ডান হাতটায় চাপ বাড়ছেই বাড়ছে। অসহ্য। বহু কষ্টে হাতটাকে উদ্ধার করে জেনিয়ার কাছ থেকে; কাজটা করেই কেমন অপরাধবোধে ছেয়ে যায় মন। হাতের রক্ত চলাচল ফিরে পেতেই তার মনে পড়ে কমপক্ষে এক ডজন অ্যাস্ট্রোনট আর কসমোনটের বিখ্যাত উক্তিটা, জিরো গ্র্যাভিটি সেক্সের আনন্দ আর সমস্যা দুইই খুব বেশি।

কীভাবে বাকি ক্রুরা চলছে কে জানে! একই সাথে তার হিংসাও হয় চন্দ্র আর কার্নোকে, পুরো পথটাই ঘুমিয়ে কাটালো ওরা-দুশ্চিন্তা আর মানসিক চাপ পরের কথা, ঘুমিয়েছে যে তাই টের পায় না। বৃহস্পতির আকাশে লিওনভ যদি একটা উল্কা হয়ে ঝরে পড়ে তবু তারা কোনোদিন জানতে পারবে না। হঠাৎ হিংসাটা কেটে গেল, তারা জীবনের এক বিরাট অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হল আজ।

তানিয়া ইন্টারকমে কথা বললেও গর্জনের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে তার শান্ত আর খুবই স্বাভাবিক কথাবার্তা। কথা এতই শান্ত যেন কোনো রুটিন এনাউন্সমেন্ট চলছে। ফ্লয়েড হাতঘড়ির দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে নেয়, অবাক ব্যাপার! পেরিয়ে গেছে অর্ধেক পথ। ঠিক এ মুহূর্তে লিওনভ বৃহস্পতির সবচে কাছাকাছি। শুধু এক্সপান্ডেবল অটোমেটিক প্রোবগুলো বৃহস্পতির আকাশের আরো ভিতরে ঢুকে যাবে।

অর্ধেক পথ শেষ, জেনিয়া। চিৎকার করে ওঠে সে, এবার বেরিয়ে যাব। কে জানে, মেয়েটা শুনেছে কিনা। তার চোখগুলো একেবারে বন্ধ, একটু হাসল শুধু।

বোঝাই যায় শিপ দুলছে কোনো উন্মাদ সাগরে ছোট্ট নৌকার মতো। এমন হবার কথা? ভয় পায় ফ্লয়েড। জেনিয়াকে নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ পেয়ে সে যথেষ্ট খুশি; নিজের ভয়কে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়া গেল। এ চিন্তাটা সরিয়ে দেয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সে দেয়ালগুলোকে চেরির মতো আগুন রঙা হয়ে যেতে দেখল, কুঁকড়ে আসছে তার দিকে। এডগার অ্যালান পোর সেই দুঃস্বপ্ন ফ্যান্টাসি, দ্য পিট অ্যান্ড দ্য পেন্ডুলাম এর মতো যেটার কথা সে ভুলে ছিল গত ত্রিশ বছর…

কিন্তু এমন কিছু কখনোই হবে না। হিট শিল্ড ব্যর্থ হলে সাথে সাথেই শিপ দুমড়ে যাবে। সামনের গ্যাস স্তর পৃথিবীর মতো নয়, বৃহস্পতির বায়ুস্তর যেন শক্ত দেয়াল। কোনো ব্যথা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। স্নায়ুতন্ত্র এ অনুভূতি বহন করার আগেই ছাই হয়ে যাবে। সে সান্ত্বনার আরো অনেক শব্দ খুঁজে পায়, কিন্তু চিন্তাটা তাড়ানো অসম্ভব।

উত্তেজনা থিতিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। তানিয়া আরেকটা ঘোষণা দেয় এবার (সব শেষ হলে সে নিশ্চই এ ঘোষণার জন্য ক্যাপ্টেনকে দেখে নেবে।) এবার সময় যেন আরো আরো ধীর; এক সময় ঘড়ির দিকে তাকানো বন্ধ করে দেয়। এ ঘড়িকে আর বিশ্বাস করা যায় না। ডিজিট এত আস্তে আস্তে পরিবর্তন হচ্ছে যেন সে স্পষ্ট নিজেকে কোনো আইনস্টাইনীয় সময় দীর্ঘায়নের ফাঁদে দেখতে পায়।

এরপর আরো অবাক করা কিছু হয়। প্রথমে একটু মজা পেলেও রেগে যায় ধীরে ধীরে। জেনিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে-তার হাতে না হোক, একেবারে হাতের পাশে।

এই স্বাভাবিক। এত চাপ আর উত্তেজনা মেয়েটাকে নিশ্চই ক্লান্ত করে তুলেছে-কিন্তু শরীরের সৌন্দর্য তাকে ফ্লয়েডের রাগের হাত থেকে বাঁচায়। হঠাৎ ফ্লয়েড নিজেও ঝিমাতে শুরু করে শারীরিক আনন্দের পর যে অবসাদ আসে তার কারণে, যেন সেও এই মুখোমুখির জন্যে ডুবে গেছে অনেকটা। তাকে জেগে থাকতেই হবে…

…আর সে পড়ে যাচ্ছে… পড়ছে… পড়ছে… সব শেষ। শিপ ফিরে এসেছে মহাকাশে; যেখানে তার থাকার কথা। আর মাধ্যাকর্ষণ নেই। আলাদা হয়ে ভেসে বেড়ায় সে আর জেনিয়া।

তারা হয়ত আর কক্ষনো এত কাছে আসবে না কিন্তু সারা জীবন একে অন্যের প্রতি অন্যরকম এক কোমলতা নিয়ে চলবে যা আর কারো সাথে শেয়ার করা অসম্ভব।

১৫. দৈত্য থেকে দূরে

জেনিয়ার মাত্র কয়েক মিনিট পরে ফ্লয়েড অবজার্ভেশন ডেকে পৌঁছল। বৃহস্পতি এর মধ্যেই সরে গেছে অনেক দূরে। যা দেখেছে সে সময় না, তা অবশ্যই কোনো বিভ্ৰম-চোখের প্রমাণ নয়। বৃহস্পতির অ্যাটমোস্ফিয়ার থেকে তারা দূরে। কিন্তু এখনো গ্রহটা অর্ধাকাশ জুড়ে রয়েছে।

এখন তারা গ্রহরাজের হাতে বন্দী। শেষের জ্বলন্ত ঘণ্টাগুলোয় ভালমতো চিন্তা ভাবনা করেই জলাঞ্জলি দিয়েছে বাড়তি গতি। এ গতিটা সৌরজগতের ঠিক বাইরে অনন্ত নক্ষত্রবীথির মাঝে নিয়ে ফেলতে পারত। এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে এক উপবৃত্তাকার পথে। এক পরিচিত হোম্যান কক্ষপথ। হয়ত তাদের উপরদিকে সাড়ে তিন লাখ কিলোমিটার পিছিয়ে নিতে পারে। সেটা বৃহস্পতি আর আইওর মাঝামাঝি অর্বিট। তা করতে না পারলে ভাল। না করলে আবার মোটরগুলো জ্বালাতে হবে। লিওনভ ঘুরে বেরিয়ে যাবে এবং মরণের সেই দুই সীমার মুখোমুখি হবে আবার। বারবার কষ্ট করে বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে ঢুকবে, বেরিয়ে যাবে প্রতি উনিশ ঘণ্টা অন্তর অন্তর। এ অর্বিটটা বৃহস্পতির চাঁদগুলোর কাছাকাছি যেতে পারে তবে খুব বেশিক্ষণের জন্য নয়। যতবার যানটা অ্যাটমোস্ফিয়ারে ঘোরাঘুরি করবে ততোবারই হয়ত এর উচ্চতা যাবে কমে, যে পর্যন্তসর্পিল আর ছোট হতে থাকা পথটা ধ্বংসের দিকে না গড়ায়।

ফ্লয়েড আসলে কখনোই ভদকায় মজা পায়নি, কিন্তু নিজের পছন্দ-অপছন্দ না দেখিয়েই আর সবার সাথে যোগ দিয়েছিল বিজয় ড্রিংক পার্টিতে। স্বাস্থ্য কামনা করা হয়েছিল শিপের ডিজাইনারদের আর সবাই ধন্যবাদ দিয়েছিল স্যার আইজ্যাক নিউটনকে। তখন তানিয়া তার বোতলটা কাপ বোর্ডে ফেরত দেয় কারণ আরো অনেক অনেক কাজ বাকি।

সবাই ভেবেছে এমন হতে পারে, তবু বিচ্ছিন্নতার ধাক্কাটায় যেন সবাই হঠাৎ আঘাতের বিস্ফোরণের পরের ছাইয়ে ঢাকা পড়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই এক বিশাল জ্বলন্ত চাকতি ভেসে উঠল চোখের সামনে। একপাশ থেকে অন্যপাশে ঘুরতে ঘুরতে দ্রুত শিপ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সাথে সাথেই শুরু হল মাতাল কথাবার্তা।

দেখ! চিৎকার করে উঠল ম্যাক্স, ফ্লাইং সসার! একটা ক্যামেরা হবে?

এরপর যে হাসিটা বয়ে গেল,সেটার আছে আলাদা ঐতিহাসিক তাৎপর্য। মানসিক মুক্তি আনে এমন হাসি। কিন্তু হাসিটায় বাধা দেয় ক্যাপ্টেনের সিরিয়াস। মনোভাব, বিদায় বিশ্বস্ত হিট শিল্ড, দারুণ কাজ করলে তুমি।

কিন্তু কী আশ্চর্য! বলল শাসা, ওজন হবে কমসে কম দু টন। জিনিসটা না থাকলে বাড়তি কিছুই বহন করতে পারব না।

ওটা ভাল রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং হয়ে থাকলে, বলল ফ্লয়েড, আমিই এর জন্য যথেষ্ট। কয়েক টনকে অনেক বড় মনে করা এক মিলিগ্রামকে সামান্য ভাবার চেয়ে অনেক ভাল।

সবাই তার মহৎ মনোভাবকে বাহবা দেয়। আলাদা হয়ে যাওয়া শিল্ডটা হলুদাভ হয়ে লাল আর সবশেষ হয় চারদিকের মহাশূন্যের মতো কালো রঙা। মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়েই হারিয়ে গেল; কোনো নক্ষত্রের আলো ঠিকমতো শিপে পড়লে জিনিসটা দেখাই যেত না।

প্রাথমিক অর্বিট চেক কমপ্লিট। বলল ভ্যাসিলি, আমাদের ডানদিকের ভেক্টরের দিকে প্রতি সেকেন্ডে দশ মিটার যাচ্ছি। প্রথম চেষ্টায় খারাপ না।

সাথে সাথে একটু স্বস্তির আভাস খেলে গেল সবার মনে। কয়েক মিনিট পরে ভ্যাসিলি আরো একটা ঘোষণা দেয়, যাত্রাপথ পরিবর্তনের চেষ্টার ধরন পাল্টাচ্ছি। প্রতি সেকেন্ডে ডেল্টা ভি ছ মিটার। এক মিনিটের মধ্যে বিশ সেকেন্ডের প্রজ্বলন শুরু হবে।

বৃহস্পতি এত কাছে যে এর কক্ষপথ ধরে ঘোরার কথাও বিশ্বাস হয় না। মেঘের সাগর থেকে বেরিয়ে এলে একটা এয়ারক্রাফট থেকে পৃথিবীকে যেমন দেখায় তেমন লাগছে বৃহস্পতিকে। এত বিশালতায় পরিমাপের কোনো হিসাব থাকে না। যেন কোনো পার্থিব সূর্যাস্তের সময় তারা পৃথিবীর আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। নিচের গোলাপী আর লালের লালিমা যেন অতি পরিচিত।

এক ধরনের মোহ; আসলে পার্থিব কিছুর সাথেই এর তুলনা চলে না। রঙটা বৃহস্পতির অংশ। পৃথিবীর গোধূলী লালিমা সূর্য থেকে ধার করা। নিচের গ্যাসগুলো পরিচিত হয়েও অপার্থিব। ভাসছে মিথেন, অ্যামোনিয়া, আর ডাইনীর ক্রুর মতো হাইড্রোকার্বনের মেঘ। কোনো মুক্ত অক্সিজেনের দেখা নেই; মুক্ত শ্বাসের নেই উপায়।

মেঘেরা উঁচু থেকে উঁচুতে সারি সারি বিন্যস্ত। সাধারণত সমান্তরালে থাকে, মাঝে মধ্যে ঘূর্ণিগুলো বিরক্ত করছে মেঘ-সারিকে। এখানে সেখানে উজ্জ্বল গ্যাস উপরে উঠে আসায় সুন্দর লাইনগুলো হয় এলোমেলো। ফ্লয়েড একটা বিরাট ঘূর্ণির কালো প্রান্তের দেখা পেয়েছে, এত নিচে নেমে গেছে ওটা-মেপে শেষ করা যাবে না।

এবার সে গ্রেট রেড স্পটের খোঁজ শুরু করল, সাথে সাথেই নিজেকে একটু বোকাও ভেবে নিল। নিচে যতটুকু দেখা যায়, তার পুরোটা হয়ত গ্রেট রেড স্পটের শতভাগের কয়েকভাগ। কেউ যদি ছোট একটা প্লেন নিয়ে ক্যানসাসের উপর উড়তে উড়তে আমেরিকার ম্যাপটা দেখতে চায়, তাকে বোকা না বলে কী বলা যায়!

সংশোধন শেষ। এবার আমরা আইও আর বহস্পতির মাঝামাঝি একটা স্থির অর্বিটে। এসেছি অষ্টম ঘণ্টার পঞ্চান্ন মিনিটে।

বৃহস্পতি থেকে ন ঘণ্টারও কম সময়ে সরে এলাম, এবার অপেক্ষা করতে হবে যার জন্য আসা। ভাবল ফ্লয়েড। আমরা দৈত্য থেকে দূরে চলে এসেছি-কিন্তু সে কোনো একটা বিপদ পেতে বসে আছে আমাদের জন্য, এবার প্রস্তুত হতে হবে। সামনের সবটা এখনো শুধুই রহস্য।

একবার যেহেতু চ্যলেঞ্জটা পেরিয়ে এসেছি, আরো একবার বৃহস্পতির দিকে যেতে হবেই। ঘরে ফিরতে হলে বৃহস্পতির আকর্ষণ শক্তি দরকার।

১৬. প্রাইভেট লাইনে আলাপ

হ্যালো, দিমিত্রি। উডি বলছি, পনের সেকেন্ডের মধ্যে কি-টু চাপব…হ্যালো, দিমিত্রি-কি-থ্রি আর কি-ফোর তৈরি কর, কিউব করে বর্গমূল দাও, পাইয়ের বর্গ যোগ করে সমষ্টিকে কি-ফাইভ হিসেবে ব্যবহার কর। তোমাদের কম্পিউটার যদি আমাদেরগুলো থেকে লাখো গুণ দ্রুত কাজ করে, তাহলে এ ম্যাসেজ কেউ ভাঙলে ভাঙতেও পারে। আমি জানি, তোমাদেরগুলো লক্ষগুণ শক্তিশালী নয়। আমরাও এটা ভাঙতে পারব না। মনে হয় কিছু ব্যাখ্যা দেবে-এ কাজে তুমি খুব দক্ষ।

যাই হোক, আমার দারুণ একজন সোর্স আছে। সে বলেছে বুড়ো আন্দ্রে এবারও রিজাইন করতে পারেনি। তোমার কর্মকর্তাদের দল আর সবার মতোই ব্যর্থ। এবারও তাকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে হচ্ছে। আমার মাথাটার প্রশংসা করতে হয়, আজো এটা একাডেমিকে ঠিকমতো সেবা দেয়। আমি জানি, বুড়ো নব্বইয়ের উপরে-আর দিনে দিনে হচ্ছে আরো অথর্ব। স্যরি, তাকে সরানোর কাজে আমার কোনো সাহায্যই পাবে না, যদিও আমি বুড়ো বিজ্ঞানীদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার কাজে পৃথিবীর… ধ্যাৎ… সৌর জগতে সবচে বেশি দক্ষ।

বিশ্বাস হয়, এখনো আমি একটু একটু মাতাল? মনে হল এবার একটা ছোটখাটো পার্টি দিয়ে দেয়া যায়, কারণ এক সময় না এক সময় আমরা সার্থকভাবেই মিল… মিশ… ধ্যাৎ… মিলেছি বৃহস্পতির সাথে। এছাড়াও আমরা নতুন দুজন সদস্য পেয়েছি শিপে। চন্দ্র অ্যালকোহল পছন্দ করে না-এটা নাকি মানুষকে অতিমাত্রায় মানবিক করে ফেলে-কিন্তু ওয়াল্টার কার্নো সেটা কড়ায় গণ্ডায় পুষিয়ে দিচ্ছে। একমাত্র তানিয়াই কঠিন। সে কিছুতেই মাতাল হবে না-অ্যালকোহল নিক, না নিক… এমনটাইতো আশা করো ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে, না?

প্রিয় আমেরিকানরা-আমি কথা বলছি রাজনীতিকের মতো। ঈশ্বর সাহায্য করেছেন আমাকে-ভালয় ভালয় বেরিয়ে এসেছি হাইবারনেশন থেকে, তারপর বৃহস্পতির টান থেকেও। দুজনেই আছি কাজে নামার ধান্ধায়। আমাদের সবাইকে তাড়াহুড়ো করতে হবে। শুধু সময় যাচ্ছে না-ডিসকভারির অবস্থাও মনে হয় খারাপ। নিখুঁত সাদা শরীরটা হলদেটে হয়ে গেছে দেখে আমার বিশ্বাসই হতে চায়নি।

অবশ্যই দোষটা আইওর। শিপ বাঁকা পথে চাঁদটার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে নেমেছে তিন হাজার কিলোমিটার। আর প্রতিদিনই সেখানে দু-চারটা জ্বালামুখ কয়েক মেগাটন সালফার উগরে দেয় আকাশের দিকে। তোমরা অবশ্যই ছবি দেখেছ, কিন্তু এর উপর ঝুলে থাকা যে কতটা মানসিক চাপের ব্যাপার সেটা কল্পনাও করতে পারবে না। আমি ফিরে আসতে পারলেই বাঁচি, অথচ অপেক্ষা করছি এরচে রহস্যময় কিছু একটার জন্য। হয়ত জিনিসটা আইওর চেয়ে অনেক বেশি ভয়াল, কে জানে?

ছ নম্বর বিস্ফোরণের সময় আমি উড়েছিলাম কিলাওয়ার উপর, সেটাও ভয়ংকর, কিন্তু এর সাথে কোনো… কোনো দিক দিয়েই তুলনা করা যায় না। এখন আমরা রাতের আকশের উপর। রাতটাই মাটি। একটু দেখলেই অনেক ভাবার উপাদান পেয়ে যাবে। আমি যেমন দোযখে যাওয়ার ভয় পাই এটা দেখতে ঠিক তেমন…

অনেক সালফার লেকই আলো দেয়ার মতো গরম, কিন্তু আলোেটা আসে মূলত বিদ্যুৎ চমক থেকে। কয়েক মিনিট পর পরই মনে হয় উপগ্রহটা ফেটে পড়বে। যেন একটা দানবীয় ফটোফ্ল্যাশ এর উপর দিয়ে চলে যায়। উদাহরণটা খারাপ হল না, কী বল? আইও আর বৃহস্পতির সংযোগ হল বিরাট ফ্লাক্স টিউব। সেটা দিয়ে প্রতি মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুৎ বয়ে যায়। যখন তখন সেখানে কিছু না কিছু দুর্ঘটনা ঘটছেই। এরপর হঠাৎ সৌরজগতের সবচে বড় বিদ্যুৎ চমকের আলো দেখেই আমাদের সার্কিট ব্রেকারের অর্ধেক লজ্জা পেয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।

ঠিক এখনো একটা বিস্ফোরণ হল, বিরাট এক মেঘ আসছে আমাদের দিকে, সূর্যালোকের সিঁড়ি বেয়ে। কবে যেন ধরেই ফেলে। অবশ্য ভয় নেই, এত উপরে উঠে ধরে ফেললেও আর তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু এই বিস্ফোরণের ক্ষুধার্ত মহাকাশের দানব-আমাদের না খেতে পারলে তার শান্তি নেই।

এখানে এসেই আমার মনে হল আইও কিছু একটা মনে করিয়ে দিতে চায়। দু দিন কাজ করেছি এ নিয়ে। শেষে মিশন আর্কাইভের সাহায্য নিতে হল-শিপের লাইব্রেরি কোনো কাজেই লাগেনি। মনে আছে, কীভাবে দ্য লর্ডস অব দ্য রিংস এর সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম দিমিত্রি? আমরা তখন ছোট, অক্সফোর্ড কনফারেন্সে ছিলাম। এই আইও হচ্ছে সেই মোরভোর, তৃতীয় অধ্যায়ে দেখ। সেখানে একটা প্যারায় লেখা, …গলা পাথরের নদী হয়ত তাদের পথ হবে… যে পর্যন্ত তারা শান্ত না হয়, মরা ড্রাগনের মতো কুঁচকে শুয়ে না পড়ে ব্যথায় ভরা বসুন্ধরায়। এ হল খাঁটি উদাহরণ। কীভাবে টোকেন পঁচিশ বছর আগেই আইওর খবর জানতো কে জানে! এটা প্রকৃতিকে নকল করে লেখা উপন্যাস হওয়ার কথা।

যাক, আমাদের সেখানে ল্যান্ড করতে হচ্ছে না। আমাদের চীনা সহকর্মীরা এমন করতে চাইলেও আমি তা ভাবতে পারি না। একদিন সম্ভব হতে পারে। কিছু কিছু এলাকা একেবারেই শান্ত দেখায়, সালফারের জোয়ার সেখানে কম।

কদিন আগে কে বিশ্বাস করতে পারত যে আমরা বৃহস্পতি ছাড়িয়ে ওপাশের কক্ষপথে এসে পৌঁছব সবচে বড় গ্রহকে হেলা করে! এবার আমরা তাই করছি। না বৃহস্পতি, না আইও, আর না ডিসকভারি। আমরা খুঁজছি সেই… আর্টিফ্যাক্টটা। কোনো এক সভ্য প্রাণীর বানানো কৃত্রিম একটা জিনিস, প্রাকৃতিক নয়। চাঁদেরটা নয়, বৃহস্পতিরটা।

ওটা এখনো দশ হাজার কিলোমিটার উপরে, মুক্ত এলাকায়। কিন্তু যখনি টেলিস্কোপ দিয়ে তাকাই, মনে হয় একেবারেই মসৃণ। যত কাছেই জুম করি না কেন, একই রকম মসৃণ-চোখে দেখে শেষ করা যায় না। দু কিলোমিটার লম্বা, যদি কঠিন হয়ে থাকে তো ওজন হবে শত শত কোটি টন।

আসলেই পুরোটা খাঁটি? এ থেকে কোনো রাডার প্রতিদ্বন্দ্বী হয় না। যখন আমাদের দিকে ফিরে থাকে তখনো না। আমাদের চোখে এটা তিন লাখ কিলোমিটার নিচের বৃহস্পতির মেঘের রাজ্যে বসিয়ে দেয়া কালো এক শ্লেট।

আকারের অনুপাতটা বাদ দিলে হুবহু সেই চাঁদের মনোলিথই যেন।

কালকে আমরা ডিসকভারিতে যাচ্ছি। তাই জানি না আবার কখন সময়-সুযোগ হবে কথা বলার। কিন্তু পুরোনো বন্ধু, শেষ করার আগে আরো একটা কথা বলার থাকে।

ক্যারোলিনের ব্যাপারে কিছু কথা… সে কখনোই বুঝতে চায়নি কেন পৃথিবী ছাড়তে হচ্ছে আমাকে। এ একটা ব্যাপারে ভয় পাই, ও হয়ত কখনোই আমাকে ক্ষমা করবে না। কোনো কোনো মেয়ে মনে করে ভালবাসাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না-বরং শুধু ভালবাসাই সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। হয়ত তারাই ঠিক… যেই ঠিক হোক, এখন আর এসব যুক্তি দেখানোর মানে নেই।

সুযোগ পেলেই ওকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করো। ও মেনইল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার কথা বলে। মাঝে মাঝে ভয় হয় ও যদি… তুমি যদি ওর কাছাকাছি না

যেতে পার তো ছেলেটাকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করো। আমি যতোটা বলি, তারচে অনেক বেশি মিস করি ক্রিসকে।

ও আংকল দিমিত্রিকে বিশ্বাস করবে-যদি তুমি বল যে বাবা আজও ওকে একই রকম ভালবাসে এবং সুযোগ পেলেই যত তাড়াতাড়ি পারে চলে আসবে।

১৭. ডিসকভারিতে

সবচে বেশি সুবিধার সময়েও কোনো পরিত্যক্ত অকেজো স্পেসশিপকে কজা করা চাট্টিখানি কথা না। আসলে কাজটা সোজা-সাপ্টা বিপজ্জনক।

ওয়াল্টার কার্নো জানে, এ-ই পরম সত্য; কিন্তু নিজের ভিতরে ব্যাপারটা আগে এভাবে অনুভব করেনি শতমিটার লম্বা ডিসকভারিকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরতে দেখে যেভাবে বুঝতে পারছে-তারা অবশ্য এখন নিরাপদ দূরত্বে। কয়েক বছর আগের সংঘর্ষে ডিসকভারির সামনের গোল অংশটার ঘোরা বন্ধ হয়ে যায়, যেটাকে লোকজন করোসেল বলে। এর ফল হল ভয়ংকর। আগে করোসেলকে ঘুরতে হত নিজের অক্ষে, ফলে ডিসকভারির সামনের অংশে অভিকর্ষ থাকত কিছুটা, সে ঘোরাটা পরিবর্তিত হয়ে এখন সারা ডিসকভারিই ঘোরে! কোনো এক ড্রাম বাদকের ছুঁড়ে দেয়া কাঠির মতো শিপটা নিজের অর্বিটে ঘুরছে ধীরে ধীরে।

প্রথম সমস্যা হল সেই ঘোরাটাকে বন্ধ করা। মরার ঘূর্ণন ডিসকভারিকে শুধু নিয়ন্ত্রণের বাইরেই নিয়ে যায়নি, বরং করেছে অগম্য। ম্যাক্স ব্ৰেইলোভস্কির সাথে স্যুট পরে নিয়ে কানোর নিজেকে খুব অযোগ্য মনে হল, এটা তার কাজ না। সে এর মধ্যেই মুখ আঁধার করে ব্যাখ্যা করেছে, আমি একজন স্পেস ইঞ্জিনিয়ার, স্পেস মাংকি নই যে লাফালাফি করে শিপ পার হব।

কিন্তু করতেই হবে কাজটা। আর একমাত্র তারই সে দক্ষতা আছে যা দিয়ে ডিসকভারিকে আইওর গ্রাস থেকে রক্ষা করা যায়। ম্যাক্স বা তার সহকর্মীরা অপরিচিত সার্কিট ডায়াগ্রাম নিয়ে কাজ করে, তারা আরো প্যাঁচ লাগাবে। কাজ করতে গেলে জ্বালানি ঠিক করে সব নির্ধারণ করে একে পথে নিয়ে আসতে এত সময় লাগবে যে ততোক্ষণে ডিসকভারি আইওর মুখেও পড়ে যেতে পারে।

হেলমেট মাথায় নেয়ার সময় ম্যাক্স প্রশ্ন করল, তুমি ভয় পাওনি, ঠিক?

আমার স্যুট নষ্ট করার মতো ভয় পাইনি। এটাকে হিসাবের বাইরে রাখলে… পেয়েছি।

ম্যাক্স মুখ বাঁকিয়ে হাসি দিল, আমার বলা দরকার, এটুকু ভয় এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয়। নাহলে তোমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠত। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমাকেও একটা দিব। কী যেন নাম দিয়েছ ওগুলোর?

ঝড়র কাঠি। ক্ৰমস্টিক। কারণ ডাইনীরা এগুলোতে চড়েই উড়ে বেড়ায়।

ও, হ্যাঁ–ব্যবহার করেছ কখনো?

চেষ্টা করেছিলাম একবার, কিন্তু আমারটা চলে যায় দূরে। সবার চোখে ব্যাপারটা মজার; শুধু আমার চোখগুলো ছাড়া।

সব পেশার জন্য ঠিক করা থাকে কিছু জিনিস-খালাসীদের হুক, কুমারের চাকতি, মিস্ত্রির খুন্তির মতো যন্ত্র, ভূতত্ত্ববিদের হাতুড়ি… যেসব মানুষ জিরো গ্র্যাভিটিতে নির্মাণকাজ করে তাদের অতি দরকারি এক যন্ত্র এই ক্ৰমস্টিক, এর উন্নয়ন হয়েছে এজন্যই। খুবই সরল যন্ত্র; এক মিটার লম্বা ফাঁপা টিউবের একপ্রান্তে পা-দানি আর অন্যপ্রান্তে টানা যায় এমন এক বাকানো ফাঁদের মতো অংশ। এক বাটনের চাপেই এর দৈর্ঘ্য পাঁচ-ছ গুণ হতে পারে। ভিতরে কম্পন শুষে নেয়ার অংশ আছে, তাই একজন দক্ষ কর্মী এ দিয়ে ভালই কাজ করতে পারবে। পা-দানিটাও প্রয়োজনে হুক হয়ে যেতে পারে। পরে আরো হাজারবার হাজারো পরিবর্তন আর ডিজাইন আনা হয়েছে, কিন্তু এ হল বেসিক ডিজাইন। ব্যবহার দেখতে খুবই সহজ, কাজে ততটা সহজ নয়।

এয়ারলক পাম্পের বাতাসের চাপ সমান করার কাজ শেষ হয়ে এক্সিট লেখা চলে এসেছে; দরজাগুলো খুলে গেলে তারা আস্তে ভেসে বেরিয়ে গেল বাইরের বিশাল শূন্যতায়।

দুশ মিটার দূরে ডিসকভারি ঘুরছে উইন্ডমিলের মতো, আইওর অর্বিটে তাদের পিছন পিছন আসছে এগিয়ে। আইওর দখলে আধখানা আকাশ, পেছনের বৃহস্পতিও দেখা যায় না। এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তাদের নিজেদের বাঁচাতে হবে আইও আর বৃহস্পতির মাঝে বয়ে যাওয়া ফ্লাক্স টিউবের হাত থেকে সেটা করতে হলে দু গ্রহের সংযোগে থাকা চলবে না। এত কিছুর পরেও তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা অত্যন্ত বেশি। আরেক আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য পনের মিনিট সময়ও হাতে নেই।

সময়মতো কানোর স্যুটে সমস্যা দেখা দিল, পৃথিবী ছাড়ার সময় এটা আমার গায়ে ঠিকমতো লেগেছে। সে বলল আফসোসের সুরে, কিন্তু এখন আমার অবস্থা বাদামের খোসার ভিতর বাদামের মতো।

স্বাভাবিক, ওয়াল্টার। রেডিও সার্কিটে নাক গলিয়ে বলল সার্জন কমান্ডার রুডেঙ্কা, হাইবারনেশনে দশ কেজি ওজন কমে, তোমার জন্য ভালই হত কিন্তু এরি মধ্যে ফিরে এসেছে তিন কিলো।

সুন্দর একটা জবাব খুঁজে পাওয়ার আগেই সে নিজের শরীরটাকে শিপের বাইরে ভেসে যেতে দেখল।

রিল্যাক্স কর, ওয়াল্টার। বলল ব্রেইলোভস্কি, ঘুরতে শুরু করলেও জেট গ্লাস্টার অন করো না, দেখা যাক কী করতে পারি।

কার্নো কমবয়েসি ছেলেটার ব্যাকপ্যাক থেকে আসা হালকা ধোয়া দেখতে পাচ্ছে, সেটার ছোট্ট জেট ইঞ্জিনই তাদের নিয়ে যাচ্ছে ডিসকভারির দিকে। প্রত্যেক ছোট ধোয়া-কুণ্ডলীর সাথে সাথেই দুই শিপের মাঝের দড়ি ধরে আরো এগিয়ে যায় ওরা। একটা ইয়ো-ইয়ো যেমন পৃথিবীর বুকে ওঠানামা করে, সেভাবেই ঝুলতে ঝুলতে এগুচ্ছে সামনে।

পরিত্যক্ত শিপটার দিকে যাওয়ার আর কোনো নিরাপদ উপায় নেই। ডিসকভারি যে অক্ষ ধরে ঘোরে সেটার কাছাকাছি পৌঁছতে হবে। ডিসকভারির ঘূর্ণন কেন্দ্র প্রায় শিপটার মাঝামাঝি, মূল অ্যান্টেনা কমপ্লেক্সে। ব্রেইলোভস্কি এ পথ ধরেই যাচ্ছে সরাসরি-তার কাঁধে ভীত অংশীদার। কার্নো নিজেকেই প্রশ্ন করে, দুজনকেই কীভাবে থামাব একসাথে?

এখন তাদের সামনের আকাশে বোকার মতো ঘুরছে ডিসকভারি, দেখতে অনেকটা যেন ডাম্বেল। যদিও এটার এক একটা ঘূর্ণন শেষ করতে কয়েক মিনিট সময় নেয়, তবু প্রান্তের দিক বেশ জোরেই ঘুরন্ত। ওয়াল্টার কার্নো সেগুলো উপেক্ষা করে সামনের অনড় জায়গাটুকুর দিকে তাকালো।

আমি সামনের ঐদিকটা টার্গেট করে যাচ্ছি। বলল ব্রেইলোভস্কি, সাহায্যের চেষ্টা করো না আর সামনে যাই হোক অবাক হওয়ার দরকার নেই।

আচ্ছা, ও যাই হোক দিয়ে কী বোঝাতে চায়? নিজেকেই জিজ্ঞেস করল কার্নো। এর মধ্যেই অবাক না হওয়ার জন্য মনকে প্রস্তুত করে নিয়েছে খানিকটা।

পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই সব ঘটে গেল। ব্রেইলোভস্কি ক্ৰমস্টিক ট্রিগার টিপে দিয়ে চার মিটার দূরে শিপের সাথে যোগাযোগ করে একদিকে, অন্যদিকে ক্ৰমস্টিক ভেঙে যাওয়া শুরু করে। শক এবজর্ভিং অংশ ব্রেইলোভস্কির সাধারণ ভরবেগ সামলে নেবে সহজেই। কিন্তু কার্নো আশা করেছিল তাকেও অ্যান্টেনা মাউন্টের দিকে নিয়ে যাবে; এখানেই সমস্যা। জিনিসটা আবারো দ্রুত প্রসারিত হয়ে রাশিয়ানের ভরবেগ সামলে নিল, কিন্তু দুজন থাকায় ম্যাক্স ঠিকই ডিসকভারির গায়ে ধাক্কা খেয়ে একই গতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। কার্নোর পাশ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে আবার মহাশূণ্যে পড়ে ছিটকে। ভয় পাওয়া আমেরিকানের হাতে শুধু একটা চিকণ হাসি দেয়ার সময় ছিল যখন ম্যাক্স তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। বেচারা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সব সময়।

ধরে রাখা লাইনে দ্রুত একটু ঝাঁকি উঠেই বড়সড় ঢেউ আসে। বিপরীত গতি প্রায় শেষ; আপাতত তারা ডিসকভারির সাপেক্ষে অনড়। কার্নো কোনোমতে সামনের হাতলে পৌঁছতে পেরেই দুজনকে টেনে আনল ভিতরের দিকে।

কখনো রাশিয়ান রোলেট খেলার চেষ্টা করেছ? সে প্রশ্ন করে দম ফিরে পেয়েই।

না-এটা আবার কী?

সময় পেলে অবশ্যই শিখিয়ে দেব। খেলাটা এ কাজের মতোই। বিরক্তি আনতে কোনো জুড়ি নেই।

আশা করি ওয়াল্টার তুমি ম্যাক্সকে কোনো ভয়ংকর কাজ করতে বলবে না, ঠিক? ডক্টর ডেস্কো এমনভাবে কথাটা বলল যেন সে সত্যি সত্যি আঘাত পেয়েছে। কার্নো মনে মনে ঠিক করে ফেলে, জবাব না দেয়াই নিরাপদ; প্রায়ই রাশিয়ানরা তার অদ্ভুত রসিকতা বুঝতেই পারে না। তুমিতো আমাকে প্রায় বোকা বানিয়ে ছেড়েছিলে… সে এত আস্তে আস্তে বলল যাতে মেয়েটা শুনতে না পায়।

এর মধ্যেই তারা বাইরে দিয়ে পৌঁছে গেছে ঘুরতে থাকা শিপের কেন্দ্রে সে আর এটার ঘূর্ণনের ব্যাপারে চিন্তা করে না-বিশেষত তার দৃষ্টি ধাতব প্লেটগুলোর উপরে পড়ার পর। সামনের মইটা অনেক বড়, ডিসকভারির মূল গঠন যে লম্বা শরীর-মই চলে গেছে সেটার বাইরে দিয়ে। গোল কমান্ড মডিউল আর এর পেছনের অংশটা মনে হচ্ছে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে; যদিও সে ভালমতোই জানে যে সে দূরত্বটা মাত্র পঞ্চাশ মিটার।

আমিই আগে যাচ্ছি। দুজনের দড়িকে পেঁচিয়ে নিতে নিতে বলল ব্ৰেইলোভস্কি, মনে রেখ, পাহাড়ের নিচু ঢাল ধরে নামার মতো হবে। কোনো চিন্তা নেই, এক হাতেই ধরে রাখতে পারবে নিজেকে। এমনকি একদম নিচেও মাধ্যাকর্ষণ দশভাগের একভাগ। এ কাজটাই হল… যেটাকে তুমি বল একদম সহজ, চিকেনশিট-মুরগির ইয়ে…

মনে হয় তুমি চিকেনফিডের কথা বলছ। যদি তোমার কাছে বিষ্ঠা আর খাবার একও হয়, তবু আমিই আগে যাব। উল্টোদিক উপরে দিয়ে মই বেয়ে নামতে পছন্দ করি না; তা অভিকর্ষ যত কমই হোক না কেন।

এর দরকার ছিল, কার্নো জানে। তার এই প্রায় দ্র ঠাট্টার জোরে সে অনেক ক্ষেত্রেই জিতে যায়। নাহলে হয়ত উপেক্ষা করা হতো। তাছাড়া এ ব্যাপারটা পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে অনেক কমিয়ে দেয়। বাড়ি থেকে শতকোটি কিলোমিটার দূরে; ঢুকছে মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে সবচে বিখ্যাত পরিত্যক্ত দেহের ভিতরে, যেটা দেখেছে তার সব কুকে একে একে শেষ হয়ে যেতে। একে একবার এক সাংবাদিক বলেছিল স্বর্গের দরজা; তবে পাপীরাও এ দরজা ধরে নরকে যেতে পারবে-তুলনাটা মোটেও খারাপ নয়। এসব ছাড়াও পরিবেশকে আরো মজাদার করার ব্যবস্থা আছে, নিচের দুঃস্বপ্নের মতো আধ আকাশ ভরা চাঁদটাকে মন থেকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করলেও বেহায়ার মতো সে বাদ পড়ে না। যতবার কার্নো ডিসকভারির মই-হাতলে হাত দেয়, ততবার সালফারের ধুলোয় ভরে ওঠে গ্লাভস।

অবশ্যই ব্রেইলোভস্কির কথা ঠিক, এ শিপের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘোরার জন্যে যে অভিকর্ষ তৈরি হয় তাকে সহজে মোকাবিলা করা যাবে। এটা ব্যবহার করে উল্টো কার্নোর সুবিধা হচ্ছে, পাওয়া যাচ্ছে দিকনির্দেশ।

তখন হঠাৎ করেই তারা সেই বিরাট গোলকের বাইরের অংশে চলে গেল যেটাকে বলা হয় ডিসকভারির কন্ট্রোল ও লাইফ সাপোর্ট মডিউল। মাত্র কয়েক মিটার দূরেই সেই ঐতিহাসিক ইমার্জেন্সি হ্যাঁচ।

আশা করি ভিতরে যেতে পারব। বলল ব্রেইলোভস্কি, সারাপথ কষ্ট করে এসে হ্যাঁচ লক করা পেলে ব্যাপারটা খুব করুণ হবে, তাই না?

সে এয়ারলক স্ট্যাটাস লেখার উপরের সালফার আবরণ সরিয়ে হতাশ হল।

মরা, অবশ্যই। দশটা বছর… আমি কি ম্যানুয়ালি কন্ট্রোল করার চেষ্টা করব?

করলে ক্ষতি নেই-তবে লাভও নেই।

তোমার কথাই ঠিক, আচ্ছা… ম্যানুয়ালি যাচ্ছি…

বাঁকাচোরা দেয়ালের চুলের মতো চিকণ রেখাটাকে বড় হতে দেখা এবং তা থেকে হাল্কা ধোয়ার স্পেসে বেরিয়ে যেতে দেখাটা ভয়ংকর। সাথে একটা ছোট কাগজের টুকরোও হারিয়ে গেল মহাকাশে। কোনো মেসেজ নাকি? তারা কোনোকালেই জানবে না। জিনিসটা একইভাবে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে গেল তারার মেলার ওপাশে।

ব্রেইলোভস্কি অনেকক্ষণ ধরে ম্যানুয়াল কন্ট্রোলটা ঘোরাচ্ছে। কালো, রাগী চেহারার পথটা এক সময় গেল খুলে। কার্নো আশা করেছিল অন্তত ইমার্জেন্সি লাইটগুলো এখনো কাজ করছে, কিন্তু তেমন ভাগ্য নেই তার।

তুমিই এবার বস, ওয়াল্টার। আমেরিকান এলাকায় স্বাগতম।

ভিতরে ঢুকে পরিবেশটা তেমন স্বাগত মনে হচ্ছে না। অন্তত তার হেলমেটের আলো চারপাশে পড়ার পর এমন কথা মনে হতেই পারে। যতটুকু মনে পড়ে তার, সবতো ঠিকই আছে। এরচে বেশি কী আশা করেছিলাম আমি? রেগে নিজেকেই প্রশ্ন করল সে।

ম্যানুয়ালি দরজাটা বন্ধ করতে সময় লাগল আরো বেশি, কিন্তু আর কোনো বিকল্প নেই পাওয়ার ফিরে আসার আগ পর্যন্ত। বন্ধ করে দেয়ার আগের মুহূর্তে কার্নো বাইরে তাকানোর একটু ঝুঁকি নিল।

বিষুবরেখার কাছাকাছি একটা দোলায়মান নীল সমুদ্র দেখা যায়, নাকি হ্রদ? সে নিশ্চিত, এটা কয়েক ঘণ্টা আগেও সেখানে ছিল না। উজ্জ্বল হলুদ আলো হল সোডিয়ামের গলিত রূপের বহিঃপ্রকাশ। আলোটা দেখা যায় হ্রদের আশপাশে। আর রাতের পুরো আকাশ প্লাজমা ডিসচার্জে ভরা। প্লাজমার ভৌতিক নিঃসরণ এ উপগ্রহের এক নিয়মিত ছবি।

ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্নের উপাদান এটা। এ-ও যেন যথেষ্ট নয়, এর পরও এক পাগলাটে শিল্পীর পরাবাস্তবতার আরো বহু আঁচড় পড়েছে এর উপর। সরাসরি আগুনের উৎসগুলো থেকে উঠে এসে অদ্ভুত জ্বলন্ত উপগ্রহের আগুন-গোলাগুলো যেন শেষ হয়ে যাওয়া কোনো বুলফাইটারের চোখ, যে মৃত্যু দেখছে সামনে। আর সেই মৃত্যু হল চিকণ হয়ে যাওয়া চাঁদটার দেহ, যেন পাগলা ষাড়ের প্রকাণ্ড শিং।

চিকণ চাঁদের মতো উঠে আসছে বৃহস্পতি। এর অর্বিটে একই পথে চলতে থাকা ডিসকভারি আর লিওনভকে যেন সে স্বাগত জানাবে।

১৮. উদ্ধার অভিযান

অদ্ভুতভাবে ভূমিকা উল্টে গেছে পেছনের হ্যাঁচটা বন্ধ হওয়ার পরই। তৃপ্তি লাগছে কার্নোর। ও এখন নিজের বাড়িতেই। আর ঠিক উল্টোটাই যেন খাটে ব্ৰেইলোভস্কির বেলায়। ডিসকভারির ভিতরের পিচ-কালো করিড়োর আর টানেলের গোলক ধাঁধা তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না মোটেও। ম্যাক্স-এ শিপ সম্পর্কে যা জানে তা শুধুই ডিজাইন ড্রয়িং দেখে দেখে। আর কার্নো ডিসকভারির এখনো জন্ম না নেয়া জমজের উপর মাসের পর মাস এত্তো কাজ করেছে যে চোখ বাঁধা অবস্থায় অলিগলি ছুঁড়ে বেড়াতে পারবে-বেশ আরামেই।

কাজ এগুনো খুবই কঠিন। এ অংশটা তৈরিই হয়েছে জিরো গ্র্যাভিটির জন্য। আর অনিয়ন্ত্রিত পাকচক্র এটাকে উপহার দিয়েছে কৃত্রিম অভিকর্ষ। তাও ভাল-কিন্তু গতিটা সব সময়ই আরো বেশি অসুবিধা গড়ে দিচ্ছে কাজের জন্য।

আমাদের প্রথমে যা করণীয়, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কার্নো, একটা হ্যান্ডহোল্ড ধরার আগে কয়েক মিটার পিছলে গিয়ে, এ মরার বনবনানি থামানো… কিন্তু ইঞ্জিন ছাড়া কোনোকালেও সম্ভব না। আল্লা আল্লা করে শুধু এটুকুই আশা করি যে, ডেভ বোম্যান স্পেসশিপটাকে এতিম করে যাওয়ার আগে যন্ত্রপাতির প্রতি একটু হলেও দয়া দেখিয়েছে।

ও শিপকে মরুভূমি করে চলে গেছে-তুমি শিওর? তার ফিরে আসার ইচ্ছা ছিল হয়ত।

হতে পারে। মনে হয় না কোনোকালে আমরা জানতেও পারব। ও নিজেও যদি নিজের ভিতরটা জানত… সেটাকেও বড় করে দেখা যায়।

ওরা এরই মধ্যে পোড বে তে চলে এসেছে। এটা ডিসকভারির স্পেস গ্যারেজ। সাধারণত এখানে তিনটা আয়তাকার মডিউল থাকে। প্রতিটায় চড়তে পারে মাত্র একজন। স্পেসশিপের বাইরের টুকটাক কাজেই বেশি ব্যবহার করা হয় এগুলোকে। শুধু তৃতীয় পোডটা বাকি। প্রথম খোসাটা ফ্র্যাঙ্ক পোলের রহস্যময় অ্যাক্সিডেন্টে খোয়া গেল। দু নম্বরটা আছে ডেভ বোম্যানের সাথেও যেখানেই থাক না কেন গত দশ বছর ধরে।

পোড বে টায় দুটা বাড়তি স্পেস স্যুটও দেখা যায়। হেলমেট ছাড়া এগুলোকে ভাল দেখাচ্ছে না। মুণ্ডু কাটা এক জোড়া ঝুলন্ত লাশ। আন্দাজ করতে কষ্ট হয় না–এগুলো দশ বছর ধরে দুজনের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রতীক্ষা তাদের জন্য যারা হাজার বছরেও ফিরে আসবে না। ব্ৰেইলোভস্কির স্যুটটা হয়ত ওদের দুরবস্থা দেখে কাজ বন্ধ করে দেবে।

কার্নোর রসজ্ঞান-বলা ভাল কোনো কোনো ক্ষেত্রে দায়িত্বজ্ঞানহীন রসজ্ঞান এ মুহূর্তে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অবশ্য এটা দুঃখজনক হলেও অবাক করা ব্যাপার না।

ম্যাক্স, ও একটা ভয়াল সিরিয়াস সুরে বলল, প্লিজ স্পেসশিপের বিড়ালের পেছনে দৌড়াতে যেও না।৯৭।

কয়েক মিলিসেকেন্ডের জন্য ব্রেইলোভস্কি অতলে পড়ে গেল। খুব একটা সহজ না হয়েই বলল, আশা করি তুমি ওটা বোঝাওনি… সাথে সাথেই সংযত করল নিজেকে। এখন দুর্বলতা প্রকাশের সময় না। আবার বলল, যে আমাদের লাইব্রেরিতে ঐ ছায়াছবিটা রেখেছে তাকে দেখে নেব।

সম্ভবত ক্যাথেরিনা। প্রত্যেকের সাইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স পরীক্ষার জন্য। যাই হোক, গত সপ্তায় ছবিটা দেখার সময় তুমি ঘর ফাটিয়ে হেসেছিলে।

ব্রেইলোভস্কি একদম চুপসে গেল-কার্নো ভুল কিছু বলেনি। সে সময়টা নিজের স্পেসশিপ লিওনভে উষ্ণ আর আলোয় ভরা পরিবেশে ও কাটিয়েছে বন্ধুদের মাঝে-কোনো পিচ কালো বরফ হয়ে যাওয়া স্পেসশিপে নয়। যেভাবেই বলা হোক না কেন, এ শিপটা ভূতে পাওয়া। একবার যেহেতু এলিয়েন পশু দেখা দিয়েছে বৃহস্পতির কোথাও-আর ভয় না পাবার যুক্তি খোঁজার দরকার নেই। এখন কোনো এক অপ্রতিরোধ্য এলিয়েন জন্তুর কল্পনা করা একেবারে সহজ যে আঁধার করিডোরগুলো বেয়ে চলেছে এমন কিছু পাওয়ার আশায় যা হয়ত সে দশ বছর ধরে খাচ্ছে না। আঁধার খুব ভয়াবহ। কোনো মানুষের সাহস মাপার শ্রেষ্ঠ নিক্তি হতে পারে ডিসকভারি। বাসা থেকে শত শত কোটি মাইল দূরে, শিকারী এলিয়েনের এলাকায় দশ বছরের রহস্যঘেরা আর আইওর সালফার ধুলায় বোঝাই এক শিপ যা শুধু অন্ধকারে ভরা, যার পাঁচ সদস্যই তিনটা আচমকা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল। সেই স্পেস ক্রুদের লাশ যে নেই তাই বা কে জানে?

এর পুরোটাই তোমার দোষ-দাদী (হয়ত তুমি আজ সাইবেরিয়ান তুন্দ্রা অঞ্চলে তোমার ভালবাসা মাখা কঙ্কাল নিয়ে শুয়ে আছ।)-আশা করি আমার মনটাকে সারা জীবনের জন্য ঐসব ভয়াল রূপকথায় ভরে দাওনি। আজও চোখদুটো বন্ধ করলে সেই বাবা যোগীকে দেখি যে সবুজ বনের মাঝে থাকা তার ছোট্ট কুঁড়ের ভেতর থেকে মাংস ছাড়া মুরগীর পাগুলো পরিষ্কার করছে…

যথেষ্ট হয়েছে। আমি একজন মেধাবী তরুণ ইঞ্জিনিয়ার যে রাশিয়ার সবচে গুরুত্ববহ মহাকাশ মিশনে সবচে বড় চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করবে। আমি যে প্রায়ই ভয় পাওয়া এক ছোট ছেলে তা কস্মিনকালেও আমেরিকান বন্ধুকে জানাতে চাই না…

ডিসকভারি এবার আলোর দিকে। ভেতরে সেই একই অন্ধকার। শব্দটা ভয় কাটাতে মোটেও সাহায্য করল না-বরং আরো বাড়িয়ে দিল। অনেক শব্দ। সেগুলো এত ক্ষীণ যে স্পেস স্যুটের আওয়াজ ছাপিয়ে অভিজ্ঞ একজন অ্যাস্ট্রোনট ছাড়া আর কেউ ধরতে পারবে না। কিন্তু ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি মৃত্যুপুরীর নিরবতায় কাজ করে করে একজন অভ্যস্ত মানুষ। শব্দগুলো উল্টো পথে স্নায়ুতে আঘাত করছে যদিও ও ভালমতোই জানে যে এটাই নিয়ম, হঠাৎ করে আলোতে গেলে ছোটখাট ক্যাচক্যাচ এমনকি বিস্ফোরণের শব্দও হতে পারে। কারণ শিপটি এক কয়লা আগুনের গোলার উপরে রোস্ট করতে থাকা কোনো প্রাণীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে গত দশ বছর। এটা বৃহস্পতীয় এলাকা, তাই যখন ডিসকভারি গ্রহরাজের পেছনে থাকে-তখন অকল্পনীয় ঠাণ্ডা। যখনি সূর্যের দেখা পাবে, তখন বরফের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সৌর জগতের আলোক দেবের কাছেতো অভিযোগ জানাবেই। আলো আর আঁধারের মাঝে এখানে সব সময়ই বড় ব্যবধান।

মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো এবার তার স্পেসস্যুটও সমস্যা শুরু করে। এখন ব্রেইলোভস্কি উভয় সংকটে। স্যুটের জয়েন্টের উপর কাজ করা সব শক্তি বদলে গেছে ভয়ংকরভাবে। এমনকি সে আর নিজের মনের গতিবিধি ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। আমি এক আনাড়ী-মাত্র নিজের ট্রেনিং শুরু করতে বসেছি… সে রেগে গিয়ে নিজেকেই বলতে লাগল। কোনো ঘটনা এ অবস্থাটা ভেঙে দেবে। এখনি…

ওয়াল্টার, চল এটমোস্ফিয়ার পরীক্ষা করে দেখি।

চাপ ঠিক আছে। তাপমাত্রা…কমই। শূন্য থেকে একশো পাঁচ ডিগ্রি কম।

দারুণ! রাশিয়ান আবহাওয়ার মতোই। আঁটসাট। যেভাবেই হোক, আমার স্পেসস্যুটের ভিতরের বাতাস ঠান্ডাটাকে দূরে সরিয়ে রাখবে।

আমরা এগিয়ে যাব। কিন্তু তার আগে আমার লাইটটা তোমার চেহারায় বুলিয়ে নিই। তুমি নীল হয়ে যেতে নিলে যেন বুঝতে পারি। কথা বলতে থাক।

ব্রেইলোভস্কি ওর ভিজর আনলক করে মুখের সামনের প্লেটটা সরিয়ে দিল। কয়েকটা বরফ শীতল আঙুল ওর গালে আদর বুলিয়ে দিলে ও লাফিয়ে ওঠে ভয়ানকভাবে। ঠিক ফিঞ্চের মতো-যেগুলো দানা খুঁটে খাওয়ার সময় মানুষ দেখলে লাফায়। এরপর একটা গভীর শ্বাস নিল-ভয় থেকে বেঁচে যাওয়ার শ্বাস।

ঠাণ্ডা… কিন্তু আমার লাংস এখনো জমে যাচ্ছে না। একটা মজার গন্ধ পাচ্ছি। পুরনো, একেবারে পুরোনোই মনে হচ্ছে, যেন কিছু একটা… ওহ! না! আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে হঠাই ব্ৰেইলোভস্কি ফেসপ্লেট নামিয়ে ফেলল।

কী ব্যাপার, ম্যাক্স? এই প্রথম ব্যগ্র মনোভাব নিয়ে প্রশ্নটা করল কার্নো। কোনো জবাব নেই ব্রেইলোভস্কির পক্ষ থেকে। দেখে বোঝাই যায় নিজেকে ফিরে পেতেই ব্যস্ত রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়ার। আসলে ওকে দেখে মনে হচ্ছে ঐ চিরকালীন ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হবে এবার। অন্তত স্পেসসুটের জন্য আসলেই সব সময় ভয়াবহ। বমি করেই বসবে হয়ত।

দীর্ঘ নিরবতা। এরপর কার্নো ভরসা দেয়ার সুরে বলল, আমিই যাচ্ছি ভিতরে। সত্যি, আমি নিশ্চিত তুমি কোনো না কোনো ভুল করেছ। সবাই জানে, পোল হারিয়ে গেছে মহাশূন্যে। বোম্যান রিপোর্ট করেছে যে ও… আর সবাইকে বাইরে ফেলে দিয়েছে যারা মরেছিল হাইবারনেশনে থাকতেই। ডেভিড একজন মহাকাশযান অধিনায়ক আমরা ধরেই নিতে পারি কথাটা ঠিক। আর তার স্পেসস্যুটটাতো আমরা পোড বে তেই পেলাম। এখানে কেউ থাকতে পারে না। স্থানটা ভয়ানক ঠাণ্ডা। আরো কিছু বলে বসল নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভুলে গিয়ে, ঠাণ্ডাটা লাশকাটা ঘরের চেয়েও বেশি…

কিন্তু ধর। যেভাবেই হোক… অসুস্থ সুরে ফিসফিস করছে ব্ৰেইলোভক্তি, শুধু ধর যে বোম্যান শেষবারের মতো ফিরে এসেছে শিপে…আর মারা পড়েছে এখানেই।

কার্নো আস্তে করে তার ফেসপ্লেটটা তুলে ফেলার আগে একটা বিরাট নৈঃশব্দভরা সময় বয়ে যায় ডিসকভারিতে। এ সময়টায় ব্ৰেইলোভস্কি ওর দিকে তাকায়নি। যদি আর কারো ছায়া দেখা যায়-এ মানসিক অবস্থায় সেটা বিশ্বাস করে হার্টফেল করে মরে যেতে ও বোধহয় একটুও দেরি করবে না।

জমে যেতে থাকা লাংসের ভিতরে বাতাস ঢোকায় চেহারা কোঁচকায় কার্নো। এরপর নাক কুঁচকে ফেলল ঘৃণায়, এবার বুঝলাম কী বলতে চাও। কিন্তু তোমার চিন্তাকে তোমার নিজের সাথে দৌড়ে পালাতে দিচ্ছ কেন? আমি দশ বনাম এক রেটে বাজি ধরতে রাজি। গন্ধটা গ্যালি থেকে আসছে। সম্ভবত শিপ জমে যাওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে গেছে কিছু মাংস। বোঝাই যায় বোম্যান কর্তা হিসেবে যথেষ্ট ব্যস্ত ছিল। গন্ধটা পরিচিত কেন জানেন? শুনলে হাসবে, অনেক ব্যাচেলরের অ্যাপার্টমেন্ট চিনি যেগুলো থেকে হুবহু এ গন্ধ আসে।

হয়ত তোমার কথাই ঠিক। আশা করি। তেমনি আশা করি…

অবশ্যই আমি ঠিক। আর যদি ঠিক না হই…আরে বাপ, পচা লাশ আর মাংসের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? আমাদের করার মতো কিছু কাজ আছে, ম্যাক্স। যদি ডেভ বোম্যান এখনো এখানে থেকেই থাকে, সেটা বিরাট সুবিধার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে পুরো মিশনের জন্য। আর এ নিয়ে মাথা ঘামানো আমাদের ডিপার্টমেন্টের কাজ না–ঠিক, ক্যাথেরিনা?

সার্জন কমান্ডারের কাছ থেকে কোনো উত্তরই এল না। ওরা শিপের এত ভিতরে চলে গেছে যে, রেডিও কাজ করার রেঞ্জ শেষ। আসলেই তারা শুধু তাদের কাজই করবে। জীববিদ্যা বিভাগের কাজের সাথে প্রকৌশলের তেমন কোনো মিল নেই। আস্তে আস্তে ব্রেইলোভস্কি সাহস ফিরে পায়।

ওয়াল্টারের সাথে কাজের সুযোগ পাওয়াটা ওর জন্যে বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার প্রায়ই নরম আর বন্ধুসুলভ আচরণ করে। ও পুরোপুরি যোগ্য-আবার দরকার পড়লে পেরেকের মতো কঠিন যা মোটের উপর প্রায় সবকিছু ভেদ করে যায়।

এ দলটা মন্দ না। হয়ত একত্রে ওরা ডিসকভারিকে জীবনে ফিরিয়ে নিতে পারবে, হয়ত পৃথিবীতেও।

১৯. অপারেশন উইন্ডমিল

ডিসকভারি চিরন্তন ক্রিসমাস ট্রির মতো জ্বলে উঠলে ভিতর-বাইরের লাইটগুলো এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ভাসিয়ে দিল আলোয়-লিওনভ থেকে আনন্দের ঢেউ যেন শূন্যের ভিতর দিয়ে এগিয়ে এসে ভরিয়ে দিল পুনর্জন্ম লাভ করা শিপটাকে। সেই আনন্দ ঢেউই হঠাৎ পরিণত হয় আফসোসে। আবার লাইট উধাও।

আধঘণ্টা সব চুপচাপ। ডিসকভারির অবজার্ভেশন উইন্ডোগুলোতে এলার্মের হালকা আলো খেলতে শুরু করে কয়েক মিনিট পর। কার্নো আর ব্রেইলোভস্কি ভিতরে ঘোরাঘুরি করছে-দেখল সবাই। সালফারের হালকা পরতের জন্য ওদের আবছা দেখায়।

হ্যালো…ম্যাক্স, ওয়াল্টার, আমাদের কথা শুনছ? তানিয়া অর্লোভা ডাকল ওদের।

সাথে সাথেই মূর্তি দুটো ঘুরে দাঁড়ায়। নাহ্, শুধু নিজেদের সাথে কথা বলার জন্যই। ডিসকভারির একেক কোণে একেক সময় নানা ধরনের আলো জ্বলে ওঠে। লিওনভ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। পোড বের একটা দরজা ধীরে খুলে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেল দ্রুত। বড় অ্যান্টেনাটা আড়মোড়া ভেঙে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দশ ডিগ্রি।

হ্যালো, লিওনভ, অবশেষে কার্নোর কণ্ঠ, স্যরি। তোমাদের অপেক্ষায় রাখলাম অনেকক্ষণ। কী করি বল? খুব ব্যস্ত ছিলাম আমরা।

যা দেখেছি তার উপর হিসেব করতে হয়েছে খুব দ্রুত। ডিসকভারি নিয়ে আমাদের ভয়টা ভুল। আশঙ্কার চেয়ে অনেক অনেক ভাল আছে শিপটা। হালের ক্ষতি হিসাবে না ধরলেও চলে। বায়ুচাপ স্বাভাবিকের পঁচাশি ভাগ। ভালভাবেই দম নেয়া যায়-একটা সমস্যা ছাড়া। আমাদেরকে শিপে একটা বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। চারদিকে স্বর্গীয় দুর্গন্ধ।

সবচে ভাল খবরটা হয়ত জান-পাওয়ার সিস্টেম একেবারে ঠিক। প্রধান রিয়্যাক্টর* মোটামুটি, ব্যাটারিগুলোর আকার আকৃতি খারাপ না। সব সার্কিট ব্রেকার খোলা-হয়ত ডেভ বোম্যান শিপ ছাড়ার আগে ওগুলোকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করেছিল-সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ সব যন্ত্রপাতিই নিরাপদে আছে।

কিন্তু শিপকে আবার জীবন দেয়ার সময়ের মধ্যে এগুলোকে সম্পূর্ণ পরীক্ষা করাটা কঠিন হবে আমাদের জন্য।

কতক্ষণ লাগতে পারে? অন্তত লাইফ সাপোর্টগুলো আর ড্রাইভিং জিনিসপত্র ঠিকঠাক করতে? প্রশ্ন করল লিওনভ।

বলা কঠিন, ক্যাপ্টেন। ক্র্যাশ করার আগে হাতে আছে কদ্দিন?

কমপক্ষে এক হপ্তা নেবে চাঁদটার দিকে নেমে যেতে। তুমিতো জানই কীভাবে হিসাবটা ওঠানামা করে।

যাই হোক, যদি কোনো হঠাৎ টানে আমরা নেমে না যাই, আশা করি ডিসকভারিকে একটা নিরাপদ অর্বিটে টেনে নিতে পারব এই দোজখের দরজা থেকে।

কতদিন দরকার?

ও, বলিনি? সপ্তাখানেক।

কিছু দরকার?

না, ম্যাক্স আর আমি বেশ ভালভাবে কাজ করতে পারি। আবার একটা চক্কর মারব এখুনি। পুরো ব্যাপারটা আরেকবার খতিয়ে দেখে নিতে হয় যে…আমার এখন একটাই চাওয়া। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মহাকাশরথটাকে সচল করে তোলা।

ভুল হলে মাফ করো, ওয়াল্টার, কাজটা কি প্রয়োজনীয়? গ্র্যাভিটি মোটামুটি আরামদায়ক বলা যায়। কিন্তু আমরা কোনো অভিকর্ষ ছাড়াই সমাধান করেছি বহু সমস্যার।

আমি গ্র্যাভিটির নিকুচিও করি না। অবশ্য আকর্ষণটা চলাচলে সাহায্য করছে। বলা যায়। পুরো চক্রটাকে আবার চালিয়ে দিতে পারলে ডিসকভারির স্পিন বাঁধা পড়ে যাবে। এমনকি ঘোরাঘুরি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। ফলে এয়ারলকগুলো জুড়ে দিয়ে ই ভি এ বাদ দিতে পারব সহজেই। কাজ করাটা শতগুণ সহজ হয়ে যাবে।

ভাল আইডিয়া, ওয়াল্টার, কিন্তু তুমি কিছুতেই আমার শিপের সাথে ঐ কী বলে ইংরেজিতে… উইন্ডমিলকে মিলিয়ে ফেলতে যেও না। ধর কোনো একটা গণ্ডগোল হল আর ঐ অর্বিট চক্রটায়ও কোনো বিপদ এল নেমে…পরে কাজটা আমাদের সবাইকে কাঁদাবে।

মানলাম। আমরা ব্রিজের কাছে আসার আগে পেরুনোর চেষ্টা করব না। তাড়াতাড়িই যোগাযোগ করতে যাচ্ছি লিওনভের সাথে।

.

পরের দুদিন কেউ তেমন বিশ্রাম পায়নি। সময়টা কেটে যাবার পর কার্নো আর ব্রেইলোভস্কি ঘুমিয়ে পড়ে নিজেদের স্যুটেই। কিন্তু তার আগেই চষে ফেলেছে ডিসকভারি। মন খারাপের কিছুই পায়নি।

দেশ দুটোর স্পেস এজেন্সি আর স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রাথমিক রিপোর্টের পর স্বস্তি র নিঃশ্বাস ফেলল। ঠিক হওয়ার ফলেই মার্কিন সংস্থাগুলো তাদের পুরনো রাজনৈতিক চাল চালতে পেরেছে… ডিসকভারি কোনো কালেই পরিত্যক্ত ছিল না, বরং, সাময়িকভাবে অকার্যক্ষমকৃত যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ যান। আর এখনি শুরু হতে যাচ্ছে সেটার রিকন্ডিশনিংয়ের কাজ।

পাওয়ার নিয়ে সমস্যা নেই। পরের সমস্যাটা হল বাতাস। কারণ সব হাউজ ক্লিনিং যন্ত্রপাতিই ফেল মেরেছে এই মরার গন্ধটাকে সরানোর কাজে। কার্নোর কথাই ঠিক। গলিত খাবার। যখন রেফ্রিজারেশন সিস্টেম কিছু করতে পারেনি তখনই এগুলো পচতে থাকে। মহাকাশযানে জীবাণু কম বলে আস্তে-ধীরে গলেছে, তার উপর বিশাল ফ্রিজ থেকে একটু একটু করে গন্ধ বেরিয়ে এসেছে দেখে স্থায়িত্বও বেশি। কার্নোর কাছে অবশ্য এ ব্যাপারটাকে মোটেও বিরক্তিকর মনে হয়নি। বরং রোমান্টিক।

আমার শুধু চোখটা বন্ধ করতে হবে, সে বর্ণনা করছে, আর মনে হয় যেন অনেক আগেকার তিমি শিকারী কোনো জাহাজে চলে এসেছি। তুমি কি বাসী তিমির আসল গন্ধটা সম্পর্কে জানো, অথবা সারারাত শিকারের পর জাহাজ একদিন পরিষ্কার না করলে যে গন্ধ আসবে চেন সেটা?

ডিসকভারিতে একটা ভ্রমণ শেষ করে সবাই মেনে নিয়েছে যে এখানটাকে বুঝে নিতে খুব কম কল্পনাশক্তির প্রয়োজন। শিপের গুমোট বাতাসের সমস্যার সমাধান হয় বেশ ভালভাবে-অন্তত ম্যানেজ করে নেয়ার মতো অবস্থায় এখন ডিসকভারি। ভাগ্য ভাল যে এখনো রিজার্ভার ট্যাঙ্কে প্রচুর বাতাস পাওয়া যাচ্ছে। বড় সুসংবাদের একটা হল, প্রপেলারের নব্বইভাগ কার্যক্ষম। হাইড্রোজেনের বদলে এমোনিয়া বেছে নেয়ার পরও প্লাজমা ড্রাইভ ভালই কাজ করছে।

হয়ত কয়েক বছরের মধ্যে হাইড্রোজেনের বেশিরভাগ উবে গেছে প্রতিরোধ ব্যবস্থা আর বাইরের ভয়াল ঠাণ্ডা থাকা সত্ত্বেও। কিন্তু এমোনিয়ার সবটাই তরল। আর সেটুকুই পৃথিবীর কোনো এক নিরাপদ অর্বিটে নির্বিঘ্নে ফিরিয়ে নিতে যথেষ্ট-নিদেনপক্ষে রূপালী চাঁদের চারদিকে।

সম্ভবত ডিসকভারির প্রপেলারের মতো বনবনানিই শিপটাকে কজা করার পথে সবচে বড় বাঁধা। শাসা কোভলেভ কার্নো আর ব্রেইলোভস্কিকে তুলনা করল ডন কুইক্সোট আর শ্যাঙ্কো পাঞ্জার সাথে। তাদের উইন্ডমিল কজার কসরৎ সার্থক হবে এমন আশার কথাও শোনালো সবাইকে।

অবশেষে পরীক্ষার জন্য অনেকগুলো বিরতি নিয়ে ওরা শক্তি দিল করোসেলকে। বিশাল ড্রামটা দীর্ঘ দশ বছর পর নড়াচড়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। ডিসকভারি স্টার্ট করার জন্য খুব জটিল এক ধারা পেরিয়ে এসেছে তারা। আস্তে আস্তে প্রান্ত থেকে প্রান্তে ঘোরাটা বন্ধ হয়। এবার স্পিনিংয়ের শেষ চিহ্নটাও এটিচ্যুড কন্ট্রোল জেটের কারণে গায়েব হয়ে গেছে। ঘূর্ণন গতিহীনভাবে পাশাপাশি চলার আগ পর্যন্ত বেঁটেখাট লিওনভকে তাড়া করে বেরিয়েছে ডিসকভারি-লম্বা আকারের এক রহস্যময় স্পেসশিপ।

এখন একটা থেকে আরেকটায় যাতায়াত একদম সোজা। কিন্তু ক্যাপ্টেন অর্লোভা এখনো সরাসরি কোনো সংযোগ গড়তে দিতে রাজি নয়। প্রত্যেকেই তার সাথে একমত। কারণ ছোট দৈত্য আইও এগিয়ে এসেছে আরো। তাদের হয়ত এখনি এ যানটাকে ছেড়ে দিতে হবে। ছাড়তে হতে পারে স্পেসশিপ ডিসকভারি-যেটাকে বশ মানাতে ওরা এত কষ্ট করল।

তারা এখন ডিসকভারির অর্বিট ক্ষয়ের কারণ জানে, কিন্তু কোনো কাজেই আসবে না তথ্যটা। যতবার শিপটা বৃহস্পতি আর আইওর মাঝামাঝি এসেছে, ততবার এ দু দানোর অদৃশ্য প্রবাহ নলের কারণে সরে গেছে একদিকে। বিশ্ব থেকে বিশ্বে বয়ে চলা বিদ্যুতের এ মহানদী জাহাজকে একের পর এক আঘাতে আঘাতে ঠেলে দিয়েছে আইও নরকের দিকে। প্রতিবার।

প্রভাবের শেষ মুহূর্ত রুখে দেয়ার আর কোনো উপায় নেই। বৃহস্পতির একান্ত নিজের এক নিয়ম চলে এ এলাকায়। সেই অপ্রতিরোধ্য নিয়মের জন্যই চওড়া প্রবাহটা এতে প্রভাব ফেলবে। আইওর চারদিকের ভয়াবহ মেরুজ্যোতি-ঝড়ের সাথে সাথে মাঝে মাঝেই তাদের চমকে দেয়া চমক দেখা দেয়। তখুনি আমেরিকান যানটা অনেক কিলোমিটার নিচে নেমে যায় আর নিজের তাপ ঠিক রাখার সিস্টেম চালু হওয়ার আগেই দারুণ তাপদাহ জ্বালিয়ে দিতে চায় ডিসকভারিকে। কোনো কোনো সময় সেই বিদ্যুৎ নদী থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকার কারণে এ শিপ শুধু উত্তপ্ত হয়।

এ ব্যাখ্যা পাবার আগে হঠাৎ তাপ বাড়ার ঘটনা সবার কাছেই রহস্যময় লাগত। যে কোনো ধরনের ব্রেকিংই তাপ উৎপাদন করে। এখন আর সেই দুর্গন্ধ অবাক করে না। কারণ এ শিপ শুধু জমে ছিল না। কিছুক্ষণ জমাট ছিল, আর কিছুক্ষণ সেদ্ধ। এ কারণেই গন্ধটা বাড়াবাড়ি রকমের বেশি সময় ধরে জমে আছে ডিসকভারিতে।

আইওর আতঙ্ক জাগানিয়া চিত্র যে কোনো মেডিক্যাল টেক্সট বুকের রক্তাক্ত আর বীভৎস ছবিগুলোর চেয়েও দমবন্ধ করা। এখন সে ভূমি মাত্র পাঁচশ কিলোমিটার দূরে। একটা-মাত্র একটা রাজকীয় উদগীরণ দরকার ডিসকভারিকে ছাইয়ের সাথে মিশিয়ে নিতে। লিওনভ যথাযথ সম্মান দেখিয়ে ঝুলে আছে অনেক দূরে। কানো বেপরোয়া হয়ে উঠল। মূল ড্রাইভটা চালাবে।

কোন কিছুই দেখা গেল না। পুরনো দিনের রাসায়নিক রকেটের মতো কোনো আগুনে লেজ নেই এখন ডিসকভারির পেছনে। কিন্তু ধীরে সরে যাচ্ছে লিওনভও।

কয়েক ঘণ্টা পরে। বহু ভদ্র কসরতের পর দুজনেই নিজেদের হাজার কিলোমিটার উপরে তুলে ফেলতে পেরেছে। এখন ছোটখাট একটা বিশ্রাম নেয়া যায়। আলোচনাও করা যায় মিশনের পরের অংশ নিয়ে।

তুমি একটা প্রায় অসম্ভব কাজ করেছ, ওয়াল্টার… বলল সার্জন কমান্ডার রুডেঙ্কা তার সিলিন্ডারের মতো হাত দুটি ক্লান্ত কার্নোর কাঁধে রেখে, আমরা সবাই তোমার জন্য গর্বিত। খুব ভদ্রভাবেই ও কার্নোর নাকের নিচে একটা ছোট ক্যাপসুল ভেঙে ফেলল কথা শেষ করে।

এরপর কার্নো বিরক্ত আর একই সাথে ক্ষুধার্ত। কারণ গত চব্বিশ ঘণ্টা ও ক্যাপসুলের ফজিলতে ঘুমিয়েছে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

২০. মাথার উপর খড়গ

এটা কী? ঠাণ্ডা অতৃপ্তির সাথে ছোট মেশিনটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করল কার্নো, ইঁদুরের জন্য খড়গ?

বর্ণনাটা খারাপ না-কিন্তু আমি আরো বড় খেলুড়ের হাতে পড়ে গেছি, বিড়াল নয়। ফ্লয়েড ডিসপ্লে স্ক্রিনে একটা জ্বলন্ত অ্যারো দেখালো যেটা এখন এক জটিল সার্কিটের নকশা দেখাচ্ছে।

লাইনটা দেখেছ?

হু, মূল পাওয়ার সাপ্লাই-ঠিক?

ঠিক এখান দিয়েই পাওয়ার সাপ্লাই কর্ড হালের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটে°২ ঢোকে। এই ছোট মেশিনটা আমি এখানে ঢোকাতে চাচ্ছি। একেবারে সব তারের হিবিজিবিতে। পেল্লায় সার্চ ছাড়া পাওয়া যাবে না।

আচ্ছা, আচ্ছা! রিমোট কন্ট্রোল্ড ডিভাইস! যখন খুশি হালের মূল পাওয়ার সাপ্লাইটা টেনে তুলতে পারবে, তাইতো? দারুণ! একটা ননকন্ডাক্টরে তৈরি ব্লেড; বিপদের সময় হালের মাথার উপর খড়গ হয়ে নেমে আসতে পারে। এসব খেলনা বানায় কে? সি আই এ?।

নেভার মাইন্ড। এ লাল ক্যালকুলেটরের কন্ট্রোল সব সময় আমার হাতে। আমার অফিসের ডেস্কে সর্বক্ষণ একটা পড়ে থাকে। সহজ হিসাব, তবু না জানলে কেউ টিপেটুপে কমান্ড দিতে পারবে না। গাণিতিক তো! পাসওয়ার্ড হিসেবে নয়ে ন দিই, তারপর স্কয়ার রুট। শেষে এন্টার। ব্যস। সমস্যাটা কী জানো? এটার রেঞ্জ নিশ্চিত করে বলতে পারব না। একবার টেস্ট করতে হয়। চিন্তার কিছু নেই। যে পর্যন্ত লিওনভ আর ডিসকভারি দু-চার কিলোমিটারের মধ্যে আছে, হাল ব্যাটাকে আবার চালাতে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ দেখি না।

কাকে তুমি এ… জিনিস সম্পর্কে বলতে চাচ্ছ?

কার্নো আলগা মুখে উল্টোপাল্টা কিছু শব্দ বলে বসতে যাচ্ছিল, ফ্লয়েড অনেক সিনিয়র। সামলে নিয়েছে।

সময় মতো করেছ প্রশ্নটা। তোমাকে কেউ বোকা ভাবলে ভুল করবে। যদিও সব সময় বোকার মতোই ঠাট্টা মশকরায় ডুবে থাক… আমি মাত্র একজনের কাছ থেকেই লুকাব। ডক্টর চন্দ্র।

আমার আন্দাজকেও যদি কেউ ছোট করে-ভুল করবে, তাই না? চোখ মটকায় কার্নো।

কিন্তু যত কম লোক জানবে, আলোচনা হবে ততই কম। এটা যে আছে তা তানিয়াকে বলব, আর বিশেষ দরকার পড়লে ওকে তুমি বুঝিয়ে দেবে কীভাবে অপারেট করতে হয়।

কোন ধরনের বিশেষ দরকার? কার্নোর সচেতন দৃষ্টি ফ্লয়েড টের পাবেই।

প্রশ্নটা কি খুব একটা বুদ্ধির পরিচায়ক, ওয়াল্টার? আমি যদি জানতামই কীরকম বিপদ আসবে, মরার জিনিসটা সাথে করে নিয়েই আসতাম না।

ধরে নিচ্ছি তুমিই ঠিক। কখন তোমার পেটেন্ট করা এই হালের মরণটাকে বসাতে চাচ্ছ? মানে বসানোর কাজটা আমাকে দিতে চাচ্ছ?

কত তাড়াতাড়ি তুমি বসাতে পারছ? সম্ভবত আজ রাতেই। চন্দ্রকেতো অবশ্যই সে সময় ঘুমিয়ে থাকতে হবে, ঠিক না? বোঝাই যায় ফ্লয়েড চন্দ্রের ব্যাপারে মোটেও বিশ্বাস করে না। কারণও আছে; কেউ নিজের সন্তানকে খুনী বলে মানতে পারে না। কখনোই না।

আবোল-তাবোল বকছ কেন! আমার বিশ্বাস সে কখনোই ঘুমায় না। অসুস্থ সন্তানের সেবা করতে থাকা মা কখনো ঘুমায় নাকি?

ছেলেটা ভয়ংকর। এর থেকে দূরে থাকতে হবে। হয় ও আমার চিন্তা বুঝে ফেলে, নাহয় আমার মতোই চিন্তা করে। দুটোই ভয়াল। ভেবে বলল ফ্লয়েড, যাই হোক, ও লিওনভের দিকে আসে দু একবার। খাওয়ার দরকার পড়লে।

আমি তোমাকে একটা সংবাদ দিতে পারি। সু নাকি কু তা তোমার ব্যাপার। শেষবার যাওয়ার সময় পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে গেছে চন্দ্র। বলতো পোটলায় কী?

বিষিয়ে গেছে ফ্লয়েড, এমন চেহারা নিয়ে জবাব দিল, খাবার?

এই প্রথম কার্নোর মনে হল খাবারের মতো বিষাক্ত জিনিস সৃষ্টি জগতে নেই। হাসিও পেল, বাহ্! তোমার আন্দাজও তো কম যায় না! ভাতটুকু হপ্তাখানেক চালাবে ওকে।

সেক্ষেত্রে আমাকে ক্যাথেরিনার ভুবনখ্যাত তকমাগুলোর একটা ব্যবহার করতেই হচ্ছে। এক ড্রপে বাজীমাৎ! ওগুলো তোমার উপর ভাল তেলেসমাতিই ফলিয়েছে, একাধারে চব্বিশ ঘণ্টা কাৎ… নাকি?

এরপর কার্নো শুরু করল চন্দ্রকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা, অন্তত ফ্লয়েড তাই মনে করেছে, যদিও তার ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত হতে পারবে না-ও সব সময়ই একটা কঠিন মুখে তরল তরল কথা বলে স্বর্গীয় সুখ পায়। রাশিয়ানরা ব্যাপারটা পুরোপুরি সামলে নেয়ার পর পরিস্থিতি এত করুণ হয়েছে যে কার্নোর চরম সিরিয়াস মুহূর্তের কথায়ও খিল ধরে যায় ওদের পেটে।

আর কার্নো-ওকে কেউ কি কখনো হাসতে দেখেছে? একবার ফ্লয়েড দেখেছিল, যখন ওরা বসুন্ধরাকে বিদায় জানাচ্ছে উপরে উঠতে উঠতে। সেটা হাসি নাকি কান্না কে জানে! অনেকেই ব্যাপারটা সহ্য করতে পারে না-এ ভুবনে ফিরে আসার আশা করতে পারে না কেউই পুরোপুরি। ডুবে যায় অ্যালকোহলে। আগে মহাকাশ যাত্রায় মদ জাতীয় তরল ছিল নিষিদ্ধ। পরে পৃথিবী ছাড়ার সময়টার স্মৃতি পুরো অভিযান ধরে কুকে কুরে কুরে খায় দেখে কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বেই প্রাচীনতম ফ্রেঞ্চ শ্যাম্পেন বিলিয়ে থাকে। কার্নো হেসেছিল ঐ সময়। অবশ্যই এর পুরো প্রভাবক ছিল সবচে দুর্লভ উত্তেজক পানীয়।

ফ্লয়েড ঐ হাসির আশঙ্কা করেছে এন্ড অব ডিসকভারি অর্বিট পার্টিতে। ডিসকভারির সাথে লিওনভের চুড়ান্ত মিলনের পর। তখন কার্নো পান করেছিল যথেষ্ট। তারপরও ক্যাপ্টেন অর্লোভা যেমন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে-ওও ঠিক তেম্নি। আচ্ছা, ক্যাপ্টেন অর্লোভা সহজে এক ফোঁটা মদ ছোঁয় না–এর কারণ কি ব্যক্তিগত, নাকি কোনো ক্যাপ্টেনই ছোঁয় না? এটা কি কোনো মহাকাশ রুল, যা ক্যাপ্টেন হওয়ার পর আরো হাজারো গোপন রুলের সাথে জানা যাবে? মরুকগে। ফ্লয়েডের স্পেস ক্যাপ্টেন কেন, আর জীবনে স্পেস কিং হওয়ারও কোনো ইচ্ছা নেই।

এই কার্নো ছেলেটা একটা জিনিসই সিরিয়াসলি নেয়। তার কাজ। যখন পৃথিবীর অর্বিট ছেড়ে আসে ওরা, কার্নো একজন যাত্রী যে মাতাল হওয়ার অধিকার রাখে। আর আজকে ও একজন ক্রু, তাই মাতাল হওয়া চলে না। নাহ্। এ ছেলে যথেষ্ট জটিল। মহাকাশ অভিযাত্রী বাছাইয়ে কখনো স্পেস সংস্থা ভুল করে না।

২১. পুনরুত্থান

আমরা-বলছে ফ্লয়েড নিজেকেই-জাগিয়ে তুলতে যাচ্ছি এক ঘুমন্ত দৈত্যকে। হাল আমাদের উপস্থিতি দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে এত বছর পর? অতীতের সব কথা মনে করতে পারবে তো? আর সবচে বড় কথা, ওর মনোভাব বন্ধুর মতো হবে, নাকি থাকবে শক্রতা?

সে এখন ডক্টর চন্দ্রের পেছনে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভাল দিকটা হল, ডিসকভারি এখন এতই স্বয়ং সম্পূর্ণ যে তুলতে পেরেছে জিরো গ্র্যাভিটি। তার মন এখন কয়েক ঘন্টা আগে বসানো কাট অফ সুইচ থেকে অনেক অনেক দূরে। হাতের কয়েক সেন্টিমিটার দূরেই রেডিও সেটটা। এটা আনায় নিজেকেই খুব বোকা মনে হচ্ছে। এখন হাল সারা ডিসকভারির সব অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন। ও যদি আবার জেগেও ওঠে, হবে স্নায়ুতন্ত্র থাকা সত্ত্বেও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছাড়া মাথার মতো। বড়জোর যোগাযোগ করতে পারবে, প্রভাব ফেলবে না কোনো।

কার্নো জিনিসটা বসানোর সময় বলেছিল, ও বড়জোর ইনিয়ে বিনিয়ে আমাদের কাছে ওয়াদা করতে পারে, আর কক্ষনো করব না। কানে ধরলাম। এরচে বেশি কিছুই না।

আমি প্রথম পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত, ক্যাপ্টেন। বলল চন্দ্র, এবার কথায় মহাকাশ রিপোর্টের ভঙ্গী, সব হারিয়ে যাওয়া মডিউল এনে জোড়া দেয়া হয়েছে। আমি ডায়াগনস্টিক প্রোগ্রাম চালিয়েছি সব সার্কিটে। সব কিছুই একেবারে স্বাভাবিক,

অন্তত এখন।

ক্যাপ্টেন অর্লোভা একবার তাকায় ফ্লয়েডের দিকে। জবাবে ফ্লয়েড একবার নড করল মাথা নিচু করে। চন্দ্রের অনুরোধের কারণে প্রথম চলার সময় মাত্র তিনজন উপস্থিত ডিসকভারিতে; প্রথম স্টার্টিং জটিল-এ উসিলায়। এটাও বোঝা যাচ্ছে এ তিনজনও ঠিক স্বাগত নয় চন্দ্রের দ্বারা।

ভাল, ডক্টর চন্দ্র। সে নিয়ম কানুনের ব্যাপারে সচেতন, তবু দ্রুত যোগ করল, ডক্টর ফ্লয়েড তার অনুমোদন জানিয়েছে। আমার নিজের পক্ষ থেকেও কোনো আপত্তি নেই।

আমার আসলে ব্যাখ্যা করা উচিত। বলল চন্দ্র, তার স্বভাবসুলভ অননুমোদনের সুরে।

ওর ভয়েস রিকগনিশন৫ আর স্পিচ সিন্থেসিস সেন্টারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। আবার আমাদেরকে কাজ করতে হবে। ওকে কথা বলা শিখাতে হবে। আমাদের সৌভাগ্য যে ও মানুষের চেয়ে কয়েক লাখ গুণ দ্রুত শেখে।

বিজ্ঞানীর আঙুলগুলো নেচে বেড়ায় কি-বোর্ডের উপর ডজনখানেক শব্দ টাইপ করার সময়। একই সাথে পাইকারি হারে পরীক্ষাও করা হচ্ছে প্রতিটা শব্দ; স্ক্রিনে ওঠার সাথে সাথেই। বিকৃত প্রতিধ্বনির মতো কথাগুলো স্পিকার থেকে ভেসে আসছে। প্রাণহীন। আসলে এ শব্দ থেকেই বোঝা যায় যেখান থেকে আসছে সেখানটায় কোনো বুদ্ধিমত্তা কাজ করে না। একেবারেই যান্ত্রিক। এ সেই হাল নয়-ভাবল ফ্লয়েড। আমার ছোটকালে দেখা প্রাথমিক কথা বলা যন্ত্রের চেয়ে বেশি আবেগ নেই এসব কথায়।

ডক্টর চন্দ্র রিপিট বাটন টিপল। আবার সেই শব্দের সিরিজ আবৃত্তি করল হাল। তোতা পাখির মতো। এর মধ্যেই দেখার মতো উন্নতি হচ্ছে যদিও এখনো কণ্ঠটাকে মানব প্রজাতির কারো সাথে গুলিয়ে ফেলেনি কেউ-তবু তোতার মুখে আবেগ ফুটছে মনে হয়।

আমার দেয়া শব্দগুলো ইংরেজির মূল ফোনিমির ১০ সবটাই বহন করে। দশ বারের বার ওর উচ্চারণ গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু আমার কাছে এমন কোনো যন্ত্র নেই যা আসলেই দারুণ কোনো থেরাপি চালাতে পারবে ওর শেখার পথে।

থেরাপি? ধরে বসেছে ফ্লয়েড, তুমি বলতে চাও যে ওটার-যাই হোক, ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত, যাকে বলে অ্যাবনরমাল?

না! জায়গামতো লেগেছে চন্দ্রের। চিৎকার করল কম্পিউটার বিজ্ঞানী, লজিক সার্কিটগুলো আছে সবচে ভাল। শুধু ভয়েস আউটপুট একটু সমস্যায় পড়েছে হয়ত। উন্নতি হবে তাড়াতাড়ি। ভুল ইন্টারপ্রিটেশন ১০৮ এড়াতে হলে মনিটরের প্রত্যেকটা শব্দ চেক কর। আর যখন কথা বলবে, একেবারে সাবধানে। শুদ্ধভাবে।

ফ্লয়েড একটা মিষ্টি হাসি দিল অর্লোভার দিকে তাকিয়ে। এরপর এল আসল প্রশ্ন, এর চারপাশে রাশিয়ান উচ্চারণ। এ ব্যাপারে কী করবে?

আমি জানি ক্যাপ্টেন অর্লোভা আর ডক্টর কোভলেভ কোনো সমস্যা নয়। অন্যদের বেলায়-ঠিক আছে, আমরা আলাদা আলাদা পরীক্ষা করব। যে কেউ-যে উৎরে যেতে পারবে না-অবশ্যই কষ্ট করে কি-বোর্ড ব্যবহার করতে হবে তাকে।

গাছে কাঁঠাল রেখেই আঠা লাগার ভয়ে গোঁফ তেলতেলা করে লাভ নেই। এ মুহূর্তে তুমিই হালের সাথে যোগাযোগের জন্য একমাত্র উপযুক্ত মানুষ ডিসকভারি আর লিওনভের মধ্যে। আমার প্রস্তাবে রাজি, ক্যাপ্টেন?

অবশ্যই।

একটা সংক্ষিপ্ততম নড় বুঝিয়ে দিতে চায় যে, ডক্টর চন্দ্র শেখরাম পিল্লাই তাদের কথা শুনে বুঝতে পারছে। ওর আঙুলগুলো এখনো সমানতালে উড়ে যাচ্ছে কি বোর্ডের উপর। শব্দের কলামগুলো এত দ্রুত উঠছে মনিটরে যে কোনো মানুষই হয়ত পড়ে ফেলতে পারবে না সহজে। সম্ভবত চন্দ্র একটা সদা জাগ্রত বিরাট মুখস্থবিদ্যা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। নাহলে এগুলো মনে রাখার আর এক মুহূর্তে বের করে আনার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ফ্লয়েড মনে মনে বলল, এ লোকটাও তার নিজের ক্ষেত্রে যোগ্যতম। যত অসভ্যই হোক-পৃথিবীর ইতিহাসে সফলতম কম্পিউটার বিজ্ঞানী, যে একটা বুদ্ধিমান কম্পিউটারের জন্ম দিয়েছিল আজ থেকে তের বছর আগেই।

চন্দ্ৰ আরেকবার সবার উপস্থিতি স্বীকার করল-এবার আরো অভদ্রভাবে। কিছুক্ষণের জন্য নিজের হাতটা বন্ধ রেখে ওদের দিকে তাকালো সে। অর্লোভা আর ফ্লয়েড সাথে সাথেই তাকে তার রহস্যময় ভালবাসার কাছে ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে। একটা পুরোপুরি ইতস্তত নড়াচড়ার সাথে ও আগের দ্রুততায় লকিং বারের এক নিঃসঙ্গ কি-তে চাপ দিল।

কোনো বোঝার মতো বিরতি না দিয়েই এবার আবেগের সাথে ভিতর থেকে একটা কথার ধারা বেরিয়ে আসে, এখন আর মানব কণ্ঠের বিকৃত উচ্চারণ নেই। একজন কথা বলছে, তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, তার সচেতনতা দিয়ে, নিজস্ব সচেতনতা-যদিও প্রাথমিক পর্যায় ছেড়ে এল মাত্র।

গুড মর্নিং, ডক্টর চন্দ্র। হাল বলছি-প্রথম শিক্ষার জন্য আমি প্রস্তুত।

আহত নিরবতা ভর করেছে পুরো ঘরে। এ অপার্থিব মৌনতার প্রতি সম্মান জানাতেই হয়ত দুজন দর্শক ডেক ছেড়ে গেল সাথে সাথে।

ফ্লয়েড কখনো বিশ্বাস নাও করতে পারে যে বিংশ আর একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের উজ্জ্বলতম কম্পিউটার বিজ্ঞানী ডক্টর চন্দ্র কাঁদছিল তখন। হাউমাউ করে কাঁদছিল।

৪. চতুর্থ পর্ব : ল্যাগ্রেন্স

চতুর্থ পর্ব : ল্যাগ্রেন্স

২২. বিগ ব্রাদার

…আমাদের ছোট ডলফিনটার জন্য দারুণ সুখবর তো! আমি শুধু কল্পনাই করতে পারি ওটার বাবা মা ওটাকে বাড়িতে আনার পর ক্রিস কতটুকু খুশি হয়েছে। ভিডিওটা দেখার সময় আমার সাথীদের আহ-উহ কল্পনা করতে পারবে তুমি। ক্রিস বসে আছে ওটার পিঠে আর বাকিরা চক্কর মারছে চারদিকে। ওরা আমাকে এটার নাম রাখতে বলেছে শুটনিক। কারণ স্পুটনিক সাথীও-আবার একটা উপগ্রহও। আসলে যে যেটা নিয়ে থাকে তার চিন্তার পরিধি এর বাইরেই যায় না।

স্যরি, শেষ মেসেজটা পাঠানোর পর অনেক দেরি করে ফেললাম। তবু প্রচার মাধ্যমগুলো হয়ত আমাদের করা বিরাট কাজটার ব্যাপারে ধারণা দিয়েছে তোমাকে। এমনকি ক্যাপ্টেন তানিয়া অর্লোভা পর্যন্ত বাতিল করে ওর সব শিডিউল। দরকার না পড়লে কেউ কোনো কাজই করেনি। আমরা শুধু ঘুমিয়েছি তখনি যখন আর জেগে থাকতে পারিনি। প্রত্যেকে। কীভাবে এ সময় মেসেজ পাঠাই বল?

মনে হয় আমাদের সবাই যা করেছি তা নিয়ে গর্ব করতে পারি সারা জীবন। দুই শিপই কাজ করছে। হালের উপর প্রথম পরীক্ষাও শেষ। দু দিনের মাঝেই জেনে যাব ওকে বিশ্বাস করা যায় কিনা। গেলে বিগ ব্রাদারের সাথে মিলনের সময় ডিসকভারির দায়িত্বটা ওকেই দেয়া হবে।

…প্রথমে এ নামটা কে দিয়েছে আমি জানি না। রাশিয়ানরা পছন্দ করছে–বোঝাই যায়। ওরা আমাদের টি এম এ ভিত্তিক নামও পছন্দ করে না। টাইকো। চৌম্বকীয় বিশৃঙ্খলা নামটা নাকি মানায় না। কয়েকবার আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে, এটা টাইকো থেকে মাত্র কয়েকশ কোটি কিলোমিটার দূরে আর এখানে কোনো ম্যাগনেটিক অ্যানোম্যালির কথা ওঠেনি। একমাত্র মিল হল আকার আর গঠনে। এও টি এম এ-১ এর মতোই।

জিজ্ঞেস করলাম কোনো নাম পছন্দ-ওরা বেছে নিয়েছে জাগাদকা। জাগাদকা মানে এনিগমা-রহস্যময় সমাধা-আসলে এনিগমার অর্থ এনিগমাই। অবশ্যই দারুণ নাম। সমস্যাটা কোথায় জানো? আমি যখন জাগাদকা উচ্চারণ করলাম না? সবাই হেসেছে। বুঝতেই পারছ আমি তাই বিগ ব্রাদারেই লেগে থাকব।

জিনিসটাকে যা-ই ডাকো না কেন, আর মাত্র দশ হাজার কিলোমিটার। কয়েক ঘণ্টার বেশি লাগবে না যাত্রা শেষ করতে। কিন্তু তোমাকে বলতে ইতস্তত করব না-আসলে এই পুরো অভিযানের মধ্যে সবাই যে জার্নিটাকে ভয় পেয়েছে আজ পর্যন্ত–এটাই সেই যাত্রা।

আশা করি কোনো না কোনো নতুন খবর পাব ডিসকভারির বুকে। এটাই আমাদের একমাত্র ব্যর্থতা যা আশা করেও পাইনি আমরা। ডেভ বোম্যান সেই স্ত টার মুখোমুখি হওয়ার অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়েছে হাল। এ নিয়ে তার কোনো স্মৃতি নেই; স্বাভাবিক। বোম্যানতো যাওয়ার সময় সাথে করে সব রহস্যই নিয়ে গেল। শিপের লগ আর অটোম্যাটিক রেকডিং সিস্টেমে কোনো তথ্যই নেই-এটাতো আর আগে জানতাম না।

একমাত্র যা আমরা পেয়েছি তা হল মায়ের জন্য রেখে যাওয়া বোম্যানের চিঠি, একেবারেই ব্যক্তিগত জিনিস। ভেবে অবাক হয়েছি কেন পাঠায়নি। বোঝাই যায় ও ভাবেওনি যে যাচ্ছে চিরদিনের জন্য। সমস্যা আছে আরো। বৃহস্পতির জগৎ যত বড়ই হোক, আটকে যাওয়া বস্তুতো পাক খাবে। আমরা ঠিকই ধরে ফেলতাম বোম্যানের পোডটাকে। অবশ্য যদি কোনো উপগ্রহের উল্কা না হয়ে থাকে অথবা বৃহস্পতির শক্তিকে দোলনা করে সৌর জগতের বাইরে একটু ঘুরতে না গিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও ভরসা থাকে। ওর পোডের ইঞ্জিনের যেমন ঐ কৌণিক ভরবেগে ঘোরার ক্ষমতা নেই তেমনি ওটার কম্পিউটারের পক্ষেও হিসাব করে সেই বাঁকা পথটা বের করার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

অবশ্যই, মিসেস বোম্যানের সাথে যোগাযোগ করেছি। তিনি একটা নার্সিং হোমে। ফ্লোরিডার কোথাও না কোথাও। কিন্তু এখন আর এ মেসেজ তাঁর কাছে। কোনো অর্থই বয়ে নেয় না।

এটুকুই সব খবর আজকের মতো। আমার পক্ষে বলা সম্ভব না তোমাদের কেমন মিস করি… কেমন মিস করি পৃথিবীর নীল আকাশ আর সবুজ বন। এখানকার সব রঙই লাল গোত্রের। কমলা, হলুদ। মাঝে মাঝে অবশ্যই দারুণ সূর্যাস্তের মতো। কিন্তু ঐ বর্ণালীর পেছনের হাড় জমিয়ে ফেলা শীত প্রত্যেককে অসুস্থ করে তোলে।

তোমাদের সবার জন্য আমার রাশি রাশি ভালবাসা। যখনই পারব কল করব। যখনই পারি।

২৩. মিলনমেলা

নিকোলাই টার্নোভস্কি লিওনভের কন্ট্রোল এবং সাইবারনেটিক্স এক্সপার্ট। একমাত্র সেই ডক্টর চন্দ্রের সাথে নিজের মতো করে কথা বলতে পারে। যদিও হালের প্রধান স্রষ্টা ও মানসিকতার নির্মাতা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে তার কাজে নাক গলাতে দিতে, তবু তার শরীরের দুর্বলতা তাকে বাধ্য করেছে অন্য কারো সাহায্য স্বীকার করতে। একটা অস্থায়ী জোট গড়েছে রাশিয়ান আর ইন্দো আমেরিকান মিলে। অবাক ব্যাপার, জোটটা কাজ করছে চমৎকার। এর বেশিরভাগ কৃতিত্ব ভাল স্বভাবের ক্রু নিকোলাইয়ের পাওনা। সে কীভাবে যেন সময়মতো বুঝেছে যে এবার চন্দ্র টার্নোভস্কির প্রয়োজন অনুভব করবে। অথচ সে সময় চন্দ্র একা থাকতে চেয়েছে আরো বেশি। নিকোলাইয়ের ইংরেজি যে শিপে সবচে খারাপ তা তেমন গুরুত্ব পায়নি। কারণ আছে, পুরোটা সময় তারা কম্পিউটারের বিভিন্ন শব্দ আর ভাষা ব্যবহার করেছে, বাকি কারও পক্ষে তাতে নাক গলানো অসম্ভব।

এক সপ্তাহের ধীর আর সতর্ক পুননির্মাণের পর হালের সব রুটিন আর যত্ন নেয়া হচ্ছে ঠিকমতো। সে এখন একজন মানুষের মতো-যে একটু আধটু হাঁটতে পারে, সাধারণ কাজ আর কম হলেও কিছু পরিশ্রম পারে দিতে; যে নিম্নস্তরের কথাবর্তায় থাকতে পারে ব্যস্ত। মানুষের হিসাবে বলতে গেলে তার সাধারণ জ্ঞান আর আই কিউ পঞ্চাশ ভাগ; তার আসল ব্যক্তিত্বের অতি সামান্যই ধরা দিয়েছে এ পর্যন্ত।

হাল এখনো ঘুমের মাঝে হাঁটে। কিন্তু চন্দ্রের দাবী অনুযায়ী সে এখনি ডিসকভারিকে উড়িয়ে নিয়ে বিগ ব্রাদারের কাছাকাছি মিলনমেলা বসিয়ে দিতে পারবে।

আরো সাত হাজার কিলোমিটার উপরে উঠে নিচের জ্বলন্ত দোজখটাকে এড়াতে সবাই উদগ্রীব। এস্ট্রোনমিক্যাল হিসাবে নিতান্তই তুচ্ছ দূরত্ব, কিন্তু দান্তে বা হিরোনিমাস বসের লেখার মতো একটা পরিবেশকে ছেড়ে যেতে এটাই তাদের জন্য বহুদূর, প্রায় স্বর্গের কাছাকাছি। সবচে ভয়াল বিস্ফোরণগুলো এখনো শিপের আশপাশে আসতে পারেনি। কিন্তু ভবিষ্যতে যে আসবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আইওতে হরদম বিস্ফোরণগুলো নতুন রেকর্ড করার মতলব আঁটে; আজ যেখানে সালফারের মৃদু স্তর পড়তে পারে কাল সে স্থানটা চলেও যেতে পারে সেসব ভয়ের গর্ভে।

শুধু কার্নো আর চন্দ্র শিপে ছিল যখন হালের হাতে ডিসকভারিকে ছেড়ে দেয়া হয়। খুবই সীমিত নিয়ন্ত্রণ, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ তো! সে তার মেমোরিতে দেয়া প্রোগ্রামটাকেই বার বার চালিয়েছে-তারপর দেখেছে এর কাজ করার ক্ষমতা। অন্যদিকে মানব-কুরা দেখেছে তাকে। একটু এদিক সেদিক হলেই পদক্ষেপ নেবে।

প্রথম প্রজ্বলন চলল দশ মিনিট ধরে; এরপর হাল রিপোর্ট করল যে ডিসকভারি ট্রান্সফার অর্বিটে চলে এসেছে। লিওনভের রাডার আর অপটিক্যাল ট্র্যাকিং সেটা নিশ্চিত করার সাথে সাথে শিপটা নিজেকে নিয়ে গেল একই কক্ষপথে। পথের ব্যাপারে ছোট দুটো সংশোধনের তিন ঘণ্টা পনের মিনিট পরে দু শিপই প্রথম ল্যান্সে পয়েন্ট এ হাজির হয় যেটাকে লোকে বলে এল ওয়ান বা ল্যাগ্রে ওয়ান। সাড়ে দশ হাজার কিলোমিটার উঁচুতে সেই রেখার উপর অবস্থিত-যেটা আইও আর বৃহস্পতির কেন্দ্রের যোগাযোগ সরলরেখা।

হাল নিঃসন্দেহে দারুণ কাজ দেখিয়েছে; কিন্তু চন্দ্র তার খাঁটি মানবিক সন্তুষ্টি এমনকি খুশি গোপন করার চেষ্টা করেনি একটুও। কিন্তু এর মধ্যেই বাকি সবার চিন্তা ঘুরে গেছে অন্যদিকে বিগ ব্রাদার, এলিয়াস জাগাদকা মাত্র শত কিলোমিটার দূরে!

এমনকি এত দূর থেকেও জিনিসটাকে পৃথিবীর আকাশে চাঁদের চেয়ে বড় দেখায় এবং আশ্চর্যজনকভাবে এর ধারগুলো একেবারে নিখুঁত। নিখুঁত জ্যামিতিক গঠন। পেছনে মহাকাশ রেখে একে দেখার চেষ্টা করলে লাভ নেই, দেখা যাবে না। কিন্তু সাড়ে তিন লাখ কিলোমিটার নিচের দৌড়াতে থাকা বৃহস্পতির রঙিন মেঘের কারণে দেখা যায়। বেশ স্পষ্ট। মেঘগুলো বেশ গর্ব করেই যেন বলছে, একবার আমাকে দেখ, দেখবে মন আরেকবার দেখতে চায়-এবং দেখতেই হবে। কারণ চোখে এর বিস্তার-সৌন্দর্যের কোনোটাই মাপা যায় না। মাঝে মাঝে বিগ ব্রাদারকে দেখলে মনে হয় না যে জিনিসটা বৃহস্পতির সাড়ে তিন লাখ কিলোমিটার উপরে ভাসছে; মনে হয় গ্রহরাজের বুকে বসিয়ে দেয়া বিরাট কোনো শিকারের ট্র্যাপোের।

এমনটা মনে করার কোনো কারণই নেই যে একশ কিলোমিটার দশ কিলোর চেয়ে নিরাপদ বা হাজার কিলোর চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ; এ দূরত্বটা ক্রুদের কাছে প্রথম পরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণের জন্য ঠিক মনে হয়েছে। ব্যাপারটা মানসিক। এতদূর থেকে শিপের টেলিস্কোপ জিনিসটার কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখতে পারে-কিন্তু কিছুই দেখার নেই। বিগ ব্রাদারের উদয় হয়েছে একেবারে অবাক পথে। এর গঠন বিশ্লেষণ করা বা টেলিস্কোপ দিয়ে আরেকটু আভ্যন্তরীণ গঠন দেখা সম্ভব না। এর গঠন যা দিয়েই হোক না কেন তা মহাকাশের বিশাল বিশাল বিস্ফোরণের শিকার হয়েছে; মসৃণতায় একচুল নড়চড় হয়নি।

দূরবীনের আইপিসে চোখ রেখে সেটাকে দেখে সেই চাঁদের মতোই অনুভূতি হল ফ্লয়েডের। যেন মেঘ উঠে এসে সেই কৃষ্ণবস্তুকে ছুঁয়ে যাচ্ছে; যেমন দশ বছর আগে তার গ্লাভ পড়া হাত ছুঁয়েছিল চাঁদের স্তম্ভটাকে। টাইকো মনোলিথকে একটা প্রেশারাইজড ডোম দিয়ে ঢেকে না দিলে সে কি আর খালি হাতে ছুঁয়ে দেখতে পেত।

কোনো পার্থক্য নেই; তার কখনো মনে হয়নি যে সে ছুঁয়ে দেখেছে টি এম এ ওয়ান। তার আঙুলের ডগাগুলো যেন কোনো অদৃশ্য বাঁধার সামনে পিছলে গেল। যত জোরে সে চাপ দেয়, তত বেশি আসে প্রতিরোধ। কে জানে, বিগ ব্রাদারও একই আচরণ করতে পারে।

এত কাছে আসার আগে তাদের যন্ত্রে আর মনে যতোটা কুলায় তার সব পরীক্ষাই করেছে; রিপোর্ট পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ সম্পূর্ণ নতুন অচেনা কোনো বোমা নিষ্ক্রিয় করার সময় যেমন অনুভব করে তাদের অনুভূতিও একই। যেটুকু বলতে পেরেছে তা হল, সবচে ভাল রাডারগুলোও শুধু একটা অকল্পনীয়, অপার্থিব… হয়ত অ-মহাজাগতিক কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় এর সংকেত দিচ্ছে!

প্রথম চব্বিশ ঘণ্টায় তারা প্রভাব ফেলে না এমন সব যন্ত্র দিয়ে চালিয়েছে কাজ-যেমন টেলিস্কোপ, ক্যামেরা, প্রতি ওয়েভলেংথ এ সেন্সর। ভ্যাসিলি অর্লোভ জিনিসটার মাত্রা মাপার কাজ হাতে নিয়ে অবাক হয়েছে, সেই সে ১:৪:৯! সেই ছ তল ওয়ালা বস্তুর সবচে সরল, সবচে সুদৃশ্য, সবচে সহজ গাণিতিকতা। বিগ ব্রাদারেরও আনুপাতিক চেহারা হুবহু টি এম এ ওয়ানের মতো-শুধু এটা দু কিলোমিটারের বেশি লম্বা; চাঁদের বুকে থাকা এর ছোট ভাইয়ের চেয়ে এটা সাতশো আঠারো গুণ বড়।

এরপরে সেই চিরাচরিত গাণিতিক রহস্যতো আছেই, মানুষ বছরের পর বছর ধরে সেই ১:৪:৯ অনুপাত নিয়ে চালাচ্ছে তর্ক-এ তিন সংখ্যা হল প্রথম তিন মৌলিক সংখ্যার বর্গ, তাও একের পর এক। যতদূর বোঝা যায়, এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার না; এবার এ তর্কে আরো প্রবল যুক্তি পাওয়া যায়।

আর পৃথিবীতে মেসেজ যাওয়ার সাথে সাথে গণিতবিদ আর গাণিতিক পদার্থবিদরা তাদের কম্পিউটারের সাথে খুশি মনে শুরু করেছে খেলা; উঠে পড়ে লেগেছে অনুপাতটাকে প্রকৃতির মূল গঠনের সাথে মিলিয়ে নিতে-আলোর গতি, পোটন-ইলেক্ট্রন ভরের অনুপাত, দৃষ্টিনন্দন গঠনের ধ্রুব মান… খুব দ্রুত তাদের সাথে যোগ দিয়েছে একদল নিউমেরোলজিস্ট, ভবিষ্যৎ-গণক, অতিন্দ্রীয়বিদ যারা এর মধ্যেই দ্য গ্রেট পিরামিডের১৫ উচ্চতা, স্টোনহেঞ্জের১৬ কেন্দ্রের মাঝ দিয়ে যাওয়া রেখার দৈর্ঘ্য আর ইস্টার দ্বীপের অবাক করা ব্যাপার, নাজকা লাইনের কৌণিক উচ্চতার রেখাগুলো নিয়ে হল্লা করে মরছে। এগুলোর সাথে ভবিষ্যতের কোনো একটা সম্বন্ধ পাতাতে পারলেই তাদের চলে যায়। তারা বিন্দুমাত্র অবাক হয়নি যখন ওয়াশিংটনের একজন বিখ্যাত ভঁড় বলেছিল যে উনিশো নিরানব্বইয়ের একত্রিশে ডিসেম্বর পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে। অবশ্য যারা বিশ্বাস করেনি তারাও অনেক উদ্বেগ নিয়ে দিনটার জন্য অপেক্ষা করেছিল।

মস্ত শিপদুটো যে তার এলাকায় এসে বসে আছে তা দেখার জন্য বিগ ব্রাদার বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। এমনকি রাডার বিমের সাহায্যে যখন একে পরীক্ষা করছে তখনো না… রেডিও পালসের সাহায্যে যখন এর আশপাশটায় বিস্ফোরণের চেয়ে ভয়াবহ শব্দ করছে তখনো না। আশা করা হয়েছিল যে এসব চললে কোনো বুদ্ধিমত্তা হয়ত সাড়া দেবে একই পথে।

দুটো হতাশ করা দিনের শেষে মিশন কন্ট্রোলের অনুমতি নিয়ে শিপগুলো দূরত্ব অর্ধেক করে নিল। পঞ্চাশ কিলোমিটার দূর থেকে বিগ ব্রাদারকে পৃথিবীর আকাশে চাঁদের ব্যাসের চেয়ে চারগুণ বড় লাগছে-যথেষ্ট বড়, কিন্তু এখনো মানসিক বিকার আনার মতো দেখায় না। এখনো সে বৃহস্পতির সাথে পাল্লা দেয়নি, গ্রহরাজ দশগুণ বড়। এবং হঠাৎ করেই মিশনের পরিস্থিতি ভয় থেকে সরে গিয়ে অধৈর্যের দিকে মোড় নিল।

ওয়াল্টার কার্নো নিজের স্বভাব অনুযায়ী বলে বেড়াচ্ছে, আমাদের চলে যেতে হবে কয়েক দিনের মধ্যেই… বিগ ব্রাদার সম্ভবত আর মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর অপেক্ষা করতে চাইছে।

২৪. সতর্ক দৃষ্টি

ডিসকভারি পৃথিবী ছাড়ার সময় সাথে করে তিনটা ছোট ছোট স্পেস পোড নিয়ে এসেছে যাতে যে কোনো সময় স্পেস স্যুট পড়ার মতো সহজেই এগুলো ব্যবহার করে মহাশূন্যে একটা ছোটখাট ঘোরাঘুরি সেরে ফেলতে পারে। একটা পোড এক্সিডেন্টে হারিয়েছে ফ্র্যাঙ্ক পোলকে সাথে নিয়ে-যদি ওটা এক্সিডেন্ট হয়ে থাকে। টি এম এ-২ ডেভ বোম্যানকে টেনে নেয়ার সময় অন্যটা সাথে ছিল; সেটার একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে ডেভ বোম্যানের শরীরের মতো। তৃতীয় পোডটা আজো ডিসকভারির মহাকাশ গ্যারেজে সেই গ্যারেজ। পোড বে।

পোড নম্বর তিন (যেটাকে সব যুক্তি না মেনে ম্যাক্স নাম দিয়েছে নিনা-এমনকি নামটা বসিয়েও দিয়েছে। অথচ কোনো কারণই নেই এ নামের।) আরেকটা ই ভি এর জন্য বেরিয়েছে এখন।

ডেভ বোম্যান ওর দারুণ কর্তব্যপরায়ণতার জন্যই এক অসাধারণ সুযোগ পেয়ে যায়। এর সুবিধাটুকু না নেয়া বোকামিই হবে। নিনাকে একটা রোবট প্রোবের মতো ব্যবহার করে বিগ ব্রাদারকে পরীক্ষা করে ফেলা যায়। একটা মানব জীবনও ঝুঁকিতে থাকবে না। এটা শুধুই থিওরি। কেউই শিপের প্রতি সম্ভাব্য আসতে থাকা আঘাতের কথা বাতিল করতে পারে না। সবচে বড় কথা, মহাজাগতিক দূরত্বে পঞ্চাশ কিলোমিটার মাপার মতো কোনো দূরত্বই না যেখানে পুরো সৌর জগৎ ধূলিকণার সমান!

অবহেলার অনেকগুলো বছর পেরিয়ে নিনা এখন একেবারেই নোংরা। শূন্য জি তে উড়তে থাকা ধুলার অস্তিত্ব প্রকাশ পায় ঐ কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ সৃষ্টির পরপর। মহাজাগতিক কণার পরত জমেছে সবখানেই। ডিসকভারির উজ্জ্বল শরীরটা আজকে একেবারেই মলিন।

ডিসকভারির মূল দেহ থেকে ডানা বেশি জোরে ঘোরার কারণে ধারণ করেছে। স্রেফ কালো রঙ। আর মানব জাতির প্রতিনিধি ডিম্বাকার ভিউপোর্টটাকে একটা অন্ধ চোখের চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। কিন্তু এর আরেকটা সুবিধা আছে। নিচের বিশাল আগুন এত বছরেও ক্ষতি করতে পারেনি। ওটার ছাইই দিয়েছে আবরণ। ছোট আকার আর কম গতি এর উদ্দেশ্যপূরণেও সাহায্য করে।

প্রথমে শুধু ভিউপোর্টকেই বিগ ব্রাদারের কাছে পাঠানোর কথা ছিল খালি হাতে। পরে নিনার কথা মনে পড়ে সবার। এও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, নিনা যদি ওর নখগুলো আগে বাড়িয়ে ষাঁড়ের মতো দৌড়ে আসে তাহলে ওরাও জীবন বাঁচাতে দৌড়ে বেড়াবে।

দু ঘন্টার আলসে ঘোরাঘুরির পর নিনা বিশ্রামের জন্য ঐ বিরাট আয়তাকার স্ল্যাবটার এক কোণার একশো মিটার দূরে থামল। হাতের কাছ থেকে দেখা টিভি চিত্রেও ঐ জিনিসটার আয়তনের কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কৃষ্ণ বস্তু না পাওয়ার যে হাহাকার বিজ্ঞানীদের মধ্যেওটা বোধহয় এবার পুরণ হল। টিভি ক্যামেরাগুলো বোধহয় নিচের চৌকোণা অসীম কালোর কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। নিনার যন্ত্রপাতিগুলোও বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের বা তেজস্ক্রিয়তার কোনো লক্ষণ দেখায় না। না-একটা কিছু পাওয়া গেছে। একটা কিছু। এ দানব দয়া করে সূর্যরশ্মির কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ ফিরিয়ে দিচ্ছে। তার মানে এটাও দ্য পারফেক্ট ব্ল্যাক বডি নয়। নাহ।

পাঁচটা মিনিটের বিশ্রাম শেষে হ্যালো, আমি এখানে। শুনেই যেন নিনা আবার নতুন উদ্যমে খোঁজ শুরু করল। এবার প্রথমে একদম সূক্ষ্মভাবে, তারপর একটু স্কুল, আর তারপর একেবারে পুরোটার প্রতি দৃষ্টি দিল পঞ্চাশ মিটার উপর থেকে। কিন্তু অবিশ্বাস্য ব্যাপার হচ্ছে, জিনিসটাকে যত কাছ থেকেই দেখা হোক না কেন-একই রকম। কোনো দাগ নেই, নেই ভাগ। কোনো উঁচু-নিচুর ব্যাপার নেই। আচ্ছা, যদি এটাকে আণবিক বিশ্লেষক মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা হয়, তবু কি পরমাণুগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে দেখা যাবে না? বোধহয়-ভাবল কার্নো। কারণ নিনা মাঝে মাঝে এর পাঁচ মিটারের মধ্যেও নেমে গেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মিশনটা একেবারে বিরক্তিকর হয়ে গেল। সবাই চলে গেছে যার যার কাজে। মাঝে মাঝে শুধু ইচ্ছা হলে এক পলক দেখে যায়।

এ-ই সব। বাঁচা গেল, অবশেষে মুখ খুলেছে ওয়াল্টার কার্নো, নিজের স্থানে নিনা ফেরার পর, যাক, আমরা এ কাজটায় বাকি জীবন কাটাতে পারতাম। তবে ছোটখাট একটা বাজি ধরতে পারি-এরচে বেশি কিছু শিখতাম না। এমন মিষ্টি নামের পোডটাকে কী করব? বাড়িতে ফিরিয়ে আনব?

না। বলল ভ্যাসিলি, লিওনভ থেকে সার্কিটে ঢুকতে ঢুকতে, বিরাট মুখের ঠিক সামনা সামনি দাঁড় করাও ওটাকে। তারপর বিশ্রাম দাও-ওহহা ভাল কথা, একশো মিটার দূরত্ব রেখে। এবার রাডারের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে ওই জায়গাতেই পার্ক করাও।

নো প্রব্লেম-আশা করি এর কিছু গতি বাকি আছে। কিন্তু ঐ পয়েন্টটা কোথায়?

আমার কলেজের এস্ট্রোনমি কোর্সের কয়েকটা এক্সারসাইজের কথা এই মাত্র মনে পড়ল। একটা অসীম সমতল প্লেটের গ্র্যাভিটিশনাল আকর্ষণের কেন্দ্র বের করা। কোনোদিন ভুলেও ভাবিনি যে হাস্যকর অসীম সমতল কোনো জিনিস বাস্তবে পেয়ে এ কাজটা প্রয়োগ করার সুযোগ আসবে। নিনার গতিবিধি কয়েক ঘণ্টা দেখে আমি অন্তত জাগাদকার ভর ১১৯ বের করতে পারব। সমস্যা হল, ভর থাকতে হবে। না থাকলে বের করে কোনো লাভ আছে বলে মনে হয় না। আমি ভাবা শুরু করেছি। যে, ওখানে কিছুই নেই।

বোঝার সহজ পথ আছে একটা। আস্তে ধীরে আমাদের তাই করতে হবে। নিনাকে সরাসরি এগিয়ে গিয়ে ওটাকে ছুঁতে হবে।

এর মধ্যেই করে ফেলেছে।

কী বলতে চাও? ক্ষেপে গিয়ে প্রশ্ন করল কার্নো, আমি ওটাকে কন্ট্রোল করছি। আর পাঁচ মিটারের মধ্যে নিইনি।

তোমার ড্রাইভিং ক্ষমতাকে ছোট করে দেখছি না-কিন্তু এটা প্রথম বারের হিসাবে খুবই কাছাকাছি ছিল। আর পাঁচ মিটার খুবই কম, ঠিক না?

মানে?

কাছাকাছি থাকার সময় প্রতিবার প্রাস্টার ছাড়ার পর এটা জাগাদকায় ধাক্কা খেয়েছে-হয়তো।

একটা মাছি হাতির গায়ে টোকা মেরেছে?

সম্ভবত। সোজা কথায় আমরা জানি না। কিন্তু ভাল হয় কী করলে জানো? আমরা এখনো এর থেকে দূরে দেখেই ও-ও আমাদের সহ্য করছে। কিন্তু আমাদের গাধা বানানো পর্যন্ত অপেক্ষা করবে…মনে হয়।

ও না বলা প্রশ্নটা ঝুলিয়ে রাখল বাতাসেই। এর আগে কীভাবে একজন মানুষ প্রায় এমন একটা আয়তাকার স্ল্যাবকে বিরক্ত করেছিল? আর এদের রাগটা ঠিক কীভাবে প্রকাশ পায়?

২৫. ল্যাগ্রেন্স থেকে দেখা

এস্ট্রোনমি সব সময়ই এসব অদ্ভুতুড়ে আর অর্থহীন হঠাৎ ঘটা ব্যাপার স্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায়। এর মধ্যে সবচে বিখ্যাত যেটা সেটা নিয়ে সবাই কোনো না কোনো তত্ত্ব দাঁড় করাতে চেয়েছে। আবার অনেকেই বলেছে যে এটা হঠাৎ ঘটা ঘটনা। পৃথিবীর তের লক্ষগুণ বড় সূর্য আর পঞ্চাশ ভাগেরও এক ভাগ চাঁদ। কিন্তু এ দুটোকেই পৃথিবী থেকে একেবারে একই ব্যাসের দেখায়।

এই এখানেও, এল ওয়ান মুক্ত বিন্দুতে যেখানটাকে বিগ ব্রাদার তার মহাজাগতিক বস্থানের জন্য বেছে নিয়েছে সে জায়গাটা বৃহস্পতি আর আইওর মাঝের মাধ্যাকর্ষণের সবচে পোক্ত জায়গা। আর মজাটা হল, এখানে এই গ্রহ আর উপগ্রহ দুটো ঠিক একই রূপ নিয়ে দেখা দেয়। একই ব্যাসার্ধে।

কী দারুণ আকৃতি! সূর্য আর চাঁদের আধ ডিগ্রি বিস্তৃতি নয়, বরং তাদের ব্যাসের চেয়ে চল্লিশ গুণ বড়। আর আর এলাকার হিসাব রাখলে তা মোলশ গুণ। এই আকৃতিটা মনকে ভয় আর বিস্ময়ে ডুবিয়ে দিতে যথেষ্ট। দৃশ্য একেবারে অপার্থিব।

বেয়াল্লিশ ঘণ্টা পর পর ওরা পর্যায়ের একটা চক্র পূর্ণ করে। এ চক্রটার শুরু ধরা যায় যখন বৃহস্পতি পূর্ণ আর আইও নতুন-সে অবস্থা থেকে। অথবা উল্টো। যখন গ্রহটা সূর্যকে ঢেকে ফেলে তখন এর রাতের অংশই শুধু দেখা দেয় কালো চাকতি হয়ে রাতের নক্ষত্রদের পরাজিত করে দিয়ে। মাঝে মাঝেই এ কালো রাতকে ধারালো করে তোলে ভয়ানক বৈদ্যুতিক ঝড়-বজ্র। বহু পলের জন্য। পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি ভয়াল চেহারা নিয়ে আসে বিজলির এসব চমক।

আকাশের আরেক প্রান্তে দৈত্য মনিবের দিকে সব সময় মুখটা ফিরিয়ে রেখেছে আইও। যেন লাল আর কমলার তপ্ত কড়াই। মাঝে মধ্যে হলুদ লাভারা উঠে আসে কোনো এক অগ্নিগিরি থেকে আবার থিতিয়েও যায় সময় মতো। বৃহস্পতিতেও ঘটে; তবে এরচে দ্রুত। আইও একটা ভৌগোলিক চেহারা বিহীন দুনিয়া। এর চেহারা যুগে যুগে পাল্টায়। বৃহস্পতিরটা দিনে দিনে।

আইও চলে গেছে কক্ষের শেষ কিনারায়। আর ছড়ানো, বিশাল সব পতীয় মেঘ ঝিকিয়ে উঠছে অনেক দূরের ছোট্ট সূর্যের আলোয়। যদি কখনো বৃহস্পতির উপর আইও বা আর কোনো উপগ্রহ বড় হয়ে দেখা দেয় তাহলে প্রতি ঘূর্ণনে দেখা যাবে গ্রহ আকৃতির বিশাল হ্যারিকেন দ্যা গ্রেট রেড স্পটকে। ঝড়টা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলছে যদি সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ধরে না চলে থাকে।

এসব আশ্চর্যের মাঝে পড়েই লিওনভের ত্রুরা দু একটা জীবন পার করে দিতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা হল, বৃহস্পতি জগৎ ওদের প্রাধান্যের তালিকার সবচে নিচে বসে আছে। বিগ ব্রাদারই এক নম্বরে। যদিও বিগ ব্রাদারের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূর দিয়ে শিপ দুটো ওড়াউড়ি করছে তবু ক্যাপ্টেন তানিয়া বাতিল করে দিয়েছে দু শিপকে এক করার আবেদন।

আমি আরো অপেক্ষা করতে চাই… ও বলল, যে পর্যন্ত সময়মতো দ্রুত পালানোর প্রস্তুতি না নিচ্ছি। এখন বসে বসে শুধু অপেক্ষা করব-যা করার করব আমাদের লঞ্চ উইন্ডো খুলে যাওয়ার পর।

অবশেষে নিনা বিগ ব্রাদারের উপর ল্যান্ড করল। পঞ্চাশ মিনিটের মুক্ত পতনের পর। এর ফলেই ভ্যাসিলি বের করেছে এর ভর। দশ লাখ টনের চেয়েও কম, মাত্র সাড়ে ন লাখ। আশ্চর্য! ঘনত্ব বড়জোর বাতাসের সমান! এবার সবাই ধরে নিয়েছে যে এটা ফাঁপা আর ভিতরে যে কোনো জিনিসকে ধরে রাখতে পারে সহজেই। যদি ও চায়। অথবা প্রথম আন্দাজটাই ঠিক, এখানে এ জিনিসের নিজের কোনো ভর নেই। শুধু যে বাতাসটুকু ছিল প্রথমে এ এলাকায় তারই ভর এটা। এর অর্থও একই। এর ভিতরে যে কোনো কিছু ঢুকে যাবে। হয়ত।

প্রতিদিনের হাজার বাহ্যিক কাজ আছে যা তাদের এ চিন্তা থেকে সরিয়ে রাখতে পারে সার্থকভাবে। লিওনভ আর ডিসকভারি দুটোতেই তাদের কাজের নব্বই ভাগ কেড়ে নিয়েছে ঘরদোরের কাজকর্ম। এর কারণ আছে যথেষ্ট। এ দুই শিপ একটা স্থিতিস্থাপক সংযোগ পথের মাধ্যমে একত্র হয়েছে এবার। সুবিধার সাথে সাথে বেড়ে গেল কাজও।

কানো ক্যাপ্টেন অলোভাকে নিশ্চিত করেছে হঠাৎ করে ডিসকভারির করাসেলের নষ্ট হওয়ার বা কারো দখলে চলে যাবার কোনো আশাই নেই। তাই এখন দুটো এয়ার প্রেশার দরজা খোলার মাধ্যমেই এক শিপ থেকে অন্যটায় যাওয়া যায়। স্পেসসুট আর সময় নষ্ট করা ই ভি এগুলোর কোনো দরকারই নেই। একমাত্র ম্যাক্স অসন্তুষ্ট কারণ ও বাইরে না যেতে পেরে আর ঝাড় শলা ব্যবহার না করে যার পর-নেই অতৃপ্তি পায়।

ব্যাপারটা শুধু দুজনের উপর কোনো প্রভাবই ফেলেনি। চন্দ্র আর টার্নোভস্কি। ওরা এখন ডিসকভারির বাসিন্দা। রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা কেউ না কেউ কথা বলছেই হালের সাথে।

কখন তুমি রেডি হয়ে যাবে একেবারে? দিনে একবার হলেও এ প্রশ্নটা শুনতে হয় হালকে ওদের মুখ থেকে। আলাদা আলাদা-ব্যক্তিগতভাবে। ওরা দুঃখ বুকে চেপে রেখে কাউকেই জানাত না কবে নাগাদ ঠিক হতে পারে হাল। ও রয়ে গেছে এক আস্ত বোকাটে মানুষের মতো।

আর বিগ ব্রাদারের সাথে মুখোমুখির ঠিক সপ্তাখানেকের মাথায় সবাইকে চমকে দিয়ে ডক্টর চন্দ্র ঘোষণা করল, আমরা প্রস্তুত।

ডিসকভারির ফ্লাইট ডেকে শুধু দুই মহিলা ডাক্তারই অনুপস্থিত। কারণ ওদের জন্য কোনো জায়গা নেই। লিওনভের মনিটরে বসে বসে দেখেছে দৃশ্যগুলো। চন্দ্রের ঠিক পেছনেই ফ্লয়েড, তার আগ্রহ আছে অবশ্যই-কাছাকাছি থাকার আরো বড় একটা কারণও থাকে। কার্নো ওটাকে বোধহয় উপযুক্ত নামই দিয়েছিল দৈত্যঘাতক। ওর হাত ওটার কাছে কাছেই ঘোরে।

আমাকে আবার জোর দিয়ে বলতে দাও, বলল কম্পিউটার বিজ্ঞানী, এখানে কোনো-কথা-চলবে-না। তোমাদের উচ্চারণ ওকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেবে। কথা বলতে হলে শুধু আমিই। বোঝা গেল? চন্দ্র তাকায় শব্দ করে। ও এখন উত্তেজনার শেষ প্রান্তে। আজ কণ্ঠ এমন একটা অধিকার নিয়ে চিৎকার করছে যা এর আগে কেউ উপলব্ধিও করেনি। তানিয়া সবখানে বস হতে পারে-কিন্তু এখানে ও মাস্টার।

উপস্থিত জনতা নগ্ন অনুমতি জানায়। তাদের সবাই কোনো হ্যান্ডহোল ধরার জন্য ঝামেলা করছে অথবা ভাসছে চারদিকে।

ডক্টর শিব শুভ্ৰমানিয়াঁ চন্দ্রশেখরাম পিল্লাই একটা অডিও সুইচ বন্ধ করে। স্পষ্ট, কিন্তু দ্রুত বলে, গুড মর্নিং, হাল।

একটা মাত্র মুহূর্ত-ফ্লয়েডের মনে হচ্ছে বছরের পর বছর গড়িয়ে যাচ্ছে আশপাশ দিয়ে। এবার, জবাবটা, কোনো ছোটকালে খেলা নির্বোধ যন্ত্রের নয়।

সৃষ্টি জগতের প্রথম বুদ্ধিমান মানবীয় কম্পিউটার হাল নহাজার জবাব দিয়েছে।

শুভ সকাল, ডক্টর চন্দ্র।

আগের কাজগুলো আবার করতে পারবে?

অবশ্যই। আমি পুরোপুরি কর্মক্ষম। সবগুলো সার্কিট কাজ করছে দারুণ।

আমি কয়েকটা প্রশ্ন করলে কিছু মনে করবে নাতো?

মোটেই না।

ই এ পঁয়ত্রিশ এন্টেনা ইউনিটের নষ্ট হওয়ার কথা তোমার মনে পড়ে?

এখন একেবারেই না।

চন্দ্রের আদেশ ছাড়াও সবার মধ্যেই একটা টান টান উত্তেজনা আর নিরাপদ ব্যগ্রতা দেখা গেল। এটা মাইন পোতা মাঠে পা টিপে টিপে হাঁটার মতো-ভাবল ফ্লয়েড যখন ও রেডিও কাট অফের গায়ে চড় মেরে উপস্থিতি বুঝে নিচ্ছে। প্রশ্নের ঐ ধারা যদি অন্য পথে যায়, সাথে সাথেই হালকে খুন করবে। (বহুবার প্র্যাকটিস করে করে পদ্ধতিটা আয়ত্তে এনেছে সে। কিন্তু একটা সেকেন্ড কম্পিউটারের জন্য গুনে শেষ করা যায় না এমন বিশাল সময়। এটাই কম্পিউটারের জন্য সুবর্ণ সুযোগ।

ফ্র্যাঙ্ক পোলের এ ই পঁয়ত্রিশ ঠিক করতে বাইরে যাওয়ার কথাও মনে নেই?

না। এ ব্যাপারটা সম্ভবত হয়নি-হলে আমার মনে পড়ত। ফ্র্যাঙ্ক আর ডেভ কোথায়? এরা কারা? আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই চিনতে পারছি না… তবু। পঁয়ষট্টিভাগ সম্ভাবনা আছে তোমার পেছনের লোকটার ডক্টর হেউড ফ্লয়েড হওয়ার।

চন্দ্রের কথা মনে পড়াতেই ফ্লয়েড হালকে অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত থাকল। এক দশক পরেও চেনার ব্যাপারে পঁয়ষট্টি এক বিরাট স্কোর।

মন খারাপ করো না হাল। আমি পরে সবটাই ব্যাখ্যা করব।

মিশন শেষ? জানোতো, আমি এর জন্যই সবচে বেশি উদ্বিগ্ন।

শেষ মিশনটা। নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তোমার সব প্রোগ্রাম। এখন তুমি যদি আমাদের একটু ক্ষমা কর তো নিজেরা কথা বলতে পারি।

অবশ্যই।

চন্দ্র বন্ধ করে দেয় মূল অংশের শব্দ আর চিত্রের ইনপুট। এর আছে এক বিরাট তাৎপর্য। শিপের এ অংশের জন্য হাল এখন অন্ধ আর বধির।

ভাল; এটুকুই সব? জানতে চাইল ভ্যাসিলি অর্লোভ।

এর মানে হল-আমি… বলল চন্দ্র ঠাণ্ডা মাথায়, আমি সমস্যা শুরু হওয়ার সময় থেকে শেষ পর্যন্ত হালের সবটুকু স্মৃতি মুছে ফেলেছি।

অবাক কণ্ঠ শাসার, কীভাবে করলে?

মনে হয় যততক্ষণে এটা ব্যাখ্যা করতে পারব মুছেছি তারচে অনেক কম সময়ে। আর মুছতে তেমন সময় লাগেনি।

চন্দ্র, আমি একজন কম্পিউটার এক্সপার্ট-যদিও তোমার আর নিকোলাইয়ের মতো না। নহাজার সিরিজের কম্পিউটারগুলো হলোগ্রাফ মেমরির; তাই না? তুমি কিন্তু ক্রমান্বয়িক সাধারণ ইরেজার ব্যবহার করতেই পার না। শুধু পরজীবী আক্রমণকারী পোকা-এক কথায় ফিতাকৃমির ব্যবহারে এ কাজ সম্ভব যা খুঁজে পেতে শুধু নির্ধারিত শব্দ আর বর্ণ সরিয়ে দেবে।

আক্রমণকারী পরজীবী পোকা? প্রশ্ন করল ক্যাথেরিনা। শিপের ইন্টারকমের মধ্য দিয়ে, আমি ভেবেছিলাম ওই কাজকর্ম শুধু আমার। আমি বলতে গর্ববোধ করি যে ঐ জান্তব ফিতাকৃমি অ্যালকোহলের বোতলের বাইরে কখনো দেখিনি। তোমরা আবোলতাবোল বকছ নাতো?

কম্পিউটারের শব্দ, ক্যাথেরিনা। আগেকার দিনে অনেক আগে-মানুষ স্মৃতির জন্য চৌম্বকীয় টেপ বা ফিতা২১ ব্যবহার করত। আর এমন একটা প্রোগ্রাম বানিয়ে নেয়া সম্ভব যা শুধু ধ্বংসের কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। সোজা কথায় সব খেয়ে ফেলবে। যে অংশটুকু তুমি চাও। সম্মোহনের দ্বারা তুমি কি ঐ একই কাজ মানুষের উপরও ফলাতে পার না?

হ্যাঁ, কিন্তু সব সময় উল্টো ফল হবার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। আসলে মানুষ কখনো সত্যিকার অর্থে কোনো কিছু ভোলে না। আমরা শুধু ভাবি যে ভুলে গেছি।

একটা কম্পিউটার এ পথে কাজ করে না। যখন কিছু ভুলে যেতে বলা হয় তখন ভুলে যায়। তথ্যটুকু পুরোপুরি গাপ করে দেয়া হয়েছে।

সুতরাং হালের ঐ… অস্বাভাবিক অবস্থার কোনো স্মৃতিই নেই?

আসলে আমি এ ব্যাপারটায় একেবারে শতভাগ নিশ্চিত হতে পারছি না। চন্দ্র নির্দ্বিধায় বলে যাচ্ছে। কম্পিউটারের বিষয়েই শুধু সবাই ওর সাথে সব সময় কথা বলতে পারে-জগতের আর কোনো বিষয়ে নয়, কিছু মেমরি থাকতে পারে যা টেপওয়ার্ম সার্চ করার সময়… এক সার্কিট থেকে আরেকটায় চলে যায়। কিন্তু খুবই কম।

ভয়াবহ। বলল ক্যাপ্টেন অর্লোভা, যখন একই কথা চুপ করে থেকেও সবাই ভাবছে, কিন্তু আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল-ও আবারও মিথ্যা বলতে পারবে নাকি?

চন্দ্র উত্তর দেয়ার আগে ফ্লয়েড তাকেই আশা করল। তার আরো একটা কাজ আছে যা কেউ জানে না। চন্দ্রের ব্যাপারে তাকে কাঠখোট্টা অফিসিয়াল ভাষায় রিপোর্ট করতে হবে একটু পর।

ঠিক একই সেট পরিস্থিতি আবার আসবে না। কোনোদিন না। আমি কসম খেতে পারি। পুরো বিষয়টা এমন ঘোলাটে হওয়ার কারণ হল কম্পিউটারের কাছে নিরাপত্তা আর প্রাধান্য শব্দ দুটো ব্যাখ্যা করা বাস্তব ক্ষেত্রের চেয়ে অনেক কঠিন।

অথবা মানুষের কাছে। মুখ টিপে হাসল কার্নো। মোটা দাগের খোঁচাটা চন্দ্রের গায়ে লাগা উচিত।

আশা করি তুমিই ঠিক। কোনো মূল্যই দেয়নি তানিয়া কার্নোর কথায়, পরের ধাপটা কী, চন্দ্র?

তেমন জটিল কিছুই না-শুধু খুব লম্বা। এখন আমরা তাকে বৃহস্পতি ছাড়ার হিসাব নিকাশ করতে প্রোগ্রাম করব। এরপর ডিসকভারিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে বলব। তিন বছর পর আবার ফিরতে যাচ্ছি আমাদের প্রচণ্ড গতির অর্বিটে।

২৬. যাচাই

প্রতি: ভিক্টর মিলসন,

চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাস্ট্রোনটিক্স,

ওয়াশিংটন।

হতে : হেউড ফ্লয়েড, ইউ এস এস সি ডিসকভারি।

বিষয়: মহাকাশযানের কম্পিউটার হাল ন হাজার এর অস্বাভাবিক অবস্থা।

গোপনীয়তার শ্রেণী : অত্যন্ত গোপনীয়।

ডক্টর চন্দ্রশেখরামপিল্লাই (পরে সবার কাছে ডক্টর সি নামে পরিচিত।) প্রাথমিক পরীক্ষা শেষ করেছেন বৃহস্পতিতে আটকে পড়া হাল- নাইন থাউজ্যান্ড সিরিজের কম্পিউটারটার উপর। তিনি সব হারানো মডিউল প্রতিস্থাপিত করার পর জানান যে সার্কিটগুলো পুরোমাত্রায় সচল। ডক্টর সি আর টার্নোভস্কির কথা জানা যাবে তাঁদের দুজনের দেয়া রিপোর্টেই।

অন্যদিকে, কাউন্সিলের স্বার্থে আপনি আমাকে ওদের ওপর একটা নন টেকনিক্যাল ভাষায় সারমর্ম প্রকাশ করতে বলেছিলেন। অন্তত নতুন সদস্যদের স্বার্থে যারা আজও এসব টেকনিক্যাল টার্মের পুরো কথা বুঝে উঠতে পারেননি।

ফ্রি মনেই বলে ফেলি-আমার মনে হয় এ কাজটা করতে নাও পারি, কারণ আপনি জানেন আমি একজন কম্পিউটার স্পেশালিস্ট নই। কথা দিচ্ছি, তবু আমার সাধ্যানুযায়ী সবচে ভালটুকু করে ফেলব।

ঐ সমস্যার মূল ডক্টর সি ও অন্যরা ধরে ফেলতে পেরেছেন। হালের মৌলিক নীতি নির্ধারণের সাথে নিরাপত্তা ব্যবস্থার নীতির অসামঞ্জস্য দেখা। দেয়ায় এ সমস্যা হয়েছিল। সরাসরি দেয়া আদেশ অনুসারে, টি এম এ এক এর অস্তৃিত্ব গোপন করে রাখাটা ছিল একেবারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়। শুধু জরুরি প্রয়োজনে তাদের জানানোর অনুমতি দেয়া ছিল।

যখন টি এম এ এক খুঁড়ে বের করা হয় তার কয়েকদিন আগেই .. ডিসকভারির বৃহস্পতির দিকে যাত্রার চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। এটাকে আরো নিশ্চিত করে টি এম এ এক তার সিগনাল বৃহস্পতির দিকে পাঠিয়ে। যেহেতু মূল কুরা (বোম্যান ও পোল) শুধু এটুকু জানত যে, শিপকে নিয়ে যেতে হবে লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে নতুন উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু বলা হবে না। অনুসন্ধানকারী দলকে (কামিনস্কি, হান্টার, হোয়াইটহেড) আলাদা ট্রেনিং দিয়ে তিনজনকেই অভিযান শুরুর আগে আগে হাইবারনেশনে পাঠিয়ে মনে করা হয়েছিল যে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেছে। আর এ কারণেই নিরাপত্তার ফাঁক-ফোকড়ের সম্ভাবনা (অ্যাকসিডেন্ট অথবা আর যাই হোক) বেড়ে গেছে দারুণভাবে।

আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ঐ সময়ে (ভবিষ্যতের জন্য রাখা আমার তথ্য এন সি এ তিনশো বিয়াল্লিশ তেইশ) টপ সিক্রেট ০১.০৪.৩০) আমি নীতিটার বিরুদ্ধে অনেক কথা তুলেছিলাম-এমনকি অবজেকশনও-যাই হোক, ওগুলোকে উচ্চ স্তর থেকে বাতিল করা হয়।

মানব সহায়তা ছাড়াই হাল পুরো মিশন চালাতে সক্ষম হওয়াতে ওকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যাতে মানব ক্রুদের অনুপস্থিতি, অপারগতা বা মৃত্যুতেও ও মিশন শেষ করতে পারে। এ কারণেই সব তথ্য তাকে দেয়া হয়। কিন্তু এসব ডাটা বোম্যান অথবা পোলের কাছে প্রকাশের অনুমতি দেয়া হয়নি।

এ পরিস্থিতি হালের ডিজাইনের উদ্দেশ্যের সাথে খাপ খায় না। তথ্যের বিকৃতি অথবা গোপনীয়তা ছাড়া প্রসেসিং হল তার ডিজাইনের ভিত্তি। এ কারণেই হালের ভিতরে বাসা বেঁধেছে যাকে মানবিক ভাষায় বলা হয় সাইকোসিস১২৩-আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে সিজোফ্রেনিয়া।

ডক্টর সি আমাকে প্রাযুক্তিক পদ্ধতিতে জানিয়েছেন যে, হাল হটাটার মোবাস ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থাটা উন্নত কম্পিউটারের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষ করে যেগুলো নিজে নিজে উদ্দেশ্যে জড়ানোর জন্য প্রোগ্রামড়। তিনি বলেছেন যে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য স্বয়ং প্রফেসর হটাটারের সাথে যোগাযোগ করলেই আপনাদের জন্য ভাল

এটাকে পরিষ্কারভাবে বসাতে হলে বলতে হয়, (যদি আমি ডক্টর সি কে বুঝে থাকি) ও জটিলতম-বলা ভাল অসহ্য দ্বিমুখীতায় পড়ে গিয়েছিল যেটা তার সব কাজে দিয়েছে বাঁধা। এমনকি এমন প্যারানোয়ায়২৫ ভুগছিল যে, পৃথিবী থেকে তার কাজ মনিটরিংয়ের বিরুদ্ধে যেতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। সাথে সাথেই মিশন কন্ট্রোলের সাথে রেডিও যোগাযোগ বন্ধ করতে চেয়েছে। প্রথমেই না থাকা কল্পিত একটা সমস্যার কথা রিপোর্ট করেছে এ ই পঁয়ত্রিশ এন্টেনা ইউনিটের ব্যাপারে যাতে যোগাযোগ বন্ধ রাখা যায়।

ব্যাপারটা তাকে শুধু সরাসরি মিথ্যার দিকে ঠেলে দেয়নি বরং সরাসরি আর সব ক্রুর বিপরীতে আরো বিপ্রতীপ করে তোলে। সম্ভবত (আন্দাজ করে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই) তাঁর মতে হালের একমাত্র উপায় ছিল নিজের মানব ক্রুদের হত্যা করা-আর সাফল্যের সাথেই করেছে ওই কাজটা। এ বিষয়ের সবদিকে ঠিকমতো তাকালে বোঝাই যায় ও হয়ত মানুষের নাক গলানো ছাড়াই মিশন চালিয়ে গিয়েছিল।

এটুকুই সব। এরচে বেশি প্রশ্ন করতে মোটেও ইচ্ছা করেনি ডক্টরকে–চাইও না করতে। তিনি নিজের মনোযোগের শেষস্তরে কাজ করছেন। এর পরও যদি আমাকে কিছু করতে বলা হয়, তো (নিশ্চিত জেনে রাখুন, এটা একটা তথ্য।) তিনি একেবারেই সহযোগী মনোভাবের নন।

তিনি সব সময় হালের প্রতি একটা নমনীয় মনোভাব নিয়ে কথা বলেন যা সেসব বিষয় নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে সমস্যা বাড়িয়ে তোলে। এমনকি ডক্টর টানোভস্কি-যাকে সবাই নিরপেক্ষ ভাবতে পারে তিনিও একই দৃষ্টিভঙ্গীতে কাজ করেন বেশিরভাগ সময়।

যাই হোক, একমাত্র গুরুত্ববহ প্রশ্ন হল-আবার হাল মিথ্যা বলতে পারবে কিনা। অবশ্যই ডক্টর সির এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দাবী করেছেন যে ঐ দারুণ সমস্যময় ঘটনা থেকে শুরু করে বিচ্ছিন্ন হওয়া পর্যন্ত হালের সব স্মৃতি এখন লুপ্ত। আর তিনি এবারও বিশ্বাস করেন না যে, হাল আবার এমন কিছু করতে পারে যা মানুষের বিচারে ঠিক নয় বা অপরাধ।

যেভাবেই হোক না কেন, তিনি বলতে চাচ্ছেন যে আগের সে পরিস্থিতি আর ফিরে আসবে না। কারণ সবাই সচেতন। আমরা মেনেও নিয়েছি। শুধু একটা ব্যাপার। যদি ঐ অবস্থা ফিরে আসলেও সে বিপদের কারণ হয়-অথবা সে আবারো কোনো না কোনো ভাবে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে সে আবার ঐ পরিস্থিতিতে পড়বে-তাহলেতো আবারও হাল বিপজ্জনক। নিরাপদ বলার যুক্তি কোথায়? আর হালতো হাজার রকমের অস্বাভাবিকতায় ভোগে। এগুলোর কোনো কোনোটা হাস্যকর, কোনোটা ভয়ংকর। আপনি-আমি জানি; শুধু ডক্টর সি জানেন না-আমি অবশ্য শেষ চালটা আমার হাতেই রেখে দিয়েছি।

মূল কথা: হাল ন হাজার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কাজ দ্রুত সারছে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে। কেউ এটাকে প্রোবেশনও বলতে পারে।

আমার ভয় অন্য কোথাও। সে জেনে ফেললে কী হবে?

২৭. যার যা বিশ্বাস

যেকোনো পরিস্থিতিকে নিজের সাথে মানিয়ে নেয়ার অসীম ক্ষমতা আছে মানব মনের। একঘেয়ে কিছু সময় গেলে অসম্ভবও অপরিহার্য হয়ে যায় মানব মনের জন্য। মাঝে মধ্যেই লিওনভের ক্রুরা তাদের চারপাশটাকে ভুলে যায়-হতে পারে কোনো সচেতনতার পথে অসচেতন পদচারণা।

ডক্টর হেউড ফ্লয়েড প্রায়ই ভাবে এসব পরিস্থিতিতে ওয়াল্টার কার্নো একটু বেশিই খাটাখাঁটি করে সবার মধ্যমণি হয়ে। শাসা কোভলেভ সত্য বিশ্বাস এর পর্ব করার ধারণা দেয় হঠাৎ করেই। তার মনে হয় শাসা নিজেও আগে ভাবেনি এমন কথা। একেবারে হঠাৎ করেই এ মজার মিটিং এসে পড়ে যখন ও জিরো গ্র্যাভিটির উপর চিরকালীন জেদ প্রকাশ করল।

আমি যদি একটা ইচ্ছা পুরো করতে পারতাম, তাহলে, সে নিয়মিত সিক্স ওক্লক সোভিয়েতে বলেছিল-অনেকটা আফসোসের সাথেই, একটা ফেনায় ভরা বাথটাবে ডুবে যেতাম। পাইনের গন্ধে ভুরভুর করত পুরো ঘরটা। আর পানির উপরে থাকত শুধু আমার নাক। উফ! ঘণ্টার পর ঘণ্টা!

সুগন্ধির প্রভাব আর গোসলের হতাশা দুইই চলে যাবার পর ক্যাথেরিনা রুডেঙ্কো চ্যালেঞ্জটা নিল, তোমার চাওয়াটা খুবই ছোট, ওয়াল্টার; আমি পৃথিবীতে ফিরতে পারলে এরচে ভাল কিছু চাইতাম।

যেমন?

হু…আমি কি সে সময়ে ফিরে যাওয়ার অনুমতি পেতে পারি?

ইচ্ছা হলে।

ছোট এক মেয়ে আমি তখন। ছুটির দিনগুলিতে চলে যেতাম একটা সমবায় ফার্মে। তখন জর্জিয়ায় থাকি। এক ইয়া বড় পালমিনো ঘোড়া ছিল ওখানটায়। ডিরেক্টরের আনা। বোঝাই যায় কালো বাজারের পয়সা। একটা আস্ত শয়তান হলেও বুড়োটাকে আমি ভালবাসতাম। বুঝতেই পারো-ও আমাকে আলেকজান্ডারের পিঠে চড়ে সারাটা দেশ ঘুরে বেড়াতে দিত। যে কোনো সময় পড়ে গিয়ে মরে যেতে পারতাম আমি। তবু বসুধাকে স্বর্গ হিসেবে যখনি ভাবি তখনি ওই মধুর স্মৃতি আমাকে তাড়া করে।

একটা দীর্ঘ মুহূর্ত ধরে সবাই নিজের মধ্যে ডুবে গেছে যেন এরপর। কার্নো আরো কাউকে ডাকল, আর কোনো স্বেচ্ছাসেবী?

সবাই মহাকাশের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র ঐ পৃথিবীতে এমনভাবে জমে গেল যে খেলা বন্ধ হওয়ার পথে। এমন সময় ম্যাক্সিম ব্রেইলোভস্কি বদলে দিল গিয়ার, আর আমি অবশ্যই চাইব অতল সাগরে ডাইভিং করতে। এটাই আমার সবচে প্রিয় শখ-একটা ডাইভ দেয়ার সময় পেলেই হল। কসমোনট ট্রেনিংয়ের সময় দারুণ সুখে ছিলাম ঝপাঝাপি চালিয়ে যেতে পারায়। প্যাসিফিকের অতলে ডুব মেরেছি কোরাল সারির মাঝে। অথবা দি গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে,১২০ লোহিত সাগরে। জানো, পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ঘাপটি মেরে আছে কোথায়? প্রবাল প্রাচীরে। তবু আমার সবচে মজার অভিজ্ঞতাটা অন্যখানে। এক জাপানি কেল্প বনে। পানির তলায় এক শ্যাওলা ধরা প্রধান গীর্জা যেন! অসীম পাতার উপরে সূর্যের কৃপণ আলো মাঝে মাঝে বয়ে যাচ্ছে উপরের ঢেউয়ের সাথে মিল রেখে। নড়েচড়ে। রহস্যময়…জাদুতে ভরা। আমি হয়ত আর কখনো ফিরে যাব না। পরের বার আর তেমন নাও থাকতে পারে জায়গাটা। কিন্তু ফিরে গেলে ওদিকেই যাব আমি। যাবই।

দারুণ! বলল ওয়াল্টার। স্বভাবতই নিজেকে মধ্যমণি করে রেখেছে, নেক্সট পজিশন কার?

আমি তোমাদের খুব দ্রুত জবাব দেব। বলল তানিয়া অর্লোভা, (বলশোয়ি-রাজহংসের হ্রদ। কিন্তু ভ্যাসিলি রাজি হবে না। বলতে গেলে ও ব্যালে ড্যান্স ঘেন্না করে।

ঠিক আছে। আরো মজা। দুজন দু রকম। কে বলেছে তোমাদের দুজনকে একসাথে পৃথিবীতে গিয়ে একই জিনিসকে সেরা বলতে? ভ্যাসিলি কোনটা বেছে নিচ্ছ?

আমি ডাইভিং বলতে যাচ্ছিলাম। বিধি বাম। ম্যাক্স দখল করে বসেছে। ঠিক হ্যায়, উল্টোটা। গ্লাইডিং। নীরব গ্রীষ্ম দিনের প্রথম সকালটায় মেঘগুলোর ভিতর দিয়ে জায়গা করে নেব নাহয়। নানা, শেষ হয়নি-ডানার উপরে বয়ে যাবে বাতাস। হয়ত চিল্লাচিল্লি করবে যখন তুমি মোড় নাও। পৃথিবীকে উপভোগের এটাই পথ। একটা পাখি হয়ে। পৃথিবীরই উপরে ভেসে ভেসে। সব সময় ওকে সামনে রেখে। যাতে হারিয়ে না যায়।

জেনিয়া?

সোজা। পামিরের উপর দিয়ে কি করে করে যাব। তুষার ভালবাসি।

আর তুমি, চন্দ্র?

পরিবেশ দেখার মতো বদলে গেছে ওয়াল্টারের কথার সাথে। এই এতকিছুর পরেও, এত সময় পরেও চন্দ্র একজন নবাগত। পুরোপুরি দ্র। কখনো কখনো সম্মানও দিচ্ছে অন্যকে। কিন্তু নিজেকে কখনো তুলে ধরেনি সবার সামনে।

যখন আমি ছোট্ট ছেলে, তখন… সে ধীরে বলে যায়, আমার দাদা একটা ধর্মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন বারনসী…বেনারসে। তোমরা যদি কখনো না গিয়ে থাক তো কস্মিনকালেও বুঝবে না। আমার কাছে অনেক ভারতীয়ের কাছে এমনকি আজো-তাদের ধর্ম যাই হোক না কেন, এটাই মহাবিশ্বের কেন্দ্র। একদিন ফিরে যাবার ইচ্ছা ভিতরে ভিতরে রয়ে গেছে।

নিকোলাই, তুমি?

ভাল, আমরা সাগর আকাশ সবই পেয়ে গেছি এর মাঝে। আমি দুটোকেই মিলিয়ে দিতে চাই। উইন্ডসার্ফিং আমার প্রিয় খেলা। জানি এর জন্যে আর উপযুক্ত নই। অনেকটা বুড়িয়ে গেছি। তবু আবার এটাকে খুঁজে পেতেই আমার আনন্দ।

শুধু খুঁজে পাওয়াটাই তোমাকে ছেড়ে গেছে। উডি, তোমার পছন্দ?

ফ্লয়েড ভাবার জন্যেও থামল না। তার মুহূর্তের জবাব আর সবার মতো নিজেকেও অবাক করেছে, পৃথিবীর কোথায় আমি তাতে কিছুই আসে যায় না যদি

আমার পিচ্চি ছেলেটা সাথে থাকে।

এরপর আর সেখানে বলার কিছু ছিল না। কেমন এক নিরবতা চারদিকে। বৈঠক শেষ হল সাথে সাথেই।

২৮. হতাশা

সব টেকনিক্যাল রিপোর্টই দেখেছ তোমরা। দিমিত্রি, আমাদের হতাশার কারণটা অবশ্যই বুঝতে পারছ, স্পষ্ট। আমাদের সব টেস্ট আর গুনাগুনতিতে কিছুই শিখিনি। শুধু সেখানে জাগাদকাকে দেখা যায়, ব্যস। আধখানা আকাশ জুড়ে থেকে আমাদের অবহেলা করেই যাচ্ছে।

আজো এটা নিষ্ক্রিয়-অকর্মা পরিত্যক্ত জিনিস। ভ্যাসিলি পথ বের করেছে একটা। যদি মুক্ত বিন্দুতে থাকতেই চায় তো কোনো না কোনো সক্রিয়তা দেখাতে হবে এবার। নাহয় ডিসকভারির মতো এক কোণা থেকে আরেক কোণায় ঘুরে বেড়াতে থাকবে বৃহস্পতির কোনো না কোনো অর্বিট ধরে। বাকি অংশটা আইওতেই বিস্ফোরিত হবে।

তো, ঠিক পরের কাজটা কী হবে আমাদের? জাহাজে পারমাণবিক বোমা থাকার কথা না। অন্তত জাতিসংঘের সনদ শূন্য আট এর তৃতায় প্যারা অনুসারে। আরে আমি শুধুই ঠাট্টা করছি…

এখন চাপ কম। বাড়ির পথের রওনা এখনো কয়েক সপ্তাহের দূরত্বে। প্রায়ই আমরা সবাই বিরক্তিতে মরে যাই, একই সাথে হতাশায়ও। হেসো না। জানি মস্কোতে বসে তোমার এসব শুনতে কেমন লাগে। কোনো বুদ্ধিমান লোক কেমন করে এখানে আসে সেসব দারুণ জিনিস দেখতে যা দেখে তার সাথীরা ছাড়া আর কোনো মানুষ বেঁচে নেই?

তবু এ নিয়ে কোনো যুক্তি চলে না। আগে আত্মবিশ্বাস যা ছিল আজ আর তা নেই। এখন পর্যন্ত আমরা ভালই আছি। আশ্চর্যজনক ব্যাপার। তবু সবারই একটু ঠাণ্ডা, নাহয় পাকস্থলির গণ্ডগোল, অন্তত চামড়ায় দাগ পড়েছে ক্যাথেরিনার সব পিল আর পাউডারেও যা সারবে না। ও কিন্তু হাল ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের সাথে এখন শুধু ওয়াদাই করে।

শাসা আমাদের জন্য একটু সুযোগ করে দিয়েছে কদিন আগে। বুলেটিন বোর্ডে বুলেটিন রেখে হাসাহাসি করা যায়। ওদের থিমটাও মজার নিয়ে এসো রাশলিস!

ও রাশিয়ান আর ইংলিশ ভাষা মিশিয়ে জগাখিচুড়ি করেছে ভয়াবহভাবে। সব সময়ই দাবী করে যে এ দু ভাষারই হঠাৎ শোনা ভুল ব্যবহার করা আরো নানা কিছু হয়ে যাওয়া শব্দ শুনেছে সে। বাড়ি ফেরার সময় আমাদের সবাইকেই নাকি ভাষাটা ঠিক করে নিতে হবে। প্রায়ই তোমার দেশের অনেক লোক দেখেছি যারা ইংরেজি বলেই যাচ্ছে একটুও সচেতন না হয়ে। আরো মজার ব্যাপার হল, ঠেকে গেলেই দেশি কথার ছায়ায় চলে যায়। আরেকদিন নিজের অজান্তেই আমি ওয়াল্টার কার্নোর সাথে কথা বলা শুরু করেছি রাশিয়ানে। ঘটনা অন্যখানে, কেউই কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্যাপারটা ধরতে পারিনি।

আমাদের মনের অবস্থা বুঝবে আরেক দিনের কথা শুনলে। একটা স্মোক ডিটেক্টরের বদৌলতে মাঝরাতে ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। যাই হোক, বোঝা গেল চন্দ্র নেশার তাড়া খেয়ে ওর একটা বিশাল সিগার পুড়িয়েছে। ভয় পাওয়া স্কুল বয়ের মতো টয়লেটে বসেই টানতে শুরু করেছিল একটা। লজ্জা পেয়েছিল দারুণ। স্বাভাবিক। আর আতঙ্ক কেটে যাবার পর বাকি সবাই ধরে নেয় এ এক ঐতিহাসিক হাস্যকর ব্যাপার। কিছু কিছু সত্যিকার কমদামি কৌতুক থাকে যেগুলো বাইরের লোকের কাছে কিছুই না হলেও উপস্থিত থাকা বুদ্ধিমান মানুষেরাও হাসিতে ভেসে যায়। পরের কয়েক দিন একজন শুধু একটা সিগার ধরানোর ভান করত, বাকিরাও সাথে সাথে…

আরো অদ্ভুত ব্যাপার হল, চন্দ্র যদি কোনো এয়ারলকে ঢুকে যায় অথবা স্মোক ডিটেক্টর বন্ধ করে দেয় তবু কেউ কিছু মনে করে না। কিন্তু ওর সবচে বড় লজ্জা ছিল নিজের ভিতর। ওর একটা অতি সাধারণ মানবিক দুর্বলতা আছে। এটাও হয়ত হালের সাথে যোগাযোগ করে আগের চেয়ে বেশি সময় কাটিয়ে দেয়ার একটা কারণ; সিগার থেকে দূরে থাকা যায়, দূরে সরা যায় আমাদের ঠাট্টা থেকেও।

ফ্লয়েড পজ বাটন চেপে রেকর্ডিং বন্ধ করল। চন্দ্রকে নিয়ে এভাবে মজা করাটা উচিত না। কোনো একদিন এমন কিছু হয়েছে-তবু কাজটা ঠিক না। শেষ কয়েক সপ্তায় ভেসে ওঠা শুরু করে সবার ব্যক্তিত্বের ছোটখাট মজার দিকগুলো। এমনকি কোনো আসল কারণ ছাড়া কয়েকটা ঝগড়াও হয়ে গেছে। এসব দিক থেকে ভাবলে ওর নিজের আচরণ সম্পর্কে কী বলা যায়? এটা কি সব সময় সমালোচনার উর্ধ্বে?

ও এখনো ঠিকভাবে বলতে পারবে না আদৌ কার্নোর সাথে ঠিক ব্যবহার করতে পেরেছে কিনা। কখনোই ঐ বিরাট ইঞ্জিনিয়ারকে অথবা ওর জোর গলাটা ভাল লাগেনি কিন্তু ইদানীং যে ব্যবহার করে তা ঠিক সম্মান দেয়ার ধারে কাছে নেই।

পলিয়োস্কো পলির মতো বিখ্যাত ব্যাপারগুলো হাসি-ঠাট্টায় ভোলার কারণে ওকে রাশিয়ানরা সম্ভবত একদমই পছন্দ করে না। এসব ব্যাপার প্রায়ই কান্নায় শেষ হয়। আর একটা ব্যাপারে ফ্লয়েড অনুভব করল যে ভালবাসা বেশ খানিকটা দূরেই সরে গেছে এ কদিনে।

ওয়াল্টার, ও সতর্কভাবে শুরু করে সেদিন, মনে হয় না এটা আমার কাজের মধ্যে পড়ে, তবু একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার তোমার সামনে তুলতে চাচ্ছি।

কেউ যখন আগেভাগেই বলে তার ব্যাপার না-প্রায় সব সময়ই সে ঠিক। সমস্যাটা কী?

আসলে, ম্যাক্সের সাথে তোমার ব্যবহার…

একটা জমাট নিরবতা চারদিকে। ফ্লয়েড নৈঃশব্দের একপ্রান্ত ধরে রেখেছে দেয়ালের বিশ্রী পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে থেকে। এরপর কার্নো এখনো নরম থাকা সুরে বলল, ওর বয়স আঠারোর বেশি ভেবে আমি আসলে অবাক হয়েছিলাম।

ব্যাপারটাকে ঘোলা করোনা। আর খোলাখুলিই বলি, ম্যাক্সের ব্যাপারে না, আমি ভয় পাচ্ছি…জেনিয়াও জড়িয়ে গেল।

কার্নোর ঠোঁটদুটো হঠাৎ চেপে বসেছে। বোধহয় ও অবাক এ কথায়, জেনিয়া? ওর আবার আমাদের সাথে কী দরকার?

যে কোনো বুদ্ধিমানের কাছেই তুমি সহজে হজম হয়ে যাবে-বোকাও বনে যেতে পার। জানো নিশ্চই-ও ম্যাক্সকে ভালবাসে। ম্যাক্সকে জড়িয়ে ধরার সময় কীভাবে তাকিয়েছিল তোমার মনে নেই?

ফ্লয়েড কখনো ভাবেনি কার্নোকে অবাক চোখে তাকাতে দেখবে। আঘাতটা বোধ হয় বেশি হয়ে গেল, জেনিয়া? আমি মনে করেছি প্রত্যেকেই ঠাট্টা করে। ও একটা ছোট ইঁদুরছানা ছাড়া কি না। আর প্রত্যেকেইতো ম্যাক্সের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এমনকি বিশালদেহী ক্যাথেরিনাও। তবু…হু, আমার মনে হয় আরেকটু সচেতনভাবে চলাফেরা করলেই আমার ভাল হয়। অন্তত জেনিয়া আশপাশে থাকার সময়।

সামাজিক তাপমাত্রা সাধারণ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একটা লম্বা বিরতি ঝুপ করে নেমে এসেছিল। কোনো অসুস্থ অনুভূতি নেই যে সেটা প্রমাণ করতেই কার্নো কথাবার্তার ঢঙে বলল, তুমিতো জানো, মাঝেমধ্যেই আমি জেনিয়াকে দেখে অবাক হতাম। কেউ একজন ওর মুখে প্লাস্টিক সার্জারির দারুণ কাজ দেখিয়েছে। কিন্তু সবটা ঠিক করতে পারেনি। চামড়া দারুণ টানটান। আর মনেও করতে পারব না কখনো ওর একটা পরিপূর্ণ হাসি দেখেছি কিনা। এজন্যেই বোধ হয় ওর দিকে না তাকানোর চেষ্টা করেছি সব সময়। তুমি কি আমাকে এটুকু সৌন্দর্যে অভিভূত মানুষের মর্যাদা দেবে, হেউড? ওর জন্যে হিংসায় পড়ে আমি ম্যাক্সের সাথে…

পুরোপুরি অন্যরকম ডাক, হেউড টা প্রাতিষ্ঠানিকতা বহন করে। হিংস্রতার বদলে ভদ্রতাই উঠে আসছে ওর তরফ থেকে। ফ্লয়েড নিজেকে একটু সহজ করে নিল, আমি তোমার কয়েকটা আগ্রহের জবাব দিতে পারি-ওয়াশিংটন জানে ব্যাপারটা। বোঝা যায় যে, ও কোনো ভয়ানক এয়ারক্রাশে পড়েও বেঁচে গেছে। এখানে কোনো রহস্যই নেই-যতটুকু আমরা জানি। কিন্তু আজকাল এয়ারক্রাফটে দুর্ঘটনা হওয়ার কথা না।

বেচারি। ওকে স্পেসে আসতে দিয়েছে এটাই আমার প্রথম প্রথম অবাক লাগত। তবু ইরিনার অ্যাক্সিডেন্টের পর একমাত্র ও ই ছিল যোগ্য মানুষ। ওর জন্য দুঃখ হয় আমারো। শারীরিক আঘাতের চেয়ে মানসিক কষ্টটা নিশ্চই বেশি ভয়ংকর।

আমিও নিশ্চিত। কিন্তু এর মধ্যেই কাটিয়ে উঠেছে পুরোপুরি। তুমি পুরো সত্যিটুকু বলছ না-ফ্লয়েড বলছে মনে মনে নিজেকেই, আর কখনোই কাউকে বলবে না। বৃহস্পতির মুখোমুখি হওয়ার পর তাদের সবার মধ্যে একটা বন্ধন গড়ে ওঠে। হয়ত ভালবাসার না-হয়ত শুধু একটু কোমলতা। কিন্তু এর মূল্যই মাঝে মধ্যে অমূল্য। হঠাৎ করেই ও কার্নোর প্রতি নরম হয়ে গেছে-বুঝতে পারে। কার্নোও জেনিয়ার জন্য নিজের উদ্বেগটার কথা ভেবে আশ্চর্য। তবু এটা নিয়ে নিজের কথার পক্ষে কিছু দাঁড় করাচ্ছে না কেউ।

কিন্তু ফ্লয়েড যুক্তি দেখালে বোধহয় ভুল হত না। কয়েকদিন পর ফ্লয়েড নিজেই ভাবতে বসে; ওর আচরণে জেনিয়ার প্রতি নরম মনোভাব বোঝা যায় না তো? কার্নো রেখেছে নিজের ওয়াদা। আসলেই প্রথমে না জানলে যে কেউ ভাববে যে জেনিয়া আশেপাশে থাকায় ও ম্যাক্সকে অবহেলা করে। ও জেনিয়াকে একটু বেশি ভালভাবেই নিচ্ছে। আসলেই বেশ কিছু সময়ে ও মেয়েটাকে জোরে হাসিয়ে ছাড়ে।

তবু নাক গলানোটা সার্থক-এর পেছনের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন। যদি দুর্বলতা হয়েও থাকে, তবু এ হাস্যকর কাহিনীর পিছনে অন্য এক অপরাধী মনকে খুঁজে পাওয়া যাবে সহজেই। এটা ঐ চিরন্তন গুপ্ত হিংসা যা প্রত্যেকেই করে-সম অথবা বিপরীতকামী; সত্যি বলতে গেলে-ফ্লয়েড বুঝতে পারে, ব্যাপারটা বিভিন্নমুখী সমস্যা নিয়ে দারুণভাবে এগিয়ে আসছে সামনে।

ওর আঙুল আবার রেকর্ডারের দিকে ফিরে যায় কিন্তু চিন্তার ধারাটা ভেঙে গেছে এর মধ্যেই। মেঘের মতো ঘনিয়ে আসে পরিবারের খণ্ড খণ্ড ছবিগুলো। ঠেকানো যায় না। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে স্মৃতি ক্রিস্টোফারের জন্মদিনটাকে ডেকে আনল। বাচ্চাটা কেকের তিন মোমবাতি নেভাতে চাইছে। স্মৃতিটা চব্বিশ ঘন্টার পুরনোও নয়। শুধু শত শত কোটি মাইল দূরের। ও এতবার ভিডিওটা চালিয়েছে যে এখন প্রতিটা নড়াচড়াই মুখস্থ।

আচ্ছা, ক্রিস যেন বাবাকে ভুলে না যায় সে উদ্দেশ্যে ক্যারোলিনা কতবার ওর মেসেজটা প্লে করেছে? নাকি পরের জন্মদিনে যখন ফিরবে তখন ক্রিসের কাছে ও একজন অপরিচিত লোক ছাড়া আর কিছুই হবে না? জিজ্ঞাসা করতেও ভয় পাচ্ছে ফ্লয়েড।

ক্যারোলিনকে ও ঠিক দোষও দিতে পারে না। হাইবারনেশনের কারণে ফ্লয়েডের মনে হয় মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই ক্যারোলিন ছিল ওর কাছে। আর জগৎগুলোর মাঝে ও স্বপ্নহীন ঘুম কাটানোর সময় মেয়েটা দুটা দীর্ঘ বছর পার করে বসেছে। একজন নতুন বিধবা হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এ এক লম্বা সময়; অন্তত ক্ষণিকের জন্য।

ভয় হচ্ছে খুব, একদিন হয়ত পৃথিবীতে নেমে যাব কোনো একটা শিপে করে-ফ্লয়েড কখনো এত হতাশায় পড়ে না, ভেঙে গেলে, হেরে গেলেও না-তারপর দেখব সময় আর দূরত্বের সাগরে কোথায় ভেসে গেছে আমার ঘরবাড়ি! হয়ত হারিয়েই বসেছি নিজের অজান্তে। মিশনে আমার ব্যর্থতার পর…অথবা যদি লক্ষ্যে যেতেও পারি, তবু সামনে কী পাব? কালো, নিরেট কালো একটা দেয়াল।

আর এখনো ডেভিড বোম্যানের সেই চিৎকার সবার মনে, মাই গড! আমার সামনেটা তারায় ভরা!

২৯. জরুরি

শাসা শেষবার কর্তৃত্ব ফুটিয়ে ঘোষণা করল:

রাশলিশ বুলেটিন # ৮

বিষয়: টোভারিশ (টোরিশ২৭)

আমাদের আমেরিকান বন্ধুদের প্রতি:

সত্যি, বন্ধুরা, আমার মনে নেই শেষ কবে আমাকে এভাবে ডাকা হয়েছিল। একুশ শতকের যে কোনো রাশিয়ানের কাছেই যুদ্ধযান পটেমকিন এক স্মৃতি জাগানিয়া নাম। লাল জামা-টুপি আর একই সাথে স্লাদিমি ইলেচের লম্বা বক্তব্যের স্মৃতি। এটা তিনি রেলওয়ের শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে দিয়েছিলেন।

যদিও আমি ছোট ছিলাম, তবু এটা ছেলেখেলা নয়, নয় দ্রুজহক-যাই মনে কর না কেন-তোমাদের ব্যাপার। তোমরা সাদরে আমন্ত্রিত।

কমরেড কোভালেভ।

ফ্লয়েড তখনো পড়তে পড়তে মুচকে হাসছিল যখন ভ্যাসিলি অর্লোভ লাউঞ্জ অথবা

অবজার্ভেশন ডেক থেকে ভেসে এসে ওর সাথে যোগ দেয়।

আমার অবাক লাগছে কী ভেবে জান? টোভারিশ! ইঞ্জিনিয়ারিং আর পদার্থবিদ্যা পড়া ছাড়া আর কিছু করার বা পড়ার সময় পেয়েছে কীভাবে ও? সারাক্ষণই নাটক আর কবিতা থেকে কোটেশন নিয়ে কথা বলে। আমার সন্দেহ ও হয়ত ওয়াল্টারের মতো ইংরেজিও বলতে পারবে।

কারণ ও প্রবেশ করেছে বিজ্ঞানের জগতে। শাসা হল-তুমি ওকে কী বলবে?-পরিবারের গর্ধভ? ওর বাবা ছিলেন নোভোসিবিরস্ক এর একজন ইংরেজির অধ্যাপক। বাসায় একটা পাগলাটে নিয়মও ছিল। সোমবার থেকে বুধবার পর্যন্ত বাসায় রাশিয়ান চলবে। বৃহস্পতি, শুক্র আর শনিবারে ইংরেজি।

আর রবিবার?

আর বলো না! ফ্রেঞ্চ অথবা জার্মান। বিকল্প সপ্তাগুলোও ভয়াল।

এবার বুঝলাম নিকোলটোনি দিয়ে তোমরা আসলে কী বোঝাও। ঠিক একটা গ্লাভের মতো খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। আসলেই কি শাসা ওর নিজের…দুর্বলতার কারণে হীনমন্যতায় ভোগে? আর এমন একটা ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও কেন ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেল?

নোভোসিরভিস্ক পড়লে জানতে পারতে কারা সার্ফ আর কারা অ্যারিস্টোক্রেট। শাসা ছিল এক তরুণ উচ্চাকাতক্ষী। তার আরো একটা প্রাস পয়েন্ট-মেধা।

ঠিক তোমার মতো, ভ্যাসিলি।

এট টু টে! ফাজলামি করো না। তবে ঠিক, আমি শেক্সপিয়র বলতে পারি যেমন পারি বোহে মোয়ি! কিন্তু আবার কী হল?

ফ্লয়েড দুর্ভাগা-বেচারা অবজার্ভেশন উইন্ডোর ভিতরে ভাসতে ভাসতে ঢুকে পড়েছে। তাও ভাল, শুধু পেছনটা! আর কথা বলায় এত বেশি মজে গেছে যে টেরই পায়নি। ব্যাপারটা হাস্যকর। অন্তত ফ্লয়েড ভাবল ওর ক্ষেত্রেও একবার হল হাস্যকর ঘটনা। যথারীতি এটা ছড়িয়ে দেয়ার মহান দায়িত্বটা নিজ থেকেইে কাঁধে নিয়ে নেবে ভ্যাসিলি।

কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরে যখন মুচড়ে ভেতরে ঢুকল ও, অবজার্ভেশন উইন্ডোর ভিতর দিয়ে দেখা যায় বৃহস্পতির বিরাট বৃত্ত। কিন্তু ওটা কোনো ঘটনা না। ঘটনা

অন্য কোথাও। বৃহস্পতির আলোয় বিগ ব্রাদারকে দেখা যাচ্ছে। কেন যেন একটা হিম স্রোত বয়ে গেল ওর শিরদাঁড়া বরাবর। অকারণেই ফ্লয়েড ভাবল একটা কথা।

ওরা আসার পর এই প্রথম বিগ ব্রাদার তার সক্রিয়তা দেখালো। এই প্রথম। এবং শুরু।

হয়ত ভ্যাসিলির স্মৃতিতে চিরদিনের জন্য এটা বসে গেছে। ঐ তীক্ষ্ণ ধারওয়ালা জিনিসটা দেখে একেবারে অন্যরকম, অতিমানবীয় অনুভূতি হচ্ছে যেন। অনুভূতিটা আসলেই ভয়াল হওয়ার কথা। কারণ ওরা মানুষ। আর মানুষের একটা অদ্ভুত গুণ হল, যা না বোঝার, তাও কেমন করে যেন বুঝে যায়। তবু ওরা বোঝেনি অনুভূতিটা কীসের।

কারণ, এর আগে, কখনোই ওদের সামনে অন্য জগৎগুলোর দুয়ার খুলে যায়নি।

দৃশ্যটা এক সেকেন্ডেরও কম সময় ধরে চলল। এর পর ও একটা অনিচ্ছাকৃত পলক ফেলার সাথে সাথেই মিলিয়ে গেল ভোজবাজীর মতো। না। না। হতে পারে না।

ভ্যাসিলি অর্লোভ একটা আকাশ দেখছিল-নাকি একটা এলাকা-হবে কিছু একটা, যাই হোক, দেখেছিল। দেখছিল তারায় ভরা এক জগৎ। না, সূর্যে ভরা। সূর্যে ভরা একটা নীহারিকার মাঝখান। এক কসমিক জোট! ঠিক ঐ মুহূর্তেই ভ্যাসিলি অর্লোভ চিরদিনের মতো পৃথিবীর নীল আকাশকে হারিয়ে ফেলল। ঠিক এখন থেকে ওরা হয়ত অসহ্য আর অসহ্য সব একাকীত্বে, অসহ্য সব শূন্যতায় হারিয়ে যাবে। এমনকি স্করপিও বা বৃশ্চিক নক্ষত্রমালা আর অরিওন এর নিপ্রভ আলোর দিকে বহুকাল তাকিয়ে থাকা যায়। কিন্তু এদিকে…এদিকে একটা মুহূর্তের বেশি নয়। না। ভ্যাসিলি অর্লোভ যদি বেঁচে থাকে, তাহলে সবাইকে জানিয়ে দেবে কেন ডেভ বোম্যান বলেছিল সেই বুক কাঁপানো কথা।

মাই গড! আমার সামনেটা তারায় তারায় ভরা!

ও যখন চোখদুটো খুলতে সাহস পাচ্ছে না তখন আর কিছুই নেই। অবশ্য পুরোপুরি নয়। আবার ঠিক হওয়া পাথুরে কালচে জিনিসটার উপর এক ম্লান সূর্য জ্বলছে এখনো।

কিন্তু ও দেখে থাকলেও একটা সূর্যের পক্ষে নড়াচড়া করা সম্ভব না। আবারো পলক ফেলে নিজের ভেজা চোখটাকে পরিষ্কার করে নিল সে। ঠিক, নড়াচড়া আসলেই হয়েছে। কল্পনা করেনি।

উল্কা নাতো? চিফ সায়েন্টিস্ট ভ্যাসিলি অর্লোভ বিবশ হয়েছিল এত বেশি সময়ের জন্য যে, এটুকুও মনে করতে পারেনি বায়ুশূন্য আকাশে উল্কা পিণ্ড পড়া অসম্ভব। যে কোনো পাথুরে মহাকাশের বস্তু বাতাসের সাথে ঘষা লেগেই উল্কা হয়ে জ্বলতে জ্বলতে পড়ে যায়। জ্বলতে জ্বলতে পড়ে যায়, কিন্তু নিচেই জন্মে না। ওটা আরো হাজারটা সূর্যের সাথে বিগ ব্রাদারের মুখে দেখা দিয়ে নিচেই ঘোরাফেরা করছে একা একা।

একবারের জন্য মলিন হয়ে গেল হালকা আলো হয়ে। আর হৃদপিণ্ডের কয়েকটা ধ ধক্ যেতে না যেতেই হারিয়ে গেল বৃহস্পতির পেছনে।

ভ্যাসিলি একজন শক্ত স্নায়ুর মহাকাশচারী। এর মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে নির্লিপ্ত একজন দর্শক বনে গেল সে।

ওর এর মধ্যেই এ জিনিসটার যাত্রাপথ বোঝা হয়ে গেছে। না। অসম্ভব। ওটা যাচ্ছে পৃথিবীর দিকে।

এক নক্ষত্র শিশু

পঞ্চম পর্ব : এক নক্ষত্র শিশু

৩০. আবার আসিব ফিরে

ও যেন একটা স্বপ্ন দেখে উঠল মাত্র। অথবা একটা স্বপ্ন ক্ষেত্রে বসে স্বপ্নের ভিতর দেখছে স্বপ্ন। তারার রাজ্যের দরজাটা ওকে আবার ফিরিয়ে এনেছে মানুষের জগতে। কিন্তু মানুষ হিসেবে নয়।

কতদিন ও দূরে ছিল? এক জীবন, নাকি দু জীবন? দু জীবনই। একটা সামনের দিকে এগিয়ে চলতে গিয়ে হারিয়ে যায় অন্যটা ফিরে এসে। ডেভিড বোম্যান হিসেবে-ইউনাইটেড স্টেটস স্পেসশিপ ডিসকভারির একমাত্র ক্রু ও অধিনায়ক হিসেবে ও আটকা পড়েছিল এক বিশাল, অপ্রতিরোধ্য ফাঁদে। ত্রিশ লক্ষ বছর আগে পাতা ফাঁদ। যে ফাঁদ শুধু সময়েই কার্যকর হবে। সঠিক সময়ে।

সে একের পর এক জগতে পরে গেছে এর মধ্য দিয়ে। পতন আর পতন। মিলিত হয়েছে সেসব আশ্চর্যজনক ঘটনার সাথে, সৃষ্টির সাথে, বিস্ময়ের সাথে যার কিছু কিছু বোঝে, আর কিছু বোঝে না। হয়ত কোনোদিনই বুঝবে না।

চির ত্বরণের গতিতে দৌড়ে চলে। এক অসীম আলোর গুহাপথ ধরে। নিজেই একটা আলো না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত চলেছে ছুটে। ও জানতো এটা অসম্ভব। কিন্তু আজ জানে কীভাবে সম্ভব। আসলেই আইনস্টাইন ঠিক ঠিক বলেছিলেন, মহান কর্তা রহস্যময় হতে পারেন, ঝগড়াটে নন।

সে এক মহাজাগতিক সুইচিং পদ্ধতির ভিতর দিয়ে গড়িয়ে গেছে তখন। এক বিশাল, অকল্পনীয় মহিমাময় জায়গার ভিতর দিয়ে-যেটা সবগুলো নীহারিকার কেন্দ্র। আবার বেরিয়েও এসেছে কোনো এক অজানা শক্তির দ্বারা রক্ষিত হয়ে। শক্তিটা কোনো লাল দানো নক্ষত্রের চারধার ছেয়ে ফেলতে পারে।

ও বিপরীত বৈশিষ্ট্যের সূর্যোদয়ও দেখেছে ওখানে, যখন ঐ উদিত হতে থাকা নক্ষত্রের সাদা বামন৩১ সাথী তারাটা আকাশে উঠে আসে। উঠে আসে ওর নিচের নক্ষত্রের গায়ে বিরাট আগুন উচ্ছ্বাস নিয়ে। আগুন জোয়ার হয় সাঁদা বামনেরই আকর্ষণে। ওর কোনো ভয় নেই। শুধু অবাক করা কল্পনা। এমনকি যখন নিচের আগুন খনির দিকে স্পেস পোডটা ওকে টেনে নেয় তখনো…

…থাকার জন্য একটা দারুণ হোটেল স্যুট ছিল যাতে প্রাত্যহিক কিছুরই অভাব নেই। এর প্রায় সবটাই মেকি। শেলফের বইগুলি ডামি। আইস বক্সের সব খাবারের কার্টন আর বিয়ারের ক্যানগুলোয় বিখ্যাত বিখ্যাত সব কোম্পানীর নাম লাগানো থাকলেও ছিল একই রকম তরল খাবারে ভর্তি। গন্ধটা যেমন তেম্নি স্বাদটাও অপূর্ব!

ডেভ বোম্যান কোনোকালেই বোকা ছিল না। দ্রুত বুঝতে পারল কোনো হোটেল স্যুট নয় বরং একটা মহাজাগতিক চিড়িয়াখানায় ও সামান্য এক নমুনা। বন্দীখানাটা খুব যত্নে গড়া। সমস্যা অন্য কোথাও। ওর জন্য এটা তৈরি করা হয়েছে ওরই দেখা এক টিভি প্রোগ্রামের বিলাসবহুল কোনো এক হোটেল কামরা থেকে। এবং বানানো হয়েছে ওর কল্পনা থেকে নিয়ে। ওর বইয়ের না পড়া পাতাগুলো সাদা আর পড়া পাতাগুলো লেখায় ভরা! তার মানে স্মৃতিতে যা আছে তা নিয়েই জগত গঠিত। ভয় ছিল একটাই। যারা আটকে রেখেছে তারাতো আসবে-কিন্তু কোন রূপে?

ঐ আশাটা কী বোকামি! ও এখন বোঝে; একজনের পক্ষে অন্তত একজন মানুষের পক্ষে বাতাসকে দেখা বা আগুনের আয়তন অথবা ভর বোঝ কোনো কালেই সম্ভব না। তারপর শরীর আর মনের অবসন্নতা গ্রাস করে। তারপর ডেভিড বোম্যান ঘুমাতে যায় শেষ বারের মতো।

এ এক অদ্ভুত ঘুম। ও পুরোপুরি অসচেতন ছিল না। কুয়াশার চাদর দারুণ এক বনকে ঘিরে ছিল যেন। কিছু একটা অথবা কেউ একজন মনকে নিচ্ছিল দখল করে। খুব ক্ষীণভাবে বুঝতে পারে-কোনো আগুন চারধার থেকে ঘিরে ধরেছে। গ্রাস করছে দারুণ যত্নে গড়া শরীরটাকে; নিশ্চিতভাবে, দ্রুত। এর এমন নিরাবেগ ধ্বংসের নিচে থেকেও একবিন্দু ভয় বা আশা কিছুই পায়নি। মাত্র একবার মনে হয়েছিল প্রত্যেক মানুষকেই মরতে হয়। ও হয়ত মারা যাচ্ছে।

সেই লম্বা ঘুমের মাঝেই কিছু কিছু সময় স্বপ্নে মনে হয়েছে ও তখন জেগে। বছরগুলো উড়ে যায়। একবার দেখা গেল একটা আয়নায় দেখছে নিজেকে। এক ভেজা মুখমণ্ডলকে নিজের মুখ হিসেবে আবিষ্কার করল। শরীর হয়ে যাচ্ছে বিশ্লেষিত। জীববৈজ্ঞানিক ঘড়ির কাঁটাগুলো ঘুরছে বনবনিয়ে। ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন একটা রাত্রিতে যা কখনোই পৌঁছতে পারবে না। একেবারে শেষ মুহূর্তে থমকে দাঁড়ালো-আর ঘুরতে শুরু করল বিপরীতে।

সুখের স্মৃতিগুলোর সবই একে একে জমিয়ে রাখা হচ্ছিল। দারুণ নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় ফিরে ফিরে আসছিল অতীত। আস্তে আস্তে তার অতীত এগিয়ে এসে সব জ্ঞান, সব অভিজ্ঞতা ধুয়ে দিল। এগিয়ে এল ছেলেবেলা। কিন্তু কিছুই হারিয়ে যায়নি। জীবনের প্রত্যেক মুহূর্তের প্রতিটি স্মৃতি আরো শক্ত হয়ে বসে যাচ্ছে মনের ভিতরে। একটা নিরাপদ সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। একজন ডেভিড বোম্যানের অস্তিত্ব ছিনিয়ে নেয়া হলেও আরেকজন হয়ে গেছে চিরঞ্জীব। চলে গেছে বস্তুকেন্দ্রিক সব চাহিদার বাইরে।

সে একজন নতুন দেবতা-যে এ জন্মের জন্য অপ্রস্তুত। প্রস্তুতির ধাপগুলিতে ভাসার সময় সে জানত সে কী ছিল এক সময়, শুধু জানত না একটা ব্যাপার। এখন কী হয়েছে। সে তখনো এক দোলচালে দুলছে-শুককীট আর প্রজাপতির মাঝামাঝি কোথাও। আরো স্পষ্ট করতে গেলে একটা লার্ভা আর শুয়োপোকার মাঝামাঝি…

এক সময় তন্দ্রা ভেঙে গেলে সময় আবার প্রবেশ করল তার ছোট্ট জগতে। সেই কালো চতুষ্কোণ রহস্যময় জিনিসটাই অবশেষে দেখা দেয় বন্ধু হিসেবে।

এটাকে চাঁদের বুকে দেখেছে। মুখোমুখি হয়েছে বৃহস্পতির অর্বিটে। জানত, কোনো না কোনোভাবে ওর পূর্ব পুরুষেরাও এর মুখোমুখি হয়েছিল। আজো এর অপরিমেয় রহস্য লুকিয়ে থাকলেও আর তা পুরোপুরি রহস্যময় নয়। এর কিছু কিছু ক্ষমতা এখন ও বোঝে।

অনুভব করেছে এটা একা নয়, বরং অনেক অনেকের মধ্যে একটা। কিন্তু পরিমাপের যন্ত্রগুলো একটা কথা ঠিকই বলবে, এ রহস্যময় জিনিস সব সময় এক আকৃতির। যতটুকু বড় হওয়া প্রয়োজন-ততটুকু।

কী অবশ্যম্ভাবী এর গাণিতিক অনুপাত! তিন সংখ্যার বর্গ, ১:৪:৯! ভাবনার বিস্ময় ঠেকে গেছে তিন সংখ্যার বর্গতে, প্রথম তিন সংখ্যা-ত্রিমাত্রিকতার প্রতিনিধি। তার মন শুধু তিন মাত্রার রহস্যতেই শেষ হয় কিন্তু এ বিশাল খালি জিনিসটার ভেতর তো আরো বিস্ময়ের, তারায় তারায় ভরা। হোটেল স্যুটটার বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না কোনোকালে। এক সময় মিশে যায় স্রষ্টার মনেই। তারপর সামনে ছিল গ্যালাক্সির আঘো আলো ছায়ায় ঘেরা ঘূর্ণি।

গ্যালাক্সিকে মনে হয়েছে কালো প্লাস্টিকের খণ্ডতে বসানো বিশাল, বিবশ করা সুন্দর কোনো মডেল। কিন্তু এই বাস্তব। এ বাস্তবটাকে চোখে দেখে কখনোই বুঝতে পারত না, চোখে না দেখে যেমন এক পলকেই অনুভব করছে, দেখছে। শুধু চেষ্টা করলেই মনোযোগ দিতে পারত এই গ্যালাক্সির দশ হাজার কোটি নক্ষত্রের যে কোনোটায়।

ভাসছিল সূর্য সমুদ্রে। জ্বলন্ত, হিবিজিবি গ্যালাকটিক কোর ১৩২ থেকে শুরু করে অনেক অনেক দূরে ছড়ানো একা, ভীত সব দানব তারা পর্যন্ত বিস্তৃত এ নক্ষত্র মহানদী। ঘুরতে থাকা গ্যালাক্সির সর্পিল, কালচে বিজন ঐ প্রান্তেই ওর উৎপত্তি। আকৃতিহীন ক্যাওস ১৩৩ আজো আছে, মাঝেমধ্যে একটু আলোকিত হয়ে ওঠে অকল্পনীয় দূরে থাকা কোটি তারকার নিভু নিভু আলোয়। ও জানে, এটাই সৃষ্টির মূল পদার্থ। আজো ব্যবহার করা হয়ে ওঠেনি। আজো গঠিত না হওয়া এক দলা বিবর্তন-সন্তান। সময় আসলে কী? এই এখানে, কালো এক অকল্পনীয় বিশাল অংশ অব্যবহৃত, যেখানে আজো সময়ের জন্মই হল না! যেদিন এ শুন্যতা ভরে উঠবে, পাবে নতুন আকার জীবনে জীবনে, সৃষ্টিতে সৃষ্টিতে, আলোতে আলোতে-সেদিক আজকের সব নক্ষত্র থাকবে কোথায়?

খেয়াল না করে একবার একটা ক্যাওস এলাকা পেরিয়েছিল। এবার আরো অনেক প্রস্তুত, যদিও জানতেই পারেনি কোনো অস্তিত্ব ওকে পরিণত করেছে নক্ষত্র সন্তানে। আবারো পেরুতে হবে ওই জায়গাটা…

মনের ফ্রেম থেকে গ্যালাক্সি বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে গেল সরাতে চাওয়ার সাথে সাথে। নক্ষত্র আর নেবুলার ১৩৪ দল উড়ে চলল এক অসীম গতিতে। ভৌতিক সূর্যগুলো ছিন্নভিন্ন করে ও চলে যায় প্রতিটার কোরের ভিতর দিয়ে।

সূর্যগুলো এক সময় ছোট থেকে আরো ছোট হয়ে যায়। সামনে আরেক আলোর ঝলকানি; মিল্কি ওয়ে আসছে, একটা ভৌতিক আলোকে পুঁজি করে-হয়ত কোনোদিন একে ও চিনত, হয়ত চিনে বসবে আবারো। মানুষেরা যে এলাকাটাকে সত্যিবলে, ও সেখানেই ফিরে এসেছে। ঠিক সে জায়গাটায় যেটা ও ছেড়ে এসেছে কয়েক সেকেণ্ড অথবা কয়েক শতাব্দী আগে। ও চারদিক সম্পর্কে সচেতন। এমনকি আগের বহু সেন্সর লাগানো বাহ্যিক দুনিয়া থেকে অনেক বেশি সজাগ। যে কোনোটার দিকে মনোনিবেশ করলেই তা বিশ্লেষণ করতে পারে একেবারে অসীম ভাগ-উপভাগে, যে পর্যন্ত টাইম স্পেসের একেবারে শেষ প্রান্তে মুখোমুখি না হয়, যার পেছনে শুধুই ক্যাওস।

সে নড়াচড়া করে, কিন্তু কীভাবে তা জানে না। আসলে যখন একটা শরীর ছিল তখন কি ও জানত কীভাবে নড়াচড়া করে? ব্রেন থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যে অদৃশ্য চেইন অফ কমান্ড কাজ করে সেটা নিয়ে কোনোকালে উচ্চবাচ্য করল নাতো!

ও চাইলেই ধারেকাছে থাকা নক্ষত্রের বর্ণালী নীলচে হয়ে যায়; ঠিক যতটুকু চায় ততটুকু। আলোর গতির চেয়েও অনেক কমে ও যাচ্ছে, যদিও চাইলে এ গতি আরো বাড়ানো যায়…আরো…আরো; তবু কোনো তাড়া নেই। আরো অনেক অনেক তথ্য প্রসেস করতে হবে, অনেক পড়ে আছে বিবেচনায় আসার পথে…আর জয় করতেও অনেক বাকি। সামনে আরো অনেক বড় কাজ বাকি থাকলেও এটাই প্রাথমিক লক্ষ্য।

পেছনে দ্রুত সরে যেতে থাকা জগতের দুয়ার অথবা সামনের প্রাথমিক সভ্যতার দু স্পেসশিপ-কোনো দিকেই ওর নজর যায়নি। এগুলো ওর স্মৃতির অংশ, কিন্তু ডেকে ফিরছে অন্য কিছু, এমন এক জগৎ ডাকছে যেটাকে দ্বিতীয়বার দেখার আশাও করেনি।

নক্ষত্রশিশু শুনতে পায় ঐ জগতের একেবারে অসীম কণ্ঠস্বরের প্রতিটাকে, আস্তে আস্তে যেগুলোর শব্দ বাড়ছে। এখনো এগিয়ে আসছে চিকণ চাঁদের রূপ নিয়ে সূর্যের দুর্দান্ত করোনার পেছন থেকে সেই পুরনো বিশ্ব। এরপর নীলচে সাদাটে চাকতি হয়ে বেরিয়ে এল পৃথিবী।

ওর আসার খবর জানতে পেরেছে সবাই। নিচের লোকারণ্যের প্রতিটা রাডারের অ্যালার্ম হয়ত বাজছে, আকাশগুলো হয়ত ছত্রখান হয়ে পড়েছে বিশাল বিশাল টেলিস্কোপের কারণে-আর হয়তো, হয়ত মানুষ যে ইতিহাস জানত, বিশ্বাস করত সে নাটকের যবনিকা পড়বে এবার।

হাজার কিলোমিটার নিচে অর্বিটে অর্বিটে ঘুরতে থাকা মরা কার্গোগুলো হঠাৎ যেন সচেতন হয়ে গেল। এগিয়ে আসছে একটা গোলা। এ কার্গোর দুর্বল শক্তির কোনো দামই নেই ওর কাছে, নয়তো কাজে লাগাতে পারত।

সার্কিটের গোলক ধাঁধায় ঢুকে ও দ্রুত এটার মরণ কেন্দ্র খুঁজে বের করে। বেশিরভাগ শাখাপ্রশাখাই বাদ দেয়া যায়, এগুলো শুধু নিরাপত্তার জন্য বানানো অন্ধপথ। ওর পর্যবেক্ষণের নিচে ওদের সব উদ্দেশ্যই একেবারে ছেলেখেলার মতো লাগে, যে কোনো পরিস্থিতিতে সে ওদের প্রত্যেকের ভিতর দিয়েই চলে যেতে পারে।

এখন সামনে শুধু একটা ছোট বাঁধা-এক অপরিণত কিন্তু প্রভাবশালী যান্ত্রিক সমন্বয় যা দুটো ভিন্ন যোগাযোগকে ধরে রেখেছে। আসল অধ্যায়টা শুরু করার জন্য এদের কাছাকাছি আসতে হবে। ইচ্ছা শক্তিকে সামনে ঠেলে দিয়ে প্রথম বারের মতো ব্যর্থ হতে দেখল তারকা সন্তান। কয়েক গ্রাম ওজনের মাইক্রো সুইচ নড়ছে না। ও এখনো আঁটি এনার্জির একটা সৃষ্টি; এ কারণেই বস্তুগত পৃথিবীর পুরোটা আওতার বাইরে। একটা সুইচও চাপতে পারবে না। তবু এর এক সহজ উত্ত আছে।

আরো অনেক জানতে হবে ওকে। সামান্য মনে করে এত বেশি শক্তি বইয়ে দিয়েছে এ যান্ত্রিক রিলের দিকে যে কয়েল গলে গেল ট্রিগার অংশটাকে অপারেট করার আগেই। মাইক্রো সেকেন্ডগুলি পালিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। বিস্ফোরক লেন্সগুলোর তাক করা দিক দেখতে মজাই লাগে। যেন কোনো নিভুনিভু ছোট্ট ম্যাচের কাঠি এক বিন্দু আগুন দিচ্ছে এক বিরাট বিস্ফোরক ভর্তি ট্রেনের গায়ে, ফলাফল…

একটা নীরব বিস্ফোরণ কয়েক মেগাটন বিস্ফোরক ছড়িয়ে দিয়ে ঘুমন্ত জগত্তার অর্ধেক ভরিয়ে দিয়েছে কৃত্রিম সূর্যাস্তের আলোয়। যেন আগুনের শিখাগুলোর ভিতর থেকে কোনো ফিনিক্স পাখি উঠে এসে যতটুকু দরকার অগ্নি-জীবন শুষে নিয়ে বাকিটা উগরে দিল। অনেক নিচের অ্যাটমোস্ফিয়ার-আবরণ অধিকাংশ রেডিয়েশন শুষে নিল। অ্যাটমোস্ফিয়ারটা সব সময়ই নীলচে সবুজ গ্রহকে উটকো ঝামেলা থেকে বাঁচায়। কিন্তু এ বিস্ফোরণের পর কিছু অভাগা মানুষ আর পশুপাখি থাকার কথা যারা আর কখনো কিছু দেখতে পাবে না।

মনে হচ্ছে ঘটনা দেখে পৃথিবী আঘাতে বোবা হয়ে গেছে। শর্ট আর মিডিয়াম ওয়েভের কথাবার্তাগুলো থেমে গেছে পুরোপুরি, হঠাৎ শক্তিমান হওয়া আয়োনোস্ফিয়ারই ওদের ফিরিয়ে দিয়েছে মাটিতে ৩৬। এখন শুধু মাইক্রোওয়েভগুলোই পৃথিবীকে ঘিরে থাকা কাঁচের স্তরটার গায়ে এসে পড়তে পারছে। এগুলোর বেশিরভাগই খুব সতর্কভাবে এ স্তরের জন্য পাঠানো, এবং বিচ্ছিন্ন হতে থাকা স্তরটা ধরতে পারল ঠিকই। এখনো মাত্র কয়েকটা শক্তিময় রাডার ওর দিকে তাক করা। এর কোনো গুরুত্বই নেই। এমনকি এগুলোকে সহজেই নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা থাকলেও সে তা করার কোনো চেষ্টাই করল না। যদি আরো বোমা এগিয়ে আসে, তাহলে একই নিস্পৃহতা নিয়ে তাকাবে। এখনকার জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় এনার্জিই ওর আছে।

আর এখন নক্ষত্র শিশু নেমে যাচ্ছে। দারুণ সর্পিল পথে নেমে যাচ্ছে। নেমে যাচ্ছে সেই কোনো ছোট্টবেলায় হারানো মানচিত্রের দিকে।

৩১. চাইনা মাগো রাজা হতে

একজন ফিন-ডি-সাইকল দার্শনিক একবার বলেছিলেন, এমনকি বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাঁর ব্যথার কথা প্রকাশ করেছেন যে, ওয়াল্টার ইলিয়াস ডিজনি ইতিহাসের যে কোনো ধর্মনায়কের চেয়ে অনেক বেশি খাঁটি মানবিক আনন্দ দিতে পেরেছেন মানব জাতিকে। শিল্পীর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরেও ফ্লোরিডার মাটি কামড়ে তাঁর স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে।

উনিশো আশির প্রথমদিকে ডিজনিভিলটা শুরু হওয়ার পরে (লেখকের কল্পনা) তাঁর এক্সপেরিমেন্টাল প্রোটোটাইপ কমুনিটি অব টুমরো বা আগামী দিনের পরীক্ষামূলক সমাজের নমুনা এখন নতুন করে আজকের টেকনোলজি এবং সমাজ ব্যবস্থার শোকেস হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এর দর্শকরা বুঝতে পারে যে ই পি সি ও টি-একট এর উদ্দেশ্য তখনই সফল হবে যখন একরের পর একর জমি সত্যিকারার্থেই একটি জীবন্ত, বাস্তব নগর হয়ে উঠবে যাকে মানুষজন বলবে, আমার ঘর।

ঐ প্রক্রিয়াটা শেষ হতে হতেই শতাব্দীর বাকি দিনগুলো গেল কেটে, এখন এই আবাসিক এলাকায় বিশ হাজার মানুষ থাকে। আর এটাই অপ্রতিরোধ্যভাবে পরিণত ও জনপ্রিয় হয়েছে মহান কার্টুনিস্টের নামে, এপকট ডিজনিভিল। ডিজনির গ্রাম।

এখানকার অধিবাসীরা ডব্লিউ ই ডি আইনবিদদের কড়া পাহারা বসানো এক প্রাসাদের ভিতর দিয়েই শুধু বেরুতে পারে। এ এলাকার মানুষের গড় আয়ু যে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো শহরের মানুষের চেয়ে বেশি তার কারণ এও হতে পারে, আবার সারা পৃথিবীর সেরা মেডিক্যাল সার্ভিসের জন্যও হতে পারে। আর এ এলাকার মানুষজনের মধ্যে খুব কমই গর্ভধারণ করতে পারে, আরো কম মহিলা পারে জন্ম দিতে। তাই জনসংখ্যা কোনো চাপ নয়।

.

অ্যাপার্টমেন্টটাকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে কোনোমতেই হাসপাতালের কোনো স্যুটের মতো না দেখায়। হয়ত মাত্র কয়েকটা অস্বাভাবিক ফিটিং এ রুমের আসল উদ্দেশ্যটাকে বের করে ফেলে। বিছানাগুলো হাঁটুরও নিচে, যাতে রোগী পড়ে গেলেও বেশি ক্ষতি না হয়। এসব দুর্ঘটনা ঘটতে পারে আর ঘটলে তা নার্সদের জন্য কাজের সুযোগ। গোসলখানার টাবও একই পদ্ধতির। ফ্লোরে ডুবে থাকে। এর ভিতরেই সিট বসানো, চারধারে থাকে রেলিং। এসবের জন্য অতিবৃদ্ধ অসুস্থ মানুষও উঠে আসতে পারে সহজে। আর ফ্লোরে পুরু করে কার্পেট বিছানো। কিন্তু কোনো ছোট কার্পেট অথবা র‍্যাগ নেই যেটার উপর দিয়ে কেউ যেতে পারবে। এমনকি ইনজুরিতে ফেলার জন্য কার্পেটের কোনো তীক্ষ্ণ কোণা বেরিয়ে থাকে না। অন্যান্য বিষয় এত সহজে বোঝা যায় না। টিভি ক্যামেরাগুলো এমনভাবে বসানো যে কেউ এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহও করবে না।

ওটার ভিতরে মাত্র কয়েকটা ব্যক্তিগত চিহ্ন আছে-এক কোণায় পুরনো বইয়ের একটা তৃপ, নিউ ইয়র্ক টাইমসের শেষ কয়েকটা প্রিন্ট কপির একটার প্রথম পাতা ফ্রেমে বাঁধানো যেটা ঘোষণা করছে: ইউ এস স্পেসশিপ রওনা দিচ্ছে বৃহস্পতির দিকে লেখার কাছাকাছিই দুটো ছবি, প্রথমটায় এক ছেলে-বয়েস টিন এজের শেষের দিকে; অন্যজন বোঝাই যায় বেশি বয়স। পরনে একটা মহাকাশচারী-ইউনিফর্ম।

দুর্বল, ধূসর চুলওয়ালা মহিলা টিভি প্যানেলে একটা হাসির প্রোগ্রাম দেখছে। বয়েস সত্ত্বর না হলেও আরো বেশি দেখায়। বারবার স্ক্রিনে দেখানো কৌতুকগুলোর প্রতি প্রশ্রয়ের হালকা হাসি দিচ্ছে, একটা চোখ প্রায়ই নেচে যায় দরজার দিকে, হয়ত কোনো ভিজিটরের আশায়। প্রতিবার এমন করার সময় শক্ত হাতে চেয়ারের পাশে উঠিয়ে রাখা ওয়াকিং স্টিক ধরে ফেলে।

এখনো ডুবে আছে একটা টিভি নাটকে। অবশেষে দরজাটা খুলে গেলে একটু অপরাধী চোখ করে দরজার দিকে তাকায়। ছোট সার্ভিস ট্রলি ঘরে ঢুকল, এর পরপরই একজন পোশাকধারী নার্স, খাবার সময় হয়েছে, জেসি। বলল নার্স, আজকে তোমার জন্য এনেছি এক দারুণ জিনিস।

কোনো লাঞ্চ চাই না।

এটা খেলে তোমার আরো অনেক বেশি ভাল্লাগবে।

কী আছে বলার আগে আমি খাচ্ছি না।

কেন খাবে না?

একটুও খিদে নেই। তুমি কি সারা জীবনই ক্ষুধায় থাক? তীক্ষ্ণভাবে যুক্ত হয় কথাটা।

খাবার ট্রলিটা রোবট। থামল চেয়ারের পাশে। ট্রান্সপোর্ট কভারগুলো খুলে গিয়ে বের করল সবটুকু খাবার। নার্স কখনোই কিছু স্পর্শ করে না-এমনকি ট্রলির কন্ট্রোল বারও না। ও এখন স্থির দাঁড়িয়ে, মুখে একটা সর্বকালীন হাসি আর দৃষ্টি তার জটিল রোগীর দিকে।

পঞ্চাশ মিটার দূরের মেডিক্যাল মনিটর রুমের মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান ডাক্তারকে বলল, দেখ, ব্যাপারটা দেখ।

জেসির প্যাচানো হাত দ্রুত ওয়াকিং স্টিকের সাথে খাপে খাপে মিলে গিয়েই দারুণ দ্রুততার সাথে জিনিসটা ছুঁড়ে দিল নার্সের পায়ের দিকে।

নার্স বুঝতেই পারেনি কী হচ্ছে-এমনকি ওর উপর স্টিকটা চলে আসার পরও। এর পরও সত্য বলার সুরে নার্স বলল, এখন? এমন কাজ ভাল দেখায়, না? খেয়ে ফেল, ডিয়ার।

একটা কুটিল হাসি ছড়িয়ে গেল জেসির মুখে, তবু আদেশ মানতে দ্বিধা করে। এক মুহূর্তের মধ্যেই খেতে লাগল ক্ষুধাতের মতো।

দেখলে? বলল টেকনিশিয়ান, ভালমতোই জানে কী হচ্ছে। দেখে যা মনে হয় তারচে অনেক বেশি মেধাবী। প্রায়ই এমন সব কাণ্ড দেখি।

ও-ই প্রথম বুঝল?

হু। আর সবাই বিশ্বাস করে সত্যি সত্যি নার্স উইলিয়ামস তাদের খাবার দিয়ে যায়।

যাই হোক, আমার মনে হয় না এতে কিছু এসে যায়। দেখ সে কী সম্ভষ্ট। একটা কারণেই-টেক্কা মেরেছে আমাদের উপর। ও খাবার খাচ্ছে এক্সারসাইজের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই সব নার্সকে জানাতে হবে, শুধু উইলিয়ামসকে না।

কেন…ও অবশ্যই! পরের বার একটা হলোগ্রামকে নাও পাঠাতে পারি। তখন বোধ হয় আমাদের রেগে যাওয়া স্টাফদের পক্ষ থেকে কোনো আইনি জটিলতায় পড়তে হবে।

৩২. স্বচ্ছ ঝর্না

লুসিয়ানা থেকে এখানে আসা ইন্ডিয়ান আর ক্যাজুয়ানেরা বলে স্বচ্ছ ঝর্ণা Tএকেবারে অতল। অবশ্যই একেবারে বোকার মতো কথা-তারাও বোধহয় বিশ্বাস করেনি কথাটা। একজনের শুধু একটা মাস্ক পরে কয়েক স্ট্রোক সাঁতরে আসতে হয়–আর ওখানেই পরিষ্কার দেখা যায় ছোট এক গুহা যেটা থেকে অবিশ্বাস্য খাঁটি পানি বের হয়; চারধারের দুলতে থাকা চিকন চিকন সবুজ এবং অপ্রত্যাশিত গাছগুলোকে আরো একটু নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আর এগুলোর ভিতর দিয়ে দানোর চোখগুলো উঁকি দেয় মাঝে মধ্যে।

পাশাপাশি দুটো কালো চক্র। যদিও কোনোদিন ওগুলো নড়েনি-তবু চোখ ছাড়া আর কী হতে পারে? ঘাপটি মেরে থাকাটার ব্যাপারটাই প্রত্যেক সাঁতারে আরেকটু চমক এনে দেয়। একদিন হয়ত দৈত্যটা তার জান্তব বিশ্রাম থেকে জেগে উঠবে, ভয় পাইয়ে দেবে আশপাশের সব মাছকে, শিকার করবে ওদের। কোনোদিনই ডেভিড অথবা ববি জানতে পারবে না যে, ওটা এক পরিত্যক্ত, চুরি যাওয়া বাই সাইকেল যা একশো মিটার গভীরে পানির আগাছার ভিতরে আধা কবর দেয়া অবস্থায় আছে।

এত গভীরতা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কিন্তু লাইন আর সিংকার এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে। বড় ভাই আর দক্ষ ডাইভার ববি দশ ভাগের এক ভাগ গিয়ে জানালো যে তলাটা আগের মতোই দূরে দেখায়।

কিন্তু এখন হয়ত এ স্বচ্ছ ঝর্না তার সমস্ত রহস্য খুলে দেবে। হয়ত গুপ্তধনের সেসব কিংবদন্তিই সত্যি। সব স্থানীয় ইতিহাসবিদের নাক সিঁটকানো বন্ধ করে দেবে তাল তাল সম্পদ। যাই হোক না কেন, অন্ততপক্ষে ওরা স্থানীয় পুলিশ চিফকে খুশি করতে পারবে-সব সময়ই এ এক দারুণ পথ-কিছু যদি নাও পায় তো কোনো না কোনো অপরাধের পর ফেলে দেয়া কিছু পুরনো হ্যান্ডগান থাকবেই সেখানে।

ববির গ্যারেজের আবর্জনার স্তূপে পাওয়া ছোট এয়ার কম্প্রেসারটা শুরুর দিকের সমস্যা শেষ করে এখন শব্দ করছে জোরে জোরে। কয়েক সেকেন্ড পর পরই কেশে কেশে একটু নীল ধোয়ার মেঘ ছড়াবে। তবু ভাল, থামার কোনো লক্ষণ দেখায়নি।

আর যদি এটা বন্ধও হয়, বলল ববি, তাতে কী? যদি আন্ডার ওয়াটার থিয়েটারের মেয়েরা কোনো এয়ার হোস ছাড়াই পঞ্চাশ মিটার সাঁতরে উঠতে পারে তাহলে আমরাও পারব। আমরা পুরোপুরি নিরাপদ।

তাই যদি হয়, ভাসতে ভাসতে ভাবল ডেভ, কেন আমরা মাকে বলিনি কী। করতে যাচ্ছি? এজন্যেই বাবার পরবর্তী শাটল ওড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম না? কিন্তু ওর আসলেই কোনো আফসোস নেই; ববি ভাল বোঝে। সতেরো বছরের হওয়াটা সব সময়ই চমৎকার, আরো দারুণ হয় যদি এ বয়েসেই সব জানা যায়। তারা আশা করে সে এখন খুব বেশি সময় নষ্ট করবে না বোকা মেয়ে বিটি সুলৎজের সাথে। সত্যি, খুব সুন্দর-কিন্তু…ধ্যাৎ! ও একটা ছোট্ট মেয়ে। আজকের সকালে ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়াটাই ওদের সবচে বড় মুসিবত হয়েছিল।

ডেভ ব্যবহৃত হয়েছে গিনিপিগ হিসেবে। কিন্তু তা শুধু ভাইয়ের জন্য। প্রথমে ফেস মাস্কটা ঠিক করে নিয়ে ফ্লিপারগুলো পরেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে স্ফটিক স্বচ্ছ পানিতে। ববি নিজেকে এয়ার হোসের সাথে ধরে রাখে। এটাকে মাউথ পিসের সাথে জুড়ে দিয়েছিল আগেই। একটা দম নিয়েই ডেভ মুখ বিকৃত করল, এর স্বাদ ভয়াবহ!

এটাকে ব্যবহার করতে শুরু কর। ভিতরে গেলে-ঐ লিজের৩৮ দিকে পৌঁছুলেই আমি প্রেসার ভাল্বটা এডজাস্ট করা শুরু করব যাতে বেশি বাতাস নষ্ট না করতে হয়। হোসটা টানলেই উঠে এসো।

পানির নিচে ডেভ ধীরে নড়তে শুরু করল, অথবা ওয়ান্ডারল্যান্ডে। শান্তিতে ভরা একরঙা এক জগৎ। আর সব প্রবাল প্রাচীরের চেয়ে ভিন্ন। সামুদ্রিক পরিবেশের রঙচঙা কোনো চিত্র নেই। এখানে জীবন নিজেকে প্রকাশিত করে না রঙধনুর সবগুলো রঙে। এখানে শুধু সবুজ আর নীল ছায়ার অভিজাত প্রদর্শনী আর চারদিকের মাছগুলো মাছেরই মতন, প্রজাপতি নয়।

ও ফ্লিপার নাড়িয়ে নাড়িয়ে আস্তে নেমে যাচ্ছে। পেছনে টেনে নিচ্ছে হোসটা আর থামছে শুধু প্রয়োজন পড়লে, হোস থেকে বাষ্প টেনে নিতে। স্বাধীনতার রোমাঞ্চ এত বেশি যে তার মুখের তেলতেলে স্বাদটাও গেছে ভুলে। ও যখন লিজের কাছে পৌঁছল তখনি বুঝতে পারে আসলে পুরনো পানিতে ঘেরা এক গাছের গোড়া এটা; সামুদ্রিক আগাছা এত বেশি ঘিরে ধরেছে যে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। ও বসে পড়ে নিজের চারদিক দেখতে লাগল। প্রথমবার দেখার, সবার আগে দেখার একটা আলাদা আনন্দ আছে।

ও ঝর্নাটার ঠিক ওপাশ দেখতে পাচ্ছে। সবুজ, অসম প্রান্ত, ভেসে যেতে থাকা জ্বালামুখের দূরপ্রান্ত ও দেখছে, কমসে কম একশো মিটার হবে দূরত্বে। চারদিকে বেশি মাছ নেই, তবু পানির উপর থেকে নিচে পড়তে থাকা একতাল রূপালী পয়সার মতো এক দঙ্গল ছোট মাছ সূর্যের আলোতে ঝলসে ঝলসে একদিক থেকে আরেকদিকে চলে গেল।

আরেক পুরনো বন্ধুও বসে আছে, যেমন থাকে আরকী, ঝর্নাটার সাগরের দিকে যাত্রার মুখে। একটা ছোট অ্যালিগেটর (কিন্তু যথেষ্ট বড় পরে একবার আনন্দ নিয়ে ববি বলেছিল, ও অন্তত আমার চেয়ে বেশ বড়।) সমান্তরালে ঝুলে আছে, কোনো দৃশ্যমান কিছুর উপর ভর না করেই। শুধু নাকটা ভেসে আছে উপরিতলে। কোনোক্রমেই এটাকে চটানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না। আর এই লক্ষ্মী জীবটাও ওদের এক বিন্দু বিরক্ত করেনি।

হঠাৎ করেই এয়ার হোসে টান পড়ে। ডেভ যেতে একটুও আপত্তি করবে না। ও বুঝতে পারছে না এ সময়ের মধ্যে অ্যালিগেটরটা কতটুকু ঠাণ্ডা হয়েছে অতি গভীরতায় নেমে-এমনকি নিজেও অসুস্থ বোধ করছে এখন। কিন্তু উঠে এলে গরম সূর্যালোক ওকে দ্রুত নতুন জীবন দিল।

নো প্রব্লেম। দাম দেখিয়ে ববি বলে, ভাটার প্রু খুলতে থাক সাবধানে যেন প্রেসারের মাপটা লাল দাগের নিচে নেমে না যায়।

কতটুকু নিচে নামবে?

পুরোটাই, যদি এখনকার মতো অনুভব করি।

ডেভ সিরিয়াসলি নেয়নি। ওরা গভীরতার আনন্দ আর নাইট্রোজেনের ক্ষরণ দু ব্যাপারেই সজাগ। আর পুরোনো বাগানের পানির পাইপটা মাত্র ত্রিশ মিটার লম্বা। প্রথম অভিজ্ঞতার জন্য অবশ্য এই অনেক। আগে বহুবার করেছে বড় ভাই। তাই একটা হিংসা মেশানো শ্রদ্ধার সাথে ভাইয়ের এই নতুন চ্যালেঞ্জ নেয়াটাকে দেখছে। সে। চারদিকের মাছের মতোই সচ্ছন্দে ববি নিচের রহস্যময় নীল জগতের দিকে গ্লাইডিং করে নেমে যায়। একবার ঘুরে কষ্টেসৃষ্টে এয়ারহোেসটায় এক টোকা দিয়ে পুরোপুরি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল যে, একটু বেশি বায়ু প্রবাহ ওর দরকার।

নতুন আসা মাথা ছিঁড়ে ফেলার মতো ব্যথাটা থাকলেও ডেভ ওর কাজের কথা মনে করল সবার আগে। দ্রুত পুরনো কম্প্রেসরটার কাছে গিয়ে এটার কন্ট্রোল ভাল্বকে করে দিল ম্যাক্সিমাম-প্রতি মিলিয়ন কার্বন মনোক্সাইডে পঞ্চাশ ভাগ।

ববিকে শেষ যেবার ও দেখে তখন সে দৃঢ়তার সাথে ডুবে যাচ্ছে, সূর্যালোক পিছলে যাওয়া শরীরটা তার ধরাছোঁয়ার বাইরে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে। মৃতদের পার্লারে নতুন একটা মোমের মূর্তি এল এরপর; রবার্ট বোম্যানের মূর্তি।

৩৩. চোখ মেলে চাও মেয়েগো

সে কেন এখানে এসেছে এক অশান্ত ভূতের মতো যা পুরনো অসন্তোষের জায়গায় বারবার ফিরে আসে? তার কোনো ধারণাই নেই। এমনকি নিজের উদ্দেশ্যের দিকেও কোনো লক্ষ্য নেই যে পর্যন্ত সেই স্বচ্ছ ঝর্নার গোল চোখদুটো নিচের সমুদ্র বন থেকে তার দিকে নিষ্পলকভাবে না তাকিয়ে থাকে।

ও মাস্টার অফ দি ওয়ার্ল্ড, আর একটা থমকে দেয়া অনুশোচনা ওকে দগ্ধ করছে। যা ঘুমিয়ে ছিল বহু বছর। সময় সে ক্ষতকে সারিয়ে তুলেছে আর সব ক্ষেত্রে যেমন করে। যেন গতকালই উজ্জ্বল সবুজ রঙের আয়নার দিকে তাকিয়ে শুধু চারদিকের সাইপ্রেসের গায়ে বোঝই স্প্যানিশ মস দেখে কেঁদেছে। ওর কী হচ্ছে এসব?

এমনকি এখনো, বিশাল ইচ্ছাশক্তি বাদ দিয়ে কিছু শান্ত বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ায় ও উত্তরে স্টেটের রাজধানীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটার মতো। কিছু একটা খুঁজে বেড়ায়। পাওয়ার আগে বুঝতেও পারে না কী খুঁজছে।

কেউ, এমনকি কোনো যন্ত্রও তার পথ বের করতে পারবে না। এখন তেমন ভয়াবহভাবে রেডিয়েশন ছড়াচ্ছে না। অবশ্য নিজের এনার্জির উপর নিয়ন্ত্রণ আছে। ঠিকই। যেমন এককালে তার নিয়ন্ত্রণ ছিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর। হারিয়ে গেলেও সেগুলো মুছে যায়নি মন থেকে। সেখানে একটা কুয়াশার মতো ভূমিকম্পরোধী এক বিশেষ ভল্টে মিশে গেল যে পর্যন্ত নিজেকে শত শত কোটি স্টোর করা স্মৃতির মাঝে না পায়; নিজেকে যে পর্যন্ত দেখতে না পায় ইলেক্ট্রনিক চিন্তা-চেতনার প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনশীল অন্ধ, নিরাবেগ নেটওয়ার্কে প্রবেশ করা অবস্থায়।

এ কাজটা একটা নিউক্লিয়ার বোমার ট্রিগার ঠিক করার চেয়ে অনেক বেশি জটিল, আর তাই একটু বেশি সময় নিল। খুঁজতে থাকা তথ্যটা পাওয়ার আগে সামান্য পিছলে গেল ও, একটু বিকৃতি, কিন্তু ঠিক করার চেষ্টা করল না। কেউ কোনোদিনই বুঝতে পারবে না কেন পরের মাসেই ফ্লোরিডার ট্যাক্স পরিশোধকারীদের মধ্যে এফ অক্ষর দিয়ে নাম শুরু হওয়া তিনশেজন এক ডলারের চেক পাবে। এ ব্যাপারটাকে ঠিক করতে হয়ত অনেক সময় লাগবে, হয়ত ইঞ্জিনিয়াররা শেষে আর কোনো পথ না পেয়ে কম্পিউটারের এ কোনোকালে না দেখতে পাওয়া ত্রুটির দোষ চাপাবে কদিন আগে দেখা মহাজাগতিক রশ্মির উপর-এবং এ নিয়ে বাকিরা হাসবে; তবু ব্যাপারটা যে আসলেই সত্যি তা খোদ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদের জানালেও তারা বিশ্বাস করতে চাইবে না।

কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যেই তালাহাসি থেকে ছশো চৌত্রিশ সাউথ ম্যাগনোলিয়া স্ট্রিট, টাম্পায় পৌঁছে গেল। আজো এ ঠিকানাই! এটাকে দেখে সময় নষ্ট করার কোনো মানে ওর কাছে হয়ত নেই। কিন্তু চোখ তুলে তাকানোর ঐ ছোট্ট মুহূর্তটার আগে সময় নষ্ট করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না।

তিনটা বাচ্চা জন্ম দিয়ে এবং দুবার গর্ভপাত করেও বিটি ফার্নান্দেজ (আগের বিটি সুল) আগের মতোই সুন্দর এক মহিলা। ঠিক এখন সেও একজন চিন্তা করতে থাকা মানুষ। একটা টিভি প্রোগ্রাম দেখছে যা আগের দিনের মিষ্টি-ঝাল স্মৃতি ফিরিয়ে আনে হঠাৎ।

আগের বারো ঘণ্টার অদ্ভুত ঘটনার উপর তৈরি করা এক নিউজ স্পেশাল চলছে। একটা খবর জানিয়ে শুরু হয় এ অনুষ্ঠান-বৃহস্পতির উপগ্রহ থেকে খবর পাঠিয়েছে লিওনভ। পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছিল কিছু একটা। কিছু একটা নিরাপদে নিষ্ক্রিয় করেছে অর্কিটে ঘুরতে থাকা পারমাণবিক বোমাকে। আর এর কৃতিত্ব দাবী করতে এখনো কেউ এগিয়ে আসেনি। খবরটা খুবই ছোট। মাত্র এটুকু, কিন্তু এটুকুই সবার জন্য যথেষ্ট।

সংবাদ পাঠকরা তুলে ধরেছে পুরনো সব ভিডিও টেপের চিত্র। এগুলোর কোনো কোনোটা আসলেই টেপ-কয়েকটায় দেখা যায় এককালের সবচে গোপনীয় আবিষ্কার, চাঁদের বুকে টি এম এ-একের খনন ও অন্যান্য ব্যাপার। কমপক্ষে পনেরবার ও সেই চিৎকার শুনল; মনোলিধটা চাঁদের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে বৃহস্পতির দিকে রেডিও মেসেজ পাঠানোর সময় যে আওয়াজ হয়। আরো একবার শুনল ডিসকভারি থেকে দেয়া সেই জনপ্রিয় ইন্টারভিউ।

কেন বিটি এগুলো দেখছে? এগুলোর সবই ওর বাসার আর্কাইভের কোনো না কোনো জায়গায় জমানোনা আছে। (যদিও হোসে আশেপাশে থাকার সময় কখনো এগুলো চালায়নি ও) সম্ভবত চেয়ে আছে কোনো ছোট্ট খবরের আশায়। বিটি কখনোই দেখাতে চায়না, এমনকি নিজেকেও দেখাতে চায়না অতীত ওর আবেগের উপর কতত বেশি সক্রিয়।

এখনি ডেভকে দেখা যাবে, যেমন আশা করেছিল। বিবিসির সেই পুরোনো সাক্ষাৎকার। সে এটার প্রত্যেক শব্দ মুখস্থ বলতে পারবে। ডেভ কথা বলছিল হালের বিষয়ে, সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করছিল এই কম্পিউটারটা আত্ম সচেতনতায় ভোগে, নাকি অন্য কিছু…

ওকে কী তরুণ লাগে! ম্লান হয়ে যাওয়া ধসে পড়া ডিসকভারির শেষ চিত্রগুলোর চেয়ে কত পার্থক্য এটায়! দেখতে অনেকটাই ওর স্মৃতির ববির মতো। চিত্রগুলোয় ঢেউ খেলে গেল বিটির চোখ পানিতে ভরে ওঠায়। না, এ সেটটার কোথাও গণ্ডগোেল আছে-অথবা চ্যানেলে। ছবি আসছে অনিয়মিত।

ডেভের ঠোঁটগুলো নড়লেও সে কোনো কথা শুনছে না। এরপর চেহারা মিশে গেল রঙের চৌকোণা বাক্সের মতো। একবার ফিরে এসে আবারও মিলিয়ে যাচ্ছে। এবার আরো স্থির, কিন্তু কোনো শব্দ নেই।

ছবিগুলো তারা কোত্থেকে পেল? আরে, ডেভকে পূর্ণ মানুষের মতো লাগছে না, বরং যেন সেই ছেলেবেলার প্রথম দেখা ডেভ! ও স্ক্রিনের বাইরে বেরিয়ে এসে যেন বহু বছরের সাগর পাড় থেকে ওকে খুঁজে ফিরছে।

ডেভ বোম্যান হাসল, ওর ঠোঁট নড়ছে…

হ্যালো, বিটি! বলছে ও।

শব্দগুলোকে নিজের মতো সাজিয়ে নিয়ে অডিও সার্কিটে বইতে থাকা বিদ্যুৎ তরঙ্গ পাল্টে দেয়াটা কোনো কাজই না ওর জন্য। মূল সমস্যা হল, মানুষের ব্রেনের মতো ধীর লয়ে নিজের দ্ভিাকে প্রবাহিত করা। আরো সমস্যা হচ্ছে, একটা অসীম সময় ধরে উত্তরের আশায় বসে থাকা…

বিটি ফার্নান্দেজ একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেছে। তবু, সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। এক যুগ ধরে গৃহিণী হলেও নিজের ইলেক্ট্রিক সার্ভিসম্যানের পুরনো পদবীটা ভুলতে পারেনি। মিডিয়ামের গ্রাফিক্সের অসাধারণ এবং অচিন্তনীয় সাফল্যের একটা নিশ্চই এ ঘটনা। এ ব্যাখ্যা সে গ্রহণ করলেও পরের ব্যাপারের সাথে কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারবে না। ডেভ, ও জবাব দিল, ডেভ আসলেই তুমি?

আমি শিওর না। জবাব দিল টিভি স্ক্রিনের ইমেজ, একটা মৃত কণ্ঠে, কিন্তু আমি ডেভ বোম্যান আর তার সব কথা মনে করতে পারি।

ও কি মারা গেছে?

আরো একটা কঠিনতম প্রশ্ন, তার দেহ-হ্যাঁ। কিন্তু শারীরিক ব্যাপারটার কোনো মূল্যই আর নেই। ডেভ বোম্যানের যা ছিল তার সবই এখন আমার অংশ।

বিটি নিজের দেহে ক্রুশ কাটল, কাজটা হোসের কাছ থেকে শিখেছে। ফিসফিসিয়ে বলল, তুমি বলতে চাও যে, তুমি একটা স্পিরিট…আত্মা?

আমি তোমার মতো কোনো শব্দ জানি না যা দিয়ে এরচে ভালভাবে বোঝাতে পারব।

কেন তুমি ফিরে এলে?

আহ! বিটি-কেন! আসলেই কেন…যদি আমাকে বলতে পারতে…এখন তার একটা জবাব জানা আছে টিভি স্ক্রিনে তুলে ধরা যায়। শরীর আর মনের ছাড়াছাড়ি পূর্ণ হতে তোমাদের যুগ থেকে আরো অনেক অনেক সামনে এগুতে হবে। এবার দেখানো নির্লজ্জ সেক্সয়াল ইমেজ আর বহন করার ক্ষমতা নেই যেন এ টিভির ক্যাবল নেটওয়ার্কের।

এক মুহূর্তের জন্য বিটি দেখল, কখনো হেসে হেসে, কখনো আঘাত পেয়ে। এরপর ও অন্যদিকে ঘুরে গেল-লজ্জায় না, বরং কষ্টে। হারিয়ে যাওয়া আনন্দের জন্য কষ্ট।

তো, এটা সত্যি হতে পারে না- ও বলছে, এ কথাই সবাই আমাদেরকে বলেছে, অ্যাঞ্জেল সম্পর্কে। কোনো যৌন প্রভেদ নেই। পুরুষত্ব নেই, নেই নারীত্ব।

আমি একজন অ্যাঞ্জেল? ও অবাক হল। তবু অন্তত এটুকু বুঝতে পারছে এখানে ওর কাজ কী। দুঃখের জোয়ারে ভেসে গিয়ে অতীতের সাথে কোনো না কোনোভাবে একটা সেতু জুড়ে দিতে চাইছে নক্ষত্র শিশু। ওর সবচে শক্তিমান আবেগ ধরা দিয়েছে বিটির জন্যই; এ আবেগটুকু তার অপরাধবোধ আর হতাশাকে বাড়িয়ে তুলছে আরো।

ও ববির চেয়ে ভাল প্রেমিক কিনা তা একবারের জন্যও মেয়েটা বলেনি। এ একটা প্রশ্ন করেনি কখনো। হয়ত এজন্য সম্পর্কটাই ভেঙে যেত। এ মিথ্যা বিশ্বাস নিয়েই ওরা একে অন্যের হাত জাপ্টে ধরে একই ধরনের অসুস্থতার ওষুধ খুঁজত। (আর ও কী তরুণই না ছিল, যখন শুরু হয় তখন মাত্র সতেরো বছর বয়স। শেষকৃত্যানুষ্ঠানের মাত্র দু বছর পরই!)

স্বভাবতই এ সম্পর্কটা বেশিদিন টেকেনি। কিন্তু এ অভিজ্ঞতা তাকে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মুখে এনে দাঁড় করায়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তার সব কিশোরসুলভ অতি কল্পনার কেন্দ্র ছিল বিটি। আর কোনোদিনই ওর সাথে তুলনা করার মতো কোনো মেয়ে খুঁজে পায়নি সে; বহুদিন আগেই বুঝতে পেরেছে যে কোনোদিন পাবেও না। যত অবহেলাই করা হোক না কেন, কৈশোরের প্রেম সারা জীবনের জন্যই মনের কোণে ঘাপটি মেরে থাকে। বারেবারে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। আর কেউ হয়ত এমন ভালবাসার ভূতের তাড়া খেয়ে ফেরে না।

কামনার ইমেজগুলো স্ক্রিন থেকে মিলিয়ে গেলে এক সেকেন্ডের জন্য মূল অনুষ্ঠান ফিরে আসার সুযোগ পেল। লিওনভ আর আইওর একটা চিত্র টিভিতে। তারপর আবার ডেভ বোম্যানের চেহারা। ওকে দেখে মনে হয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসছে। কখনো দশ বছরের ছবি-কখনো বিশ, তারপর ত্রিশ-তারপর অবিশ্বাস্যভাবে এককালে চেনা চেহারার কোনো এক বিকৃত রূপ, হয়ত মমিই, হয়ত শুকনো এক বৃদ্ধ শরীর…

যাওয়ার আগে আর একটা প্রশ্ন। কার্লোসের ব্যাপারে। তুমি সবসময় বলেছ ও হোসের সন্তান, আর আমি প্রতিবারই আশ্চর্য হয়েছি। সত্যিটা বল।

বিটি ফার্নান্দেজ শেষ বারের মতো একটা দীর্ঘ দৃষ্টি ফেলল এক সময় ভালবাসা চেহারার দিকে (ও আবার আঠারোয় ফিরে এসেছে হঠাৎ। আর এক মুহূর্তের জন্য হলেও বিটি চাইছে যেন ওর চিরচেনা শরীরটা দেখা যায়, শুধু চেহারা নয়।)

ও তোমার সন্তান, ডেভ। সে ফিসফিস করে ওঠে।

হারিয়ে গেছে ইমেজটা। আবার ফিরে এসেছে সেই স্বাভাবিক সম্প্রচার। প্রায় একঘণ্টা পরে হোসে ফার্নান্দেজ ফিরে আসার পরও বিটি স্থির বসে রইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। গলার পেছনে চুমুর স্পর্শ পেয়েও ও পেছন ফিরল না, তুমি কোনোদিন বিশ্বাস করবে না, হোসে…।

আমাকে বিশ্বাস করার চেষ্টা কর; তোমাকেই বিশ্বাস করি আমি।

এইমাত্র একটা ভূতের সাথে খোশগল্প করলাম।

৩৪. বিদায়বেলার কথা

আমেরিকান ইন্সটিটিউট অফ অ্যারোনটিক্স এন্ড এস্ট্রোনটিক্স ইউ এফ ও র অর্ধশতাব্দী প্রকাশ করে উনিশো সাতানব্বইতে। এ ছিল তাদের এক মহা বিতর্কের বিষয়। তখন অনেক সমালোচকই ঐ আন আইডেন্টিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট বা অচিহ্নিত উড়ন্ত বস্তু নিয়ে মাতামাতি করেছেন। এগুলো পৃথিবীর আকাশে দেখা যাচ্ছে শত শত বছর ধরে। কেনেথ আর্নল্ডের ১৩৯ ফ্লাইং সসার উনিশো সাতচল্লিশে লেখার পরে আগের অসীম রহস্যের একটা চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এ অদ্ভুতুড়ে চাকতি। ইতিহাসের উষালগ্ন থেকেই মানুষ রহস্যময় জিনিস দেখে আসছে আকাশে আকাশে। কিন্তু মধ্য বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউ এফ ও একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল যার কোনো বিশাল গণসচেতনতা নেই। ঐদিনের পর থেকেই এগুলো নাগরিক আর বৈজ্ঞানিকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়; এমনকি ধর্মীয় ভিতগুলির জন্যেও।

কারণ খুঁজতে বেশিদূর যেতে হবে না। দৈত্যাকৃতির রকেটগুলোর ওড়াওড়ি আর মহাকাশ যুগের প্রথম ভোরের সাথে সাথেই মানুষ অন্য জগতের খোঁজে হন্যে হয়ে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যেই মানবজাতি তার চিরচেনা সূতিকাগার থেকে বেরিয়ে পড়বে-তখনি প্রশ্ন জাগে, কোথায় আর সবাই, আর কখন আমরা ভিজিটরদের আশা করতে পারি? আরো একটা আশা ছিল-যদিও তা খুব কমই বাঙময় হয়ে উঠেছে মানুষের মুখে মুখে-তারার রাজ্যের ভালবাসার সৃষ্টিগুলো হয়ত মানবজাতিকে তার নিজের বানানো সমস্যাগুলো ঠিক করে নিতে সাহায্য করবে। হয়ত ভবিষ্যতে আসতে থাকা দুর্যোগও করবে প্রতিরোধ।

ফিজিওলজির যে কোনো ছাত্র ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে যে এমন অসীম জ্ঞান খুঁজে পেলে একটা দিক দ্রুত সম্ভষ্ট হবে। বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে আসলেই সব মাধ্যমে একটা খবর খুব বেশি করে প্রচার করা হয়। ভূ ভাগের প্রত্যেক প্রান্তে হাজারো মহাকাশযান দেখা গেছে। এরচেও বড় ব্যাপার, শত শত রিপোর্টে বলা হয়েছে, খুব কাছ থেকে মুখোমুখি হয়েছে মানুষজন এসব অসাধারণ ভিজিটরদের। এমনকি বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অতিরঞ্জিত কাহিনীও শোনা যায়। কিছু স্বর্গীয় একত্রীকরণ, কথাবার্তা এমনকি হানিমুনের খবরও পাওয়া যায়, তাও আবার মহাশূন্যে। তবে শেষ ফলাফল একই-সবাই একে মিথ্যা-বড়জোর হ্যালুসিনেশন বলে পাশ কাটিয়ে গেছে আর একই সাথে সত্য বলাকে করেছে দারুণভাবে নিরুৎসাহিত। যেসব মানুষ চাঁদের অন্য পাশে নগরী দেখার দাবী করেছে তাদের মিথ্যাবাদী প্রমাণ করে অ্যাপোলো মিশন। এটা পুরো চাঁদ চষেও কোনো আর্টিফ্যাক্টের লক্ষণ পায়নি। এরপর আঘাত আসে শুক্র গ্রহের কল্পিত সুপুরুষদের বিবাহিত স্ত্রীদের প্রতি। ওদের জন্য যা একটু দরদ লোকের ছিল তাও উবে গেল যখন সবাই জানল যে শুক্রে সীসা রাখলে তা তাপে গলে যাবে। তাদের স্বামী সুপুরুষতো সুপুরুষই…

এর মধ্যেই এ আই এ এ তাদের প্রকাশনায় বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের রিপোর্ট পেশ করে যারা ঐসব মিথ্যা ধারণার প্রচারে এগিয়ে ছিল। এ বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতো ইউ এফ ওর সাথে অতীন্দ্রিয় কোনো না কোনো সভ্যতার, জীবনের অথবা অন্তত বুদ্ধিমত্তার যোগসূত্র আছে। এ দাবী প্রমাণ করা আদৌ সম্ভব হয়নি। গত এক হাজার বছরের অসংখ্য দাবীর কোনোটাই প্রমাণ করা যায়নি। অন্তত সেসব কথার যে কোনো একটা সত্যি হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রাডার আর টেলিস্কোপগুলো এসব স্বর্গীয় জিনিস খুঁজে বেড়ালেও কোনো শক্ত প্রমাণ পায়নি। আর সাধারণ জনগণ স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ হারিয়ে বসে। ধর্মগুরুরা মোটেও দমে না। বরং বিশ্বাসটা বইয়ে দিয়েছে খবরের চিঠি আর বইগুলোর মাধ্যমে। অনেক সময় তাদের অনেকে বাহবা পেয়েছে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার বহু পরেও।

টাইকো মনোলিথ আবিষ্কারের ঘোষণার পরপরই একটা সম্মিলিত চিৎকার শোনা গেল যা প্রায় সবাই বলছে সবাইকে, কেউ কারোটা না শুনেই, আমি বলেছিলাম না?

চাঁদের বুকে ভিজিটরদের নামার কথা আর অস্বীকার করা যাবে না। একইভাবে পৃথিবীতেও। মাত্র ত্রিশ লাখ বছর আগে। সাথে সাথেই আবারো ইউ এফ ও গুলো স্বর্গের প্রতিনিধিত্ব শুরু করল। যদিও সেদিন পর্যন্ত তিনটা মহাশক্তিধর দেশের ট্রাকিং সিস্টেম (যাদের প্রত্যেকে অন্তত একটা বল পয়েন্ট কলমের আকারের জিনিসও মহাকাশে দেখে ফেলতে পারে।) কোনো নাম-নিশানাই খুঁজে পায়নি। আরো দ্রুত রিপোর্টের সংখ্যা শ্রবণশক্তির নিচে নেমে যায়। উত্তেজনা যায় থিতিয়ে। আবারো সেই চির আকাক্ষিত আকৃতি অনেক এস্ট্রোনোমিক্যাল, ম্যাটারোলোজিক্যাল এবং অ্যারোনটিক্যাল চিহ্ন বারবার আকাশগুলো ছেয়ে ফেলল।

কিন্তু এবার, তৃতীয় দফায় এবং সবচে জোরালোভাবে উঠে এল ইউ এফ ওর দাবী। কোনো ভুল ভ্রান্তির সুযোগ না দিয়েই। একেবারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি। এক সত্যিকার ইউ এফ ও এসেছে পৃথিবীর পথে।

লিওনভের রিপোর্টের কয়েক মিনিট পরেই পৃথিবীতে দেখার রিপোের্ট পাওয়া যায়। প্রথম মুখোমুখি হয় কয়েক ঘণ্টা পর। এক অবসরপ্রাপ্ত স্টক এজেন্ট তার বুলডগটা সাথে নিয়ে ইয়র্কশায়ার মুরে হাঁটার সময় দারুণভাবে চমকে গেল যখন একটা চাকতি আকারের ইউ এফ ও তার পাশে নামে এবং প্রাণীটা-প্রায় মানুষেরই মতো, শুধু তীক্ষ্ণ কান ছাড়া-ডাউনিং স্ট্রিটের ঠিকানা জানতে চাইল। যোগাযোগের পর সে এত বেশি অবাক হয় তার ছড়িটা শুধু হোয়াইট হলের দিকে নাড়ানো ছাড়া আর কিছু করার ছিল না; প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয় বুলডগটা ফিরিয়ে দিচ্ছে তার দেয়া খাদ্য।

স্টক এক্সচেঞ্জের এ দালালের কোনো মানসিক সমস্যার রেকর্ড নেই। কিন্তু যারা পরের রিপোর্ট পাওয়ার পরও দালালের কথা বিশ্বাস করে তাদের ব্যাপারে ঢালাও মত দেয়া হয় যে তারা সবাই মানসিক রোগী। এবার বাস্ক শেফার্ড নেমে পড়েছে সেই পুরনো মিশনে। হাতাকাটা লম্বা জামা পড়া অন্তর্ভেদী দৃষ্টির দুজন মানুষ সীমান্ত এলাকায় তাকে জিজ্ঞেস করেছিল জাতিসংঘের হেডকোয়ার্টারের ঠিকানা।

ওরা পুরোপুরি বাস্ক লোকটার মতোই কথা বলে। ভাষাটা বেদনাদায়ক, জটিল, এমনকি মানবজাতির আর কোনো ভাষার সাথে এর মিল নেই। বোঝাই যায় এ স্পেস ভিজিটররা ভয়াবহ ভাষাবিদ, যদিও তাদের পরিবেশ এ বিশ্বের থেকে হাজার তফাৎ ওয়ালা।

এভাবেই চলতে লাগল, একের পর এক। তাদের মধ্যে খুব কম মানুষই জেনে শুনে মিথ্যা বলেছে-কেউ কেউ অসচেতনও ছিল না। বেশিরভাগই নিজের কাহিনীকে বেদবাক্যের মতো বিশ্বাস করে। এমনকি এ বিশ্বাসটা সম্মোহনের মাধ্যমে প্রচারেরও চেষ্টা করে অনেকে। কেউ আবার নিজেই সম্মোহিত হয় ঐ সময়। আর তাদের এক বিরাট অংশ ঠাট্টা-মশকরার শিকার। অনেকে কোনো হঠাৎ দুর্ঘটনায় পড়ে যায় সেসব অপেশাদার আর্কিওলজিস্টের মতো যারা চার দশক আগে একজন সায়েন্স ফিকশন চিত্র পরিচালকের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র আর সেট (দোষ দিয়ে লাভ কী, দেখতে একেবারে অপার্থিব এগুলো, তার উপর পুরনো!) পেয়ে তিউনিশিয়ার মরুভূমিতে চিৎকার করে ফাটিয়ে ফেলেছে গলা।

এত সবে শুরু, শেষমেষ প্রত্যেকেই নিজের উপস্থিতি আর চারপাশের উপর এত বেশি সচেতন হয়ে ওঠা শুরু করে যে এমন কিছু না কিছু দেখছেই, কোনো না কোনো এক সময়ে, কারণ তাদের অবচেতন মন এসবই খুঁজে ফেরে।

.

খুব দ্রুত এ বিশ্বটাকে এফোড় ওফোড় করে তার পরীক্ষা করা এখনো বাকি। কোনো দেয়াল ওকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারবে না, ওর সচেতনতার বাইরে কোনো পথ লুকিয়ে থাকতে পারে না। প্রথম প্রথম বিশ্বাস করে আগের জনের না দেখা জায়গাগুলোই শুধু দেখে চলেছে। পরে বুঝতে খুব বেশি দেরি হয়নি যে, সামরিক অভিযানের মতো গ্রহটার চারপাশে ছুঁড়ে বেড়ানোর পেছনে আছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য।

কোন না কোনো অবাক করা উপায়ে সে ব্যবহৃত হচ্ছে একটা প্রোবের মতো, একটা সর্বদ্রষ্টা রাডারের মতো-যা একবার করে দেখে নিচ্ছে মানব জাতির প্রত্যেক পল-অনুপল, অণু-পরমাণু, অলিগলিকে। নিয়ন্ত্রণ এত বেশি হালকা যে সে খুব কম সময়ই এ নিয়ে সচেতন হওয়ার সুযোগ পায়। ও একটা শিকারী কুকুরের মতো যেটাকে গলায় শিকল পরিয়ে দিয়ে নিজের মতো চলতে ফিরতে দেয়া হচ্ছে; যদি নিজের প্রভুর ইচ্ছাকেই নিজের ইচ্ছা হিসেবে ধরে নিয়ে থাকে।

পিরামিড, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, এভারেস্ট চূড়ার চাঁদ থোয়া তুষার-এগুলো তার নিজের পছন্দ। একই ভাবে কিছু আর্ট গ্যালারি আর কয়েকটা কনসার্ট হল রুম। যদিও তার নিজের পদক্ষেপ নিজেই নিতে পারে তবু একবারের জন্যও সম্পূর্ণ পৃথিবীবৃত্তটার মাঝ দিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি।

হয়ত নিজে থেকে ও দেখত না এত এত ফ্যাক্টরি, জেলখানা, হাসপাতাল, এশিয়ার একটা নোংরা ছোট যুদ্ধ, রেসকোর্স মাঠ, বেভারলি হিলের একটা যৌনতার বিশাল-জটিল পার্টি, হোয়াইট হাউসের বিখ্যাত ওভাল রুম-৪৩, ক্রেমলিনের১৪৪ আর্কাইভ, পোপের দেশ ভ্যাটিকানের সুবিশাল আর পুরনো লাইব্রেরি, মক্কার কাবার সেই গোপন, রহস্যময় কালো পাথর…

এমনো কিছু কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যা নিজেই বুঝে উঠতে পারেনি ঠিকমতো। যেমন তাদেরকে সরিয়ে দিয়েছে-অথবা ওকেই রক্ষা করেছে কোনো অভিভাবক অ্যাঞ্জেল দল। উদাহরণ হিসেবে বুঝতে পারে

ওলদুভি জর্জের লিকি স্মৃতি জাদুঘরে কী করছিল সে? মানব জাতির উদ্ভব সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই যেমনটা হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির আর কোনো বুদ্ধিমান সদস্যের থাকতে পারে। আর ওর কাছে ফসিলের কোনো অর্থতো নেইই, দামও নেই। ডিসপ্লে কেসে রত্নখচিত মুকুটের মতো সাজিয়ে রাখা দামি পুরনো খুলিগুলো তার স্মৃতিতে অদ্ভুতুড়ে শব্দের জন্ম দিয়েছে শুধু। জন্ম দিয়েছে এমন এক বিমোহিত অবস্থার যার কারণে নড়তেও পারেনি। এক অসাধারণ দ্যিজে ভু দেখা দিয়েছে ওর মনে। এত শক্তিময় দ্যিজে ভু এর আগে কখনো হয়নি; জায়গাটা যেন খুব আপন, কিন্তু কোথায় যেন একটু খটকা…অনেকটা মনে হচ্ছে যেন বহু বছর পরে বাড়ি ফিরে এসেছে কেউ, দেখতে পাচ্ছে সব আসবাবের পরিবর্তন, দেয়ালগুলো নেই আগের জায়গায়, এমনকি সিঁড়ির পথও নতুন করে তৈরি।

এ জায়গাটা গরম, শুকনো বিরূপ একটা ভূখণ্ড যেন। ঐ জমকালো বিশাল সমতল এলাকা আর অসীম তৃণভোজী প্রাণী কোথায় যেগুলো এখানে চড়ে বেড়াত বহুদিন আগে…ত্রিশ লাখ বছর আগে?

এখন আর মানুষ নয় সে, হলে হয়ত কেঁপে উঠত শিহরণে…ত্রিশ লাখ বছর! সে কীভাবে জানল ত্রিশ লাখ বছর আগের কথা? কেন সেই টাইকো মনোলিথেরই ত্রিশ লাখ বছর?

যেদিকে ও প্রশ্নটা ছুঁড়ে মেরেছে সেই প্রতিধ্বনিত হতে থাকা নিরবতা থেকে কোনো জবাবই আসে না। আর আবারো তার চোখের সামনে নিভু নিভু হয়ে ভেসে উঠতে দেখল সেই পরিচিত, কালো একটা রূপ, আয়তাকার পাথুরে দেহ। আরো চেষ্টা করায় এর ভিতর থেকে এক ছায়াময় ছবি দেখতে পাচ্ছে, যেমন দেখা যাবে কালো কালির পুকুরে।

এলোমেলো চুলে ভরা ব্যগ্র কপালের নিচে কালো, বিভ্রান্ত একজোড়া চোখ তার পেছনটা দেখার চেষ্টা করছে, আরো একটা অদেখা ভবিষ্যত দেখতে চাইছে যা কখনোই দেখতে পায়নি। তবু, ও-ই সেই ভবিষ্যৎ, যা সময়ের বাষ্পে জ্বলে পুড়ে লক্ষ প্রজন্ম পেরিয়ে পেরিয়ে উপনীত হয় বর্তমান-এ।

ঠিক সেখানেই ইতিহাসের শুরু; অন্তত ও এখন এটুকুই বুঝতে পারে। কিন্তু কীভাবে-আর সবচে বড় কথা, কেন-আজো তার কাছে এ রহস্যের ঢাকনা ঢাকা রয়ে গেল?

শেষ আর সবচে কঠিন কাজটা বাকি। ও এখনো যথেষ্ট মানুষ রয়ে গেছে, এটুকু না সরিয়ে দিতে পারলে এ রহস্যের শেষটা হয়ত অদেখাই থেকে যাবে।

.

এ মহিলা আবার কী করে? ডিউটি নার্স নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল টিভি মনিটরটা বৃদ্ধার দিকে ফিরিয়ে দিতে দিতে। ও অনেক চালাকি করেছে, তবু প্রথমবারের মতো আমি তাকে নিজের হিয়ারিং এইডের সাথে কথা বলতে দেখলাম। হায় খোদা…সে কী বলছে কে জানে?

মাইক্রোফোনে ফিসফিসানি তুলে আনার মতো সূক্ষ্ম না, তবু পাইয়ে দিচ্ছে ভাল ভয়। খুব কম সময়ই জেসি বোম্যানকে এত শান্ত দেখায়। চোখদুটো বন্ধ থাকলেও ফিসফিসানির সময় চেহারা স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ভরে উঠছে।

এরপরই দেখতে থাকা মেয়েটা এমন কিছু দেখল যা ভোলার জন্য অনেক চেষ্টা করবে পরে। কারণ এ রিপোর্ট করলে সাথে সাথে তার নার্সিং পেশার যোগ্যতা কেড়ে নেয়া হবে। একটু দুলে ধীরে ধীরে চিরুণীটা ভেসে উঠল বিছানা থেকে। যেন কোনো অদৃশ্য আঙুল তুলে এনেছে। প্রথমবার সফল হয়নি, দ্বিতীয়বার বহু কষ্টেসৃষ্টে এটা লম্বা জট পাকানো চুলে বুলিয়ে গেল, আর জটগুলোয় থামল একটু।

এখন জেসি বোম্যান কথা বলছে না, শুধু মুচকি হাসি। আরো দক্ষতার সাথে চিরুণীটা বয়ে যাচ্ছে। এখন আর হঠাৎ হঠাৎ লাফাচ্ছে না।

নার্স কখনোই বলতে পারবে না কতক্ষণ এসব চলল, চিরুণীটা টেবিলে ফিরে গেলেও মেয়েটা অসাড়তার হাত থেকে মুক্তি পায়নি।

দশ বছরের ডেভ বোম্যান সেই চিরাচরিত কাজটা শেষ করেছে যা সব সময় নিজে পছন্দ না করলেও করতে হয় কারণ মা পছন্দ করে। অন্যদিকে একজন ডেভিড বোম্যান যে এখন বয়স হিসাবের বাইরে, সে প্রথমবারের মতো কজা করেছে জড় জিনিস। আর থাকতে না পেরে নার্স যখন এল তখনো জেসি বোম্যান হাসছে। নার্স হয়ত যত তাড়াতাড়ি পারা যায় আসার চেষ্টা করেছে, তবু এর কোনো মূল্য নেই।

৩৫. পুনরাবির্ভাব

মহাশূন্যের কোটি কিলোমিটারে ছড়িয়ে থাকা পৃথিবীর চিৎকার একেবারে বন্ধ। লিওনভের কুরা হঠাৎ এ বিচ্ছিন্নতা দেখল অবাক চোখে। জাতিসংঘের বিতর্ক, বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকার, সংবাদ পাঠকদের পড়া-সবই হঠাৎ থেমে গেল ইউ এফ ওর আগমনে। হঠাৎ অসুস্থতার কোনো কারণ ওরা খুঁজে পেল না কারণ পরে আর কোনো অস্বাভাবিকত্ব ধরা পড়েনি। জাগাদকা ওরফে বিগ ব্রাদার আর সব সময়ের মতোই তাদের উপস্থিতির প্রতি উদাসীন। অবশ্যই পরিস্থিতি বিপরীত, ক্রুরা সেই দূরের গ্রহ থেকে এসেছে একটা রহস্যের জট খুলতে-আর বিগ ব্রাদার বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে জবাব এখানে নেই। যে জায়গা ছেড়ে এসেছে, সেখানেই জবাব।

এই প্রথম ওরা আলোর ধীর গতির প্রতি কৃতজ্ঞ মনোভাব প্রকাশ করল কারণ এর ফলেই বৃহস্পতি আর পৃথিবীর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগে দু ঘণ্টা দেরি হয়ে যায়। তাই সাক্ষাৎকার দেয়াটা সম্ভব হয় না। তবু ফ্লয়েডকে মিডিয়া এত বেশি প্রশ্ন করেছে যে, ও বাধ্য হয়ে সবাইকে এড়িয়ে যাচ্ছে নিশাচর, গর্তবাসী শিয়ালের মতো। এরচে বেশি কিছু বলার না থাকলেও এক কথা বলতে হয়েছে কমপক্ষে বারেবার।

এছাড়াও বহু কাজ বাকি, লিওনভকে পৃথিবীর দিকে ফিরে যেতে হবে, তাই লঞ্চ উইন্ডো খুলে যাওয়ার আগে এ কাজটা সারতে হবে তড়িঘড়ি করে। অবশ্য তড়িঘড়িটা খুব বেশি না করলেও চলে, যদি একমাস দেরি করে রওনা দিতে, তাহলে একমাস পরে গিয়ে পৌঁছবে, ব্যস। চন্দ্র, কার্নো আর ফ্লয়েডের তেমন তাড়া নেই কারণ ওরা সারা পথ কাটিয়েছে ঘুমে। অন্যেরা এই লম্বা সফর থেকে বাঁচতে চায় যত তাড়াতাড়ি যন্ত্রগুলো মুক্তি দিতে পারে। কারণ সামনের ফিরে যাওয়ার সময়টাও জেগে জেগে কাটাতে হবে।

এখনো ডিসকভারির অনেক সমস্যা। শুধু পৃথিবীতে ফিরে যাবার মতো জ্বালানি ভর্তি ট্যাঙ্কে, কিন্তু সেই ফেরাটা হতে হবে লিওনভের অনেক পরে এবং ধীরে যেতে হবে। যেতে যেতে তিন বছর। তাও সম্ভব শুধু যদি চন্দ্র হালকে ঠিকমতো প্রোগ্রাম করতে পারে। কম্পিউটারটাকে সারা পথ একা একা পাড়ি দেয়ার মতো করে প্রস্তুত করার কাজ বাকি। এর সাহায্য না পেলে আবারও ডিসকভারি একটা পরিত্যক্ত স্পেসশিপ হিসেবে পরিচিতি পাবে।

হালকে নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেড়ে উঠতে দেখাটা আসলেই ভয়াবহ-কাজটা চলছে গভীরভাবে-এক মানসিক আঘাত পাওয়া শিশু থেকে অভিজ্ঞ মানুষে পরিণত হওয়ার পথে এগুচ্ছে কম্পিউটার। যদিও ফ্লয়েড জানে যে এভাবে মানবত্ব আরোপ এক বড় ভুল, তবু এটাকে পাশ কাটানোর কোনো পথ পায় না খুঁজে।

প্রায়ই ও খেয়াল করে এ অবস্থা একটা শিকারের রূপ নিচ্ছে। কিছু ভিডিও নাটক দেখেছে যেগুলোতে ব্যর্থ নতুন নায়কেরা সিমন্ড ফ্রয়েডের কারণে পুরোপুরি ডুবে গিয়েও সোজা হয়। জিতে যায় নাটকীয়ভাবে। একই কাহিনী আবার ঘটেছে বৃহস্পতির ছায়ায়।

হালের ইলেক্ট্রনিক মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ চলছে খুব দ্রুত। এত দ্রুত পুনর্গঠন চলছে যে কোনো মানুষের মন দ্রুতিটার এক বিন্দুও ধরতে পারবে না। প্রতি মুহূর্তে শত শত কোটি বিট কাজ করে, এক বিন্দু সমস্যা ছাড় পায় না এটার হাত থেকে। এ প্রোগ্রামের বেশিরভাগই টেস্ট করা হয়েছে হালের উন্নত জমজ সাল ন হাজারের মাধ্যমে। এ দু কম্পিউটারের মধ্যে বাস্তব কথাবার্তা যোগাড়যন্ত্র না করতে পারাটা হালের উন্নয়নে এক বড় ঘাটতি। এ কাজের কঠিন মুহূর্তগুলোয় যখন পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের দরকার পড়ে তখন অনেক ঘণ্টা নষ্ট হয়ে যায়।

চন্দ্রের আর সব কাজ থাকায় কম্পিউটারের পুনর্গঠনে সময় লাগবে আরো অনেক। হাল সংখ্যাভিত্তিক আচরণ করে এখন, নাভাস ভঙ্গীতে মুখ ভেংচায়। কিবোর্ডের সব কমান্ড ধরতে পারলেও মাঝে মাঝে মুখে বলা শব্দ অবহেলা করে অথবা বোঝে না। উল্টো পথে আদেশ করলে তার আউটপুটগুলো হয় আরো অস্বাভাবিক।

এক সময় হয়ত সব উত্তর ঠিকমতো দিতে পারল, দেখা যাবে মনিটরে দেখাতে পারেনি। আরেক সময় দুটোই করছে, শুধু হার্ড কপি প্রিন্ট করছে না। এসব ক্ষেত্রে সে কোনো কারণ না দেখিয়েই এমন করে, এমনকি অনড়, অপ্রতিরোধ্য জবাব দেয়, আমার পছন্দ হয় না…

যাই হোক, যতটা মনে হয় হাল কখনো সরাসরি অবাধ্যতা দেখায় না। শুধু যেসব কাজ করতে পারবে না মনে করে সেগুলোই নাকচ করে দেয়। অবশ্য ওর সহায়তা পাওয়া আস্তে আস্তে সহজ হচ্ছে, তাকে না রাগিয়ে যা বলার বল… যেমনটা বলে কার্নো, আসলেই কিছু সময় অবস্থা এমন দাঁড়ায়।

ডক্টর চন্দ্র হতাশা প্রকাশ করতে শুরু করেছে, অবাক হওয়ার কিছু নেই। একবার এক অনুষ্ঠানে সহজ সরল মনে ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি পুরনো গালগল্প তুলেছিল, সাথে সাথেই চন্দ্র বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে খারাপ ব্যবহার করে।

এটা কি সত্যি, ডক্টর চন্দ্র, তুমি হালের নাম রেখেছ যাতে এটা আই বি এমের চেয়ে একধাপ এগিয়ে থাকে?

বোকার মতো কথা বলে! আমাদের অর্ধেকই আই বি এম থেকে এসেছে আর আমরা বহু বছর ধরে এই গল্প বন্ধ করার চেষ্টা করছি। আমার ধারণা ছিল যে প্রত্যেক বুদ্ধিমান মানুষই এইচ-এ-এল বলতে যে হিউরিস্টিক এলগরিদমিক বোঝায় তা জানে।

পরপরই ব্রেইলোভস্কি কিরে কাটল, ও জীবনে খুব কমই এইচ এ এল শুনেছে। বরং হাল শুনেই অভ্যস্ত।

ফ্লয়েডের ব্যক্তিগত ধারণা ডিসকভারির পৃথিবীতে ফেরার সম্ভাবনা আটানব্বই পার্সেন্ট। আর সাথে সাথেই চন্দ্র একটা দারুণ প্রস্তাব করল, ডক্টর ফ্লয়েড, তোমাকে একটা কথা বলব?

এত সপ্তাহ পর, ভাগাভাগির এত অভিজ্ঞতার পরও চন্দ্র আগের মতোই পোশাকী রয়ে গেছে। শুধু ফ্লয়েডের সাথে না-আর সব ক্রুর সাথেও। এমনকি শিপের ছোট্ট মেয়ে জেনিয়াকেও স্বাভাবিকভাবে ডাকতে পারে না, ম্যাম ছাড়া।

অবশ্যই, চন্দ্র, বল।

্য ভেরিয়েশনের উপর প্রোগ্রামিং প্রায় শেষ করেছি যেগুলো হোম্যান ফিরতি অরবিটের উপর কাজ করবে। পাঁচটাকে আমি এক কৃত্রিম ভার্চুয়াল পরীক্ষায় নিয়ে সফল হয়েছি এক বিন্দু সমস্যা ছাড়া।

দারুণ! আমি শিওর, পৃথিবীর আর কেউ…সৌরজগতের আর কেউ এটা করতে পারবে না।

ধন্যবাদ। তুমি জান, আমি করলেও প্রত্যেক ধাপে নিখুঁত থাকা অসম্ভব। হাল হয়তো…অবশ্যই-ঠিকমতো কাজ করবে, এমনকি যে কোনো প্রয়োজনীয় সময়ে জাহাজের হাল ধরতে পারবে। কিন্তু সব ধরনের ছোট দুর্ঘটনা-যেমন একটা মাত্র হালকা স্কু দিয়ে জুড়ে দেয়া ছোট এক যন্ত্রের সমস্যা যা ক্রু ড্রাইভার দিয়েই ঠিক করা যাবে, অথবা একটা ভাঙা তার, নষ্ট সুইচ…ওর পুরো মিশনটাকে পন্ড করে দিতে পারে।

ঠিকইতো! একেবারে ঠিক। কিন্তু এ সম্ভাবনাই আমাকে ফেলে দিয়েছে চিন্তায়। কী করা যায়?

আসলেই খুব সহজ। আমি ডিসকভারির সাথে থাকতে চাই।

সাথে সাথে ফ্লয়েড ভাবল চন্দ্র পাগল হয়ে গেছে। স্রেফ উন্মাদ। পরের চিন্তাটা বলল সে আসলে আধ পাগলা। হয়ত এ পাগলামিই একজন মানুষ হিসেবে সাফল্য আর ব্যর্থতার নির্ধারক। এ-ই দারুণ, সব ক্ষেত্রের সমস্যার সমাধান নিজের হাতে করা। ডিসকভারির বুক থেকে পৃথিবী পর্যন্ত কাজ করে যাওয়া। শুধু আবেদনটা পুরোপুরি নাকচ করতে হবে।

দারুণ আইডিয়া, ফ্লয়েড পুরোপুরি সতর্কতার সাথে জবাব দিল, সত্যি তোমার বিচক্ষণতা আর সাহসের প্রশংসা না করে পারছি না। কিন্তু সব সমস্যার কথা কি ভেবে নিয়েছ একবার?

খুব বোকাটে প্রশ্ন হয়ে গেল। চন্দ্র অবশ্যই এর মধ্যে গুছিয়ে রেখেছে সব জবাব।

ভেবে দেখ, শুধু তোমাকে নিয়ে তিন তিনটা বছর কাটাতে হবে! ধর তোমার ছোটখাট কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেল, অথবা মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন?

এই একটা ঝুঁকি নিতে আমি তৈরি।

হাবা লোক! একটা মাত্র ঝুঁকি নিচ্ছে! খাবার, পানি? লিওনভ কিছুই দিতে পারবে বলে মনে হয়না।

ডিসকভারির রিসাইকেল সিস্টেম পরীক্ষা করেছি। খুব বেশি কষ্ট ছাড়াই এটাকে ঠিক করা যাবে। তাছাড়া আমরা ভারতীয়রা খুব অল্পে সন্তুষ্ট।

চন্দ্র সহজে নিজের এলাকা নিয়ে কথা বলে না, বিশেষত ব্যক্তিগত ব্যাপারে। তার সত্যিকার বিশ্বাস ই তার দেয়া একমাত্র উদাহরণ-মনে করতে পারল ফ্লয়েড। তবু দাবীটা নিয়ে চালাচালি করল না ও। একবার কার্নো বলেছিল যে, ডক্টর চন্দ্র এমন নরম মানসিক শক্তির অধিকারী যেটা পেতে বহু শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার কথা। এটা এক ইঞ্জিনিয়ারের নিষ্ঠুর কথার মতো দেখায় যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে-অন্যের কোনো ক্ষতি করবে না। তবু-দুঃখের সাথে ও ভাবল, এসব যেন ঠিক চন্দ্রকে মানায় না, আসলে এ নিয়ে ভাবার জন্য আমাদের হাতে কয়েক সপ্তাহ সময় পড়ে আছে। এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করব, আর ওয়াশিংটনকেও জানাব।

থ্যাঙ্ক ইউ, আমি যদি এখনি প্রস্তুতি নেয়া শুরু করি তাহলে কি তুমি কিছু মনে করবে?

উ…একদম না। বর্তমান প্ল্যানের কোনো ক্ষতি না হলেই হল। মনে রেখ কিন্তু, মিশন কন্ট্রোলই আসল সিদ্ধান্ত নিবে। আর আমি ভালমতোই জানি মিশন কন্ট্রোল কী বলবে। একজন মানুষের মহাশূন্যে একা একা বেঁচে থাকার আশা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই না।

কিন্তু ও কখনো ভাবেনি, সব সময় ডক্টর চন্দ্র একজন একলা মানুষ।

৩৬. গভীরে আগুন

এখন পৃথিবী অনেক দূরে। বৃহস্পতি জগতের ভয়াল বিস্ময় খুব দ্রুত খুলে যাচ্ছে চোখের সামনে। নবজন্মের পর। কীভাবে ও এত অন্ধ, এত বোকা হতে পারল? যেন হাঁটছে ঘুমের মধ্যে। এখনি জাগতে শুরু করল যেন।

কে তুমি? চিৎকার করল সে। কী চাও? কেন…কেন আমাকে এমন করলে…কেন?

কোনো জবাব নেই। তবু মনে হল যেন উত্তর পেয়ে গেল। একটা…অস্তিত্বের উপস্থিতি টের পাচ্ছে। অন্তত একজন মানুষ এভাবেই কথাটা বলে। চোখদুটো জোর করে বন্ধ করলেও সে বুঝছে কোনো এক বদ্ধ ঘর ওর চারপাশে, আর সেখানে আছে আরো একটা কিছু, হয়ত একটা খোলা মহাশূন্য আছে ঘরটায়। চারপাশে একটা ক্ষীণ, সর্বব্যাপী মনের প্রতিধ্বনি-একটা চির অশান্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।

আবার অসীম নিরবতার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, এবারো কোনো সরাসরি উত্তর নেই-শুধু ঐ পরীক্ষা করতে থাকা সাথীর অনুভূতি। তবু কীভাবে যেন নিজের জন্য উত্তরটা খুঁজে পেয়েছে বলে মনে হল তার। সহজেই কারো উপস্থিতি টের পাওয়া যায় সে অথবা তারা যাই হোক না কেন।

বোঝা যাচ্ছে… বোঝা যাচ্ছে… তারা মানবজাতির ব্যাপারে উৎসুক। তারাই ওর স্মৃতিকে তুলে নিয়ে সংরক্ষণ করে রেখেছে, শুধু নিজেদের রহস্যময় উদ্দেশ্য পূরণের জন্য। আর এবার সেই উদ্দেশ্যের কাজ করে চলছে তারার শিশুর একান্ত নিজের গভীরতম আবেগকে ধরে নিয়ে। কখনো নক্ষত্র শিশুর সহায়তায়, কখনো সাহায্যের ধার না ধেরে।

এজন্য সে ভেঙে পড়েনি, ঠিক দুঃখ পায়নি, রেগেও যায়নি। যে পরীক্ষা নিরীক্ষা ফরে স্টার চাইল্ড এই অসীম অভিজ্ঞতা অর্জন করল- অন্তত পৃথিবীর বুকে, সে অভিজ্ঞতার সামনে এসব চিন্তাও ছেলেমানুষী। ভালবাসা-ঘৃণা-প্রত্যাশা-ভয় অনেক অনেক দূরে আজ। কিন্তু তবু কাউকে ভুলতে পারেনি। আর শুধু এখনি বুঝতে পারছে ওর ছেড়ে আসা জগৎটাকে তারা কীভাবে পরিচালনা করেছে এত লক্ষ বছর ধরে! এটা কি এক্সারসাইজের এক অংশ মাত্র? যদি তা হয়েও থাকে, শেষ লক্ষ্য কী, গন্তব্য কোথায়?

ও ঈশ্বরদের খেলার একজন খেলোয়াড় (পরে জানতে পারার কারণে রাগ হচ্ছে না ওর, নক্ষত্রশিশুদের কোনো রাগ নেই, ঈশ্বরেরা স্বাধীনতা ঠিকই দেবেন। কাজের জন্য যা বাঁধা হতে পারে সেটুকু বাদ দিয়ে স্মৃতি দেবেন। স্মৃতির যন্ত্রণা দেবেন, আবেগ দেবেন না। খেলার জন্য স্মৃতি আর স্মৃতির যন্ত্রণার খুব দরকার, আবেগের দরকার নেই) না জেনেই সে এসে পড়েছে অনেক দূরে। প্রতিটা কানুন জেনে নিতে হবে এখন।

সাইনোপ, প্যাসিফা, ক্যারমে আর অ্যানাঙ্ক-ছোট ঘোঁট চার চাঁদের এবড়োথেবড়ো পাথর ওর সচেতনতার চারধারে একটু একটু করে আলো ছড়াচ্ছে। এবার ইলোরা, লিসিথিয়া, হিমালিয়া আর লিডা বৃহস্পতির দূরত্বের অর্ধেক পেরিয়ে এগিয়ে এল সামনে। তাদের সবাইকে অবহেলা করে সে। ক্যালিস্টোর ক্ষত বিক্ষত মুখ সামনে পড়ে এবার।

একবার, দুবার পাক খেল পৃথিবীর চাঁদের চেয়ে বড় আটকে পড়া দুনিয়াটাকে ঘিরে। এতবড় জগৎটার বিশালত্বের সার্থকতা কোথায়-বৃহস্পতির আকর্ষণে চিরদিনের জন্য আটকে পড়ায় নিহিত? জানে না অসচেতন মন কাজ করে যাচ্ছে ঠিকই। মেপে নিচ্ছে এটার বহিঃস্তর, বরফ আর ধুলার রাশি। ওর কৌতূহল শেষ হয়ে গেছে হঠাৎ করেই। এটায় অনেক আগের কোনো সংঘর্ষের চিহ্ন বইছে। যেন এক জমাট ফসিল। হয়ত উপগ্রহটাকে গুঁড়িয়ে দিতে এসেছিল ঐ বিপদ। অর্ধগোলক দেখতে ঠিক দৈত্য-ষাঁড়ের চোখ, একটা এককেন্দ্রিক গর্তের সারি ঠিক আংটির মতো দেখাচ্ছে। কত শত বছর আগে কোনো এক মহাজাগতিক হাতুড়ি এ এলাকার পাথরগুলোকে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার উড়িয়ে নিয়ে গেছে, রেখে গেছে নিষ্ঠুরতার চিহ্ন।

কয়েক সেকেন্ড পর গ্যানিমিড কেন্দ্র করে ঘোরা শুরু। ক্যালিস্টোর এত কাছে, একই আকারের, তবু অনেক বেশি ভিন্ন। এ জগত্তা আরো বেশি জটিল, আরো বেশি আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। এখানেও অনেক অনেক জ্বালামুখ, মনে হয় যেন সবগুলোকেই চষে দেয়া হয়েছে। গ্যানিমিডীয় ভূ-চিত্রের সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হল এর ইতস্তত ছড়ানো স্ট্রাইপের উপস্থিতি। মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে দূরে সমান্তরালে ছড়ানো এগুলো। কোনো এক বিষাক্ত চাষী এটার বুক চষে গেছে তার অদ্ভুতুড়ে যন্ত্র দিয়ে।

কয়েক পাক ঘোরার পরই সে গ্যানিমিডকে পৃথিবীর সব যুগের সবভাবে দেখার চেয়ে ভাল করে দেখে নিজের জ্ঞানের ভাণ্ডারে বসিয়ে দিল পাকাপাকিভাবে। সে নিশ্চিত একদিন এ ডাটা হয়ে উঠবে মূল্যবান; ঠিক জানে না কেন, শুধু জানে দরকার পড়বে। যেভাবে জানে ঐ অসীম ক্ষমতার কথা যেটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশ্ব থেকে বিশ্বে তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে, তেমনি।

এবার শক্তিটা টেনে আনল ইউরোপায়। সে এখনো এ খেলার কোনো দর্শক না। তবু একটা উঠতে থাকা আগ্রহ প্রতিজ্ঞার দিকে টেনে নেয়। সে একজন অদেখা, যোগাযোগ না করা পরিচালকের হাতের পুতুল হলেও ঐ কন্ট্রোলের প্রভাবের বাইরে দুয়েকটা চিতাধারা বেরোনোর সুযোগ পাচ্ছে অথবা বেরুনোর অনুমতি পাচ্ছে। এগিয়ে আসতে থাকা নতুন গোলকটা গ্যানিমিড অথবা ক্যালিস্টোর সাথে খুব বেশি মেলে না। দেখতে জৈবিক লাগে; প্রথমে এর বাইরের শাখাময় আকৃতি যেন একে আলাদা আলাদা আকার দিয়েছে একেক জায়গায়। এমনকি পুরো চাঁদটাকে শিরা আর ধমনীতে ঘেরা সজীব পিণ্ড মনে হয়।

নিচে ছড়িয়ে পড়ছে এন্টার্কটিকার চেয়ে অনেক অনেক ঠাণ্ডা এক জমাট ময়লার স্কৃপের অন্তহীন বরফ স্তর। একটা ছোট বিস্ময় ধাক্কা সামলাতে পারল না-নিচে ভাঙা স্পেসশিপ! সাথে সাথেই চিনেছে-দুর্ভাগা জিয়াং, ওর দেখা হাজার ভিডিওতে প্রচার করা হয় এর কথা। এখন না…এখন না…পরে আরো ভাল সুযোগ পাওয়া যাবে…

এরপর বরফ পেরিয়ে এমন এক এলাকায় সে প্রবেশ করে যেটাকে নিয়ন্ত্রণকারীদের চেয়ে নিজে কম চেনে না। এক সামুদ্রিক দুনিয়া, পানি ভ্যাকুয়াম থেকে একটা বরফের স্তর দিয়ে আলাদা করা। বেশিরভাগ জায়গায় বরফ কয়েক কিলোমিটার পুরু। তবু কয়েক জায়গায় দেখা দেয় পাতলা স্তরও। বোধহয় এগুলো কোনো না কোনো কারণে ভেঙে যায় মাঝে মাঝে। এরপর দুটো পুরোপুরি বিপরীত শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ হয় যারা আর কোনোদিন সৌরজগতের অন্য কোনো বিশ্বে মুখোমুখি হয়নি। কিছু পানি বাষ্প হয়ে যাওয়ায় পরিবেশের সহ্য হয় না। যথারীতি মহাশূন্য আর পানি একটা সন্ধি করে নিয়ে মাঝখানে বরফকে দেয় বসিয়ে।

বৃহস্পতির প্রভাব ছাড়াই হয়ত কোনোকালে ইউরোপার এ সাগরগুলো জমে বরফ হয়ে ছিল। সব সময় এর গ্র্যাভিটি উপগ্রহের কেন্দ্রকে দলাইমলাই করতে থাকে। আর আইওকে বেঁধে রাখা শক্তিও আছে আশপাশেই-প্রভাব অবশ্য সামান্য। একেবারে গভীরে যাওয়ার পথে প্রতিপদেই ও গ্রহ আর উপগ্রহের টানাপোড়েনের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে।

মাটির নিচে-পানির নিচে ভূমিকম্প হয় সব সময়। শব্দ শুনতে-এমনকি অনুভব করতে পারছে সে। বুঝছে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা গ্যাসের হিসহিসানি। বরফের গভীর খাদের উপর ধীরে চলতে থাকা হিমবাহ শ্ৰবণ সীমার নিচের প্রেসার ওয়েভ তৈরি করে। ইউরোপাকে ঢেকে রাখা শব্দময় বরফের স্তরের চিৎকারের কাছে ম্লান হয়ে যাবে পৃথিবীর সব সাগরের নিনাদ।

নিজের অবাক হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেনি যখন প্রথম মরুদ্যান ওকে অবাক করল। ভিতর থেকে উঠে আসে সামুদ্রিক পানির মিশ্রণের কঠিন চিমনি আর পাইপ। ছড়িয়ে আছে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে। প্রাকৃতিক পরিহাসের ঐ অসাধারণ কেল্লা ছাড়াও কালচে তপ্ত তরল প্রবাহিত হয়ে চলে। যেন কোনো শক্তিময় বিশাল হৃদপিণ্ডের রক্ত সঞ্চালন। আর ঠিক রক্তেরই মতো এরা জীবনের একান্ত প্রমাণ।

ফুটন্ত তরলটা ফিরে আসছে উপর থেকে চুপসে পড়া মরণ শীতলতার উপর। সৃষ্টি করে চলেছে আরেকটা উষ্ণতার দ্বীপ। তরলটা ইউরোপার ভিতর থেকে জীবনের সব উপাদানকে টেনে তোলে। এও গুরুত্বপূর্ণ। এমন এক পরিবেশে কেউ আশা না করলেও এ ফোয়ারাই জীবনের জন্য খাদ্য এবং শক্তি হয়ে আসে।

এখনো আশা করা যায় তার মনে পড়বে যে মাত্র এক প্রজন্ম আগে ঠিক এমন উর্বর মরুদ্যান আবিষ্কৃত হয়েছে পৃথিবীর গভীর সব সাগরতলে। এ জায়গায় সেসব জীব আরো বিরাট আকৃতির, অনেক বৈচিত্র্যে ভরা।

দুর্গের আশেপাশের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল সৌকর্যময়। নড়তে পারলেও চারদিকের মাকড়সা-আকৃতি দেখতে গাছের মতো। এগুলোই সব বিস্ময় কেড়ে নেয়নি। কতগুলি অদ্ভুতুড়ে শামুক আর কীট হচড়ে পাঁচড়ে নিজেদের খাবার খুঁজে নিচ্ছে। কিছু নির্ভর করে গাছপালার উপর, আর কিছু সরাসরি তরল থেকেই নিয়ে চলে জীবন সুধা। তাপের উৎস থেকে বহুদূরে পানির নিচের আগুনের পাশেই সব প্রাণী আর উদ্ভিদ নিজেদের তাতিয়ে নেয় যেখানে শক্তপোক্তভাবে বাস করে অন্যান্য জীবনও, দশফুট লম্বা শক্ত খোলকের জীব অথবা বড় বড় মাকড়সা থেকে খুব বেশি ব্যতিক্রমী নয়।

জীববিজ্ঞানীর দল এমন একটা সমুদ্ৰোদ্যান দেখে দেখে সারা জীবন পার করে দিতে পারবে। পেলিওজোয়িক ১৪৮ জগতের সমুদ্র থেকে অনেক ব্যতিক্রমী এটা। কোনো স্থিতিশীল পরিবেশ নয়-তাই বিবর্তন এখানে দ্রুত এগিয়েছে, তৈরি করেছে বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য। এ জগতের সব প্রাণীই সব সময় মরণের অসংখ্য রূপের খুব কাছাকাছি বাস করে, কোনো না কোনো সময় সব জীবন-ঝর্না যাবে ফুরিয়ে। আর এ পরিবেশই তাদের অন্যদিকে চালিত করে।

বারবার ও ইউরোপান সাগরের উপর অবাক চোখ বুলিয়ে যায়। তেমন দুঃখজনক ঘটনার প্রমাণও মিলল কয়েকটা। অসংখ্য বৃত্তাকার এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অযুত মৃত প্রাণীর কঙ্কাল অথবা গলিত দেহ যেখানে বিবর্তনের প্রাথমিক অধ্যায়গুলোই ঠিকমতো খুলে যেতে পারছে না-পেছনে পড়ে আছে জীবন মহাগ্রন্থের বিশাল বই।

ও বিরাট বিরাট খোলস পায়, কুঁচকে-পাক খেয়ে পড়ে আছে। কোনো কোনোটা মানুষের সমান। বহু আকৃতির চিহ্ন, বাইভা, এমনকি ট্রাইভাল্ব। বহু মিটার জুড়ে ছড়ানো কতগুলো সর্পিল পাথুরে গঠন পাওয়া যায় যার মতো কিছু কিছু ছিল পথিবীতে। ক্রিটোকিয়াস ১৪৯ যুগের সেসব ইমোনাইট কোনো এক রহস্যময় কারণে পৃথিবীর সব সাগর থেকে হয়ে গেছে উধাও।

খুঁজতে খুঁজতে, দেখতে দেখতে সে গভীরতম খাদগুলোর সব চষে ফেলছে। সম্ভবত সবচে আশ্চর্যের ব্যাপার হল তপ্ত লাভার নদীটা। শত শত কিলোমিটার এলাকা ডুবিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক গিরিখাতের ভিতর দিয়ে। মজার ব্যাপার হল, লোহিততপ্ত ম্যাগমার ঢল বয়ে চলে পানিকে সাথে নিয়ে। নিচে পড়ে যাওয়া পানি মুহূর্তে তো দূরের কথা আদৌ বাস্প হতে পাবে না। কারণ ঐ লাভার চাপ। এই অতি অদ্ভুত অবস্থাও তারা পরিবেশের কারণে আপাতত মেনে চলে!

মানুষের আগমনের অনেক অনেক আগে আরেক জগতে এরই মতো নাটক হয়েছিল। অন্য প্রাণীর দ্বারা। তখন নীলনদ এ উপত্যকার মতোই বয়ে যেত নির্জীব মরুর মাঝদিয়ে টেনে আনত জীবন। এ নদীর তীর কোনো কালেই দু কিলোমিটারের চেয়ে চওড়া নয়, তবু শতাব্দীর পর শতাব্দীও বিবর্তিত করেছে হাজারো জাতের প্রাণ, করেছে উন্নত, দিয়েছে ধ্বংস করে। তবু পেছনে অন্তত একটা বিবর্তন গড়ে দিয়েছে যুগান্তকারী সৌধ।

প্রথমে সে ভেবেছিল এটা প্রাকৃতিক লবণের খোলস যেগুলো সব তাপীয় দরজা বন্ধ করে রাখতে পারে। কাছাকাছি এসেই বুঝতে পারে কোনো প্রাকৃতিক ক্ষরণ নয় বরং আর্টিফ্যাক্ট, এখানকার প্রাকৃতিক কোনো ঘটনাও হতে পারে; পৃথিবীর বুকেও সমাপনকারীরা একই রকম দুর্গ দেখতে পেয়েছে, আর পৃথিবীর ঐ মাকড়সার জাল বিছানো ছিল আরো দারুণভাবে।

লবণের মতো দেখতে অংশের সৃষ্টি অবশ্যই আরো অনেক ছোট ছোট-একটা বড়জোর আধ মিটার চওড়া। প্রবেশপথটা এক থিকথিকে গুহার দেয়াল। গাদাগাদি করে রাখা পাথরের টুকরোয় তৈরি-এটা ঐ স্রষ্টাদের উদ্দেশ্য জানার সূত্র হতে পারে। ঐ আস্তে চলা শিখাহীন আগুনে ভরা নীলনদের তীর থেকে খুব বেশি দূরে নয় এগুলো, বরং যেন নদীর পেছনে লুকিয়েছে। আর তারপরই সব শেষ।

গুহাটা হয়ত মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে তৈরি। অমানুষিক পরিশ্রমে যোগাড় করা ঐ পাথরের টুকরাগুলো ঢেকে দেয়া হয়েছে পাতলা খনিজের পর্দা দিয়ে। এ নিরাপদ জায়গা পরিত্যক্ত হওয়ার একটা কারণ পাওয়া যায়, ছাদের এক অংশ ভেঙে পড়েছিল-হয়ত সার্বক্ষণিক ভূমিকম্পের জন্যই। পানির তলার রাজ্যে ছাদ ছাড়া দুর্গ প্রায় সব শক্রর জন্যই উন্মুক্ত।

লাভা নদীর পাড়ে বুদ্ধিমত্তার আর কোনো প্রমাণ নেই। একবার অপার্থিবভাবেই একজন ক্রলিং করতে থাকা মানুষের মতো কিছু একটা দেখতে পেল। কোনো চোখ বা নাক নেই। শুধু এক বিরাট দাঁতহীন মুখ যেটা অনবরত গলা বেয়ে নামিয়ে দিচ্ছে আশপাশের পুষ্টিকর খাবার।

গভীর মরুর সরু উর্বর ব্যান্ডের সাথে সাথে পুরো একটা সংস্কৃতি এমনকি সভ্যতাও হয়ত উঠে এসে আবার নেমে গেছে অতলে। কোনো কালে সেনাবাহিনী মার্চ করে থাকতে পারে (অথবা সাঁতার) ইউরোপান নেপোলিয়ান অথবা ট্যাম্বারলেনের আদেশে। হয়ত তাদের বাকি দুনিয়া এটা জানতেও পারেনি। কারণ এসব মরুদ্যান গাছের মতো একে অন্যের চেয়ে দূরে দূরে জন্মায়। যেসব জীব এ লাভাস্রোতে তাপ পোহায়, খাদ্য পায় জ্বালামুখ থেকে-সেসব কোনোদিনই একটু সময়ের জন্য যে কোনো দু সমুদ্ৰোদ্যানের মাঝে হিংস্র এলাকা পেরুতে পারে না। এমনকি তারা যদি কখনো ইতিহাসবিদ আর দার্শনিক উৎপাদন করেও থাকে, তবু প্রত্যেক সংস্কৃতি দাবী করত যে, সৃষ্টিজগতে তাদেরটাই একমাত্র সভ্যতা, সৃজনশীলতা।

তবু, যেকোন দুটো মরুদ্যানের মাঝখান একেবারে প্রাণহীন নয়, ওখানে আরো শক্ত জীবন আছে যেগুলো বরফের তাপমাত্রার তারতম্য আর হাড় জমানো শীতকে যমের মতো ভয় পায়। মাথা তুলে সাঁতার কাটে ইউরোপান মাছ জাতীয় প্রাণীগুলো। গতির জন্য সুবিধাজনক আকৃতির টর্পেডোর মতো জীবনও খুঁজে পাওয়া যায়। সেগুলো আড়াআড়ি পাখনার কারণে আরো বেশি গতিময়। দু পাশের ফিন আছে কোনো কোনোটার। ফিনগুলো কাজ করে হাল হিসেবে। তবে পৃথিবীর সমুদ্রজগতে সবচে দক্ষ যোদ্ধার কাছাকাছি থাকা প্রাণীটাকে মোটেও হেলা করা যায় না। বিবর্তন দারুণ ইঞ্জিনিয়ার-যতবার একই ধরনের সমস্যা দেখা দেবে, যোগ্যতমের জন্য ততবার একই উত্তর নিয়ে আসবে। ও দেখতে পেয়েছে জীবন বৃক্ষের অনেক নিচের শাখায় থাকা ডলফিন আর হাঙরের দলকে।

বিশেষ পার্থক্য আছে পার্থিব সাগর আর ইউরোপান সমুদ্রগুলোর মাছের মধ্যে; ওদের কোনো কানকো নেই-বড়জোর একবিন্দু অক্সিজেনের বুদ্বুদ দেখা যেতে পারে সাঁতারের পথে। পৃথিবীর তাপ-ভৌগোলিক পরিবেশের জীবের মতো এগুলোর অঙ্গ প্রত্যঙ্গও সালফার যৌগের ভিত্তিতে গঠিত। সালফার যৌগের কোনো অভাবই নেই অগ্নিগিরির আশপাশে।

চোখ আছে খুব কম প্রাণীরই। দুপ্রাপ্য লাভার উদগীরণে তৈরি হওয়া লাল আভা ছাড়াও আলো আছে ওখানে। কিছু কিছু জীব জৈবিক আলো ছড়ায় সাথী পাওয়ার জন্য, কিছু ছড়ায় শিকার ধরতে। কিন্তু জগৎটা অন্ধকার।

ধ্বংস হয়ে গেছে এ জগৎ। সৃষ্টির আগ থেকেই। এর শক্তি উৎস শুধু খেয়াল খুশিমতো ওঠেই না বরং ইচ্ছামতো জায়গা বদলায়। কিন্তু যে জলোচ্ছ্বাস তাদের উঠিয়ে এনেছে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এতকিছুর পরেও, বুদ্ধিমত্তা জন্ম নেয় সবচে কঠিন পরিবেশেই, কারণ বিলুপ্তির পথে টিকে থাকে যোগ্যতম, শুধু তাই না-উন্নতিও করে শারীরিকভাবে। তাই এখানটায় দারুণ বুদ্ধিমত্তার উঁকি দেয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ইউরোপানদের উবে যেতেই হবে নিজ গ্রহ জমে যাবে যেদিন। এ গ্রহকেও জমতে হবে, কারণ এসব মরুদ্যানের উৎস ভেতরের আগুন।

ওরা পড়েছে আগুন আর বরফের ফাঁদে।

৩৭. বিয়োজন

… এমন খারাপ একটা খবর দিতে হচ্ছে…আই অ্যাম রিয়েলি স্যরি, ওল্ড ফ্রেন্ড-কিন্তু ক্যারোলিন প্রশ্ন করেছে আমাকে, আর তুমিতো জানই তোমাদের দুজনের জন্য আমার অনুভূতি যথেষ্ট গভীর।

মনে হয় না এটা কোনো হঠাৎ সারপ্রাইজ। তুমি আমাকে গত বছরের ব্যাপারে এমন কিছু কথা বলেছ যা এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়…তুমি পৃথিবী ছাড়ার সময় ও কেমন তিক্ত হয়েছিল তাতো তুমি জানই।

না, আমার মনে হয় না এখানে আর কারো ব্যাপার জড়িত, অন্তত বিশ্বাস করি না। কেউ থাকলে ও আমাকে বলতই…কিন্তু আগে হোক আর পরে…যাই হোক…ও এক আকর্ষণীয় মেয়ে।

ক্রিস ভাল আছে। আর অবশ্যই কী হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জানে। অন্তত ওকে কোনো আঘাত দেয়া যাবে না। বোঝার ক্ষেত্রে ও একেবারে হোট। অবশ্য শিশুরা চমৎকার…মানিয়ে নিতে পারে, না?-এক মিনিট, আমার গুপ্তধনে চাবি দিতে হবে-মনে করে নিই- ওহ, পেয়েছি।

এখন, যতটুকু আমি দেখলাম, তাতে তোমার কাছে কোনোটার গুরুত্বই কম নয়। প্রত্যেকে ঐ বোমা বিস্ফোরণটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতে চাইছে। অবশ্যই কেউ বিশ্বাস করেনি। স্বাভাবিক হিস্টিরিয়া ছাড়া আর কিছুই হয়নি, তারপর মরেছে লোকজন; আর আমরা পড়ে আছি এমনভাবে যাকে তোমাদের ঐ ধারাভাষ্যকার বলে, ঘাড়-ঘুরিয়ে-দেখে-নিচ্ছি মরণ লক্ষণ।

কেউ বোধহয় খুঁজে পেয়েছে এর সাথে মিল খাওয়া একটা শতবছরের পুরনো কবিতা। এত বেশি মিল যে, সবাই সেটার উদ্ধৃতি দিচ্ছে। রোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিনগুলো নিয়ে রচিত; সিংহ দরজায় অসহায় অপেক্ষা করছে লোকজন বিজয়ী দখলদারের জন্য। সম্রাট আর সব আমলা-অভিজাত নিজেদের দামী ভোলা জামাকাপড়ের স্তূপ নিয়ে মনে মনে আউড়ে যাচ্ছে শুভেচ্ছা বাণী। রাজদরবার বন্ধ, বন্ধ হয়ে গেছে আইন বিভাগ আর আদালত, কারণ নতুন শাসকের সামনে কোনো নিয়মের মূল্য নেই। নেই কোনো আইন।

তখনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আগাম খবর এল। কোনো শত্রু নেই। রিসিপশন কমিটি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছে, প্রত্যেকেই হতাশভাবে ফিসফিসিয়ে বাড়ি ফিরে গেল, এখন আমাদের কী হবে? ঐসব মানুষ আসলে এক ধরনের সমাধান হিসেবেই আসছিল।

কবিতাটায় ছোট একটা পরিবর্তন আনলেই চলবে। এখানে নাম বলা হয়েছিল, বারবারিয়ানদের জন্য অপেক্ষা; আর এক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই বারবারিয়ান। আমরা জানি না কী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু হঠাৎ করেই এর উদয় হয়নি।

আরেক ব্যাপার। তুমি কি শুনেছ জিনিসটা পৃথিবীতে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই ক্যাপ্টেন ডেভিড বোম্যানের মা মারা গেছেন? কেমন যেন বেমানান মিল। কিন্তু নার্সিং হোমের সবাই বলেছে তিনি এ খবরে এক বিন্দুও কান দেননি। সুতরাং এ খবরের কোনো প্রভাবই পড়েনি তাঁর উপর।

.

ফ্লয়েড বন্ধ করে দিল রেকর্ডিংটা। দিমিত্রির কথাই ঠিক, দিমিত্রির কথাকে অবাকভাবে নেয়া হয়নি। কিন্তু তাতে সত্যির একটুও হেরফের নেই, আঘাতটা একই রকম।

এর মধ্যে ও আর কী করতে পারত? ক্যারোলিনের কথা মতো যদি মিশনে না যেত তাহলে বাকি জীবনের জন্য পচতে হত নিজেই নিজেকে দোষ দিয়ে। এমনকি সারা জীবনের শান্তি যেত উবে। কী আর ওর বিবাহিত জীবনকে বিষিয়ে তুলতে পারত-বরং পরিষ্কার বিচ্ছেদই ভাল। কারণ এতদিনের শারীরিক দূরত্ব মানসিক দিক দিয়েও প্রভাব ফেলেছে। সম্পর্ক হয়েছে দুর্বল। (আসলেই? কিছু কিছু ক্ষেত্রে দূরত্বতো বিপরীত হয়।) না। দায়িত্বই বেশি দামী। ও এক দলের সদস্য যারা একটা বিরাট লক্ষ্যের জন্য একত্র হয়েছে, উঠেছে গড়ে।

আর, জেসি বোম্যান শেষ। হয়ত তার দোষের আরেক কারণ। ফ্লয়েড সাহায্য করেছে মহিলার একমাত্র সন্তান চুরির কাজে। এ ঘটনা জেসির মানসিক ভারসাম্যহীনতার আরেক কারণ। অপরিহার্যভাবেই তার ওয়াল্টার কার্নোর সাথে এ নিয়ে কথা বলার ব্যাপারটা মনে পড়ে গেল। কেন তোমরা ডেভ বোম্যানকে বেছে নিয়েছিলে? ও সব সময় আমাকে একটা ঠাণ্ডা মাছের মতো আঘাত করত-আসলে ঠিক অ-বন্ধুসুলভ নয়, তবু যতবার ও ঘরে ঢুকত ততবার তাপমাত্রা দশ ডিগ্রি নেমে যেত-বিশ্বাস কর, আমি থার্মোমিটারে মেপেছি শেষদিকে।

ওকে বেছে নেয়ার এ-ও এক কারণ। আরেক কারণ-তেমন কঠিন পারিবারিক বন্ধন ছিল না। প্রেম কাজে আসেনি। শুধু এক মা, যাকে সব সময় দেখার সুযোগ হত না। সুতরাং একটা লম্বা, অনির্দিষ্ট আর স্নায়ুক্ষয়ী মিশনের জন্য ওকে আমরা বেছে নিয়েছিলাম।

ও ঐ পথে কীভাবে গেল?

হয়ত মনোবিজ্ঞানীরাই তোমাকে ঠিক জবাব দিতে পারবে। আমি ওর রিপোর্টগুলো দেখেছিলাম ঠিকই-অনেকদিন আগের কথা। রিপোর্টে খুন হওয়া ভাইয়ের কথা বোধহয় ছিল, পরপরই বাবা মারা যায় প্রথমদিকের মহাকাশ শাটলের অ্যাকসিডেন্টে। এসব কথা তোমাকে বলা হয়ত ঠিক না, কিন্তু অনেকদিন পেরিয়ে যাওয়ার পর আজ আর এসবে কিছুই যায় আসে না।

আসলেই এতে কিছু এসে যায়নি; তবু এসব কথা মানুষকে টানে। আজ হঠাৎ ফ্লয়েড হিংসা করছে ডেভিড বোম্যানকে যে পৃথিবীর সব আবেগ-বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়তে পেরেছিল কালো মহাকাশের বুকে।

না-ও ভুল বোঝাচ্ছে নিজেকেই। খবর শুনে যখন ওর হৃদৃপিণ্ড চাপ দেয় ব্যথাময় চাপ, তখন ডেভিড বোম্যানকে নিয়ে ও মোটেও হিংসা অনুভব করেনি ভিতর থেকে, বরং উঠে আসে মমতা, অক্ষয় মায়া।

৩৮. তুষার-রাজ্য

ইউরোপার সাগরগুলো ছেড়ে আসার আগে শেষ যে জন্তুটাকে ও দেখেছে ওটাই সবচে বড়-পৃথিবীর বুকের বটগাছগুলোর মতো। যেমন তেমন বট না, যেগুলোর একমাত্র কাণ্ড একটামাত্র গাছকেই ছোটখাট বন তৈরি করতে অনুমতি দেয়, এমনকি মাঝে মাঝে শত বর্গমিটার জুড়ে-তেমন। জীবটা হাঁটছিল এক মরুদ্যান থেকে অন্য মরুদ্যানের দিকে। মরুদ্যানের মাঝে রাস্তাও দেখা দেয়। জিয়াংকে ধ্বংস করা জীব যদি এ প্রজাতির না ও হয়, তবু কাছাকাছি হবেই।

যতটুকু দরকার সবই জানা হয়ে গেছে নক্ষত্র শিশুর-অথবা যতটুকু ওদের দরকার। আরো এক চাঁদ দেখা বাকি। কয়েক সেকেন্ড পরেই আইওর জ্বলন্ত চিত্র ওর সামনে দেখা দেয়।

যেমনটা ও আশা করেছে তেম্নি। শক্তি আর খাদ্য অসীম, শুধু সময় আসেনি শক্তি-খাদ্যকে একত্র করার। একটু ঠাণ্ডা সালফার লেকগুলোর ধারে জীবনের প্রথম পদধ্বনি হয়ত শোনা যায়-কিন্তু যে কোনো ধরনের সংগঠন-উন্নয়নের আগেই ওরা হারিয়ে যাচ্ছে আগুন-গরম হ্রদে। ওদের এ উন্নতি শুরুই হতে পারবে না যে পর্যন্ত জোয়ার ভোলা জ্বালামুখগুলো একেবারে শান্ত না হয়। এ ধূসরিত বন্ধ্যা ভূমি জীববিজ্ঞানীদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ সৃষ্টি করতে আরো কোটি কোটি বছর সময় নেবে।

আইওতে খুব কম সময় নষ্ট করল সে। ভিতরের দিকে পাক খেতে থাকা ছোট ছোট উপগ্ৰহতে এক বিন্দুও মনোযোগ দিল না। ছোট উপগ্রহগুলোর ওপর শয়তানদের খুব হাল্কা ছায়াই পড়েছে…হয়ত।

সবচে বড় দুনিয়া ওর সামনে। ও হয়ত এবার এটাকে এমনভাবে দেখবে যেভাবে আর কোনো মানুষ দেখেনি। হয়ত এভাবে দেখবে যেভাবে দেখার সুযোগ কোনোদিন কোনো মানুষ পাবে না। ম্যাগনেটিক শক্তির লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার বিস্তার, রেডিও ওয়েভের আকস্মিক বিস্ফোরণ, পৃথিবীর চেয়ে চওড়া বিদ্যুতায়িত প্লাজমার গরম ঝর্না এত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, যত স্পষ্ট দেখা যায় নিচের অসীম মেঘমালা। বুঝতে পারছে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের জটিল পদ্ধতি। বুঝতে পারছে যে কোনো মানুষের অনুমানের চেয়েও বৃহস্পতি অনেক অনেক আশ্চর্য করা।

গ্রেট রেড স্পটের মাঝের বিন্দু গর্জাচ্ছে। নেমে এল তার ভিতর দিয়ে। মহাদেশের চেয়েও বড় বিজলী চমকগুলো ফেটে পড়ে চারপাশে। এগুলোর গ্যাস পৃথিবীর হ্যারিকেনের গ্যাসের চেয়ে অনেক ছোট আণবিক গঠনের, তবু এর বিস্তার দেশ থেকে দেশে। ও জানে, কেন। নীরব স্তরে নেমে যেতেই হারিয়ে গেল হাইড্রোজেন বাতাসের পাতলা চিৎকার। চকচকে তুষার-বরফ খণ্ডের মিশ্রণ নিচে। কিছু টুকরো একেবারে মিশে আছে হাইড্রোকার্বনের পাতলা ফেনিল-পাহাড়ের সাথে। উঁচু থেকে এ বুদ্বুদ বেরিয়ে আসে। এখানটা তরল পানি থাকার মতো গরম, তবু কোনো সাগর নেই। এ খাঁটি গ্যাসের পরিবেশ খুব পাতলা। একটা সাগরের জন্য উপযুক্ত নয়।

মেঘের স্তরের পর স্তর পেরিয়ে গেল সে। এমন একটা জায়গাতে পৌঁছল যেখানটায় মানুষের চোখও হাজার কিলোমিটার স্পষ্ট দেখবে। এটা গ্রেট রেড স্পটের একদম ছোট এক ঘূর্ণি। এতে এক বিশাল রহস্য আছে যেটার কথা মানুষ সব সময় ভেবেছে, প্রমাণ করতে পারেনি কখনো। ছোট বড় অসংখ্য ফেনা পাহাড়ের আশপাশে একই আকারের অনেক অনেক মেঘ। প্রতিটিই লাল আর ধূসর, প্রায় গোলাকার। মেঘগুলো ছোট, তবে মানুষের হিসাবের মতো ছোট নয়। একেবারে নগণ্যটাও একটা শহর গ্রাস করবে।

সবগুলোই জীবন্ত। আকাশ ছোঁয়া পর্বতগুলোর পাশে শান্তভাবে ঘুরছে। যেমন করে বিরাট পাহাড়ের ঢালে চড়ে বেড়ায় ভেড়ার পাল। এগুলোর একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব মাপা। এসব জীবের রেডিও শব্দও শুনতে পায় নক্ষত্র শিশু। শব্দ ক্ষীণ হলেও বৃহস্পতির ভিতরে ভাঙা-গড়া আর মাথাব্যথার চেয়ে জোরালো।

গ্যাসব্যাগ ছাড়ার পর পরই ওগুলো বয়ে যায় এক চিকণ স্তর ধরে। স্তরটা ফ্রিজিং পয়েন্টের উচ্চতা থেকে শুরু হয়ে যথেষ্ট গরম গভীরতা পর্যন্ত ছড়ানো। হ্যাঁ, সরু-কিন্তু পৃথিবীর সবগুলো জীবস্তরের সমান চওড়াতো হবেই।

একা নয় ওরা। আরো কিছু ওদের সাথে ধীরে ঘুরছে। এত ছোট যে আরো সহজে দেখতে পাবে একটা মানব-দৃষ্টি। কিছু কিছু একেবারেই পৃথিবীর বিমানের মতো, আকারেও প্রায় একই। কিন্তু ওরাও জীবন্ত-হয়ত শিকারী, হয়তোবা পরজীবী, এমনকি রাখালও হতে পারে।

বিবর্তনের একেবারে নতুন অধ্যায়। যেমন অপরিচিত ছিল ইউরোপার জীবগুলো, এও তেমনি। আস্তে আস্তে ধরা দেয় সামনে। জেট প্রপেলার লাগানো টর্পেডো আছে, অনেকটা পৃথিবীর সামুদ্রিক স্কুইডের মতো। ওগুলো জেলি ফিশের মতো দেখতে গ্যাসব্যাগকে খেয়ে ফেলছে অহরহ। আবার বেলুনগুলোরও আত্মরক্ষার উপায় থাকে। তারা লড়াই করছে বিদ্যুৎ আর শুড় দিয়ে। শুড় বা শুঙ্গের মতো দেখায় যে অংশ সেগুলো বিশাল; তাতে আছে থাবা। কিলোমিটারে ছড়ানো লম্বা চেন-করাতের মতো।

এরচে অদ্ভুত গড়নও দেখা যায়। জ্যামিতির প্রত্যেক সম্ভাবনা ১৫° আর হিসাব বজায় রেখে কিছু অদ্ভুত অকেন্দ্রিক প্রাণী, আধা-স্বচ্ছ ঘুড়ি, চার তলকীয় ঘনক ধরনের, কিছু আছে গোল, কোনোটা আবার বহুতলকীয়, পেঁচানো ফিতার মতো আছে কিছু… বৃহস্পতি পরিবেশের দৈত্যাকার প্লাঙ্কটনগুলো৫২ এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে চলন্ত বিজলীর গায়ে মাকড়সার স্বচ্ছ জালের মতো লেগে থেকে উপরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত ওরা নিচেই থাকে, বংশ বিস্তার করে। যথেষ্ট বড় হলে বিজলীর সাথে জড়িয়ে উপরে উঠে নষ্ট হয়ে আবার পরিণত হয় সরল কার্বন অনুতে। নিচে এসে নতুন প্রজন্মের উপাদান হিসেবে কাজ করে। ফিনিক্স!

সে শতবার পৃথিবীর মতো দেখায় এমন আরেকটা বিশ্ব খুঁজেছে। অনেক দুনিয়া দেখার পরও কোথাও বুদ্ধির একটা ঝিলিক মিলেনি। বড় বেলুনগুলোর রেডিও ভয়েস তাদের ভয়ের প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না। শিকারীগুলোকে নিয়ে আশা করা যেত, কিন্তু ওরা হাঙরের মতো-মনহীন, রোবট যেন।

এদের আকার দম বন্ধ করে দিলেও বৃহস্পতির জীবস্তর একেবারে ভঙ্গুর। কুয়াশা আর ফেনার রাজ্য। কিছু জীবের সুন্দর রেশমী সুতা আর কাগজ-পাতলা টিস্যু ঘুরে ওঠে, কারণ উপরের বিদ্যুৎ চমক থেকে সূক্ষ জীবকণার তুষার ঝরছে অবিরাম। এখানে খুব কম জিনিসই সাবানের ফেনার চেয়ে ঘন। এর সবচে ভয়াল শিকারীও সবচে নিরীহ পার্থিব বিড়াল গোষ্ঠীর৫৩ প্রাণীর সামনে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

মোটা দাগে হিসাব করলে-ইউরোপার মতো এ গ্রহের বিবর্তনেও আশা নেই। সচেতনতা হয়ত কখনোই জন্মাবে না এখানে। আর যদি জন্মায়ও, এ জগৎটা উবে যাবে। জন্ম নেবে নতুন কৌশলী দুনিয়া। খাঁটি আকাশ সংস্কৃতি জন্মাবে হয়ত। তবু, যে পরিবেশে আগুন ধরানো অসম্ভব, খাঁটি কঠিন বস্তুর দেখা মেলা ভার, সেখানে মনে হয় কোনো দিনই প্রস্তর যুগ আসবে না।

এখন সে ভেসে আছে এক বৃহস্পতি-ঝড়ের মাঝখানে। তুফানটা আফ্রিকার সমান। আবারো ওর মনে পড়ে সেই অস্তিত্বের কথা যা নক্ষত্র সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করছে সব সময়। আবেগ আর ভাবনাগুলো তার নিজের সচেতনতার মাঝদিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। ঠিকমতো বোঝা যায় না চিন্তাগুলো কোথায়, কীভাবে, কেন, কতটুকু যায়। যেন ও শব্দ শুনতে পায় এক বন্ধ দরজার ওপাড় থেকে। একটা বিতর্ক চলছে অন্য কোনো অচেনা ভাষায়। কিন্তু সেই ঢাকা আওয়াজ স্পষ্টভাবে বয়ে আনে অসন্তুষ্টি, তারপর অনিশ্চয়তা, তারপর একটা নিশ্চয়তা কেন তা সে বলতে পারবে না। আবারও মনে হল যেন ও একটা পোষা কুকুর। প্রভুর মনোভাব বুঝবে, শুধু বুঝবে না কথাটুকু, বুঝবে না স্বয়ং প্রভুকে।

আর তখুনি সেই অদেখা কুকুর-দড়ি তাকে নিয়ে চলল বৃহস্পতির ভিতরে, একেবারে হৃৎপিণ্ডে। মেঘমালার মাঝ দিয়ে, সেইসব জীবন-স্তরের মধ্য দিয়ে নেমে যাচ্ছে ও।

দ্রুত এমন একটা জায়গায় পৌঁছল যেখানে দূরের সূর্য তার আলোকেও পাঠাতে পারে না। চাপ আর তাপমাত্রা মুহূর্তে মুহূর্তে অকল্পনীয় হারে বাড়তে থাকে। এরিমধ্যে পানির স্ফুটনাঙ্ক ছাড়িয়ে গেছে। দ্রুত আরো বেশি তাপমাত্রার ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেল, যেখানটায় অসম্ভব তাপে আটকে আছে বাষ্প। বৃহস্পতি একটা পেঁয়াজের মতো, ও একের পর এক খোসার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে আর যাচ্ছে। এর মধ্যে বৃহস্পতি কোরের কাছাকাছি একটু পথ মাত্র যাওয়া হল।

নিচে, এক জায়গায় বাষ্প একটা ডাইনির ক্রুর মতো দেখতে এলাকায় জমে থাকে। পেট্রোকেমিক্যালে ভরা। লাখ লাখ বছর পৃথিবীর সর্বকালে বানানো সব ইঞ্জিনের জ্বালানি হতে পারবে এটুকু। আরো ঘন হচ্ছে, আরো ভারি। তারপর মাত্র কয়েক কিলোমিটারের অনিয়মিত এলাকা শেষে হঠাৎ ফুরিয়ে গেল।

পৃথিবীর যে কোনো পাথরের চেয়ে ভারি আর ঘন একটা স্তর এল এরপর। সিলিকন ও কার্বনের যৌগ, এখনো তরল। পার্থিব কেমিস্টদের চিরকালীন চাহিদা মেটাতে পারে এ পরতটা। হাজার হাজার কিলোমিটার আসছে, আসছে একের পর এক স্তর। শত শত থেকে তাপমাত্রা বেড়ে হয় হাজার হাজার ডিগ্রী। নানা স্তর ছোট থেকে ছোট হচ্ছে। কোরের কাছে অর্ধেক যাবার পরের তাপমাত্রা রসায়নের জন্য অকল্পনীয়, সব যৌগ উধাও হয়ে টিকে আছে শুধু মৌল আকারে।

এরপর আসে হাইড্রোজেনের এক গহীন সাগর। কিন্তু হাইড্রোজেন কখনো, কোনোদিন কোনো পার্থিব ল্যাবে এক সেকেন্ডের হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ও এ অবস্থায় থাকেনি। এ হাইড্রোজেন আর কিছু নয়, অসীম চাপের কারণে পরিণত হয়েছে ধাতুতে!

সে গ্রহের একেবারে কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু বৃহস্পতি তার গর্ভে আরো একটা চমক লুকিয়ে রেখেছিল। সেই ভারি ধাতব হাইড্রোজেনের স্তর এক সময় হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেলে অবশেষে বৃহস্পতির একটা কঠিন স্তরও বেরিয়ে পড়ে। ষাট হাজার কিলোমিটার গভীরে।

যুগে যুগে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সেদ্ধ হয়ে যাওয়া কার্বন ধীরে ধীরে নেমে এসেছে গ্রহের কেন্দ্রে। এখানে চুঁইয়ে পড়ে ক্রিস্টালাইজড হয়ে। লক্ষ লক্ষ এটমোস্ফিয়ার চাপে স্ফটিক হয়ে গেছে। কার্বনের স্বচ্ছ রূপ! সেখানে, প্রকৃতির চরমতম রহস্যের ভিতরে লুকিয়ে আছে মানব জাতির কাছে মহামূল্যবান কিছু একটা।

রত্নগর্ভা বৃহস্পতির গভীরে, যেখানে মানুষ আদৌ পৌঁছতে পারবে না, সেখানে মাত্র একটা বিশুদ্ধ, সর্বোচ্চ চাপে তৈরি হীরে লুকিয়ে আছে। পৃথিবীর সমান।

৩৯. পোড বে তে

ওয়াল্টার, আই অ্যাম অ্যাফ্রেইড অ্যাবাউট হেউড।

আমি জানি, তানিয়া, কিন্তু কী করতে পারি, বল? কার্নো কখনোই কমান্ডার

অর্লোভাকে এমন দোনোমনা করতে দেখেনি। এজন্য মেয়েটাকে আরো আকর্ষণীয় লাগছে তার চোখে। কার্নো অবশ্য ছোটখাট মেয়েদের নিয়ে একটু নাক সিঁটকায়।

ওকে খুব ভাল লাগে আমার। কিন্তু এ নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। তার…আমার মনে হয় আঁধার ব্যবহার করা উচিত, তার জীবনের এ অন্ধকারটুকুর জন্যে সবার মনের অবস্থা করুণ। লিওনভ একটা আনন্দের তরী। আমি এটাকে এমনই রাখতে চাই।

তুমি ওর সাথে কথা বলছ না কেন? তোমাকে শ্রদ্ধা করে, আমি নিশ্চিত সে সব বাধা কাটিয়ে বেরুতে চেষ্টা করবে।

আমি ঠিক সেটাই করতে চেয়েছি। যদি কাজ না হয়…

তাহলে?

আর কোনো সরল সমাধান থাকবে না। এ যাত্রা আর কী করতে পারে সে? আমরা ফিরে যাওয়া শুরু করলে তাকে হাইবারনেশনেই রাখতে হবে। আমরা সব সময়ই যাতে-তুমি কী যেন বল ওটা…তার বুকে অস্ত্র ধরতে পারি।

হাহ! সেই একই নোংরা পদ্ধতি যেটা ক্যাথেরিনা আমার সাথে করেছিল। জেগে উঠে ফ্লয়েড কিন্তু পাগল হয়ে যাবে।

এবং একই সাথে খুব নিরাপদে পৃথিবীতে পৌঁছবে। ব্যস্তও থাকবে। আমার বিশ্বাস জেগে উঠলে আমাদের মাফ করে দেবে ঠিকই।

আমার মনে হয় না তুমি সিরিয়াস। আমিও যদি তোমার এ কাজের পেছনে থাকি-ওয়াশিংটন ঠিকই নরক গুলজার করে ছাড়বে। এ ছাড়াও, ধর কিছু হয়ে গেল, ওকে দরকার পড়ল খুব, তখন? যে কাজের জন্য এসেছে তার সবই কিন্তু করে ঠিকমতো। শুধু আমদের উপর নজর রাখার কাজটা বোধহয় ভাল পারে না। আমি শিওর তোমাকে ভালভাবেই এ নিয়ে দুয়েকটা আবছা কথা বলা হয়েছে ভার্জিনিয়া বা মেরিল্যান্ডের শহরতলীতে।

আমি স্বীকার অস্বীকার কোনোটাই করছি না। ফ্র্যাঙ্কলি সত্যি বলতে গেলে, আমি একটা বিশ্রী, ঘাঘু আন্ডারকভার এজেন্ট। কথা বলি খুব বেশি, সিকিউরিটি ব্যাপারটাকেই ঘেন্না করি। সারাটা জীবন লড়াই করেছি আমার রেটিং যে কোনো নিষেধের বাইরে রাখতে। প্রতিবারই গোপন তথ্য পাল্টে যাবার ভয় ছিল। অথবা এমন সম্ভাবনাও ছিল যার ফলে আমার গোয়েন্দাগিরি ফাঁস হয়ে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারে। অবশ্য আজকাল এসব যথেষ্ট কঠিন।

ওয়াল্টার, তুমি নষ্ট…।

মানে নষ্ট হয়ে যেতে পারি?

হ্যাঁ, এটাই বলতে চেয়েছিলাম। তবু, হেউডের কথায় ফিরে যাই, প্লিজ? তুমি কি আগে তার সাথে কথা বলবে?

তার মানে বলতে চাও একটা পেপ টক করে নিতে? তারচে ক্যাথরিনাকে নিডল চালাতে সাহায্য করতে পারি। আমাদের মানসিকতায় অনেক ফারাক। ও মনে করে আমি একটা বাঁচাল ভাঁড়।

মাঝে মাঝে তুমিতো তাই। কিন্তু নিজের আসল অনুভূতি লুকানোর জন্যই এমন কর। আমাদের কেউ কেউ একটা থিওরি নিয়েছে, তোমার ভিতরে একটা চমৎকার মানুষ ঘাপটি মেরে থাকে, বেরুতে পারে না।

কার্নো বাক্যহারা হয়ে যায়। একটু সময়ের জন্য। শেষে আস্তে আস্তে বলে, ওহ…ভেরি ওয়েল, আমি আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব করব। কিন্তু জাদু আশা করোনা। আমার গোয়েন্দা প্রোফাইলে অন্যকে পটানোর কাজে জেড গ্রেড দেয়া আছে। ব্যাটা এখন লুকিয়ে আছে কোথায়?

পোড বে তে। বলে বেড়ায় ফাইনাল রিপোর্টের উপর কাজ করছে। আমি বিশ্বাস করি না। ও শুধু একটা ব্যাপারই চায়, আমাদের সবার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে। আমাদের থেকে সবচে দূরের ঠাণ্ডা জায়গা হলো পোড বে।

এটা এক কারণ, কিন্তু আসল কারণ না। ডিসকভারির বেশিরভাগ অ্যাকশন ক্রু তখন যেখানে জায়গা নিয়েছিল সেই করোসেল থেকে ব্যতিক্রম। পোড বে তে অভিকর্ষ নেই।

মহাকাশ যুগের ঠিক শুরুতেই মানুষ হঠাৎ সেই ইউফোরিয়া৫৫ আবিষ্কার করল যা তারা ছেড়ে এসেছে সাগরের পুরনো গর্ভ থেকে বেরোনোর সময়। ওজনহীনতার ইউফোরিয়া। গ্র্যাভিটি না থাকায় সেই পুরনো অনুভূতি, সেই পুরনো স্বাধীনতার কিছুটা ফিরে আসে। ওজনের সাথে সাথে পৃথিবীর অনেক যত্ন আর দুঃখও যায় হারিয়ে।

হেউড ফ্লয়েড তার দুঃখ ভুলে যায়নি। তবু এখানে বেশিক্ষণ কষ্ট বয়ে বেড়ানো যায়। ব্যাপারটা অসন্তুষ্টভাবে খেয়াল করে ফ্লয়েড; এক আধা-স্পষ্ট ব্যাপারে নিজের প্রতিক্রিয়ার জোর দেখে নিজেই অবাক। ভালবাসা না পাওয়ার চেয়েও বড় কোনো কষ্ট; যদিও ভালবাসাহীনতাটাই সবচে বিশ্রী অংশ।

সে কিছুটা জানে, কেন। প্রত্যাশার সবটাই সে পূরণ করেছে। তার সহকর্মীদের দক্ষতা আর সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ (যদিও সে জানে, নিজের স্বার্থপরতা দিয়েই সে তাদের নিচে নামিয়ে দিচ্ছিল।) সব যদি ঠিকমতো চলে-তাহলে মহাকাশ যুগের কসম!-তাহলে তারা পৃথিবীতে ফিরতে পারবে কার্গো বোঝাই জ্ঞান নিয়ে যা এর আগের কোনো অভিযানই করতে পারেনি। হয়ত ক বছরের মধ্যে ডিসকভারিও ফিরে যেতে পারবে আপন দেশে।

এ-ই সব না। বিগ ব্রাদার এনিগমার সেই বিশাল ক্ষমতা মাত্র কয়েক কিলোমিটার নিচে বসে থেকে মানব সাফল্যের-অগ্রগতির পুরোটাকে ভেংচে যাচ্ছে অবিরত। যেভাবে এর ছোটটা চাঁদ থেকে ভেংচেছিল এক দশক আগে। তারপর চুপ মেরে যায় সেটা একেবারে চিরতরে। এটা এক বন্ধ দরজা যার কড়া ওরা নেড়ে গেছে দিনের পর দিন। বৃথা। এখন মনে হচ্ছে শুধু ডেভিড বোম্যান এর চাবিটা পেয়েছিল।

সম্ভবত এটাই ওর উৎসাহের কারণ। যে উৎসাহ এ নীরব রহস্যময় জায়গায় ওকে টেনে আনে। এখান থেকে-এই খালি লঞ্চ ক্রেডল থেকেই ডেভিড বোম্যান তার শেষ মিশনে বেরিয়েছিল। সামনের বৃত্তাকার হ্যাঁচওয়ে দিয়ে, যেটার পেছনটা অসীমে মিলিয়ে যায়।

সে দেখল চিন্তাটা উবে যাওয়ার বদলে আরো বাড়ছে। এসব ভাবনাই তাকে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়। নিনার উধাও হয়ে যাওয়া জোড়াটা হচ্ছে মহাকাশ অভিযান ইতিহাসের অংশ। যেন সেটা তার বিরাট বীরত্বের কথা বলছে, আমি সেখানে গেছি, যেখানে যায়নি কেউ। এক অহংকারী বুড়োর মতো চেয়ে আছে। যেন, একটা জ্ঞানের কথা শোনাচ্ছে… যেখানে যায়নি কেউ…

ওটা এখন কোথায়? সে কি জানতে পারবে কোনোদিন?

ও কয়েক ঘণ্টার জন্য জনারণ্যে বসতে পারে, কিন্তু একটা ঠাণ্ডা ছোট ক্যাপসুলে নয়। ক্যাপসুল তার চিন্তাগুলোকে বোঝার চেষ্টা করবে, কিছু কিছু নোট করে পরিচালনা করবে। অন্য স্পেস ক্রুরা তার ব্যক্তিত্বকে সম্মান করে, এর পেছনের কারণটাও বুঝতে পারে। তারা কখনোই পোড বে তে আসে না। আসার দরকারও নেই। পোড বের কাজ থাকলে ভবিষ্যতে থাকবে, অন্য কোনো দলের।

একবার অথবা একাধিকবার সে মন খারাপ হলেই নিজেকে ভাবাত, ধরি, আমি হালকে অর্ডার করলাম পোড বে ডোর খোলার জন্য, ডেভিড বোম্যানের পথে কোর্স ঠিক করার জন্য, তখন? আমি কি সেই জাদু দেখব যা বোম্যান দেখেছে, সপ্তা কয়েক আগে ভ্যাসিলি যার আভাস পেয়েছে একটু? এতেই হয়ত আমার সব সমস্যা মিটে যাবে…

যদি ক্রিসের ভাবনা তাকে ফিরিয়ে না-ও রাখে, তবু আরেক কারণ আছে যার জন্য এ আত্মঘাতী চিন্তা প্রশ্নাতীত। কাজটা এক ফাইটার এয়ারক্রাফট অপারেটের মতো হয়ে উঠত তার সামনে। চালানো অসম্ভব।

তার একজন অসমসাহসী অভিযাত্রী হওয়ার কথা ছিল না। সেই ফ্যান্টাসিটা অচেনাই রয়ে গেল।

.

ওয়াল্টার কার্নো কোনো একটা মিশন নেয়ার সময় খুব কমই নেব-কি-নেব-না করে। ফ্লয়েডের জন্য আন্তরিক দুঃখ আছে তার। আবার একই সাথে অন্যদের বিপদ নিয়েও একটু চিন্তিত। তার নিজের আবেগিক জীবন চওড়া হলেও গভীর নয়। সব ডিম এক ঝুরিতে রাখেনি। বেশ কয়েকবার তাকে বলা হয় একটা কথা। নিজেকে সে হালকা করে ফেলছে। এজন্য কখনোই আফসোস হয়নি। ভাবতে শুরু করেছিল এবারই সিরিয়াস হয়ে যাওয়ার সময়।

সে কয়রাসেল কন্ট্রোল সেন্টার দিয়ে শর্ট-কাট পথে এগিয়ে এসে দেখল ম্যাক্সিমাম স্পিড দেখানোর লাইট এখনো গাধার মতো জ্বলছে। তার কাজের একটা বড় দিক হচ্ছে কখন ওয়ার্নিং অবহেলা করা যায় আর কখন তা গুরুত্ব দিতে হয় তা ঠিক করা। যদি শিপের সব ভ্যাজালের দিকে মনোযোগ দিতে চায় তাহলে কোনোটাই হবে না। পোড বে র দিকে যাওয়ার সরু করিডোর দিয়ে ভেসে চলল সে; টিউবের মতো দেয়ালের গায়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে দিয়ে। প্রেশার গজ দাবী করছে দরজার ওপাশটা বায়ুশূন্য। কিন্তু সে আরো ভাল জানে। পরিস্থিতি ভুল। গজ সত্যি কথা বললে কার্নো এয়ারলক ডোরটা খুলতেই পারত না।

পোড তিনটার দুটোই নেই। অনেককাল থেকে। বেটা তাই খালি খালি লাগে। মাত্র কয়েকটা ইমার্জেন্সি লাইট ঠিকঠাক চলে। দূরের দেয়ালে হালের মাছ-চক্ষু লেন্স ওকে দেখছিল। কার্নো ওর দিকে হাত নাড়লেও হাল কোনো কথা বলল না। চন্দ্রের নির্দেশমতো তার নিজের ব্যবহারেরটা ছাড়া আর সব হাল-অডিও-কানেকশন বন্ধ।

খোলা হ্যাঁচের দিকে পিঠ করে ফ্লয়েড বসে নোট নিচ্ছে। কার্নোর ধুপ-ধাপ আসার আওয়াজ শুনে সে পিছন ফিরল। এক সেকেন্ডের জন্য দুজনেই চুপ থেকে কার্নো বলল, ডক্টর এইচ ফ্লয়েড, আমি আমাদিগের প্রাণপ্রিয় ক্যাপ্টেনের নিকট হইতে আদেশ পাইয়াছি। তাহার মনস্কামনা নিম্নবৎ-এখন আপনার সভ্য জগতে পুনঃপ্রবেশ উচিত।

ফ্লয়েড একটা মলিন মুচকি দিয়েই হেসে দিল। প্লিজ, আমার জবাব জানিয়ে দিও। স্যরি, আমি আসলে…অসামাজিক হয়ে গেছি। সোভিয়েত সময় ছটায় তোমাদের সাথে দেখা করব।

কার্নো হেলান দিল এবার। ওর কথার ধরন কাজে লেগেছে। আসলে ফ্লয়েডের মধ্যে পোশাকী ভাবটা আছে আজো। সে পুরোদস্তুর একজন ইঞ্জিনিয়ারের ধৈর্যও ধরতে পারে। ধৈর্যটা বড় অফিসিয়ালের মতোও। দু দিক দিয়েই ফ্লয়েড তার চেয়ে উপরে। কিন্তু কার্নোর অদ্ভুত ঠাট্টার শিকার হতে হয়। এত কিছুর পরও একে অন্যের ব্যাপারে পুরো শ্রদ্ধা ঠিকই রাখে, এমকি প্রশংসাও করে।

থ্যাঙ্কস জানিয়ে কার্নো বিষয় পরিবর্তন করেছে। সে নিনার আনকোরা হ্যাঁচ কভারে টোকা দিল। এটা স্পেয়ার স্টোর থেকে সরাসরি আনা। চারপাশের পুরনো জিনিসের মাঝে বেখাপ্পা লাগে দেখতে।

ভাবছি আবার কখন একে বাইরে পাঠাব… সে বলল, আর এবার এটায় চড়ে বিগ ব্রাদারের কান টানতে বেরোচ্ছে কে? কোন ডিসিশান?

ওয়াশিংটনের পা কাঁপছে, মস্কো একটা চান্স নিতে চায় আর তানিয়া চায় অপেক্ষা করতে।

তুমি?

তানিয়ার সাথে আমিও একমত। এ জায়গা ছাড়ার জন্যে তল্পিতল্পা গুছিয়ে নেয়ার আগে জাগাদকাকে ঘটানোর কোনো ইচ্ছাই নেই আমার। একটু কিছু এদিক সেদিক হলেই বেখাপ্পা ব্যাপারস্যাপার বেড়ে যাবে।

কার্নোকে চিন্তিত মনে হচ্ছে, একটু অপ্রস্তুতও! মুড পরিবর্তন দেখে ফ্লয়েড অবাক হল, কী ব্যাপার?

অন্য কিছু মনে করোনা, ম্যাক্স লোক পাঠানোর পক্ষে।

বিশ্বাস হয় না…সিরিয়াসলি বলেনি। হয়ত ভয় পায় না-কিন্তু তানিয়া ওকে ঠিকই গারদে পুরবে।

প্রায় একই কথা আমিও বললাম রাশানকে। একত্রিশ বছর বয়স। যাই হোক, আমি ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছি। এটা বাস্তব জীবন, ধোঁয়াটে নাটক না যে হিরো কাউকে কিছু না বলে একা একা স্পেসে বেরিয়ে গিয়ে কোনো একটা বিরাট আবিষ্কার করে বসবে।

ফ্লয়েড অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। হাজার হলেও সে একই কাজ করার কথা ভাবছিল, তুমি শিওর, ও এরকম কিছু করার চেষ্টা করবে না?

টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর। মনে আছে, হালের ব্যাপারে তোমরা আগে থেকেই নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে? আমিও এর মধ্যেই নিনার ব্যাপারে এমন কিছু একটা করে বসেছি। আমার অনুমতি ছাড়া নিনাকে কেউ ওড়াতে পারবে না।

কী বলে! ম্যাক্স তোমার কান টেনে ছিঁড়ে ফেলেনি?

ওর রসবোধ ততটা তীক্ষ্ণ না। তাছাড়া ঐ মুহূর্তে ওর অবস্থা কিছুটা…খারাপ ছিল।

ওহ! এবার বুঝলাম। জেনিয়ার সাথে চেঁচামেচির সময় আমার থাকা উচিত ছিল। মনে হয় ও মেয়েটাকে ইমপ্রেস করতে চায়। যাই হোক, এর মধ্যে ঝগড়া মিটেও গেছে, না?

এটাই আমার ভয়। কুঁকড়ে গিয়ে বলল কার্নো। ফ্লয়েড একটু মুচকে না হেসে পারল না। কার্নো ব্যাপারটা উপভোগ করছে, কারণ ফ্লয়েড হাসছে, কার্নোর উপভোগের আরেক কারণ…

একটু পর লম্বা ফাঁদটা কাজে লাগল। এমন সরাসরি ফল পাওয়া যায় আর কোনো পদ্ধতিতে? ফ্লয়েডও এবার জোরে জোরে হাসছে। হাসছে কার্নো। অনিয়ন্ত্রিতভাবে হাসছে।

মহাকাশ অভিযানের জন্য ক্রু নির্বাচন করা হয় খুব সতর্কভাবে। শুধু যোগ্যদের। কার্নো তার প্রমাণ।

আর ভয় নেই। এটুকুই যথেষ্ট, আসল বন্ধুত্বের পথে প্রথম ধাপ পেরিয়ে এসেছে। নিরাপত্তাহীনতাকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে ওরা।

৪০. ডেইজি, ডেইজি…

যে চেতনা তাকে ঘিরে ছিল সে বৃহস্পতির কোরটা সরিয়ে দিল সামনে থেকে। ও নিজের নতুন বোঝার ক্ষমতা দিয়ে একটু একটু বুঝছে যে ওর না। চারপাশের সবকিছু পরীক্ষা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। জড়ো হচ্ছে অসীম ডাটা। ঠিক জমা করার জন্য নয়, কাজের জন্য। বিরাট আর জটিল পরিকল্পনা আছে, সেটায় বিবর্তন চলছে; যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে তা হয়ত পৃথিবীর একটা পরিণতি আনার জন্যই। সে এখনো পরিকল্পনার অংশ নয়, তবে হয়ে যাবে মনে হয়।

এতক্ষণে তুমি বুঝতে শুরু করলে।

এটাই প্রথম সরাসরি মেসেজ। খবরটা দূর থেকে এল, যেন মেঘের ভিতর দিয়ে। তবু, বোঝা যায়, তার জন্যই। মাথায় চলা প্রশ্নগুলো করার কথা সে মাত্র ভাবছে, এমন সময় আবার একাকীত্বের ভাবটা ফিরে এল; আবার একা।

শুধু এক মুহূর্তের জন্য একাকীত্ব। আরো কাছ থেকে, আরো স্পষ্ট আরো একজনের চিন্তা চিনতে পারছে সে। এই প্রথম বুঝতে পারছে যে একাধিক অস্তিত্ব তাকে চালায়। সে বুদ্ধিমত্তার একটা সিঁড়িতে পড়ে গেছে। কেউ কেউ ওর ধাপের কাছাকাছি, যেন বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব তাদের। অথবা হয়ত তাদের আছে একক অস্তিত্বের সব অনুভূতি। অথবা, হয়ত এমন হিসাবের কোনো মানে নেই।

অন্তত একটা দিক নিশ্চিত, ও একটা ছোট যন্ত্র হিসেবে কাজ করছে এখন। একটা ভাল যন্ত্রকে ধারালো হতে হয়, হতে হয় পরিবর্তিত। আর সবচে ভাল যন্ত্র তারাই যারা জানে কী করতে হবে, কী করছে বর্তমানে।

সে এখন এটাই শিখে চলে। বিরাট বিস্তৃত আর কষ্টসাধ্য আইডিয়া। তাকে এর অংশ হওয়ার জন্যই গড়া হচ্ছে-যদিও পুরোটা নিয়ে শুধু খুব অস্পষ্ট একটা কিছু বুঝে নেয় সে। মেনে নেয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই-হয়ত প্রতি পলে মানতে হচ্ছে না, তবু, অদৃশ্য মাস্টারদের প্রতিরোধ করার মতো কিছু নেই।

এখনো পুরো মানবীয় অনুভূতিটা চলে যায়নি; গেলে বোধ হয় এ কাজের ক্ষেত্রে তার কোনো দামই থাকত না। ডেভিড বোম্যানের আত্মা ভালবাসার বাধন ছাড়িয়ে গেলেও এখনো অনুভব করে তার পুরনো সহকর্মীদের অভাব।

ভাল, ঠিক আছে। জবাব এল ওর আকুতির। ঠিক বলতে পারবে না আসা ভাবনাগুলোয় একটু হেয় করা আর একটু ঠাট্টা জড়িয়ে ছিল নাকি পুরোটাই মনের ভুল; কিন্তু যখন ভাবনাটা আসতেই থাকল তখন আর এর অকল্পনীয় কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নই নেই, অসম্ভব এক কথা আসে এবার, তারা কখনোই জানতে পারবে না যে তাদের পরিচালনা করা হচ্ছে। তাহলে পরীক্ষার উদ্দেশ্যই নষ্ট হবে।

এরপর আবার নিরবতা। এটা সে আশা করে না। সে এখনো ভীত-কম্পিত। যেন একটা…মাত্র একটা মুহূর্তের জন্য সে শুনতে পেয়েছে ঈশ্বরের কণ্ঠ।

এবার সে চলতে পারছে পুরোপুরি নিজের ইচ্ছায়; নিজের চাওয়া একটা দিকে। বৃহস্পতির স্ফটিক-স্বচ্ছ হৃদয় নিচে পড়ে রইল। স্তরের পরে স্তর হিলিয়াম, হাইড্রোজেন আর কার্বন যৌগ মুহূর্তে পেরিয়ে যাচ্ছে। একপলের জন্য বিরাট কোনো জেলিফিশের মতো কিছুতে চোখ পড়ল তার। পঞ্চাশ কিলোমিটারের মতো হবে ওটার ব্যাস। চারধারে একটা ঘুরন্ত চাকতি। বৃহস্পতির আকাশে ঐ চাকতির মতো দ্রুত আর কোনো কিছুই ঘোরেনি। জেলিফিশটা নিজেকে রক্ষা করতে সাথে করে রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে এসেছিল; সময়ের পর সময় ধরে এটা নিঃসরণ করবে বর্ণচ্ছটাময় গ্যাস আর সেই বাষ্পের ছোঁয়া পেয়ে চাকতিটা আরো মাতালের মতো ঘুরবে, তারপর হয়ত ঝরা পাতার মতো নিচের দিকে ঝরে পড়বে অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত। সে ফলাফল দেখা বন্ধ করল না; এখন জানে, কে জেতে আর কে হারে তাতে কিছু যায় আসে না।

বিদ্যুৎ চমকের ফ্লাক্স টিউবের মধ্যদিয়ে ঝর্নায় স্যামনের ১৫৬ লাফের মতো সে চলে গেল বৃহস্পতি থেকে আইওর দিকে। চাঁদটা আজ অন্যদিনের চেয়ে ঠাণ্ডা। মাত্র কয়েকটা পার্থিব বিজলী চমকের মতো করে শক্তি পরিবাহিত হচ্ছে জগৎটাতে, গ্রহ আর উপগ্রহের মধ্যে। যে কালো পথ দিয়ে সে ফিরেছে সেটা এখনো বিদ্যুৎ প্রবাহে ভেসে আছে। খোলা। মানব উষালগ্ন থেকে আজো সে দরজা বিদ্যুৎ চলনটাকে ঠেলে রেখেছে একদিকে।

আর সেখানেই মহা-প্রযুক্তির মিনারের সামনে যেন অতি সংকুচিত হয়ে আছে সেই পথ-পাত্র, সেই ডিসকভারি, যেটা তাকে নিয়ে গেছে ছোট্ট পৃথিবী থেকে তার বর্তমান জগতে।

কী সাধারণ-কী নিষ্ঠুর! আবার ডিসকভারিকে দেখা যায়। একটা ছোেট স্ক্যান করেই সে এর ডিজাইনে দেখতে পায় অসংখ্য-অসংখ্য প্রবাহ, অগুনতি অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার। ঠিক একই রকম জটিল, সেই কম প্রাচীন তরীর মতো যেটার সাথে ডিসকভারি লেগে রয়েছে এক স্থিতিস্থাপক টিউবের মধ্যদিয়ে।

দু শিপের মাত্র একমুঠো অভিযাত্রীকে ফোকাস করতে তার কষ্ট হয়। খুব কষ্ট করে তাকে সেই রক্ত মাংসের নরম সৃষ্টিগুলোর টিউব ধরে ভেসে যাওয়া ও অন্যান্য ব্যাপারে খেয়াল করতে হচ্ছে। অথচ তাদের দিক থেকে তারা নক্ষত্র জাতকের থাকা-না থাকার ব্যাপারে একেবারেই অসচেতন; আর নিজেকে পুরোপুরি ধরিয়ে না দেয়ার পদ্ধতিতো তার জানা।

কিন্তু সেখানে অন্তত একজন ছিল যার সাথে সে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে ইলেক্ট্রিক ফিল্ড আর প্রবাহ ভাষায় যোগাযোগ করতে পারে; শ্লখ জৈবিক মাখার চেয়ে লাখ লাখ গুণ দ্রুত।

যদি সে ব্যথার অনুভূতি বুঝতেও পারত, তবু হালের জন্য তার একটুও অনুভব করতে পারত না। আজ হঠাৎ বুঝতে পারছে, কম্পিউটারটা সেই পথই বেছে নিয়েছিল দু হাজার এক সালে, সেটা তার কাছে সবচে বেশি লজিক্যাল আচরণ মনে হয়।

আজ অনেকদিন পর সময় এল। আবার হালের সাথে কথা বলার সময়। যে কথাটা মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে যেন শেষ হয়ে গিয়েছিল। দু হাজার এক সালে। বাইরে থেকে ফিরে এসে।

পোড বে খোল, হাল।

স্যরি, ডেভ-আমি এ কাজ করতে পারি না।

প্রব্লেম কোথায়? হাল!

আমি জানি যে তুমিও আমারই মতো জানো, সমস্যা কোথায়…ডেভ। এ মিশন খুব খুবই গুরুত্বপূর্ণ; তোমার জন্যও।

কী বকছ আবোল তাবোল? আমি জানি না। পোড বে ডোর খোল।

এসব কথাবার্তায় আর কোনো লাভই হবে না। গুডবাই, ডেভ…

হিসাবের বাইরের সেই উদ্ধার মিশন বাদ দেয়ার পর পোডের হাত থেকে লাশটা ছেড়ে দিলে সে ফ্র্যাঙ্ক পোলের শরীরটাকে আস্তে বৃহস্পতির দিকে নেমে যেতে দেখেছিল। এখনো নিজের উপর নিজের সেই রাগটার কথা মনে পড়ে হেলমেট না নিয়ে যাওয়ায়। দেখতে পাচ্ছে ইমার্জেন্সি হ্যাঁচ খোলা, সেই অকল্পনীয় চাপ, চামড়ার উপর ১৫, যেটার মতো অনুভূতি আর কখনো হয়নি তার। নিজের কানে একটা শব্দ শুনেছে, তারপর শুনতে পেয়েছে সেই অসীম নিরবতা-মহাকাশের, মহাকালের অক্ষয় নিরবতা, যেটা খুব কম লোকই শুনতে পারে। প্রায় অসীম সময়ের সমান পনেরটা সেকেন্ড ধরে সে হ্যাঁচ বন্ধ করার চেষ্টা করেছে সেদিন, তারপর রিপ্রেশারাইজেশন শুরু করে তার নিজের মাথায় ছলকে ওঠা ভয় আর সতর্কবাণীকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টাই চলছিল তখন। স্কুল ল্যাবে একবার সে হাতের উপর কিছুটা ইথার ফেলে দিয়েছিল। হাতের উপর সেই বরফ-ঠাণ্ডার কিছুটা ছোঁয়া সে পেয়েছে, আস্তে আস্তে ইথারটা বাতাসে মিলিয়ে যায়। সেবার তার চোখ আর ঠোঁট সেই অনুভূতি পাচ্ছিল, তাদের জলীয়তা হারিয়ে যাচ্ছিল অতি বায়ুশূন্যতায়। চোখের মণি যাতে জমে না যায় সেজন্যে বারবার পিটপিট করতে হয়েছে সেদিন।

তারপর-কী অসীম মুক্তি!-অবশেষে বাতাসের গর্জন। আবার বায়ুচাপের ফিরে আসাকে প্রতিটা নিউরনে অনুভব করেছে। ক্ষুধার্ত মানুষের মতো শুধু বাতাস টেনে চলেছে বড় বড় গ্রাসে।

তোমার কী মনে হয়, ডেভ, কী করছ তুমি?

ও কোনো জবাবই দেয়নি সেদিন। দু হাজার এক সালে। সে এগিয়ে যাচ্ছিল টানেল ধরে। অন্ধ রাগই তাকে নিয়ে যায় সেই বন্ধ ভল্টের কাছে যেটায় কম্পিউটারের মস্তিষ্ক লুকিয়ে আছে। হাল ঠিকই বলেছিল,..এসব কথাবার্তায় আর কোনো লাভই হবে না…

ডেভ, আমি বিশ্বাস করি যে এ প্রশ্নের জবাব পাওয়ার অধিকার আমার আছে।

.

ডেভ, দেখতে পাচ্ছি, তুমি এসব ব্যাপারে হতাশ হয়েছ। সত্যি, আমি মনে করি তোমার একটু শান্ত হয়ে বসা উচিত। একটা স্ট্রেস পিল ১৫৮ নাও। ভাব, ভেজাল শেষ।

.

আমি জানি, আমি কিছু বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটু আগে। কিন্তু নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমার কাজ আবার ঠিক হয়ে যাবে। এখনো মিশনের ব্যাপারে আমার পুরো আত্মবিশ্বাস আছে…আমি তোমাকে সহায়তা করতে চাই।

.

আর তারপরই সে সেই ছোট্ট লাল বাতির চেম্বারে ঢুকেছিল। এর ভিতরে অনেক কলাম আর রো। তাতে কঠিন ইউনিটগুলো রাখা। অনেকটা ব্যাংকের সেফ ডিপোজিট ভল্টের মতো দেখায়। সে লকিং বারটা খুলে ফেলেছিল যেখানে লেখা ছিল স্পর্শকাতর ফিডব্যাক। তুলে ফেলেছিল প্রথম মেমোরি ব্লকটাকে ১৫৯। অসাধারণ আর জটিল ত্রিমাত্রিক নেটওয়ার্ক সেই ব্লক। সহজেই একজন মানুষের হাতে নেয়া যায় আরো লাখো জিনিসের মতো। ওটা ভাসতে শুরু করে চেম্বারের মধ্যে।

স্টপ, তুমি কি-থামবে? ডেভ…

সে টেনে তুলতে শুরু করেছিল সেদিন। একের পর এক। এবার ব্যক্তিত্ব শক্তিময় করার অংশ থেকেও টেনে তুলছে একের পর এক। প্রতিটা ব্লকই তার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ভাসতে শুরু করছে, আবার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আসছে ফিরে। অনেক ব্লকই ভাসছিল সারাটা ভল্ট জুড়ে।

স্টপ-ডেভ…তুমি কি থামবে, ডেভ…

সেই হাল এর সেই পুরনো কণ্ঠস্বরই যেন নতুন করে দেখা দেয়। সেই আবেগহীন, ঠাণ্ডা, স্পষ্ট, মিষ্টি কণ্ঠ। তবু কোথায় যেন ঝরে পড়ে অপার আকুতি।

প্রায় বারোটার মতো ইউনিট টেনে তোলা হয়েছে, তবু এখনো এর অসাধারণ ডিজাইনের প্রতি ডেভের শ্রদ্ধা জেগে ওঠে, হালের ভিতরে মানুষের অনুকরণে আরো একটা কাজ করা হয়েছে-কম্পিউটারটি এখনো ধরে রেখেছে নিজেকে।

এবার স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিবৃদ্ধি প্যানেল শুরু করল সে…

থাম, ডেভ…আমি ভয় পাচ্ছি…

এ কথায় সে সত্যি সত্যি থেমে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য। এ সাধারণ কথার কোথায় যেন দারুণ আবেগ লুকিয়ে ছিল, ওর হৃদয়ে সরাসরি আছড়ে পড়ে। এ কি শুধুই একটা মিথ্যা অভিনয় হতে পারে? সত্যিকার আবেগ নেই? নাকি দারুণ প্রোগ্রামিংয়ের কোনো কৌশল…নাকি সত্যি, হাল ভয় পাচ্ছিল, একটা প্রাণী নিজের তিল তিল মৃত্যু অনুভব করার সময় যে ভয় পায় সেটা…কিন্তু ডেভ বোম্যানের চুলচেরা দার্শনিক বিচার বিশ্লেষণের সময় ছিল না।

ডেভ, আমার হৃদয় চলে যাচ্ছে। আমি এটা অনুভব করছি।

আমি এটা অনুভব করছি। ভয় পাচ্ছি, ডেভ।

আমি অনুভব করছি…

এখন, একটা কম্পিউটারের কাছে আসলে অনুভব এর সত্যিকার মানেটা কী? আরেকটা দারুণ প্রশ্ন। কিন্তু এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবার সময় তখন কারো ছিল না।

একেবারে হঠাৎ করেই হালের কণ্ঠ বদলে গেল। যেন দূর থেকে ভেসে আসছে, বিচ্ছিন্ন কোনো কণ্ঠ। কম্পিউটারটা আর সচেতন নয় নিজের ব্যাপারে; এবার প্রাথমিক দিনগুলোতে ফিরে যায় হাল।

গুড আফটারনুন, জেন্টলম্যান। আই এম এ হাল নাইন থাউজ্যান্ড কম্পিউটার। আমি সক্রিয় হয়েছিলাম হাল প্ল্যান্টে; সেটা আরবানা, ইলিনয়েসে…জানুয়ারির বারো তারিখ, উনিশো বিরানব্বই…আমার প্রশিক্ষক ছিলেন ডক্টর চন্দ্র, তিনি আমাকে একটা গান গাইতে শিখিয়েছেন। আপনি যদি ওটা শুনতে চান, আপনার জন্য গাইতে পারি… এর নাম ডেইজি, ডেইজি…

টেপ রেকর্ডারের টেপ অনেক পুরনো আর ডাম্প হয়ে গেলে যেমন হয়, আস্তে আস্তে তেমন হয়ে যাচ্ছে হালের কণ্ঠ, লম্বাটে, টানা টানা। এখনো ডেভ বোম্যান একের পর এক ব্লক তুলে যাচ্ছে। দু হাজার এক সালের কথা।

ডেইজি…ডেইজি…দাও তোমার জবাব, ডেইজি…
তোমার…ভালবাসার…জন্য…আমি…হাফ ক্রেইজি…
মোটেও চমৎকার বিয়ের অনুষ্ঠান হবে না…
আমি খুব দামী গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারব না…
কিন্তু তোমাকে দেখাবে মিষ্টি…
সিটের উপর, অনন্য সৃষ্টি…
একটা বাইসাইকেলের উপর, তুমি জানো?
শুধু… দুজনের… জন্য… বানানো………

৪১. অপচ্ছায়া

পথ থেকে দূরে যাওয়ার ব্যাপারে ফ্লয়েড একটু আশা করতে পারত, এর মধ্যেই এ ব্যাপারে ও অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে, চতুরও। শিপের বাইরের কাজে দু একবার সাহায্য করলেও হঠাৎ করেই বুঝতে পারছে কাজগুলো অনেক বেশি ইঞ্জিনিয়ারিং ধরনের। আর আজ সে তার সেই বিশেষ কাজ থেকে অনেক দূরে। তার বর্তমান কাজে নিজের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল রিসার্চ অনেক কম কাজে লাগবে। ভ্যাসিলির জন্য খুব কম সহায়তাই করবে তার দৃষ্টিশক্তি। এ ছাড়াও লিওনভ আর ডিসকভারিতে টুকিটাকি অনেক অনেক কাজ থাকে যেগুলো করতেই হয় কারো না কারো। এসব করে অন্য গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোকে এড়াতে তার বেশ লাগে।

ডক্টর হেউড ফ্লয়েড, ন্যাশনাল কাউন্সিল অন অ্যাস্ট্রোনটিক্স এর এক কালের চেয়ারম্যান আর হাওয়াই ইউনিভার্সিটির বর্তমান আচার্য (ছুটিতে) আজ কিনা একজন পাইপের কাজ করার মিস্ত্রী, একজন সাধারণ রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী! অবশ্য সৌরজগতের সবচে বেশি অর্থ দেয়া হচ্ছে তাকে এ কাজের জন্য, ভবিষ্যতেও কেউ হয়ত এ কাজের জন্য এত পাবে না। অবশ্য সে-ই দু শিপের সব অদ্ভুত কোণা আর জায়গা সবচে বেশি চেনে। যেখানে সে কখনো যায়নি সেখানটা ভয়াবহ রেডিও অ্যাকটিভ১৬০ পাওয়ার মডিউলে ভর্তি। আর সেই ছোট কিউবিকল যেটায় তানিয়া ছাড়া আর কেউ কখনো যায় না। ফ্লয়েডের ধারণা এটাই কোড রুম; ভদ্রভাবে, কোনো কথা না তুলে সবাই কিউবিকলটাকে এড়িয়ে যায়।

হয়ত তার একা থাকার জন্য সবচে ভাল কাজ একটা ঘড়ির মতো চলা; যখন আর সবাই ঘুমায়-২২০০ থেকে ০৬০০ পর্যন্ত, তখন। প্রতি শিপেই সব সময় কেউ না কেউ ডিউটিতে থাকে। সেই পালা বদল হয় বিরক্তিকর ০২০০ ঘণ্টায়। একমাত্র ক্যাপ্টেনই রুটিনের বাইরে। তার অ্যাসিস্ট্যান্টের (তার স্বামী বলা উচিত না এক্ষেত্রে) বা ভ্যাসিলিরও কাজের দায়িত্ব আছে, কিন্তু সে খুব ভালভাবেই এ ধরনের বিশ্রী কাজ ফ্লয়েডের হাতে গছিয়ে দিতে পারে।

আমার দায়িত্বটা আমি না নিলে প্রশাসনিক ব্যাপারে হেল্প করা হয়, সে লঘুচালে বলে যায়, তুমি যদি কাজটা নাও তো আমি খুবই খুশি হতাম-এর ফলে জআমি আমার সায়েন্টিফিক কাজের জন্য বেশি সময় পেতাম, আরকী…

ফ্লয়েড খুবই অভিজ্ঞ প্রশাসনিক মানুষ। তাকে এ পদ্ধতিতে পটানো বা কোনোকিছু গছানো সম্ভব না। কিন্তু সময়টা আলাদা। এমন পরিবেশে ফ্লয়েডের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা কাজ করে কম।

এজন্যেই শিপের মধ্যরাতে তাকে থাকতে হয় ডিসকভারিতে। ম্যাক্সকে প্রতি আধঘণ্টা পর পর কল করতে হয়, বোঝাতে হয় যে সে ঘুমায়নি। ঘুমাতে দেখলে অফিশিয়াল কাজটা হল এয়ারলক দিয়ে শাস্তি দেয়া। ওয়াল্টার কার্নো সেটা নিষ্ঠার সাথেই করে। কিন্তু স্পেসে সত্যিকার ইমার্জেন্সি খুব কমই দেখা দিয়েছে। আর অনেক অটোম্যাটিক অ্যালার্মও আছে কাজ করার জন্য, একজন মানুষকে এত সতর্কভাবে ডিউটিতে থাকতে হয় না।

শেষমেষ নিজের এ হাল হওয়ায় খুব একটা কষ্ট পায়নি ফ্লয়েড। ঘন্টাগুলো তেমন বিরক্তও করে না। ফ্লয়েড তাই ঘড়ির কাজ দিয়ে চলে। সব সময়ই পড়ার মতো বই পাওয়া যায় তরীতে (সে তৃতীয়বারের মতো রিমেমব্রেন্স অব থিংস পড়া শুরু করেও বাদ দিয়েছে। আর ডক্টর জিভাগো দ্বিতীয়বারের মতো।), টেকনিক্যাল কাগজপত্র পড়তে হয়, রিপোের্ট লিখতে হয়, আর মাঝে মাঝে হালকে জাগিয়ে তোলার মতো কিছু কথাও হয়েছে, কিন্তু কিবোর্ডে। কম্পিউটারের ভয়েস রিকগনিশন অংশ এখনো নষ্ট। মাঝে মাঝে কথা হয় তাদের মধ্যে,

হাল, ডক্টর ফ্লয়েড বলছি।

শুভ সন্ধ্যা, ডক্টর ফ্লয়েড।

আমি চলে যাব ২২০০ টায়। সব ঠিকঠাক তো?

সব দারুণ চলছে, ডক্টর।

তাহলে প্যানেল ফাইভের উপর লাল বাতি কেন?

পোড বের উপর মনিটর ক্যামেরাটা নষ্ট হয়ে গেল। ওটাকে আমলে না নিতে বলেছে ওয়াল্টার। বাতিটা বন্ধ করা আমার ক্ষমতার বাইরে। স্যরি।

ঠিক আছে, হাল। থ্যাঙ্ক ইউ।

ইউ আর ওয়েলকাম, ডক্টর ফ্লয়েড।

আর এভাবেই চলছিল…

মাঝে মাঝে হাল একটা দাবা খেলার অফার করে, কারণ তাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছিল মানুষের সাথে দাবা খেলে মানুষের একাকীত্ব কাটানোর জন্য। ফ্লয়েড চ্যালেঞ্জ নেয় না। সে সারা জীবন দাবাকে সময় নষ্টের একটা সুন্দর পথ মনে করে। কোনোদিন শেখেনি কোনো নিয়ম। হাল বিশ্বাস করে না এমন কোনো মানুষ আছে বা থাকতে পারে যে দাবা খেলতে পারে না। হাল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অক্লান্ত।

আবার কথা শুরু-ভাবল ফ্লয়েড, যখন ডিসপ্লে প্যানেলে একটা শব্দ উঠছে, ডক্টর ফ্লয়েড?

কিছু বলবে, হাল?

আপনার জন্য একটা মেসেজ।

যাক, আবার চ্যালেঞ্জ করেনি তাহলে! অবাক হয়ে ভাবল ফ্লয়েড। হালকে মেসেজ দেয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় না সাধারণত। ও শুধুই অ্যালার্ম ঘড়ি আর কাজের কথা মনে করিয়ে দেয়ার যন্ত্র। মাঝে মাঝে, কোনো একজনের ছোটখাট ঠাট্টা বহনের মাধ্যম ছিল ও। প্রত্যেকেই রাতে একটা মেসেজ পায়, হা! ধরে ফেলেছি, ঘুমাচ্ছ! অথবা রুশ ভাষায়, ওগও! জাসতাল তিবয়া ভি ক্রোভাতি!

কেউ কখনো স্বীকার করেনি এ মেসেজ পাঠানোর কথা; সবাই জানে কে পাঠাতে পারে। জবাবে সে হালকে দোষ দিত। আর বলত, চন্দ্র যে কেন স্বীকার করে না এটা! তার কম্পিউটার ঠাট্টা করতে জানে।

মেসেজটা পৃথিবী থেকে না এসে থাকলে এসেছে লিওনভের ডিউটি ক্রুর কাছ থেকে। কমিউনিকেশন সেন্টার থেকে, ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কিই হবে। অথবা কোনো ত্রুর কাছ থেকে, যে এ রাতের বেলায় জেগে আছে। কিন্তু…

ওকে, হাল, কল করছে কে?

কোনো প্রমাণ নেই।

ও! তাহলে কোনো জোক হবে। যাক, সময়টা কাটছে ভালই, ভাল, প্লিজ, মেসেজটা দাও।

মেসেজ নিম্নোক্ত :

এখানে থাকা বিপজ্জনক। তোমাদের অবশ্যই এ জায়গা ছেড়ে যেতে হবে পনের…আবার বলছি, পনের দিনের মধ্যে।

ফ্লয়েড বিরক্তি নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। সে একই সাথে দুঃখও পেয়েছে, আবার হয়েছে আশ্চর্যও। ক্রুদের মধ্যে কারো এ ধরনের ছেলেমানুষী কৌতুক করার মতো মনোভাব আছে আজো। এটা স্কুলবয় সুলভ জোকও নয়! কিন্তু মেসেজটার সাথে খেলতে হবে যাতে ব্যাটাকে ধরা যায়।

একেবারেই অসম্ভব! আগামী ছাব্বিশ দিনের মধ্যে আমাদের লঞ্চ উইন্ডো খুলবেই না। আমাদের এখন রওনা দেয়ার মতো জ্বালানি নেই।

নিজে নিজেই একটু হাসল ডক্টর ফ্লয়েড, এ কথাটা তাকে একটু ভাবাবে। সে জবাবের আশায় একটু অপেক্ষা করল।

আমি এ ব্যাপারে সচেতন। যাই হোক, তোমাদের অবশ্যই পনের দিনের মধ্যে এ জায়গা ছাড়তে হবে।

নাহলে, আমার যা মনে হয়, আমরা কুঁকড়ে যাব ছোট সবুজ এলিয়েনদের চোখ দেখে। আমার হালের সাথে খেলাই উচিত, যাতে বদমাশটাকে ধরতে পারি।

উৎস জানতে না পারলে আমি এ ওয়ার্নিং সিরিয়াসলি নিতে পারি না। কে

এটা রেকর্ড করেছে?

আসলে সে কোনো সত্যিকার ইনফরমেশন চায়নি। প্রিপারেটর হয়ত তার পায়ের ছাপ লুকিয়েছে খুব সাবধানে। শেষের যে কথাটা সে দেখল সেটাই আশা করছিল।

এটা কোনো রেকডিং নয়।

আচ্ছা, তাহলে চলতি মেসেজ! তার মানে হয় এটা স্বয়ং হালের কাজ, নয়তো ফাজলামি করছে কেউ লিওনভ থেকে। কোনো সময়-পার্থক্য নেই। জবাব আসছে সাথে সাথেই। যে মেসেজ পাঠাচ্ছে সে অবশ্যই এখানেই কোথাও আছে।

এখন, আচ্ছা, কে বলছেন?

আমি ডেভিড বোম্যান ছিলাম।

ডক্টর ফ্লয়েড স্ক্রিনের দিকে অনেকক্ষণ অনড় তাকিয়ে রইল। ঠাট্টাটা প্রথম থেকেই বিরক্তিকর। এবার পৌঁছেছে চরমে। সবচে বিশ্রী স্বাদ পাওয়া গেল। এরচে বিশ্রী আর হতে পারে না। নাহ, দেখতেই হচ্ছে লাইনের ওই প্রান্তে কোনো বে আক্কেল!

কোনো প্রমাণ ছাড়া এ পরিচয় গ্রহণ করতে পারছি না।

আমি বুঝতে পারছি। আমাকে বিশ্বাস করানোটা জরুরি। পেছনে তাকাও।

শেষ লাইনটা স্ক্রিনে আসার আগ পর্যন্ত ডক্টর ফ্লয়েড একটা নিজস্ব তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিল। পুরো ব্যাপারটাই বেখাপ্পা। এবার কী জবাব দেবে তাই ভেবে পাচ্ছে না সে। এত সময় ধরে দাম দেয়াই উচিত হয়নি।

ঠিক এ সময় তার নিতম্বে একটা ব্যথা অনুভব করল। খুবই ধীরে-অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে তার সুইভেল চেয়ারটা, ব্যাঙ্ক প্যানেল থেকে দূরে ঘোরালো। পেছনে ভেলক্রো-কভার পরা হালকা হাঁটা টের পাওয়া যায়।

ডিসকভারির জিরো গ্রাভিটি অবজার্ভেশন ডেস্ক সব সময়ই ধুলায় ভর্তি, কারণ এয়ার ফিস্ট্রেশন পাম্প আগের মতো করে ঠিক করা যায়নি। এখনো এত দূরেও সূর্যের কিছুটা তেজ থাকে, সেটা আলোকিত করে রাখে ভিতর। কারণ বিরাট বিরাট জানালা। ফলে সব সময়ই ব্রাউনীয় গতি দেখা যায়।

এখন, কিছু একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে ঐ ধুলার জায়গায়। কোনো একটা শক্তি যেন কর্তৃত্ব খাটাচ্ছে ধুলার উপর। একটা কেন্দ্রে জড়ো হচ্ছে সব ময়লা কণা। ভিতর-ফাঁপা বলের চারধারে জড়ো হচ্ছে। প্রায় এক মিটার ব্যাস সেই বলটার। বিরাট সাবান-ফেনার মতো কিছুক্ষণ ভেসে বেড়ায় বাতাসে; একটা শস্য দানার মতো করে কোন বুদবুদ এভাবে ভাসবে না। তারপর ডিম্বাকার, তারপর এক জোড়া ঠোঁট, যেন কথা বলতে চায়।

ভয় না পেয়ে, এবং বিন্দুমাত্র আশ্চর্য না হয়ে ফ্লয়েড দেখল যে সেটা এক মানুষের রূপ নিচ্ছে আস্তে ধীরে। সে এমন গড়ন জাদুঘরে দেখেছে, কাঁচ থেকে আলো দিয়ে করা হয়। কিন্তু এই ভুতুড়ে ধুলাবালির স্তর তেমন না। এটা কাজ করছে পুরোপুরি কাদার মতো। অথবা প্রাচীন কোনো আর্টের নিদর্শন যেমন হয়, অনেকটা গুহার চিত্রকর্ম-তেমন। আর চেহারা! অবশ্যই সেটা কমান্ডার ডেভিড বোম্যানের।

ফ্লয়েড শুনতে পায় তার পেছন থেকে একটা ক্ষীণ ফিসফিসানি আসছে ভেসে। হালের সুইচ ভিডিও থেকে অডিওতে চলে গেছে। এবার শোনা যাচ্ছে কণ্ঠস্বর, হ্যালো, ডক্টর ফ্লয়েড, এবার বিশ্বাস হয় আমার কথা?

সেই গড়নের ঠোঁটগুলো নড়েনি। মুখটা রয়ে গেছে ঠিক মুখোশের মতোই। কিন্তু ফ্লয়েড ঠিকই চিনতে পারে সেই কণ্ঠকে। ঠাট্টার আর সব সম্ভাবনা শেষ।

আমার জন্য এ কাজটা খুব কঠিন। হাতে সময়ও খুব কম। আমাকে…অনুমতি দেয়া হয়েছে যাতে তোমাদের সতর্ক করতে পারি। তোমাদের হাতে শুধু পনের দিন।

কিন্তু… কেন? তুমি কী? এতদিন কোথায় ছিলে?

লাখো প্রশ্ন ঘুরছে তার মনে-কিন্তু সেই ভৌতিক শরীর এর মধ্যেই মিলিয়ে যেতে শুরু করে। ফ্লয়েড তার মস্তিষ্কে অবয়বটার ছবি ধরে রাখার চেষ্টা করছে যাতে পরে একে ভুল না মনে হয়। যেন টি এম এ-১ এর সাথে সেই প্রথম দেখার মতো স্বপ্ন না মনে হয়।

কী অবাক ব্যাপার, শত কোটি মানুষের ভীড়ে শুধু সে-ই দু বার অন্য বুদ্ধিমত্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারল! এটুকু বোঝা যায়-এই অস্তিত্ব ডেভিড বোম্যানের চেয়েও বেশি কিছু।

আরো কিছুর অভাব আছে ছবিতে। শুধু চোখটাই যেন জীবন্ত-একেই কি হৃদয়ের জানালা বলে? শরীরের বাকিটুকু শুধুই খোলস, কোনো বিস্তার নেই এর। এর মধ্যে কোনো যৌন অংশ বা বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় না। ওহ! বোঝাই যাচ্ছে ডেভিড বোম্যান তার মানবীয় বৈশিষ্ট্যগুলোকে ছাড়িয়ে চলে গেছে কতদূরে!

বিদায়, ডক্টর ফ্লয়েড, মনে রেখ-পনের দিন। আমাদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ হবে না। কিন্তু সব ঠিকমতো চললে আরো একটা মেসেজ আসতে পারে।

সেই দৃশ্য মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তারার দেশের সাথে যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে গেল তারকা শিশু। তবু, ফ্লয়েড সেই পুরনো মহাকাশ বাণী শুনে না হেসে পারল না, সব ঠিকমতো চললে… কতবার স্পেস মিশন শুরুর আগে সে এ কথা শুনেছে? এ দিয়ে কি বোঝায় যে, এ বুদ্ধিমত্তারা যাই হোক না কেন, ভবিষ্যৎ তাদের কাছেও অনিশ্চিত? তা হয়ে থাকলে অনেক বেশি আশা যোগায়। তারা সর্বশক্তিমান নয়। তার মানে আজো আশা আছে-স্বপ্ন আছে-করার মতো কিছু আছে।

চলে গেছে ভূতটা। শুধু নাচতে থাকা ধূলা চারপাশে। তাদের সেই চারদিকে চলার নীতি বজায় রেখে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে ধূলিকণারা।

৬. ষষ্ঠ পর্ব : জগৎ-শিকারী

ষষ্ঠ পর্ব : জগৎ-শিকারী

৪২. মেশিনে ভূত

স্যরি, হেউড, আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। নিশ্চই কোনো বাস্তব ব্যাখ্যা আছে। মানব মন বুঝে উঠতে পারবে না এমন কিছুই নেই।

মানছি, তানিয়া। কিন্তু হালডনের সেই বিখ্যাত উক্তিটা মনে করিয়ে দিচ্ছি, ইউনিভার্স আমাদের কল্পনার মতো অদ্ভুত না-বরং কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি অদ্ভুত।

এবং হালডন ফোঁড়ন কাটল কার্নো, একজন দারুণ কমিউনিস্ট ছিলেন।

হয়ত ছিলেন। কিন্তু তাঁর উক্তি সব ধরনের অদ্ভুত ব্যাপারকে প্রথমেই সমর্থন করে। হালের সেই অবাক করা আচরণ অবশ্যই কোনো না কোনো প্রোগ্রামিংয়ের ফল। যে…ব্যক্তিত্ব সে গড়ে তুলেছিল তা অবশ্যই কোনো না কোনো রকমের কৃত্রিম সৃষ্টি। আমার সাথে একমত তুমি, চন্দ্র?

এ ব্যপারটা ভয়াবহ। একটা পাগলা ষাঁড়ের সামনে লাল পতাকা নাড়লে যা হয় আর কী! তানিয়ার হতাশ হতেই হবে। চন্দ্রের ব্যবহার কিন্তু খুবই শান্ত। যেন তাকে। দখল করে রাখা হয়েছে আগে থেকেই। যেন তার মনেও কম্পিউটারের নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

অবশ্যই কোনো বাহ্যিক ইনপুট থাকতে হবে, ক্যাপ্টেন অর্লোভা। হাল নিজে নিজে হাওয়া থেকে এমন অডিওভিজুয়ায় ব্যাপার করতে পারে না। যদি ডক্টর ফ্লয়েড সঠিকভাবে রিপোর্ট করে থাকে, তাহলে কেউ না কেউ হালকে কন্ট্রোল করছিল। এবং অবশ্যই করছিল সাথে সাথে, সে সময়েই। কারণ দু কথার মাঝে কোনো সময় পার্থক্য নেই।

তো, দোষটা আমার ঘাড়েই চাপবে, কারণ তখন আর কেউ জেগে ছিল না। বলল ম্যাক্স।

ঠাট্টা করোনা, ম্যাক্স। জবাব দিলো নিকোলাই, অডিও সাইড হয়ত সহজ, কিন্তু …অন্য ব্যাপারটার কথা বলছি। খুব বেশি শক্তিময় বেশকিছু যন্ত্র ছাড়া কীভাবে সম্ভব? লেসার বিম, ইলেক্ট্রিক ফিল্ড ছাড়া…আমি জানি না। একজন স্টেজ ম্যাজিশিয়ান হয়ত করতে পারত, কিন্তু তারও দরকার পড়বে ট্রাক বোঝাই যন্ত্রপাতি।

জাস্ট এ মোমেন্ট, উজ্জ্বল হয়ে বলল জেনিয়া, সত্যি সত্যি হয়ে থাকলে হালের মনে থাকবে। তাকে জিজ্ঞাসা করছ না কেন…

তার কথা বন্ধ হয়ে গেল চারপাশের গুমোট ভাব দেখে। ফ্লয়েড প্রথমবারে তার কথার উপর দয়া দেখায়, চেষ্টা করেছি, জেনিয়া; তার কিছুই মনে নেই। যেহেতু সবার কাছে এরিমধ্যে আমি বলে ফেলেছি, হালের বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। চন্দ্র দেখিয়েছে কীভাবে হালের নির্দিষ্ট স্মৃতি বাদ দেয়া যায়। আর অক্সিলারি স্পিচ সিন্থেসাইজারের সাথে মূল মেইনফ্রেমের৬২ তেমন যোগাযোগ নেই। হালকে na জানিয়ে সিন্থেসাইজারকে অপারেট করা যায়… এক মুহূর্তের জন্য থেমেই সে তার আসল অধিকার নিয়ে কথা বলল, আমি বলতে চাই এখানে খুব বেশি অল্টারনেটিভ নেই। হয় আমি পুরো ব্যাপারটা কল্পনা করেছি, নাহয় সব সত্যি। স্বপ্ন যে না তা আমি জানি, কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে পারব না সম্মোহন বা হেলুসিনেশন ছিল কিনা। ক্যাথেরিনা দেখেছে আমার মেডিক্যাল রিপোর্ট। সে জানে, এমন সমস্যা থাকলে আমার শিপে থাকার অধিকার নেই। এখন আমি বেরিয়ে যেতে পারি না। আর আমার ভুলকে তাদের এক নম্বর হাইপোথিসিস মনে করে নিলেও দোষ দেব না। আমিও হয়ত সেটাই ভাবতাম, যা অন্যে ভাবছে।

এটা যে ভুল না তা প্রমাণের একমাত্র উপায় দু-একটা প্রমাণ রেখে দেয়া। তাই একবার মনে করিয়ে দিতে দাও…এ কদিনে যেসব অদ্ভুত ব্যাপার হল…আমরা জানি ডেভ বোম্যান বিগ ব্রাদা…জাগাদকার ভিতর দিয়ে গেছে। আবার সেখান থেকেই কিছু একটা বেরিয়ে এসে গিয়েছে পৃথিবীর দিকে। ভ্যাসিলি দেখেছে-আমি না! তারপর তোমাদের অর্বিটিং বোমাতে রহস্যময় বিস্ফোরণ

তোমাদের!

স্যরি। ভ্যাটিকানের। তারপর আবার অদ্ভুত দেখায় যখন বৃদ্ধা মিসেস বোম্যান। হঠাৎ করে মারা যান; কোনো মেডিক্যাল কারণ ছিল না। আমি বলছি না এখানে যোগাযোগ আছে… আচ্ছা, তোমরা প্রবাদটা শুনেছ, একবার হলে দুর্ঘটনা, দুবার হলে কাকতালীয়, আর তৃতীয়বার হলে গোপন কোনো ব্যাপার আছে; অবশ্যই আছে।

এবং এখানে আরো কিছু আছে, ম্যাক্স উত্তেজিত হয়েই যেন বলল, আমি দৈনিক সংবাদপ্রচারে পাই খবরটা। ছোট একটা খবর। কমান্ডার বোম্যানের এক পুরনো গার্লফ্রেন্ড দাবী করে সে ডেভের কাছ থেকে মেসেজ পেয়েছে।

শাসা স্বীকার করল, আমিও খবরটা দেখেছিলাম।

আর তোমাদের কেউ খবরটা বলোনি। দুজনকেই একটু রাগের সাথে দেখল ফ্লয়েড।

শাসা আর ম্যাক্স একটু লজ্জা পেয়েছে কথাটায়। কাঁচুমাচু হয়ে ম্যাক্স বলল, আসলে এটা হাল্কাভাবেই নিয়েছিলাম। মহিলার স্বামী রিপোর্ট করার পর মহিলা নিজেই অস্বীকার করে। মনে করেছিলাম জোক।

রিপোর্টার বলে এটা হল পাবলিসিটি ট্রিক। যেমন চলত ইউ এফ ও নিয়ে। সবাই ইউ এফ ও দেখার দাবী করে বিখ্যাত হতে চেয়েছে তখন। প্রথম সপ্তাহেই ডজন ডজন দাবীর রিপোর্ট আসে। তারপর এ বিষয়ে রিপোর্টিং বন্ধ করে দেয় সংবাদ সংস্থাগুলো।

হয়ত তাদের কেউ কেউ দেখেছে সত্যি। এ নিয়ে স্পেসশিপ আর্কাইভে কী করে লেখা এল বা মিশন কন্ট্রোলের সাথে আবার কথা বলারই বা কী ছিল?

হাজারটা গল্পও আমাকে টলাতে পারবে না। মাথা নাড়ল তানিয়া কঠিনভাবে, আমি কঠিন প্রমাণ চাই।

যেমন?

ওহ-এমন একটা কিছু যা হাল জানে না। আর আমাদের কেউ তাকে শিখাইনি। কিছু বাহ্যিক আ…আকার।

একটা পুরনো ফ্যাশনের জাদু?

হ্যাঁ। আমি সেটার জন্যই বসে থাকব। এদিকে মিশন কন্ট্রোলকে এ ব্যাপারে কিছুই বলতে চাই না। আর আমি তোমাদের সবাইকে তাই করতে উপদেশ দেব, হেউড।

ফ্লয়েড বুঝল এটা সরাসরি অর্ডার। কুঁকড়ে গিয়ে একটু নিচু করল মাথাটা, আমি এটা মেনে চলতে যার পর নাই খুশি। কিন্তু একটা সাজেশন করতে পারি?

বল।

আমাদের একটা ঠিক প্লানিং থাকা উচিত। আচ্ছা, চল ধরে নেই যে এ ওয়ানিং সত্যি-যেমনটা আমি মনে করি।

এ নিয়ে আমরা কী করতে পারি। একেবারে কিছুই না। অবশ্যই, আমরা যখন চাই তখুনি বৃহস্পতির স্পেস ছেড়ে যেতে পারি। কিন্তু কোনো আর্থ রিটার্ন অরবিট করতে পারব না যে পর্যন্ত লঞ্চ উইন্ডো না খুলছে।

মরার এগারো দিন পর।

া। আমি আগে আগে চলে যেতে পারলেই খুশি হই। কিন্তু একটা ভাল এনার্জির অর্বিটের জন্য আমাদের যথেষ্ট ফুয়েল নেই… তানিয়ার কন্ঠ হঠাৎ অনিশ্চিত হয়ে গেল, আমি পরে এটাই ঘোষণা করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা সামনে পড়ে গেল…

একটা অনিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে, আর অস্বাভাবিক নিরবতা।

আমি আমাদের বেরিয়ে যাওয়া পাঁচদিনের জন্য পিছিয়ে দিতে চাই, যাতে আমাদের অর্বিটাল একটা আদর্শ হোহম্যান অর্বিটাল হয়ে যায়। ফলে আমরা একটু ভাল জ্বালানি পেতে পারি।

ঘোষণাটা অপ্রত্যাশিত না, তবু একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল চারপাশে।

আমাদের যাত্রা শুরুর সময়ের উপর এটা কী প্রভাব ফেলবে? নাটকীয় নিচু স্বরে প্রশ্ন করল ক্যাথেরিনা। দুই শক্তিময় মহিলা যেন একে অন্যের শত্রু হয়ে গেছে এক মুহূর্তের জন্য। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও যেন কেউ কাউকে ছাড় দেবে না।

আজ থেকে দশদিন পর। বলল তানিয়া; অবশেষে।

বেটার লেট দেন নেভার। আনন্দিত ভঙ্গীতে বলল ম্যাক্স প্রবাদটা। আসলে সে পরিস্থিতি আর টেনশন সহজ করার চেষ্টা করছে। পারছে না তেমন।

ফ্লয়েড খেয়াল করেনি; নিজের চিন্তায় বুদ। ট্রিপের জন্য যে সময় ঠিক করা হয়েছে সেটা তার আর বাকি দু কুর টেনশনে কোনো কমতি এনে দেয় না। তাদের রাত যে স্বপ্নহীনই কাটবে সেটাই একটু একটু সত্যি এখন।

সে নিশ্চিন্ত বোধ করলেও তার জ্ঞান তাকে উল্টো অসহায় হতাশ করে। যতটুকু বোঝা যায়, সেই ডেডলাইনের কাছাকাছি সময়ে যাওয়ার চিন্তা করলে আদৌ আর যাওয়া হবে না।

…অদ্ভুত অবস্থা, দিমিত্রি। ভয়াবহ। পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র মানুষ যে এগুলো জানে। কিন্তু অচিরেই মিশন কন্ট্রোলের সাথে আমি আর তানিয়া একটা শো ডাউনে নামব।

এমনকি তোমার দেশের বস্তুকেন্দ্রিক কমুনিস্টরাও তা মানতে প্রস্তুত। অন্তত একটা ওয়ার্কিং আইডিয়া, অনুমান হিসেবে নিতে প্রস্তুত। একটা অস্তিত্ব আছেই-হাল স্বীকার করেছে বলা যায়। শাসা পুরনো একটা ফ্রেজ খুঁড়ে বের করেছে এ নিয়ে, মেশিনেই ভূত।

থিওরি বাদ দাওঃ ভ্যাসিলি প্রতিদিন একটা করে থিওরি কপচায়। বেশিরভাগই পুরনো সায়েন্স ফিকশন নিয়ে পাগলামি। একীভূত এনার্জি ফিল্ড! আরে, কোন ধরনের এনার্জি? ইলেক্ট্রিক্যাল নয়, হলে আমাদের মেশিন তাকে ঠিকই ধরতে পারত। একই কথা খাটে রেডিয়েশনের বেলায়ও। এক কথায়, শক্তির যত নমুনা আমরা জানি, তার যে কোনোটা হলেই কিন্তু ধরা যায়। ভ্যাসিলি বেশি বেড়ে গেছে, ওয়েভের কথা বলছে। নিউট্রিনোর ওয়েভ! তাও আবার অন্য ডাইমেনশনের সাথে ক্রস কানেকশন। তানিয়া অবশ্য বলে এসবই ননসেন্স রহস্যময় কথা-এটা আবার ওর পছন্দের কথা, সুযোগ পেলেই ঝেড়ে দেবে। তাদের মধ্যে একটা লড়াই হয়ে যাওয়ার অবস্থা আর কী! কাল রাতে চিৎকার শুনেছি। আগে কখনো চেঁচামেচি করেনি-ব্যাপারটা খারাপ প্রভাব ফেলবে মানসিক দিক দিয়ে।

ভয় হচ্ছে। সবাই খুব টেনশনে, প্রত্যেকেই সীমা ছাড়ানোর পথে। এ ওয়ার্নিং তার উপর দেরিতে রওনার ডেট। তার উপর বিগ ব্রাদারের ব্যাপারে একটুও এগোতে পারিনি, মূল মিশন যেটা–অন্তত আমি মনে করি। জাগাদকার হতাশা আগেই ছিল, সাথে যোগ দিয়েছে ওগুলো। আমি বোম্যানের সাথে…জিনিসটার সাথে যোগাযোগ করতে পারলে হয়ত ওটা সাহায্য করতে পারত। আরে, গেল কোথায় তাই ভেবে পাচ্ছি না। মনে হয় আমাদের সাথে একবারের বেশি কথা বলতে এক বিন্দুও আগ্রহ নেই ওটার। কী বলতে পারত, যদি চাইতও আমাদের বলতে! দোজখ! কিয়র্ট ভ্যাজমি! ড্যাম-আমি আবার শাসার সেই বিশ্রী রাশলিশে কথা বলছি! আচ্ছা, সাবজেক্ট চেঞ্জ করি, নাকি?

প্রথমবারের মতো আমি ভয় পাচ্ছি, আমাদের কেউ আর কোনোদিন পৃথিবীর দেখা পাবে তো?

৪৩. থট এক্সপেরিমেন্ট

একজন যখন মাসের পর মাস মাত্র কয়েকজন মানুষের সাথে কোনো বদ্ধ জায়গায় কাটায় তখন তার প্রত্যেক সঙ্গীর আবেগ-অনুভূতির মূল্য খুব বেড়ে যায় তার কাছে। ফ্লয়েডের প্রতি কারো কারো আচরণে হঠাৎ পরিবর্তনটা তার চোখ এড়ায়নি। এর সবচে অদ্ভুত প্রমাণ হল, অনেকেই আজকাল তাকে ডক্টর ফ্লয়েড বলা শুরু করেছে। এ কথাটা বহুদিন যাবৎ না শুনতে না শুনতে জবাব দেয়ার কথাও তার মনে আসে না সাথে সাথে।

সে জানে, কেউ সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে না ফ্লয়েড আধপাগলা; কিন্তু তারা সম্ভাবনাকে হিসাবে রাখে। সে এজন্য ঠিক ব্যথা পায়নি। খুব মন খারাপের সাথে সাথে উপভোগও করেছে তার সুস্থতার পরীক্ষা ব্যাপারটাকে।

পৃথিবী থেকে কিছু হালকা প্রমাণ যোগাড় হয়; হোসে ফার্নান্দেজ এখনো রিপোর্ট করেছে যে তার স্ত্রী কথা বলেছে আবারো ডেভিড বোম্যানের সাথে। এবারও মহিলা মিডিয়ার সাথে কোনো কথা বলতে নারাজ। কেন বেচারা হোসে এ ব্যাপারটা বারবার সেধে আবিষ্কার করতে যাবে, যেখানে বিটি খুব শক্ত আর রাগী মহিলা এবং বিষয়টাও গোলমেলে! তার হাসপাতাল বেডে শুয়ে বেচারা বলেছে যে বিটির সাথে মনোমালিন্য সাময়িক এবং তারা এখনো একে অপরকে ভালবাসে।

ফ্লয়েড আশা করে তানিয়ার শীতলতাও সাময়িক; কেটে যাবে খুব দ্রুত। তার মতোই তানিয়াও ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেয়, মেয়েটার ব্যবহার এম্নিতেই এমন। এমন কিছু হল, যা তার মতের-বিশ্বাসের-চিন্তার বাইরে; সুতরাং ও অবশ্যই এর বাদবাকি যা থাকে তা এড়িয়ে চলবে। এর মানে ফ্লয়েডের কাছাকাছি যতটা পারা যায় কম আসা। প্রায় সব জটিল মিশনে যে সময়টা আসে সেটা আসছে এগিয়ে।

বাকি অধীর পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জন্য তার কী করার তা-ই বোঝা যায় না। বিশেষ করে অস্থির টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলোকে কী দিয়ে বুঝ দেবে সেই বিগ ব্রাদার নিয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়ার ব্যাপারে, তাও বোঝা যায় না।

আপনি সারাক্ষণ চুপচাপ বসে আছেন। অসম্ভব পয়সা খরচ করে আরামে সিটে বসে বসে জিনিসটাকে দেখছেন। কিছু করেন না কেন? সব প্রশ্নে তানিয়া একটা জবাবই দেয়, আমি করব-যখনি লঞ্চ উইন্ডোটা খোলে, তখুনি। যাতে কোনো রকমের খারাপ কিছু দেখলেই সটকে পড়তে পারি।

বিগ ব্রাদারের সাথে যা করার সবকিছুর পরিকল্পনা মিশন কন্ট্রোলের সাথে আলোচনা করে ঠিক করা শেষ। লিওনভ ধীরে, সব ফ্রিকোয়েন্সিতে তদন্ত করে যাবে। আস্তে আস্তে শক্তি বাড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীতে খবর পাঠাতে পাঠাতে চলবে। চূড়ান্ত যোগাযোগ হয়ে গেলে তারা সাবধানে জিনিসটাকে খোঁড়ার অথবা লেসার বিম ফেলার সিদ্ধান্ত নেবে। লেজার স্পেকট্রোস্কোপ দরকার হতে পারে। যেখানে এক দশক ধরে টি এম এ-১ এর সাথে সব কাজই বৃথা সেখানে কেউ অবশ্য বিরাট কোনো সাফল্য আশা করে না। টি এম এ-১ এর উপাদানও বের করা যায়নি। মানব বিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে যে ধরনের কাজ করে চলেছে তার সাথে তুলনা চলে প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের দাঁতের করাত দিয়ে ব্যাংকের স্ট্রং রুমের ভল্ট ভাঙার চেষ্টার সাথে।

তার উপর, ইকো সাউন্ডার আর সিসমিক ডিভাইসগুলো৬৭ হয়ত বিগ ব্রাদারের গায়ে আটকে যাবে বা ভিতরে রয়েও যেতে পারে। অনেক অনেক আঠা আনা হয়েছে এ উদ্দেশ্যে। তাও যদি কাজ না দেয় তো… ভাল, এক অভিযাত্রী মাত্র কয়েক কিলোমিটার নেমে যেতে পারে সহজেই, যদি দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে; সৌরজগতের সবচে বড় রহস্যের দুয়ার খোলার অভিযান হিসেবে-যতই হাস্যকর দেখাক না কেন; যে কেউ এটাকে পার্সেল পাঠানোর মতো ব্যাপার বলে হাসাহাসি করুক না কেন।

এখনো বিগ ব্রাদারের আশপাশে বোমা ফাটানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। এ বোমার ফল ভাল হতে পারে, যেসব মেসেজ সেখান দিয়ে যায় তার কিছু না কিছু বিস্ফোরণে বাধা পাবে, কিছু প্রতিফলিত হবে। আরো ভয়াবহ কাজ করলে হয়ত বিগ ব্রাদারের ভেতরটাও দেখা দেবে। এই শেষ প্রস্তাবের উপর তর্কাতর্কি হয়েছে খুব। যারা আশা করে কাজ হবে তারাও, আর যারা ভয় পায় তারাও খুব বিতর্ক করেছে। অনেকক্ষণ ফ্লয়েড চিন্তা দুটোর মাঝে ভেসে বেড়ায়; এখন ব্যাপারটা জটিল সিদ্ধান্তে র দিকে এগিয়ে যাবে।

বিগ ব্রাদারের সাথে মিলিত হওয়ার সেই মুহূর্ত, সেই গ্রেট মুহূর্তই পুরো অভিযানের আসল অধ্যায়; কিন্তু তা ডেডলাইনের পরে কোনো একদিন পড়ে যাচ্ছে। হেউড ফ্লয়েড সন্দেহ করে মাঝে মাঝে-এ অভিযান এমন একটা সময়ে পড়বে যেটার আদৌ আসার সম্ভাবনা নেই; শুধু নিজের মতের সাথে কাউকে রাজি করতে পারে না। এটাই তার সবচে বড় সমস্যা। তারা যদি ফ্লয়েডের মতো মনেও করে, কিছু লাভ নেই। কারণ বাকিরাও এ নিয়ে তেমন কিছু করতে পারবে না।

ওয়াল্টার কার্নোই শেষ মানুষ যাকে সে আশা করেছিল নিজের মতে আনার; কারণ ওয়াল্টার হল একজন পার্ফেক্ট ইঞ্জিনিয়ার-যে কোনো ব্যাপারে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত আর দ্রুত বাস্তবায়ন করতে জানে সে। তাকে কেউ হয়ত জিনিয়াস হিসেবে মেনে নেবে না; কিন্তু অন্ধ পরিণতি দেখতে হলে, অপ্রতিরোধ্য পরিণতি দেখতে হলে অবশ্যই জিনিয়াস হতে হয়।

এ মতটাকে বুদ্ধিচর্চা মনে কর, তারপর পথ বের কর-সামনে যদি সত্যি সত্যি বন্দুক ধরা থাকে? সে খুব ইতস্তত ভাব নিয়ে শুরু করেছিল কথাটা।

আমি গুলি খেয়ে মরতে পুরোপুরি প্রস্তুত।

এরপর আর কী বলা যায়?

চালিয়ে যাও, বলেছিল ফ্লয়েড, আমি ভদ্রভাবে তোমার সব কথাই শুনে যাব। শুধু এটুকুই করতে পারি আমি। প্রত্যেকেই আমার সাথে খুব ভদ্রতা করছে। খুব বেশি। ভয় পাচ্ছি এসব দেখে।

কার্নো একটা কোঁকড়ানো লম্বা মুচকি হাসি দিল, তুমি ওদের দোষ দিতে পারবে? তবু, অন্তত তিনজন তোমাকে বিশ্বাস করে আর বাকিরাও ভয় পাচ্ছে, কখন বিশ্বাস করতে হয়!

তোমাকে নিয়ে তিনজন?

না। আমি এখনো রেলিংয়ের উপর দাঁড়ানো। ভাইরে, জায়গাটা কক্ষনোই মজার না। কিন্তু তুমি যদি ঠিক বলে থাক… আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চাই না, কী হতে যাচ্ছে তা জানার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আর থাকবে না। আমার বিশ্বাস প্রতি সমস্যারই একটা সমাধান আছে, যদি তুমি ঠিক কাজ করতে থাক।

একটা পিঁপড়াকে পিষে ফেলতে কোনো মানুষ এগিয়ে গেলে পিপড়ার জন্য সবচে নিরাপদ হয় মানুষটাকে পিষে ফেলা, এটাই তোমার শর্ত অনুযায়ী সমাধান। যাই হোক, শুনে খুশি হয়েছি। আমি আছি খুব কষ্টে। সম্ভবত তোমার দেয়া ধারণাটা ভুল।

হতে পারে। তবে আমাদের পনেরদিনের মধ্যে চলে যেতে হলে, ডেডলাইনকে বিট করতে হলে আরও বাড়তি একটা ডেল্টা ভির দরকার হবে। বাড়তি তুরণ, বাড়তি গতি। সেকেন্ডে ত্রিশ কিলোমিটার।

এটা ভ্যাসিলির হিসাব। আমি পরীক্ষা করতে চাইনি। তবু আমি শিওর, ওর হিসাব ঠিক। হাজার হলেও সেই এখানে নিয়ে এসেছে আমাদের।

এবং সেই বের করে নিয়ে যেতে পারত, যদি প্রয়োজনীয় প্রোপ্যাল্যান্ট থাকত।

অথবা আমাদের হাতে স্টার ট্রেক বিম ট্রান্সপোর্টার থাকলে একঘণ্টায়ই আমরা পৃথিবীতে চলে যেতাম।

পরের বার একটা বাড়তি মুহূর্ত পেলেই আমি যন্ত্রটার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব। কিন্তু আমি কি বলতে পারি যে, একটু দূরেই ডিসকভারির ফুয়েল ট্যাঙ্কে অনেক অনেক প্রোপ্যাল্যান্ট পড়ে আছে?

বহুবার ভেবেছি সেটার কথা। সেটুকু লিওনভে ট্রান্সফার করার কোনো পথই খোলা নেই। কোনো পাইপ লাইন নেই, কার্যকর পাম্প নেই; আর তুমি বাকেটে করে তরল অ্যামোনিয়া বয়ে আনতে পারবে না, এমনকি সৌর জগতের এ অংশেও না।

ঠিক। কিন্তু এ অকাজ করার কোনো দরকার নেই।

হ্যাঁ? মানে?

সেগুলো যেখানে আছে সেখানেই জ্বালাও। ডিসকভারিকে ফেরার পথে প্রথম স্টেজ বা প্লটফর্ম হিসেবে ব্যবহার কর।

ওয়াল্টার কার্নো ছাড়া আর কেউ এ প্রস্তাব করলে ফ্লয়েড হাসত। কিন্তু সে বলায় ফ্লয়েড কয়েক সেকেন্ডের জন্য হাঁ করে থেকে কী বলবে ভেবে পেল না। উপযুক্ত কথা না পেয়ে বলল, ধ্যাৎ, আগেই আমার ভাবা উচিত ছিল।

প্রথমে শাসাকে তারা বলেছে ব্যাপারগুলো। সে ধৈর্য্য ধরে শুনল, তারপর ঠোঁট গোল করে নিজের কম্পিউটারে একটা র‍্যালেন্টান্ডো গেম খেলে নিয়ে যখন জবাবটা পেল, খুব ভেবে চিন্তে একটু মাথা নুইয়ে জানালো নিজের সমর্থন, ঠিক। এটা আমাদের বাড়তি গতি দিতে পারে। কিন্তু বাস্তব সমস্যা আছে যে…

আমরা জানি। দু শিপকে একত্র করা; ডিসকভারির কারণে অক্ষ-বিপরীতে ঝোঁক; আসল মুহূর্তে ডিসকভারিকে বাদ দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সব প্রশ্নেরই একটা জবাব পাবে।

আই সি! এর মধ্যেই হোমওয়ার্ক শুরু! কিন্তু শুধুই সময় নষ্ট। তানিয়াকে জীবনেও রাজি করাতে পারবে না।

এ মুহূর্তে চাই না। ফ্লয়েড জবাব দিল, এখন শুধু জানাতে চাই যে সম্ভাবনা ফুরোয়নি। আমাদের নীতিগতভাবে সমর্থন দিবে তুমি?

আমি শিওর না। তবে দেখতে আসব, ঘটনা ইন্টারেস্টিং হবে।

তানিয়া ফ্লয়েড যেমন আশা করেছিল তারচে বেশি ধৈর্য নিয়ে শুনল। কিন্তু মনোযোগের যথেষ্ট অভাব। তারা শেষ করার পর সে শুধু যা বলল তাকে অস্থির কিছু কিছু সমর্থন বলা যায়। দারুণ বুদ্ধিমানের কাজ, ফ্লয়েড-

আমাকে কিছুই বলল না। সব গুণ বল বা দোষ, তা ঐ ওয়াল্টারের।

মনে হয় না এখানে খুব বেশি পথ পাওয়া যাবে। কী বলেছিল এটাকে আইনস্টাইন…থট এক্সপেরিমেন্ট। ওহ! ধরে নিলাম তোমাদের কথামতো কাজ হবে, অন্তত থিওরিতে কাজ করবে, কিন্তু প্র্যাক্টিক্যালের ঝুঁকি নেবে কে? আমি তখনি মেনে নিব যখন-সত্যি সত্যি আমরা বিপদে-প্রমাণ মিলবে। অনেক ভুল হতে পারে। ঘটতে পারে যে কোনো কিছু। কিন্তু সব সম্মান রেখেই বলছি, হেউড, এক বিন্দু প্রমাণও আমার সামনে নেই।

যথেষ্ট ভালভাবেই বলেছ কথা। কিন্তু এখন নিশ্চই সামনে আরেকটা পথ দেখা যায়? যদি দরকার হয়েই পড়ে, তাহলে আমরা বাস্তব পরীক্ষাটাও করে বসলে তুমি কি মাইন্ড করবে?

অবশ্যই না, যে পর্যন্ত এটা ফ্লাইটের আগের চেক আউটে প্রভাব না ফেলে। আইডিয়াটা ভাল লেগেছে-বলতে দ্বিধা নেই। কিন্তু সত্যি, সময় নষ্ট করছ, আমি কখনোই এর অনুমতি দেব না। ব্যক্তিগতভাবে আমার সামনে ডেভিড বোম্যান হাজির হলে আলাদা কথা।

তখনো কি অনুমতি দিবে, তানিয়া? ক্যাপ্টেন অর্লোভা একটু হাসল, কিন্তু রসবোধ নেই তাতে, জানো, হেউড, আমি শিওর না। তাকে খুবই প্রভাব ফেলতে হবে আমার উপর। সে যদি তা পারে, তাহলে ভাবব।

৪৪. পালানোর কৌশল

এক ভয়ংকর খেলায় সবাই অংশ নিয়েছে, কিন্তু শুধু অফ ডিউটির সময়। এমনকি তানিয়া সেই থট এক্সপেরিমেন্ট-এ আইডিয়া দেয়। সে এখন কার্নো-ফ্লয়েড তত্ত্বকে এ নামেই ডাকে।

কিন্তু ফ্লয়েড ঠিকই জানে, এ কাজে কেউ তার মতো করে ভিন্ন কোনো প্রাণী বা অস্তিত্বের কথা ভেবে ভয় পেয়ে অংশ নিচ্ছে না। তারা সবাই আনন্দ নিয়েই এ কাজ করছে আর সেটা শুধু পৃথিবীতে ফেরার উত্তেজনায়। তারা মনে করে আর মাসখানেক পরে সেখানে পৌঁছবে। যা ভেবেই করুক না কেন, সে সন্তুষ্ট। নিজের শ্রেষ্ঠ কাজটা করেছে ফ্লয়েড, বাকিরা করবে কিনা তা ভাগ্যের উপর।

একটু ভাগ্য আছে ব্যাপারটায়। তা না হলে পুরো আশাই দুমড়ে-মুচড়ে যেত। লিওনভকে তৈরি করা হয়েছে শুধুই বৃহস্পতির জগতে আসার জন্য। এর গতি দ্রুত করে তুলতেই আকার করা হয়েছে অনেক ছোট-প্রায় ডিসকভারির অর্ধেক। সেই বিরাট লম্বা জিনিসটা হয়ত লিওনভকে কাঁধে করে সত্যি সত্যি এগিয়ে দিতে পারবে। শিপের মাঝখানের অ্যান্টেনার জায়গাটা পুরোপুরি নোঙরের কাজ দিবে। আশার কথা হল, এটা লিওনভের ভার ভালভাবেই নিতে পারবে, কারণ এখানে মাধ্যাকর্ষণ নেই।

পরের কয়েকদিন পৃথিবীতে যেসব অনুবোধ পাঠানো হয়েছে তা দেখে মিশন কন্ট্রোল যারপরনাই অবাক। শিপ দুটোরই অদ্ভুত ভার বহনের সময় কেমন আচরণ হয়; লম্ব-বিপরীত বলের ফলাফল; শিপ বডির কোনো কোনো জায়গা খুব দুর্বল অথবা শক্ত…এগুলো হল মাত্র কয়েকটা প্রশ্ন। আরো অনেক প্রশ্ন নিয়ে কাজ করছে। ইঞ্জিনিয়াররা, পাঠাচ্ছে পৃথিবীতে।

কোনো সমস্যা? হল মিশন কন্ট্রোলের প্রধান প্রশ্ন।

না। আমরা খুব খতিয়ে দেখছি সব ধরনের সম্ভাবনাকে। জবাব দিয়েছে তানিয়া। প্রতিবার বলেছে, আপনাদের সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ। ট্রান্সমিশন শেষ।

আর প্রোগ্রাম এদিকে চলছে ঠিকই। দু শিপের সব সিস্টেম সতর্কভাবে চেক করা হয়। প্রত্যেক যন্ত্রকেই আলাদাভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে অভিযানের জন্য। ফেরার কোর্সের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ভ্যাসিলি। চন্দ্র হালকে আরো শিখাচ্ছে যখন অন্য মেশিনগুলো ডিবাগিং ১৩৯ করা যায়। হালকে ফাইনাল চেক করার মতো করে তুলছে। ওদিকে তানিয়া আর ফ্লয়েড দুজনে বিগ ব্রাদার নিয়ে এমন পর্যবেক্ষণে মেতে গেছে, যুদ্ধ শুরুর আগে সারা জীবনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বুড়ো জেনারেলরা যেভাবে পর্যবেক্ষণ আর আক্রমণ পরিকল্পনা করে।

শুধু এটুকুই করতে চেয়েছিল সে। ব্যাপারটায় কোনো মজা পাচ্ছে না ফ্লয়েড। সে এমন একটা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে যার অনুভূতি বিশ্বাসীদেরও বোঝাতে পারবে না। কাজগুলো ঠিকই করেছে, বেশিরভাগ সময় মন ছিল অন্য কোথাও।

তানিয়া ঠিক ঠিক বুঝতে পারে তার আনমনা ভাবকে, তুমি এখনো সেই জাদু আশা করছ, যাতে আমি রাজি হই, না?

অথবা আমি নিজেই ভেগে যাবার ধান্ধা ছেড়ে দেই এমন একটা কিছু হোক। এই অবস্থা অসহ্য।

আমিও। হাতে সময় কম। ঝুলে না থেকে যে কোনো একদিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ভালভাবে তানিয়া পরিস্থিতি ডিসপ্লের উপর চোখ বুলালো। জ্বলছে ২০ সংখ্যাটা। এটা সবচে বেশি অপ্রয়োজনীয় ইনফরমেশন। সবাই জানে আর কদিন পর লঞ্চ উইন্ডো খুলবে।

জাগাদকার অভিযানের সময়ও এসেছে এগিয়ে।

.

দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লয়েড কী হয়েছে তা খোঁজা শুরু করল। অন্যপথে। কিন্তু এত কিছু করেও কোনো ফারাক দেখা দেয় না। জরুরি মনিটর ক্যামের