২০৬১ : ওডিসি থ্রি

১. জাদুর পাহাড়

 

২০৬১ : ওডিসি থ্রি – আর্থার সি ক্লাক
অনুবাদ : মাকসুদুজ্জামান খান

প্রথম প্রকাশ : জুন ২০০৫

উৎসর্গ

নিপুণকে
আমার এতো ভাল বন্ধুভাগ্য কোথা থেকে এসেছে কে জানে!

.

লেখকের কথা

২০১০: ওডিসি টু যেমন ২০০১: এ স্পেস ওডিসি র সরাসরি সিকুয়্যাল নয় তেন্নি ২০৬: ওডিসি খ্রি ও দ্বিতীয়টার সরাসরি ঝাণ্ডাবাহী নয়। বরং এই সবগুলোকে একই থিমের উপর বিস্তৃতি ধরা যায়, আর সেই অর্থে, সময়কে মাপকাঠি ধরে সিকুয়্যাল বলা যায়। কিংবা, সরলতার জন্য একই নাম ও চরিত্র-ঘটনা থাকা সত্ত্বেও যেন একই ঘটনা নয়, বরং সমান্তরাল চলতে থাকা বিভিন্ন ইউনিভার্সে একই ধারার ঘটনা।

মানুষের চাঁদে পা রাখার বছর পাঁচেক আগে, ১৯৬৪ সালে যখন স্ট্যানলি কুবরিক প্রস্তাব রাখলেন, সত্যিকার ভাল সায়েন্স ফিকশন মুভি বানাবেন, তখন ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। কিন্তু তারপর, এ ধারণায় আগের দুটি বই বিজ্ঞানে সরাসরি অনেক প্রভাব ফেলল, ফলে বলা চলে সেগুলো সার্থক সায়েন্স ফিকশন।

২০১০ খিতে উৎসাহী হই ১৯৭৯ সালের সফল ভরেজার অভিযানের পর। কিন্তু বৃহস্পতীয় অঞ্চলে ভয়েজারের অভিযানের পর আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিযান গ্যালিলিও পাঠানো হয়।

আশায় বুক বেঁধেছিলাম গ্যালিলিওকে নিয়ে, সে যাবে, বৃহস্পতির বাতাবরণে একটা প্রোব ছুঁড়ে দেবে, দু বছর খুঁটিয়ে দেখবে বৃহস্পতীয় উপগ্ৰহজগৎ। এর উৎক্ষিপ্ত হবার কথা ছিয়াশির মে মাসে। ডিসেম্বর আটাশিতে লক্ষ্যে যাবার কথা এবং উনিশশো নব্বইতে নূতন বাণীর স্রোতে ভেসে যাবার কথা আমার।

হায়, চ্যালেঞ্জটা পিছিয়ে গেল, জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে গ্যালিলিও তার ক্লিন রুমে অপেক্ষার প্রহর গুণছে। আরেকটা লঞ্চ ভেহিকলের আশায় তার বসে থাকা। হয়তো নির্ধারিত সময়ের সাত বছর পর সেটা ঠিকই জায়গামতো পৌঁছবে, তদ্দিন আমার ধৈর্য থাকলেই হল।

গ্যালিলিওকে নিয়ে তৃতীয় স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল, সেটায় চিড় ধরার আগেই আমি অপেক্ষা বন্ধ করে কলম হাতে নিলাম।

কলম্বো, শ্রীলঙ্কা,
এপ্রিল, ১৯৮৭

প্রথম পর্ব – জাদুর পাহাড়

১. বরফ জমাট বছরগুলো

সত্তুর বছরের বুড়োদের তুলনায় তোমার শরীর অনেক অনেক ভাল, মেডকমের চূড়ান্ত প্রিন্ট আউট থেকে চোখ তুলে বলল ড, গ্লাজনভ, আমিতো তোমার বয়স পঁয়ষট্টিরও কম বলতাম।

বড় খুশির খবর, ওলিগ। বিশেষত আমি যখন কাঁটায় কাঁটায় একশ তিন বছর পেরিয়ে এসেছি, তুমিতো ভাল করেই জান।

এইযে, আবার শুরু! যে কেউ ভাববে তুমি প্রফেসর রুডেঙ্কোর বইটা কখনো পড়ে দেখনি।

ডিয়ার ওল্ড ক্যাথেরিনা! ওর শততম জন্মদিনে আরেকবার সবাই একত্র হওয়ার প্ল্যান করা যেত। কিন্তু ও কখনোই এমন কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি। প বেশি বেশি সময় ব্যয় করার এ এক ঝঞ্ঝাট।

একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস। অথচ ও-ই সেই বিখ্যাত উক্তির জননী, মাধ্যাকর্ষণই বার্ধক্য টেনে আনে।

ডক্টর হেউড ফ্লয়েড চিন্তাক্লিষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে অনিন্দ্য সুন্দর গ্রহের চির পরিবর্তনীয় লম্বাটে ছবির দিকে; মাত্র ছ হাজার কিলোমিটার দূরে; যেখানে তার সবুজ শৈশব, দুর্দম তারুণ্য আর অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্মজীবন কেটেছে; সেখানেই আর কখনো সে হাঁটতে পারবে না। এ যেন ভাগ্যের আরো শক্তিময় পরিহাস, সে জীবনের সবচে বোকামিপূর্ণ দুর্ঘটনার পরও শক্ত-সমর্থ আছে অথচ তার পুরনো বন্ধুদের প্রায় সবাই চলে গেছে পরপারে।

মাত্র সপ্তাখানেক আগে সে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিল। কাছের মানুষেরা তো সব সময় সাবধান করতেই, সে নিজেও ছিল সতর্ক। তাছাড়া স্পেস ভ্রমণ এক জীবনে কম তো করেনি! এমন কিছু তার ক্ষেত্রে হতেই পারে না! কিন্তু বিধি বাম। দোতলার ব্যালকনি থেকে পড়ে গিয়ে বেশ কয়েকটা হাড় ভেঙে যায়। (হ্যাঁ, সে ছিল এক সেলিব্রিটি, খ্যাতিমান অভিযাত্রী। লিওনভ যে নতুন পৃথিবীতে ফিরে এসেছে সেই দুনিয়ায় সেও এক হিরো।) তারপর হাড়ের ভাঙনগুলো আরো জটিল হয়ে পড়ে, পাস্তুর স্পেস হসপিটালের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।– সেসব ২০১৫ সালের কথা। আর আজ… তার বিশ্বাসই হয় না, কিন্তু দেয়ালের ক্যালেন্ডারই বলছে, ২০৬১ সাল।

পৃথিবীর তুলনায় এক-ষষ্ঠাংশ মাধ্যাকর্ষণ শুধু তার বয়সের জৈব-ঘড়িকে ধীর করে দেয়নি, বরং হাসপাতালটার এ অবস্থা জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো ঘড়ির কাঁটাকে পেছনদিকে ফিরিয়ে দিল। বৃহস্পতি অভিযানের সেই হাইবারনেশন শুধু তার বয়েস বেড়ে যাওয়া রোধ করেনি, বরং উল্টোদিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। আজ এ কথা সর্বজনবিদিত, কেউ কেউ অবশ্য দ্বিমতও পোষণ করে । ফ্লয়েড সত্যি সত্যি বৃহস্পতি মিশন শেষে আরো ঝলমলে তারুণ্য ফিরে পেয়েছিল; আমার যাওয়াটা নিরাপদ? তাহলে তুমি সত্যি সত্যি মনে কর?

“এই ইউনিভার্সে কোনোকিছুই নিরাপদ নয়, হেউড। আমি যতটা জানি, তাতে শারীরিক কোনো সমস্যা নেই। তাছাড়া ইউনিভার্স এর পরিবেশ এখানকার মতোই হবে। হ্যাঁ, সেখানে হয়তো-যাকে বলে-আমাদের এই পাস্তুরের মতো মেডিক্যাল এক্সপার্টদের দেখা মেলা ভার, কিন্তু ড, মাহিন্দ্রন খুবই ভাল লোক। তার আওতার বাইরে পরিস্থিতি একবিন্দু সরে গেলেই সে সোজা তোমাকে হাইবারনেশনে পাঠিয়ে দেবে, তারপর আবার পাঠাবে আমাদের কাছে, সি ও ডি।

ফ্লয়েড এমন কোনো সুযোগ পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চাচ্ছিল, কিন্তু এখন হঠাৎই তার আনন্দের সাথে বেদনা মিলে একাকার হয়ে যায়। প্রায় অর্ধ শতাব্দীর বাসা পেছনে ফেলে কয়েক সপ্তাহ থাকতে হবে। ছেড়ে যেতে হবে গত কয়েক বছরের বন্ধুদের । আজকের ইউনিভার্স কে পরিবহনের ক্ষেত্রে তুলনা করা হয় আদ্দিকালের লিওনভ এর সাথে । (লিওনভ এখন ল্যাগ্রেন্স জাদুঘরে এক দর্শনীয় পুরোনো মহাকাশযান। মহাকাশের সন্তান লিওনভ কখনো মাটি ছোঁয়নি, এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর বাইরের জাদুঘরটার সাথে ।) হাজার তুলনা করা হোক, আজো বড় মহাকাশ অভিযানগুলোয় কিছু কিছু ঝুঁকি থাকে। বিশেষত এমন মাইলফলক কোনো অভিযান হলেতো কথাই নেই….

কিন্তু তারপরও সে হয়তো ঠিক এমন কোনো মওকাই খুঁজছিল-এই একশ তিন বছর বয়েসেও। (কিংবা মৃত প্রফেসর ক্যাথেরিনা রুডেস্কোর কমপ্লেক্স জেরিয়াট্রিক এ্যাকাউন্টিংয়ের হিসেবে তরতাজা পঁয়ষট্টি।) আজো সে বুভুক্ষের মতো চেয়ে থাকে; এতো আরামদায়ক, নির্ভেজাল জীবন সহ্য হচ্ছিল না গত এক যুগ ধরে।

সৌরজগত জুড়ে আজ হাজারো চমৎকার প্রজেক্টের ছড়াছড়ি। মঙ্গলের নব্যকরণ, মার্কারি বেসের উদ্বোধন, গ্যানিমেডে সবুজায়ন… আসলে আজ আর এমন কোনো স্বতন্ত্র প্রজেক্ট বাকী নেই যেখানে সে তার ক্ষয়িষ্ণু দেহমন নিবেদন করতে পারে। দুই শতাব্দী আগে বৈজ্ঞানিক যুগের প্রথমদিকের এক কবি তাঁর আবেগকে তুলে ধরেছিলেন নিখুঁতভাবে, ওডিসিউস / ইউলিসিসের কণ্ঠ দিয়ে:

জীবনের উপর জীবনের স্তূপ
সব ছিল একেবারে ক্ষীণকায়, এর মধ্যে একটা আমার
থেকে যায় সামান্যই, কিন্তু বেঁচে যায় প্রতি ঘণ্টা
সেই অপার নিরবতা থেকে, এরচেও বেশি কিছু,
নূতনের আমন্ত্রক: এবং এ ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র
আমাকে তিনখানা সূর্য যক্ষের ধন করে রাখতে হয়,
আর এই ধূসর আত্ম প্রত্যাশা-কাতর
পিছু ধাওয়া করে ডুবন্ত সূর্যের মতো জ্ঞানকে,
মানুষের অকিঞ্চিৎকর ক্ষমতার অনেক অনেক বাইরে।

তিনখানা সূর্য, অবশ্যই। চল্লিশেরও বেশি ছিল, ইউলিসিস হয়তো নিজেই লজ্জা পেয়ে যেত। কিন্তু পরের পদ্যটা আরো বেশি মিলে যায়:

উপসাগরের দল আমাদের ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতেও পারে,
আমরা অবশেষে সুখ-দ্বীপপুঞ্জের সন্ধান পেয়ে যেতেও পারি,
আর মহান একিলিসকে দেখ একটি বার, আমরা যাকে চিনতাম।
যদিও নেয়া হয়েছে অনেক, অপেক্ষা করছে অনেক; এবং যদিও
আজ আর অতীতের শক্তি-মদ-মত্ততা নেই আমাদের ভেতর
নিরন্তর ঘুরে চলে পৃথিবী আর স্বর্গ; আমরা যা, আমরা তা-ই;
সেই একই সমান, সতেজ বীর-হৃদয়
সময় আর ভাগ্য যাকে ক্ষীণকায় করে তুলেছে, শুধু আছে শক্ত ইচ্ছা
সংগ্রামের জন্য, অনুসন্ধানের জন্য, পাবার জন্য, পুরস্কারের জন্য নয়।

অনুসন্ধানের জন্য, পাবার জন্য… আজ সে জানে ঠিক কী খুঁজে বেড়াচ্ছিল এতোদিন তার মন। খোঁজার জন্য এবং পাবার জন্য… সে জানে খোঁজার ও পাবার স্থানটা কোথায়। আর তাকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ নেই।

এই লক্ষ্যটাকেই যে সে সব সময় সচেতনভাবে মনে রেখেছিল এমন নয় । ফ্লয়েড জানেও না ঠিক কী কারণে ব্যাপারটা এত অগ্রাধিকার পাচ্ছে। সে হয়তো মানবজাতির দিকে আবারো আসতে থাকা জ্বরের প্রতিষেধক মনে করে নিজেকে দ্বিতীয় বারের মতো!-কিন্তু তার ভুলও হয়ে থাকতে পারে। কিংবা ইউনিভার্স এর অভিযাত্রীদের শর্ট লিস্টে তার নাম রাখার অতল প্রলোভন তার মনের গহীনে লুকিয়ে ছিল, সেটাই জেগে উঠছে।

আরো একটা সম্ভাবনা আছে, এই এতো বছর পরেও, ১৯৮৫/৮৬ সালের দ্বন্দ্বে মানুষের মনোভাবের কথাটা ভোলা যায়নি। এবার একটা সুযোগ এসেছে-তার জীবনের শেষ সুযোগ-আর মানুষের জন্য প্রথম বারের মতো-যার মাধ্যমে আগের সব অসন্তুষ্টি কাটিয়ে ওঠা যায় ।

সেই বিংশ শতাব্দীতে শুধু ওড়াউড়িই সার ছিল। এরচে বেশি কিছু করা মুশকিল। কিন্তু আজ সত্যি সত্যি ল্যান্ড করা সম্ভব। পথ দেখিয়েছিল আর্মস্ট্রং আর। অলড্রিনের চাঁদের বুকে প্রথম পদক্ষেপ।

ডক্টর হেউড ফ্লয়েড, ২০০১ সালের চাঁদের মনোলিথ বিষয়ক সিদ্ধান্তদাতা, ২০০১ সালের বৃহস্পতি-শনি মিশনের সর্বেসর্বা, ২০১০-১৫ সালের বৃহস্পতি অভিযানের অংশগ্রহণকারী তার সমস্ত কল্পনাকে উড়তে দিল। অতল মহাকাশ থেকে উঁকি দেয়া সেই পরিদর্শকের চারপাশে উড়তে দিল। সেই অতিথি নিজের গতি আরো আরো বাড়িয়ে নিচ্ছে, প্রদক্ষিণ করবে সূর্যকে। আর পৃথিবী ও শুক্রের অর্বিটের মাঝামাঝি এখনো অসম্পূর্ণ স্পেস লাইনার ইউনিভার্স তার প্রথম উড্ডয়নেই মিলিত হবে স-ব ধূমকেতুর রাজার সাথে।

সম্মিলনের জায়গাটা কাঁটায় কাঁটায় ঠিক করা হয়নি, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত ঠিকই ঠিক করা হয়ে গেছে।

হ্যালি-এইতো, আসছি আমি…, ফিসফিস করে ওঠে হেউড ফ্লয়েড।

২. প্রথম দর্শন

এমন কোনো কথা নেই- কেউ পৃথিবী ছাড়লেই যে পরিপূর্ণ স্বর্গসুধা পানের উদ্দেশ্যেই শুধু যাবে। আর আকাশ থেকে দেখা আকাশ ও পৃথিবীর যে কোনো উঁচু পর্বতশৃঙ্গ থেকে মেঘহীন রাতে দেখা আকাশের মধ্যেও একচুল ফারাক নেই। আসলে আকাশ এর চিত্রপটে তেমন কোনো বদল দেখাই যায় না। এমিতে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে তারার আলো আরো উজ্জ্বল দেখায়, সাথে নক্ষত্রলোককে আরো উদ্দীপিত লাগে, কিন্তু খালি চোখে স্পেস থেকে দেখা আকাশ আর নিচ থেকে দেখা আকাশের মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ পাওয়া যাবে না। এই অবজার্ভেশন উইন্ডো তো এক লহমায় তুলে আনতে পারে না আধখানা পৃথিবীকেও।

হেউড ফ্লয়েড সৃষ্টিজগতের উপর যতটা দৃষ্টি দিতে পারতো তা নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল, বিশেষত তার আবাসিক এলাকা যখন ধীরে ঘূর্ণায়মান হসপিটালের আঁধার অঞ্চলে মুখ লুকায়। তখন তার চতুষ্কোণ দৃষ্টি জুড়ে থাকে তারকালোক, গ্রহ জগৎ, নেবুলা আর সব… সব কিছুকে স্নান করে দিয়ে নূতন নক্ষত্র লুসিফারের ক্ষীণ আলোর ঝলক। লুসিফার, সূর্যের নবীন প্রতিদ্বন্দ্বী।

কৃত্রিম রাত শুরুর মিনিট দশেক আগেই সে সাধারণত কেবিনের সবগুলো আলো নিভিয়ে দেয়। লাল ইমার্জেন্সি লাইটটাও বাদ পড়ে না। নিকষ কালো অন্ধকার চাই তার। স্পেস ইঞ্জিনিয়ারদের তুলনায় একটু দেরিতেই বলতে হয়, সেও খোলা চোখের মহাকাশবিদ্যার অপার্থিব আনন্দের একটু সন্ধান পেয়েছে। আজ সত্যি সত্যি সে প্রায়ই নক্ষত্র-বিবর্তনের সন্ধান পায়, নগ্ন চোখে। এমনকি এ প্রক্রিয়ার একটু আলোকছটা ছিটকে এলেই সে ধরতে পারবে।

সেই মে মাসের প্রতিটি রাতেই ফ্লয়েড ধূমকেতুটার অবস্থান দেখে নিয়েছে স্টার চার্টে। তখন সেটা মঙ্গল-এলাকা পেরুচ্ছিল। একজোড়া ভাল দূরবীণেই অবশ্য হ্যালিকে পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু সে কিছুতেই সেসব জিনিস ছুঁয়ে দেখবে না। এ যেন এক খেলা। আর কদুর তার বুড়োটে চোখ সয়ে যেতে পারে তা দেখার চ্যালেঞ্জ। অবশ্য এরই মধ্যে মাউনা কিয়ার দুজন অ্যাস্ট্রোনোমার খালি চোখে ধূমকেতুটাকে দেখার দাবী করে বসেছে। তাদের কথায় কেউ কান দেয়নি। আর পাস্তুরের অন্য বাসিন্দাদের দাবীকে তো অবশ্য মেনে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

কিন্তু আজ রাতে তার ভাগ্য হয়তো প্রসন্ন। গামা থেকে এফসাইলন পর্যন্ত সে যেন একটা রেখার দেখা পাচ্ছে। এর উপর বসানো কল্পিত কোনো এক ত্রিভুজের দিকে পড়ে আছে দৃষ্টি। যেন একটু চেষ্টা করলেই চোখের মামুলী দৃষ্টি দিয়ে পুরো সৌর জগৎ তেড়ে-ফুঁড়ে বেরুতে পারবে।

এবং এইতো সেই আকাক্ষার বস্তু!-সেই প্রথমবার দেখার অভিজ্ঞতার মতোই। ছিয়াত্তর বছর আগে! অস্পষ্ট, কিন্তু ভুল হবার জো নেই। অবশ্য সে যদি কাঁটায় কাঁটায় খোঁজার জায়গাটা না চিনত তাহলে দেখলেও বোঝার নিশ্চয়তা থাকত না। যেন দূরের কোনো নেবুলা।

খোলা চোখে জিনিসটা নিখুঁত গোল, ধোয়াটে অবয়ব। এতোদূর থেকে বিখ্যাত লেজের দেখা পাওয়া দুষ্কর। চারধারে ভেসে চলা ছোট্ট ফ্লোটিলা প্রোবগুলো একে মাসের পর মাস ধরে পাহারা দিচ্ছে। এরই মধ্যে এর গায়ের একটু বিস্ফোরণের ছোঁয়া আবিস্কৃত। আর মাত্র কিছুদিন পরই সৌকর্যময় পুচ্ছ আলোক-ধোয়ার বন্যা বইয়ে দেবে, নির্দেশ করবে এর স্রষ্টা-সূর্যের ঠিক বিপরীত দিক।

আর সবার মতো হেউড ফ্লয়েডও সেই চিরাচরিত হিমশীতল, আঁধার… না পুরোপুরি কালো গড়নটাকে সৌরজগতের ভিতরদিকে প্রবেশ করতে দেখেছে। শত্রুর বছরের শীতলতা কাটিয়ে সেই পানির জটিল মিশ্রণ, অ্যামোনিয়া আর অন্য বরফের স্তূপ ফুটতে শুরু করে। এ এক উড়ন্ত পাহাড়, আকার আকৃতিতে কিম্ভূত, ম্যানহাটান আইল্যান্ডের মতো বিশাল। হ্যালির ধূমকেতুকে সূর্য একটা ফুটোওয়ালা স্টিম বয়লারের মতো আকৃতি দিচ্ছে। জলীয় বাষ্পের স্কুণের সাথে মিশে আছে ধুলার আস্তর। আর আধডজন জ্বালামুখ থেকে অবিরাম বেরিয়ে আসছে রাসায়নিক ধোঁয়াশা। স্থানীয় সূর্যাস্তের ঘণ্টা দুয়েক পরেই সবচে বড়টাও উদ্গীরণ শুরু করে। সেটার আকার বিশাল একটা ফুটবল মাঠের সমান। ঠিক যেন কোনো বিশাল বাষ্প-উদগীরক।

এরই মধ্যে সেই জ্বালামুখের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকার ফ্যান্টাসিতে ভুগছে সে, যেন অপেক্ষা করছে সূর্যোদয়ের জন্য। চারপাশে পরিচিত পরিবেশ, পরিবেশটাও দেখেছে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে। অবশ্য হ্যালির বুকে মহাকাশতরী নোঙর ফেললেও ক্রুরা বাইরে যেতে আদৌ রাজী হবে না।

সেই ছোট প্রিন্ট আউটে এ কাজটাকে শক্তভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

আমাকে থামানো তাদের জন্য বড় ঝামেলার ব্যাপার হবে, ভাবল হেউড ফ্লয়েড। আমি নিশ্চিত আজো একটা স্পেসস্যুট ভালমতো ব্যবহার করতে জানি। আর যদি কোনো ভুল হয়েই যায় তো…

একবার তাজমহল দেখতে দেখতে কোনো এক পর্যটক বলেছিল: এমন একটা স্মৃতিসৌধের জন্য আমি কালকেই মরে যেতে রাজি।

সে মহানন্দে তাজমহলের জায়গায় হ্যালি শব্দটা বসিয়ে দিতে চায়।

৩. পুনঃপ্রবেশ

এমন ভয়াল দুর্ঘটনার কথা হিসেব থেকে বাদ দিলেও তার পৃথিবীতে পা রাখা চাট্টিখানি কথা নয়।

প্রথম চমক এসেছিল জেগে ওঠার পরপরই। ড. রুডেস্কো লম্বা ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। তার পাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল ওয়াল্টার কার্নো। সেই আধঘুমেও ফ্লয়েড বুঝতে পারে কিছু একটা গড়বড় আছে। তারা যেন ফ্লয়েডের জেগে ওঠায় খুব একটা খুশি নয়। সে আগে পুরোপুরি জেগে ওঠে; তারপর জানতে পারে ড. চন্দ্র আর নেই তাদের সাথে।

মঙ্গলের পেছনে কোনো এক জায়গায় তার নিষ্প্রাণ দেহ ভেসে বেরিয়ে যায়। অনেক অনেক আগেই সে লীন হয়ে গেছে সূর্যের সাথে।

কেউ জানে না তার মৃত্যুর কারণ। ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি তার ধারণার কথা বলল, একেবারে অবৈজ্ঞানিক কারণ হলেও সার্জন-কমান্ডার ক্যাথেরিনা রুডেঙ্কা কথাটা ফেলে দিতে পারেনি।

সে হালকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারেনি।

ওয়াল্টার কার্নো আরেকটা কারণ বলেছিল সবাইকে টপকে গিয়ে।

কে জানে হাল ব্যাপারটাকে কীভাবে নেবে! সেও বিমর্ষ, কোনো…একটা কিছু আমাদের স-ব দেখছে। আজ বা কাল, সে ঠিকই জানতে পারবে।

আর আজ কার্নোও অন্য সবার সাথে চলে গেল; আছে শুধু ছোট্ট জেনিয়া। গত বিশ বছর ধরে তার দেখা নেই। শুধু প্রতি ক্রিসমাসে আজো তার সুন্দর কার্ড ভেসে আসে। সর্বশেষটা তার ডেস্কে পিন দিয়ে সাঁটা আছে, সযত্নে।

কার্ডে আঁকা আছে রাশিয়ান শীতের নিদারুণ বরফ, তার সাথে অতি ক্ষুধার্ত নেকড়ের দল।

পঁয়তাল্লিশ বছর! যেন এই গতকালই লিওনভ পৃথিবীর অর্বিটে ফিরে এসেছিল। পৃথিবীজুড়ে স্বাগত জানানোর জোয়ার যেমন ছিল তেমনই ছিল একটু শীতলতা। লিওনভের বৃহস্পতি মিশন ছিল অনেকাংশে সফল, দামী, সেইসাথে সেই মিশনই আবার একটা প্যানডোরার বাক্স খুলে দিয়ে এসেছে, যেন পৃথিবীর মানুষের জন্য খাল কেটে টেনে এনেছে মস্ত নরখাদক কুমীরকে। কিন্তু সেই বাক্সের রহস্য আজো পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।

টাইকো মনোলিথ বা টাইকো জ্বালামুখের চৌম্বকীয় বিশৃঙ্খলা আকারে একশিলাস্তম্ভটা চাঁদের বুকে আবিস্কৃত হবার পরই সব বিশৃঙ্খলার শুরু। তখন হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন সেটার অস্তিত্বের কথা জানতো। তার মধ্যে অনেকেই নিশ্চিত ছিল না; মানে রাশিয়ানরা তো শুধু গোয়েন্দা রিপোর্ট পেয়েছিল, ফ্লয়েডের মতো ছুঁয়ে দেখেনি। সময় এগিয়ে গেল, ব্যর্থ হল ডিসকভারির মিশন; পৃথিবীর মানুষ জানল, চার মিলিয়ন বছর আগে অপার্থিব বুদ্ধিমত্তা আমাদের ছুঁয়ে গিয়েছিল। শুধু চাঁদের বুকে ফেলে গিয়েছিল কলিংবেলটাকে। খবরটা স্বস্তিদায়ক হলেও সারপ্রাইজ ছিল না মোটেও। কত দশক ধরে মানুষ এমন একটা খবরের আশায় দিন গুনেছে!

এসবই মানব জাতির আগমনের অনেক অনেক আগের কথা। ডিসকভারির চারধারে আরো কত অব্যাখ্যাত ঘটনা যে ঘটে গেল তারপর? শুধু কম্পিউটারের বিগড়ে যাবার ঘটনা ছাড়া আর কিছুরই প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু দার্শনিক তত্ত্বে কোনো বিচ্যুতি আসেনি, দেখা পাবার কথা গোনায় ধরলে, ত্রিশ-চল্লিশ লাখ বছরে সেই আগন্তুকরা হারিয়ে গেছে এমন মনে করলে, মানুষ তখনো সৃষ্টিজগতের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী।

কিন্তু আজ আর সে কথাও সত্যি নয়, মাত্র এক আলোক মিনিট দূরে, ব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় ধূলিকণার চেয়েও কম দূরত্বে এমন এক বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটেছে যে বা যারা আস্ত নক্ষত্রের জন্ম দিতে পারে। যারা নিজেদের সামান্য এক ইচ্ছা পূরণের জন্য পৃথিবীর চেয়ে হাজার গুণ বড় একটা গ্রহকে নির্দ্বিধায় ধ্বংস করতে পারে। তারা মানুষের ব্যাপারে যে পুরোপুরি সচেতন তার প্রমাণস্বরূপ ডিসকভারির মাধ্যমে খবরও পাঠিয়েছে; তারপরই ধ্বংস হয়ে যায় বৃহস্পতি, জন্ম নেয় লুসিফার, শুধু মানুষের মনে বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁটে দেয় সেই মেসেজ

এই স-ব দুনিয়া তোমাদের –শুধু ইউরোপা ছাড়া।
সেখানে নামার কোনো চেষ্টা করো না।

সেই জ্বলজ্বলে নক্ষত্র লুসিফার পৃথিবীর বুকের রাত কেড়ে নিল বছরে কয়েক মাসের জন্য, যখন সে সূর্যকে অতিক্রম করে। নিয়ে এল আশা, কেড়ে নিল অমানিশা, বয়ে আনল ভয়। ভয়-মানুষ চিরদিনই অজানাকে ভয় পায়। আশা-কারণ বিশ্বপ্রকৃতি বদলে যাচ্ছে, সভ্যতার জন্মদাত্রী আলোক আজ সুলভ, পৃথিবীর রাজনৈতিক পট যাচ্ছে বদলে এবং মানুষ চিরদিনই অজানাকে দেখে আশায় বুক বাঁধে।

সব সময় বলা হতো, পুরো মানবজাতি এক হবে সেদিনই যেদিন বাইরের জগৎ থেকে কোনো হুমকি আসবে। কারণ মানুষ সব সময় একতাবদ্ধ হয় হুমকির বিরুদ্ধে আর হুমকিস্বরূপ মানুষের অন্যপক্ষ শুধু মানুষই অবশিষ্ট ছিল। কেউ জানে না লুসিফার হুমকি ছিল কিনা, জানে শুধু এ এক চ্যালেঞ্জ। এই যথেষ্ট।

হেউড ফ্লয়েড পাস্তুরে বসে বসে পৃথিবীর রাজনৈতিক পট বদলে যাওয়া দেখেছে, যেন সে এক অ্যালিয়েন দর্শক। প্রথমদিকে তার আর স্পেসে থাকার সাধ ছিল না, একবার সুস্থ হলেই চলে যেত। কিন্তু তার ডাক্তারেরা অপ্রয়োজনীয় রকমের লম্বা সময় নিয়ে ফেলল।

পরের বছরগুলোর উত্তেজনা দেখে সে ঠিক ঠিক বুঝতে পারে ঠিক কী জন্য তার হাড়গুলো ফিরে যেতে চাচ্ছে না।

সে আর পৃথিবীতে ফিরে যেতে চায়নি। নিচের সেই সাদাটে-নীলচে গোলকে তার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আজ সে বুঝতে পারে কেন চন্দ্রর বাঁচার কোনো ইচ্ছা বাকি ছিল না।

সেই ইউরোপের ফ্লাইটে তার প্রথম স্ত্রীর সাথে না যাওয়াটাই বদলে দিল সবকিছু। ম্যারিয়ন আজ অন্য জীবনের অংশ, তার দুই কন্যা নিজের নিজের পরিবারে নবাগতদের নিয়ে ব্যস্ত।

কিন্তু সে ক্যারোলিনকে নিজের কারণেই হারিয়েছে, কিন্তু কিছু করার ছিল না। সে কোনোদিনই বোঝেনি। (ফ্লয়েড নিজে কি বুঝেছে?) কেন সে নিজের এতো যত্নে গড়া ঘর ছেড়ে, কয়েক বছরের জন্য সূর্য ছেড়ে এতোদূরে গেল?

মিশনের অর্ধেকটা পেরুনোর পরও সে জানতো আর কোনো উপায় নেই, ক্যারোলিনকে পাওয়া যাবে না। শুধু আশা ছিল ক্রিস তার বাবাকে বুঝবে। কিন্তু তার ছোট্ট ছেলে ততদিনে বাবা ছাড়া অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে বসেছে। ফিরে এসে ফ্লয়েড দেখে তার স্থান অন্য একজন দখল করে বসে আছে, ক্রিসের মনও। ভেবেছিল কোনোদিন এত সব দুঃখ কাটিয়ে উঠতে পারবে না। ঠিক ঠিক পেরেছে, এতোগুলো বছর মুখের কথা নয়। তবে পৃথিবীও তাকে আর ঠিক গ্রহণ করেনি। শরীরও সয়নি। ফিরে যেতে হয়েছে পাস্তুরে, পৃথিবীর কত কাছে! কিন্তু পৃথিবীতে নয়। পৃথিবীর বুকে মানুষ আজ এক শতাব্দী ধরেই অবলীলায় দশ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়, অনেকে প্রতিদিন। সে মাত্র ছ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে সবুজ গ্রহটা দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না।

সে অবশ্য পরিত্যক্ত হয়নি-বরং উল্টো। এমনকি চিকিৎসার সময়ও রিপোর্ট করে যাচ্ছিল, বলছিল হাজারো কমিশনের খবর, ইন্টারভিউ দিচ্ছিল দেদার। সে ছিল এক বিখ্যাত লোক, উপভোগ করত ব্যাপারটাকে। তার নিজের দুঃখময় দুনিয়া থেকে একটু সরে আসতে, একটু স্বস্তি পেতে এই ব্যাপারগুলো অনেক সহায়তা করত।

প্রথম পূর্ণ দশক, ২০২০ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময়টা এত দ্রুত কেটে গেছে যে এখন সেদিকে তাকালে কেমন যেন মনে হয়। কোনো চিরাচরিত সংকট ছিল না, বড় কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি, শুধু সেই ক্যালিফোর্নিয়া ভূমিকম্প। কী প্রতাপ ছিল সেটার! পরে স্ক্রিনে দেখেছিল দৃশ্যগুলো। বিশাল মহানগরী মিশে যায় ধুলার সাথে । সেই মহাদানব তার ঐশ্বরিক চোখকে এক-দুজন মানুষের উপর নিবদ্ধ করেনি বলেই অনেক অনেক মানুষ বেঁচে যায় । আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যামেরাগুলোই মূল দৃশ্য তুলে আনতে পেরেছিল।

সেই দশকে ভৌগোলিক টেকটোনিক প্লেটের সাথে সাথে রাজনৈতিক প্লেটগুলোও বারংবার রূপ বদলায়। তার দৃষ্টি যেন সময়কে কেটে পৃথিবীর গোড়ার দিকে চলে যাচ্ছে, একমাত্র মহাদেশ প্যানগায়ার দিকে। তারপর কত শত সহস্রাব্দের ভাঙাগড়ায় এতোগুলো মহাদেশের সৃজন চলতে থাকে। মানুষের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। কত অগুনতি গোত্র, উপগোত্র, জাতি, উপজাতি! পুরনো সাংস্কৃতিকতা আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে আসে; ভাষার লক্ষ-কোটি উচ্চারণ, আঞ্চলিকতা ঝরে পড়ে। তারপর মানুষ আস্তে আস্তে এক হয়ে যায়। তবু এই এক হওয়ার প্রক্রিয়াটা মাত্র দু-চার শতাব্দীর অবদান।

ঘটনাটায় অনুঘটকরূপে যোগ দেয় মহাজাগতিক সেইসব ঘটনা, লুসিফার স্বয়ং। আর যে পরিবর্তন আরো কয়েক শতাব্দীতে হবার কথা ছিল তা ঘটে যায় খুব দ্রুত।

জেট যুগ বৈশ্বিক ভ্রমণের দ্বার খুলে দিয়েছিল। প্রায় একই সাথে স্যাটেলাইট আর ফাইবার অপটিক্স যোগাযোগের পথকে আরো সহজ করে তোলে। দু হাজার সালের একত্রিশে ডিসেম্বর থেকে আর কোনো লঙ ডিসটেন্স কল বলতে কিছু নেই পৃথিবীতে। ফাইবার অপটিক্সের বদৌলতে পৃথিবীর সবখানে কলরেট সমান। আর, মানবজাতি তৃতীয় সহস্রাব্দকে বরণ করে, দু হাজার এক সাল অবাক চোখে দেখে পৃথিবীতে পুরো মানবজাতি একটি মাত্র পরিবার।

আর সব পরিবারের মতো এটাতেও অশান্তি ছিল টুকটাক। কিন্তু এর সেসব খুনসুটি আর আগের মতো পুরো গ্রহটাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় না। দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ নিউক্লিয়ার যুদ্ধে মানুষ পারমাণবিক বোমার স্বরূপ আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করে। আস্তে আস্তে শান্তির দিকে চোখ ফেরে সবার। তেলের উপর চাপ কমাতে পারমাণবিক গবেষণাকে শান্তি-শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এতো সহজে এতোকিছু হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল না। তিন দানব-আমেরিকা, রাশিয়া আর চীন বলিষ্ঠ ভূমিকা নেয়।

এক শতাব্দী আগে কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রের অচিন্তনীয় যুদ্ধের মতোই ২০২০ ২০৩০ এর বড় যুদ্ধটা ছিল অকল্পনীয়। তারপর তারা শান্তির কাজে লাগানো শুরু করে শক্তিকে। দেখতে পায় এখানেও কাজ করছে উত্তেজনা…

কোন আদর্শবাদী লোক পিস হোস্টেজ প্রকল্পের কর্মসূচী হাতে নেয়নি। হঠাই দেখা গেল আমেরিকায় কয়েক লাখ সোভিয়েত লোকের আনাগোনা চলছে আর রাশিয়ায় আধ মিলিয়ন আমেরিকান সব সময় থাকে। এইসব মানুষ থেকেও শান্তির পণবন্দী চিন্তার একটু সূত্রপাত হয়। তাদের পরিজন আছে অনেক অনেক, দু দেশেই। সম্পদ আর রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে কামড়াকামড়িতে তারা উপাদান হতে চায়নি।

আর কোনো দেশ চাইলেও লম্বা কোনো যুদ্ধ বাধানোর উপায় ছিল না। কারণ যুগটা হল স্বচ্ছতার। স্বচ্ছতার যুগের শুরু ১৯৯০ এর পরপরই। সংবাদ সংস্থাগুলো নিজেদের স্যাটেলাইট ছাড়ে সে সময়টায়। তাতে ছিল হাই রেজুলেশন ক্যামেরা, সামরিক স্থাপনাও বাদ পড়ত না সেসবের করাল দৃষ্টি থেকে। পেন্টাগন আর ক্রেমলিন ভয়ংকর, তারচেও বেশি ভয়াল এসোসিয়েটেড প্রেস, রয়টার্স আর চব্বিশ ঘণ্টা-জাগ্রত নিউজ সার্ভিস এর অর্বিটাল ক্যামেরাগুলো। তথ্য লুকিয়ে রাখার যুগ তখন থেকেই তিরোহিত হয়।

২০৬০ সালের মধ্যে যে সারা পৃথিবীকে একেবারে নিরস্ত্র করা গেছে তা নয়, কিন্তু অবশিষ্ট মাত্র পঞ্চাশটা পারমাণবিক বোমাকে আন্তর্জাতিক নজরদারীর আওতায় আনা হয়। সেই জনপ্রিয় দানব অষ্টম এডওয়ার্ড প্রথমবারের মতো পৃথিবীর গৃহপতি নির্বাচিত হবার সময় তেমন কোনো বাদানুবাদ ওঠেনি। মাত্র কয়েকটা স্টেট সমর্থন দেয়নি, আর তারা তেমন শক্তিশালীও ছিল না। আর্জেন্টিনা-ব্রিটেন বিবাদের মতো ব্যাপারগুলো আস্তে আস্তে কেটে যায়।

এরপর বিশ্ব অর্থনীতিতে এলো প্রবল প্রতাপশালী জোয়ার। সেটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিকরও ছিল। অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান ঝরে গেল, ডুবল বড়গুলোও।

এতদিনে নূতন আরো কিছু বানানোর সময় এসেছে। মানবজাতি যুদ্ধের সমান অন্য রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়ায় মানুষ হাজার সহস্রাব্দ এগিয়ে যাবার কথা ভাবছে, এত সামনে এগুনোর কথা ভাবছে আজকাল, যেখানে যাবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে ভয় পেত আগের মানুষ।

৪. উত্তাল ঝড়

জন্মের সময় উইলিয়াম সুংকে বিশ্বের সবচে ব্যয়বহুল শিশু বলা হয়। দাবীটা দু বছর টিকে ছিল। তার বোনই রেকর্ড ভেঙে বসে। এরপর পারিবারিক আইন উঠিয়ে দেয়া হলে আর একে চ্যালেঞ্জ করার মতো কিছু বাকী থাকল না।

তাদের বাবা, কিংবদন্তীতুল্য স্যার লরেন্সের জন্ম চীনের সেই বিখ্যাত এক সন্তান, এক পরিবার নীতির সময়ে। প্রজন্মটা ছিল মনোবিদ আর সমাজবিদদের হাজারো কাজের জন্য একেবারে উপযুক্ত। সেকালে ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। কোনো ভাইবোন নেই, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কোনো চাচা-ফুপুও নেই… মানব ইতিহাসে এ এক অনন্য ঘটনা। মনস্তত্ত্ব আর সমাজবিদ্যার প্রয়োগকাল বলা যায় তাই সে সময়টাকে।

২২ সালে তার দ্বিতীয় সন্তান জন্মের সময় লাইসেন্সিং সিস্টেমটি আইনে পরিণত হয়েছে। আপনি যত খুশি সন্তান নিতে পারেন, শুধু পর্যাপ্ত ফি টা পরিশোধ করতে হবে। (পুরনো কমিউনিস্টরাই যে এর পথে সমস্ত দৃঢ়তা একা একা দেখিয়েছিল এমনটা হয়নি। বরং তাদের সমর্থন জানিয়েছে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক।)

প্রথম দু সন্তানের কোনো ফি ছিল না। তৃতীয় সন্তানের জন্য দিতে হত এক মিলিয়ন সোল, চতুর্থজনের জন্য দুই, পঞ্চম চার এবং এভাবে দ্বিগুণ করে বাকী সবার হিসাব ধরা হবে। মজার ব্যাপার হল পুঁজিবাদী সমাজে এমিতেও তিন সন্তানের প্রতি কারো বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

তরুণ মি. সুং (অনেক বছর আগের কথা অবশ্যই, কিং অ্যাওয়ার্ড তাকে তার কে বি ই দেয়ার আগে) মনে মনে কোনো ফন্দি এঁটেছে বলে মনে হতো না; তার পঞ্চম সন্তান জন্মের সময়ও সে এক নিতান্ত গোবেচারা কোটিপতি। কিন্তু তখন বয়স মাত্র চল্লিশ। তারপর হংকং হাতবদলে তার যতটা অৰ্থক্ষয় হওয়ার কথা ছিল ততোটা না হওয়ায় দেখতে পেল হাতে মোটামুটি কিছু টাকাকড়ি দেখা যাচ্ছে।

সুতরাং, এগিয়ে চলল ঐতিহ্য… কিন্তু স্যার লরেন্স সম্পর্কে আরো অনেক গল্পের মতো এটারও সত্যমিথ্যার কোনো মা-বাপ নেই। যেমন আগের গুজবটিও ছিল ভিত্তিহীন, তার হাতে নাকি লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের একটা চোরাই এডিশন ছিল, আকারে মাত্র জুতার বাক্সের সমান।

চান্দ্র চুক্তিতে আমেরিকার সই করতে না পারার ফলেই পুরো মলিকুলার মেমোরি মডিউল র‍্যাকেট প্রজেক্ট আলোর মুখ দেখে।

এমনকি স্যার লরেন্স একজন মাল্টি ট্রিলিয়নিয়ার না হলেও তার কর্পোরেশনের জটিল ধাঁধাগুলো তাকে বিশ্বের শক্তিমান আর্থিক শক্তিতে পরিণত করে। সে তার ষষ্ঠ সন্তানের জন্য আট মিলিয়ন বা অষ্টমের জন্য বত্রিশ মিলিয়নের ঘোড়াই পরোয়া করত। কিন্তু নবম সন্তানের জন্য চৌষট্টি দেয়ার পর বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলোর টনক নড়ে। দশমজনের পর বাজিকররা তার একাদশ সন্তানের জন্য দুশো ছাপ্পান্ন খরচ করা না করা নিয়ে দর কষাকষি শুরু করে দিয়েছিল। বাধ সাধল লেডি জেসমিন। তার মনে হল হঠাৎ, দশ সন্তান নিয়ে সুং গোশিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা গেছে।

বাই চান্স (যদি এ নামে আসলেই কিছু থেকে থাকে) স্যার লরেন্স একেবারে ব্যক্তিগতভাবে স্পেস বিজনেসের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তার অবশ্যই অনেক আনন্দের যোগাড়যন্ত্র করা থাকতো, আর মহাকাশবিদ্যায়ও ছিল অপার আগ্রহ, কিন্তু এসব দেখাশোনার জন্য পাঁচ ছেলে আর তাদের সেক্রেটারিরাই যথেষ্ট। কিন্তু স্যার লরেন্সের আসল ভালবাসা পড়ে আছে সমস্ত যোগাযোগ মাধ্যমে-অবলুপ্তি থেকে টিকে যাওয়া কয়েকটি সংবাদপত্র, বই, ইলেক্ট্রনিক আর কাগজের ম্যাগাজিন এবং সবচে বড় কথা, আন্তর্জাতিক টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলোতে।

এরপর এক কথায় সে কিনে ফেলল পুরনো পেনিনসুলার হোটেল ভবনটা। কারণ, কোনো এক কালে এক গরীব চীনা ছেলে হোটেলটা দেখে নিজের বাড়ি করার কথা ভেবেছিল। বিশাল শপিং মল আর রাজকীয় মার্কেটগুলোকে খুব ভদ্রভাবেই উঠিয়ে দিয়েছে, আজ ভবনটার চারধারে গড়ে উঠেছে মনোরম পার্ক। আর সেই ঐতিহ্যবাহী সুরম্য অট্টালিকা তার বাসভবন এবং মূল অফিস। আসলে নতুন লেসার অ্যাক্সক্যাভেশন কর্পোরেশনের ভাগ্য একটু প্রসন্ন হয়েছিল, আর তা থেকেই কিছু বাড়তি লাভ চলে আসে, এই যা।

একদিন, পোতাশ্রয়ের ওপাশ থেকে মহানগরীর অসম আকাশ দেখে সে সন্তুষ্টির সাথে সাথে আরো কিছু উন্নয়নের কথা ভাবে। পেনিনসুলারের নিচের কয়েকটা তলা সামনের একটা বিশাল, গলফ মাঠ টাইপ বিল্ডিংয়ের জন্য কেমন আড়াল হয়ে যাচ্ছে! এটার-সিদ্ধান্ত নিল স্যার লরেন্স-এখানে থাকা চলবে না।

হংকং প্ল্যানেটরিয়ামের ডিরেক্টরকে পৃথিবীর সেরা পাঁচের মধ্যে ধরা হয়। তার অন্য কিছু প্ল্যানও ছিল। আর স্যার লরেন্স জীবনে প্রথমবারের মতো পয়সায় কেনা যায় না এমন কিছু দেখে বেশ চমৎকৃত হয়। তাদের মধ্যে বেশ গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। এবং অতঃপর স্যার লরেন্সের ষাটতম জন্মবার্ষিকীতে সে পার্টি দিয়েছিল; কিন্তু তার জানা ছিল না যে, পুরো সৌরজগতের ভাগ্যলিপি বদলে দেয়ার পথে সুং গোষ্ঠি সহায়তা করতে পারে।

৫. বরফের বাইরে

১৯২৪ সালে জেসিয়া সর্বপ্রথম জিনাতে প্রোটোটাইপ বানান। তার শত বছর পরেও কয়েকটা অপটিক্যাল প্ল্যানেটরিয়াম প্রজেক্টর কাজে লাগছে। আজো সেগুলো দর্শকের চোখের সামনে মিটমিটিয়ে জ্বলে। হংকং তৃতীয় প্রজন্মের যন্ত্রপাতির দিন ছাড়িয়ে এসেছে কয়েক দশক আগেই।

বিরাট ডোমের পুরোটাই এক দৈত্যাকার টেলিভিশন স্ক্রিন। এজন্য কাজে লাগানো হয়েছে হাজার হাজার ভিন্ন ভিন্ন প্যানেল। আসলেই, এ টিভিতে ধরা যায় না এমন কোনো দৃশ্য নেই।

প্রোগ্রামটা উদ্বোধন করা হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর এক চৈনিক আবিষ্কারককে উৎসর্গ করার মাধ্যমে। অচেনা সেই বৈজ্ঞানিক রকেটের জনক ছিলেন বলে দাবী করা হয়। প্রথম পাঁচ মিনিট তুমুলবেগে ঐতিহাসিক জগৎ খুঁড়ে দেখার কাজ চলল। তারপর ড. হিউ সেন জিয়াংকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অনেক উপরে তোলা হল; অবশ্যই তার ক্যারিয়ারের পেছনে আমেরিকা, রাশিয়া আর জার্মানির বিজ্ঞানীদের সব অবদানকে তুচ্ছ করে। অবশ্য তার দেশের মানুষকে মাফ করা যায়, এমন একটা জমকালো অনুষ্ঠানে লোকজন তাঁকে রকেটশিল্পের জগতে গদার, ভন ব্রাউন কিংবা কোরেলভের সাথে তুলনা করলেও অত্যুক্তির মতো দেখাতো না। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রে তার গ্রেফতার হওয়ার কথা নিয়ে তুবড়ি ছোটে, ঘটনাটার কিছুদিন আগেই ডক্টর জিয়াং সুখ্যাত জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি স্থাপন করেন এবং তার পরপরই ক্যালটেকের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রথম গদার প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু তারপর তিনি গ্রেফতারের ঘটনায় আঘাত পেয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন।

১৯৭০ সালে লঙ মার্চ ১ রকেটের মাধ্যমে চীন যে প্রথমবারের মতো মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায় সেকথা খুব কমই উচ্চারিত হল। কারণ হয়তো এই যে, সে সময়টায় আমেরিকানরা চাঁদের বুকে দাপড়ে বেড়াচ্ছে। আসলেই, বিংশ শতাব্দীর বাকী সময়টা দু-চার মিনিটেই যেন কেটে গিয়েছিল। এরপরই সেই অবিস্মরণীয় স্পেসশিপ জিয়াং এর সৃষ্টির ঘটনা, ২০০৭ সালে।

ভাষ্যকার বাকী কাহিনীটুকু বলেনি, বলেনি যে জিয়াঙের অনেক আগেই, ২০০১। সালে আমেরিকার ডিসকভারি মাতিয়ে রেখেছিল বৃহস্পতি-শনি জগৎ, এমনকি জিয়াং যাত্রা শুরু করার সামান্য কিছুদিন আগে রাশিয়ার একক প্রযুক্তিতে মার্কিন-রাশিয়ান অভিযান চালানো হয় বৃহস্পতির দিকে কসমোনট অ্যালেক্সি লিওনভ স্পেসশিপে করে । এ কথা উচ্চারণ করাও যায় না, কারণ তড়িঘড়ি করে জিয়াংয়ের এগিয়ে যাবার ফলটা ছিল বড় মর্মপীড়াদায়ক; অন্যদিকে সফলতার সাথে লিওনভ ফেরত আসে।

টিভি সম্প্রচার খুব একটা কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু ইউরোপার বুকে জিয়াংয়ের কুরা টিভি ডকুমেন্টারি প্রস্তুত করার চেয়ে জরুরী কাজ করছিল; ব্যস্তভাবে।

তারপর বৃহস্পতির চান্দ্রজগতে মানুষের প্রথম পদার্পণের গৌরবগাঁথা বলা হল সুন্দর করে। লিওনভের বুক থেকে সেই ল্যান্ডিং আর তার ফলে অবধারিত দুর্ঘটনার ধারাভাষ্য দিয়েছিল হেউড ফ্লয়েড, সবিস্তারে। আর ইউরোপাকে চিত্রিত করার মতো

অনেক অনেক ডকুমেন্টারি পাওয়া যায় লাইব্রেরিগুলোতে, সেসবও দেখানো হল দেদারসে। সেই সাথে ফ্রয়েডের ঐতিহাসিক কথা:

“ঠিক এ মুহূর্তে আমি শিপের সবচে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছি নির্নিমেষ চোখে। আপনারা ভোলা চোখে চাঁদকে যেমন দেখেন আমি দেখছি তারচে দশ গুণ বড়। আর আসলেই, দৃশ্যটা ভয়াল।

“উপরিতলটা মোটামুটি গোলাপী বর্ণের। সাথে আছে কয়েকটা ধূসর আঁচড়। কিছু সরু রেখা জটিল গোলকধাঁধা গড়ে তুলেছে; কোকড়ানো, ঢেউ খেলিয়ে চারদিকে ছড়ানো। বাস্তবে কোনো মেডিক্যাল টেক্সটবুকের শিরা-ধমনীর ছবির মতোই লাগে।

“সেসব রেখার কয়েকটি শত শত এমনকি হাজার মাইল লম্বা। দেখতে অনেকটা পার্সিভাল লোয়েল ও অন্যান্য বিংশ-শতাব্দী-বিজ্ঞানী বর্ণিত মঙ্গলের খালের মতো।

“কিন্তু মঙ্গল-নালার মতো ইউরোপা-নালা মোটেও ফাঁকিবাজী নয়। আর ঐ বিজ্ঞানীরা যেমন দাবী করতেন যে মঙ্গলের খালগুলো সভ্য প্রাণীর গড়া-তেমন কোনো ব্যাপারও এখানে নেই। এসবই প্রাকৃতিক। উপরি পাওনা হল, মঙ্গলের সেসব কল্পিত খাল ছিল খটখটে শুকনো, আর এখানে অকূল পানি; অন্তত অনেক অনেক বরফ পাওয়া যাবে। কারণ এই উপগ্রহটা চারদিকে গড়ে পঞ্চাশ কিলোমিটার গভীর সমুদ্রে ঢাকা পড়ে গেছে।

“সূর্য থেকে অনেক অনেক দূরে হওয়ায় বৃহস্পতির এই প্রজার উপরিতল তাপমাত্রায় অনেক অনেক কম । শূন্যের দেড়শো ডিগ্রীরও নিচে। সুতরাং যে কোনো সুস্থ মানুষ ভাবতে পারে যে পুরো সাগরটা বরফের এক টুকরো।

“কিন্তু অবাক হলেও সত্যি যে, বাস্তবটা তেমন নয়, ইউরোপার অভ্যন্তরীণ তাপ একে গলিয়ে রাখে, তার উপর প্রতিবেশী আগ্নেয়-উপগ্রহ আইওর জোয়ার-আকর্ষণ সব সময় পানিটাকে নড়াচড়ার উপরই রাখছে। আর আছেন গ্রহরাজ, তাঁর দোর্দণ্ড প্রতাপ সমেত।

“তাই সারাক্ষণ বরফ ভাঙছে, গলছে, আবার জমে উঠছে শক্ত হয়ে। আর তাই আমাদের মেরুদেশে ভাসমান বরফের উপরের ফাটলের মতো দেখতে কিন্তু তারচে শতগুণ বড় আর গভীর ফাটল তৈরি হচ্ছে সারাক্ষণ। এই সব জটিল খানাখন্দই দেখছি এখন। এদের বেশিরভাগই অতি পুরোনো আর অন্ধকার। কোনো কোনোটা লাখ লাখ বছরের পুরনোও হতে পারে। কিন্তু কোনো কোনোটা একেবারে তুষারশুভ্র। তারা মাত্র জন্মাচ্ছে, কারো কারো খাদ মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার গভীর।

“এই সাদা গর্তগুলোর কোনো একটার পাশেই জিয়াং অবতরণ করে। পনেরশ কিলোমিটার লম্বা গড়নটা; নাম গ্র্যান্ড ক্যানেল। স্বাভাবিকভাবেই চৈনিকেরা এ থেকে পানি তুলতে চায়; সেই পানি পোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্কে ভরে নিয়ে তারা বৃহস্পতীয় উপগ্রহ জগৎ ছুঁড়ে বেড়িয়ে পৃথিবীতেও ফিরে যাবার মতলব এটেছে। কাজটা ছেলের হাতের মোয়া নয়, কিন্তু তারা আগুপিছু না ভেবে এসেছে এমনটা হতেই পারে না। তারা অবশ্যই যা করতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখে।

“আজ আর ব্যাপারটায় কোনো পর্দা নেই। বোঝাই যাচ্ছে, আসার পথে কেন প্রোপ্যাল্যান্টের সবটুকু খুইয়ে বসেছিল তারা আর ইউরোপার মতো বিরান এক উপগ্রহের দাবী নিয়ে কেনইবা আসর মাতিয়ে রেখেছিল এতোদিন। রিফুয়েলিং পয়েন্ট হিসেবে ধরলে এখান থেকে শুধু পুরো সৌর জগৎই দাপড়ে বেড়ানো যাবে না, বরং যাওয়া যেতে পারে দূর নক্ষত্রলোকের…

কিন্তু তা আর কাজে লাগল কৈ? ভাবছে স্যার লরেন্স তার কৃত্রিম আকাশরূপী শেল্টারের নিচে বিলাসবহুল চেয়ারে বসে থেকে। কোনো এক অজানা কারণে ইউরোপার দপীয়সী সাগরগুলো আজো মানুষের জন্য অগম্য। আর শুধু অগম্য হলেও সারা হতো, একেবারে অদৃশ্য আর অদৃষ্টপূর্ব। বৃহস্পতি নক্ষত্রে পরিণত হবার পর পরই এর ভিতরের দিকের গ্রহগুলো (ভাবতেও অবাক লাগে, যেগুলো ক দশক আগেও উপগ্রহ ছিল সেগুলো আজ গ্রহ!) বারাজ্যে নিজেদের ঢেকে রেখেছে, আগাগোড়া। এ বাষ্প তাদের শরীর থেকেই উথলে উঠছে অবিরাম।

স্যার লরেন্স আজকের ইউরোপার কথা ভাবছে না, ভাবছে ২০১০ সালের কথা।

সে তখন এক দুরন্ত কিশোের। সেদিন কী গর্বই না অনুভব করেছিল সে, তার দেশের লোক কুমারী বরফাবৃত ইউরোপার ঘুম প্রথমবারের মতো ভাঙিয়েছে। তখনও রাজনীতির লোকেরা হংকং আর চীন নিয়ে কীসব বলে তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি সে।

সেসব দৃশ্য ধারণের জন্য কোনো ক্যামেরা প্রস্তুত ছিল না। তবু মনশ্চক্ষে সে দেখত কীভাবে ইউরোপার মিশকালো আকাশে ধ্বংসের দেবতা নেমে এলো, কীভাবে ধ্বংস হয়ে গেল স্পেসশিপটা। কীভাবে গ্র্যান্ড ক্যানেলে আবার নেমে গেল সেই আততায়ী; পানির স্তরটা কেমন করে আবার বরফে পরিণত হল।

সবাই জানতো এমনটাই ঘটেছে, তাই কল্পনায় দেখে নিতে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। এবার সেই পুরনো ইউরোপার বদলে এমন একজনের ছবি ভেসে উঠল যাকে চীনারা এতোটা চেনে যতোটা রাশিয়ানরা চেনে গ্যাগারিনকে।

প্রথম ছবিতে রুপার্ট চ্যাংয়ের গ্র্যাজুয়েশন ডের চেহারা ভেসে উঠল, ১৯৮৯ সালের কথা। লাখো মানুষ থেকে ব্যতিক্রমী মেধাবী তরুণ মুখ, পরের দুই দশকে কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই সে মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তিতে।

একটু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে সাথে ভাষক ড. চ্যাংয়ের ক্যরিয়ার বর্ণনা করা শুরু করল। একেবারে জিয়াংয়ের সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া পর্যন্ত বলে গেল একটানা। একের পর এক বয়েসি ছবি এসে আগেরটা দখল করে নিচ্ছে। সবশেষে তার মিশনের আগ মুহূর্তে ভোলা ছবি ভেসে ওঠে।

স্যার লরেন্স প্ল্যানেটরিয়ামের আধো অন্ধকারকে অশেষ ধন্যবাদ দিল। কারণ ড. চ্যাংয়ের লিওনত্রে উদ্দেশ্যে পাঠানো সেই অনিশ্চয়তাময় কথাগুলো প্রচারিত হবার পর তার আশপাশের বন্ধু-শত্রুরা তার চোখে জড়ো হওয়া জলীয়তা দেখতে পাবে না।

…জানি আপনারা লিওনভেই আছেন… হয়তো খুব একটা সময় পাব না হাতে… আমার স্যুট অ্যান্টেনাটা লক্ষ্য করে যেখানে…

কয়েক মুহূর্তের জন্য চলে গিয়েই সিগন্যাল আবার ফিরে আসে। আরো স্পষ্ট, কিন্তু ক্ষীণতা বজায় থাকে।

“…তথ্যগুলো দয়া করে পৃথিবীতে পাঠান। তিন ঘণ্টা আগেই জিয়াং ধ্বংস হয়ে গেছে। একা আমিই আছি বেঁচে। জানি না আমার স্যুট রেডিওর যথেষ্ট রেঞ্জ আছে কিনা, কিন্তু এটা ব্যবহার করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। প্লিজ, মনোযোগ দিয়ে শুনুন। ইউরোপায় জীবন আছে। আবারও বলছি আমি, জীবন আছে ইউরোপায়…

সিগন্যাল অস্পষ্ট হয়ে যায় আবারো।

“স্থানীয় মধ্যরাতের পরপরই। আমরা বেশ ভালভাবে পানি পাম্প করছিলাম, প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্ক অর্ধেকটা ভরে উঠেছে ততক্ষণে। পাইপ পরিবহন পরীক্ষা করতে আমি আর ড. লি এগিয়ে গেলাম। জিয়াং দাঁড়িয়ে আছে… ছিল… গ্র্যান্ড ক্যানেলের কিনারা থেকে ত্রিশ মিটার দূরে। পাইপ সোজা এখান থেকে নিচে নামানো, বরফ খুবই হালকা। হাঁটাটা নিরাপদ নয়। তার উপর নিচ থেকে গরম পানির ধাক্কাতে এ উপগ্রহে…

আবারো এক লম্বা নিরবতা।

“…নো প্রব্লেম। শিপের উপর পাঁচ কিলোওয়াটের বাতি টানানো আছে। ঠিক যেন এক ক্রিসমাস ট্রি। বর্ণে বর্ণে বর্ণিত, বরফের ভিতর দিয়েও দেখা যাচ্ছে। প্রথমে সেটাকে লি-ই দেখতে পায়। গভীর থেকে এক বিশাল কালচে আকৃতি উঠে আসছে। প্রথমে আমরা মনে করেছিলাম কোনো মাছের ঝাঁক, বিশাল কোনো দল। একক সত্তার পক্ষে আকারটা বিশালতো, তাই। স্বচ্ছ বরফ দিয়ে দেখতে তেমন সমস্যা হচ্ছিল না।

“…অনেকটা সামুদ্রিক শৈবালের ঝোঁপ যেন। এগিয়ে আসছে বরফের বুকে ক্রল করে করে। লী ক্যামেরা আনতে দৌড়ে গেল শিপের দিকে। আমি থেকে গেলাম দেখার জন্য। দেখতে দেখতে রিপোর্ট করব রেডিওতে। জিনিসটা এতো ধীরে নড়াচড়া করছিল যে আমি ইচ্ছা করলেই এরচে দ্রুত যেতে পারতাম। সতর্ক হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত ছিলাম। ভাবলাম এটা কী ধরনের প্রাণী আমি জানি। ক্যালিফোর্নিয়ার কাছাকাছি বড় সামুদ্রিক গুল্মবনের ছবি আমার দেখা কিন্তু খুব বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল অনুমানের বেলায়।

“… প্রাণীটার কোনো না কোনো সমস্যা ছিল, আমি শিওর। এর সাধারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থার চেয়ে একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী কম তাপমাত্রায় বেঁচে থাকা অসম্ভব। সামনে আসার সময় জমে কঠিন হয়ে গিয়েছিল-ছোট ছোট টুকরো আলাদা হয়ে যাচ্ছিল কাঁচের মতো কিন্তু তখনো জাহাজের দিকে এগুচ্ছেই। কালো সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সব সময়ই মন্থর মনে হয়।

“আমি তখনো এত বিস্মিত যে সোজাসুজি চিন্তা করতে পারিনি। কল্পনাই করতে পারিনি এটা কী করার চেষ্টা করছে…।

বলে চলেছে প্রফেসর চ্যাং, … জাহাজের উপর উঠে এগিয়ে যাবার সাথে সাথে তৈরি করে বরফের এক সুড়ঙ্গ। সম্ভবত জিয়াংয়ের উষ্ণতা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চায়-মাটির ছোট্ট করিডোরে উইপোকা যেমন আটকা পড়ে যায়, তেমন করে শিপও এর ঘোরটোপে পড়ে গেল।

“…জাহাজের উপর টনকে টন বরফ জমেছে। রেডিও এন্টেনা বন্ধ হয়ে গেছে প্রথমবারের মতো। তারপর দেখতে পেলাম নামতে থাকা পাগুলো সব কুঁচকে যেতে শুরু করে; দুঃস্বপ্নের মতো ধীর গতিতে।

“শিপ নড়বড় হয়ে পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি জিনিসটা কী করার চেষ্টা করছে-তখন আর সময় নেই। ঐ লাইটগুলো বন্ধ করে দিলেই নিজেদের আমরা রক্ষা করতে পারতাম।

“সম্ভবত প্রাণীটা আলোতে সক্রিয় হয়, এবং বায়োলজিক্যাল আবর্তনে সূর্যের আলো পড়লে হয়ত এ অদ্ভুত জিনিসটা হিংস্র হয়ে পড়ে। সেই আলো বরফের মধ্য দিয়ে বিশোধিত হয়ে প্রবেশ করে ভিতরের জগতে। আলোর প্রতি পতঙ্গের মতো আকৃষ্ট হতে পারে এটা। আমাদের ফ্লাডলাইট অবশ্যই ইউরোপা এ পর্যন্ত যা দেখেছে তার চেয়ে অনেক অনেক উজ্জ্বল…।

তারপর ভেঙে গেল আমাদের শিপ। আমি নিজের চোখে জাহাজের কাঠামো লম্বালম্বিভাবে টুকরা হতে দেখলাম। তুষার ফলকের এক মেঘ ঘন ঘন আর্দ্র করে তোলে চারপাশকে। দুমিটার উপরে ক্যাবলে ঝুলছিল একটা বাতি। বাকী সবগুলো নিভে গেল সামনে পেছনে দুলতে দুলতে।

“জানি না কী হল এর পর । আমার আর কী করণীয়? জাহাজের ধ্বংসস্তৃপের পাশে লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। সূক্ষ্ম ফ্রেশ বরফের পাউডারে আমি আবদ্ধ । এর মধ্যে আমার জুতার ছাপ খুব স্পষ্ট দেখতে পেলাম। অবশ্যই সেখানে হেঁটেছি সম্ভবত মাত্র এক বা দুমিনিট পর। হিতাহিত জ্ঞান ছিল না।

“চারাগাছটি–আমি এখনো এটাকে ঝাকড়া চারাগাছ হিসেবে ভাবি! জিনিসটা ছিল স্থির। অবাক চোখে দেখি এটা ধ্বংস হচ্ছে আঘাতে আঘাতে, বড় বড় কাটা অংশ মানুষের হাতের মতো ঘন টুকরো টুকরো হয়ে শাখা প্রশাখার মতো ছিটকে পড়ল।

“তারপর আবার চলতে শুরু করে প্রধান কাণ্ডটা। স্পেসশিপের কাঠামো থেকে নিজেকে টেনে বের করে আমার দিকে হামাগুড়ি দিতে শুরু করলে আমি নিশ্চিতভাবে জানলাম যে জিনিসটি আলোতে প্রতিক্রিয়াশীল । দাঁড়িয়ে ছিলাম হাজার ওয়াট বাতির ঠিক নিচে। জিনিসটা এখন বন্ধ করেছে নিজেকে দোলানো ।

“একটা ওক গাছের সাথে এর মিল এখনো দেখতে পাই যেন, একটি বটগাছ বহুশাখা এবং মূল নিয়ে মাধ্যাকর্ষণে চিড়েচ্যাপ্টা হলে যেমন দেখায় তেমন। বরফ ঘেঁষে চুপিসারে চলতে চেষ্টা করছিল জিনিসটা। আলোর পাঁচ মিটারের মধ্যে পৌঁছে আমার চারদিকে এক নিখুঁত বৃত্ত তৈরি করে নিজেকে ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। বোঝাই যায় সে এলাকাই ওটার সহ্যক্ষমতার সীমা-আরো সামনে তার আলোক আকর্ষণ হয়ত অরুচিকর। তারপর কয়েক মিনিটের জন্যে কিছুই হয়নি, আমি বরং ভাবছি মরে জমে কঠিন হয়ে গেল কিনা।

“তারপর দেখলাম বিরাট বিরাট মুকুল গঠিত হতে শুরু করেছে অনেক শাখা প্রশাখা সহ। অনেকক্ষণ। ফুল ফুটতে দেখার মতো ধৈর্য নিয়ে বসে থাকতে হল আমাকে। আসলে ভাবছিলাম অন্য কথা, এক একটা ফুল মানুষের মাথার মতো বড়! কোমল, সুন্দরভাবে রঙিন ঝিল্লি ভাজ ভাঙ্গতে শুরু করে। এমনকি তখনও মনে হল যে, কোনো মানুষ বা প্রাণী এর আগে এমন রঙ কক্ষনো দেখেনি। এত রঙের অস্তিত্বই থাকত না যদি আমাদের লাইট-আমাদের প্রাণনাশক লাইট এ দুনিয়ায় বয়ে না আনতাম।

“চারদিকে আস্তে আস্তে দুলছে পুংকেশর…জীবন্ত দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটলাম যাতে ব্যাপারটা ঠিকমতো দেখতে পারি। আমি ঐ প্রাণীকে সামান্যতম ভয় পাইনি কখনোই। শিওর ছিলাম, এটা পরশ্রীকাতর না-যদি তাই হয়ে থাকে তবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করত। ও আমার অস্তিত্ব টের পায় ভালভাবেই।

“বড় ফুলগুলোর স্তরে স্তরে ভাঁজ ভাঙার খাঁজ। এবার এরা মনে করিয়ে দেয় প্রজাপতির কথা, যা এইমাত্র শুয়োপোকার আবরণ থেকে বেরুল-ডানায় ভাঁজ ভাঁজ চিহ্ন, এখনো ক্ষীণ-আমি ক্রমেই সত্যের কাছাকাছি যাচ্ছিলাম।

এই মুকুলগুলোর মধ্যে কিছু কিছু যত তাড়াতাড়ি গঠিত হয় জমেও যায় তত তাড়াতাড়ি-যায় মরে। তারপর মূল মুকুল থেকে একের পর এক ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে শুকনো ভূমিতে মাছের আঁশের মতো ভেঙ্গে পড়ল এলোপাথাড়ি। চারদিকে। অবশেষে বুঝতে পারলাম এগুলো কী। ঐ ঝিল্লিগুলো পাপড়ি না-জলজপ্রাণীর ডানা বা তার সমমানের একটা কিছু। মুক্তভাবে সাঁতার কাটার জন্যে ঐ প্রাণীর একটা স্তর। অনেকটা ডানার মতো। হয়ত জীবনের বেশিরভাগ কাটিয়ে দেয় সমুদ্রগর্ভে শিকড় গেড়ে, তারপর এ চলমান বাচ্চাদের নতুন এলাকা খুঁজে বের করার জন্য পাঠায়। ঠিক যেমনটা করে পৃথিবীর মহাসাগরের প্রবাল।

“ছোট্ট প্রাণীর একটাকে কাছে থেকে দেখার জন্যে আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। সুন্দর রঙ ম্লান হচ্ছিল তখন। বৈচিত্র্যহীন বাদামী রঙ বেরিয়ে পড়ে। পাপড়ি-ডানার কিছুটা হঠাৎ করে জমে যাওয়ায় ভেঙে পড়ে ভঙ্গুর মাটির পাত্রের মতো। প্রাণীটা তখনো ক্ষীণভাবে নড়ছিল, এমনকি আমি সামনে গেলে আমাকে এড়িয়েও গেল। আমিতো অবাক! এটা কীভাবে আমার উপস্থিতি বোঝে?

“তারপর দেখতে পাই পুংকেশরগুলো…এ নামেইতো ডেকেছিলাম-এদের ডগার উপরে উজ্জ্বল নীল ফোঁটা ধরে রেখেছে। দেখতে ঠিক ছোট উজ্জ্বল নীল রঙা তারার মতো অথবা ঝিনুকের আবরণের সাথে নীল চোখের মতো-সেগুলোও আলো থেকে সাবধান, কিন্তু সত্যিকারের মুড নিতে পারেনি। তারপর উজ্জ্বল নীল ম্লান হয়ে যায়, সাধারণ পাথরের মতো…

ডক্টর ফ্লয়েড অথবা অন্য যে কেউ শুনছেন… আশা করি কেউ না কেউ শুনতে পাবেন আমার কথা, হাতে খুব একটা সময় নেই, বৃহস্পতি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সিগন্যাল ব্লক করবে। আমার কথা অবশ্য প্রায় শেষ।

“জানি এরপর আমার কী কাজ। হাজার ওয়াট বাতির তারটা ঝুলছিল মাটির কাছাকাছি। এটাতে হ্যাঁচকা টান মারলে লাইটটা নিভে গেল একটু স্পার্ক করে। অনেক দেরি হয়ে গেছে কিনা ভেবে আমি ভয়ও পেয়েছি কিছুটা। কিছুক্ষণ কিছুই হয়নি। সুতরাং মনের ঝাল ঝাড়তে চারদিকের জট পাকানো শাখাপ্রশাখার দেয়ালের উপর হাঁটতে হাঁটতে লাথি লাগালাম কষে।

“ধীরে ধীরে প্রাণীটি তার শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে নেয় গ্র্যান্ড ক্যানেলে ফিরে যাওয়ার জন্য। অনেক আলো থাকার কারণে আমি সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বৃহস্পতির দুই উপগ্রহ গ্যানিমেড আর ক্যালিস্টো আকাশে ভাসে আর গ্রহরাজ বৃহস্পতি দেখায় পাতলা এক চাঁদের মতো। আইওর ঘুরতে থাকা শেষপ্রান্ত বৃহস্পতির দিকে ফেরানো। উপগ্রহটার রাতের আকাশে মেরুজ্যোতির ফুলঝুরি ফুটেছিল। কোনো প্রয়োজন ছিল না আমার হেলমেট লাইট ব্যবহার করার। আমি বেশ আগ্রহের সাথে দৌড়াই প্রাণীটার পেছনে। একটু ধীর হয়ে এলেই লাথিও দিই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে; অনুভব করি বুটের নিচে বরফ ভাঙার কড়মড় শব্দ…ক্যানেলের কাছাকাছি যেতেই মনে হল এটা শক্তি পেয়েছে আরো। ঠিকই, সে ফিরছে নিজের বাড়িতে। ভয় পাচ্ছিলাম এবার একটু একটু। আবার মুকুল সৃষ্টির জন্য বেঁচে থাকতে পারে। শত্রু এলাকায় কিছু মৃত লার্ভা রেখে সে চলে গেল পানির উপর দিয়ে। খোলা পানিতে কিছুক্ষণের জন্য বুদবুদ উঠল যে পর্যন্ত বরফের একটা চাদর পানির স্তরটাকে শূন্যতা থেকে সরিয়ে না আনে। দৃষ্টি সরিয়ে ফিরে গেলাম শিপের কাছে। যদি কেউ বেঁচে থাকে…এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমার শুধু দুটি অনুরোধ আপনার কাছে, ডক্টর। যখন ট্যাক্সোনমিস্টরা এই প্রাণীকে শ্রেণীভুক্ত করবে, আশা করি নামটা হবে আমার নামে।

“আর…ডক্টর…প্লিজ…পরের শিপ আসার সময়-তাদের একটু বলে রাখবেন আমাদের কঙ্কাল যাতে চীনে নিয়ে যায়। মাইনাস একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে আমরা পচে যাব না। আর…আমার বাসায় আছে ছোট্ট…না, থাক। যা বলছিলাম, বৃহস্পতি আমাদের ধ্বংস করে দেবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। আশা করি এবং আমার বিশ্বাস কেউ

কেউ আমার কথাগুলো শুনছে। যাই হোক, যোগাযোগ করার সুযোগ পেলে এ মেসেজ আবার পাঠাব। অবশ্য আমার স্পেস স্যুট যদি তখনো টিকে থাকে।

“ইউরোপা থেকে প্রফেসর চ্যাং মহাকাশ যান জিয়াং ধ্বংসের প্রতিবেদন দিচ্ছি। আমরা ল্যান্ড করলাম গ্র্যান্ড ক্যানেলের পাশে। আমাদের পাম্পগুলো বসানো হয় বরফের কিনারায়…

সংকেতটি ধীরে মিলিয়ে গিয়ে আবার মুহূর্তের জন্য ফিরে এসে শ্রাব্যতার সীমার নিচে নেমে চিরতরে হারিয়ে গেল ।

আবার যোগাযোগের সুযোগ হয় এক সময়। একই ফ্রিকোয়েন্সিতে লিওনভ মনোযোগ দেয়-কিন্তু প্রফেসর চ্যাংয়ের কাছ থেকে আর কোনো মেসেজ আসেনি কোনোদিন।

৬. গ্যানিমিডের সবুজ হয়ে ওঠা

রালফ ভ্যান ডার বার্গ ই এ কাজের জন্য একেবারে উপযুক্ত। উপযুক্ত স্থানে, উপযুক্ত সময়ে। আর কোনো সমন্বয়ই কাজে লাগত না।

সেই সঠিক মানুষ কারণ সে দ্বিতীয় প্রজন্মের আফ্রিকানা রিফিউজি; এবং একজন সুপ্রশিক্ষিত ভূগোলবিদ। দুটো ব্যাপারই সমান গুরুত্বপূর্ণ। জায়গাটা উপযুক্ত, কারণ এটা হল বৃহস্পতি উপগ্রহ জগতের সবচে বড় সম্পদ; আইও, ইউরোপা, গ্যানিমিড, ক্যালিস্টোর মধ্যে তৃতীয়টা।

সময়টা উপযুক্ত, কারণ গত কয়েক দশক ধরে হাজারো পর্যবেক্ষণের ডাটা পাহাড় গড়েছে। ভ্যান ডার বার্গ সাতান্ন সালের আগে এ ভাবনাটার মুখোমুখি হয়নি। আরো একটা বছর তার কেটে গেল নিজেকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে। এ ব্যাপারটা বোঝাতে যে সে পাগলাটে নয়। আর পরের বছর অর্থাৎ উনষাট সালে পদক্ষেপ নেয় যাতে তার আবিষ্কারে আর কেউ নাক না গলাতে পারে। এবং এতোকিছুর পরে পরের সমস্যাটায় মনোযোগ দেয়ার সময় পেল: এবার কী করা?

সবটাই শুরু হয়ে গেছে। ঘটনার শুরু তার উপজাতীয় চোখে কিছু এলাকা আর ঘটনা খুটিয়ে দেখা থেকে। তার চাকরি প্ল্যানেটারি ইঞ্জিনিয়ারিং টাস্ক ফোর্সে, একজন সদস্য হিসেবে সে দেখে বেড়াতো গ্যানিমিডের প্রাকৃতিক সম্পদ। এর সাথে আরেকটু কাজও ছিল, মাঝে মাঝে পাশের নিষিদ্ধ উপগ্রহে চোখ ফেরানো।

কিন্তু ইউরোপা যেন এক রুদ্ধদ্বার কিংবদন্তী। তার আশপাশের কাউকে প্রবেশাধিকার দেবে না। সাতদিন অন্তর সে গ্যানিমিডের পাশ দিয়ে যায়, আর পাশ কাটিয়ে যায় সেই ক্ষুদে তারকাকে যেটা এককালে বৃহস্পতি ছিল। তৈরি হয় চন্দ্রকলার মতো কলা, মাত্র বারো মিনিটের জন্য। সবচে কাছ থেকে এটাকে দেখতে পৃথিবীর আকাশে চাঁদের চেয়ে একটু ছোট। কিন্তু অন্যপাশে চলে গেলে অনেক ছোট হয়ে যায়।

এর চন্দ্রকলার আকার দেখতে মনোহর। কিন্তু যখন লুসিফার আর গ্যানিমিডের মাঝামাঝি চলে আসে তখন একটা কালো চাকতি যেন। চারধারে আগুনের গোল দাগ। জ্বলন্ত। সেটা ছোট সূর্যেরই আলোর বিচ্ছুরণ।

মানুষের জীবদ্দশার অর্ধেক সময়ের মধ্যেই ইউরোপা আমূল বদলে গেল। লুসিফারের দিকে সারাক্ষণ মুখ করে থাকা প্রান্তের গহীন বরফ গলে গেল কদিনেই। সৃষ্টি হল সৌর জগতের দ্বিতীয় গলিত সাগর। একটা যুগ ধরে এটা বাষ্পের ঝড় তুলে চলল। অকূল সমুদ্রের চারদিকে পানির ফোয়ারা বাষ্পে পরিণত হচ্ছে। তারপরই দেখা দিল অদৃষ্টপূর্ব ভূভাগ। আজ ইউরোপার আছে একটা নিজস্ব, কার্যকর (কিন্তু মানুষের জন্য নয়) পাতলা বাষ্প-বায়ুমণ্ডল। এখানে আছে হাইড্রোজেন সালফাইড, কার্বন। সালফার ডাই অক্সাইডও এতে শামিল। এমনকি নাইট্রোজেন আর বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য গ্যাসের সমাহারও চোখে পড়ে।

উপগ্রহটার তথাকথিত রাতের দিক আজো জমে আছে গত কোটি বছরের মতো। তার পরও মাঝে মাঝে পানির দেখা মেলে, সেই পানিতে ভাসে বরফের বিশাল বিশাল চাকতি। আর পেছনের বরফ-ভাগটা আফ্রিকার সমান।

এসবই পৃথিবীর অর্বিটে ভেসে বেড়ানো টেলিস্কোপের মাধ্যমে দেখতে হয়েছে। তারপর ২০২৮ সাল এগিয়ে এল । গ্যালিলিয়ান চাঁদগুলোর দিকে চালানো হল প্রথম পূর্ণমাত্রার অভিযান। এরই মধ্যে ইউরোপা এক স্থায়ী মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে সারা জীবনের জন্য। এরপর খুবই সাবধানে প্রোবিংয়ের পালা। দেখা গেল এখনো সাগর শুকায়নি। পুরো ইউরোপা আজো সৌরজগতের সবচে মসৃণ রিয়েল এস্টেট।

দশ বছর পরই আর কথাটা খাটলো না। অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে সেখানে; ইউরোপায়। সাগরের বুক চিরে, চির গোধূলী অঞ্চলের বরফ তেড়েফুঁড়ে মাথা তুলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে এভারেস্টের মতো বিশাল এক পর্বত। হাজার হলেও, ইউরোপার প্রতিবেশী আইও। তার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে এই উপগ্রহও অগ্নি উদগীরণ শুরু করে দিল। তারই ফলে এই মহাপর্বতের উত্থান কিনা কে জানে!

কিন্তু এই ব্যাখ্যার সাথে কিছু ঘাপলাও আছে। মাউন্ট জিউস অনেকটা অমসৃণ পিরামিড। স্বাভাবিক অগ্নিগিরির মতো নয়। আর রাডার স্ক্যানেও স্বাভাবিক লাভা প্রবাহের কোনো খোঁজ লাগানো যায়নি। কারণ আছে। গ্যানিমিড থেকে সারাক্ষণ তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকার পর হালকা মেঘ সরে গেলে যে ছবি তোলা যায় তাতে মনের তুষ্টি আসে না কিছুতেই। বরং অস্পষ্ট ছবিতে যেটুকু ঠাহর করা যায় তাতে পর্বতটাকেও বরফের তৈরি বলে মনে হচ্ছে। গঠনে যাই থাক না কেন, এর অনধিকার দ্রষ্টাদের চোখে মাউন্ট জিউস এক মহাবিস্ময়।

কোন এক ম্যাভেরিক বিজ্ঞানী বলেছিলেন যে, মাউন্ট জিউস কোনো মহাজাগতিক বরফখণ্ড। স্পেস থেকে ইউরোপার উপর পড়ে যাওয়া কোনো মহাজাগতিক শিলাখণ্ড । অদূর অতীতে এমনটা যে ঘটেছে সে প্রমাণ দিচ্ছে ক্যালিস্টো। কিন্তু তত্ত্বটা গ্যানিমিডের বুকে খুবই অজনপ্রিয়। তার হতেও-পারে-অধিবাসীরা এর মধ্যেই সমস্যায় পড়ে গেছে। এমন যদি হয়েই থাকে, তবে তাদের জীবন কাটবে শঙ্কায় শঙ্কায়।

তারা অনেকটাই আশ্বস্ত হয় যখন ভ্যান ডার বার্গ তার নূতন থিওরি উপস্থাপন করে। উপর থেকে এতো বড় বরফখণ্ড মানুষের চোখ এড়িয়ে গত এক শতাব্দীতে পড়াটা খুবই কঠিন। আর যত কমই হোক, ইউরোপার একটা নিজস্ব গ্র্যাভিটি তো আছে, তার টানে পাহাড়টা ভেঙে যাবার কথা। জবাব আর যাই হোক, বরফ নয়, কারণ ধীরে ধীরে বরফটা সাগরে ডুবছে।

সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় যদি একটা, মাত্র একটা ছোট্ট পোব ইউরোপার আকাশে পাঠানো যায়। কিন্তু একটা কথাই সব উৎসাহে বরফ শীতল পানি ঢেলে দেয় পলকে।

এই সব দুনিয়া তোমাদের–শুধু ইউরোপা ছাড়া।
এখানে নামার কোনো চেষ্টাই করো না।

ডিসকভারি স্পেসশিপের বুক থেকে ধ্বংসের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘোষিত সতর্কবাণী ভুলে যাবার কথা নয়। তবু এ নিয়ে লক্ষ যুক্তি তর্কের ধোঁয়া উঠছে অবিরাম।

“নামার দিয়ে কি ভোব পাঠানোও নিষেধ করা হয়েছে, নাকি শুধু মনুষ্য যানের বেলায় নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য? আর না নেমে যদি কাছাকাছি দিয়ে উড়ে যাওয়া হয়, মানুষ থাক বা না থাক, তাহলে? অন্তত বায়ুমণ্ডলের উপরদিকটায় একটা ভাসমান বেলুন পাঠালে ক্ষতি কী?

বৈজ্ঞানিকের দল সমাধান বের করার জন্য চিন্তায় মরলেও সাধারণ মানুষ ঝুঁকি নিতে নারাজ। ভালইতো আছি ভাই পৃথিবীর বুকে। আরো অর্ধশতাধিক গ্রহ উপগ্রহওতো আমাদের। কেন শুধু শুধু ইউরোপায় নাক গলাতে যাওয়া? তাছাড়া সেসব দেখতেই তো শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যাবে। তারপর নাহয় নাক গলাই।

সেজন্যেই ভ্যান ডার বার্গ ভালমতো বারবার শুনতে পেয়েছে যেন সেসব নিয়ে খুব বেশি ভাবাভাবি না করে। ইউরোপার চিন্তা গৌন। লাখো কাজ পড়ে আছে গ্যানিমিডে। (হাইড্রোপোনিক ফার্মগুলোর জন্য কার্বন, ফসফরাস আর নাইট্রেট যৌগ কোথায় পাই? আর বসতির কাঠামো? সবুজায়ন কেমন হবে, কতটুকু? এবং এমনি আরো হাজারটা প্রশ্নের প্রহেলিকা…)

কিন্তু তার জিনে পরিবাহিত পূর্বপুরুষদের একাগ্রতা সব সময় জেগে থাকে। আর তার চোখ সবসময় থাকে ইউরোপার দিকে, নির্নিমেষ।

তারপর একদিন, মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য, মাউন্ট জিউসের প্রহেলিকাময় যবনিকা একটু সরে যেতেই দেখা গেল তার কাঙ্ক্ষিত চেহারা।

৭.ট্রানজিট

আমিও নিচ্ছি ছুটি, ছুটি নিচ্ছি, যা ছিল আমার, সবকিছু থেকে…

স্মৃতির কোন গহীন থেকে সাঁতরে লাইনটা উপরে উঠে এল? হেউড ফ্লয়েড বন্ধ করল চোখ দুটো। অবশ্যই কোনো কবিতার লাইন। আর কলেজ ছেড়ে আসার পর সে কি আদৌ কোনো কবিতা পড়েছে? অবশ্য একবার একটা ছোট ইংরেজির সেমিনারে বসেছিল।

তারপরই স্টেশন কম্পিউটারে কথাটা প্রবেশ করিয়ে দেয়ার পর লাইনটা খুঁজে বের করতে বেশ অনেকটা সময় নেয় কম্পিউটার। দশ মিনিট। কবিতার নাম জানা থাকলে কয়েক সেকেন্ড লাগতো, কিন্তু পুরো ইংরেজি সাহিত্য চষে ফেলে লাইনটা খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়।

যুদ্ধের কবিতা, কিন্তু কোন যুদ্ধের? বিংশ শতাব্দীটাইতো যুদ্ধের ডামাডোলে গেল…

এখনো মনের কুয়াশা ছিন্ন করে খুঁজে যাচ্ছে সে লাইনটাকে। এরই মধ্যে তার মেহমানরা এসে পড়েছে; এক-ষষ্ঠাংশ মাধ্যাকর্ষণে অভ্যস্ত তারা, নড়াচড়া করে ধীরে ধীরে। পাস্তুরের সমাজ কেমন বদলে যাচ্ছে। যারা নড়তে পারে না তেমন, তারা পছন্দ করে হাসপাতালের মাঝামাঝি এলাকাটাকে। প্রায় মাধ্যাকর্ষণহীন। আর পাস্তুরকে ভালবাসে যারা তাদের আবাস কিনারা আর মধ্যবিন্দুর মাঝে। সেখানে মাধ্যাকর্ষণ চাঁদেরই মতো। কিন্তু একদল মানুষ ফিরে যেতে চায় উৎসভূমি পৃথিবীতে, তারা বেছে নিয়েছে প্রান্তভাগ। এখানেই ফোর্সটা সবচে বেশি।

আজকাল জর্জ আর জেরিই হেউড ফ্রয়েডের সবচে পুরনো বন্ধু। ব্যাপারটা মজার, কারণ তাদের মধ্যে মিল ছিল সামান্যই।

তুমি কি কখনো ডিভোর্সের কথা ভাবনি? সে মাঝেমধ্যেই খোঁচা দেয়ার ভঙ্গীতে প্রশ্ন করেছিল।

স্বভাবত জর্জও বাঁকা পথে জবাব দেয়। জর্জের কারণেই ক্লাসিক অর্কেস্ট্রা ফিরে এসেছে বিনোদনের জগতে।

ডিভোর্স-কখনোই না তারপর একটু থামে, খুন-কখনো কখনো।

অবশ্যই, সে কখনোই পালাবে না। ফোড়ন কাটে জেরি, সেবাস্টিয়ান বরং সিমগুলো ফেলে দিবে।

সেবাস্টিয়ান হল তাদের আনা তোতা পাখি, অনেক কষ্টে তাকে আনা গেছে। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সাথে বচসা করে। সে শুধু কথাই বলতে পারে না, বরং সিবেলিয়াস ভায়োলিন কনসার্তোও বাজাতে পারে মুখে মুখে। যে কাজে জেরি অর্ধশতাব্দী আগে অ্যান্টোনিও স্ট্রাভার্দির সাথে বিস্তর সুনাম কুড়িয়েছিল।

এবার জর্জ, জেরি আর সেবাস্টিয়ানকে বিদায় জানাবার পালা। হতে পারে মাত্র কয়েক হপ্তার জন্য, চিরদিনের জন্যও হতে পারে। এরই মধ্যে বাকী সবার সাথে বিদায় নেয়া হয়ে গেছে একটা পার্টি দেয়ার মাধ্যমে। হাসপাতালের মদের সেলারটাও বেশ। হাল্কা হয়ে গেছে সেই সুযোগে। তেমন কোনো কাজ আর বাকী নেই।

আর্চি, তার পুরনো মডেলের কার্যকর কমসেককে ভালমতো প্রোগ্রাম করা হয়েছে, সে ঠিকঠিক গুছিয়ে নিতে পারবে নতুন আসা মেসেজগুলোকে। বেশিরভাগের সুন্দর, ভদ্র জবাব পাঠিয়ে দেবে সাথে সাথে। বেশি গুরুত্বপূর্ণগুলো চলে যাবে ইউনিভার্সের বুকে।

এই এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও যদি যার সাথে ইচ্ছা কথা বলা না যায় তো ব্যাপারটা কেমন বেখাপ্পা ঠেকবে? অবশ্য ভাল দিকও আছে, যাকে অপছন্দ তাকে এড়ানো যাবে সহজেই। এতো দূর চলে যাবে ইউনিভার্স স্পেসশিপ যে আর সরাসরি কারো সাথে কথা বলা সম্ভব নয়। কারণ আলো যেতেই মিনিট-ঘণ্টা পেরিয়ে যাবে। কথা হবে টেলিটেক্সট অথবা রেকর্ডে।

আমাদের ধারণা ছিল তুমি আমাদের বন্ধু, অভিযোগ করছে জর্জ, তোমার পক্ষে কাজ করতে হবে আমাদের, অথচ রেখে যাচ্ছ না কিছুই।

দু একটা চমক তো তোমাদের জন্য থাকছেই, ক্যাবলা-হাসি দিয়ে বলল ফ্লয়েড, সাধারণ খবরগুলো দেখবে আর্চি। তোমরা শুধু দেখবে ও কিছু বুঝতে না পারলে, এই আরকি।

ও না পারলে আমরা কস্মিনকালেও পারব না। তোমার ওই ছাইপাশ সায়েন্টিফিক সোসাইটির মাথামুণ্ডু আমরা যে কী বুঝব আল্লা মালুম।

ওদের নিয়ে চিন্তা নেই আমার, নিজেদের আখের ভালই গোছাতে জানে। খেয়াল রেখ যেন ক্লিনার ঘরটাকে উজবুকের মতো আলুথালু করে না ফেলে। আর যদি ফিরে না-ই আসি তো এখানে কিছু ব্যক্তিগত জিনিস আছে, সেসব বিভিন্নখানে পৌঁছে দিতে হবে। বেশিরভাগই পারিবারিক।

পারিবারিক! কথাটা বলার মধ্যে যেন নিযুত দুঃখ এগিয়ে আসে, আর আসে অনেক অনেক সুখের স্মৃতি।

আজ তেষট্টি বছর ধরে… তেষট্টি বছর! ম্যারিয়ন নেই। সেই যন্ত্রণাময় বিমান দুর্ঘটনা! আর এর পরই একটু অপরাধী মনে হয় নিজেকে, যতটা উচিত ততটা বেদনাবোধ যেন তার নেই, কিংবা স্মৃতি অনেক অনেক পলেস্তারা বসিয়ে দেয় মানুষের মনে।

সে কি আজো বেঁচে থাকতো না? মাত্র একশ বছর বয়েস হত এতোদিনে। কাঁটায় কাঁটায়…

আর তার সেই দুই অতি আদুরে কন্যা আজ ধূসর চুল নিয়ে হাজির হয়, সাথে থাকে ছেলেমেয়ে, এবং নাতি নাতনী! তাদের নিজের। বয়েস তো ওদেরও কম হল না, ষাটের ঘর পেরিয়ে যাচ্ছে।

সেদিকে আছে নজন। আর্চির সহায়তা ছাড়া তাদের নামও ঠিকমতো মনে করা কঠিন। আর ভালবেসে হোক বা দায়িত্ববোধে- তারা প্রতি ক্রিসমাসেই তাকে মনে করে। জানে তার নাম।

অন্যদিকে আবার বিয়ে; প্রথম স্ত্রী হারানোর যন্ত্রণা মুছে যাওয়া; আবার বিচ্ছেদ-অর্ধশতাব্দী আগে; পৃথিবী আর বৃহস্পতির মাঝামাঝি কোথাও। কিন্তু আশা ছিল-ছেলেকে ফিরে পাবার আশা, স্ত্রীকে ফিরে পাবার আশা। কিন্তু দেখা হল ফিরে আসার পরে সবার জন্য দেয়া পার্টিতে। নিতান্ত পরিচিত একজনের মতোই! তারপর আর কী, অসাবধানতা, অবসাদ, ভরবেগের হিসাব ঠিক রাখতে না পেরে দোতলার বারান্দা থেকে পড়ে যাওয়া এবং সবশেষে, পাস্তুর।

কিন্তু পরের দেখাটাও কাজে লাগল না। বিস্তর খরচ করে কত চেষ্টা-তদ্বির! এই রুমেই, এই পারে। ক্রিস এরই মধ্যে বিশে পড়েছে, বিয়ে করেছে মাত্র। ফ্লয়েড আর ক্যারোলিনের মধ্যে একটা মাত্র মিল ছিল, ক্রিসের পছন্দকে পছন্দ না করা।

এরমধ্যে একটা ব্যাপারে হেলেনাকে বেশ সফল বলে মনে হল। সে ক্রিস টুর যত্ন-আত্তিতে কোনো অংশে কম নয়। ক্রিসদের বিয়ের মাসখানেক পরেই জন্ম নেয় ফ্লয়েডের নাতি। অন্য অনেকের মতো হেলেনাও কোপার্নিকাস দুর্ঘটনা য় বিধবা হয়। কিন্তু দিশেহারা হয়ে পড়েনি মেয়েটা।

কী অদ্ভুত মিল, ক্রিস আর ক্রিস টু দুজনেই মহাকাশে নিজেদের জনককে হারিয়েছে; দু পথে। ফ্লয়েড তার আট বছর বয়েসি ছেলের কাছে একেবারে অচেনা মানুষ হয়ে এসেছিল, কিন্তু ক্রিস টু তার জীবনের প্রথম দশকটায় নিজের বাবাকে দেখতে পেয়েছে চোখের সামনে, এই যা সান্ত্বনা।

কিন্তু এই দিনগুলোতে ক্রিস ছিল কোথায়? ক্যারোলিন বা তার তদানীন্তন বেস্ট ফ্রেন্ড হেলেনা, কেউ জানেনি কোথায় ছিল সে। পৃথিবীতে নাকি শূন্যে। শুধু ক্ল্যাভিয়াস বেস লেখা পোস্টকার্ড দেখে বোঝা গেছে যে সে চাঁদে প্রথমবারের মতো পা রেখেছে।

ফ্লয়েড এ কার্ডটাও আঠা দিয়ে বসিয়ে রেখেছে ডেস্কের উপর। ক্রিস টু যেমন রসিক ছিল তেম্নি ইতিহাসে ছিল তার অপার আগ্রহ। সে দাদুকে যে কার্ড পাঠিয়েছে সেটায় একটা কালো মনোলিথের ছবি, তার আশপাশে কয়েকজন স্পেসস্যুট পরা মানুষ। জায়গাটা চাঁদে। অর্ধ শতাব্দী আগের কথা।

ফ্লয়েড যে ছবিটা নাতির কাছ থেকে ক্রিসমাস কার্ড হিসেবে পেল সেটায় সে নিজেও আছে। এবং তখন, বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে, চাঁদের বুকে সেই কালো একশিলা স্তম্ভের কথা মানবজাতির একশ সদস্যও জানতো কিনা সন্দেহ। সে দলের বাকী সবাই আজ মৃত। আর মনোলিথটাও নেই সেখানে। ২০০৬ সালেই চাঁদ থেকে তুলে এনে জাতিসংঘ সদরদপ্তরের বিল্ডিংটার সামনে বসিয়ে দেয়া হয়। সে যেন সেই বিল্ডিংটারই প্রতিবিম্ব । চিৎকার করে যেন সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছে, আমি একা নই।

একা নয় মানবজাতি।

কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর, তারপরই লুসিফারের আলো ছিল কথাটা বলার জন্য।

আজকাল ফ্লয়েডের আঙুলগুলো যেন কথা শুনতেই চায় না। বিশেষ করে ডান হাতের আঙুলগুলোর যেন আলাদা স্বাধীনতা আছে কার্ড খেলার সময় বা পকেটে হাত ঢোকানোর সময়। এই একটা সমস্যাই সৃষ্টি হতে পারে ইউনিভার্সে তার যোগ্যতার ব্যাপারে।

মাত্র পঁচিশ দিন, আছ নাকি নেই তা আমরা বোঝার আগেই ফিরে আসবে। বলল জেরি, আর হ্যাঁ, শুনলাম অভিযানে নাকি দিমিত্রি তোমার সাথী হচ্ছে; আসলেই?

সেই ছোটখাট কসাক! বলল জর্জ, বাইশ সালের কথা মনে আছে, তার দ্বিতীয় সিফনীর ঝংকার।

না, না। ভুল করে বসেছ তোমরা। সেটা মাত্র দিমিত্রি, মাইকেলোভিচ নয়। আর…

যাই হোক, অন্যজনতো? আমি তার কথাই বলছি। রাস্কেলটাকে আমার ভালবাসা দিও। আর জিজ্ঞেস করো ভিয়েনার কথা তার মনে আছে কিনা, সেই রাতের কথা। আর কে কে থাকছে তোমার সাথে?

আমি জোর গুজব শুনলাম, প্রেসের পান্ডারাও নাকি ভিড় জমাবে? জেরি চিন্তার ভাণ করে বলল।

চিন্তার কারণ নেই। যারাই হই না কেন, আমরা সবাই আমাদের বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সৌন্দর্য, আরও নানাবিধ মানবিক-অতিমানবিক-অমানবিক গুণাবলীর কারণে স্যার লরেন্সের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছি। পোশাকি সুরে বলে চলল ফ্লয়েড।

আর কর্মক্ষমতা?

যাক, প্রসঙ্গটা যখন তুললেই, আমি আসলে যাচ্ছি বেশ কিছু শর্তসাপেক্ষে। আমরা প্রত্যেকেই কিছু কাগজ জমা দিয়েছি। আমারটাও আছে।

আমরা কি সেটা পেতে পারি কোনোও সুযোগে? আশা করে জর্জ বলল ।

সুং আমাকে হ্যালি পর্যন্ত নিয়ে যেতে, ফেরত আনতে এবং পথে খাবার-দাবার দিতে ও দেখার জন্য একটা জানালা সহ ঘর দিতে রাজি হয়েছে।

আররাহা খরচের বিনিময়ে?

ফিরে আসার পর ভবিষ্যতের অভিযান যাতে চলে সেসব পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। লিখতে হবে কিছু প্রবন্ধ, খুবই প্রাসঙ্গিক হতে হবে সেসব । যাতে সারা জীবনের জন্য কাজে লাগে। ও, আরো একটা ব্যাপার, আমি আমার সঙ্গীদের এক আধটু বিনোদনও দিব।

কীভাবে? নেচে-গেয়ে?

ভাল কথা, এককালে নেচেছি গেয়েছি বৈকি। কিন্তু প্রফেশনালদের সাথে পাল্লা দেব সে ক্ষমতা কি আর আছে? ও, তোমরা তো জানো না, শিপে ইভা মারলিনও থাকবে।

কী? ওকে কেমন করে পার্ক এভিনিউর গরাদ থেকে বের করে আনল?

ওতো নিশ্চই একশ এবং…উফ, কী হল? খোঁচান ক্যান ভাইসাব?

যেন আহত হয়েছে ফ্লয়েড, বেচারির বয়স সত্ত্বর, পাঁচ যোগ বা বিয়োগ করতে পার, মিস্টার।

বিয়োগটা ভুলে যাও, নেপোলিয়ান মুক্তি পাবার সময় আমি ছোট ছিলাম।

এবার বেশ লম্বা বিরতি। তিনজনেই স্মৃতি মন্থনে মগ্ন। কোনো কোনো সমালোচকের মতে তার পরিচয়ের জন্য স্কারলেট ওহারা চরিত্রটাই মানানসই ছিল। কিন্তু সাধারণ্যে সেই ইভা মারলিন আজো জোসেফাইন রূপেই নমস্য। বেচারীর জন্ম হয় সাউথ ওয়ালেসে, ইভিলিন মাইলস নামে। অর্ধ শতাব্দী আগে ডেভিড গ্রিফিনের অমর মহাকাব্য ফরাসী আর ব্রিটিশ রসিকদের উদ্বেলিত করেছিল দারুণভাবে। আজ তারা সবাই মানে যে তার কাজগুলোতে ক্লাসিকের কিছু গুবলেটও মিশানো থাকত।

এতো স্যার লরেন্সের বিলাসিতা। বলল জর্জ, সেই চিন্তান্বিত মুখেই।

মনে হয় আমিও কিছুটা গর্ব পেতে পারি এ ব্যাপারে। তার বাবা ছিল একজন অ্যাস্ট্রোনোমার, কাজ করেছিল আমার সাথে কিছুদিন। মেয়েও বিজ্ঞানে অনেক আগ্রহ রাখে। সুতরাং আমি বেশ কিছু ভিডিও কল করেছিলাম তাকে।

ফ্লয়েড ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কথাগুলো বলা দরকার কিনা। কিন্তু কথাতো সত্যি, সে জি ডব্লিউ এম টির মার্ক টুর আমলে এই মেয়ের প্রেমে পড়েছিল।

অবশ্যই, বলে চলে সে, স্যার লরেন্স খুব আনন্দে ছিল তখন। কিন্তু আমিই তাকে বিশ্বাস করিয়েছি যে অ্যাস্ট্রোনোমিতে তার সাধারণ আগ্রহই শুধু নেই, আছে আরো বেশি কিছু। ভয়েজটা এক ঘেয়েমিতে ভরে উঠত এমন কেউ না থাকলে।

আর এ কথাটাই মনে করিয়ে দিল যে, নাটকীয়ভাবে জর্জ পেছন থেকে একটা প্যাকেট বের করে বলল, একঘেয়েমি কাটাতে তোমার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে ছোট্ট এক উপহার আছে।

এখন ভোলা যাবে? খুলব?

কী মনে হয়? এখানে খোলা উচিত হবে তার? জেরি বেশ ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন তোল।

তাহলেতো অবশ্যই উচিত বলেই খুলে ফেলল রিবনটা।

ভেতরে চমৎকার ফ্রেমবন্দী এক পেইন্টিং। ফ্লয়েড আর্ট সম্বন্ধে খুব একটা না জানলেও এটা সম্পর্কে ভালমতোই জানে। কে না দেখেছে?

ঢেউয়ের দোলায় টলায়মান ফেনা, অর্ধনগ্ন পরিবেশ, দূরে-একমাত্র অলঙ্কার একটা জাহাজ। নিচে লেখা:

দ্য র‍্যাফট অব দ্য মেডুসা
(থিওডোর গেরিক্যাল্ট, ১৭৯১-১৮২৪)

তার নিচে জেরি আর জর্জের লেখা, সে পর্যন্ত পৌঁছুলেই আধা মজা মাত্র পাওয়া হবে…।

ফাজিলের মানিকজোড়, কিন্তু ভালবাসি তোমাদের, অসম্ভব ভালবাসি। জড়িয়ে ধরল ফ্লয়েড তাদের। আর্চির কিবোর্ডে এ্যটেনশন লাইট জ্বলছে। সময় এসেছে যাবার।

বন্ধুদের পেছনে ফেলে, সামনে গেল সে, শেষবারের মতো হেউড ফ্লয়েড তার ঘরের চারদিকে চোখ বোলাল, ছোট্ট একটা ঘর, তার অর্ধেক জীবনের ইউনিভার্স।

আর হঠাৎ করেই তার সেই কবিতার শেষটা মনে পড়ে গেল। একেবারে হঠাৎ করেই:

সুখে ছিলাম আমি। এবার যাচ্ছি, যাচ্ছি চলে।

৮. তারকা বহর

স্যার লরেন্স মোটেও আবেগকে প্রাধান্য দেয় না, আর কাজের ক্ষেত্রেও জাতিভেদ তার মাথায় আসে না। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাজুয়েট হওয়াতে শিল্প-সংস্কৃতির তৃতীয় অভ্যুত্থান তেমন নাড়া দিতে পারেনি তার মনোজগতে। কিন্তু একটা বিশেষ বয়সে জিয়াংয়ের দুর্ঘটনায় মনে বেশ ছাপ পড়েছিল। স্পেসের প্রতি বাড়তি দুর্বলতার শুরু সেখান থেকেই।

অনেক আগে থেকেই সে মাঝে মধ্যে চাঁদে বেড়াতে যেত। এখন তার বত্রিশ মিলিয়ন সোল পুত্র চার্লসকে সুং অ্যাস্ট্রোফ্রাইটের ভাইস প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটা তেমন কিছু করতে পারেনি, দুটো উৎক্ষেপণ ছাড়া। এর ফলে চার্লস একটা কথা ভালমতো বুঝেছে যে আগামী দশকগুলোতে এর ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী । অবশেষে সত্যি সত্যি স্পেস এজ বা মহাকাশ যুগ এগিয়ে আসছে।

মাত্র আধ শতাব্দীর কিছু বেশি সময় নিয়ে মানুষ রাইট ব্রাদারের পুরনো আশীর্বাদ ছেড়ে কার্যকর এরোপ্লেনের সুফল ভোগ শুরু করে। আর এ থেকে উত্তরণের জন্য, সৌর জগতের প্রান্তসীমা ছুঁড়ে ফেরা শুরু করার জন্য লেগেছে এরও দ্বিগুণ কাল।

লুইস আলভারেজ ১৯৫০ এর দশকে তাঁর দলবল নিয়ে আবিষ্কার করেন মিউওন-ক্যাটালাইজড ফিউশন এর পদ্ধতি। সেদিন ব্যাপারটাকে খরুচে ল্যাবরেটরি-আগ্রহ কিম্বা স্রেফ তত্ত্ব ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। ঠিক মহান বিজ্ঞানী রাদারফোর্ডের আবিষ্কারের মতো। তিনিও নিশ্চিত ছিলেন না তা আবিষ্কারের কার্যকারিতার ব্যাপারে। শীতল নিউক্লিয়ার ফিউশন আদৌ কাজে লাগবে তো? তারপর হঠাৎ করেই ২০৪০ সালের দিকে স্থিত মিউওনিয়াম-হাইড্রোজেন যৌগগুলো আবিস্কৃত হয়ে মানুষের ইতিহাসে নূতন অধ্যায়ের সূচনা করে। যেমন হঠাৎ করে নিউট্রনের আবিষ্কার মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল আণবিক যুগের দিকে।

আজ সহজেই বহনযোগ্য আণবিক শক্তি স্থাপনা গড়া যায়; খুব বেশি প্রতিরক্ষা বর্মের প্রয়োজনও নেই। এর ফলাফল একেবারে প্রথমেই বিশ্ব বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে পড়েনি; পড়ে যায় স্পেস সায়েন্সের উপর। এর সাথে একটা ব্যাপারেরই তুলনা চলে-উড়োজাহাজের যুগ থেকে রকেটের যুগে প্রবেশের স্মরণীয় ঘটনা।

প্রোপ্যাল্যান্টই মহাকাশ যাত্রায় সবচে বড় সমস্যা; সব সময়। সেই আদ্দিকালে বিশাল বিশাল প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্কের আড়ালে ঢাকা পড়ে যেত মূল যান, এক রত্তি দেখা যেত সেগুলোকে। আর গতিও ছিল ঢিমে তাল। এমনকি ডিসকভারিতেও চুল্লী আর শীতলীকরণ এলাকাটাই আশিভাগ দখল করে রেখেছিল। আর আজ মূল যানটাই সব। অন্যদিকে এখন যাত্রাকাল বছর কিংবা মাসের বদলে সপ্তাহে এসে ঠেকেছে। কিন্তু মিউওন ড্রাইভ আজো রিয়্যাকশন ডিভাইস। তাই চিরাচরিত রকেটগুলোর প্রথম ধাক্কার জন্য কিছু কার্যকর তরলের প্রয়োজন পড়ে। আর কাজের জন্য সবচে সরল, সস্তা, নির্ভেজাল, সহজলভ্য তরল জিনিস হল খাঁটি পানি।

প্যাসিফিক স্পেসপোর্টে এ জিনিসের অভাব পড়ার কথা না। পরের বন্দরে ব্যাপারগুলো উল্টে যায়। সার্ভেয়র, অ্যাপোলো আর লুনা মিশনগুলোয় চাঁদে এক ফোঁটা পানির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। আর যদি কোনোকালেও দু চার ফোঁটা পানি থেকে থাকত চাঁদে-অসীম সময়ের মহাজাগতিক বিস্ফোরণে বিস্ফোরণে সেটুকু উবে গেছে পুরোপুরি।

অথবা এটা চান্দ্রবিদ বা সেলেনোলজিস্টদের বিশ্বাস। এই চেঁচামেচি আর রহস্যের শুরু প্রথম যেদিন গ্যালিলিও গ্যালিলি চাঁদের দিকে তাঁর টেলিস্কোপ ফেরান সেদিন থেকেই। কারণ কিছু কিছু চান্দ্র পর্বত এমনভাবে আলো ছড়ায়, যেন মাথায় বরফ-কিরীটি নিয়ে বসে আছে। আধুনিক অ্যাস্ট্রোনমির জনক উইলিয়াম হার্শেল মহা ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন অ্যারিস্টার্কাস পর্বতের বিরাট জ্বালামুখটার দেদীপ্যমান রূপ দেখে; নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন চাঁদে অগ্নি উদগীরণ হচ্ছে। তার উপর সময়টা রাতের। কিন্তু এখানেও ভুল হয়েছিল। তিনি তিনশো ঘণ্টায় জমে ওঠা পাতলা চকচকে কিছু দেখেছিলেন জ্বালামুখটায়। আর তার থেকে যে আলো ঠিকরে বেরুচ্ছিল তা পৃথিবী থেকেই আসা।

কিন্তু অবশেষে হতাশা থেকে বাঁচা গেল। চাঁদের গভীরে এক বিশাল বরফ স্তর আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই মহাকাশ ভ্রমণের বাধা আরো কমে যায়।

সুং নৌবহরের প্রথমটির নাম কসমস। সে মানুষ আর জিনিসপাতি বহন করে পৃথিবী-চাঁদ-মঙ্গল রুটে। একই সাথে পরীক্ষা চলছে মিউওন ড্রাইভের। এটা নির্ভেজাল চলতে থাকলে ড্রাইভটা স্বীকৃতি পাবে ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান আর সরকারের কাছে। কারণ কসমসের সাথে হাজারো রকমের চুক্তি হয়েছে তাদের। ইম্বিয়াম শিপইয়ার্ডে জন্মাবার পর সে শুধু চাঁদের মাধ্যাকর্ষণটুকু কাটিয়ে উড়ে যাবার ক্ষমতা পেয়েছে। তাও আবার বিনা ভারে। আর কোনোকালেই সে কোনো ভূমি স্পর্শ করবে না। অর্কিট থেকে অর্বিটে ঘুরবে, গ্রহ থেকে গ্রহে। অনেকটা বিজ্ঞাপন হিসেবেই স্যার লরেন্স এটাকে স্পুটনিক দিবসের শততম বার্ষিকীতে মহাকাশে পাঠায়। দিনটা ছিল চৌঠা অক্টোবর, দু হাজার সাতান্ন।

দু বছর পরেই কসমসের আরেক বোনের জন্ম হয়। গ্যালাক্সির জন্ম পৃথিবী বৃহস্পতি পথ ধরে চলার জন্য। সে আরো ক্ষমতা রাখে, নিয়মিত বৃহস্পতীয় চাঁদগুলোয় নামতে এবং উঠতে পারবে, বেশ খানিকটা পে-লোড সহ! এমনকি প্রয়োজনে একটু চিকিৎসা নিতে তার জন্মস্থান চাঁদের বুকেও নেমে যেতে পারবে।

মানুষের বানানো সর্বকালের সবচে গতিময় বাহন সে। সবটুকু প্রোপ্যাল্যান্ট এক ধাক্কায় পুড়িয়ে দিলে প্রতি সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে যেতে পারবে। অবিস্মরণীয় গতি! বৃহস্পতি-পৃথিবী ট্রিপ সম্ভব মাত্র এক সপ্তাহে, দু বছর নয়। আর এই অবিস্মরণীয় গতিতে নিকটতম নক্ষত্রলোকে যেতে লাগবে হাজার বছরের কিছু বেশি সময়।

এ নৌবহরের তৃতীয়জনই স্যার লরেন্সের সমস্ত বিজ্ঞানীকুলের সব দরদ ঢেলে তৈরি করা ক্ষণজন্মা মহাকাশ অগ্নিরথ, ইউনিভার্স। দু বোনের সমস্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতার সাথে সাথে বিজ্ঞানের অগ্রগতি যুক্ত হয়েছে তার সারা গায়ে, অলঙ্কারের মতো।

পৃথিবী থেকে সৌর জগতের হীরা শনির দিকে সেই প্রথম যাত্রীবাহী রণপোত।

স্যার লরেন্সের ইচ্ছা ছিল এর উদ্বোধনে আরো বিচিত্র কিছু করার। কিন্তু কিছু বিদঘুঁটে আন্দোলনের কারণে নির্মাণ পিছিয়ে যায়; কয়েকটা টেস্ট ড্রাইভের পর লয়েডস এর সার্টিফিকেট নিতে নিতে দু হাজার ষাটের শেষ মাস এসে পড়বে। কিন্তু আফসোস, হ্যালির ধূমকেতু তো আর অপেক্ষা করবে না, এমনকি স্যার লরেন্স সুংয়ের জন্যও নয়।

৯. দেবরজের পর্বত

ইউরোপা-৬ পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ পনের বছর ধরে অর্বিটে ঝুলে আছে। অবশ্য এর প্রত্যাশিত আয়ু এরই মধ্যে ফুরিয়ে গেছে একেবারে; কিন্তু কাজ চলায় একে সেখানেই রাখা হবে, নাকি অন্য একটা বসানো হবে তা নিয়ে গ্যানিমিডের ছোট্ট সায়েন্টিফিক এস্টাবলিশমেন্টে একটু কথাবার্তার ঝড় উঠবে এই যা।

এতে চিরাচরিত জিনিসপাতি ঠাসা ছিল। যেমন আজকাল অচল হিসেবে বিবেচিত ইমেজিং সিস্টেম। তবু বিজ্ঞানীরা ইউরোপার সদা অপরিবর্তিত মেঘের দল ভেদ করার লক্ষ্যে সেটাকেই তরতাজা রাখে। বর্তমানে কুইক লুক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক সহজে পৃথিবীর পথে ডাটার প্রবাহ পাঠানো যাচ্ছে প্রতি সপ্তাহে। তাই ওরা বরং স্বস্তি পাবে যদি ইউরোপা-৬ তার অপ্রয়োজনীয় তথ্যভাণ্ডার খালি করে আর সামনে না এগোয়, যদি অকেজো হয়ে যায়।

কিন্তু এখন, এ্যাত্তোদিন পরে, প্রথমবারের মতো শিউরে দেয়া কিছু কাজের কাজ করল সে।

অরবিট ৭১৯৩৪, বলল ডেপুটি চিফ অ্যাস্ট্রোনমার, রাতের পাশ থেকে এগিয়ে আসছে, সরাসরি মাউন্ট জিউসের দিকে। অবশ্য আগামী দশ সেকেন্ড কিছুই দেখতে পাবেন না।

ভ্যান ডার বার্গ দেখল স্ক্রিনটা পুরোপুরি কালো । অবশ্য কল্পনা বশ মানছে না। মেঘের ছাদের হাজার কিলোমিটার নিচে বরফের মহাসাগর দিব্যি চোখে ধরা দেয়। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দূরের সূর্য দেখা যাবে। এদিকে ইউরোপা ঘুরে গেছে আরো একপাক। প্রতি সাত পৃথিবী-দিনের পর পরই ঘোরে। রাতের পাশ না বলে আসলে গোধূলী পাশ বলাই ভাল। অর্ধেক সময় শুধু হাল্কা আলো ছিল, তাপ নয়। কারণ এর অন্য অর্থ আছে, ইউরোপা সূর্যোদয় চেনে, লুসিফারোদয় নয়।

আর এগিয়ে আসছে সেই দূরের সূর্য, সৌরজগতপতি; মিলিয়ে যাচ্ছে আঁধার।

এতো হঠাৎ আলোর ঝলকানি এলো যেন কোনো আণবিক বিস্ফোরণ হয়েছে। সেখানে। এক সেকেন্ড না পেরুতেই রঙধনুর সবগুলো রঙ পেরিয়ে উজ্জ্বল সাদার বন্যা তলিয়ে দিল সবকিছু। কারণ সূর্য এবার উঠে এসেছে পাহাড় পেরিয়ে। তারপর হারিয়ে গেল। অটোম্যাটিক ফিল্টারগুলো সার্কিট কেটে দিয়েছে।

এই সব। আফসোস, সেখানে কোনো অপারেটর ডিউটিতে নেই। সে ক্যামেরাটা প্যান করে নিচের দৃশ্য স্পষ্ট ধারণ করতে পারত। সার্কিটও বন্ধ রাখা যেত তাহলে। আমি জানি আপনি জিনিসটা দেখতে চান, যদিও তাতে করে আপনার থিওরির গুড়ে বালি লেপ্টে যাবে।

কী করে? বিরক্ত হওয়ার চেয়ে ধাঁধায় পড়ে গেছে ভ্যান ডার বার্গ।

দৃশ্যটুকু স্লো মোশনে দেখলে বুঝবেন। এই সৌকর্যময় রঙধনুগুলো বায়ুমণ্ডলের ফল নয়, বরং স্বয়ং পাহাড়ের কারসাজি। শুধু বরফের পক্ষেই এমন দৃশ্য তুলে আনা সম্ভব, আর নাহলে কাঁচ দরকার। কাঁচটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক, কী বলেন?

অসম্ভব নয়, আগ্নেয়গিরি থেকেও গলিত কাঁচ সৃষ্টি হয়, কিন্তু ওগুলো সাধারণত কালো রঙের…অবশ্যই!

মানে?

তথ্য না পেলে আমি কোনো দাবী করব না। কিন্তু আশা করি আমার ধারণাটা একেবারে স্বচ্ছ। ওটা স্বচ্ছ কোয়ার্টজের সৃষ্টি নয়তো? এ দিয়ে সহজেই প্রিজম আর লেন্স বানানো যায়। আরো অবজার্ভেশনের সম্ভাবনা আছে কি?

মনে হয় না। একেবারে ভাগ্যগুণে এবার পেরেছি। ভাগ্য আর কাকে বলে, সূর্য, পাহাড়, ক্যামেরা সব একই সাথে এসেছে। তার সাথে ছিল মেঘহীন আকাশ। দুর্লভ; সত্যি, হাজার বছরে আরেকবার এ সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না আর।

“থ্যাঙ্কস, এনি ওয়ে, আপনি কি একটা কপি পাঠাতে পারবেন? তাড়াহুড়োর কিছু নেই। পেরিনের দিকে একটা ট্রিপে বেরুচ্ছি, না ফিরে চোখ বুলাতে পারব না।

ভ্যান ডার বার্গ একটা ছোট, সুন্দর হাসি দিল।

ইউ নো, সেটা যদি সত্যি সত্যি রক ক্রিস্টাল হয়ে থাকে তো আমাদের নানা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনকি বেতন নিয়ে গণ্ডগোলটাও কেটে যাবে সই করে…

কিন্তু ভাবনাটা একেবারেই ছেলেমানুষী। কবেইতো মানা করে দেয়া হয়েছে, সবখানে যাও তোমরা, এখানে নয়। পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। এমন কোনো লক্ষণ প্রকাশিত হয়নি যাতে বোঝা যাবে যে নির্দেশটা আর বহাল নেই।

১০. বোকার স্বর্গ

অভিযানের প্রথম আটচল্লিশ ঘণ্টা পর্যন্ত হেউড ফ্লয়েডের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না কোনোকিছুই; ধূমকেতু, ইউনিভার্স আর এর জীবনপদ্ধতি, সবই যেন অবিশ্বাস্য। এরই মধ্যে তার সহযাত্রীদল আনন্দে আটখানা। যারা কোনোদিন পৃথিবী ছাড়েনি এর আগে, তারা মনে করে স-ব স্পেসশিপ অবশ্যই এমন হতে হবে। হওয়াটা উচিত।

কিন্তু সে এতো কাঁচা নয়, অ্যারোনটিক্সের ইতিহাস ঘাঁটতে হবে তাকে। তার জীবদ্দশায়ই কত শত উত্থান-পতন! নিজেই পেছনের সেই জ্বলজ্বলে গ্রহটার উড্ডয়নবিদ্যায় কতশত নূতনত্বের স্বাদ যে নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই পুরনো লিওনভ আর এই তারুণ্যমাখা ইউনিভার্সের মধ্যে পড়ে আছে কাঁটায় কাঁটায় পঞ্চাশটা বছর। আবেগিক দিক দিয়ে সে ঠিক বিশ্বাস করতে চায় না কথাটা, কিন্তু কী করা, বিধি বাম, এই ছিল কপালে।

সেই রাইট ব্রাদারদের যুগ, তার আধ-শতক কাটতে না কাটতেই রকেটের তর্জন-গর্জন, তার পর পরই একের পর এক ফুয়েল-উন্নয়ন! অবিস্মরণীয়। আর এখন সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটার। কিন্তু মাঝের বিশাল সময়টাও বিবেচ্য।

তাই, হয়তো, তার উচিত ছিল না আশ্চর্য হওয়া। হোক না ঘরটা অতি সুন্দরভাবে সাজানো, এমনকি এই সাজানো ঠিক রাখার জন্য একজন কাজের লোক থাকলেও অবাক হওয়ার মতো কী হল? জানালার বাহারও দেখার মতো। আর ঘরতো ঘর নয়, প্রকাণ্ড স্যুইট। ভেতরে টনকে টন বাতাসের চাপ থাকলেও তার মন পড়ে থাকে বাইরে, নিঃসঙ্গ শূন্যতায় ।

আধুনিক সাহিত্য তার মনকে ব্যাপারটার জন্য প্রস্তুত করেছিল, তবু, মাধ্যাকর্ষণের স্বচ্ছ উপস্থিতি যেন কেমন ভড়কে দেয়। ইউনিভার্স মানবেতিহাসে প্রথম স্পেসশিপ যা একবার ধাক্কা দিয়ে সারা পথ চলবে না বরং, নিয়মিত ত্বরণে গতিবৃদ্ধি চলতেই থাকবে মাঝখানের সামান্য তুনা রাউন্ড বাদ দিয়ে।

তার দানবাকার প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্কে পাঁচ হাজার টন পানি পূর্ণ করে নিয়েও এক দশমাংশ জি তোলা সম্ভব হয়। মোটামুটি ভালই বলা চলে, কিন্তু তার পরও নতুন যাত্রীদের নড়াচড়ার রীতি আর স্যুপ খাবার সময় আস্তে চামচ তোলার কায়দা রপ্ত করার পথে হোঁচট খেতে খেতে কদিন কেটে গেছে ।

এরই মধ্যে ইউনিভার্স তার বুকের মানুষদের চার শ্রেণীতে ভাগ করে নিয়েছে।

আভিজাত্যের শুরু ক্যাপ্টেন স্মিথ আর তার অফিসারদের থেকে, পরের শ্রেণীতে আছে যাত্রীরা; এরপরই নন কমিশন্ড আর সাধারণ ক্রুরা। সবশেষে …।

এই বাস্তব কৌতুকটা প্রথমদিকে পাঁচ তরুণ মহাকাশ বিজ্ঞানী নিজেদের জন্য ঠিক করেছিল, পরে ব্যাপারটা বেশ তিক্ত হয়ে পড়ে। ফ্লয়েডের সুইটের সাথে তাদের ছোট্ট কোয়ার্টারের বিস্তর তফাৎ। ব্যাপারটা ক্যাপ্টেনের চোখে তুলে ধরা ছাড়া উপায় ছিল না।

শিপকে প্রস্তুত করতে হয়েছে শেষ মুহূর্তে, চট-জলদি করে। কারণ হ্যালির জন্যে সে আরো পৌণে শতাব্দী নাও টিকতে পারে। তাই আবাসনের জটিলতা হতেই পারে।

আর সায়েন্টিফিক টিমের তো হাজারো কাজ করার আছে, শিপের বাইরে যাওয়া, হ্যালির বুকে নামা, আরও কত ঝক্কি-ঝামেলা। তাছাড়া এই অভিযানের গুরুত্বও তো তারা জানে, তাই না? প্রথম ধাক্কায় একটু খারাপ লাগতেই পারে।

একটু আবেগ আর উচ্ছ্বাস বেরিয়ে আসে সেসব তরুণের বুক থেকে। তাদের গুঞ্জন তোলা ভেন্টিলেশন সিস্টেম, দমবন্ধ হয়ে যাওয়া কেবিন আর অজানা পদের বিশ্রী গন্ধ নিয়ে আরো হাজারো অভিযোগ করার আছে।

কিন্তু খাবার নিয়ে টু শব্দও নয়। এক কথায় চমৎকার। অনেক ভাল, বলল ক্যাপ্টেন, অন্তত বিগলের বুকে ডারউইন যেমনটা খেয়েছিলেন তার চেয়ে।

এ নিয়ে ভিক্টর উইলিস বলেছিল, তিনি কি আর জানতেন ইতিহাসে বিগল কোথায় গিয়ে ঠেকবে? বিলাস আসবে কোত্থেকে? আমরা আমাদের অভিযানের সাথে ইতিহাসের যোগসূত্র জানি। আর, বাই দ্য ওয়ে, জানা থাকলে বিগলের কমান্ডার ইংল্যান্ডে ফিরে নিজের গলাই কেটে ফেলত।

ব্যাপারটা ভিক্টরের কাছে যথেষ্ট চিন্তার। তিনি ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী অথবা পপ-বিজ্ঞানী, তার ভক্ত শ্রোতাদের সামনে। তার মধ্য-প্যাসিফিক উচ্চারণ, ক্যামেরার সামনে ব্যয়বহুল হস্ত-সঞ্চালন অনেক কৌতুকের কারণ ছিল। তার উপর বিরাট দাড়ির বহর ছিল দর্শনীয়।

যে লোক এতো লম্বা চুল-দাড়ি গজাতে পারে, বলত সমালোচকের দল, সে লুকাতেও জানে বিস্তর।

ছজন ভি আই পির মধ্যে সে-ও একজন, কিন্তু ফ্লয়েড নিজেকে ঠিক সেলিব্রিটি মনে করে না। বরং বাকীদের ডাকে দ্য ফেমাস ফাইভ নামে। ইভা মারলিন খুব দুর্লভ সময়গুলোয় নিজের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে পার্ক এভিনিউর নির্জন প্রান্ত ধরে কখনো-সখনো হাঁটতেও পারে। দিমিত্রি মাইকেলোভিচ তার ক্ষুদ্র উচ্চতার জন্যই হয়তো হাজার খণ্ড অর্কেস্ট্রার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে।

ক্লিফোর্ড গ্রিনবার্গ আর মার্গারেট মবালাও অচেনা বিখ্যাত তালিকায় পড়ে-অবশ্য পৃথিবীতে ফেরার সাথে সাথেই ব্যাপারটা আমূল বদলে যাবে। মার্কারিতে পা রাখা প্রথম মানব চেহারা-সুরতে তেমন আহামরি কিছু নয় যে তাকে তেমন আলাদাভাবে মনে রাখা যাবে। তার উপর খবরের জগতে রাজত্ব চালানোর কালটা চলে গেছে বছর ত্রিশেক আগেই। অন্যদিকে, যেসব লেখক সাক্ষাৎকার, টক-শো আর অটোগ্রাফ দেয়ার নেশায় আসক্ত নয়, তাদের মধ্যে মিসেস মবালা তার লাখ লাখ পাঠকের মনে কাজের মধ্য দিয়েই চির জাগরূক হয়ে থাকবে।

চল্লিশের দশকে তার সাহিত্যকর্ম বেশ নাড়া দিয়েছিল। যথারীতি এ স্কলারি স্টাডি অফ দ্য গ্রিক প্যান্থিয়ন বেস্ট সেলারের লিস্টে কামড়াকামড়ি করেনি, কিন্তু মিসেস মবালা এ বইয়ের অন্তর্নিহিত আর আবেগকে, ঐতিহ্যকে একটা আনকোরা যুগের সন্ধিক্ষণে, মহাকাশ যুগের প্রারম্ভে প্রকাশ করেছিল। এক শতাব্দী আগে যে নামগুলো শুধু অ্যাস্ট্রোনমার আর চিরায়ত মেধাবীদের কাছে পরিচিত ছিল তা আজ প্রতিটি শিক্ষিত মানুষের দুনিয়ার এক অংশ। প্রতিদিনই দু-চারটে খবর আসবে গ্যানিমিড, ক্যালিস্টো, আইও, টাইটান, বৃহস্পতি… এমনকি আরো নির্জন দুর্গম সব এলাকা থেকে ক্যারমে, প্যাসিফা, হাইপেরিয়ন, ফোবস… [**দেখুন: প্রাসঙ্গিক টিকা]

তার বই শুধু সার্থকই হয়নি বরং মানুষকে ফিরিয়ে দিয়েছে তার পুরনো ঐতিহ্যের ছোঁয়া। প্রকাশ করেছে জুপিটার-জিউসের পারিবারিক কাহিনী যিনি ছিলেন সব দেবতার পিতা। এমনকি সম্পাদকরা এ-ও বলেছিল যে, তার দ্য ভিউ ফ্রম অলিম্পাস, টু দ্য প্যাশন্স অফ দ্য গডস এর মতো একটা লেখা লিখতে পারলে তারা সার্থক হত।

যাত্রীদের একজন শিপটাকে বোকাদের জাহাজ বলে বেড়ায়। ভিক্টর উইলিস ব্যাপারটার সাথে শতাব্দী-পুরনো এক ঘটনার মিল খুঁজে পেয়েছে। কয়েকজন বিজ্ঞানী আর লেখককে সাথে নিয়ে ক্যাথরিন এ্যান পোটার পাল তুলে দিয়েছিল সমুদ্রে; এ্যাপোলো ১৭ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে চান্দ্র অভিযানের প্রথম অধ্যায়ের পতন দেখার জন্য।

ব্যাপারটা মনে রাখব। মবালা বলল, তৃতীয় দৃষ্টি দেয়ার আসল সময় হয়তো এখুনি, তবে ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হবে পৃথিবীতে ফেরার পর…

১১. মিথ্যা

কয়েক মাস আগেই রালফ ভ্যান ডার বার্গ দ্বিতীয়বার মাউন্ট জিউসের দিকে চোখ তুলে মনোযোগ দেয়ার এনার্জি খুইয়ে বসেছে। গ্যানিমিডকে বশ । মানানোটাই ফুল টাইম জবের চেয়ে বেশি কিছু। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো সে এই ফুল টাইম জব করেও হপ্তার পর হপ্তা মূল এলাকা দার্দানাস বেসের বাইরে থেকে প্রস্তাবিত গিলগামেশ-ওসিরিস মনোরেল নিয়ে টানা-হেঁচড়া করে বেড়ায়।

গ্যালিলীয় জগতের তৃতীয় উপগ্রহের ভূগোল উল্টে গেছে বৃহস্পতির রূপ বদলের সাথে সাথে। বদলাচ্ছে আজো। নূতন সূর্যটা ইউরোপার বরফ গলিয়ে দিলেও তার দৈবতেজ এখানেও সমান নয়, কারণ চার লক্ষ কিলোমিটার দূরত্ব। কিন্তু সারাক্ষণ সূর্যটার দিকে মুখ করে থাকা অংশকে চলনসই উত্তাপ দিয়ে যেতে পারে।

উপগ্রহের এখানে-ওখানে ছোট ছোট অগভীর সমুদ্র। কোনো কোনোটা দুনিয়াবী মেডিটারিয়ানের মতো বড়। বিংশ শতাব্দীতে করা ভয়েজার অভিযানগুলোর চোখ থেকে খুব বেশি এলাকা বাঁচেনি, তাই আগের দিনের মানচিত্র ছিল প্রায় পূর্ণ এবং সে মানচিত্রও বদলে গেছে আমূল। আজো বদলাচ্ছে, দেদার। গলতে থাকা পার্মাফ্রস্ট, তাপে দ্রুত হওয়া টেকটোনিক প্লেটের চলন, তার উপর দু পাশের অভ্যন্তরীণ উপগ্রহের সমান জোয়ার-শক্তি প্রতিনিয়ত উপগ্রহটাকে এমনভাবে উল্টেপাল্টে দেয় অহর্নিশি যে মানচিত্রকারদের দুঃস্বপ্ন দেখতে আর বাকী নেই।

কিন্তু এই একই ব্যাপার উল্টে গেছে, প্ল্যানেটারি ইঞ্জিনিয়াররা এখন আহ্লাদে আটখানা। এ যেন তাদের জান্নাতুল ফেরদৌস। রুদ্র, অসভ্য, পুরনো মঙ্গলকে হিসাবের বাইরে রাখলে এ-ই সে মহাজাগতিক এলাকা যেখানে একদিন মানুষ চড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখতে পারে; খোলা বাতাসে বুক ভরে নিয়ে। গ্যানিমিড়ে আছে প্রচুর পানি, জীবনের সব রাসায়নিক উপাদান, আর লুসিফার যখন মন-মর্জি ভাল রাখে তখন পৃথিবীর চেয়েও ভাল আবহাওয়ার দেখা পাওয়া যায়।

সবচে বড় আশীর্বাদ, সারা শরীর মুড়ে নিয়ে স্পেসস্যুট পরার কোনো দরকার নেই। আজো পরিবেশের বাতাস টেনে নেয়া নিরাপদ না হলেও শুধু একটা মাস্ক আর অক্সিজেন সিলিন্ডার হলেই কাজ চলে যায়। আর মাত্র কয়েক দশক… বলে বেড়ায় মাইক্রোবায়োলজিস্টরা, যদিও ঠিক কবে তা বলতে তারা রাজী নয়… তারপরই উপড়ে ফেলব গ্যাসমাস্ক আর ভারী সিলিন্ডার। গ্যানিমিডের মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে অক্সিজেন উগড়ে দেয়া ব্যাক্টেরিয়ার দঙ্গল। অবশ্যই, প্রথম চোটে ইচ্ছামতো তারা মারা পড়ে উপগ্রহের বিরূপ পরিবেশে, তারপরও কেউ কেউ বেঁচে গেছে; বাঁশঝাড়ের মতো বিস্তার করছে নিজের বংশ, অতি ধীরে বাড়াচ্ছে বায়ুমণ্ডলের চার্টের একটা বিশেষ রেখার বক্রতা, সাথে সাথে বাড়ছে দার্দানাসে বসে থাকা লোকগুলোর আশা।

প্রথম প্রথম ভ্যান ডার বার্গ ইউরোপা-৬ থেকে আসা ডাটার উপর চোখ রাখত, যদি…যদি একবার মেঘটা সরে যায় জিউস পর্বতের উপর থেকে… সে জানে, সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, তবু চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখে না কখনো। রিসার্চের আর কোনো পথ ধরে চলার ধার ধারে না তখন। অবশ্য তাড়াহুড়োর কিছু নেই, সে খুব ভালমতোই জানে। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হাতে পড়ে আছে; সেসব না করলে কপালে পড়বে উপজাতীয় হওয়ার দোষ আর অজনপ্রিয় হবার বোঝা।

আর তারপরই, অকেজো হয়ে পড়ল ইউরোপা-৬; একেবারে হঠাৎ করেই এলোপাথাড়ি উল্কাঝড়ের কবলে পড়ে। এদিকে পৃথিবীতে ভিক্টর উইলিস বেশ একটা বোকাটে কাজ করে বসেছে। গত শতাব্দীর ইউ এফ ও গুজবদাতাদের স্থান পূরণ করা ইউরোপাগল মানুষগুলোর কথা শুনতে গিয়েই এই দুর্গতি। তাদের মতে-এই কৃত্রিম উপগ্রহের পতন হয়েছে নিচের বিচিত্র দুনিয়ার অধিবাসী অথবা তাদের রক্ষাকারীর কল্যাণে। মজার ব্যাপার হল, জিনিসটা যে এর তৈরি করা ও ডিজাইনের সময়ে প্রত্যাশিত জীবদ্দশার দ্বিগুণের চেয়েও বেশি টিকেছে, প্রায় পনের বছর-সে কথাটা যেন ধর্তব্যই নয়। এ কথা বলে ভিক্টর উইলিস অনেক চিৎকার করলেও এখন আর করার কী থাকতে পারে! সে-ই তো এই সব মানুষকে প্রচার দিয়ে খাল কেটে কুমির টেনে এনেছে প্রথমদিকে।

ভ্যান ডার বার্গের হিসাব মতে তার এই সহকর্মী হল একেবারে কাঠখোট্টা ডাচম্যান; সে এই তত্ত্ব সব সময় চাউর করে বেড়াতেও চেষ্টা করে। ইউরোপা-৬ এর পতন তার কাছেও এক চ্যালেঞ্জ। আর এই বিশ্বস্ত উপগ্রহটার বদলে আরেকটা বসানোর টাকা অনুমোদনের বিন্দুমাত্র লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না, যাবার কথাও নয়।

তাহলে বিকল্পটা কী? নিজস্ব চিন্তা আর করণীয় নিয়ে বসে গেল কাজের মানুষ ভ্যান ডার বার্গ। যেহেতু সে একজন ভূতত্ত্ববিদ-কোনো অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট বা মহাজাগতিক পদার্থবিদ নয়, গ্যানিমিডে অবতরণের সাথে সাথেই তার দিক নির্ধারিত হয়ে বসে আছে।

গালি দেয়ার দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচে ভাল ভাষাগুলোর মধ্যে একটা হল আফ্রিকান; অতি ভদ্রভাবে বলার সময়ও ভ্যাজাল পাকিয়ে বসে। ভ্যান ডার বার্গ কয়েক মিনিটের জন্য বাষ্প বন্ধ রেখে টিয়ামাট অবজার্ভেটরিতে একটা কল করল। ওই অবজার্ভেটরিটাও নগ্ন লুসিফারের ছোট্ট সদা জ্বলন্ত চোখের নিচে অবস্থিত। অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টরা, মহাজাগতিক সুবিশাল রহস্যগুলো নিয়ে সর্বক্ষণ চিন্তিত বিজ্ঞানীর দল প্রায়ই বিরক্তির চরমে পৌঁছে যায় ভূতত্ত্ববিদদের একটা গ্রহের মতো অকিঞ্চিৎকর বিষয় নিয়ে মাতামাতি দেখতে দেখতে। কিন্তু সামনের সেই রণক্ষেত্রে সবাই সবাইকে সহায়তা করছিল যথাসম্ভব; আর ড. উইলকিন্স শুধু আগ্রহীই নয় বরং সহমর্মী।

টিয়ামাট অবজার্ভেটরি মাত্র এক উদ্দেশ্যে গড়া হয়েছে, যে উদ্দেশ্যটা গ্যালিমিডে বেস গড়ার অন্যতম কারণ। লুসিফারের উপর গবেষণা শুধু বৃহস্পতি-অবলোপন রহস্য বা সাধারণ বৈজ্ঞানিক চিন্তা চেতনা নয় বরং নিউক্লিয়ার প্রকৌশলী, উল্কাতবিদ, সমুদ্রবিজ্ঞানী এমনকি দার্শনিকদেরও বাস্তব প্রয়োজন মেটাতে পারে : একটি সূর্য। তার উপর কী ঘটলে একটা গ্রহ পরিণত হয় নক্ষত্রে সেই চিন্তাও সহস্ৰজনকে জাগিয়ে রেখেছে রাতের পর রাত। ব্যাপারটা জানা মানবজাতির জন্য খুবই প্রয়োজন। এই জ্ঞানই এমন কোনো কাজ করতে সক্ষম করবে মানুষকে, অথবা এমন কোনো সম্ভাব্য ঘটনা ঠেকাতে করবে সহায়তা যা…

আর এজন্যই এক দশকেরও বেশি সময় ধরে টিয়ামাট একে জরিপ করে চলেছে অবিরত; সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে। প্রতিটি মিলি সেকেন্ডের সমস্ত তথ্য টুকে রাখছে সেসব যন্ত্র। পুরো ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ব্যান্ডের সমস্ত আলোক বর্ণালী রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে সর্বক্ষণ। আর পরীক্ষা চলছে আগ্নেয়গিরির মুখে বসানো একটা শত মিটারের ডিশ অ্যান্টেনা দিয়ে।

ইয়েস, বলল ড. উইলকিন্স, আমরা মাঝেমধ্যে ইউরোপা আর আইওর দিকে তাকাই বটে, কিন্তু আমাদের ডিশটা একেবারে লুসিফারের দিকেই তাক করে রাখা হয়েছে; ফিক্সড। উপগ্রহগুলো যখন লুসিফারকে পার করে যায় তখনই শুধু কয়েক মিনিটের জন্য দেখতে পাই-এই যা। আপনার ঐ জিউস পর্বত তত দিনের প্রান্তে, না?

হ্যাঁ।

“আমরা ইউরোপার রাতের দিকটাই শুধু দেখতে পাই।

আমিও ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারছি। একটু অস্থির যেন ভ্যান ডার বার্গ, কিন্তু আপনারা কি বিমটাকে সামান্য একটু সরিয়ে সেট করতে পারেন? ইউরোপা লাইনে আসার আগেই যেন দেখা যায় এমন কোথাও? দশ-বিশ ডিগ্রি ঘোরাতে পারলেই দিনের পাশটা দেখা সম্ভব।

“এক ডিগ্রিই লুসিফারকে হারিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট। আর অন্যদিকে ইউরোপাকেও পাওয়া যাবে। কিন্তু লুসিফারের ক্ষমতার এক শতাংশও পাব না তখন। তারপরও একটা চেষ্টা করে দেখা যাবে। আপনি এক কাজ করুন, ফ্রিকোয়েন্সিগুলোর বর্ণালী, তরঙ্গ খাম, মেরুকরণ সহ আর যা যা করা গেলে কাজ হবে এমন তথ্যগুলো পাঠিয়ে দিন। দু-এক ডিগ্রির জন্য কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। সবচে বড় কথা, এ ব্যাপার নিয়ে আমাদের কেউ এত বেশি মাথা ঘামাবে না যে ডিশটা সরালে তেমন সমস্যা হতে পারে। ভাল কথা, আপনি ইউরোপায় বরফ আর পানি ছাড়া আর কিছু নিশ্চই আশা করেন না?

যদি জানতামই আনন্দিত কণ্ঠ ভ্যান ডার বার্গের, তাহলে সাহায্যের কথা বলতাম না, বলতাম কি?

আর আমিও পাবলিকের সামনে বাহাদুরি ফলাব না। তার উপর আমার নামটাই যাচ্ছেতাই, শেষ অক্ষর দিয়ে শুরু। আপনি আমার চেয়ে একটা মাত্র অক্ষরের জন্য এগিয়ে থাকবেন।

এক বছর আগের কথা: লঙ রেঞ্জ স্ক্যানগুলো তেমন কাজের ছিল না। তারপর ইউরোপার উপর বিম তাক করতে গিয়ে আশাতীত কষ্ট হল সবার। কিন্তু সবুরের মেওয়া ফলবেই, কম্পিউটারে সুন্দর তথ্য এলো অযুত-নিযুত। ফলে ভ্যান ডার বার্গ মানবজাতির প্রথম সদস্য হিসেবে লুসিফার-পরবর্তী ইউরোপার অভ্যন্তরীণ গঠন দেখতে পেয়েছিল সেদিন।

আসলেই, ড. উইলকিন্সের কথামতো প্রায় পুরোটাই বরফ আর পানিতে ভর্তি। ব্যাসল্টের সাথে সাথে কোথাও কোথাও দেখা গেল সালফারের তূপ। কিন্তু দুটো ব্যাপার বেশ গণ্ডগোল পাকায়।

একটা যেন একেবারে নিখুঁত কৃত্রিম বস্তু। দু-কিলোমিটার টাক লম্বা। কোনো রেডিও প্রতিফলনই হচ্ছে না সেটা থেকে। ভ্যান ডার বার্গ ড. উইলকিন্সকে এ নিয়ে ধাঁধায় পড়ে যেতে দিল। তার নিজের ধাঁধা শুধু মাউন্ট জিউস।

ব্যাপারটা বুঝে উঠতে অনেক অনেকদিন লেগে গেল তার। কারণও আছে, এমন কথা আগেভাগে কল্পনা করতে পারে শুধু দুজন-হয় এক পাগল, নাহয় কোনো অতি অগ্রসর কল্পনার বিজ্ঞানী। এমনকি এখনো-সবকিছু কঠিনভাবে চুলচেরা হিসাব করার পরও তার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। পরবর্তীকালে কী যে করবে বা করা উচিৎ তাও ভাবছে না এক বিন্দু।

ড. উইলকিন্স কল করে দু-একটা এদিক-সেদিক করা কথা বলল, খুব বেশি অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়… কোয়ার্টজের কোনো দুর্নল গোত্ৰটোত্র হবে আর কী। পৃথিবীর স্যাম্পলের সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি এখনো…

এই প্রথমবারের মতো সে কোনো সহকর্মী বিজ্ঞানীর কাছে কাজের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলল।

কিন্তু এ ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল তার?

১২. ওম পল

রালফ ভ্যান ডার বার্গ প্রায় একযুগ ধরে তার চাচাকে দেখে না। চর্ম-মাংসের শরীরে তাদের আবার দেখা হবার কথাও নয়। এখনো সে এই বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে খুব কাছ থেকে অনুভব করে। এই একজনই তাদের উপজাতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছেন এখন, তাদের সেই পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষদর্শী।

ওম পল নামেই ড. পল ক্রুগারকে ডাকে তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধব। প্রয়োজনের সময় প্রতিবারই তাকে কাছে পেয়েছে ভ্যান ডার বার্গ, সরাসরি অথবা আধ বিলিয়ন কিলোমিটার লম্বা রেডিও সংযোগের মাধ্যমে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তার পার্টিকেল ফিজিক্স বিষয়ক আবিষ্কারটি ঘরদোর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে আরো নানা কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় সভ্য দুনিয়ার ধুলো-ময়লা থেকে পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে নতুন যুগের সূচনা হয়। বাজারে জোর গুজব প্রচলিত যে তার প্রাপ্য নোবেল পুরস্কারটি প্রচণ্ড রাজনৈতিক চাপসৃষ্টির কারণেই ঠেকে আছে।

কথাটা সত্যি হলেও ড. পল ক্রুগারের কিস্যু যায় আসে না। একেবারে সাদাসিধে লোক, কারো সাতে-পাঁচে নেই, ব্যক্তিগত একজন শত্রুও মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবী এম্নিতেই তাকে শ্রদ্ধা-সম্মানের ডালি সাজিয়ে দিয়েছে। বেশ কয়েকবার তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ পেয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছেন নিমন্ত্রণ। ইউ এস এস এ বা ইউনাইটেড স্টেটস অব সাউদার্ন আফ্রিকা ভ্রমণ করলে যে তার শারিরীক কোনো ক্ষতি হতে পারে বা আক্রমণ আসতে পারে সে সম্ভাবনা বিন্দুমাত্র নেই কিন্তু তিনি অতীতকে আর সামনে আনতে চান না; চান না অসহ্য নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হতে।

ভ্যান ডার বার্গ যে ভাষা ব্যবহার করেছে সেটা সর্বমোট দশ লাখ লোকও বোঝে কিনা সন্দেহ। নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য যে কোনো মানুষের কাছে এর কোনো অর্থই নেই। ড, পল খবরটিকে তেমন গুরুত্বের সাথে নিতে পারলেন না, যদিও ভাস্তের মেসেজ বুঝতে তার বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি। তার ধারণা রালফ ছোঁড়াটা কোনো গাঁজায় পড়েছে অথবা তাকে দিয়ে কিছু করিয়ে নিতে চাচ্ছে, একটু কাছে টানার চেষ্টাও হতে পারে। ঠিক যেমন তিনি সহজে সাধারণ মানুষের কাছে যান না, অন্তত তাঁর চুপ করে থাকার ক্ষমতাটা ভালই ছিল…

তবু ধরা যাক-শুধু ধরাই যাক না-যদি কথাটা সত্যি হয়েই থাকে, তাহলে? মলিন চুলগুলো পলের ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে গেল সরসর করে। সম্ভাবনার এক নূতন দুয়ার; বৈজ্ঞানিক, আর্থিক, রাজনৈতিক… হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে খুলে গেল। তিনি ব্যাপারগুলোকে যতই গোনায় ধরলেন ততই তারা ফুলে-ফেঁপে উঠল।

তার পূর্বপুরুষদের মতো নন তিনি। বিপদে, মানসিক অস্থিরতায়, সিদ্ধান্ত হীনতায় ভরসা দেবার মতো কোনো ঈশ্বর তার নেই। এখন তিনি ব্যাপারটাকে মিস করছেন, অবশ্য থাকলেও কোনো কাজে আসততা কিনা সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান। এখন কম্পিউটারে বসে ডাটা ব্যাঙ্কে ঢোকার মুখে তিনি বারবার ভাবছেন একটা কথাই- ভাস্তে কি আসলেই কোনো বোকামিতে ভরা আবিষ্কার করে বসেছে নাকি আন্দাজের উপর বগল বাজাচ্ছে! সেই পুরনো জন কি আসলেই মানব জাতির উপর এত বড় একটা চাল চালতে পারে! তার মনে পড়ে যায় মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত উক্তি, যদিও তিনি ছিলেন মহারহস্যময়, কখনোই অকল্যাণময় ছিলেন না।

দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ কর, নিজেকেই বললেন ড. পল ক্রুগার। তোমার ভাল লাগা বা মন্দ লাগা-তোমার আশা অথবা ভয় দিয়ে পুরো ব্যাপারটার একেবারে কিস্যু আসে যায় না।

তার সামনে, সৌরজগতের অর্ধেকটা জুড়ে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ঘুরপাক খাচ্ছে, আসল সত্যের একটা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তিনি শান্তি পাবেন না।

১৩. কেউ আমাদের সাঁতারের পোশাক আনতে বলেনি..

পঞ্চম দিন পর্যন্ত ক্যাপ্টেন স্মিথ ছোট্ট চমকটা জিইয়ে রেখেছিল, ঘুরে যাবার কয়েক ঘণ্টা আগেও কথাটা বলেনি কাউকে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, তার ঘোষণায় সাড়া পড়েছে দারুণ!

ভিক্টর উইলিসই প্রথমে কথা বলছিল।

সুইমিং পুল। তাও আবার একটা স্পেসশিপের ভিতর! রসিকতা করছেন, আপনি নিশ্চই রসিকতা করছেন!

পেছনে হেলান দিয়ে ব্যাপারটা উপভোগ করতে লাগল ক্যাপ্টেন। একটা ঝরঝরে হাসি দিল হেউড ফ্রয়েডের দিকে তাকিয়ে। সেও ব্যাপারটা জেনে গেছে।

আসলে, আমার মনে হয় কলম্বাসও তার পরবর্তী যুগের শিপগুলো দেখে ভড়কে যেত। এটাই স্বাভাবিক।

তাহলে তো ডাইভিং বোর্ডও থাকার কথা, আছে নাকি দু একটা? গ্রিনবার্গের কথায় আশার ধ্বনি, আমি আবার কলেজ চ্যাম্পিয়ন ছিলাম।

বুঝতেই পারছেন-আছে। উচ্চতা মাত্র পাঁচ মিটার। তাতে কী বা এসে যায়? পাক্কা তিন সেকেন্ডের পতন উপভোগ করতে পারবেন আপনি। হাজার হলেও আমাদের মাধ্যাকর্ষণটা জির দশ ভাগের এক ভাগ। তাতেও জনাবের তুষ্টি না এলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। কার্টিস সাহেবকে অনুরোধ করলে নিশ্চই তিনি ফেলবেন না। থ্রাস্ট কমিয়ে দিলেই জি অনেক কমে যাবে।

তাই নাকি? বলল চিফ ইঞ্জিনিয়ার শুকনো গলায়, আর তারপর আমার অর্বিট ক্যালকুলেশনের সবটুকু গড়বড় হয়ে যাক আর কী! পানি উপচে চলে আসার ঝুঁকির কথা নাইবা বললাম। পৃষ্ঠটানের কাহিনী কে না জানে…

কিন্তু এমন এক স্পেস স্টেশন কি ছিল না যেটায় চতুষ্কোণ সুইমিং পুল… প্রশ্ন করতে নিয়েছিল কেউ একজন।

“তারা পুলটাকে পাস্তুরের অক্ষে বসানোর চেষ্টা করেছিল, ঘূর্ণন শুরুর আগেই। কথা কেড়ে জবাব দিল ফ্লয়েড, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও বাস্তব নয়। শূন্য গ্র্যাভিটিতে জিনিসটা পুরো ভর্তি থাকার কথা। আর একটু অপ্রস্তুত হয়ে নামলেও আপনি ডুবে যেতে পারেন। তার উপর যদি ভয় পান তো…

তো রেকর্ড বুকে নাম উঠবে। মহান নাম। মহাকাশে ডুবে যাওয়া প্রথম মানব ছিলেন…

বাগড়া দিল মবালা, তার একটাই চিন্তা, কেউ তো আমাদের সাঁতারের পোশাক আনতে বলেনি।

যার পরার দরকার সে আনতেই পারত, মানা করেছে কে? আমি বাবা খালি গায়েই নেমে যাব। মাইকেলোভিচ ফিসফিস করল ফ্লয়েডের কানে কানে।

আদালতে অর্ডারের ভঙ্গিতে ক্যাপ্টেন স্মিথ টেবিলে টোকা দিল কয়েকবার।

কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। প্লিজ। আপনারা একটু শুনুন। আমরা জানি, আজ রাতেই সর্বোচ্চ গতিতে পৌঁছব। গতিও কমাতে হবে। ব্রেক করব তখন থেকেই। ড্রাইভটা বন্ধ হয়ে যাবে ২৩:০০ টায়। শিপ পিছুটান দেবে। ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ওজনহীনতা আসবে। পরবর্তী থ্রাস্ট দেব ১:০০ টায় ।

“বুঝতেই পারছেন, সমস্ত কু ব্যতিব্যস্ত থাকবে। ইঞ্জিন আর শিপের শরীর বা হাল পরখ করার সুবর্ণ সুযোগ বলা যায় সময়টাকে। পাওয়ারে থাকার সময় কিন্তু এসব সম্ভব নয়। আমি আপনাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করব সে সময়টায় ঘুমিয়ে থাকার জন্য। আর ক্রস করে যেন লুজ বেল্ট আটকানো থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখবেন আশা করি। স্টুয়ার্ড লক্ষ্য রাখবে যেন গতি ফিরে পাবার সময় কোনো আলগা জিনিস না থাকে। তখন গতির কারণে সংঘর্ষ নিশ্চিত। কোন প্রশ্ন?

একটা স্থির নিরবতা চারদিকে। সদস্যরা যেন ঠিক ঠাউরে উঠতে পারছে না কী। করবে বা বলবে।

“যাক। আশা করেছিলাম আপনারা এই বিলাসের কারণ এবং খরচা সম্পর্কে দু একটা প্রশ্ন তুলবেন। তবু বলছি। এটা আসলে মোটেও বিলাস নয় এবং এর পেছনে স্পেসশিপের তুলনায় একটা কানাকড়িও ব্যয় করা হচ্ছে না।

“আপনারা তো ভাল করেই জানেন, পাঁচ হাজার টন পানি বয়ে নিচ্ছি। এ পানিটাই রিয়্যাকশন মাস। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন, এটার সর্বোচ্চ ব্যবহারে সদগতি না করলেই নয়। একটা ট্যাঙ্ক বর্তমানে চার ভাগের তিন ভাগ খালি। এ অবস্থাতেই রাখব এটাকে। তোআগামীকাল ব্রেকফাস্টের পর সমুদ্রতটে দেখা হচ্ছে আমাদের…

.

ইউনিভার্সকে মহাশূন্যের সন্তানে পরিণত করার মতো দামী কাজটা এতো যে সহজসাধ্য হবে তা এককালের মহাকাশযানে ভাবাই যেত না।

সমুদ্রতটটা আসলে ধাতব। মিটার পাঁচেক চওড়া হবে টেনেটুনে। একটু বেঁকে গেছে; যেমনটা বাস্তবে হয়। দূরের দেয়াল বড়জোর বিশ মিটার দূরে; কিন্তু পরিবেশ দেখে মনে হয় দূরত্বটা অসীম। আর এই সমুদ্র এমন একটা অপর পাড়ে গিয়ে ধীরে ধীরে মিশেছে যেখানে কারো যাওয়া সম্ভব নয়। আর যে কোনো ট্রাভেল এজেন্ট দৃরের প্যাসেঞ্জার ক্লিপারটাকে সুং সি স্পেস কপোরেশনের দুরন্ত পালতোলা। পোত ভাবতেই পারে।

এই ধোঁকাটাকে আরো জীবন্ত করে তুলেছে পায়ের নিচের বালি-স্তর। অবশ্য স্তরটা একটু ম্যাগনেটিক করে রাখা হয়েছে যাতে নিজের জায়গা ছেড়ে তেমন নড়তে না পারে। উপরি পাওনা হিসেবে আছে একটা সত্যিকার ছোট্ট বেলাভূমি, শেষ হয়েছে ঘন পাম বনের ভিতরে। কাছ থেকে না দেখলে বনটাকে নিয়ে তেমন অভিযোগ উঠবে না। মাথার উপরে একটা গনগনে আরামদায়ক সূর্যও বসে আছে আলসে পরিবেশ মাতিয়ে। ব্যাপারটা এই পরিবেশে বিশ্বাসই হতে চায় না যে সামনের দেয়ালের ওপাশেই আসল সূর্য পৃথিবীর যে কোনো সাগর তীরের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে জ্বলছে।

ডিজাইনারের কাজটা আসলেই চমৎকার; বিশেষত এই ছোট্ট পরিসরে। তারপরও যেন মন ভরল না গ্রিনবার্গের, ইস্! সার্ফিংয়ের সুযোগটা থাকলেই হতো…

১৪. অনুসন্ধান

বিজ্ঞানের এ ব্যাপারটা বেশ ভাল; কোনো জানা ব্যাপারকেও গোনায় ধরা হয় না। এমনকি বেশ সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকলেও না। মানা হবে তখনই যখন কোনো স্বীকৃত, যাচাই করা মাপকাঠির সাথে ব্যাপারগুলো মিলে যাবে। এমনও হয়-একটা কিছু আবিষ্কার হলো; সেটাই মেনে নেয়া হল। কিন্তু আদপে এমন ঘটনা সহজে ঘটে না। হাজার হলেও, গ্যালিলিও আর আইনস্টাইনরা শতবর্ষে একবারই জন্ম নেন; আর জন্মে পাল্টে দেন বিশ্বের চেহারা-সুরত।

ড. ক্রুগার এই নীতিতে অটল। ভাস্তের আবিষ্কারকে কোনো পরিচিত সুরতের সাথে মেলাতে না পেরে সুরতহাল রিপোর্টে তেমন বিশ্বাস করতে পারেননি। আর কাজটা সরাসরি ঐশ্বরিক হওয়া ছাড়া কোনো উপায়ও নেই। রালফ কোনো ভুল করে বসেছে ভেবে ব্যাপারটার কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই সহজ।

ড. পল বেশ অবাক না হয়ে পারেন কীভাবে! হাজার হলেও এ যুগের নির্ভরযোগ্য রাডারের তথ্য ভেসে এসেছে। আর সেটাকে পরীক্ষা করার কাজ নিয়ে দেরি করলেও ঘাঘু ঘাঘু রাডার এক্সপার্টের রিপোের্ট বলছে সেই একই কথা। এবং সাথে একটা বিস্ময়, কোত্থেকে পেলেন এ রেকর্ড?

স্যরি, জবাব দিতেন তিনি প্রতিবার বাড়তে থাকা গর্বের সাথে, বলার অনুমতি পাইনি।

পরের ধাপটা কম কষ্টের নয়। অসম্ভবটাই যে বাস্তব তা প্রমাণ করা। আর সাহিত্যের ক্ষেত্রে ধরা যাক কেউ চর্চা শুরু করতে চাচ্ছে; ব্যাপারটা অকুল সমুদ্রে পড়ার মতো তার জন্য, যে জানে না কোত্থেকে শুরু করতে হবে। একটা কথা ঠিক, প্রচণ্ড এক শক্তির ধাক্কা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। এ দিনটার সাথে রন্টগেনের এক্স রে আবিষ্কার করার পরের দিনের তুলনা চলে। তিনি সে সময়কার ফিজিক্স জার্নালগুলো চষে ফেলছিলেন এ বিষয়ে একটু তথ্যের আশায়। এমন কোনো তথ্যের আশায় যেটা পদার্থবিজ্ঞানের সাময়িকীগুলোতে পাওয়া গেছে ঠিকই; বেশ কয়েক বছর পর।

তবু বিজ্ঞানের এই গঙ্গাস্নানের যুগে আশা করা যায় বিশাল তথ্য-মহাসাগরের কোনো না কোনো এলাকায় এমন কিছুর হদিস পাওয়া যাবে। খুব সাবধানে ড. ক্রুগার এমন একটা প্রোগ্রাম করলেন যেটা সার্চের সময় তার আশার তথ্য পেলে তো নিবেই এমনকি কাছাকাছি কিছু পেলেও যাচাই বাছাই করে নেয়ার চেষ্টা করবে। তবে প্রোগ্রামটার কাজ একটু সহজ হয়েছে কারণ পৃথিবী সংশ্লিষ্ট যৌক্তিক সব ব্যাপারই সে বাদ দেবে। নিশ্চই কোটি কোটি…। আর সার্চের কাজ চলবে অপার্থিব সব ব্যাপার নিয়ে।

ড. ক্রুগারের হাজার সুবিধার একটা হল: তিনি কম্পিউটারে অসীম বাজেট পেয়ে থাকেন। বিনিময়ে বিভিন্ন সময়ে তিনি অনেক প্রতিষ্ঠানকেই তাঁর প্রজ্ঞা কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেন। এই সার্চে দেদার খরচ হচ্ছে, হোক না, বিল নিয়ে কারো কোনো বিকার নেই।

কাজ শেষ হবার পর বেশ অবাক হতে হল ড. ক্রুগারকে। তিনি বেশ ভাগ্যবান, মাত্র দু ঘণ্টা সাতাশ মিনিটে কেল্লা ফতে। একুশ হাজার চারশো ছাপ্পান্নতম রেফারেন্সেই কাজ হয়ে গেল।

টাইটেলটাই যথেষ্ট। পল এতো উত্তেজিত ছিলেন যে তার এক্কেবারে নিজস্ব কমসেক তার ভয়েস কমান্ডকে অগ্রাহ্য করে বসেছে! ভাল প্রিন্ট আউটের জন্য আরো একবার বলতে হল।

উনিশশো একাশিতে ন্যাচার পত্রিকায় রিপোর্টটা এসেছিল। তার জন্মেরও পাঁচ বছর আগে। এবার মাত্র পৃষ্ঠাখানেক রিপোর্টে চোখ বুলিয়েই তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তার ভ্রাতুস্পুত্র শুধু ঠিক কথাই বলেনি বরং এমন কোনো আবিষ্কার করে বসেছে যাকে এক কথায় অলৌকিক বলা চলে।

ঐ আশি বছরের বুড়ো পত্রিকার সম্পাদককে বেশ রসিক বলা চলে। এই পেপারটা আউটার প্ল্যানেটগুলোর কোরের গঠন নিয়ে আলোচনা করেছে বিস্তর। কিন্তু সেকালের পত্রিকা হিসেবে টাইটেলটা তেমন ভয়াল ছিল না। বরং এক কালে একটা বিখ্যাত গানের অংশ ছিল কথাগুলো।

যাই হোক, পল ক্রুগার কখনো বিটল বা তাদের উন্মাতাল চমকের কথা বিন্দুমাত্র জানতেন না।

২. কালো তুষারের উপত্যকা

দ্বিতীয় পর্ব – কালো তুষারের উপত্যকা

১৫. সম্মেলন

হ্যালি এখন বলতে গেলে চোখের সামনে। তবে পৃথিবীতে বসা দর্শকরাই ধূমকেতুটাকে সবচে স্পষ্ট দেখতে পাবে। তখন এর পুচ্ছ ছড়িয়ে পড়বে আরো আরো। এখনি পাঁচ কোটি কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রাজত্ব করছে এর লেজ। যেন কোনো রণপোত তার বিশাল ত্রিকোণ নিশান উড়িয়ে চলেছে সৌর বাতাসে শিষ কেটে; কোন্ এক দেশের খোঁজে।

সম্মেলনের দিন হেউড ফ্লয়েড সকাল সকাল একটা ক্লান্তিকর ঘুম ছেড়ে উঠল। স্বপ্ন দেখাটা তার কাছে বেশ অস্বাভাবিক। অন্তত স্বপ্নের কথা মনে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না–বিশেষত আগামী কয়েক ঘণ্টার আসন্ন উত্তেজনায় স্বপ্ন দেখার দিন কি এখনো আছে? অবশ্য ক্যারোলিনের মেসেজটাও বেশ কষ্ট দিল; গত কদিনে ক্রিসের কোনো খবর পেয়েছে কিনা ফ্লয়েড-এই ছিল তার প্রশ্ন। সে খবর পাঠালো, একটু বিরক্ত হয়েই। ফ্লয়েড ক্রিসকে ইউনিভার্সের সিসটার শিপ কসমসে বর্তমান পদে সুযোগ করে দিলেও কক্ষনো ক্রিস দাদুকে ধন্যবাদ দেয়ার মতো কষ্ট স্বীকার করেনি। সে হয়তো এর মধ্যেই চাঁদ-পৃথিবী-চাঁদ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে। অন্য কোনো উত্তেজনা খুঁজছে অন্য কোথাও।

যথারীতি, ফ্লয়েড এটুকুও যোগ করল, আমরা তার জবাব পাব যদি কখনো সুন্দরমতো সময় করে গুছিয়ে উঠতে পারে…

সকালের নাস্তার পর পরই যাত্রী আর বিজ্ঞানীদল ভিড় করল ক্যাপ্টেন স্মিথের কাছে। পরবর্তী ব্রিফিংয়ের আশায়। বিজ্ঞানীদের আসলে এমন কোনো ব্রিফিংয়ের আদৌ প্রয়োজন নেই, কিন্তু এটা নিয়ে না রাখার পর যদি কোনো ভুল ভ্রান্তি হয়েই যায় তো পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাবে। তারচে ক্যাপ্টেনের কাছে ক্লিয়ার থাকাই ভাল।

এমনটা ভাবা খুবই সহজ যে ইউনিভার্স কোনো নেবুলার মধ্যদিয়ে পথ করে যাচ্ছে-ধূমকেতুর পাশ দিয়ে নয়। সামনের পুরো আকাশ সাদা কুয়াশায় আচ্ছন্ন । একই রকম নয়-কোথাও কালচে, কোথাওবা ঘন, মাঝে মাঝে উজ্জ্বল জেটের ছোঁয়া; ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এই ম্যাগনিফিকেশনে ধূমকেতুটির নিউক্লিয়াস পর্যন্ত দেখা যায়; কালো, ছোট্ট বিন্দু। আর এই উৎস থেকেই চারপাশের সব জাদুর উৎপত্তি।

ঘণ্টা তিনের মধ্যে ড্রাইভ বন্ধ করতে পারব আমরা। বলল ক্যাপ্টেন, তখন নিউক্লিয়াসের কত কাছে থাকব আপনারা কি কল্পনা করতে পারেন? মাত্র এক হাজার কিলোমিটার। এবং আপেক্ষিক গতি থাকবে শূন্য। তখনই চূড়ান্ত কয়েকটা পর্যবেক্ষণ আর পরীক্ষার পালা। তারপর? ল্যান্ডিং সাইট খুঁজে বের করব আমরা।

“তারমানে ওজনশূন্যতা আসছে কাঁটায় কাঁটায় ১২:০০ টায়। তার আগে আপনাদের কেবিন স্টুয়ার্ডরা সব ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখবে। আবারও ব্যাপারটা বদলে যাবে, তবে এবার দু ঘণ্টার পালা নয়-টানা তিন দিন। এই যা, তারপরই আবার ওজন ফিরে পাচ্ছি।

“হ্যালির মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে চিন্তিত? ভুলে যান। পৃথিবীর হাজার ভাগের এক ভাগ। অনেক অনেকক্ষণ থাকলে ব্যাপারটা এক-আধটু বুঝে উঠতে পারবেন হয়তো; ব্যস-এটুকুই। কোনো জিনিসের এক মিটার পতন হতে সময় লাগে মোটামুটি পনের সেকেন্ড…

“নিরাপত্তার খাতিরে আমি আপনাদের সবাইকে এখানে, অবজার্ভেশন লাউঞ্জে পেলেই বেশি খুশি হব। বেল্ট যেন শক্ত করে বাঁধা থাকে, অন্তত সাক্ষাৎ আর

স্পর্শের সময়টায়। অবশ্য এখান থেকেই সবচে ভালভাবে ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করা যাবে। পুরো অপারেশনে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লাগবে না আশা করি। খুবই ছোট ছোট থ্রাস্ট কারেকশন ব্যবহার করব; কিন্তু সেসব ছোট্ট থ্রাস্ট শিপের যেকোন অংশ থেকে আসতে পারে, তাই কাছেপিঠে থাকাটা ঠিক নয়; আঁকিলাগতে পারে।

আসলে ক্যাপ্টেন স্পেস সিকনেসের কথাই বলতে চায়। কিন্তু এই শব্দটা ইউনিভার্সে ব্যবহার না করার চুক্তি হয়েছে আগেই। অনেক হাতই সিটের নিচে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলাটা আছে তো? প্লাস্টিক ব্যাগটা না থাকলে বিপদে পড়তে হতে পারে।

ম্যাগনিফিকেশন বাড়ছে, স্ক্রিনের ইমেজটা আরো আরো চলে যাচ্ছে ভিতরের দিকে। মুহূর্তকালের জন্য ফ্লয়েডের মনে হল যেন কোনো এরোপ্লেনে আছে সে-প্লেনটা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে হাল্কা মেঘের ভিতর পথ করে নিয়ে। নিউক্লিয়াসটা আরো আরো স্পষ্ট হচ্ছে; এখন আর দেখতে মোটেও কালো বিন্দু নয়, বরং এবড়োথেবড়ো চন্দ্রকলার মতো। যেন মহাসৃষ্টির অসীম সাগরে পথ হারানো কোনো নিঃসঙ্গ দ্বীপের পথ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, ধীরে ধীরে হাজার বছরের রহস্য-কুয়াশার চাদর সরে যাচ্ছে।

এখনো পরিমাপ বোঝার কোনো উপায় নেই। যদিও ফ্লয়েড জানে সামনের দৃশ্যটা টেনেটুনে দশ কিলোমিটার হবে, তবু দেখেশুনে চাঁদের কথা মনে পড়ে যায়। চাঁদটা এতো বাষ্প ছড়ায় না, আর বুকে এমন বিশাল কোনো জ্বালামুখও নেই।

মাই গড! চিৎকার করে উঠল মাইকেলোভিচ, এটা আবার কী?

সে নিউক্লিয়াসের নিচের প্রান্তে আঙুল তুলল; আঁধার অংশটার শেষপ্রান্তে আলো দিচ্ছে কী যেন। নিয়মিত ছন্দে অন-অফ, অন-অফ! দু-তিন সেকেন্ডে একবার করে। নিশ্চই কোনো প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়। যেন কোনো সিগন্যাল বাতি।

যেন কেন? অবশ্যই বাতি। কৃত্রিম বাতি। কোনো ইশারা দিচ্ছে ওটা। কী ইশারা?

ড. উইলিস তার ধৈর্যের পরিচয় দিল, আমি এক লহমায় আপনাকে ব্যাখ্যা দিতে পারি।

কিন্তু ক্যাপ্টেন স্মিথ প্রথমে শুরু করল ব্যাখ্যাটা, আপনাকে হতাশ করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত, মাইকেলোভিচ সাহেব। ওটা স্যাম্পলার পোব টুর বিকন। জিনিসটা মাসখানেক হল হ্যালির গায়ে সেঁটে আছে; আমরা যাব, তুলে আনব।

কী লজ্জার কথা! আর আমি কিনা ভেবে বসে আছি সেখানে কেউ একজন…কিছু একটা আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে।

তেমন কোনো সৌভাগ্য কি আর হবে? একা আমরাই ওর দিকে এগিয়ে গেছি। বিকনটা আমাদের ল্যান্ড করার জায়গা নির্দেশ করছে। হ্যালির দক্ষিণ মেরুতে; এখন স্থায়ী আঁধার সেখানটায়। আমাদের লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের সাপেক্ষে সেটাই সুবিধাজনক স্থান। সূর্যালোক পাশে তাপমাত্রা ১২০ ডিগ্রী। পানির স্ফুটনাঙ্কের অনেক উপরে।

দেখেশুনে খুব একটা স্বাস্থ্যসম্মত মনে হচ্ছে না যে যাই বলুক। তিতকুটে চেহারা করে দিমিত্রি বলল, বিশেষত ঐ জেটগুলোতো মোটেও ভাল লক্ষণ দেখায় না। আচ্ছা, এই মরার পার্ক কি না করলেই কি নয়?

“ওই জেটগুলোও আমাদের অন্যপাশে পার্কিয়ের অন্যতম কারণ। ওখানে কোনো ব্যস্ততা নেই। এখন, আপনারা ক্ষমা করলে আমি একটু ব্রিজের দিকে যেতে চাই। একেবারে আনকোরা কোনো ভুবনে প্রথমবারের মতো ল্যান্ড করার সুযোগ আমার জীবনে এই প্রথম এলো। আর বড় সন্দেহ হয় জীবনে আর একবার নতুন দেশে প্রথমবার নামতে পারব কিনা। সুতরাং…

ধীরে ধীরে ক্যাপ্টেন স্মিথের সমাবেশ ফাঁকা গড়ের মাঠ হয়ে গেল। জুমটা আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে, নিউক্লিয়াসটা আবারো পরিণত হয়েছে কালো, ছোট্ট বিন্দুতে ।

দেখা হবার চার ঘণ্টা আগেও শিপটা ধূমকেতুর দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল ঘণ্টায় পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার বেগে।

খেলার এই পর্যায়ে মূল ড্রাইভে যদি কোনো গণ্ডগোল হয়, তো হ্যালির বুকে যে কোনো জ্বালামুখ হার মেনে যাবে।

১৬. স্পর্শ

ল্যান্ডিংটা হল একদম ঠিকমতো; যেমনটা আশা করেছিল ক্যাপ্টেন স্মিথ। ঠিক কোনো মুহূর্তে যে ইউনিভার্স তার ভর ছেড়ে দিয়েছে তা কেউ বলতে পারবে না। স্পর্শেরও মিনিটখানেক পর সব যাত্রী বুঝতে পারল; তার পরই জয়ধ্বনি।

এক সরু উপত্যকার প্রান্তে, টেনেটুনে শত মিটার উঁচু পর্বতঘেরা এলাকায় উড়ে এসে জুড়ে বসেছে ইউনিভার্স। চান্দ্র-প্রকৃতি দেখার আশা যেই করে থাক না কেন-বেশ অবাক হতে হবে তাকে। চাঁদের প্রকৃতি হাজার বছরের মহাজাগতিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বোমাবর্ষণে মসৃণতা পেয়েছে। আর তার গঠন লাখো বছরের পুরনো।

অন্যদিকে হ্যালি চিরযুবা। চির পরিবর্তনশীল। এমনকি পার্থিব পিরামিডগুলোও এসব পাহাড় আর উপত্যকার চেয়ে পুরনো। এখানে হাজার বছরের পুরনো বলে কোনো কথা নেই। প্রতিবার সূর্যের চারধারে ঘোরার সময় নক্ষত্রটার কাছাকাছি এসে পেরিয়ে যেতে যেতে সৌর আগুনে আমূল বদলে যায় হ্যালির পুরো চেহারা। এমনকি ১৯৮৬ সালের হ্যালির সাথেও বর্তমানের কোনো মিল পাওয়া যাবে না। ভিক্টর উইলিসের মতো নির্জলা কন্ঠে বলতে গেলে, ৮৬ সালের বাদাম আকৃতি এখন সরু কোমর হয়ে গেল!

ঠিকই, বোঝা যাচ্ছে এভাবে আরো দু-চারবার চললে সূর্য একে প্রায় সমান দু ভাগ করে বসবে। আঠারোশ ছিচল্লিশের মহাকাশবিদদের মাথা খারাপ করে দিয়ে যেমন করে দুভাগ হয়ে যায় বিয়েলার ধূমকেতু, সেভাবে।

প্রায় না থাকা মাধ্যাকর্ষণও বোঝা যাচ্ছিল এই আজব ভূমিতে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে কিম্ভূত বস্তু আর তার আরো কিতাকার গঠন। মাকড়শা-জালের মতো হাল্কা, ফাপা জিনিসের বহর দেখেই এখানটার আকর্ষণ ঠাহর করা যায়। এমনকি চাঁদের বুকেও এগুলো কয়েক মিনিট টিকবে না, মিশে যাবে।

ক্যাপ্টেন স্মিথ মহাকাশ যানটাকে আঁধার প্রান্তে ল্যান্ড করালেও চারপাশ দেখা খুব সহজ। গ্যাসের যে বিশাল মোড়ক নিউক্লিয়াসটাকে মুড়ে রেখেছে সেটা যথেষ্ট আলো দেয়। দেখে মেরুজ্যোতি মনে হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। আর তাও যেন দেখা যাচ্ছে অ্যান্টার্কটিকার বরফপ্রান্ত ছাড়িয়ে। এ-ও যথেষ্ট না হলে লুসিফারের দেয়া শত সূর্যের আলো তো আছেই।

সবাই আশা করেছিল রঙের কোনো খেলা দেখা যাবে না এর বুকে-তবু না পেয়ে বেশ হতাশ হতে হল ক্রুদের। যেন ইউনিভার্স কোনো খোলা কয়লাখনিতে বসে আছে। চারপাশের কালোকে গোনায় ধরলে তুলনাটা মন্দ নয় মোটেও। তুষার আর বরফের সাথে অঙ্গাঅঙ্গি মিশে আছে কার্বন আর কার্বনঘটিত যৌগের দল।

ক্যাপ্টেন স্মিথ, তার দায়িত্বানুযায়ী, ধীরে মূল এয়ারলক থেকে সাবলীলভাবে নিজেকে বের করে দিল। ভূমিতে পৌঁছতে পৌঁছতেই যেন বয়ে গেল অসীম সময়। তারপর গুঁড়োয় ঢাকা উপরিতল থেকে খানিকটা সে তুলে নিল মুঠো ভরে, গ্লাভস পরা হাতে রেখে খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে দেখাও তার আগ্রহের অংশ।

আর এদিকে, ইউনিভার্সে বসে থাকা প্রত্যেকে অধীর আগ্রহ নিয়ে ইতিহাসের বুকে জায়গা করে নিবে যে কথাটুকু তার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে শুরু করল।

ক্যাপসিকামের বিচি আর নুনের দানার মতো দেখাচ্ছে। বলল ক্যাপ্টেন, ছিটিয়ে দিলে বেশ ফসল ফলবে বোধহয়।

* * *

মিশনের পরিকল্পনা একটু ভিন্ন। একটা পূর্ণ হ্যালির-দিন গবেষণায় কাটানোর কথা। পৃথিবীর হিসাবে পঞ্চান্ন ঘণ্টা। তারপর যদি কোনো সমস্যা না দেখা দেয় তো দক্ষিণ মেরু থেকে মাইল দশেক দূরে বিষুবীয় এলাকায় আরেকটা চক্কর দেয়া যেতে পারে। সুযোগ বুঝে সেখানে কোনো উষ্ণ প্রসবণ নিয়ে মেতে থাকা যাবে পুরো একটা দিবস-রজনী চক্র সাথে নিয়ে।

প্রধান বিজ্ঞানী পেভ্রিল সময় নষ্ট করায় বিশ্বাসী নয়। অপেক্ষারত প্রোবের বিকনের দিকে বেরিয়ে গেল সে একজন সহকারী সাথে করে নিয়ে দুজনের জেট স্নেডে করে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সগর্বে ফিরে এল তারা। সাথে বিভিন্ন স্যাম্পলের দঙ্গল। ডিপ ফ্রিজে রাখা হবে সেগুলো।

অন্য দলগুলো উপত্যকাজুড়ে তার-টারের একটা জাল বুনে ফেলেছে। খুঁটি দিয়ে বসানো সেসব, শেষপ্রান্ত ভাজা ভাজা কয়লার গহীনে। ফলে শুধু শিপের হাজারো যন্ত্রের সাথে সংযোগ হয়নি, বরং বাইরে চলাচলে বেশ সুবিধাও পাওয়া যাচ্ছে। ঝক্কিঝামেলার এক্সটার্নাল ম্যানুভারিং ইউনিট বাদেই চলাচল সহজ হল এবার। শুধু ক্যাবলগুলোতে দু হাত দিয়ে আড়াআড়ি ধরলেই চলবে, আপনিই ধীরে ধীরে চলাচল করা যায়। খটমটে ই এম ইউ ব্যবহার করার চেয়ে এ কাজ অনেক সহজ আর আনন্দদায়ক। আসলে কোনো যন্ত্র যখন বেশি পূর্ণতা পায় তখনি সেটার প্রতি মানুষের আসক্তি কমে আসে। এই ইউনিটগুলো এক মানুষের জন্য পূর্ণ স্পেসশিপের কাজ করে দেখেই হয়তো এ অনাসক্তি।

যাত্রীরা এসব দেখেশুনে বেশ উত্তেজিত; আর আবিষ্কারের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টাতেও কোনো ত্রুটি নেই। এই উত্তেজনা খিতিয়ে আসতে আসতে প্রায় বারো ঘণ্টা কেটে গেল। সাবেক মহাকাশচারী ক্লিফোর্ড গ্রিনবার্গের মতে সময়টা অনেক কম। শিঘ্নি বাইরে যাওয়া নিয়ে কথা উঠল; শুধু ভিক্টর উইলিস কোনো কথা তোলেনি।

আমার ধারণা ও ভয় পাচ্ছে, খুব। দিমিত্রি বলল ঝাঁঝের সাথে। এমিতেও সে ভিক্টরকে কক্ষনো পছন্দ করতো না; বিশেষত এই বরেণ্য লোকটার কানে সামান্য খাটো হবার কথা জানার পর। ভিক্টরের প্রতি এটা অতি অন্যায় অবিচার। কারণ সে নিজেরই অসীম কৌতূহল আর পরীক্ষায় নিজেকে গিনিপিগ বানানোর মতো সাহস দেখিয়েছিল। দিমিত্রি কথাটার সাথে আরো একটু যোগ করার লোভ সামলাতে পারল না, যে মানুষের ভিতরে নেই সংগীতের মূৰ্ছনা; তার থাকবে শুধু অতৃপ্তি, অনন্ত সংগ্রাম আর অপূর্ণতা।

এদিকে পৃথিবীর অর্বিট ছেড়ে আসার আগেই ফ্লয়েড সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল। ম্যাগি মবালা নিজেই যথেষ্ট, ধার করা উৎসাহের কোনো প্রয়োজন নেই তার ক্ষেত্রে। (হাজার হলেও, তার প্রিয় স্লোগান, একজন লেখকের কখনোই নূতন অভিজ্ঞতার সুযোগ হারাতে নেই। তার আবেগিক জীবনে অনেক অনেক বিখ্যাত প্রভাব পড়েছে)

ইভা মারলিন যথারীতি সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে; তাকে নিয়ে একটা ট্যুরের ইচ্ছা আছে ফ্লয়েডের মনে। সবার জানা, ফ্লয়েড তার একটু ভক্ত বটে; তার উপর প্যাসেঞ্জার লিস্টে ইভার নামটা উঠে আসার পেছনে ফ্লয়েডের যে হাত আছে তা নিয়েও কথা কম হয়নি। সেসব কথা বাড়তে বাড়তে এখন দারুণ একটা রূপ পেয়েছে, তাদের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে ব্যস্ত সবাই। ব্যাপারটায় একটু হিংসা করছে যেন দিমিত্রি আর শিপের ফিজিশিয়ান ড. মহিন্দ্র।

প্রথম প্রথম বিরক্ত হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না; কিন্তু কিছু সময় কাটার পর ফ্লয়েডের তারুণ্যের কথা মনে পড়ে যায়। এখন আর তাই রসিকতাটুকু খারাপ লাগে না, বরং উপভোগ্য মনে হয় । কিন্তু এসব ঠাট্টায় ইভা কী মনে করে তা ফ্লয়েড জানে, জিজ্ঞেস করার মতো ঠিক সাহসও জোটানো যাচ্ছে না। এই এখানে, ছোট্ট সমাজে, যেখানে হাজার রহস্যময় ব্যাপারও ঘণ্টা ছয়েক গোপন থাকে না, সেখানেও ইভা তার সেই রহস্যগুলো অবগুণ্ঠনে সযত্নে ঢেকে রেখেছে-যে রহস্য দিয়ে তিন তিনটা প্রজন্মকে সে পাগল করে রেখেছিল বছরের পর বছর।

ভিক্টর উইলিস পড়েছে আরেক ঝামেলায়।

ইউনিভার্সে সর্বাধুনিক স্পেসস্যুট মার্ক এক্স এক্স সাজানো আছে; এর ভিতর আবার নন ফগিং, নন রিফ্লেক্টিভ এবং নিশ্চয়তা দেয়া থাকে যে মহাকাশের অসমান্তরাল দৃশ্য পাওয়া যাবে। হেলমেটগুলো বিভিন্ন আকার আর প্রকারের হলেও ভিক্টর উইলিস কোনোটাতেই মাথা গলাতে পারবে না বড়সড় অপারেশন করানোর আগ পর্যন্ত।

তার প্রতীক প্রতিষ্ঠিত হতে পনেরটা বছর চলে গেল।

এখন দাঁড়িই ভিক্টর উইলিস আর হ্যালির মাঝে বাঁধা; এ দুয়ের মাঝে যে। কোনোটাকে বেছে নিতে হবে এবার।

১৭. কালো তুষারের উপত্যকা

ক্যাপ্টেন স্মিথ ই ভি এর পক্ষে। তার মতে, ধূমকেতুর বুকে পা না ফেলাটাই উত্তম।

ইন্ট্রাকশন মতো চললে কোনো সমস্যাই দেখা দেবে না, তার সেই অপ্রতিরোধ্য ব্রিফিং চলছে, এমনকি আগে কোনোদিন স্পেসস্যুট না পরলেও কুছ পরোয়া নেহি-দূর জানি, কমান্ডার গ্রিনবার্গ আর ড. ফ্লয়েড এ ধরনের স্যুট গায়ে গলিয়েছিলেন-তবে আজকের স্যুটগুলো কিন্তু সে আমলের মতো নেই। পুরোপুরি অটোম্যাটিক, পরেও বেশ আরাম পাবেন। কোনো কন্ট্রোল বা অ্যাডজাস্টমেন্ট নিয়ে গলদঘর্ম হবার দরকার নেই, শুধু এয়ারলক দিয়ে বেরিয়ে যাবেন, ব্যস।

একটা স্থির নিয়ম মানতেই হবে, ই ভি এ দিয়ে একবারে মাত্র দুজন বেরুতে পারবেন। পাহারা কিন্তু থাকছেই, ভয় নেই। পাঁচ মিটার লম্বা দড়িতে বাঁধা থাকবে যানটা, প্রয়োজনে বিশ মিটার পর্যন্ত বাড়ানো যাবে দূরত্ব। আরো অ্যাডভেঞ্চার চান? তো ভ্যালি জুড়ে যে ক্যাবলগুলো ঝুলিয়ে রেখেছি তার একটায় দুজনকেই বেঁধে দেয়া যাবে। চলাচলের নিয়মকানুন পৃথিবীর মতো-সবাই নিজের নিজের ডানদিক ধরে যাবেন। প্রয়োজনে একজন ছুটে যেতে পারেন, এমনকি দুজনে ছুটলেও অসুবিধা নেই, নিউক্লিয়াসের বাইরে ভেসে যাওয়াতেও ভয়ের কিছু দেখছি না। স্পেস থেকে ধরে আনতে জানি আমরা। কোনো প্রশ্ন?

কতক্ষণ বাইরে থাকা যাবে?

আপনার যতক্ষণ ইচ্ছা, মিস মবালা। কিন্তু আমার মতে একটু অস্বস্তি হলেই ফিরে আসা উচিত। প্রথম আউটিংয়ে ঘণ্টাখানেকই ভাল। যদিও মনে হবে মিনিট দশেকের মধ্যেই সময় কেটে গেল…

ক্যাপ্টেন স্মিথের কথাটা অনেকাংশেই ঠিক। পেরুনো সময় ডিসপ্লেতে তাকিয়েই আৎকে উঠল ফ্লয়েড। কোন ফাঁকে চল্লিশ মিনিট উড়ে গেল কে জানে! অবশ্য এ নিয়ে এতো অবাক হবার কিছু নেই, শিপ এখান থেকে কিলোমিটার-টাক দূরে।

যে কোনো বিচারে সবচে জ্যেষ্ঠ যাত্রী হিসেবে সেই প্রথম ই ভি এ তে ওঠার সৌভাগ্য অর্জন করে। আর সহযাত্রীর ব্যাপারে কিছু বলার সুযোগ পায়নি ফ্লয়েড।

ই ভি এ উইথ ইভা! বলেছিল মাইকেলোভিচ, কী করে এই সম্মিলনকে হেলা করা যায় হে! এমনকি যদি, একটা বিস্তৃত মুচকি হাসি দিয়ে যোগ করল বাকী কথাটা, তুমি চাও-ও, তবু ওই খটমটে স্যুটগুলো তোমাদের বাড়তি যে কোনোকিছু করার চেষ্টায় বাধা দেবে।

ইভা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই রাজি হয়ে গেল; অবশ্য বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাসও প্রকাশ পেল না… এই ব্যাপারটা, বলল ফ্লয়েড মনে মনে, তার ক্ষেত্রে চিরায়ত । আর বিরক্তও হল বেশ। বিরক্তিটা ইভার উপর নয়, নিজেরই উপর। হাজার হলেও, ইভার সাথে মোনালিসার তুলনা হয়েছে বেশ অনেকবার; তাদের দুজনের কাউকেই আর যা-ই দেয়া যাক না কেন, দোষ দেয়া যায় না।

তুলনাটা আসলেই… বেখাপ্পা লা জিওকন্ডাও রহস্যময়ী। কিন্তু সে তো অবশ্যই উত্তেজক নয়। ইভার ক্ষমতাটা ঠিক এখানে লুকিয়ে থাকে, এই দুয়ের মাঝামাঝি কোথাও-সাথে নিষ্পাপ সারল্যের একটা ছোঁয়া… এই আধ শতাব্দী পরও তার ভেতরে এই তিনের দারুণ সমাহার দেখা যায়; অন্তত বিশ্বাসীর চোখে।

শুধু একটা ব্যাপারেরই বেশ অভাব দেখা যাচ্ছে-এভাবে ভাবতে চায় না ফ্লয়েড, তবু না ভেবে উপায় নেই, একটা সত্যিকার ব্যক্তিত্বের বেশ অভাব তার ভিতরে।

ইভার উপর মনোসংযোগ করার জোর চেষ্টা করলে দেখা যায়, ওর পার্সোনালিটিটা আসলে ওর অভিনয় করা প্রতিটি চরিত্রের অদ্ভুত মিশেল। কোনো এক সমালোচকের সেই বিখ্যাত উক্তির সাথে একমত না হয়ে উপায় নেই, ইভা মারলিন আসলে সব মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন; কিন্তু একটা আয়নার কোনো নিজস্ব চরিত্র নেই।

এখন, হাজার বছরের রহস্যমাখা, সৌর জগতের সাময়িক অতিথি হ্যালির ধূমকেতুর বুকে, কালো তুষারের উপত্যকা জুড়ে একটা ক্যাবলে আটকানো অবস্থায় এই বিচিত্র সৃষ্টিই তার পাশে পাশে ভেসে চলেছে। উপত্যকাটাকে এ নামেই ডাকে সবাই, কেউ কোনোদিন কোনো স্থির মানচিত্রে একে দেখতে পায়নি। হুবহু দেখতে পাবেও না, কারণ পৃথিবীর ঋতু বদলের মতো করে এখানকার মানচিত্র বদলায়। সে ব্যাপারটাকে দারুণ উপভোগ করছে; এই চারপাশের দৃশ্যগুলো কোনো মানুষের চোখ কোনোকালে দেখেনি, সম্ভবত এমনভাবে কোনোকালে দেখবেও না। এদূর আসার সাহস হবে না সবার।

চাঁদের বুকে, অথবা মঙ্গলের বুকে, কোনো কোনো এলাকায় কিস্তৃত আকাশের কথাটা হিসাব থেকে বাদ দিলে মানুষ পৃথিবীর সাথে কিছু না কিছু মিল দেখতে পাবেই, অথবা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। এ অঞ্চলে সে আশায় গুড়ে বালি। প্রায় ভেসে থাকা কালো কালো ফেনা ফেনা তুষার দেখে বোঝাই যায় না যে এখানে বিন্দুমাত্র গ্র্যাভিটি থাকা সম্ভব। এমনকি সত্যি সত্যি ফেনার বিশাল বিশাল দঙ্গল ভেসে আছে চারদিকে। কখনো কখনো অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে উপর-নিচ নির্ধারণ করতে হয়।

তবে কালো তুষারের উপত্যকায় কাহিনী উল্টো। এর আকৃতি একেবারে কঠিন। পানি আর হাইড্রোকার্বনের বিচিত্র বরফ-সাগরের উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কঠিন কোনো রিফ। ভূতত্ত্ববিদরা এখনো এর উৎপত্তি নিয়ে হা-পিত্যেশ করে বেড়ায়। কারো কারো মতে এটা কোনো গ্রহানুপুঞ্জের অংশ, অজানা অতীতে ধূমকেতুটার বুকে আঘাত হেনেছিল, আজো নিজের ভিন্ন অস্তিত্বের কথা ভোলেনি। এর ভিতরে জৈব যৌগের বিচিত্র সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়, অনেকটা যেন জমাট কাঠকয়লা, যদিও এটুকু নিশ্চিত যে জীবন এখানে খেলা করেনি কোনোকালে।

ছোট্ট ভ্যালিটাকে ঢেকে ফেলা তুষার কিন্তু সত্যিকার অর্থে পুরোপুরি কালো নয়; ফ্লয়েডের ফেলা আলো লেগে এমনভাবে ঝিকিয়ে উঠল-যেন লাখ লাখ অতি খুদে হীরা দিয়ে তৈরি। কে জানে, ভাবল ফ্লয়েড, হ্যালিতে হীরা থাকতেও পারে, অন্তত কার্বনের কোনো অভাবতো নেই। আর এ-ও সত্যি যে হীরা গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপ বা চাপের কোনোটাই নেই এখানে।

হঠাৎ কথাটা ভাবতে ভাবতেই সে দু মুঠো ফেনা তুলে নেয়ার জন্য নিচু হল… কাজটা করার সময় একটু ভাড় ভাড় লাগছিল নাকি তাকে? অন্তত সার্কাসের দড়িখেলায় লোকগুলো যেভাবে শক্ত রশির উপর লাফায়-এগোয় অনেকটা সেভাবেই এগিয়েছিল সে, শুধু উপরের দিকটা নিচে, এই যা। ভঙ্গুর উপরিতলটা একটুও বাঁধা দিল না তার মাথা আর কাঁধকে। তারপর ভদ্রভাবে নিজের উর্ধ্বাঙ্গ উদ্ধার করল ফ্লয়েড, মুঠোভর্তি হ্যালি নিয়ে।

ব্যাপারটা হাতের গ্লাভসগুলো বেয়ে অনুভব করতে পারলে বেশ হত। এমনকি দলা করে একটা বলের মতো গোল চকমকে আকার দেয়ার সময়ও টের পাওয়া যায়নি। এইতো! মিশকালো বলটাও কী সুন্দর দ্যুতি ছড়ায় নাড়াচাড়া করার সময়!

আর সাথে সাথেই, কল্পনার রঙে রঞ্জিত হয়ে বলটা হয়ে গেল সাদা, দুধসাদা। আর সে যেন সেই ছোট্ট ছেলে, শীতের মাঠে খেলছে, হাতে বরফ, আর সামনে পেছনে-চারদিকে ভূত-প্রেত-ডাইনী। শুনতে পাচ্ছে খেলার সাথীদের চিৎকার, হুমকি; অনুভব করছে তাদের ছোঁড়া বলগুলোর আঘাত…

স্মৃতিটা ছোট্ট, কিন্তু বেশ বড়সড় ধাক্কা দিয়ে যাবার মতো। অসহ্য এক যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল তার মনে। আজ এই শত বছর পরে তার ভূত-প্রেত বন্ধুদের কারো কথাই মনে পড়ে না। ওদেরই কারো একজনকে সে ভালবাসত, কী ভালই না বাসত…

ফ্লয়েডের আঙুলগুলো মমতা নিয়ে অপার্থিব তুষারের গোলাটাকে আদর করছে, আর চোখ দিয়ে নামছে অবিরল জলধারা। এরপর দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে ওঠে; কেটে যায় ঘোর। এতো দুঃখের মুহূর্ত নয়, আনন্দের সময়।

মাই গড! চিৎকার করে উঠল হেউড ফ্লয়েড, তার শব্দগুলো স্পেসস্যুটের ছোট্ট, আঁটসাঁট জগতে প্রতিধ্বনিত হয়ে গুমরে মরছে, আমি হ্যালির ধূমকেতুতে দাঁড়িয়ে আছি, আর কী চাই! এখনি যদি কোনো উল্কার আঘাতে মরে যাই তো কী এসে যায়!

তারপর সে তুলে আনে হাত দুটো, বলটাকে ছুঁড়ে দেয় তারার রাজ্যে। একেবারে ছোট বলটা মুহূর্তেই হারিয়ে যায় কালো আকাশের গায়ে, তাতে কী, হেউড ফ্লয়েড একদৃষ্টে চেয়ে থাকে সেদিকেই।

ঠিক তক্ষুনি এলোমেলোভাবে আলোর একটা ঝাক এসে পড়ল। অপ্রত্যাশিতভাবে, লুকানো সূর্য তার আলোর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে ঐ বলটার গায়ে। লাখো প্রতিফলক কণার গায়ে পড়ে আধো আঁধারির আকাশে স্পষ্ট দেখা গেল সেটাকে।

এখনো ফ্লয়েড তাকিয়ে আছে, হারিয়ে যাচ্ছে জিনিসটা। কে জানে কোথায় হারালো, নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে, আবার চলেও যেতে পারে অনেক অনেক দূরে। উপরের তেজস্ক্রিয়তার ঝড়ে বেশিক্ষণ টিকবে না, তাতে কী, কজন মানুষ নিজের বানানো ধূমকেতু নিয়ে বাহাদুরি করতে জানে?

১৮. ওল্ড ফেইথফুল

ইউনিভার্স মেরু এলাকায় থাকতে থাকতেই সাবধানে সব অভিযাত্রা শুরু হয়ে ১ গেল। প্রথম প্রথম এক মানুষবাহী ই এম ইউগুলো এখনো অনেকে জানে না যে ই এম ইউ মানে এক্সটার্নাল ম্যানুভারিং ইউনিট) দিন-রাত সব এলাকাই চষে বেড়ালো, আগ্রহ জাগানো সব বিষয়ই টুকে নিল সতর্কভাবে। প্রাথমিক নিরীক্ষা একটু ঝিমিয়ে আসতেই সর্বোচ্চ পাঁচ বিজ্ঞানীর দল ঝাঁপিয়ে পড়ল স্পেসশিপের শাটল নিয়ে। কৌশলগত পয়েন্টগুলোতে বিদঘুঁটে সব যন্ত্রপাতি পেতে আসাই মূল উদ্দেশ্য।

লেডি জেসমিন হল ডিসকভারি যুগের প্রাচীন স্পেস পোডের অতি আধুনিক বিবর্তিত রূপ। শুধু গ্র্যাভিটি বিহীন এলাকায় রাজত্ব চালানো এর কাজ। আসলে ছোটখাট একটা স্পেসশিপ। চাঁদের, মঙ্গলের বা বৃহস্পতীয় উপগ্রহ থেকে ইউনিভার্সে হাল্কা-পষ্কা মাল সামান অথবা মানুষ পারাপারের কাজ এর কাঁধে ন্যস্ত। ওর গর্বিত চিফ পাইলট ওকে সামান্য একটা ধূমকেতুতে কাজে লাগানোর পক্ষপাতী নয়।

হ্যালির বহিরঙ্গে কোনো বিশেষ চমক নেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ক্যাপ্টেন স্মিথ মেরুদেশ ছেড়ে উড়ল। মাত্র ডজনখানেক কিলোমিটার যেতে না যেতেই ইউনিভার্স নতুন এক জগতে উপস্থিত। মাসের পর মাস অন্ধকারে পড়ে থাকা এলাকা ছেড়ে ছন্দিত দিবা-রাত্রির সাথে পরিচিত অঞ্চলে হাজির হল এই সর্বাধুনিক স্পেসশিপ। এখানে সূর্যোদয়ের পর পরই ধীরে ধীরে ধূমকেতুর গায়ে নূতন প্রাণের সঞ্চার হয়।

সূর্যের কিরণ সরাসরি পড়ার সাথে সাথে জ্বলজ্বল করে উঠবে সব পর্বতচূড়া। বেশিরভাগই স্তব্ধ হয়ে থাকবে, তাদের সরু কণ্ঠনালী বেয়ে খনিজ নুন উঠতে উঠতে এখন একেবারে বুজে গেছে স্বর।

তারপরও, সূর্য এবার হ্যালির বুকে রঙের খেলা দেখাবে। জীববিদরা চিৎকার শুরু করে দিল, এখানে প্রাণ জন্ম নিচ্ছিল ঠিক প্রাচীন পৃথিবীর মতো। কেউ কেউ সে আশা ছেড়ে দেয়নি, কিন্তু হাতে কোনো প্রমাণ নেই।

অন্য জ্বালামুখগুলো থেকে বাস্পের রেখা উঠে যাচ্ছে উপরে। অতিপ্রাকৃতভাবে শুধু সোজা উপরে উঠে যাচ্ছে, কারণ বাঁকা করে দেয়ার মতো কোনো বাতাস নেই চারপাশে। যথারীতি প্রথম দুয়েক ঘণ্টায় আর তেমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু সূর্যের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে এসব ঘটনার তেজও বাড়বে, আড়মোড়া ভাঙবে ভিতরের জমাট যৌগ। ভিক্টর উইলিস একেই বলে, তিমির জলোচ্ছাস।

মোটামুটি চিত্রিত করা গেলেও কথাটা দিয়ে আসল উদাহরণ টানা যায় না। হ্যালির পানি ছোঁড়া সামান্য সময় ধরে হয় না, বরং ঘন্টার পর ঘণ্টা চলতেই থাকে। তার উপর, কখনো বেঁকে আবার সারফেসে ফিরে আসে না, বরং উঠতেই থাকে সেই কুয়াশার দিকে যার সৃষ্টিতে ওরা অবদান রেখে যাচ্ছে।

প্রথম প্রথম বিজ্ঞানীরা এমনভাবে উষ্ণ প্রসবণগুলো নিয়ে পরীক্ষা করছিল যেন তারা অগ্নিগিরি বিশেষজ্ঞ, এগুচ্ছে এটনা অথবা ভিসুভিয়াসের দিকে, অতি সাবধানে। একটু পরই ভুল ধরা পড়ল। না, মাঝেমধ্যে এক-আধটু বেয়াদবি করলেও তারা আসলে তেমন হিংস্র নয়। সাধারণ আগুন নেভানোর হোজ থেকে যেভাবে পানি বেরোয় ঠিক সেভাবেই বিচ্ছুরণ ঘটে। পানিটা বেশ গরম। আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার থেকে বেরিয়েই মুহূর্তের মধ্যে বাষ্প আর ক্রিস্টাল বরফের মিশ্রণরূপে লুটিয়ে পড়ে উপরের বিশাল সাদা অঞ্চলে। উপরের দিকে পড়তে থাকা তুষারঝড়ে আবৃত এক ধূমকেতুর নাম হ্যালি। এমনকি সবচে দ্র বেগে বেরুনো জিনিসগুলোও আর ফিরে আসছে না আপন উৎসের বুকে। প্রতিবার সূর্যের কাছাকাছি এসে আবার ফিরে যাবার পথে হ্যালি তার জীবন অমৃতের অনেকটা হারিয়ে বসে মহাশূন্যের নিঃসীম শূন্যতায়।

যথেষ্ট সময় ধরে অপেক্ষা করার পর ক্যাপ্টেন স্মিথ ইউনিভার্সকে ওন্ড ফেইথফুলের শত মিটারের মধ্যে নিতে রাজি হল। দিবা-ভাগের সবচে বড় উষ্ণ প্রসবণের নামটা মন্দ হয়নি। ধোঁয়াশার এক স্থূল স্তম্ভ, যেন কোনো অতি ক্ষুদ্র মূলের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বপু গাছের গা। ধূমকেতুর অন্যতম প্রবীণ জ্বালামুখটার ব্যাস তিনশো মিটার। বিজ্ঞানীরা আরো আগেই এর আশপাশ চষে বহুরঙা বীজ নিয়ে এসেছে। হায়, নিষ্ফল বন্ধ্যা বীজ! যথারীতি থার্মোমিটার আর স্যাম্পলিং টিউব দাবিয়ে দেয়া হয়েছে চারপাশে, এমনকি স্তম্ভের গায়েও।

যদি আপনাদের কাউকে এটা উপরে ছুঁড়ে দেয়, সাবধান করেছিল ক্যাপ্টেন, তাড়াতাড়ি উদ্ধার পাবার আশা করবেন না আশা করি । অপেক্ষা করতে হবে, অন্তত নিজে নিজে ফিরে আসা পর্যন্ত।

কী বলল ব্যাটা? কী বোঝাতে চায়? ধাঁধায় পড়ে দিমিত্রি মাইকেলোভিচ প্রশ্ন তোলে।

ভিক্টর উইলিস জবাব দিতে তেমন দ্বিধা করেনি, মহাজাগতিক বিদ্যায় ব্যাপারগুলো আমাদের আশা অনুযায়ী বা কল্পনা অনুযায়ী ঘটে না। হ্যালি থেকে নির্দিষ্ট গতির চেয়ে জোরে ছুঁড়ে দেয়া যে কোনোকিছু মোটামুটি নিয়মানুযায়ী অর্বিট ধরেই ঘুরতে থাকবে। বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য প্রচুর গতি দরকার। সুতরাং, একবার আবর্তন শেষ হইলে কক্ষপথদুইটি পরস্পরকে ছেদ করিবে; এবং তুমি আবার আগের জায়গাতেই ফিরে আসবে। বয়েস বাড়বে ছিয়াত্তর বছর, ব্যস।

ওল্ড ফেইথফুলের আশপাশেই এমন একটা কিছু ছিল যা কেউ আশা করেনি। প্রথম দেখে বিজ্ঞানীদলতো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেনি। হ্যালির বুকে কয়েক হেক্টর জুড়ে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া যে এলাকা দেখা গেল তাকে সোজা কথায় হ্রদ বলা যায়। শুধু চরম কৃষ্ণত্ব বাদে।

আর যাই হোক, পানি নয়। এখানে ভারী তেল জাতীয় পদার্থ ছাড়া অন্য কোনো

তরলের টিকে থাকা অসম্ভব। আসলে লেক টুনেলা দেখে পিচকালো পদার্থের কথাই বেশি করে মনে পড়ে। ঠিক যেন পিচ। প্রায় কঠিন, শুধু উপরিতলে এক মিলিমিটারের চেয়েও কম পুরু একটা আধ-তরল স্তর। এই অত্যন্ত কম গ্র্যাভিটিতে ব্যাপারটায় নিশ্চই বেশ কবছর সময় লেগে গেছে… সম্ভবত সূর্যের চারদিকে কয়েকবার ঘুরে আসার ফল। বিশেষত এর উপরিতলটা আয়নার মতো সমতল হতে এমন সময়ই লাগার কথা।

ক্যাপ্টেন এর উপর থামার পর পরই হ্যালির বুকে এটা এক বিশেষ পর্যটন আকর্ষণে পরিণত হল। কেউ একজন (কৃতিত্বটা কেউ দাবী করছে না) বলেছিল যে এর উপর হেঁটে যাওয়া বেশ মজার এবং আরামদায়ক হবে, ঠিক পৃথিবীর মতো। সারফেসের আঠালো ভাবটা পা আটকে রাখার কাজ ভালভাবেই করবে। খুব বেশিক্ষণ পেরুনোর আগেই অভিযাত্রীদের বেশিরভাগ পানির উপর হেঁটে যাওয়া অবস্থায় নিজেদের ভিডিওচিত্র ধারণ করল..

এর পরপরই ক্যাপ্টেন স্মিথ এয়ারলক এলাকা পরিদর্শন করে, এবং আবিষ্কার করে যে দেয়ালগুলো খুব সুন্দরভাবে আঠালো হয়ে আছে। এরপর, তাকে যতটুকু রাগতে দেখা গেল তাও বিস্ময়কর।

খুব খারাপ কথা, দাঁতের ফাঁক গলে বলল ক্যাপ্টেন স্মিথ, শিপের বাইরের দিকটা-ছাইগুড়োয় মোড়া দেখা আমার জন্য… আমার জীবনে দেখা সবচে নোংরা জায়গা হল হ্যালির ধূমকেতু…

এরপর আর কখনোই লেক টুনেলায় আলসী হাঁটাহাঁটির ঘটনা ঘটেনি।

১৯. অটি কুঠুরী নয় দরজা

ছোট্ট ভুবনে, পিচ্চি কোনো ইউনিভার্সে, যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের নাড়ীনক্ষত্র জানে, সেখানে এক্কেবারে নবাগতের মতো বিস্ময় আর কোনো কিছু উৎপাদন করতে জানে না।

এই বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে ফ্লয়েড, করিডোর ধরে ভদ্রভাবে মূল লাউঞ্জের দিকে ভেসে যাবার সময়। অবাক হয়ে নাক গলানো লোকটার দিকে তাকালো সে, কী করে শিপের ভিতর এ্যাদ্দিন লুকিয়ে থাকল ব্যাটা! অন্যজন তার দিকে একই সাথে বাহবা আর অপ্রস্তুতভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে, যেন ফ্লয়েডই আগে কথা বলবে।

ও, ভিক্টর! অবশেষে কথা বলল সাবেক অ্যাস্ট্রোনট, স্যরি! প্রথম প্রথমতো চিনতেই পারিনি। তো, তুমিই বিজ্ঞানের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছ… নাকি বলব তোমার লোকজনের জন্য?

হু, একটু যেন বিরক্ত হল উইলিস, কোনোমতে একটা হেলমেটে এঁটে যেতে পারলাম আর কী! কিন্তু মরার হেলমেট-গাত্রে এতো বিরক্তিকর শব্দ ওঠে যে কাউকে একটা কথাও বোঝাতে পারি না। শুধু খসখস শব্দেই দুনিয়া ঢেকে যায়।

তো, বাইরে যাচ্ছ কখন?

ক্লিফ ফেরার সাথে সাথেই। বিল চ্যান্টের সাথে সেই যে বেরিয়েছে…

.

সেই ১৯৮৬-তে প্রথম যেবার হ্যালির দেখা পেল বিজ্ঞানীদের টেলিস্কোপের বাহিনী। তখনই জানা যায়, ধূমকেতুটার ঘনত্ব পানির চেয়েও কম। তার মানে, হয় সূক্ষ্ম ছিদ্র ছিদ্র উপাদান ভর্তি, নয়তো শক্ত গায়েই বড় বড় গর্ত ছড়িয়ে আছে। দেখা যাচ্ছে দু ব্যাখ্যাই সত্যি।

সুড়ঙ্গ-অভিযানের ব্যাপারে চির সাবধান ক্যাপ্টেন স্মিথ সোজাসাপ্টা মানা করে দিয়েছে। কিন্তু বাঁধা মানে কে! ড. পেড্রিল তার নিজের মতে স্থির, পেড্রিলের চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ড. চ্যান্ট খুবই অভিজ্ঞ মহাকাশ-ভূগোলবিদ। তাকে সুযোগ দেয়া যায়। আর কী করা, দেয়া গেল।

লো গ্র্যাভিটিতে গুহায় ঢোকা অসম্ভব, সন্দিগ্ধ ক্যাপ্টেনকে বলেছিল পেড্রিল, তার মানে, আটকে পড়ার কোনো ভয় নেই।

হারিয়ে পড়ার ভয়ের খবর কী?

চ্যান্ট ব্যাপারটাকে পেশাদারী অপমান মনে করতে পারে। সে ম্যামথ গুহার বিশ কিলোমিটার গভীরে গিয়ে অভ্যস্ত। যাই হোক, তার হাতে একটা গাইডলাইন থাকবে।

যোগাযোগ?

লাইনের ভিতরে ফাইবার অপটিক্স থাকছে। আর স্যুট রেডিওর যোগাযোগ ক্ষমতাও প্রকট।

“উমম! তো, কোনখান দিয়ে যেতে চায় সে?

এটনা জুনিয়র বেসের কাছাকাছি যে মরা উষ্ণ প্রসবণটা আছে, সেটায়। অন্তত হাজার বছরে সেখানে কোনো উদগীরণ হয়নি।

তার মানে আশা করি আরো দিন দুয়েক চুপ থাকবে গর্তটা। খুবই ভাল-আর কেউ কি যেতে চায়?

ক্লিফ গ্রিনবার্গ স্বেচ্ছাসেবক হতে চাচ্ছে। এক পায়ে খাড়া। সে বাহামা দ্বীপপুঞ্জে অনেক আন্ডারওয়াটার গুহায় অভিযান চালিয়েছে এককালে।

“আমি একবারই চেষ্টা করেছিলাম… ওটুকুই যথেষ্ট। ক্লিফকে বলল, তার দাম অনেক। যে পর্যন্ত প্রবেশপথ দেখা যায় সে পর্যন্ত যাবার অনুমতি মিলবে। এর এক পা-ও ভিতরে নয় । আর যদি কোনোমতে চ্যান্টের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে যায় তো পিছুধাওয়া করতে পারবে না। অন্তত আমার অনুমতিতে নয়।

তারপর নিজের মনে বাকী কথাটা শেষ করল কাপ্তান, অনুমতি দেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার…

.

মহাকাশ-ভূগোলবিদদের নিয়ে যেসব পুরনো রসিকতা বাজারে চালু আছে তার মধ্যে মহাকাশ ভূগোলবিদরা আবার গর্ভে ফিরে যেতে চায় ভয়ে… টা সবচে চলতি কৌতুক। ড. চ্যান্ট এ কথাটা বৃথা করে দিতে বদ্ধ পরিকর।

মরার জায়গাটায় নিশ্চই বিজবিজে শব্দ চলবে সারাক্ষণ; সদা-সর্বদা অলক্ষুনে গর্তটা তর্জন-গর্জন-জাবর কাটা ছাড়া আর কোনো কাজে ব্যস্ত থাকবে বলেতো মনে হচ্ছে না। তার বিরক্ত মতামত এমনই, আমি খানাখন্দ-গর্ত পছন্দ করি কারণ সেগুলোতে বিন্দুমাত্র শব্দ নেই। আর সময় থাকে থেমে। হাজার বছরে কিস্যু বদলে যায়নি, শুধু স্ট্যালাকলাইটগুলো আরো একটু মোটা হয়েছে, ব্যস।

আর এখন, চিকন কিন্তু দুর্দান্ত শক্ত রশি দিয়ে ক্লিফোর্ড গ্রিনবার্গের সাথে বাঁধা অবস্থায় হ্যালির আরো আরো গভীরে ভেসে যাবার সময় সে বুঝতে পারছে যে কথাটা সত্যি নয়। কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়াই তার ভূগোলবিদের মন বলছে যেন এ আজব এলাকাটা মাত্র গতকাল তৈরি হল… অবশ্যই, সৃষ্টি জগতের সময় মাত্রায় হিসেবটা ধর্তব্য। আসলেও, গুহাটা কোনো কোনো মানব-সৃষ্ট মহানগরীর চেয়েও নবীন।

যে সুড়ঙ্গ ধরে সে নেমে যাচ্ছে তার সরু ঠোঁটগুলো বড়জোর মিটার চারেক চওড়া। তার উপর পরিবেশের ওজনহীনতা পানির নিচের গুহা-ডাইভিংয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঠিক যেন পৃথিবীর কোনো জলমগ্ন সুড়ঙ্গে বাড়তি কিছু ওজন বয়ে নিচ্ছে সে, তাই নেমে যাচ্ছে আরো আরো নিচে। শুধু বিন্দুমাত্র বাঁধা না থাকায় বোঝা যায় যে এলাকাটা বায়ুশূন্য, পানিতো দূরের কথা।

তুমি কিন্তু দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাচ্ছ, অভিযোগ তুলল গ্রিনবার্গ, প্রবেশপথের পঞ্চাশ মিটার ভিতরে যাবার পর পরই, রেডিও লিঙ্ক বেশ ভাল কাজ দিচ্ছে। আশপাশটা কেমন?

বলা মুশকিল-আমি কোনো ফরমেশন পাচ্ছি না খুঁজে, সুতরাং ব্যাখ্যা করার মতো ভাষা নেই। ঠিক কোনো প্রকারের পাথর নয়, আঙুল ছোঁয়ালেই ভেঙে ভেঙে পড়ছে-যেন কোনো বিশাল পনিরের ভেতর বসে আছি আমরা…

তার মানে জিনিসটা জৈবিক?

হ্যাঁ-কিন্তু অর্গানিক অর্থে-প্রাণের কোনো সম্পর্ক নেই, আশাও করা যায় না। কিন্তু প্রাণ সঞ্চারের প্রাথমিক উপাদানে ভরপুর। সব ধরনের হাইড্রোকার্বন… কেমিস্টরা বেশ মজা পাবে। এখনো দেখতে পাচ্ছ তো আমাকে?

শুধু তোমার লাইটের হাল্কা আলো। তাও মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

আহ-এখানে একটু খাঁটি পাথরের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে…দেখেশুনে ঠিক এখানটার সাথে মেলানো যায় না। আরে! আমি স্বর্ণের সাথে ধাক্কা খেলাম!

মশকরা বাদ দাও তো!

পুরনো পশ্চিমে হাজার মানুষকে এ জিনিসটা ধোঁকা দেয় যুগ যুগ ধরে-আয়রণ পাইরাইটস। বাইরের দিকের উপগ্রহগুলোতে সহজলভ্য। কিন্তু এ জিনিস এখানে কী করছে দয়া করে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলো না…

ভিজুয়াল কন্টাক্ট লস্ট। দুশ মিটার ভিতরে চলে গেছ, সাবধান।

এক ভিন্ন স্তর ধরে এগুচ্ছি। দেখেশুনে উল্কাজাত খণ্ড মনে হয়। নিশ্চই দারুণ। কিছু হয়েছিল সে সময়ে-আশা করি দিনক্ষণ বের করতে পারব পঞ্জিকা উল্টে-ওয়াও!

এমন কিছু আমার বেলায় না করলেই হল।

স্যরি-আসলে দম আটকে ফেলেছে-সামনেই একটা বিশাল… কী বলা যায় একে? চেম্বার। আমার চাওয়া শেষ জিনিস। দাঁড়াও, আলোটা একটু আশপাশে বুলিয়ে নিই…

পুরোপুরি চতুষ্কোণ। এপাশ-ওপাশে ত্রিশ-চল্লিশ মিটার হবে। আর… অবিশ্বাস্য! হ্যালির বুক জুড়ে শুধু চমক আর চমক! স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালেগমাইট।

এ নিয়ে এতো অবাক হবার কী হল?

এখানে পানির মুক্ত পতন নেই, নেই চুনাপাথর-অন্তত এতো লো গ্র্যাভিটিতে থাকার কথা নয়। কোনো ধরনের মোম হবে হয়ত। এক মিনিট, ভালমতো ভিডিও নিয়ে নিই… চমৎকার আকৃতি… যেন গলন্ত মোম থেকে তৈরি… কী ব্যাপার…

আবার কী হল?

ড. চ্যান্টের স্বরের সুর পাল্টে গেল অনেকটা। গ্রিনবার্গের বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

কয়েকটা কলাম ভেঙে গেছে; পড়ে আছে ফ্লোরের উপর… ঠিক যেন…

বলে যাও।

.. যেন কিছু একটা ভর করেছে ওগুলোর উপর।

পাগলের মতো কথা বলোনা! ভূকম্পনে এমন হয়নি তো?

এখানে ভূমিকম্পের কোনো অস্তিত্বই নেই। শুধু জীবিত প্রসবণ থেকে মৃদু কম্পন আসে, এই যা। যেন কোনো এক সময় বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল গুহাটা। যাই হোক, অন্তত কয়েক শতাব্দী আগের ঘটনা। পড়ে থাকা কিছু স্তম্ভের উপর কয়েক মিলিমিটার পুরু মোম পড়েছে, মুখের কথা না।

ড. চ্যান্ট ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পাচ্ছে যেন। সে এম্নিতে মোটেও কল্পনা বিলাসী নয় কিন্তু পরিস্থিতির কারণে বিধি বাম; মনের বিরক্তিকর স্মৃতির কুঠুরী খুলে গেছে হঠাৎ করে। স-ব কলাম দেখে মনে হয় যেন কোনো বিশাল দৈত্য খাঁচা খুলে পালানোর পর লোহার দণ্ডগুলো পড়ে আছে চারপাশে…।

অবশ্যই, কল্পনাটা অতিরঞ্জিত; এবং মানানসই। ড. চ্যান্ট অবশ্য কোনো সম্ভাবনাকেই খাটো করে দেখতে শেখেনি। যে কোনো পরিবর্তনই ভাবায়, আর সাবধানের মার নেই-পুরনো কথা। এই সাবধানতাই জীবন বাঁচিয়েছিল একাধিকবার। ভয়ের কারণ ধরতে পারার আগ পর্যন্ত এই চেম্বার ছাড়িয়ে যাবে না সে। নিজের সাথে চাতুরীর কোনো ইচ্ছাও তার নেই, শব্দটা আসলে ভয়ই হবে।

বিল-সব ঠিকঠাক চলছে তো? কী হল?

এখনো ভিডিও করছি; আসলে কলামগুলো দেখে ঠিক রেড ইন্ডিয়ানদের তাঁবু লুটের কথা মনে পড়ে গেল। কী বলব, বিতিকিচ্ছিরি!

সে মনের ভয়-ভয় ভাবটাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে বেশ জোরেসোরে। কাজের কথা ভাবতে থাকলেই হল। তার উপর মানসিক দৃষ্টিটা যদি বেশ উঁচু হয় তো যে কোনো অবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ। অবশ্য এই খাঁটি যান্ত্রিক রেকর্ডিংয়ের কাজটা মনের অনেক অংশ দখল করে রাখে, ভয় জাতীয় আবেগ নয়।

আরে, উল্টা-পাল্টা কিছু নেই; সে নিজেকে জানিয়ে রাখল, স্বাস্থ্যবান ভয়কে সাথে নিয়েই। তার জানা আছে, ভয় বাড়তে বাড়তে আতঙ্কে পরিণত হলে মানুষ এম্নিতেই মরে যেতে পারে। আতঙ্ক কাকে বলে, কত প্রকার ও কী-কী, প্রত্যেক প্রকারের সংজ্ঞা সহ উদাহরণ দিতে পেরেছে সে, জীবনে দুবার। একবার পাহাড়ের উপর, আরেকবার পানির নিচে। এখন-ভাগ্যকে হাজার ধন্যবাদ-সে আতঙ্ক থেকে যোজন যোজন দূরে। কেন কে জানে, মনে একটু ভরসা ভরসা পাওয়া যাচ্ছে হঠাৎ । এই পরিবেশের ঠিক কোথায় যেন হাস্যরসাত্মক কিছু একটা লুকিয়ে আছে।

আর তারপরই বলা নেই, কওয়া নেই, সে হাসা শুরু করল-হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে নয়, বরং স্বস্তিতে।

পুরনোদিনের স্টার ওয়র্স ছায়াছবিগুলো দেখেছ নাকি কখনন? গ্রিনবার্গের দিকে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে।

অবশ্যই-অন্তত আধ ডজনবার।

“যাক, এবার বোঝা গেল কোন দুঃখে এমন অস্বস্তিতে ছিলাম। একটা দৃশ্যে লিউকের স্পেসশিপ গ্রহাণুর গায়ে আছড়ে পড়ে। তারপর এক দানবীয় সাপ জাতীয় প্রাণীর দিকে এগিয়ে যায়। প্রাণীটা সেই গ্রহাণুর গর্তে বাস করত।

লিউকের শিপ নয়-হ্যান্স সোলোর মিলেনিয়াম ফ্যালকন। আমি সারাক্ষণ ভেবে মরতাম বেচারা প্রাণী কী করে এমন জীবন্ত জিনিসকে হজম করল। ওটা নিশ্চই সাংঘাতিক ক্ষুধায় ছিল, স্পেস থেকে কোনো খাবার আসবে সে আশায় মুখ ব্যাদান করে থাকা ছাড়া আর কোনো যুক্তিতো মনে পড়ে না। আর প্রিন্সেস লিয়া নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার কথা না, কী বল?

এখানে, হ্যালির ধূমকেতুতে, ছিয়াত্তর বছরে যেখানে এক বছর হয়, এবং মাত্র একবার সামান্য সময়ের জন্য অকল্পনীয় তাপে ফুটতে থাকে পুরো হ্যালি, অন্য সময়টুকু অবিরত হিম-সেখানে কোনো প্রকার জীবন-ঝর্নার অস্তিত্ব অসম্ভব নয় কি?

সে প্রাণ থাকার কথা ভাবতে ভালবাসে; কিন্তু শুধু ভালবাসা দিয়েই সব হয় না। তার ফিরে গিয়ে কিছু এক্সপ্লোসিভ নিয়ে আসতে হবে, আর অন্য করিডোরটা এদিকে…

এই রুট ধরে আর বেশিক্ষণ যেতে পারব না। গ্রিনবার্গকে বলল সে, বরং অন্যটায় একটু ঢু মেরে যাই। জংশনে ফিরে আসছি আবার, অন্য ফিতা উল্টো পেঁচিয়ে নিয়ে।

সে আর রহস্যময় আলোটার কথা তুলল না। আলো জ্বালতেই হারিয়ে গেল সেটা।

গ্রিনবার্গ সাথে সাথেই জবাব দেয়নি। ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক। সম্ভবত শিপের সাথে কথা বলছে; চ্যান্ট এ নিয়ে ভাবে না। নিয়মানুযায়ী, জবাব না দেয়া পর্যন্ত সে কথাটা বলেই যাবে।

বিরক্ত হবার সুযোগ নেই, গ্রিনবার্গ একটু মাফ চেয়ে নিল সাথে সাথে ।

ফাইন-ক্লিফ-আমি অবশ্য তোমাকে মিনিটখানেকের জন্য হারিয়ে বসেছিলাম। চেম্বারে ফিরে এসেছি, যাচ্ছি অন্য টানেলটায়। আশা করি সেখানে কোনোকিছু পধরোধ করে দাঁড়াবে না।

এবার গ্রিনবার্গ সাথে সাথেই জবাব দিল ।

“স্যরি, বিল। শিপে ফিরে এসো। একটু ইমার্জেন্সি পরিস্থিতি দেখা দিল-না, ইউনিভার্সে নয়। কিন্তু আমাদের এক্ষুনি পৃথিবীতে ফিরতে হতে পারে।

.

ড. চ্যান্ট সেই ভাঙা কলাম আবিষ্কারের কয়েক সপ্তাহ পরের কথা…

সূর্যের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে প্রতিবারই যেহেতু এই বিখ্যাত ধূমকেতু বেশ অনেকটা ভর উগড়ে দেয় স্পেসের বুকে-সেহেতু এর ভর-বিন্যাস বদলে যায় প্রতিনিয়ত। এবং এমন হতে হতে কয়েক সহস্র বছর অন্তর অন্তর ঘূর্ণনের আগাপাশতলা আমূল পরিবর্তিত হয়। বদলে যায় মধ্যবিন্দু, বেশ নিষ্ঠুরভাবেই কেঁপে ওঠে পুরো হ্যালি। শক্তিক্ষয়ের অপরিবর্তনীয় এ খেলায় যে ভূকম্পনটা হয় তার মাত্রা রিখটার স্কেলে পাঁচের কম হবে না কোনোমতেই। এজন্য স্ট্যালাকলাইটগুলো পড়ে ছিল।

কিন্তু সে আর কখনোই সেই রহস্যঘেরা আলোর কোমল বিচ্ছুরণ-রহস্য ভেদ করতে পারেনি। আর এখনকার নূতন নাটকের যবনিকাপাত হবার পর পরই এ ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার সুযোগ নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু এ নষ্ট সুযোগের কষ্ট সারা জীবন তাকে জ্বালিয়ে যাবে।

ব্যাপারটা যে সে দেখেছে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই মনে। কেন যেন কলিগদের আর বলা হয়নি। ভিডিও ক্যামেরায় যা ওঠেনি, অন্ধকারে সামান্য সময় তা দেখার দাবী খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তাও যথেষ্ট সন্দেহজনক।

কিন্তু তার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই পরবর্তী অভিযানের জন্য একটা সিল করা নোট ছেড়ে যাচ্ছে।

সে নোটটা ছেড়ে যাচ্ছে ২১৩৩ সালে ভোলা হবে, এই আশায়।

২০. অবির পড়েছে ডাক

ভিক্টরকে দেখেছ নাকি? আনন্দে মাইকেলোভিচের দাঁত বেরিয়ে পড়ছে। এদিকে ফ্লয়েড কাপ্তানের ডাকে সাড়া দিচ্ছিল। কথা শেষ করল প্রশ্নকর্তা, ওর মনটা ভেঙে গেল যে!

বাড়ি ফিরতে ফিরতে ধাক্কা কাটিয়ে উঠবে। কাটছাট জবাব দিল ফ্লয়েড, খোঁচাখুঁচি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই, অন্য ব্যাপারে সে ব্যস্ত, কী হল সেটা খতিয়ে দেখছি…

ক্যাপ্টেন স্মিথ এখনো স্থাণুর মতো গোঁজ হয়ে বসে আছে নিজের কেবিনে। সত্যি যদি স্মিথ মনে করত শিপের কোনো ঝুঁকি আছে-সাথে সাথেই নিজের এনার্জি-ঝড়টাকে ডানে-বামে আদেশ-নিষেধের স্রোতে ছড়িয়ে দিত। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে তার কিছু করার নেই, বসে বসে পৃথিবী থেকে আসতে থাকা পরবর্তী মেসেজের আশায় মাছি মারতে হবে ।

ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস তো আজকের বন্ধু নয়-অনেক পুরনো, সে কেমন করে এমন তালগোল পাকালো কে জানে! গোনায় ধরার মতো কোনো দুর্ঘটনা নেই, না আছে পরিচালনায় কোনো ভুল বা যান্ত্রিক ত্রুটি। তাহলে কেন এই গ্যাড়াকলে ফেলারে বাবা! ইউনিভার্সেরও অন্য কোনো পথ ছিল না। অপারেশন্স সেন্টার ঠিকঠাক কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল পালাক্রমে। মহাকাশের সেই চিরাচরিত ইমার্জেন্সির মতো লাগছে দেখেশুনে-খবর পাঠানো আর নেয়া ছাড়া কিছু করার নেই। কিন্তু ফ্লয়েডের কাছে রিপোের্ট দেয়ার সময় সে অসন্তুষ্টির বিন্দুমাত্র আভাস দেয়নি।

দুর্ঘটনা ঘটে গেল যে, এক্ষুনি পৃথিবীতে ফেরার হুকুম এসেছে। একটা রেসকিউ মিশনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

কোন ধরনের একসিডেন্ট?

আমাদের সিস্টার শিপ গ্যালাক্সি গাঁজায় পড়েছে। বৃহস্পতীয় উপগ্রহগুলো চষছিল একটা সার্ভের সময়। তারপর হঠাৎ ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করতে হয়।

ফ্লয়েডের চোখেমুখে অবিশ্বাস ফুটে উঠতে দেখল ক্যাপ্টেন স্মিথ।

ঠিক তাই, আমিও জানি এমন কিছু হওয়া অসম্ভব। কিন্তু আপনি পুরোটা শোনেননি। জাহাজটা ইউরোপার মাটি কামড়ে পড়ে আছে।

ইউরোপা!

এমনটাই মনে হচ্ছে। ক্ষতি হল শিপটার, আর উঠে দাঁড়াতে পারবে কিনা কে জানে!-কিন্তু কোনো প্রাণহানি হয়নি। এরচে বেশি জানতে হলে এখন অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই।

কখন?

বারো ঘণ্টা আগে। গ্যানিমিডে খবর পাঠাতে বেশ দেরি করে ফেলেছিল।

কিন্তু আমরা কী করতে পারি? আমরাতো সৌর জগতের অন্যপ্রান্তে। এখন চাঁদে দৌড়ে গিয়ে রিফুয়েলিং করে বৃহস্পতি জগতের দিকে যেতে যেতে অন্তত মাস দুয়েক লেগে যাবে! (এবং মনে মনে বাকীটা যোগ করল ফ্লয়েড, লিওনভের যুগে ব্যাপারটা বছর দুয়েক ঠেকার কথা…)

আমিও জানি। কিন্তু কাজে লাগার মতো আর কোনো শিপ নেই।

তাহলে গ্যানিমিডের নিজস্ব আন্তঃউপগ্রহ ফেরিগুলোর খবর কী?

ওগুলো শুধু অর্বিটাল অপারেশনের জন্য তৈরি। কক্ষপথের চেয়ে নিচে নামতে পারবে না।

ক্যালিস্টোতে নেমেছে না সেগুলো?

বেশ নিম্নস্তরের এনার্জি মিশন ছিল সেসব। ও, ইউরোপায় কোনোমতে নামতে পারবে, কিন্তু প্রায় খালি অবস্থায়। এদিকেও নজর দেয়া হয়েছে, অবশ্যই!

ফ্লয়েড এখনো অবিশ্বাসের চোখে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে আছে, খবরটা হজম করা বেশ কষ্টকর। আধ শতাব্দীর মধ্যে এই প্রথম এমনটা হল, আর মানব ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো। একটা শিপ নিষিদ্ধ চাঁদের বুকে পা রেখেছে। এই একটা চিন্তাই হাজার ভাবনার জন্ম দেয়ার জন্য যথেষ্ট…

ক্যাপ্টেন স্মিথ, আপনার কি মনে হয় ওই… যেই হোক-ই হোক না

কেন-ওরাই এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী?

এ নিয়েই ভাবছিলাম। কিন্তু অনেক বছর ধরেইতো এলাকাটার আশপাশে ঘুরছি আমরা। এতোদিন কিছু হয়নি।

আরো একটা কথা থেকে যায়, উদ্ধার করতে গেলে আমাদের ক্ষেত্রে কিছু হবার সম্ভাবনা থাকে কি-না।

সবার আগে আমার মাথায় এ চিন্তাটাই গোত্তা দিয়েছে। কিন্তু সবটা না জেনে রাজা-উজির মেরে কোনো লাভ নেই। ও, যেজন্য আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, এইমাত্র গ্যালাক্সির তালিকা হাতে এল। ভাবছিলাম…

ক্যাপ্টেন একটু দ্বিধার সাথে একটা কাগজ ঠেলে দিল টেবিলের ওপাশে। জানে, ফ্লয়েড কী বলবে এবার।

মাই গ্র্যান্ডসন…

এবং মনে মনে বাকীটা যোগ করল সে, একমাত্র মানুষ, যে আমার নাম সাথে নিয়ে কবরে যাবে।

৩. ইউরোপান রোলেট

তৃতীয় পর্ব – ইউরোপান রোলেট

২১. মুক্তির রাজনীতি

এতো বিশ্রী ব্যাপারের পরও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপ্লব বিনা রক্তপাতে সফল হয়েছিল-এসব ব্যাপারে যা হয় আর কী! হাজারো ক্ষতির জন্য যে টেলিভিশনকে শাপ-শাপান্ত করা হয় তাই এর পেছনে তুরুপের তাস হিসেবে কাজে লেগে যায়। ফিলিপাইনেও ক্ষমতার দাপটে যখন বিশেষ সাধারণ জনগোষ্ঠির গোড়া উপড়ে যাবার দশা তখন এই টেলিভিশনের কল্যাণেই ভাল ব্যাবহার করতে বাধ্য হয় ক্ষমতালিন্দুরা। তারপরও সারা দুনিয়া বেশকিছু ধ্বংসযজ্ঞের ন্যাক্কারজনক দৃশ্য দেখতে পেয়েছে।

বেশিরভাগ আফ্রিকানারই অপ্রতিরোধ্য ভবিতব্য আঁচ করতে পেরে ক্ষমতার পালা বদলের অনেক আগে দেশ থেকে পাততাড়ি গোটায়। দেশটার নতুন প্রশাসন যে তেতো অভিযোগ তুলেছে, সেসব কথা অনুযায়ী তারা মোটেও খালিহাতে বাক্স পেঁটরা গোছায়নি। বিলিয়ন বিলিয়ন র‍্যান্ড চলে গেছে সুইস আর ডাচ ব্যাঙ্কগুলোর অতল গর্তে। নাটকের শেষ দিকে যে কত রহস্যময় ফ্লাইট দেখা গেল কেপ টাউন বা জোহান্সবার্গ থেকে জুরিখ-আমস্টার্ডামের দিকে উড়ে যেতে তার ইয়ত্তা নেই। পরে স্বাধীনতা দিবসে এমন কথাও প্রকাশ্যে বলাবলি করতে লোকে যে এক আউন্স খাঁটি সোনা বা এক ক্যারেট দ্যুতিময় হীরাও পড়ে নেই সদ্যলুপ্ত দক্ষিণ আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে। কথা একেবারে মিথ্যা নয়। সবচে দুঃখজনক ব্যাপার-খনিকৰ্মীদের উপর তলে তলে গণহত্যা চলেছে শেষদৃশ্যে। হেগে নিজের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে বসে কোনো এক রিফিউজি তার বনিয়াদী কণ্ঠে দম্ভোক্তি ছড়িয়েছিল, কিম্বার্লিকে কর্মক্ষম করতে কাফ্রিদের বছর পাঁচেক তো লাগবেই… যদি ওরা কোনোদিন পেরে ওঠে।

অবাক হলেও সত্যি কথা, ডি বিয়ার্স আবার সচল হল এক সময়, নতুন নামে-নতুন মুঠোয় আবদ্ধ হয়ে। না, পাঁচটা বছরও লাগেনি। এই ছোট্ট সময়ের মধ্যেই নতুন জন্ম নেয়া দেশটার আর্থিক চালিকাশক্তিতে পরিণত হল হীরার ভুবনমোহিনী আলো।

এক প্রজন্মের ব্যবধানেই নবীন রিফিউজিরা একত্র হল তাদের গোঁড়া পূর্বপুরুষদের ছত্রছায়ায়-একবিংশ শতাব্দীর একীভূত পরিবেশে। সগর্বে তারা উঠে দাঁড়ায়, সদম্ভে নয়। উঠে দাঁড়ায় পূর্বপুরুষের কর্মোদ্যম আর স্পৃহা নিয়ে, বাদ দেয় বিগতদের গোড়ায় থাকা গলদটুকু। আসলেই, তারা আফ্রিকান ভাষায় কথা বলত না, নিজেদের ঘরেও নয় ।

শতাব্দী পুরনো রুশ বিপ্লবের কথা মনে করে অনেকে ঘড়ির কাঁটা উল্টে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল। অন্তত যারা দখলদারদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার সুদী কারবার করেছিল তাদের দাঁত উপড়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছে বেশ কবার। যথারীতি তাদের এই জিঘাংসা আর নিষ্ফল আক্রোশ প্রবাহিত হয় অপপ্রচারের দিকে। প্রোপাগান্ডা, মহড়া, বয়কটের মাধ্যমে তারা ব্যতিব্যস্ত করতে চায় ওয়ার্ল্ড কাউন্সিলকে। এমনকি মাঝেমধ্যে ব্যবহার করে শিল্পকেও। উইলহেম স্যামুটের দ্য ভোট্রেকার্স কে ইংরেজি সাহিত্যের একটা মাস্টারপিস হিসেবে প্রদর্শন করা হয়, এমনকি যারা লেখকের সাথে একমত নয় তারাও একাজ করে।

তারপরও অনেকে মনে করত রাজনৈতিক চাপ বাদবাকীদের ফায়দা লোটা যাবে না, পুরনো কারাগার গড়ে তোলা আর সম্ভব নয়। অনেকে বেশ জানতো, ইতিহাসের পাতাগুলো নূতন করে লেখা যায় না। কিন্তু প্রতিশোধ না নিয়ে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় আরো অনেকেই।

এই দু শ্রেণীর আশপাশে গজিয়ে উঠল রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক খেলার পাল্টাপাল্টি চাল।

ডার বান্ড সবচে বড় না হলেও সবার চেয়ে শক্তিমান এবং অবশ্যই সবচে বেশি ধনী। হারানো প্রজাতান্ত্রিক দেশটার সম্পদ লোপাট করার কাজে বান্ডদের একটা নেটওয়ার্ক এবং কয়েকটা হোল্ডিং কোম্পানিই যথেষ্ট ছিল। আর আজ, সময়ের অদ্ভুত নদী বেয়ে চলতে চলতে তাদের বেশিরভাগই পুরোপুরি আইনসম্মত, শুধু আইনসম্মত হলেও হত-বরং শ্রদ্ধার পাত্র।

সুং এ্যারোস্পেসে অন্তত আধ বিলিয়ন বান্ড-মানি খাটছে, বার্ষিক খতিয়ানে কী সুন্দরভাবে পরিমাণটা দেখা যায়! দু হাজার উনষাটে স্যার লরেন্স আরো পঞ্চাশ কোটি গ্রহণ করতে মোটেও কার্পণ্য করেনি-হাজার হলেও তার ছোট্ট নৌবহরে আরো একটু জাঁকজমক বাড়বে।

কিন্তু তার সেই বিখ্যাত ব্যবসাবুদ্ধিও বান্ড এবং সুং এ্যারোস্পেসের শেষ চার্টার্ড মিশনটার সাথে সম্পর্কের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। এম্নিতেই তখন হ্যালি এগিয়ে আসছিল মঙ্গলের দিকে, তার নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে ইউনিভার্সকে শেষ সাজে গড়ে নেয়ার কাজে। অন্য সিসটার শিপটার রুটিন অপারেশনে চোখ না পড়ারই কথা।

লন্ডনের লয়েডস অবশ্যই যথারীতি গ্যালাক্সির প্রস্তাবিত রুটিন খতিয়ে দেখেছে, কিন্তু তেমন কোনো ফারাক পড়েনি। সৃষ্টি জগতের চারধারে বাড়দের লোক বসে আছে; অবশ্যই ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোয়।

ব্যাপারটা ইনস্যুরেন্স দালালদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও মহাকাশ আইনবিদদের জন্য পোয়াবারো হয়ে দাঁড়ায়।

২২. ঝুঁকিপূর্ণ মালামাল

প্রতিনিয়ত লাখ লাখ কিলোমিটার বদলে যাওয়া দূরত্বের দুটো লক্ষ্যে শিপিং লাইন চালানো চাট্টিখানি কথা নয়। তার উপর আবার গতীয় দিক দিয়ে প্রতি মুহূর্তেই শত কিলোমিটার হিসাব উড়ে এসে জুড়ে বসে। নিয়মিত কর্মতালিকা থাকার প্রশ্নই নেই। তাই সৌর জগতের আগাগোড়া বদলে মানবজাতির জন্য নতুন খোলনলচে নিতে নিতে যে কেউ বন্দর বা কক্ষপথগুলোয় থেকে থেকে হয়রান হয়ে যেতেই পারে-এতে অবাক হবার কিছু নেই।

সৌভাগ্যক্রমে এই পালাবদলগুলো বেশ কবছর আগে থেকেই হিসাব করে বের করা যায়। তাই নিয়মিত যানগুলোও সুযোগমতো মেরামতি করিয়ে নেয়, ক্রুদের নামিয়ে দেয় একটু আরাম আয়েশে ছুটি কাটানোর কাজে। এবং ভাগ্যক্রমে মাঝেমধ্যে অতি ধরাধরি করে কেউ কেউ ব্যক্তিগত কাজে ভাড়া করে বসতে পারে এসব যাত্রার রথ এবং রথীদের। আগের দিনে ব্যক্তিগত সমুদ্রভ্রমণে জাহাজ ভাড়া করার মতো বিলাস আর কী!

ক্যাপ্টেন এরিক ল্যাপ্লাস যখন জানল যে গ্যানিমিডের বাইরে কাটানোর সেই তিনটা মাস একেবারে জলে যাচ্ছে না তখন খুশি না হয়ে উপায় থাকে না। প্ল্যানেটারি সায়েন্টিফিক ফাউন্ডেশন একটা উদ্যোগ নিয়েছে। বৃহস্পতীয় উপগ্ৰহজগৎ ছুঁড়ে ফেরার নতুন মওকা দেবে তারা দিচ্ছে আর্থিক সুবিধা। (এখনো কেউ এটাকে লুসিফারীয় জগৎ বলে না, বৃহস্পতীয় জগই বলে।) তারা বিশেষ দৃষ্টি দেবে অবহেলিত ডজনখানেক ছোট উপগ্রহের দিকে। চাঁদগুলোর কোনো কোনোটা ঠিকমতো সার্ভে করা হয়নি; বাকীগুলো দায়সারাভাবে ঘোরা হয়েছে অতীতে।

মিশনের খবর পাবার সাথে সাথেই রালফ ভ্যান ডার বার্গ সুং শিপিং এজেন্টকে ডেকে এনে অভিযানের আগাপাশতলা জেনে নেয়ার জন্য জেরা শুরু করে দিল।

হ্যাঁ-প্রথমে যাব আইওর দিকে। তারপর ইউরোপার আশপাশদিয়ে একটু উড়ে যাওয়া…

শুধু উড়ে যাওয়া? কত কাছ দিয়ে?

এক মিনিট, ব্যাপারটা বেখাপ্পা। ফ্লাইট প্ল্যানে বিস্তারিত কিছু লেখা নেই। কিন্তু অবশ্যই যানটা নিষিদ্ধ অঞ্চলে যাবে না।

শেষ আইনে নিষিদ্ধ দূরত্ব ছিল দশ হাজার কিলোমিটার। পনের বছর আগের কথা। যাই হোক, আমি মিশন প্ল্যানেটোলজিস্টের পদে স্বেচ্ছাসেবী হতে চাই। আমার বায়োডাটা পাঠিয়ে দেব…

না-না। সেসবের দরকার নেই, ড, ভ্যান ডার বার্গ। তারা এরই মধ্যে আপনার নাম মনোনয়ন করে আপনাকে অনুরোধের চিন্তাভাবনা করছে।

.

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে–চিরাচরিত রীতি। বুদ্ধি বাড়ার পর মানুষ যখন পেছনে তাকায় (পরে তাকানোর অনেক সময় থাকে। তখন অনেক ভুল চোখে পড়ে। পরে, ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস চার্টারে অনেকগুলো অসঙ্গতি দেখতে পেল। দুজন ক্রু অসুস্থ ছিল, একেবারে হন্তদন্ত হয়ে তাদের বদলে অন্যদের বসানো হয়েছিল তখন। তখন বদলি ক্রু পেয়েই সে আহ্লাদে আটখানা-তাদের কাগজপাতি খুঁজে দেখার জন্য তেমন একটা গা করেনি-অথচ করার কথা ছিল। (অবশ্য আঁতিপাতি করে খুঁজেও কোনো গরমিল পাওয়া যেত না…)

এরপরই কার্গো নিয়ে ভ্যাজাল শুরু। ক্যাপ্টেন হিসেবে শিপের প্রতিটা জিনিস খুঁটিয়ে দেখার দায়িত্ব তার এক্তিয়ারেই পড়ে। যে যাই বলুক, খুঁটিনাটি সব আসলে দেখা যায় না-তবু কারণ থাকলে সব দেখতে কোনো আপত্তি নেই তার। কুরা সাধারণত নিখুঁত হয়ে থাকে, অন্তত শারীরিক দিক দিয়ে। তবু লম্বা মিশন বিরক্তিকর হতে পারে, তাই গা-ঝাড়া দেয়ার পানীয় নিয়ে নেয়া হয় সাথে করে। এমিতে পৃথিবীতে পুরো বৈধ হলেও মহাকাশ অভিযানে স্নায়ু উত্তেজক তরল যথাসম্ভব এড়িয়ে চলাই নিয়ম।

সেকেন্ড অফিসার ক্রিস ফ্লয়েড যখন নিজের সন্দেহের কথা তুলল তখন ক্যাপ্টেন তেমন গা করেনি। বলেছে শিপের ক্রোমাটোগ্রাফিক পরীক্ষায় উচ্চ স্তরের ওপিয়াম পাবার আরেক খনি আবিষ্কার করেছে যা চীনা কুরা ব্যবহার করে মাঝেমধ্যেই। কিন্তু এবার ব্যাপারটা সিরিয়াস-খুবই সিরিয়াস। মহাকাশরথে নেশার আফিম!

কার্গো হোল্ড থ্রি, আইটেম ২/৪৫৬, ক্যাপ্টেন। তালিকায় লেখা আছে, সায়েন্টিফিক এ্যাপারেটাস। কিন্তু ভিতরে বিস্ফোরক ঠাসা।

কী!

অবশ্যই, স্যার। এইযে, ইলেক্ট্রোগ্রাম।

আমি আপনার মতামত নিব এ ব্যাপারে, মি. ফ্লয়েড। দেখেছেন নাকি জিনিসগুলো?।

না, স্যার। একটা সিল করা ক্রু কেসের ভিতরে রাখা আছে। আধ মিটার বাই এক মিটার বাই পাঁচ মিটার… প্রায়। সায়েন্টিফিক টিমের আনা সবচে বড় প্যাক গুলোর অন্যতম। লেবেল আঁটা আছে, সুর-সাবধানে নাড়াচাড়া কন্য। ভুলে যাওয়া যাবে না, বাকী সবকিছুই কিন্তু ভঙ্গুর, সাবধানে নাড়াচাড়া করা উচিত।

ক্যাপ্টেন নিজের ডেস্কের বিশেষায়িত প্রাস্টিক কাঠের গায়ে আঙুল দিয়ে তাল ঠুকতে লাগল। সে অভ্যাসটাকে ঘৃণা করে, আর ছাড়ার চেষ্টা করে অনেক-কিন্তু কাজ হয় না।) এই সামান্য কাজই তাকে চেয়ার থেকে ঠেলে তুলল, তারপর বিগড়ে গেল মন-মগজ আরো! এই গাধাটে কাজ কী করে সে করে একজন স্পেস ক্যাপ্টেন হয়ে! পা দুটোকে চেয়ারের সাথে বেঁধে নিয়ে তাকালো তরুণ ফ্লয়েডের দিকে।

এম্নিতে সে ব্যক্তিগতভাবে ফ্লয়েডের রিপোর্টের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করে না। তার নতুন সেকেন্ড অফিসার দারুণ কর্মক্ষম। সে সবচে বড় কথা, কখনোই নিজের ভুবনখ্যাত দাদার কথা তোলে না। ব্যাপারটার এক সরল ব্যাখ্যা থাকতে পারে। হয়তো পরীক্ষণের সময় অন্যান্য কেমিক্যালের সাথে দুর্বল আণবিক বলের সম্পর্ক ধরা পড়েছে, এমন সম্পর্ক অনেকটা টেলিপ্যাথির মতো, হতেই পারে। ফলে সংবেদী পরীক্ষার রেজাল্ট দেখা যাবে একটু ভীতিকর, যদিও বাস্তবে কোনো সমস্যা নেই।

তারা ইচ্ছা করলেই হোন্ডে গিয়ে প্যাকেজ খুলে দেখতে পারে। না, জোর করা ঠিক হবে না। তার উপর বিপদ হওয়া বিচিত্র নয়। সাথে সাথে লিগ্যাল প্রব্লেম হওয়া

খুবই সম্ভব। আইনি জটিলতা বড় খারাপ জিনিস। তারচে খবরটা উপরের সিঁড়িতে পাঠিয়ে দিলেই হল, পরে ঝামেলা নিজের ঘাড়ে পড়বে না। আজ হোক আর কাল, এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিলেও কেউ দুষতে পারবে না তখন।

প্লিজ, ড. অ্যান্ডারসনকে একটু ডেকে পাঠান-অন্য কারো কাছে এ নিয়ে কোনো কথা না বলাটাই ভাল।

ভেরি গুড, স্যার। ক্রিস ফ্লয়েড একটা সশ্রদ্ধ কিন্তু অপ্রয়োজনীয় স্যালুট করল, তারপর একেবারে সুড়ৎ করে ভেসে বেরিয়ে গেল ঘরটা থেকে।

সায়েন্টিফিক টিমের লিডার জিরো গ্র্যাভিটিতে মোটেও অভ্যস্ত নয়; বেচারার নড়াচড়া নিতান্ত আড়ষ্ট। আপনার সহজাত প্রতিভা এক্ষেত্রে তেমন কাজে দিচ্ছে না বরং দৃষ্টিকটুভাবে বেশ কবার ক্যাপ্টেনের ডেস্ক আঁকড়ে ধরতে হয়েছে তাকে।

এক্সপ্লোসিভ! অফ কোর্স নট! ম্যানিফেস্টটা দেখতে দিন তো… ২/৪৫৬…

ড. অ্যান্ডারসন তার পোর্টেবল কিবোর্ডে কথাটা তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে পড়ে গেল, পঞ্চম মাত্রার পেনিট্রোমিটার। অর্থাৎ কিনা প্রবেশ-সম্ভাবনা মাপক। পরিমাণ-তিনটি। অবশ্যই-কোন সমস্যা নেই।

এবং ঠিক কী জিনিস এই পেনিট্রোমিটার বা প্রবেশ সম্ভাবনা মাপক? আড়ষ্ট একটা হাসি ঝুলে আছে ক্যাপ্টেনের মুখে।

“স্ট্যান্ডার্ড প্ল্যানেটারি স্যাম্পলিং ডিভাইস। আপনি শুধু ছেড়ে দিবেন, আর যে কোনো মূল্যে সে চলে যাবে দশ মিটার গভীরে। এমনকি পাথরের উপরিতল হলেও কোনো অসুবিধা নেই। তারপরই একটা পূর্ণ রাসায়নিক বিশ্লেষণ পাঠাবে। শুক্রের বা বুধের দিবা অংশে গবেষণা চালানোর উপযোগী একমাত্র জিনিস। একথা আইওর ক্ষেত্রেও চলবে। সেখানেই আমরা প্রথমটা ফেলতে যাচ্ছি।

ড. অ্যান্ডারসন। শীতল কণ্ঠ ক্যাপ্টেনের, আপনি একজন চমৎকার দক্ষ ভূগোলবিদ হতে পারেন, অবশ্যই আপনি সৌরজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ। কিন্তু, শ্রদ্ধার সাথেই বলছি, আপনি মহাজাগতিক প্রকৌশলের ঘোড়াই জানেন। মরে গেলেও অর্বিট থেকে জিনিসপত্র ছুঁড়তে পারবেন না। সেগুলো বেকুবের মতো ঘুরতেই থাকবে জীবনভর।

সাথে সাথেই বিজ্ঞানীর চেহারায় অপমানের রেখা ফুটে উঠল ।

বেকুবের দলই কাজটা করবে… বলল সে, অবশ্যই। আপনার কথাটা যোগ করা উচিত ছিল।

“একেবারে ঠিক কথা। জিনিসটাকে ছুঁড়ে দেয়া যাবে না, বরং জিনিসটাই ধেয়ে যাবে। এবং তাতে সলিড রকেট ফুয়েল থাকলেই তা সম্ভব। সলিড রকেট ফুয়েলকে সরাসরি বলা হয় ঝুঁকিপূর্ণ মালামাল। এবং এটাই এর ক্লাসিফিকেশন। আমি প্রস্তুতকারকের লিখিত ক্লিয়ারেন্স চাই এবং ব্যক্তিগতভাবে আপনার গ্যারান্টিও প্রয়োজন। আর যাই হোক, সেফটি সিস্টেম একেবারে পারফেক্ট না হলে চলবে না। যদি না হয় তো মালামাল নামানো ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই। এখন, আর কোনো ছোট্ট সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে নাতো? আপনারা কি সিসমিক সার্ভের পরিকল্পনা করেছিলেন? আমার বিশ্বাস, ভূ-কম্পন বিষয়ক যন্ত্রপাতির মধ্যে যেগুলো গবেষণায় লাগে সেগুলোতে বেশ খানিকটা করে বিস্ফোরক ঢোকানো থাকে…

ঘণ্টা কয়েক পরে দেখা গেল ফুরিনের দুটো সিলিন্ডারও পাওয়া গেছে কার্গোতে। এগুলো অতি শক্তিশালী লেজার রশিকে হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিধ্বংসী করে রাখে । মানুষের কাছে সর্বভেদী লেজারও ছোঁয়াচে ভয়, এবং যথারীতি বিশুদ্ধ ফুরিন সেই লিস্টেই পড়ে। কিন্তু পেনিট্রোমিটারকে ঠিক জায়গামতো ফেলার জন্য লেসার গাইডেড রকেট ছাড়া তেমন কোনো সস্তা পথ নেই, তাই এটাও উতরে যেতে পারে।

সব প্রয়োজনীয় সতর্কতা নেয়া হয়েছে-এমন বোঝার পরই ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস সায়েন্টিফিক টিমের কাছে মাফ চেয়ে নিল। বলল, তার সবটা সতর্কতাই শুধু শিপ ও যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নেয়া হয়েছে, আর বেচারা কী করবে, তাদের এমনভাবে ট্রেনিং দেয়া হয় যে সহজাত প্রবৃত্তির জোরেই হাজারটা প্রশ্ন করে বসে, খুঁতখুঁতে ভাব যায় না।

সে একটু আশ্বস্ত বোধ করছে, ড. অ্যান্ডারসনের কথা হয়তো সত্যি। কিন্তু এরই মধ্যে মিশন নিয়ে ঘাপলা বসে গেছে মনে। স্পেস ক্যাপ্টেনদের মনকে ঘষে ঘষে এমন করে তোলা হয় যে তারা বাতাস থেকেই বিপদের গন্ধ শুঁকতে জানে।

কিন্তু ঠিক কতটা বেখাপ্পা যে হবে তা সে এখন কল্পনাও করতে পারছে না।

২৩. নরকের আগুন

বিস্ফোরণের আগে সৌরজগতে শুক্রের পর আইওই দোজখের সবচে কাছাকাছি এলাকা ছিল বৃহস্পতি। কিন্তু বৃহস্পতির নবরূপ লুসিফার এখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথম নির্বাচিত, অবশ্যই সৌরজগতপতি সূর্যকে হিসাবের বাইরে রাখতে হবে।

লুসিফারের জন্মের পর আইওর ক্ষমতা বেড়ে গেছে কয়েকশো ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে। এখন এর সাথে শুত্রু মোটেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। সালফার আগ্নেয়গিরি আর উষ্ণ প্রসবণগুলো তাদের কার্যক্ষমতা কয়েকগুণ করেছে। আজকাল এর চেহারা দশকে দশকে বদলায় না, বরং বছরখানেক সময়ই যথেষ্ট। ম্যাপ বানানোর কোনো চেষ্টাই করে না এখন আর গ্রহবিদের দল। বরং কয়েকদিন পর পরই অর্বিটাল ফটোগ্রাফ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের। এ থেকে তারা নরক-আগুনের পালা বদল টাইপের সিনেমাও বানাতে পারে ইচ্ছা করলে।

এই মিশনের জন্য লন্ডনের লয়েডস বেশ মোটা অঙ্কের প্রিমিয়াম বাগিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু দশ হাজার কিলোমিটার দূর দিয়ে উড়ে যেতে থাকা শিপের জন্য আসলে আইও কোনো হুমকি নয়।

দূর থেকে আসতে থাকা কমলা-হলুদ রঙা গ্রহটাকে দেখে ক্রিস ফ্লয়েড অর্ধশত বছর আগের কথা মনে না করে পারে না। এ পথেই তার দাদু চলেছিল সদর্পে। এখানে, ঠিক এখানেই বিখ্যাত শিপ লিওনভ মিলিত হয়েছিল পরিত্যক্ত ডিসকভারির সাথে। এখানেই ড. চন্দ্রশেখরামপিল্লাই তার পাগলা কম্পিউটারকে জাগিয়ে তোলে দু হাজার দশে। তারপর দু শিপই এল-১ এ ভাসতে থাকা বিশাল কালো মনোলিথের আগাগোড়া দেখে বেড়িয়েছিল।

এখন আর কোনো মনোলিথ নেই। নেই জুপিটার বা বৃহস্পতি বলে কোনো গ্রহ। এই ছোট্ট সূর্যটা ফিনিক্স পাখির মতো বৃহস্পতির ছাই থেকে উত্থিত হয়ে নিজের উপগ্রহজগৎকে পরিণত করেছে এক নতুন সৌরজগতে। শুধু ইউরোপা আর গ্যানিমিডের পরিবেশ এক-আধটু মিলে যায় পৃথিবীর সাথে, তাপমাত্রার দিক দিয়ে। ব্যাপারটা এভাবে কদ্দিন এগুবে তাও কেউ জানে না। জীবন বিকাশে হাজার হাজার থেকে লাখ লাখ বছর লেগে যেতে পারে, যদি কোটি কোটি বছর না লাগে।

গ্যালাক্সির বিজ্ঞানীদল আশা নিয়ে এল-১ এর দিকে তাকায়। যাওয়াটা মুখের কথা নয়। এখানে চিরকালই বৃহস্পতি-আইওর আগুন নদী বয়ে যেত, এখন লুসিফার তৈরি হওয়ার পর তাড়িতিক প্রবাহটার শক্তি বেড়েছে কয়েকশ গুণ। এমনকি মাঝেমধ্যে শক্তি-তটিনী খালি চোখে বেশ ভালভাবেই দেখা যায় । আয়োনিত সোডিয়ামের বৈশিষ্ট্যধারী উজ্জ্বল হলুদ রেখা। গ্যানিমিডের বিজ্ঞানীদের কী আফসোস, এই অসীম গিগাওয়াট যদি নিয়ে নেয়া যেত। কিন্তু কাজটা করার কোনো বাস্তব উপায় দেখা যাচ্ছে না।

প্রথম পেনিট্রোমিটারটা ক্রুদের নানা সন্দেহের মুখে বেরিয়ে যায়, তার দু ঘণ্টা পর হাইপোডার্মিক সুচের মতো বিদ্ধ হয় উপগ্রহের গায়ে ।

প্রায় পাঁচ সেকেন্ড টিকে ছিল পরীক্ষা-বাণটা, ডিজাইন করার সময় যেখানে প্রত্যাশিত সময়ের পরিমাণ মাত্র টেনেটুনে আধসেকেন্ড। এবং দশগুণ বেশি টিকে থাকার কারণে লক্ষ লক্ষ অজানা ডাটা পাঠিয়ে গেল অবিরত। আশপাশের প্রতিটি মৌল-যৌগ-উপাদানের নাড়ী-নক্ষত্র মানুষের জানা হয়ে গেল এক পলকে। তারপর, আইওর সর্বগ্রাসী মুখ নিয়ে নিল বাণটাকে, মিশিয়ে দিল নিজের সাথে।

বিজ্ঞানীরা যার পর নাই খুশি। ভ্যান ডার বার্গ আরো এক কাঠি বাড়া। আইও মোটামুটি সহজ লক্ষ্য-এখানে কাজ হবে, এটাই সবার আশা ছিল। কিন্তু ইউরোপা নিয়ে তার সেই ভয়ংকর আবিষ্কার যদি ঠিক হয়ে থাকে তো পরের যন্ত্রটা নিশ্চই ব্যর্থ হবে।

তবু, প্রমাণ হবে না কিছুই। ডজনখানেক শক্তিশালী কারণে জিনিসটা ব্যর্থ হতে পারে। এবং ব্যাপারটা এমন হলে ল্যান্ডিং ছাড়া কোনো গতি থাকবে না।

কাজটা পুরোপুরি নিষিদ্ধ-শুধু মানুষের আইনে নয়…

২৪. আমি ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন

অ্যাস্ট্রোপোল-তার এই বিশেষ টাইটেল থাকা সত্ত্বেও স্বীকার করে না যে আশাকার অস্তিত্ব থাকতে পারে। ইউ এস এস এ ও একই কথা বলে সব সময়। এবং এই আফ্রিকান দেশটার রাষ্ট্রদূতরা বেশ বিব্রত হন যদি কেউ এ নিয়ে মাতামাতি করতে থাকে।

কিন্তু নিউটনের তৃতীয় সূত্র জগতের আর সবকিছুর সাথে সাথে রাজনীতিতেও সমানভাবে প্রযোজ্য। প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে। জগৎ কাঁপানো সূত্র। বান্ড সব সময়ই তার ভেতরে বেশ কয়েকজন কট্টর দক্ষিণ আফ্রিকা বিরোধী মানুষকে ক্ষমতায় রাখে। সাধারণত তারা আর্থিক যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। তবু মাঝেমধ্যেই বাস্তব বিস্ফোরণ আর হত্যাকাণ্ড যে হয়না তা নয়।

বলা বাহুল্য, আফ্রিকানরা ব্যাপারটাকে হাল্কা করে নেয়নি। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তারাও নিজেদের অফিশিয়াল কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস গঠন করে। তাদের কাজের ক্ষেত্র যথারীতি স্বাধীন; এর জন্য তেমন একটা জবাবদিহিতা করতে হয় না অপারেটরদের। এবং জ্ঞানী লোকের মতো আফ্রিকানরাও তাই শাকার ব্যাপারে কিছু জানে না। তারা হয়তো সি আই এর সেই বিখ্যাত অস্বীকার নীতিকে নিজেদের আদর্শের ভেতরে নিয়েছে। এ-ও হতে পারে, তা কথা সত্যি।

এক উৎসের মতে, শাকা আসলে একটা কোডওয়ার্ড। তারপর হয়তো এ নাম জনপ্রিয় এবং কার্যকর হয়ে যাবার পর কাজ শুরু হয়ে গেছে সাথে সাথে। একটা বিষয় গোয় ধরার মতো, কেউ কোনোদিন ধরা পড়ার পর বলেনি যে সে শাকার এজেন্ট বা অপারেটর।

এ কথার অন্যরকম ভয় ধরানো ব্যাখ্যাও থেকে যায়, হয়তো তারা ধরা পড়তে জানে না। জিজ্ঞাসাবাদের সম্ভাবনা দেখা যাবার সাথে সাথে নিজেদের ধ্বংস করে ফেলার মতো মন-মানসিকতা সিক্রৈট এজেন্টের এম্নিতেও থাকে, তার উপর মানসিকভাবে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তুললেতো কথাই নেই।

সত্যি যাই হোক না কেন, কেউ কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি যে দুশ বছর আগে জীবন দেয়া সামান্য কিন্তু বীর সেই জুলুর নামে সারা দুনিয়ায় এমন শত শত জুলু ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং একইভাবে কাজ উদ্ধারের আশায় জীবন লুটিয়ে দিতে পারে।

সেই উপজাতীয় লোকটাও নিশ্চই ভাবেনি।

২৫. কফিনে মোড়ানো ভুবন

বিস্ফোরণের পর পর এক-দু দশক বৃহস্পতির সেই শ্বাসরুদ্ধকর নিষেধাজ্ঞার কথা মনে করে কখনোই ইউরোপাকে ঘটানো হয়নি। এরপর চীনারা মেঘের উপর দিয়ে দ্রুত উড়ে যায় একবার; শুধু তাদের সেই জিয়াং এর ধ্বংসাবশেষকে একটু চিনতে পারার আশায়।

শিপটাকে তারা পায়নি, কিন্তু তাদের হাতেই প্রথমবারের মতো উপগ্রহটার দিবা ভাগে বরফের আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠা নতুন নতুন মহাদেশের একটা মোটামুটি চিত্র ধরা পড়েছে।

এমনকি একটা নিরেট, দু কিলোমিটার জুড়ে থাকা বস্তুর সন্ধান পেয়েছে সেখানে; ঠিক যেন চীনের দেয়ালের মতো নিরেট। এমন গঠনের কারণেই সেই মনোলিথটার মতো মনে হয় জিনিসটাকে, কিংবা সেই লাখো মনোলিথের জোড়া ভাই-যারা বৃহস্পতি ভেঙে লুসিফার গঠন করেছিল।

যাই হোক, কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। না ছিল বুদ্ধিমত্তার কোনো সংকেত। অবশ্য সুস্থির ভারী মেঘের নিচ থেকে সভ্যতার চিহ্ন দেখতে হলে অন্তত ছ হাজার বছর আগে মানুষ যতটুকু সভ্য ছিল-প্রাণীদের ততটুকু সভ্য হতে হবে। তাহলেই পিরামিড আর রাজমহল দেখে বোঝা সম্ভব। কিন্তু বিপদ দেখা দেয়নি। সুতরাং স্থায়ী সার্ভে স্যাটেলাইট বসানোয় কোনো বাধা ছিল না। বাতাসের ধরন দেখার জন্য দু একটা বেলুন পাঠানোও দোষের নয়। বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখে ইউরোপার মধ্যখানে একটা সুন্দর সাগর জেগে উঠছে, চারপাশে জাগছে ভূমি, আর আছে একটা স্থির সূর্য-যেমনটা দেখা যায় বাচ্চাদের টেক্সট বুকে।

এবং, তখন থেকেই শুরু ইউরোপান রোলেট। প্রশাসনের লোকেরা ব্যাপারটাকে নিষ্ঠুর জুয়া খেলা বলেই মনে করে বিজ্ঞানীরা একটু একটু করে কাছে যাচ্ছে, একটু একটু করে সাহস বাড়াচ্ছে, সেই সাথে বাড়ছে ঝুঁকি।

পঞ্চাশটা ঝুঁকিহীন বছর পেরিয়ে আসার পর ব্যাপারটা বেশ বোরিং হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস আশা করে ব্যাপারটা তেম্নি থাকবে, আর তার উপর ড. অ্যান্ডারসনের নিশ্চয়তা তো আছেই।

পার্সোনালি নিতে গেলে, বলল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস, আমি ব্যাপারটাকে একটু অ-বন্ধুসুলভ বলে ধরে নিব। বিশেষত যদি টনখানেক এক্সপ্লোসিভসহ একটা জিনিস হাজার কিলোমিটার গতিতে আমার বুকে নেমে আসে তো কথাই নেই। ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল যে আপনাকে অনুমতি দিয়েছে দেখেশুনে আমি বেশ অবাক হলাম।

ব্যক্তিগতভাবে ড. অ্যান্ডারসনও কম অবাক হয়নি। কিন্তু ব্যাপারটা এসেছে অন্যভাবে। এক শুক্রবারের অলস বিকালে বিশাল সায়েন্টিফিক লিস্টের নিচের দিকে একটু অবহেলা আর অসম্পূর্ণ করে ব্যাপারটাকে তুলে ধরা হয়। তবু চোখ এড়ানোর কথা নয়, কীভাবে এড়ালো আল্লা মালুম।

“আমিও একই কথা বলি, ক্যাপ্টেন। কিন্তু আমাদের কাজকর্ম অনেক শক্ত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ঘটছে। এবং আসলে ঐ… কী বলে… ইউরোপানদের দিনযাপনে নাক গলানোর কোনো সুযোগ নেই, তারা যা-ই হোক না কেন। আমরা সি লেভেলের পাঁচ কিলোমিটার উপরে একটা টার্গেটে এইম করব।

ও, বুঝলাম। মাউন্ট জিউস নিয়ে মানুষের কৌতূহলের কোনো শেষ নেই।

জিনিসটা আগাগোড়া রহস্যে মোড়া। এমনকি মাত্র কয়েক বছর আগে সেখানে ছিলই না। বুঝতেই পারছেন, কেন ভূগোলবিদরা এমন পাগল হয়ে গেছে এটা নিয়ে।

এবং আপনাদের ঐ দূতটা নেমে যেতে যেতে পর্বতকে বিশ্লেষণ করবে, এইতো?

ঠিক তাই। আপনাকে বলা ঠিক হচ্ছে না, তবু, আমাকে সমস্ত রিপোর্ট গোপন রাখতে হবে। কোড করা অবস্থায় পাঠাতে হবে পৃথিবীর বুকে। আর কেউ একজন বেশ বড় একটা আবিষ্কারের পথে আছে, সে চায় না প্রকাশনার কাছে হেরে যেতে। আপনার বিশ্বাস হয়, বিজ্ঞানীরা এতো চাপা স্বভাবের হতে পারে…

ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস বেশ সহজেই ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারে। যত সময় যাচ্ছে ততই কাপ্তান দেখছে, বেচারা ড. অ্যান্ডারসন মিশন সম্পর্কে খুব একটা জানে না।

আমার শুধু একটাই আশা, ডক্টর-ইউরোপানরা যেন পর্বত বেয়ে উপরে না যায়। আমি তাদের স্থানীয় পর্বতের গায়ে পতাকা এঁটে দেয়ার পথে বিন্দুমাত্র বাঁধা দেখতে চাই না।

.

পেনিট্রোমিটার ছাড়ার পর পরই গ্যালাক্সি জুড়ে কেমন একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। এমনকি অপ্রতিরোধ্য যে কৌতুকগুলোর চর্চা সর্বক্ষণ চলতেই থাকে, সেসবও কেমন থিতিয়ে এল হঠাৎ! আসলে পোব নামার এই লম্বা দুই ঘণ্টা ক্রুর সবাই একটা কাজের ছুতো পেয়ে উত্তেজনা ভোলার পথ পেল। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে কন্ট্রোল রুম আর ব্রিজের দিকে। পনেরমিনিট আগে ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস সবাইকে সরিয়ে দিল শুধু নতুন স্টুয়ার্ডেস রোজি আর তার আনা চমৎকার কফির টিউবের সেখানে থাকা বৈধ।

সব ঘটে গেল একেবারে ঠিকমতো। বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সাথে সাথে, এ্যারোব্রেকিং প্রযুক্তি চালু হয়ে গেল গতি একটু কমিয়ে আনার লক্ষ্যে। টার্গেটের রাডার ইমেজ দেখেশুনে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মাপার কোনো উপায় যেন নেই। বড় হচ্ছে, আরো আরো বড় হচ্ছে। তারপর মাইনাস ওয়ান সেকেন্ডে সব রেকর্ডারের কাজের গতি বেড়ে গেল হাজার গুণ…

কিন্তু রেকর্ড করার মতো কিছুই নেই।

এবার আমি বুঝলাম, বলল ড. অ্যান্ডারসন, বিমর্ষনে, প্রথম রেঞ্জাররা চাঁদের বুকে নিজেদের সবসুদ্ধ ভেঙে পড়ার সময় কী কষ্ট পেয়েছিল।

২৬. রাতের আকাশ

একমাত্র সময়ই সারা সৃষ্টিজগতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাত আর দিন একেবারে স্থানীয় হিসাবের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা যায়। এই এলাকায় জোয়ারের সাথে ঘূর্ণনের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু মানুষ তার ঘরের কোণা ছেড়ে যত দূরেই যাক না কেন, তার সেই চিরাচরিত দিন-রাতের হিসাব কখনো ভুলতে পারবে না।

তাই, সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ ইউনিভার্সাল টাইম রাত একটা পচে যখন ব্রিজে দাঁড়ানো তখন পুরো গ্যালাক্সি ঘুমিয়ে কাদা। তারও জেগে থাকার কোনো মানে হয় না। সে বুঝে ওঠার আগেই গ্যালাক্সির ইলেক্ট্রনিক সেন্সর টের পেয়ে যাবে যে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি। তবু, অপ্রত্যাশিতের সাথে লড়ার ক্ষেত্রে মানুষ সব সময় যন্ত্রের চেয়ে এক কাঠি বাড়া-সাইবারনেটিক্সের এক শতাব্দী এ কথাটা প্রমাণ করে বসেছে। আর এখন বা তখন-অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটবেই।

কফি কোথায়? ভাবল চ্যাঙ বিরক্ত হয়ে, রোজির তো দেরি হবার কথা নয়। গত চব্বিশ ঘণ্টার ব্যর্থতায় ক্রু আর বিজ্ঞানীদের মনে যে দক্ষযজ্ঞ চলছে তার কোনো আসর স্টুয়ার্ডের উপরও পড়েনিতো!

প্রথম পেনিট্রোমিটারের ব্যর্থতার পর করণীয় নিয়ে দ্বিতীয় একটা মিটিং বসেছিল। পরের মিটারটা ক্যালিস্টোর জন্য ঠিক করা ছিল, তাতে কী? কোন্ মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে সেটা এখানে ব্যবহার করলে?

যাই হোক, যোগ করেছিল ড. অ্যান্ডারসন, আমরা কোনোমতে ক্যালিস্টোর উপর ল্যান্ড করতে পারি। সেখানে ভাঙা বরফের টুকরা ছাড়া আর কী পাব?

কোনো দ্বিমত ছিল না। ক্যালিস্টোর জন্য পেন-প্রোবের কোনো দরকার নেই, সেখানে নামা যাবে। এখানে তৃতীয়টা ফেলে দেয়া যায়।

ঘণ্টা কয়েক প্রস্তুতির পর শেষটা নিক্ষেপ করা হল ইউরোপার বুকে; সেটাও পূর্বপুরুষের অদৃশ্য পথ ধরে এগিয়ে গেল নিচের রহস্যঘেরা মেঘের দিকে।

এবার শিপের রেকর্ডার কিছু তথ্য পেল ঠিকই, এক মিলি সেকেন্ডের অর্ধেক সময়ের জন্য! অ্যাক্সিলারেটোমিটার বিশ হাজার জি তেও কাজ করার কথা, সেটা নষ্ট হয়ে যায় এবার। নিশ্চই একটা চোখের পলক পড়ার হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে সব ধসে গেছে।

পরে, সাথে সাথেই পৃথিবীতে খবর পাঠানো হল, জবাব আসার আগে উচ্চ অর্বিট ধরে ঘোরাফেরা করবে তারা। আরো কিছু করার ইচ্ছা তাদের আছে, তবু পৃথিবীর এক-আধটু নির্দেশনা জরুরী।

স্যরি স্যার, দেরি হয়ে গেল। বলল রোজি ম্যাককোলেন। (কেউ হয়তো কল্পনাও করেনি যে তার হাতের কফির চেয়ে সামান্য বেশি কালো তার গায়ের রঙটা।)

আমি স্যার নিশ্চই অ্যালার্মটা ভুল করে সেট করেছিলাম।

আমাদের দুজনেরই ভাগ্য ভাল। একটু বাঁকা হাসি দিল চ্যাঙ, যে তুমি শিপটা চালাচ্ছ না।

আমার মাথায় ঢোকে না কী করে কেউ এটাকে চালায়… সাথে সাথে বেশ ভদ্রভাবে জবাব দিল সে, …জিনিসটা বড়ই জটিল।

দেখে যতটা মনে হয় আসলে কিন্তু ততটা খারাপ নয়, রোজি। তার উপর বেসিক ট্রেনিং কোর্সে সবকিছু জানিয়ে দেয়ার কথা, তাই নয় কি?

আ… হ্যাঁ। কিন্তু আমি বেশিরভাগই বুঝে উঠতে পারিনি কখনো। অর্বিট আর যত্তসব ফালতু কথা…।

চ্যাঙ বুঝতে পারছে সময় নষ্ট করা ছাড়া লাভের লাভ কিছু হবে না। তার উপর রোজ ঠিক তার টাইপের নয়। যেটা চ্যাঙের সারা জীবনের ভালবাসা, সেটারই মাথামুন্ডু কিছু বোঝে না এবং বুঝতেও চায় না মেয়েটা। এ নিয়ে আফসোসের কী আছে? সবারতো আর এক বিষয়ে আগ্রহ থাকবে না… তবু, মেয়েটা বেশ আকর্ষণীয়। না, বেচারিকে আটকে রাখার কোনো মানে নেই। হয়তো ও ঘুমাতে চাচ্ছে।

বিশ মিনিট পরে, সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ নেভিগেশন কনসোলের ব্যাপারগুলো দেখিয়ে কথা শেষ করল: তো, বুঝতেই পারছ, জিনিসটা আসলেই পুরোপুরি অটোম্যাটিক। তোমার শুধু দু-চারটা নম্বর টিপতে হবে, বাকীটা শিপের হাতে ছেড়ে দিলেই হল।

রোজকে বেশ বিরক্ত দেখাচ্ছে; সারাক্ষণ চেয়ে আছে হাতের ঘড়ির দিকে।

স্যরি। হঠাৎ বুঝতে পারল সেকেন্ড অফিসার, হুঁশ ফিরে পেয়েই বলল, তোমাকে আটকে রাখাটা ঠিক হয়নি।

ও, না! ব্যাপারটা দারুণ ইন্টারেস্টিং। বলে যান, প্লিজ।

না-না। অবশ্যই নয়। অন্য এক সময় বাকীটা বলব। গুডনাইট রোজি… আর, থ্যাঙ্কস ফর দ্য কফি।

গুডনাইট, স্যার।

স্টুয়ার্ড থার্ড ক্লাস রোজ ম্যাককোলেন ভেসে চলল (খুব একটা দক্ষতার সাথে নয়) খোলা দরজার দিকে। বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনে চ্যাঙ ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করল না।

কিন্তু একটু পরই একেবারে অপরিচিত কণ্ঠ শুনে চমকে ওঠা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না তার। নারীকণ্ঠ, সন্দেহ নেই, এবং রোজিরই কন্ঠ, কিন্তু কেমন যেন কাঠ কাঠ।

মি. চ্যাঙ, অ্যালার্ম বাটন চাপার কষ্টটা করবেন না। ডিসকানেক্ট করে দেয়া হয়েছে অনেক আগেই। ল্যান্ডিং কো অর্ডিনেট দেখাচ্ছি, শিপ নামিয়ে নিন।

ধীরে, যেন কোনো দুঃস্বপ্নে চেয়ার ঘোরালো চ্যাঙ। মনে হচ্ছে দৃশ্যটা কোনো শ্বাসরুদ্ধকর অ্যাকশন মুভির অংশ-সে এখুনি পপকর্ন চিবুতে চিবুতে চেয়ার ছেড়ে উঠবে, তারপর মুভি দেখা বন্ধ করে গ্যালাক্সির পরবর্তী ফ্লাইটের খবর নেবে।

গোলাকার হ্যাঁচওয়ের পাশে রোজি ম্যাককোলেন নামে পরিচিত মেয়েটা ভাসছে দরজার লকিং লিভারে হাত রেখে নিজেকে স্থির করে রেখে। মেয়েটার সবকিছুই যেন বদলে গেল মুহূর্তের মধ্যে। এক পলকেই তাদের পদাধিকারও যেন পাল্টে গেছে। লজ্জাবনত স্টুয়ার্ড, যেম কখনো সরাসরি চ্যাঙের চোখের দিকে চোখ তুলে তাকায় না পর্যন্ত সেই কিনা এমন ঠাণ্ডা, নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যে চ্যাঙের নিজেকে সেই ইঁদুরের মতো মনে হল যেটা সাপের শিকারে পরিণত হবে জেনেও নড়তে পারছে না, কারণ সাপ তার দৃষ্টি এবং মাথার দোলা দিয়ে সম্মোহিত করে রেখেছে খেয়ে ফেলার ঠিক আগ মুহূর্তটায়। তার হাতের ছোট্ট কিন্তু কার্যকর অস্ত্রটাকে একেবারে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হল, এটা না থাকলেও তার কথা এবং ব্যক্তিত্ব পরিবেশের কর্তৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিত। চ্যাঙের কোনো সন্দেহ নেই মেয়েটা চাইলে এ অস্ত্র ব্যবহার না করেই তাকে নিশ্চিন্তে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে।

অনন্তর, তার আত্মসম্মান আর কাজের প্রতি শ্রদ্ধা ঠিক করল, যাই হোক-বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র-মেদিনী। আর কিছু হোক না হোক, কিছুটা সময় বের করে নেয়া যায় ।

রোজ, সে বলল, এবং হঠাৎ বেখাপ্পা নাম উচ্চারণে ঠোঁট কেমন যেন অকেজো হয়ে আসে, কী অদ্ভুত ব্যাপার! এইমাত্র তোমাকে যা বলেছি, কথাগুলো মোটেও সত্য নয়। নিজে নিজে আমার পক্ষে আর যাই করা সম্ভব হোক না কেন, শিপ ল্যান্ড করানো অসম্ভব। সঠিক অর্বিট হিসাব করে বের করতেই ঘণ্টার পর ঘন্টা লেগে যাবার কথা। সেই সাথে সাহায্যকারীর দরকার পড়বে, অন্তত একজন কো পাইলট।

অস্ত্রের মুখ একটুও নড়ল না।

“আমি বোকার হদ্দ নই, মিস্টার চ্যাঙ। পুরনোদিনের রকেটের মতো এ শিপ মোটেও এনার্জি-লিমিটেড নয়। ইউরোপা থেকে উঠে আসার জন্য সেকেন্ডে মাত্র তিন কিলোমিটার স্পিড দরকার। মেইন কম্পিউটার নষ্ট অবস্থায় ল্যান্ড করাটা আপনাদের বেসিক ট্রেনিংয়ের অংশ। আপনি এখন ভালোয় ভালোয় সেটা প্র্যাকটিস করতে পারেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে চাই, ব্যস।

এ ধরনের কাজে, মনটাকে যথাসম্ভব মিষ্টি রাখার চেষ্টা করল চ্যাঙ, নয়তো মিষ্টি কথা বেরুবে না, ব্যর্থতার সম্ভাবনা পঁচিশ পার্সেন্ট। সত্যিকার হারটা আসলে শতকরা দশভাগ, আর ব্যাপারটার চর্চা নেই আমার অনেক বছর হল।

সেক্ষেত্রে, বলল রোজি ম্যাককোলেন, আমার আপনাকে আক্ষরিক অর্থে নির্জীব করে ক্যাপ্টেনের সহায়তা আশা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ব্যাপারটা বিরক্তিকর, কারণ আমরা এই জানালাটা হারাব, আর পরবর্তী সুযোগের জন্য আরো ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে। চার মিনিট বাকী।

সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ জানতো, খেল খতম। কিন্তু শেষ চেষ্টা করতে দোষ নেই।

কো-অর্ডিনেটগুলো দাও…

২৭. রোজি

অ্যাটিচ্যুড কন্ট্রোল জেটের প্রাথমিক ধাক্কার শব্দেই ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস জেগে উঠল। শব্দটা তেমন জোরালো নয়, যেন কোনো কাঠঠোকরা দূর থেকে গাছ ঠুকে চলেছে একটু একটু করে। প্রথমেই মনে হল সে স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু না-শিপ এগিয়ে যাচ্ছে স্পেসের ভিতর দিয়ে, পরিবর্তন করছে দিক।

সম্ভবত কোনো একদিক একটু বেশি গরম হয়ে যাওয়ায় থামাল কন্ট্রোল সিস্টেম আপনাআপনি ছোটখাট কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট করে নিচ্ছে। এমনটা ঘটে খুব কম, এবং ঘটলে ধরে নেয়া হয় অফিসার অন ডিউটি ব্যর্থ হয়েছে, কারণ তাপীয় ইনভেলাপ পরিবর্তনটা তার চোখে পড়ার কথা।

ইন্টারকম বাটনে চাপ দিয়ে জানতে হবে কে এমনটা করছে… মি. চ্যাঙ ব্রিজে আছেন… তার হাত কখনোই কাজটা শেষ করেনি।

ওজনহীনতায় অনেক অনেক দিন কাটানোর পর সাধারণ মাধ্যাকর্ষণের দশভাগের একভাগই বেশ আঘাত হিসেবে আসে। ক্যাপ্টেনের মনে হল ব্যাপারটা বেশ কমিনিট ধরে ঘটছে যদিও এতোক্ষণ লাগার কথা নয়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডই যথেষ্ট। কিন্তু সেফটি হার্নেস থেকে গা ছাড়িয়ে নিতে নিতেও ব্যাপারটা থামছে না কেন? এবার বাটনটা পেয়েই সে চেপে ধরল, কিন্তু কোনো জবাব নেই।

জিনিসপত্র এমিতে বেঁধেছেদে রাখা হলেও ওজনহীনতার দিনগুলোতে ব্যাপারটা একটু ঢিলেঢালাভাবে এবং অন্যপথে করা হয়। জিনিসপত্র বেশ ধীরে ধীরে পড়ছে, কিন্তু চমকে যাবার মতো ব্যাপার হল-আসল ড্রাইভ তার মূল জেটটায় প্রজ্বলন ঘটিয়েছে, পূর্ণ শক্তিতে….

সে কেবিনের ছোট্ট জানালায় লাগানো পর্দাটা জোরেসোরে সরিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়, তাকায় নক্ষত্রমণ্ডলের দিকে, মোটামুটি জানা আছে ঠিক কোনদিকে শিপের মুখ থাকার কথা-যদি ব্যতিক্রমটা মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ ডিগ্রি হয় তবু দুটো সম্ভাব্য ব্যাপার ধরে নেয়া যায়।

গ্যালাক্সির ভেক্টর বদলে যাবে হয় বাড়ানোর জন্য, নয়তো কমানোর জন্য। ইউরোপায় নামার পথে এগুলোই হওয়ার কথা।

দরজায় বেশ অধৈৰ্য্য টোকা পড়ার শব্দ পেয়ে ক্যাপ্টেন বুঝতে পারল এক মিনিটেরও বেশি সময় ধরে কেউ আসার চেষ্টা করছে। চিকন প্যাসেজওয়েতে সেকেন্ড অফিসার ফ্লয়েড আর দুজন ক্রু ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।

দ্য ব্রিজ ইজ লভ, স্যার রিপোর্ট করল ফ্লয়েড, রুদ্ধশ্বাসে, ভেতরে যেতে পারছি না। চ্যাঙও কোনো সাড়া দেয়নি। কী হল, জানিনা কিছুই…

ভয় হচ্ছে, আমি বোধহয় জানি। সোজাসাপ্টা জবাব দিল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস, কোনো না কোনো পাগল এ কাজ করতই, আজ অথবা কাল। আমরা হাইজ্যান্ড হয়েছি। কিন্তু কেন? যদি জানতে পারতাম!

সে দ্রুত ঘড়িতে চোখ বুলিয়েই একটা ছোট্ট হিসাব কষে নিল।

এই থ্রাস্ট লেভেলে আমরা মিনিট পনেরোর মধ্যে অর্বিট ছেড়ে যাব। দশ মিনিট হলে নিরাপদ হতো। শিপের কোনো ক্ষতি না করে মূল ড্রাইভকে অকেজো করার কোনো উপায় আছে নাকি?

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সেকেন্ড অফিসার যুকে বেশ অসন্তুষ্ট লাগছে, কিন্তু সাথে সাথে জবাব দিয়ে সে সাহায্য করল।

পাম্প মোটর লাইন থেকে সার্কিটগুলো তুলে ফেলা যায়, সেক্ষেত্রে প্রোপ্যাল্যান্ট সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবে।

ওদের কাছে যাওয়ার কোনো উপায়?

হু-ডেক থ্রিতে সেগুলো সাজানো।

তাহলে চলুন।

“আরে… তখন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্যাকআপ সিস্টেম দায়িত্ব তুলে নিবে। নিরাপত্তার জন্য সেটা ডেক ফাইভের একটা লক করা বাল্কহেডের পেছনে লুকানো থাকে। একটা কাটার দরকার পড়বে, না… সময় মতো শেষ করা সম্ভব নয়।

এই ভয়ই পাচ্ছিল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস। গ্যালাক্সির ডিজাইনার মেধাবী লোকগুলো শিপটাকে সব রকমের সম্ভাব্য দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচানোর পরিকল্পনা নিয়েই কাজ করেছিল। কিন্তু মানব-শত্রুর হাত থেকে পুরোপুরি বাঁচানো কখনোই সম্ভব নয়।

কোনো বিকল্প?

এখন নেই, যতটুকু বুঝতে পারছি।

তাহলে চলুন, ডেকের দিকে যাই। চ্যাঙ আর তার সাথে যে-ই থাক না কেন, কথা বলার চেষ্টা করতে হবে।

এবং কে হতে পারে? তার নিয়মিত ক্রুদের কারো এমন মতিভ্রম হওয়া অসম্ভব। বাকী থাকে… হু, এখানেই জবাব লুকিয়ে আছে। পাগল বিজ্ঞানীদের অ্যাচিভমেন্টের শেষ চেষ্টা যেমন হয়…

ঠিক, ড. অ্যান্ডারসন নোবেল প্রাইজটা লুফে নেয়ার শেষ চেষ্টা করছে।

ধারণাটা ভেঙে গেল হাঁপাতে থাকা বিজ্ঞানীর কণ্ঠ শুনে, খোদার কসম, ক্যাপ্টেন, কী হল! ফুল থ্রাস্ট চলছে! কোনদিকে যাচ্ছি? উপরে না নিচে?

নিচে। বলল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস, দশ মিনিটের মধ্যে ইউরোপাকে ক্রস করছে এমন একটা অর্বিটে পৌঁছে যাব। একটাই আশা, কন্ট্রোলে যে আছে সে যদি যা করছে তার মানেটা বুঝতে পারে…

তারা এখন ব্রিজে, বন্ধ দুয়ারের অপর পাশে।

ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস তার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, সর্বশক্তিতে। দিস ইজ দ্য ক্যাপ্টেন! লেট আস ইন!

সে এরপরই ব্যাপারটা বুঝল, অবশ্যই অমান্য করা হবে এমন কোনো আদেশ জোরগলায় দেয়াটা বোকামী। কিন্তু এমন অবস্থায় সাধারণত একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় অপরাধী, এবং কোনো না কোনো জবাব দিয়ে বসে। ঠিকই, সে জবাব পেল।

বাইরের স্পিকার হিসহিসিয়ে উঠেছে, তারপরই ভেসে এল একটা কণ্ঠ, বোকার মতো কিছু করে বসবেন না, ক্যাপ্টেন। আমার হাতে একটা গান আছে, আর মি. চ্যাঙ আমার আদেশমতোই কাজ করে যাচ্ছেন।

কে রে? ফিসফিস করে উঠল একজন ক্রু, মহিলার কণ্ঠ মনে হল!

অবশ্যই। বলল কাপ্তান। আর সব সন্দেহ ঝেড়ে ফেলা গেলেও মূল সমস্যার কোনো সমাধা হচ্ছে না।

কী করতে পারি আমরা? তুমি কী আশা কর? এ শিপটা নিয়ে তুমি সম্ভবত বেরিয়ে যেতে পারবে না, জানতো? একটু কর্তৃত্বের সুর ফুটিয়ে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা তার গলায়।

ইউরোপায় নামতে যাচ্ছি আমরা। আর, আবার কখনো টেক অফ করার ইচ্ছা থাকলে আমাকে থামানোর চেষ্টা করবেন না।

তার রুম পুরোপুরি পরিষ্কার। ত্রিশ মিনিট পর সেকেন্ড অফিসার ক্রিস ফ্লয়েড রিপোের্ট করল। এতোক্ষণে থ্রাস্ট থেমে গেছে, কিন্তু বাকীটা ভবিতব্য। বাঁকা কক্ষপথ ধরে শিপ সোজা ইউরোপায় ঢুকবে। এখন ইঞ্জিন নষ্ট করা সম্ভব-কিন্তু কাজটা আত্মহত্যার শামিল। বরং জিনিসপাতি ঠিকঠাক থাকলে পরে কখনো ওড়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।

রোজি ম্যাককোলেন! কে বিশ্বাস করবে এ কথা! আপনার কী মনে হয়, ও নেশা-টেশা করেনিতো?

জবাব দিল ফ্লয়েড, না। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় একাজ করা অসম্ভব। খুব সূক্ষ্মভাবে প্ল্যান করা হয়েছে। শিপের কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো লুকানো রেডিও পাওয়া যাবে। সেটা খুঁজে পেলেই বরং ভাল হবে আমাদের জন্য। কু পেতেও পারি…

আপনার কথাবার্তা ঠোলাদের মতো লাগছে। জানেন তো, পুলিশের অজনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে এ শব্দ ব্যবহার করা হয়?

যথেষ্ট হয়েছে, ভদ্রমহোদয়গণ! বলল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস। ধৈৰ্য্য টলে যাচ্ছে সবার। তার উপর কেউ কন্ট্রোলের সাথে কথা বলতে পারছে না। সে আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকালো।

আর দু ঘণ্টাও বাকী নেই। বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়ব। কেবিনে গেলাম। আমাকে ডেকে নেয়ার একটা সম্ভাবনা আছে এখনো। মি. য়ু, ব্রিজের দিকে দাঁড়ান, প্লিজ। কোনো উন্নতি দেখলে ডাকবেন।

জীবনে কখনো এতো অসহায় অবস্থায় পড়েনি সে। কিন্তু মানুষের জীবনে মাঝেমধ্যে এমন সময় আসে যখন কিছু না করাটাই একমাত্র করণীয় হয়ে দাঁড়ায়।

অফিসারদের কামরা ছেড়ে আসার সময় শুনতে পেল পিছনে কে যেন বলছে, আমার এক টিউব কফি হলেই চলবে। রোজির মতো এত সুন্দর কফি আর কাউকে বানাতে দেখিনি আমি।

হু, সে দারুণ সিরিয়াস। যে কাজই নিক না কেন, সুচারুভাবে করবে…

২৮. কথোপকথন

গ্যালাক্সিতে একজনই আছে যে পুরো ব্যাপারটাকে দুর্ঘটনা ছাড়া অন্য কোনো হিসেবে নিতে জানে। আমি হয়তো মরতে বসেছি, কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে অমর হয়ে থাকার স্বর্ণদুয়ার খুলে গেল… নিজেকে বলছে ভ্যান ডার বার্গ। যদিও ব্যাপারটা বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব একটা কাজের কাজ হবে না, তবু এ ছাড়া আর কী-ই বা করার থাকতে পারে!

ইউরোপায় আর কোনো গ্রহের সাথে তুলনা করার মতো কিছু নেই। ব্যাপারটা উল্টো হয়ে আসে তার কাছে, ইউরোপার সাথে তুলনা করার মতো আর কোনো গ্রহ-উপগ্রহ নেই…

এটাই তার তত্ত্ব-এবং এখনো ব্যাপারটাকে তত্ত্ব হিসেবে দেখতেই বেশি পছন্দ করে সে। কিন্তু খবরটা আর গোপন কোনো ব্যাপার নয়। বাইরে বেরুল কীভাবে কথাটা?

সে আঙ্কল পলকে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করেছিল, তিনিই কি বিশ্বাসঘাতকতা করলেন? এমনো হতে পারে, কেউ রুটিনমাফিক তার কম্পিউটারের ডাটা পরীক্ষা করেছে। এমন কিছু হয়ে থাকলে বেচারা বুড়ো বিজ্ঞানীরও বিপদে থাকার কথা। যদি কোনোমতে তাকে সতর্ক করা যেত! কোনো একটা ইমার্জেন্সি ট্রান্সমিটার দিয়ে কমিউনিকেশন অফিসার গ্যানিমিডের সাথে যোগাযোগ করছে, সে জানে। পৃথিবীতেও যে কোনো মুহূর্তে খবরটা পৌঁছে যাবে, এক ঘণ্টারও আগে রওনা হয়ে গেছে সতর্কবাণী…

কাম ইন। নক করার শব্দ পেয়ে সে বলল, ও-হ্যালো! ক্রিস। কী করতে পারি আপনার জন্য?

সেকেন্ড অফিসার ক্রিস ফ্লয়েডকে দেখে সে বেশ অবাক হল। যদি কোনোমতে নামা যায় ইউরোপায়, সে ভাবল মন খারাপ করে, তাহলে প্রত্যাশার চেয়ে ভালোভাবে দেখতে পাবে আশপাশটা।

হ্যালো, ডক্টর। আমাদের মধ্যে আপনিই এ এলাকার বাসিন্দা। যদি কোনো সাহায্য করতে পারেন।

এমন পরিস্থিতিতে কী করে কেউ কাউকে সহায়তা করে কে জানে! ব্রিজের শেষ খবর কী?

নতুন কোনো খবর নেই। য়ু আর জিলিংসকে ছেড়ে এলাম সেখানে। দরজায় একটা স্পিকার লাগানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কেউ কথা বলছে না ভিতরে। স্বাভাবিক। চ্যাঙ নিশ্চই মহাব্যস্ত।

সে কি নিরাপদে নামাতে পারবে?

সেই সেরা। কেউ যদি কাজটা পারে তো সে-ই পারবে। নামা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। আবার উঠে আসাটাই আমার চিন্তার কারণ।

গড-এদ্দূর ভাবার দরকার নেই; এখন টিকে যাব, এই যথেষ্ট।

“টিকে যাব তার নিশ্চয়তা কোথায়? ভুলে যাবেন না, শিপটা অর্বিটাল অপারেশনের জন্য তৈরি হয়েছিল। কোনো বড় চাঁদের বুকে নামানোর কথা কখনো ভাবিনি আমরা। অ্যানাঙ্ক আর ক্যারমের সাথে যোগসূত্র বসানোর কথা মাথায় রাখা হয়েছিল তৈরির সময়, এই যা। তাই আকাশ থেকে ইউরোপার বুকে উতরে যাবার ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকে, তাও যদি চ্যাঙ ভাল জায়গার আশায় যথেষ্ট ফুয়েল নষ্ট করে, তাহলে।

কোথায় নামার চেষ্টা করবে জানেন নাকি? প্রশ্ন করল র‍্যালফ, অতি উৎসাহী সুর যাতে দেখা না দেয় সে ব্যাপারে সতর্ক সে। নিশ্চই লুকাতে পারেনি-কারণ ক্রিস তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে তার দিকে।

এখন বলার কোনো উপায় নেই। আপনিতো জানেন, অ্যারোব্রেকিং শুরুর আগে কিছু বলা যাবে না। আর এই চাঁদটাকে আমাদের চেয়ে অনেক ভাল জানেন আপনি। ঠিক কোথায় নামতে পারে?

একটাই ইন্টারেস্টিং এলাকা আছে। জিউস পর্বত।

সেখানে ল্যান্ড করতে চাওয়ার কারণ কি? শ্রাগ করল র‍্যালফ।

এ এলাকা নিয়েইতো আমাদের আগ্রহ জাগবে। দু দুটো দামী জিনিস খোয়াতে হল সেখানে।

দেখেশুনে মনে হচ্ছে আরো অনেক কিছু খোয়াতে হবে। আপনার কোনো আইডিয়া আছে নাকি?

আপনার বোধহয় পুলিশ বেশ পছন্দ.. সরল মনে বলে গেল ভ্যান ডার বার্গ। মজার ব্যাপার তো! একঘণ্টার মধ্যে দুবার কথাটা শুনতে হল আমাকে।

সাথে সাথেই কেবিনের পরিবেশ আমূল বদলে গেল। যেন লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের অবস্থা হেরফের হয়েছে কোনোভাবে।

“ওহ্-আমি ঠাট্টা করছিলাম, আসলেই?

যদি হয়েই থাকি, আর যাই হোক কখনো বলবো কি?

এটাতো কোনো জবাব হল না… আরে, অন্য অর্থে এটাই একটা জবাব…

সে পূর্ণদৃষ্টিতে তরুণ অফিসারের দিকে তাকালো-এই প্রথম নয়। তার গঠন গড়ন ঠিক পিতামহের মতো। কে যেন বলেছিল, ক্রিস ফ্লয়েড অন্য একটা শিপ থেকে গ্যালাক্সিতে জয়েন করে অন্য একটা মিশনে। অবশ্য সেই শিপটাও সুং নৌবহরের। ব্যাপারটা উৎসাহজনক। আবার স্পেস অফিসার হিসেবে ফ্লয়েডের কোনো সমালোচনা হয়নি কখনো। কিন্তু সেই দক্ষতার জোরেই অন্যান্য কাজে নিযুক্ত হওয়া অসম্ভব নয়। রোজি ম্যাককোলেনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। রোজির মতো সে-ও তো মিশনের আগ মুহূর্তে এখানে এসেছিল।

রালফ ভ্যান ডার বা প্রশ্নোত্তরের ক্ষেত্রে সরলমনা। সে একজন বিজ্ঞানী-আর বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিকে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে, উত্তর লুফে নেয়-মাঝখানে ঝোলাঝোলি তাদের কাছে সবচে অসহ্য বিষয়।

কিন্তু নিজেকে ধোয়া তুলসী পাতা দাবী করে না সে। নিজের বিশ্বাসটাকেই সত্য বলে মনে করে, সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কিন্তু ঘটনার এমন অদ্ভুত ক্রমবিন্যাস অনেকটা নিউট্রনের বাড়তে থাকা চেইন রিয়্যাকশনের মতো হয়ে যাচ্ছে। সামান্য একটা নিউট্রন বেরিয়ে এসে পরমাণুর নগণ্য নিউক্লিয়াসকে আঘাত করে ভেঙে দিবে, বেরুবে আরো দুটো নিউট্রন… কিন্তু তারপর? ছোষ্ট্র থেকে শুরু হয়ে ব্যাপারটা প্রলয়ে পরিণত হয়।

ক্রিস ফ্লয়েড কোন পক্ষের এখন এখানে কটা পক্ষ কাজ করছে? বান্ড নিশ্চই জড়িয়ে পড়েছে এর সাথে; অন্তত গোপনীয় কথাটা বেরিয়ে যাবার পর তারা কি আর

জড়িয়ে পারে? স্বয়ং বান্ডের ভিতরেই বোমার স্প্রিন্টারের মতো হাজারটা খুদে কিন্তু শক্তিমান অংশ লুকিয়ে আছে। তারপর বান্ডের বাইরে আরো কত পক্ষ যে আছে এবং থাকতে পারে আল্লা মালুম। রালফ ভ্যান ডার বার্গ যেন কোনো আয়না মহলে আটকে পড়েছে, চারদিকে খণ্ড খণ্ড আয়না আটকানো।

এমন কোনো উপায় নেই যেটা ভেবে সে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারে। ক্রিস ফ্লয়েডকে তার কানেকশনগুলোর দোহাইয়ের কারণে বিশ্বাস করা যেতে পারে। আমি সমস্ত টাকা বাজি ধরতে রাজি, ভাবল ভ্যান ডার বার্গ, সে এই মিশনের জন্য অ্যাস্ট্রোপোল থেকে নিয়োগ পেয়েছে, যদ্দিনের জন্যই হোক, অথবাধ্যাৎ, ব্যাপারটা এখন অন্যরকম হতে পারে…

আমি আপনাকে হেল্প করতে পারলেই খুশি হব, ক্রিস। ধীর লয়ে বলে গেল বিজ্ঞানী, যা সন্দেহ করছেন, ঠিক। আমার কিছু থিওরি আছে। কিন্তু সেগুলো এখনো এক্কেবারে বোকার হদ্দদের মতো শোনায়, এখনো…

আসল সত্যি জানতে আধ ঘণ্টাও লাগবে না। সে পর্যন্ত কিছু না বলাই ভাল।

তবে, তার কথা যদি সত্যি না হয় তো এমন কারো সাথে সে মরতে রাজি নয় যারা তাদের সর্বনাশের জন্য তাকেই দায়ী করবে।

২৯. থিতিয়ে পড়া

সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ কন্ট্রোল প্যানেলের সাথে কুস্তি লড়ে যাচ্ছে তখন এ থেকেই যখন সে অবিশ্বাসের সাথে সাথে স্বস্তির দৃষ্টি দিয়ে দেখল যে গ্যালাক্সি ভালভাবেই ট্রান্সফার অর্বিটে চলে এসেছে। পরের ঘণ্টা দুয়েক শিপটা সৃষ্টিকর্তার হাতে ছিল, অন্তত স্যার আইজ্যাক নিউটনের হাতে; ফাইনাল ব্রেকিং আসার পর ডিসেন্ট ম্যানুভার শুরু না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

সে রোজিকে বোকা বানানোর একটা ছোটখাট চেষ্টা করেছিল, উপগ্রহের সবচে কাছাকাছি এসে ভেক্টর বদলে আবার ঘুরে যাবার চেষ্টা আর কী! সেক্ষেত্রে শিপটা অন্য কোনো স্থিত কক্ষপথে বসে যেত, অন্তত গ্যানিমিড থেকে উদ্ধার শিপ আসার একটা সম্ভাবনা থেকে যেত তখন। কিন্তু এ কাজ করতে গেলে একটা মৌলিক সমস্যা থেকেই যাচ্ছে সব সময়, সেই উদ্ধারপর্যায়ে আর যাই হোক, সে উদ্ধার পাবার জন্য বেঁচে থাকবে না। চ্যাঙ মোটেও কাপুরুষ নয়, তারপরও গাধার মতো মহাকাশ হিরো হবার কোনো ইচ্ছাই তার নেই।

ঘণ্টাখানেক ঘুরেফিরে দেখতে পারলেও একটা সুযোগ নেয়া যেত। কিন্তু সোজাসাপ্টা বলে দেয়া হয়েছে, এক হাতে তাকে পুরোপুরি অজানা এলাকায় তিন হাজার টনের একটা যানকে নামাতে হবে যে যানের ভারী কোথাও নামার কথা নয়। এমনকি পরিচিত চাঁদে হলেও (এবং চাঁদ মহা এবড়োথেবড়ো হলেও সে কাজটা করতে ভয় পেত না।

আপনার ব্রেকিং শুরুর কত মিনিট বাকী?

প্রশ্ন, নাকি আদেশ? সে সম্ভবত স্পেস টেকনোলজির প্রাথমিক সব ব্যাপারই জানে। আর চ্যাঙ তাকে নিয়ে যে বোকাটে ভাবনা ভেবেছিল তা নিয়ে বেশ লজ্জায় পড়তে হল তাকে, মনে মনে।

পাঁচ । আমি কি বাকী শিপকে শক্তি হতে বলব? জাস্ট এ ওয়ার্নিং।

আমিই বলছি। মাইকটা দিন… দিস ইজ দ্য ব্রিজ। উই স্টার্ট ব্রেকিং ইন ফাইভ মিনিটস। রিপিট, ফাইভ মিনিটস। আউট।

ওয়ার্ডরুমে জড়ো হওয়া বিজ্ঞানী আর ক্রুদের কাছে তথ্যটা পুরোপুরি জানা। তাদের একটা সৌভাগ্য আছে বলা যায়, এক্সটার্নাল ভিডিও মনিটরটা বন্ধ করা হয়নি। হয়তো রোজ ভুলে বসেছে। কিংবা হোড়াই পরোয়া করে। এখন, রোজির এই বদান্যতায় তারা বন্দী হিসেবে… আক্ষরিক অর্থেই বন্দী হিসেবে,.. তাদের মৃত্যুদূতকে উঠে আসতে দেখছে।

ব্যাপারটা যেন ফাঁসির আসামীর সাথে তুলনীয়, যমটুপি না পরানো আসামী তার দড়ির ফাঁসের দিকেই চেয়ে থাকবে সারাক্ষণ।

ইউরোপার নতুন চাঁদের মতো ক্ষীণ-বাঁকা তনু মেঘে মেঘে ছাওয়া; ভরে তুলছে রিয়ারভিউ ক্যামেরা। এই অতি ঘন বাষ্পধারে কোনো হাল্কা এলাকা নেই; সবই ঘন মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। ল্যান্ডিংটা রাডার নিয়ন্ত্রিত হবে, তাই এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তবে ব্যাপারটা দর্শকদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, যারা চর্মচক্ষুর উপর নির্ভর করে।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উপগ্রহটাকে আঁতিপাতি করে খুঁজছে যে বিজ্ঞানী তার মতো করে আর কেউ রহস্য-দুনিয়াটার উঠে আসার ব্যাপার লক্ষ্য করছে না; যদিও চোখ খুলে দেখছে সবাই। র‍্যালফ ভ্যান ডার বার্গ মোলায়েম গদি আঁটা নন গ্র্যাভিটিক চেয়ারে নিজেকে বেল্ট দিয়ে আটকে রেখে বসে আছে। সে এতোই তন্ময় হয়ে ইউরোপার দিকে চেয়ে আছে যে ওজন বাড়ার ব্যাপারটা টেরই পায়নি।

সেকেন্ড পাঁচেকের মধ্যেই তারা ফুল ব্রাস্টে চলে গেল। সব ক্রু যার যার কমসেটে হিসাব কষতে শুরু করে দিল, কিন্তু কারোটাই নেভিগেশনের সাথে যুক্ত নয়। ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস শুধু চূড়ান্ত সময়টার অপেক্ষায় আছে।

এগারো মিনিট। সে বলে উঠল হঠাৎ করে, যদি সে থ্রাস্ট না কমায়-বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। ধরা যায়, দশ কিলোমিটার উপরে ভেসে থাকবে, তারপর নামবে সোজা। সে কাজে আরো মিনিট পাঁচেক লাগার কথা।

সে আর বাড়তি কথা বলতে চায় না, তবু বলা যেত, সেই পাঁচ মিনিটের শেষ পলটাই সবচে বিপজ্জনক।

দেখেশুনে মনে হচ্ছে ইউরোপা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের মনেই রহস্যটুকু লুকিয়ে রাখবে; দেখতে দিবে না কাউকে। গ্যালাক্সি যখন স্থির দাঁড়িয়ে আছে, নামবে বরাবর নিচে, তখনো ঘন মেঘে মেঘে নিচের সব এলাকা ডুবে আছে। সাগর-ভূমি সব অদৃশ্য, কুয়াশা-মোড়ানো। তারপর বেশ কয়েকটা যন্ত্রণাময় মুহূর্তের জন্য ক্যামেরাগুলোয় বেরুতে থাকা ল্যান্ডিং গিয়ার ছাড়া আর কিছু দেখা যায়নি। এ জিনিস খুব-ই কম ব্যবহার করতে হয়। এখন, বেরুনোর সময় একটু অ্যালার্মের আওয়াজ করার সময় যাত্রীদের একটাই আশা, জিনিসটা যেন ঠিকমতো কাজ করে।

এই মরার মেঘ আর কত গভীর! নিজেকেই প্রশ্ন করল ভ্যান ডার বার্গ, একেবারে নিচে পর্যন্ত যাবে নাতো?

না, মেঘ হাল্কা হচ্ছিল এখন, কেটে যাচ্ছিল ভারী স্তর। এখন মেঘের দলেরা হাল্কা হাল্কা, কোথাও বিভক্ত।

তারপর, অনেকটা হঠাৎ করেই যেন সবার রক্ত ছলকে উঠল। ইউরোপা! মাত্র কয়েক হাজার মিটার নিচে চির রহস্যময়ী নতুন ইউরোপা ভাসছে, সত্যি সত্যি মাত্র কয়েক হাজার মিটার।

অবশ্যই, গঠন পুরোপুরি বদলে গেছে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য ভূগোলবিদ হওয়ার দরকার নেই। চার বিলিয়ন বছর আগে, সম্ভবত, প্রাচীন পৃথিবী দেখতে ঠিক এমন ছিল। এবং সেই পৃথিবীতে সমুদ্র-ভূমির কালান্তরী কামড়াকামড়ির শুরু হয়।

কিন্তু এখানে? মাত্র অর্ধশত বছর আগেও না ছিল স্থলভাগ, না জল-শুধু বরফ আর বরফ। আর এখন লুসিফারের দিকে মুখ করা প্রান্তের বরফ গলে গেছে, তরল পানি বাষ্প হয়ে উঠে গেছে উপরদিকে, তৈরি করেছে অথৈ মেঘের স্তর, তারপর ভাসতে ভাসতে রাতের প্রান্তে যেতেই অকল্পনীয় ঠাণ্ডায় চিরদিনের জন্য জমা হয়েছে উল্টো পিঠে। এক মুখ থেকে আরেক মুখে বিলিয়ন বিলিয়ন টন পানি স্থানান্তরিত হওয়াতে এমন ভূমি জেগে উঠেছে যেখানে কোনদিন দূর-সূর্যের ক্ষীণ আলো পড়েনি।

তারপর, কোনো একদিন হয়তো এই ভূমি নরম হবে, ভরে উঠবে নমনীয় জৈবিক সৃষ্টিতে, ফলাবে ফসল । কিন্তু এখন তারা নাঙা। এখন সেখানে শুধু লাভা আর গরম কাদার স্তর। মাঝেমধ্যে নিচ থেকে উঠে আসে শক্ত পাথরের দল।

দেখে পষ্ট বোঝা যায়, এখানে আসলে স্থিরতা বলে কিছু নেই, সত্যিকার শক্ত বলে বড় কিছু নেই উপরিতলে; এখন যেটা ভূমি সেটাই হয়তো আসল সময়ে চিরস্থায়ী সাগরে পরিণত হবে, আর সাগর হবে ভূমি। একেই বলে টেকটোনিক যুগ। ব্যাপারটা বেশ ধাঁধায় ফেলে দেয়, এই এলাকায় কিনা প্রায় মাউন্ট এভারেস্টের মতো একটা পর্বতের উত্থান হয়েছে।

এইতো, সেই পাহাড়, অপ্রত্যাশিত উচ্চতায় জ্বলজ্বল করছে অবিরাম। রালফ ভ্যান ডার বার্গ বুকের কাছে কেমন যেন ব্যথা অনুভব করছে, আর গলার কাছে আটকে আসছে খাস। কোনো যান্ত্রিক-অসম্পূর্ণ চোখে মেঘের আড়াল থেকে লো রেজুলেশনে এক মুহূর্তের জন্য নয়, নিজের চর্মচক্ষুতে মাত্র দু-চার কিলোমিটার উপর থেকে দেখা যাচ্ছে স্বপ্ন পর্বত! তার স্বপ্ন পর্বত।

সে ভালমতোই জানে এর আকার প্রায় নিখুঁত চতুষ্কোণ, একটা মুখ প্রায় খাড়া। (এই নিচু গ্র্যাভিটিতেও এখানে ওঠাটা বেশ কষ্টকর হবে পর্বতারোহীদের জন্য…) ওদের দিকে ফেরানো মুখটা তুষারাবৃত আর গোড়া ঢেকে আছে মেঘের আড়ালে।

এটা নিয়েই কি এতো রাজা-উজির মারামারি হলো এতোদিন? কে যেন আড়াল থেকে বলে উঠল, দেখেশুনে তো মনে হয় একদম আটপৌরে… যদ্দুর মনে হয় আপনি একবার কোনো একটা… কথা শেষ না করেই রাগে বন্ধ করে দিল কথক।

এখন গ্যালাক্সি ধীরে ধীরে মাউন্ট জিউসের দিকে এগুচ্ছে, চ্যাঙ একটা ল্যান্ডিং সাইটের আশায় দেখছে আশপাশ। আরো মিনিট পাঁচেক ভেসে থাকার মতো প্রোপ্যাল্যান্ট জমা আছে শিপের গায়ে; তার পরও সে নিরাপদে ল্যান্ড করার একটা সুযোগ নিতে পারে, কিন্তু আবার ওঠা সম্ভব হবে না কোনোদিন।

প্রায় শতবছর আগে নিল আর্মস্ট্রং এমনই এক মানসিক অবস্থায় পড়েছিল; আর যাই হোক, তার দিকে নিশ্চই কোনো আগ্নেয়াস্ত্র তাক করা ছিল না সে সময়টায়…

এখন, গত পাঁচটা মিনিট ধরে তার না মনে আছে আগ্নেয়াস্ত্রের কথা, না রোজির কথা। আর আসলেই, মন-মগজ ঢুকে আছে পুরোপুরি কাজের ভিতরে। আক্ষরিক অর্থেই যে বিশাল যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণভার তার হাতে সেটারই এক অংশে পরিণত হয়েছে অবশেষে। মানবিক আবেগ বলতে একটা ব্যাপারই কাজ করছে তার মনে, ভয় নয়-কাজ কাজ আর কাজ। এ কাজের জন্যই সে এতো কষ্টে ট্রেনিং নিয়েছে, এবং জীবনে শেষবার হলেও কাজটা সে করতে চায় নিজের পেশাদারিত্বের প্রমাণসহ।

কিন্তু এখন তাই প্রমাণ করার পালা, পর্বতের পা আর মাত্র কিলোমিটারখানেক দূরে, এবং এখনো সে কোনো ল্যান্ডিং সাইট খুঁজে পায়নি। নিচে একটুও স্থিত ভূমি নেই। ছোটবড় খাদ আর খানাখন্দে ভরা চারদিক। তার উপর মহা উঁচুনিচু। একটা টেনিস কোর্টের মতো ছোট জায়গাও পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ফুয়েল গজের লাল দাগ ত্রিশ সেকেন্ডে ঠেকে গেছে।

এবং সেখানে, অবশেষে, একটা মোটামুটি সমতল এলাকা দেখা যাচ্ছে… যথেষ্ট সমতল… এই তার শেষ সুযোগ। কত কম সময়ে কত সুন্দর কাজ করতে জানে সে সেই প্রমাণটা এবার দেখাতে হবে।

অনেক কষ্টে সে দানবটাকে এগিয়ে নিল সেদিকে, অস্থির সিলিন্ডারটাকে সামনের পথের দিকে তাক করে নিল। মনে হয় তুষারে মোড়া… তাইতো, তুষার পড়ে আছে উপরে-ব্লাস্টের কারণে তুষার উড়ে যাচ্ছে–কিন্তু নিচে কী?-এবড়োথেবড়ো ভূমি নয়তো?-কাদার স্তরও হতে পারে-না, বরফের মতো দেখাচ্ছে নিশ্চই জমাট কোনো লেক-নিশ্চই-কতোটা পুরু?-কতো পু

গ্যালাক্সির পাঁচ হাজার টন হাতুড়ির আঘাত পড়ল। মূল জেটগুলো আপনজনের মতো আকড়ে ধরল ভূমি। এর উপর ছড়িয়ে পড়ল তেজস্ক্রিয়তার একটা রেখা, ভাঙতে শুরু করল বরফের বিশাল বিশাল আকৃতি, হঠাৎ মুখ উন্মোচিত হওয়া লেকের গায়ে ড্রাইভের আগুন-গরম অংশ লাগায় বরফ পরিণত হল বাষ্পে, বাস্পঝড় উঠল চারদিকে।

একজন দক্ষ এবং সুন্দর ট্রেনিং পাওয়া অফিসার হিসেবে চ্যাঙ সাথে সাথেই, সাড়া দিল, মনের বিবশ ভাবকে মোটেও ধর্তব্যে আনেনি। বাম হাতটা এক ঝটকায় সেফটি লক বার টেনে নিল নিজের দিকে, ডানটা ধরল লাল লিভার, টেনে তুলল উপরদিকে।

অ্যাবোর্ট নির্দেশনায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সে, প্রোগ্রামটা এই পর্যন্ত ঘুমিয়েই ছিল, জেগে উঠল সাথে সাথে, উল্টে গেল হিসাবের ছক, এবং স্পেসশিপ গ্যালাক্সি জেগে উঠল আকাশের বুকে; আবারও…

৩০. ভাঙা আমার তরী

মরণের মতো আঘাত হয়ে এসেছিল ফুল থ্রাস্টটা; ওয়ার্ডরুমে। আতঙ্কে অস্থির অফিসাররা দেখল তাদের নামার ভূমি মাকড়সা জালের মতো ভেঙে পড়েছে নিচের দিকে; তারা জানে, বাঁচার একটা মাত্র উপায় বাকী আছে, এবং-তাদের জানা মতে গ্যালাক্সিকে চালানোর জন্য সৃষ্টি জগতে শ্রেষ্ঠ মানুষটি আবারও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ায় একটা শ্বাসকে আসার অনুমতি দেয়া যায়।

কিন্তু আর কততক্ষণ ব্যাপারটা উপভোগ করা যায়? কেউ জানে না। শুধু চ্যাঙই জানে শিপের যথেষ্ট প্রোপ্যাল্যান্ট আছে কি না। কোনো স্থিত কক্ষপথে ওঠা যাবে কি যাবে না….

ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাসের চিন্তা অন্য, আগ্নেয়াস্ত্র হাতের সেই উন্মাদটা আবারও হয়ত নামার আদেশ দেবে, সেক্ষেত্রে? এবং পর মুহূর্তেই আবার মনে পড়ে গেল কথাটা, আর যাই হোক, রোজি ম্যাককোলেন আর যাই হোক, পাগল নয়। সে ঠিক ঠিক জানে কী করতে হবে। আফসোস, তাদের জানার সাথে মেয়েটার জানার কোনো মিল নেই।

তারপরই, হঠাৎ বদলে গেল ব্রাস্টের আচরণ।

নাম্বার ফোর থ্রাস্ট এইমাত্র বিকল হয়ে গেল। ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার রিপোের্ট করল সাথে সাথে, আমি মোটেও অবাক হইনি। সম্ভবত উপরের দিকে…আসলে এ পরিস্থিতিতে বেশিক্ষণ টেকার কথাও নয়।

অবশ্যই, কোনো দিকনির্দেশনার ঠিক ঠিকানা নেই এখন। নিভু নিভু থ্রাস্টটা এখনো কন্ট্রোল প্যানেলের কথা মেনে চলছে, বাইরের দৃশ্য পাগলের মতো উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে, যা হবার কথা… শিপ এগিয়ে যাচ্ছে এখনো, কিন্তু ভূমির সমান্তরালে নয়। পুরো গ্যালাক্সি একটা ব্যালাস্টিক মিসাইলে পরিণত হয়েছে মুহূর্তে, তার টার্গেট অজানা, এবং অজানা ইউরোপার বুকের দিকে লক্ষ্য করা।

আবারো থ্রাস্ট এলোমেলোভাবে শক্তি ছড়াল; মনিটর জুড়ে ভূমি আবার সমান্তরাল হয়ে গেছে।

বিপরীত মনিটরটা বন্ধ করে দিয়েছে চ্যাঙ, আমরা যেন পাগল না হই সেজন্যে… কিন্তু সে কি উচ্চতাটা ধরে রাখতে পারবে… ভদ্রলোক…।

দেখতে থাকা বিজ্ঞানীরা এ কাজের ভাল মন্দ বোঝেনি। বাস্তবকে সরিয়ে রাখলে কী এসে যায়? মনিটরের দৃশ্য পুরোপুরি চলে গেছে, সামনে শুধুই চোখ ধাঁধানো সাদা।

বাড়তি জ্বালানীটাও পুড়িয়ে দিচ্ছে।

এবং, তারপর থ্রাস্ট একেবারে থেমে গেল, মুক্ত পতন হচ্ছে শিপের। থ্রাস্টের তাণ্ডবের সময় বরফের অসীম গুড়া ছড়িয়ে পড়েছিল আশপাশের আকাশে, সেগুলো সাথে নিয়েই শিপ নেমে যাচ্ছে নিচে। তারপর যখন পৃথিবীর স্বাভাবিক মাধ্যাকর্ষণের আটভাগের একভাগ আকর্ষণে মহাকাশতরী নিচের দিকে নামছিল, তাকে স্বাগত জানানোর জন্য ইউরোপার কেন্দ্রীয় মহাসাগর মুখব্যাদান করে ছিল প্রবল উৎকণ্ঠায়।

অন্তত চ্যাঙ একটা ভ্যাজাল থেকে বাঁচল, তাকে আর ল্যান্ডিং সাইট খুঁজে বেড়াতে হবে না। এখন থেকে অপারেশনাল সিস্টেম পৃথিবীর কোটি কোটি ভিডিও গেমারের গেম কন্ট্রোলের মতো হবে যারা কখনোই স্পেসে যায়নি, হয়তো কখনো যাবে না।

এখন তার কাজটা বেশ সরল এবং কঠিন, তার উপর এ গেমে গেম ওভারটা খুবই নিষ্ঠুর হওয়ার কথা। নামতে থাকা শিপের জেটগুলোকে শুধু পতনের বিপরীতে চালাতে হবে; জিরো মুমেন্টে জিরো মোমেন্টাম পেলেই খেলোয়াড় এ স্টেজে জিতে যাবে, এগিয়ে যাবে পরের স্টেজের দিকে। সাগরের উপরভাগ ছুঁয়ে দেয়ার মুহূর্তে পতন গতি যেন শুধু শূন্য হয় এটাই যে কোনো দক্ষ খেলোয়াড় (ভিডিওগেমের ক্ষেত্রে) এবং দক্ষ পাইলটের (স্পেস শিপের ক্ষেত্রে) একমাত্র লক্ষ্য। আমেরিকান স্পেসবিশেষজ্ঞরা আগের দিনে এভাবে নামাটাকেই সবচে নিরাপদ এবং নির্ভেজাল মনে করত। কিন্তু সেজন্যে শিপটাকে সেভাবেই ডিজাইন করতে হয়। আর না এর মালিকপক্ষ আমেরিকান, না চালকপক্ষ। কিন্তু সে যদি গত ঘণ্টা কয়েকের দক্ষতার পরও শেষ কাজটায় ব্যর্থ হয় তাহলে কোনো হোম এন্টার্নেইনমেন্ট কম্পিউটার বলবে না, স্যরি-তুমি ক্র্যাশ করেছ। আরেকবার চেষ্টা করবে? অ্যানসার-ইয়েস/নো…

.

সেকেন্ড অফিসার য়ু আর তার দু সহকর্মী ব্রিজের লক করা দরজার বাইরে নিজেরদের উন্নয়ন করা অস্ত্র হাতে ওঁৎ পেতে আছে, এবং এটাই সম্ভবত তাদের জীবনের সবচে বিদঘুঁটে অ্যাসাইনমেন্ট। ভিতরে কী হচ্ছে তা জানানোর জন্য কোনো মনিটর স্ক্রিন নেই, শুধু ওয়ার্ডরুমের মেসেজের উপর নির্ভর করতে হবে। এবং স্পাই মাইকের ভিতর দিয়ে কোনো নির্দেশনা আসছে না; ব্যাপার লক্ষণীয়। রোজি আর চ্যাঙের কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।

টাচডাউনটা চমৎকার হল, শুধু সামান্য একটা ধাক্কা, ব্যস। আরো কমিটার ডুবে গেল গ্যালাক্সি, তারপর ভেসে উঠল আবার… আর ইঞ্জিনের অবস্থান ও ওজনকে ধন্যবাদ, সেগুলো উপরের দিকে বসানো।

এরপরই শ্রোতারা দরজার ওপাশ থেকে হাল্কা কথা শুনতে পায়।

তুমি, ম্যানিয়াক রোজি; আশা করি তোমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমরা সবাই এখন মৃত।

একটা পিস্তলের আওয়াজ ভেসে এল, তারপর সব চুপচাপ।

একজন নুইয়ে ফেলল মাথা, স্পেস ক্রুকে এমনটা মানায় না। অন্যজন পেছনে। তাকায়, যেন চিৎকার করবে। কিন্তু য়ুর বাধার মুখে কিছু করার নেই।

সেকেন্ড অফিসার য়ু আর তার কলিগরা ধৈর্য ধরল, দাঁতে দাঁত চেপে। তারা জানে, এখন কিছু না কিছু ঘটবেই।

ঠিক তাই, দরজার লকিংবারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে তাদের কোনো একজনকে পেড়ে ফেলতে পারে, সবাইকে নয়-খোলার সাথে সাথে আঘাত হানতে হবে, তিনদিক থেকে।

দরজা খুলে গেল, অতি ধীরে।

“স্যরি, আমি নিশ্চই মিনিটখানেকের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম…

তারপর, যে কোনো বুদ্ধিমান মানুষের মতো চুপ করে থাকল সে, সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ।

৩১. প্রখর, দারুণ, অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন

কে জানে কীভাবে মানুষ ডাক্তার হয়! ভাবছে ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস। অন্যদিকে, মানুষ যে কী করে গোরখোদক হয় তাই বা কে জানে? দুজনেরই কিছু না কিছু বিচ্ছিরি কাজ করতে হয় হরহামেশা…

কিছু পেলেন নাকি?

না, স্কিপার। এম্নিতেও আমার সঠিক যন্ত্রপাতি নেই। দেখেশুনে মনে হচ্ছে তাদের দেখতে হলে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে আঁতিপাতি করে খুঁজতে হবে।

একটা রিলে ট্রান্সমিটার থাকার কথা বলেছিল ফ্লয়েড, দেখুনতো। আর ফিঙ্গারপ্রিন্টও দরকার। নিয়েছেন এসব?

হু-গ্যানিমিডের সাথে যোগাযোগ বসার সাথে সাথে তার পেপারগুলোসহ পাঠিয়ে দিব। কিন্তু সন্দেহ হয়, আমরা কোনোদিনই জানতে পারব না রোজি কে ছিল, অথবা কার ভূমিকায় অভিনয় করছিল, অথবা কেন-আল্লা মাবুদ জানে।

ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস যেন তার মানবিক গুণ খোঁজায় ব্যস্ত, যাই হোক, ওর ব্যবহারে কিছু মানবিক দিক প্রকাশ পেয়েছিল। অ্যাবোর্ট লিভার টানার সময় সে ইচ্ছা করলেই চ্যাঙকে গুলি করতে পারত।

তাতে আমাদের বেশ ভালই হত, মনে হয়। এক ধাক্কায় সবাই শেষ হয়ে যেতাম। জেঙ্কিন্স আর আমি লাশটা রিফিউজ ড্যাম্প দিয়ে ফেলে দেয়ার সময় কী হল বলি…

ডাক্তার আতঙ্কিতভাবে ঠোঁটদুটোকে চেপে ধরল পরস্পরের সাথে।

“আপনার কথাই ঠিক, অবশ্যই। এছাড়া আর কী করার ছিল? যাই হোক, আমরা বাড়তি ওজন বওয়ার ঝামেলায় যাইনি-কয়েক মিনিট ভেসে ছিল শরীরটা-তারপর শিপ থেকে দূরে যায় কিনা তা দেখার জন্য চেয়ে ছিলাম-ঠিক তখনই…

ডাক্তার যেন কথা খুঁজে পাবার চেষ্টা করছে।

কী? ড্যাম ইট!

“পানি থেকে কিছু একটা উঠে এসেছিল। অনেকটা টিয়ার ঠোঁটের মতো; কিন্তু প্রায় শতগুণ বড়। এক ঠোকরেই এটা-রোজিকে-নিয়ে উবে গেল। আমাদের এখানে বেশ ভাল সঙ্গী জুটবে মনে হয়। এমনকি বাইরে শ্বাস নেয়ার সুযোগ থাকলেও আমি সাঁতরানো পছন্দ করি না এমন পরিস্থিতিতে।

ব্রিজ টু ক্যাপ্টেন বলল অফিসার অন ডিউটি, পানিতে বড় ধরনের আলোড়ন দেখা যাচ্ছে, ক্যামেরা থ্রি তে। আপনাকে ছবি দিচ্ছি।

এই জিনিসটাকেই দেখেছিলাম আমরা! কেঁদে উঠল যেন ডাক্তার, তার গলায় ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি হচ্ছে, একটাই চাওয়া তার: আশা করি আরো বেশি কিছু পাবার জন্য জিনিসটা উঠে আসেনি।

তারপর হঠাৎ করেই এক বিশাল আকৃতি পানি থেকে ছিটকে উঠল উপরে; পানি আর আকাশের মাঝামাঝি পুরো আকৃতিটা চোখে পড়ল এবার।

পরিচিতিটা এতো বেশি, মিলটা এতো কাছাকাছি যে ডক্টর আর ক্যাপ্টেন একসাথে চিৎকার করে উঠল: ইটস এ শাক!

দৈত্যটা আবার সাগরে ফিরে যেতে যেতে একবারের জন্য শরীর আর টিয়া পাখির ঠোঁটের দিকে দৃষ্টি বুলানোর সুযোগ পাওয়া যায়। একজোড়া বাড়তি ফিন দেখা যাচ্ছে, আর কোনো ফুলকা আছে বলে মনে হল না। কোনো চোখও নেই-কিন্তু তা কী করে সম্ভব? অসম্ভব কেন! ঠোঁটের অন্যপাশে কেমন একটা অংশ দেখা গেল-সেটাই হয়তো ভিন্ন ধরনের কোনো ইন্দ্রিয়।

চিরাচরিত বিবর্তন। বলছে চিকিৎসক, সেই একই ধরনের সমস্যা, একই। ধরনের সমাধান, সব গ্রহে। পৃথিবীর দিকে চোখ ফেরান-ডলফিন, হাঙর আর ইকথায়োসর-সব সামুদ্রিক শিকারীর এই একই বেসিক ডিজাইন থাকতে হয়। কিন্তু ঐ চোয়াল মার্কা ঠোঁটটাই আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিচ্ছে।

জীবটা আবারও জেগে উঠেছে উপরে, কিন্তু এবার ধীরলয়ে এগুচ্ছে, যেন ঐ দানবীয় লম্ফঝম্পের পর বেশ ক্লান্ত এখন। বোঝা যাচ্ছে এর ভিতরে গন্ডগোল হয়েছে কোনো, যেন যন্ত্রণায় লেজ দিয়ে পানিতে আঘাত করছে বারবার, কোনোদিকে যাবার আশায় নয় ।

তারপর হঠাৎ করেই প্রাণীটা শেষ খাবারটা উগড়ে দিয়ে পেট উপরের দিকে তুলে নির্জীব ভেসে থাকল শান্ত পানির উপর।

ও মাই গড! বলল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস, যেন কোনো সিদ্ধান্তে এসে পড়েছে, আমি জানি কী হল এখন!

পুরোপুরি ভিন্ন জৈবরসায়ন, বলল ডাক্তার, তারপর ভয় পেয়ে যেন চমকে উঠল অনেকটা, অবশেষে রোজি অন্তত একজনকে শিকারে পরিণত করতে পারল।

.

গ্যালিলির সাগরের নামকরণ হয়েছে অবশ্যই ইউরোপার আবিষ্কারকের নামে। অন্য এক দুনিয়ায় ছোট্ট এক সাগরের নাম এখন তার নামে।

সাগরের বয়স একেবারেই কম, মাত্র অর্ধশত বছর। কিন্তু আর সব নবজাতকের মতো সেও নানা বিপত্তি ঘটাতে পারে। ভরসার কথা একটাই, ইউরোপায় এখনো ঝড় তৈরি হবার মতো শক্তিশালী বায়ুমণ্ডল গড়ে ওঠেনি। একটা শান্ত বাতাস ভূমি থেকে সমুদ্রের দিকে বয়ে গেল, যেখানকার আকাশে লুসিফার চির স্থির রূপ নিয়ে বসে আছে, সেদিকে। এখানে, স্থির দুপুরের এলাকাটায় সব সময় পানি সেদ্ধ হয়ে উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। এই বায়ুমণ্ডলের চাপে এমন তাপমাত্রায় সহজেই এক কাপ চা বানিয়ে নেয়া যায়।

সৌভাগ্যজনকভাবে, যেখানে সারাক্ষণ এই তাণ্ডব চলছে সেখান থেকে প্রায় হাজার কিলোমিটার দূরে পড়েছে স্পেসশিপটা। এলাকা বেশ শান্ত। সবচে কাছের ভূমি থেকে শত কিলোমিটার দূরেও নয়। সর্বোচ্চ গতিতে সে এই দূরত্বটা এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে পার করে যেতে পারে। কিন্তু এই অদ্ভুতুড়ে পরিবেশে ইউরোপার চিরস্থায়ী মেঘের নিচে পানিতে পড়ে থেকে সামান্য দূরত্বটাকেই কোয়াসারের মতো অসীম বলে মনে হচ্ছে।

এই ল্যান্ডিংটা যদি এমন শুধু সমুদ্রে না হয়ে কোনো কুমারী বেলাভূমিতেও হতো, কী লাভ হতো তাতে।

এখানে আরেকটু আরাম আয়েশ থাকত তখন। স্পেসশিপ ওয়াটারপ্রুফ হলেও পানিতে তেমন আরামদায়ক নয়। শিপটা সমুদ্র উপরিতলে সত্যিকার জাহাজের মতোই ভেসে আছে, কিন্তু সমস্যা হল, প্রতিটি বড় ঢেউয়ের সাথে এদিক-সেদিক দুলছে এবং এ শিপের ত্রুরা কেউ নাবিক নয়। তাই মহাকাশতরীর অর্ধেক সারেংই অসুস্থ হয়ে পড়েছে বাকীদেরও একই অবস্থায় আসতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়।

সব ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট পেয়েই ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস সবার আগে জানতে চায়, কেউ নৌকা চালাতে জানে কিনা। যে আকার প্রকারেরই হোক না কেন, নৌকা চালাতে জানলেই হল।

ত্রিশজন অ্যাস্ট্রোনট এবং বিজ্ঞানীর মধ্যে কেউ না কেউ সৌখিন নাবিক হবেই, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পাওয়া গেল পাঁচজনকে, এবং মজার ব্যাপার, একজন সত্যিকার নাবিকও বেরিয়ে গেল সাথে সাথে। পার্সার ফ্র্যাঙ্ক লি আসলে সুং শিপিং লাইনে কাজ শুরু করে, তারপর সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়ে মহাকাশ তরীতে।

পার্সাররা অ্যাকাউন্টিং মেশিন চালানোয় বেশি পারদর্শী হলেও তাদেরকে অবশ্যই বেসিক সীম্যানশিপ পাশ করতে হয়, তাই তাদের নেভিগেশনাল অপারেশন জানা অবাক করা ব্যাপার নয়। মজার ব্যাপার, ফ্র্যাঙ্ক লিকে অনেক সময় দুশ বছরের পুরনো অ্যাবাকাসও চালাতে হয়েছিল। অবশ্য সে কখনোই তার বিয়ের সময়কার সেই ট্রেনিংয়ের বাস্তব ব্যবহার করতে পারেনি, তার উপর কোথায় বিলিয়ন কিলোমিটার দূরের দক্ষিণ চীন সাগর আর কোথায় সি অফ গ্যালিলি।

প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্কগুলো ভরে ফেলা উচিত বলল সে ক্যাপ্টেনকে, তাহলে আর শিপ উঠা নামা করবে না। বেশ স্থির থাকবে।

শিপে আরো পানি আসতে দেয়াটা কেমন যেন বোকামী বলে মনে হল। আর ক্যাপ্টেনও বেশ ইতস্তত করছিল।

ধরা যাক আমরা আশপাশে ঘুরে বেড়াতে চাই, তখন?

আর কেউ আসল জবাবটা দিল না, তাতে কী এসে যায়?

এবং তারপর বেশ কিছুক্ষণ গুম মেরে থেকে সিদ্ধান্ত হল পানির চেয়ে মাটির উপরে থাকাটাই ভাল হবার কথা-যদি যাওয়া সম্ভব হয় তাহলে।

আবার যে কোনো সময় ট্যাঙ্ক খালি করা যাবে। একাজ করা প্রয়োজনও পড়বে হাল্কা পানিতে যাবার সাথে সাথে। প্রথম সুযোগেই শিপটাকে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়া করানো যাবে, থ্যাঙ্কস গড, আমাদের হাতে ক্ষমতা আছে…

তার কণ্ঠ স্তিমিত হয়ে গেল সাথে সাথেই। সবাই জানে, কী বোঝাতে চায় সে। অকজিলারি রিয়্যাক্টরটা না থাকলে সবাই এরমধ্যে মারা যেত, লাইফ সাপোের্ট সিস্টেম চালায় ওটাই।

এবং এরই মধ্যে তারা সবাই বেশ ভালভাবে জেনে গেছে, সি অফ গ্যালিলির বুকে পুষ্টির কোনো চিহ্নই নেই। শুধু বিষ আর বিষ, চারদিকে।

গ্যানিমিডের সাথে যোগাযোগের কাজটা সেরে ফেলা হয়েছে, সারা সৃষ্টি জগতের মানুষ জেনে গেছে ওদের কথা। সৌর জগতের শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কগুলো এবার তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করবে। আর তাতেও কাজ না হলে গ্যালাক্সির কু আর যাত্রীরা অসম্ভব জনপ্রিয়তা নিয়ে মরার সুযোগ পাবে।

৪. পানির গর্তে

চতুর্থ পর্ব – পানির গর্তে

৩২. ধনুকভাঙা পণ

সর্বশেষ খবর হল, বলছে ক্যাপ্টেন স্মিথ, তার নতুন যাত্রীদের প্রতি, গ্যালাক্সি ভাসছে এবং তার অবস্থাও বেশ ভাল। একজন ক্রু মেম্বার মারা গেছে, মহিলা স্টুয়ার্ড। বাকী সবার অবস্থা ভাল, নিরাপদেই আছে সবাই।

শিপের সব সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করছে । দু চার জায়গায় ছিদ্র থাকলেও সময় মতো সামলে নিয়েছে তারা। ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস বলেছেন আপাতত কোনো বিশেষ বিপদ নেই। কিন্তু বিশেষ বাতাসটা ভূমি থেকে আরো দূরে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, দিবাভাগের কেন্দ্রের দিকে। দিনের অংশে আশপাশের হাজারখানেক কিলোমিটারের বাতাস সারাক্ষণ সেদিকেই যায়, কারণ সেখান থেকে বাষ্পের সাথে সাথে বাতাসও গরম হয়ে উপরে ওঠে সব সময় লুসিফারের তাপে সিদ্ধ হয়ে । কিন্তু প্রব্লেমটা মেজর নয়। দেখে বোঝা যাচ্ছে বড়বড় বেশকিছু দ্বীপের মধ্যে কোনো কোনোটায় তারা গিয়ে ঠেকতে পারবে।

বর্তমানে তারা সবচে কাছের ভূ-ভাগ থেকে নব্বই কিলোমিটার দূরে। বেশকিছু বড় সামুদ্রিক প্রাণীর দেখা পাওয়া যায় সেখানে। সেগুলো কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

এখন কোনো উটকো ঝামেলায় না পড়লে আরো মাস কয়েক টেনেটুনে চলতে পারবে। খাবারের সঙ্কটটাই প্রধান এবং শক্ত রেশনিং চলছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন ল্যাপাসের মতে মনোবল এখনো অটুট আছে সবার।

“এখন, আমরা এমন এক জায়গাতেই যাচ্ছি। রওনা হয়ে পৃথিবী থেকে জ্বালানী নিতে হবে। তারপর অর্বিটে পৌঁছতে পৌঁছতে ৮৫ দিন লেগে যেতে পারে। আর বর্তমানে একমাত্র ইউনিভার্সই সেখান থেকে যথেষ্ট পে লোড নিয়ে আবার ওটার ক্ষমতা রাখে। গ্যানিমিডের শাটলগুলো বড়জোর সাপ্লাই ফেলতে পারে, তাও পাবার ঠিক ঠিকানা নেই। এবং এ কাজ করতে গিয়ে ধসে পড়ার ভয়ও থাকে।

“আই অ্যাম স্যরি, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, কিন্তু আমাদের যাত্রা একটু কেটেহেঁটে ছোট করতে হচ্ছে। কিন্তু আপনারা নিশ্চই একমত হবেন যে ওয়াদামতো আমরা আপনাদের সব দেখিয়েছি, এবং এ নিয়েও আমি নিশ্চিত যে নতুন মিশনের ব্যাপারেও আপনাদের কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। যদিও, মুক্ত মনে বলতে গেলে, সফলতার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। এখনকার মতো এটুকুই বলতে চেয়েছিলাম। ড. ফ্লয়েড, আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে?

সবাই চিন্তিত মনে ভেসে বেরিয়ে যাবার সময় ক্যাপ্টেন একটা ক্লিপবোর্ড হাতে তুলে নিল। এ যুগেও মাঝেমধ্যে কাগজের টুকরাতে ডাটা প্রিন্ট করা হয়, কিন্তু খুব কম। এখানেও একটা কিন্তু থেকে যায়, এ মাল্টিফ্যাক্স পেপার এক বিশেষ জিনিস। ওয়েস্ট পেপার বক্সের ওজন কমানোর জন্য এক কাগজেই হাজারবার প্রিন্ট নেয়া হয়।

হেউড সে বলল, কারণ আনুষ্ঠানিক ভদ্রতার সময় শেষ হয়ে গেছে, দেখতেই পাচ্ছেন, এতো এতো তথ্য আসছে যে সার্কিট পুড়ে যাবার দশা। আর চারধারে এতোকিছু ঘটছে যে মাথায় চট করে কিছু ঢোকে না।

ক্রিসের কোনো খবর, ডিটো?

“না। কিন্তু গ্যানিমিড আপনার খবর প্রচার করেছে। এর মধ্যে তার মেসেজটা পাবার কথা, এমিতেও প্রাইভেট মেসেজের উপর আমাদের পাঠানো খবরগুলোর প্রাধান্য আছে, তার উপর আপনার নাম নিশ্চই জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করবে, অন্তত করার কথা।

“থ্যাঙ্কস, কাপ্তান। কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?

আসলে, না-আমি আপনাকে সাথে সাথেই জানাব।

এই শেষবার তারা নিকট বন্ধুর মতো পরস্পরের সাথে কথা বলছে, আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তারপরই ড, হেউড ফ্লয়েড হয়ে যাবে, ঐ পাগলা বুড়োটা… আর শুরু হবে ক্ষণস্থায়ী, ইউনিভার্সের বুকে বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে পুরোধা হবে ক্যাপ্টেন স্বয়ং।

.

আইডিয়াটা আসলে হেউড ফ্লয়েডের নিজস্ব নয়; সে শুধু আশা করেছিল যেন…

সেকেন্ড অফিসার রয় জলসন নেভিগেশন অফিসারদের মধ্যে তারকায় পরিণত হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এর আগে ফ্লয়েড তার সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলেনি, মুখচেনা লোকটাকে বড়জোর শুভ সকাল জানানো হত। তাই ফ্লয়েডের কেবিনে অন্যরকম নক শুনে বেশ অবাক হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

অ্যাস্ট্রোগেটর (মহাকাশ নেভিগেটর) হাতে একগাদা চার্ট নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছিল; এম্নিতেও ফ্লয়েড তার উপস্থিতি টের পায়নি। তার উপর শিপের আবহাওয়া গেছে। বদলে। তবু এভাবে আসার অন্য কোনো কারণ অবশ্যই আছে।

ড, ফ্লয়েড, সে হড়বড় করে কথা শুরু করল, যেমন করে নতুন সেলসম্যান তার লাইসেন্সদাতার কাছ থেকে লাইসেন্স পাবে নাকি পাবে না তা জানার আগে কথা বলে, সেভাবে, আমি আপনার পরামর্শ চাই-এবং একটু সহায়তা।

অবশ্যই! কিন্তু কী করতে পারি আমি আপনার জন্য?

জলসন চার্টটা মেলে ধরল সামনে। চার্টে লুসিফার অর্বিটের ভিতরে সব গ্রহের অবস্থান দেখাচ্ছে।

লিওনভ আর ডিসকভারিকে জুড়ে দিয়ে বৃহস্পতি জগৎ ধসে পড়ার আগে টেনে নেয়ার যে পদ্ধতি আপনি নিয়েছিলেন, সেটাই আমাকে আইডিয়াটা দিয়েছে।

ধারণাটা আমার নয়, ওয়াল্টার কার্নোর মাথা থেকে বেরিয়েছিল।

ও-আমি এ কথা জানতাম না। অবশ্যই, এখানে গতি বাড়ানোর জন্য আমাদের হাতে অন্য কোনো শিপ নেই, কিন্তু অন্য কোনো ব্যাপার আছে। আরো বড় ফ্যাক্টর।

কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে ফ্লয়েড প্রশ্ন তুলল।

কেন কষ্ট করে পৃথিবী পর্যন্ত যাব? যেখানে দুশ মিটার দূরে ওল্ড ফেইথফুল আমাদের জ্বালানী বুকে নিয়ে বসে আছে! তিন মাসের জায়গায় হপ্তা তিনেক লাগবে, বড়জোর। তারপর সোজা ইউরোপার বুকে নামব আমরা।

চিন্তাটা এতো অবাক করা যে ফ্লয়েড কয়েক মুহূর্তের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেল। সাথে সাথেই চোখের সামনে আধ ডজন অভিযোগ ভেসে উঠল, কিন্তু কোনোটাই খুব বেশি ভয়ংকর নয়।

ক্যাপ্টেন কী ভাবছে এ নিয়ে?

তাকে বলিনি। আপনার কাছ থেকে এই সাহায্যটাই চাই। আগে হিসাবনিকাশ শেষ করে তারপর বলব। সে পাত্তাই দেবে না-অবশ্যই। আমি হলেও তাই করতাম…।

ছোট্ট কেবিন অনেক অনেকক্ষণ ধরে চুপ থাকার পর ফ্লয়েড বলল, ধীরলয়ে, কেন কাজটা সম্ভব না তা বলার ফুরসত দিন আমাকে। তারপর আপনি জানাবেন আমার কোথায় কোথায় ভুল হল।

.

সেকেন্ড অফিসার জলসন তার ক্যাপ্টেনকে হাড়ে হাড়ে চেনে। সে জিন্দেগীতেও এমন কথায় কান দেবে না..

তার জেদটা একটু পুরনো তালের। তোমার কথা ঠিক আছে, কিন্তু মানা সম্ভব না.. এখানে প্রযোজ্য নয় (এবং, তোমার মাথায় এই আইডিয়া আসার কথা নয়) গোছের।

ও-এটা তত্ত্বেই সম্ভব, বাস্তবে না। বাস্তববাদী হও, ছেলে। দেখ, কীভাবে ওগুলো ট্যাঙ্কে ভরবে?

ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে আগেই কথা হয়েছে আমার। জ্বালামুখের পঞ্চাশ মিটারের মধ্যে শিপ নিয়ে যাওয়া তেমন বিপজ্জনক নয়। তারপর একটা লাইন টেনে নিব ওল্ড ফেইথফুলের দিকে। আপনিতো জানেন, সেটা যথেষ্ট ভাল আচরণ করে।

কিন্তু প্রায় শূন্য বায়ুচাপে আমাদের পাম্প কাজ করবে না।

তাদের কোনো দরকার নেই। উষ্ণ প্রসবণটার নিজস্ব গতিই যা করার করবে। প্রতি সেকেন্ডে শত কিলোমিটারের চেয়েও বেশি স্পিড দিতে পারবে তখন।

সেটা শুধু ক্রিস্টাল বরফ আর বাস্প দিবে, তরল পানি নয়।

শিপে ঢুকতে ঢুকতে জুড়িয়ে যাবে সেগুলো।

“তুমি আসলেই এ নিয়ে ভেবেছ, তাই না? ক্যাপ্টেন ফুঁসছে কিন্তু বুঝতে দিতে চাচ্ছে না, এবং তা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু আমি শুধু ব্যাপারটা বিশ্বাস করি না। ব্যস। পানি কি যথেষ্ট খুঁটি? সেখানে কার্বনের গুঁড়া ভর্তি। তা নিয়ে কী করবে?

ফ্লয়েড না হেসে পারল না। ক্যাপ্টেন স্মিথ যেন গুলি করার পাঁয়তারা কষছে…

বড়গুলোকে হেঁকে তোলা সহজ। আর রিয়্যাকশনে ছোটগুলো কোনো প্রভাবই ফেলবে না। হাইড্রোজেন আইসোটোপের হার পৃথিবীর চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে। ফলে আরো বেশি থ্রাস্ট পাওয়া সম্ভব।

আপনার কলিগরা আইডিয়াটা নিয়ে কী ভাবছে? এখন সোজা লুসিফারের দিকে তেড়ে গেলে তাদের বাড়ি ফিরতে আরো বেশ কমাস লেগে যাবে…

আমি তাদের সাথে কোনো কথা বলিনি। কিন্তু এতো জীবন ঝুঁকিতে থাকার সময় এটা কোনো ব্যাপার নাকি? আমরা গ্যালাক্সিতে পৌঁছতে পারি সত্ত্বর দিন আগেই। সেভেন্টি ডেজ! একবার চিন্তা করুন, এই সময়ে ইউরোপায় কী না হয়ে যেতে পারে!

আমার সময়জ্ঞান যথেষ্ট টনটনা আছে এখনো। হাত নাড়ল ক্যাপ্টেন, ব্যাপারটা আমাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরাও এতো লম্বা যাত্রা করতে চাই না।

এখন ফ্লয়েড ভাবল, আমার ভাবনা সেও জেনে যেতে পারে, তারচে একটু কৌশলী হওয়া ভাল…

মাত্র বাড়তি দু সপ্তা! ভাবতে অবাক লাগছে, আমাদের মানসিকতা এতো সংকীর্ণ হয়ে গেল কীভাবে! আপনি আমাদের অত্যন্ত ভালভাবে খাওয়াচ্ছেন। আমাদের কেউ কি হপ্তা দুয়েকের জন্য খাবার চুলচেরা করে খেতে রাজি আছে?

ক্যাপ্টেন কোনোমতে একটা বরফ-জমাট হাসি যোগাড় করল মুখ জুড়ে।

কথাটা উইলিস আর মাইকেলোভিচকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। কিন্তু আমার ধারণা পুরো আইডিয়াটাই উদ্ভট।

যাই হোক, অন্তত মালিকপক্ষের হাতে ছেড়ে দিন ব্যাপারটা। আমি স্যার লরেন্সের সাথে কথা বলতে চাই।

আমি আপনাকে বাঁধা দিতে পারিনা। অবশ্যই। ক্যাপ্টেন স্মিথ এমন এক সুরে বলল, যেন পারলে সে বেশ খুশিই হয়, কিন্তু আমি ঠিকই জানি তিনি কী বলবেন।

ক্যাপ্টেন স্মিথের কথা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।

.

স্যার লরেন্স ত্রিশ বছর ধরে বাজি জিতে জিতেও খুশি নয়, বর্তমান বিশ্ববাজারে তার অবস্থান যথেষ্ট নয় যেন। বাজি সে সবখানেই ধরে। হং হং রেসকোর্সে তাই তার নিয়মিত যাতায়াত। কিন্তু মানুষের সাধারণ মানবিকতার কারণে সরকার রেসকোর্সটা বন্ধ করে দিয়েছে। কী নিষ্ঠুর খেলা! যখন খেলাটা খেলার উপায় ছিল তখন টাকা ছিল না, আর বর্তমানে বিশ্বের সবচে ধনী লোকটার এ খেলা খেলার ইচ্ছা থাকলেও কোনো উপায় বাকী নেই। অন্য পথে বাজি জিতে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপনের উপায় আছে এখনো।

আর তারচে ভাল কেই বা জানে, তার পুরো ক্যারিয়ারটাই এক জুয়া। সে সব সময় নিষ্ঠুর হাতে বিরূপ পরিবেশকে নিজের মতো গড়ে নিয়েছে, নিয়েছে লাখো ঝুঁকি এবং সবশেষে, সবচে দক্ষ লোকগুলোকে সবচে দামী উপদেশের জন্য সবচে বেশি মূল্য দিয়েছে। সে তারপরই কাজ করত, এবং তাদের কথা ভুল হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়ার সাথে সাথে আরো নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হতো; তার পরও, পুরো জীবনটাই এক জুয়া।

এখন, হেউড ফ্লয়েডের কাছ থেকে পাওয়া মেমোরেন্ডাম পড়তে পড়তে, হঠাৎ যৌবনের সেই ঘোড়াগুলোর শেষচক্র পূর্ণ করার কথা মনে পড়ে যায়। কী উত্তেজনা, কী উত্তেজনা চারদিকে! এটাও এক জুয়া, সম্ভবত তার জীবন এবং ক্যারিয়ারের শেষ এবং সবচে বড় বাজি, যদিও সে কখনো তার বোর্ড অফ ডিরেক্টরসকে কোনো আদেশ দিতে ভয় পায় না…

বিল, তোমার কী মনে হয়?

তার ছেলে (স্থির এবং ভরসা করা যায় তার উপর। কিন্তু সেই ঝলক নেই-ঝলকটা অবশ্য প্রয়োজন পড়বে না আরো কয়েক প্রজন্মের মধ্যে) প্রত্যাশিত জবাবই দিল ।

থিওরিটা কাগজে কলমে ভাল। এদিকে আমরা এরই মধ্যে একটা শিপ হারিয়ে বসেছি। অন্যটাকেও গাড্ডায় ঠেলে দেয়া কি ঠিক হবে?

শিপটা বৃহস্পতিতেমানে লুসিফারে যাচ্ছে।

হ্যাঁ, কিন্তু পৃথিবীর অর্বিটে একটা পূর্ণ চেক-আউটের পর। আর আপনি কি ভাবতেও পারেন কত ঝুঁকি নেয়া হবে একাজে? সে সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙে সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। এবং ফিরে আসবে। এজন্য আর যাই হোক, যত্ন দরকার।

এরচে অভদ্রভাবে তার পক্ষে বাবাকে কিছু বলা সম্ভব নয়।

বেশ শান্ত সুরেই স্যার লরেন্স জবাব দেয়, একটা পরীক্ষা করলে দোষ কী? অবশ্য ক্যাপ্টেন স্মিথ দাঁত-নখ দিয়ে যুদ্ধ করছে। সম্ভবত পদত্যাগ করবে। যাই হোক, লয়েডস এর সাথে কথাবার্তা সেরে ফেল। আমরা গ্যালাক্সি দাবী করতেই পারি।

সে বলতে পারতো, অন্য শিপটাকেও সেদিকে ছুঁড়ে দিচ্ছি, আর্থিক দিক দিয়ে হিসাব করলে লাভই হবার কথা।

ক্যাপ্টেন স্মিথের ব্যাপারে সে বেশ দুঃখিত। অন্যদিকে ল্যাপ্লাস পচছে ইউরোপায়। আর কে আছে এখন পৃথিবীতে এতো দক্ষ?

৩৩. গর্তের শেষ

কলেজ ছাড়ার পর সবচে বিশ্রী কাজ এটা, কিন্তু এ ছাড়া আর কী করার আছে আমাদের?

উম্মা ঝাড়ল চিফ ইঞ্জিনিয়ার।

পঞ্চাশ মিটার লম্বা পাইপলাইনের ভিতর দিয়ে এখন ওল্ড ফেইথফুলের বাষ্প আর বরফকণার সাথে কার্বনের সূক্ষ্ম আকৃতি এগিয়ে যাবে। সূর্য ওঠার সাথে সাথে উষ্ণ প্রসবণটার ভিতরে চঞ্চলতা বেড়ে যাবে অনেকখানি।

অবজার্ভেশন লাউঞ্জ থেকে দেখতে দেখতে হেউড ফ্লয়েড ভাবল, চব্বিশটা ঘন্টা কাটতে না কাটতেই এতোকিছু হয়ে গেল কীভাবে! প্রথমেই শিপের সবাই দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল, একদল ক্যাপ্টেনের পক্ষে, অন্যদল ফ্লয়েডের। এম্নিতে কোনো

প্রকাশ্য বিতর্ক হয়নি, এমনকি শীতল হলেও সৌজন্যমূলক কথাবার্তাও চলেছে, সামনে পড়ে গেলে। কিন্তু আড়ালে আবডালে কেউ কেউ তাকে সুইসাইড ফ্লয়েড নামেও ডেকেছে। হাজার হলেও, জীবনভর যে সম্মান নিয়ে চলেছে সে, সেটার সাথে মানাচ্ছে না ব্যাপারটা।

এখনো কেউ ফ্লয়েড-জলসন চলনের কোনো ভুল খুঁজে পায়নি। (নামটাও অন্যায়: সে হাজারবার বলেছে যে সমস্ত ক্রেডিট জলসনের; কিন্তু কে শোনে কার কথা! তারপর সহাস্যে মাইকেলসন বলল, তুমি কি দোষের ভাগ নিজের কাঁধে নিতে চাও না?)

বিশ মিনিটের মধ্যে প্রথম টেস্ট হয়ে যাবার কথা ওল্ড ফেইথফুলে সকাল হবার সাথে সাথেই। আর সাথে সাথেই যদি ক্যাপ্টেন স্মিথের কথামতো কাদামাটির বদলে বিশুদ্ধ পানিতে ট্যাঙ্ক ভরে উঠতে শুরু করে তাহলেই ইউরোপা যাবার পথ বেরিয়ে যাচ্ছে না।

সমস্যাটা ছোট হলেও চিন্তা করতে হবে। অতিথিদের ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে। তারা সবাই মাটির সেরা সন্তান, দুসপ্তাহের মধ্যে বাড়ি ফেরার কথা ছিল, সেখানে তাদেরকে সৌর জগতের একদিক থেকে আরেকদিকে, প্রায় অর্ধেক এলাকা ঘুরিয়ে একটা নিষিদ্ধ অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে (যেখানে উদ্ধার পাওয়াও এক প্রশ্ন) আবার ফিরিয়ে আনতে হবে উদ্ধারপ্রাপ্ত লোকদের সাথে খাবার এবং সুবিধা শেয়ার করিয়ে। তাদের বয়সটাও বিবেচ্য।

উইলিস বেশ বিরক্ত হয়েছে, তার সব শিডিউল এলোমেলো হয়ে যাবে। সে উড়ে বেড়াতে বেড়াতে আইনের আশ্রয়ে যাবার কথা বলছিল বেশ গরম সুরে, কিন্তু কেউ দাম দেয়নি।

টগবগ করে ফুটছে গ্রিনবার্গ। অনেক বছর পর, আবার সে সত্যিকার স্পেস অভিযানে নামতে পারবে। অন্যদিকে মাইকেলোভিচ তার বেশিরভাগ সময় নষ্ট করে গেছে সাউন্ডপ্রুফ অফিসে বসে বসে কম্পোজ করার কাজে, সেও বেশ উৎফুল্প। তার বিশ্বাস, এই পরিবর্তনটা জীবনে নূতন গতি এনে দেবে, সৃষ্টিশীলতা আসবে আবার ফিরে।

ম্যাগি পুরোপুরি দার্শনিকতায় ভরপুর: যদি কাজটা অনেক জীবন বাঁচায়, তো উইলিসের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বাকীটা শেষ করে সে, কী করে কোনো মানুষ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে?

ইভা মারলিনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যভাবে এসেছে। ফ্লয়েড সময় নিয়ে সবকিছু বুঝিয়েছে তাকে, তারপর আবিষ্কার করেছে যে সেও পরিস্থিতি বুঝতে পারে বেশ সহজেই। অবাক হয়ে সে লক্ষ্য করে অন্যরা যে প্রশ্ন তোলেনি তাই ইভার মনে উঁকি দিয়েছে সবার আগে, যদি ইউরোপানরা আমাদের ল্যান্ড করতে দিতে না চায়? যদি

তারা উদ্ধার করতে দিতে না চায় তখন?

ফ্লয়েড এখনো তাকে ঠিক রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে মেনে নিতে পারছে না। সে দুর্বোধ্য জগত থেকে কখন বেরিয়ে আসবে কে জানে! তার অন্যরকম থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।

বিশ্বাস কর, আমি এ নিয়ে কাজ করছি এখনো, ইভা।

তার কথা সত্যি। সে কখনো ইভা মারলিনের সাথে মিথ্যা কথা বলতে পারবে না।

.

উষ্ণ প্রসবণ থেকে বাস্পের প্রথম ছোঁয়া বেরিয়ে আসে একটু একটু করে, তারপর একেবারে হঠাৎ উপরের সবটুকু আকাশের সারা বাঁধা এড়িয়ে তীরবেগে উঠে যেতে থাকে উপরদিকেই।

আবারও ওল্ড ফেইথফুলের মুখ খুলে গেছে। আকাশের দিকে তুষারশুভ্র এক স্তম্ভ উঠে গেছে বিনা বাঁধায়। যে কারো পার্থিব দৃষ্টি আশা করবে প্রসবণটার উপরপ্রান্ত ব্যাঙের ছাতার মতো বেঁকে গিয়ে ফিরে আসবে মাটিতে, কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। খুব কমই ছড়াচ্ছে আশপাশে, এবং উঠতে উঠতে মিশে যাচ্ছে এর বাড়তে থাকা বিশাল বাষ্প-খামের সাথে। ফ্লয়েড দেখল পাইপলাইনটা ঋকি খাচ্ছে, ভিতরে তরল।

দশ মিনিট পর ব্রিজের উপর একটা যুদ্ধসভা বসল। ক্যাপ্টেন স্মিথ সামান্য মাথা নুইয়ে ফ্লয়েডের উপস্থিতি স্বীকার করল। তার সারিন্দাই সব কথা বলল, একটু অপ্রস্তুত হয়ে।

যাই হোক, কাজ করছে চমৎকার। বিশঘণ্টা এ হারে পানি ভরলেই আমাদের সবটা পূর্ণ হয়ে যাবে। বাইরে গিয়ে পাইপটা একটু শক্ত করে নিতে হবে, এই যা।

ময়লার কী হবে? প্রশ্ন তুলল কেউ একজন।

ফাস্ট অফিসারের হাতে একটা স্বচ্ছ স্কুইজ বা ধরা, সেটায় স্বচ্ছ পানি ভরা।

কয়েক মাইক্রন পর্যন্ত যা ছিল সবই ছেকে নিয়েছে ফিল্টারগুলো। নিরাপত্তার খাতিরে আমরা কাজটা একাধিকবার করব। এক ট্যাঙ্ক থেকে আরেকটায় পানি নিয়ে গেলে ফিল্টারিংয়ের কাজ আরো সূক্ষ্মভাবে হয়। মঙ্গল ছেড়ে যাবার আগে কোনো সুইমিং পুল নয়।

এতোক্ষণে একটু হাসির আওয়াজ উঠল আশপাশ থেকে। ফলে ক্যাপ্টেনও সহজ হয়ে এল একটু। হাসিটা দরকার ছিল খুব।

হ্যালির পানিতে কোনো সমস্যা নেই তা বোঝার জন্য একটু সময়ের জন্য ইঞ্জিন চালানো হবে। যদি বিন্দুমাত্র সমস্যা দেখা দেয় তো নির্দ্বিধায় চাঁদে ফিরে গিয়ে সহজ সরল এ্যারিস্টার্কাসের পানিই ব্যবহার করব।

এখানেও সেই পার্টি নিরবতা জেঁকে বসেছে, যখন সবাই আশা করে অন্য কেউ কথা বলবে।

আর না পেরে ক্যাপ্টেন স্মিথ অস্বস্তিকর পরিবেশটা ভেঙে দিল।

আপনারা সবাই জানেন আমি পুরো আইডিয়াটার উপর খুব নাখোশ। এমনকি তারপর হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। সবাই জানে যে সে এই নাখোশির প্রমাণ– স্বরূপ স্যার লরেন্সের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছিল।

কিন্তু গত কয়েক ঘণ্টায় যেন কয়েক রাত কেটে গেল। মালিকপক্ষ রাজি, যদি

কোনো মৌলিক সমস্যা না থাকে। আর সবচে অবাক ব্যাপার, ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল শুধু অনুমোদন দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং অনুরোধ করেছে যেন কাজটা আমরা করি । এমনকি যে কোনো মূল্যে কাজটা করার কথাও আছে সেখানে। হ্যাঁ, আমার মতো আপনাদের অনুমানের ক্ষমতাও সমান….

কিন্তু এখনো আমার একটা দুঃখ রয়ে গেল।

সে একটু তাকায় পানির বাটার দিকে। সেটা এখন হেউড ফ্লয়েডের হাতে ধরা। সে জিনিসটাকে আলোর দিকে ঝাঁকাচ্ছিল।

আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার, কোনো মরার কেমিস্ট নই। দেখতে তো বেশ পরিষ্কার- কিন্তু যদি ওটা কোনো বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় লাইনিংয়ের জন্য?

ফ্লয়েড বোঝে না কেন লোকটা এমন আচরণ করে যা তার সাথে মিলছে না। মিলছে না তার চরিত্রের সাথে । হয়তো হাজার তর্কে সে ক্লান্ত হয়ে রণেভঙ্গ দিয়ে কাজে ফিরতে চাচ্ছে। নয়তো তার মন-মস্তিষ্কে বসে গেছে যে ক্যাপ্টেনের অবশ্যই আচার-আচরণে, মেরুদণ্ডে বেশ শক্তপোক্ত হওয়া উচিত।

সাথে সাথেই সে হ্যালির পানি থেকে খানিকটা, প্রায় বিশ সিসি তুলে নিয়ে গলায় ঢেলে দিল।

সবার বিস্মিত চোখের সামনে বলল, এই আপনার জবাব, ক্যাপ্টেন।

.

এটা আমার জীবনে দেখা সবচে বোকামিপূর্ণ প্রদর্শনী। আধঘণ্টা পর ডাক্তার বলল, আপনি কি জানেন না যে এই পানিতে সায়ানাইড, সায়ানোজেন আর কী কী আল্লা মালুম টাইপের যৌগ থাকার কথা?

অবশ্যই আমি জানি, বিস্তৃত হল ফ্রয়েডের হাসি, জানি বলেই খেয়েছি। লাখ লাখ ভাগে একভাগ সায়ানাইড ধরনের কম্পাউন্ড আছে সেখানে। কেমিক্যাল অ্যানালাইসিসটা আগেই দেখে বসে আছি। তবে একটা চমক আমি পেয়েছি।

কী চমক? আরো বেশি বিস্তৃত হল এবার বৃদ্ধ সেলিব্রিটির মুখের হাসি, একবার পানিটা পৃথিবীতে নিয়ে যান না; তারপর হ্যালির পানি মানুষ একনামে কিনবে।

৩৪. কার ওয়াশ

এবার যাবার কথা দেয়ার পর পরই পুরো ইউনিভার্সের চেহারা বদলে গেল পুরোপুরি। আর কেউ কথা তোলেনি তারপর। এরচে খারাপ পরিস্থিতি যাতে না হয় সে আশাই সবার। সাধ্যমতো কাজ করছে পুরো স্পেসশিপ। পরের দু হ্যালি দিবস (পৃথিবীতে শত ঘণ্টা কেটে যাবে এটুকু সময়ে।) অনেকেই ইচ্ছামতো ঘুমিয়ে নিল।

প্রথমবার, সারাদিন বেশ সাবধানে ওল্ড ফেইথফুলের পানি সংগ্রহ করা হলেও পরে আর কোনো সন্দেহ থাকেনি। হাজার টনের চেয়েও বেশি পানি তোলা হয়েছে শিপের গায়ে। বাকীটা ভরার জন্য পরদিনই যথেষ্ট।

ফ্লয়েড যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে ক্যাপ্টেনকে। বেচারা দেখা হলেই হাজারটা ফ্যাকড়া তোলার ধান্ধা করে। নতুন অর্বিট নিয়েও কথা তুলতে পারে। যাক, বাঁচা গেল, অর্বিটটা তাদের তৈরি নয়, বরং পৃথিবী থেকেই নিশ্চিত করা হয়েছে।

প্রশংসা জুটছে দেদার। এবং প্রত্যাশিত সময়ের চেয়েও কম লাগবে কাজ শেষ হতে। প্রাথমিকভাবে জলসন যে সময় এবং কক্ষপথ দেখিয়েছিল তারচে সুন্দর, সহজ এবং নিরাপদ ব্যবস্থার অনুমতি দিয়েছে পৃথিবীর কন্ট্রোল। সবাই ব্যাপারটায় দারুণ খুশি।

আচ্ছা, ঠিক আছে, সবাই না। প্রায় সবাই।

পথিবীতে, দ্রুত ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হ্যান্ডস অব হ্যালি সোসাইটি পৃথিবীজুড়ে মাতম তুলল, এর সদস্যরা (সব মিলিয়ে মাত্র ২৩৬ জন, কিন্তু তারা জানে কীভাবে নিজেদের ঢোল নিজেদের দিয়ে পেটাতে হয়।) চিরে ফেলল আকাশ, না, এই প্রাকৃতিক জিনিসটা থেকে আর যাই হোক, ভর ছিনিয়ে নেয়া যাবে না। এমন বিজ্ঞান থাকার চেয়ে না থাকা ভাল। হ্যালি সৌর জগতের মুক্তা, এর এমন ক্ষতি সহনীয় নয়। হয়তো এ ভরটা একদিন হ্যালি ছড়িয়ে দিত কালো মহাকাশে, তাই বলে তার ধ্বংস ত্বরান্বিত করার কোনো অধিকার কারো নেই।

একটা অ্যাটিচ্যুড কন্ট্রোল থ্রাস্টার দিয়ে অতি সাবধানে ক্যাপ্টেন স্মিথ পরীক্ষাটা চালালো। এটা নষ্ট হয়ে গেলে এ ছাড়াও আপাতত শিপের চলবে। আর পৃথিবী থেকে আনা ফিরে যাবার মতো পানি তো আছেই। জেটের আচার ব্যবহার অতি ভদ্র, যেন কিছুই হয়নি, যেন চাঁদের কোনো খনি থেকে পানি তুলে ভরা হয়েছে এর ভিতরে।

এবার সে আসল থ্রাস্ট ড্রাইভটাকে পরীক্ষার ময়দানে তীর-ধনুকে সাজিয়ে পাঠালো। ক্ষতি যদি হয়েই যায়, চলাচল বন্ধ হবে না। এটাই আসল গতি দেয়, ঠিক, কিন্তু চারপাশের চার অ্যাটিচ্যুড কন্ট্রোল জেটই দিক ঠিক করে। এটা নষ্ট হলে চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে না, গতিটা শুধু আশিভাগ কমে যাবে।

এখানেও তাবৎ ইঞ্জিন বহাল তবিয়তে থাকল। এবং সবাই ভাল ব্যবহার করা শুরু করল হেউড ফ্লয়েডের সাথে, এমনকি সেকেন্ড অফিসার জলসন আর মানুষের চক্ষুশূল নয়।

তারপর, পরের ঘণ্টাগুলোয় অভিযানের পরিকল্পনা চলল। আর কিছুক্ষণ, তারপরই ওল্ড ফেইথফুল হারিয়ে যাবে মানুষের চোখের সামনে থেকে। পরের অভিযানে এটা থাকে না থাকে আল্লা মালুম। কে জানে, ভাবল ফ্লয়েড, হয়তো ১৯১০ সালের ছবিগুলোতেও এই প্রসবণটাকে দেখা যাবে।)।

আগেকার দিনের মতো কোনো কাউন্ট ডাউনের ঝক্কি ঝামেলা নেই। সব ঠিকঠাক চলছে বোঝার সাথে সাথেই ক্যাপ্টেন মাত্র পাঁচ টনের ধাক্কা দিয়ে শিপকে ভদ্রভাবে ধূমকেতু থেকে তুলে দিল।

ত্বরণ স্বাভাবিক হলেও প্রযুক্তিটা মানুষকে বিবশ করে রাখে। এই বাইরে থেকে না দেখতে পাওয়া জেটগুলো অসাধারণ। উচ্চ আয়োনিত হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন বেরিয়ে যায় নরকের তাপ গায়ে নিয়ে। শত শত কিলোমিটার দূরে সরে গিয়ে আস্তে আস্তে তাপ থিতিয়ে আসে, তারপর রাসায়নিকভাবে যুক্ত হওয়ার মতো ঠাণ্ডা হয়। তারও অনেক অনেক পরে তাপমাত্রা পরিবেশের সাথে মানিয়ে যায়। এবং সেই জ্বলন্ত পরমাণু বা আয়নগুলোকে দেখা যায় না কারণ দেখার মতো বর্ণালী নেই সে আলোতে।

কিন্তু এখন ইউনিভার্স এমন এক আলো পেছনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে যেদিকে তাকানো যায় না তখন মানুষ অবাক না হয়ে কি আর পারে! যেন আগুনের এক কঠিন স্তম্ভ। যেখানে এটা পাথরকে স্পর্শ করছে সেখানেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রস্তরগাত্র! চলে যাবার আগে মহাজাগতিক স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে ইউনিভার্স, হ্যালির ধূমকেতুর বুকে।

সবাই স্তম্ভিত। ফ্লয়েড অপ্রতিরোধ্য ব্যাখ্যার আশায় বসে আছে। উইলিসকে বোঝানো হচ্ছে যে এমনটা মাঝেমধ্যেই ঘটতে পারে।

কার্বন। সে কোনো কথাই মানবে না, কার্বনের হার বেশি। তাই এমনভাবে জ্বলছে। মোমের আলোর মতোই, শুধু একটু বেশি গরম।

এই, সামান্য আর কী! যোগ করে ফ্লয়েড।

“আমরা জ্বলে পুড়ে মরতে যাচ্ছি না-তুমি যদি কথাটাকে ক্ষমা করো-(ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না যেন ফ্লয়েড)- পিওর ওয়াটার-অনেক সাবধানে ফিল্টারিং করার পরও হাজারটা মাইক্রনিক গুড়ো রয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কলয়েডিয় কার্বন থেকেই যায়। সাথে এমন কিছু যৌগ থাকে যা শুধু ডিস্টিল্ড ওয়াটারেই থাকে না।

কাজ হয়েছে দুর্দান্ত, কিন্তু আমি একটু হতাশ হলাম। বলছে গ্রিনবার্গ, এই তেজস্ক্রিয়তা কি ইঞ্জিন আর শিপের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না?

দারুণ প্রশ্ন-এবং বেশ চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে দিল চারপাশে। ফ্লয়েড আশা করেছিল উইলিসই জবাব দেবে কিন্তু চতুরতার সাথে সে বলটা তার দিকেই ফিরিয়ে দিল।

জবাবটা ড, ফ্লয়েড দিলেই ভাল হয়। হাজার হলেও আইডিয়াটা তার।

জলসনের, প্লিজ। তোলা পয়েন্টটা বেশ শক্ত, বলতেই হয়। ফুল গ্রাস্টে চলার সময় সমস্ত পুচ্ছটা হাজার কিলোমিটার দূরে থাকবে। এ নিয়ে চিন্তার কিছুতে দেখছি না।

শিপ এখন নিউক্লিয়াসের কিলোমিটার দুয়েক দূরে ভেসে আছে। নিচের-অথবা দূরের সেই উষ্ণপ্রস্রবণ এর উঠে এসে সামান্য প্রশস্ত হয়ে যায় দেখে তার লেক জেনেভার কথা মনে পড়ে যায় হঠাৎ। সে পঞ্চাশ বছর ধরে সেগুলো দেখছে না। কে জানে এখনো আছে কিনা সেখানে।

ক্যাপ্টেন স্মিথ এখনো পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে, সামান্য প্রাস্টে ডান-বাম করে দেখছে কোনো সমস্যা আছে কিনা। একবার এক্স আরেকবার ওয়াই অক্ষ ধরে এগুচ্ছে। আর কোনো সমস্যা না দেখা দেয়ায় কথা বলে উঠল এবার সে।

মিশন টাইম জিরো এখন থেকে দশ মিনিট দূরে। ০.১ জি থাকবে প্রথম পঞ্চাশ ঘণ্টা, তারপর ঘোরার আগ পর্যন্ত ২।

কথাটা হজম করার সুযোগ দিল সে সবাইকে। এর আগে কোনো শিপ এতোক্ষণ ধরে এতে ত্বরণ সয়নি। যদি ইউনিভার্স সয়ে যেতে পারে তো সে প্রথম শিপ হিসাবে নাম লেখাবে ইতিহাসের বুকে।

শিপ উপরের দিকে মুখ করে (শুনতে বেখাপ্পা লাগে) সোজা বরফ-বাষ্পের স্তম্ভের দিকে উঠে যাচ্ছে।

কী করছে লোকটা? অস্থির হয়ে প্রশ্ন তুলল মাইকেলোভিচ।

নিশ্চই ক্যাপ্টেন জানে এ প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে তাকে। তাই সে নিজে থেকেই কাঠখোট্টা জবানিতে ব্যাখ্যা করল।

ছেড়ে যাবার আগে এই একটু চেখে নেয়া। আমি ঠিকই জানি, কী করছি না করছি। নাম্বার টু ও আমার সাথে একমত। আপনারা কী বলেন?

ইয়েস, স্যার-যদিও প্রথমদিকে মনে হল আপনি ঠাট্টা করছেন…

ব্রিজে কী হচ্ছে? হচ্ছেটা কী? প্রশ্ন ঝুলে আছে উইলিসের কণ্ঠে।

এখন শিপ ধীর একটা কাজ শুরু করল। প্রস্রবণটার কাছাকাছি চলে এসেছে তারা, আরো বেশি করে জেনেভা হ্রদের কথা মনে পড়ছে ফ্লয়েডের।

নিশ্চই সে আমাদেরকে এটার ভিতরে নিতে চাচ্ছে না…

কিন্তু সে তাই চাচ্ছে। ফোমের উঠতি স্তম্ভের গায়ে লেগে গিয়েই ইউনিভার্স ছোটখাট একটা ঝাঁকি খেল। তারপর ভিডিও মনিটর আর বাকী সবকিছুতে একটা অস্পষ্ট সাদাটে আলো ছাড়া অন্য কিছুই দেখা গেল না।

পুরো কাজের পেছনে খুব বেশি হলে দশ সেকেন্ড ব্যয় হল, তারপরই উঠে এল * অনেকটা উপরে এবং বেরিয়ে এল অন্যপাশে। ইতস্তত বোধ করছে সবাই, অফিসার অন ডিউটিও চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে চারদিকে। বেচারার ভাব, যাত্রীরা প্রশ্ন তুললে কী জবাব দেবে!

এবং অবশেষে শব্দ ভেসে এল, ক্যাপ্টেনের গলা থেকেই, আমরা এখন যেতে প্রস্তুত। আবার একটা ঝকঝকে তকতকে শিপে করে যাত্রা হোক শুরু।

.

পরের আধঘণ্টা পৃথিবী আর চাঁদে উথাল পাথাল চলল। দশ সহস্রাধিক অপেশাদার ধূমকেতু দর্শক হা-পিত্যেশ করে মরল! হ্যালির উজ্জ্বলতা বেড়ে গেছে অনেকগুণ। কমেট ওয়াচ নেটওয়ার্ক অতি ভারে পুরোপুরি ব্লক হয়ে গেল সাথে সাথে। এবং ভয়াবহ রূপ নিল পেশাদার অ্যাট্রোনোমাররা।

সাধারণ মানুষ ব্যাপারটাকে দারুণভাবে নিচ্ছে। আর কটা দিন কাটুক না, তারপর ভোরের দিকে আরো বড় চমক অপেক্ষা করছে।

শিপটা, প্রতি ঘণ্টায় যেটা দশ হাজার কিলোমিটারের চেয়েও অনেক বেশি গতি বাড়াচ্ছে, সেটা এখন শুক্রের এলাকায়। সে সূর্যেরও বেশ কাছ দিয়ে সৎ করে বেরিয়ে যাবে, এবং তখন, তার গতি থাকবে যে কোনো পার্থিব-অপার্থিব বস্তুর চেয়ে অনেক অনেক বেশি। গন্তব্য লুসিফারের সাম্রাজ্য।

সূর্য ছাড়িয়ে পৃথিবীর কাছাকাছি দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় পৃথিবীর মানুষ খালি চোখেই আরো একটা মজার ব্যাপার দেখতে পেল। অসম্ভব গতিতে একটা বিশাল তারা এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে, খুব কাছ দিয়ে, এবং তার লেজটা জ্বলজ্বলে, হাজার কিলোমিটার লম্বা।

সৃষ্টি জগতের যে কোনো বস্তুর চেয়ে বেশি (এমনকি সূর্যের বা চাঁদের দিকেও সারা পৃথিবীতে এতো মানুষ একই সময়ে তাকিয়ে থাকেনি কোনোদিন, গ্রহণের সময়ও না।) মানুষের চোখে একেবারে একই সময়ে ধরা পড়ার নতুন রেকর্ড গড়ল এই মহাকাশযান, ইউনিভার্স।

৩৫. দিকচিহ্নহীন

সিস্টার শিপ ইউনিভার্স আসছে। এমন এক গতিতে এমন এক অভাবনীয় পন্থায় এমন এক সাহসিকতা দেখিয়ে আসছে যে কথা মানুষ স্বপ্নেও দেখতে সাহস পায় না। তারা আসছে অনেক অনেক আগে। এর যে কী প্রভাব পড়ল গ্যালাক্সির উপর তার কোনো তুলনা নেই, মানুষজন যেন অজান্তেই নেশার চরম শিহরন অনুভব করছে, যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার।

তারা যে অজানা সাগরের বুকে অচেনা অপার্থিব জলদানব পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছে, তাও নিষিদ্ধ জগতে, সেকথা যেন সবাই ভুলে গেছে।

একই কথা জানোদের ক্ষেত্রেও বলা চলে, তারা আশপাশে আসে, এমনকি সেই হাঙরেরাও আসে, কিন্তু যথেষ্ট দূরত্ব রেখে চলে। এমনকি ময়লা ফেলার সময়ও কাছেধারে ঘেঁষে না। অবাক ব্যাপার, দেখেশুনে মনে হয় তারাও যেন যোগাযোগের দারুণ একটা পদ্ধতি মেনে চলে। এখন মনে হচ্ছে তারা হাঙরের চেয়ে ডলফিনদের সাথেই বেশি আত্মীয়তা তাদের।

এবং ছোট্ট মাছেদের বেশ বড় বড় সমাজ দেখতে পাওয়া যায় যার কোনোটাই কোনোকালে পৃথিবীর মেছো হাটগুলোয় পাওয়া যায়নি।

হাজার যত্নআত্তি করে এক অফিসার একটা ধরতে পারল হুক দিয়ে। ভিতরে আনতে নিলে ক্যাপ্টেন খুনখারাবি বাঁধিয়ে দিবে। কী দরকার বাবা! তারচে বেশ কয়েকটা ছবি নিয়ে সাগরে নামিয়ে দিলেই হল।

এবং এ কাজের জন্য খেলোয়াড়কে সাথে সাথেই মূল্য দিতে হয়েছিল। তার প্রেশার স্পেসস্যুটে মাছটার গা লেগে যায় সামান্য সময়ের জন্য। তারপর শিপে প্রবেশ করেই যত বিপত্তি। পঁচা ডিমের গন্ধ এল তার গা থেকে। যতই বলা হোক, কেউ মানল না, বিশ্রী ব্যাপারটা নিয়ে কথা চালাচালি চলতেই থাকবে এবার। গায়ের গন্ধ ঠিকই যায় মনের গন্ধ যায় না। হায়রে অ্যালিয়েন বায়োকেমিস্ট্রি!

তারপরই বেঁধে ফেলা হল বিজ্ঞানীদলকে, আপনারা প্রকৃতিবিদ নন, ভূগোলবিদ। তাই প্রকৃতিবিদ্যা নিয়ে গবেষণার সময় দূর থেকে ডাটা কালেক্ট এবং রেকর্ড করতে পারবেন, প্রকৃতিকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে । কেউ ফরমালিন আনার কথা ভাবেনি। হাজার হলেও এখানে নামতে হবে তা কার মাথায় ছিল? রোজি আনলে আলাদা কথা।

সামনে শিপ সবুজ সবুজ শ্যাওলা জাতীয় দলের মুখোমুখি হল। জিনিসগুলো প্রায় দশফুটি, ডিম্বাকার এবং প্রায় সমান সমান। বিনা বাধায়ন জাহাজ সেগুলোকে এড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনে। কোনো ধরনের কলোনিয়াল উদ্ভিদ হবে হয়তো।

তারপর এক সকালে অফিসার ইন ডিউটি সমুদ্রের বুক থেকে পেরিস্কোপ জেগে উঠতে দেখে যারপরনাই অবাক হল। একটু পর পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠেই সে বর্ণনা করেছিল, জিনিসটা নাকি অনেকটা মরা গরুর চোখের মতো। ঠাণ্ডা, নীল। সেটা তাকে বেশ অনাগ্রহ আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সাথে বেশ কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে ভুস করে আবার সাগরে ডুব দিল।

এখানে কোনোকিছুই দ্রুত চলে না। ব্যাখ্যাটা বেশ সরল, পৃথিবীর ভারী অক্সিজেন স্তর সব প্রাণীকেই জন্ম থেকে ও-টু বিস্ফোরণে শক্তির জোগান দিয়ে আসছে। এখানে হাল্কা বায়ুমণ্ডল এবং তারচেও পল্কা অক্সিজেন গ্যাসের হার থাকায় কেউ জুতসই প্রসেসিং চালাতে পারে না, ফলে দ্রুত কার্যক্ষম হয় না দেহঘড়ি।

শুধু হাঙর গুলোর মধ্যে বেশ ব্যতিক্রম দেখা গেল। প্রথম পরিচয়ে তেমন গতি দেখাতে না পারলেও শেষবেলায় তার শক্তিমত্তার একটু দেখতে পেয়েছিল সবাই।

স্পেসস্যুটে নিজেদের যারা জড়িয়ে রাখছে তাদের জন্য এটা বেশ সুখবর। এখানে চাইলেও কেউ তাদের ধরে খেতে পারছে না। আপাতত।

.

ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস সমস্ত শিপের ভার পার্লারের হাতে ছেড়ে দিয়ে মৌজেই আছে বলা চলে। এই দূর সমুদ্রে, সাগর-মাটির সন্ধিক্ষণের কাছাকাছি চলে এসে শিপ-হিসাব রক্ষককে পুরো শিপের কর্ণধার করে দেয়ার মতো কাজ করার মধ্যে গভীর একটা দার্শনিকতাও যেন আছে।

অবশ্য মি. লির করার মতো তেমন কোনো কাজ নেই। গ্যালাক্সি একটা স্থিত গতিতে ঢিমে তালে এগিয়ে চলছে; এক তৃতীয়াংশ মুখ বাইরে ভাসিয়ে রেখে, পাঁচ নটের মৃদুমন্দ গতিতে, সমান্তরালে। দু চারটা ছিদ্র পেয়ে সাথে সাথে ঠিক করা হয়েছে আগেই, মূল খোল ভালই আছে, একেবারে অটুট।

বেশিরভাগ নেভিগেশন ইকুইপমেন্ট ভালই আছে, যদিও তারা একেবারে অকর্মার টেকি। গ্যানিমিড় প্রতি ঘণ্টার বিকন দিয়ে গ্যালাক্সির সাথে যোগাযোগ রাখছে। এ গতিতে চলতে থাকলে তিন দিনের মধ্যে একটা নতুন দ্বীপে চলে যেতে পারবে তারা।

বড় দ্বীপটায় ঠেকতে না পারলে বিপদ। শিপ সোজা ভেসে যাবে মধ্য ইউরোপার দিকে, বা মধ্য দিবসের দিকে-যেখানে সর্বক্ষণ লুসিফারের রাক্ষস-চোখ কুটিল দৃষ্টি হেনে থাকে। তখন বড় সমস্যায় পড়তে হবে। অ্যাক্টিং ক্যাপ্টেন লির চিন্তার অনেকাংশ জুড়ে এ ভাবনাটা থাকে।

পালে তেমন কোনো ফারাক পড়বে না। টানানো সম্ভব কিনা তাও ভাবার বিষয়। এরই মধ্যে নোঙর বানানোর কাজ শেষ, পাঁচশো মিটার গভীরেও বসিয়ে দেয়া হয়েছে, লুকানো জলস্রোতের খোঁজে। তাও বিন্দুমাত্র কাজ দেয়নি। না পেয়েছে তলা, না ভিন্ন স্রোতের অস্তিত্ব। এখন তার একটা কথা ভাবা ছাড়া কোনো উপায় থাকছে না, আমিতো এর আগে কখনো দুঃস্বপ্নে স্পেসশিপকে জাহাজ হিসেবে চালানোর ট্রেনিং নিইনি।

অবশ্য অতল হওয়ায় লাভও হয়েছে একটা, মাটির নিচে পানির নিচে সর্বক্ষণ ভূ-আকৃতি ঠিক করার যে কসরৎ চলছে তার কম্পন টের পেতে হচ্ছে না মোটেও। মাঝেমধ্যে নিচ থেকে উঠে আসা শকওয়েভে গ্যালাক্সি কেঁপে ওঠে, যেন বিশাল কোনো হাতুড়ির বাড়ি খেয়েছে। আর ঘণ্টা কয়েক পর ইউরোপার কোথাও না কোথাও প্রায় কয়েক ডজন মিটার উঁচু সুনামি আছড়ে পড়বে কোনো অচেনা সাগরতীরে। কিন্তু এখানে একটা জোর কাঁপন, ব্যস।

তারপরই দেখা গেল সামুদ্রিক ঘূর্ণি, সেইসাথে ঝড়। এতো বেশি ভয়াল যে ইচ্ছা করলে মুহূর্তেই গ্যালাক্সিকে টেনে নিতে পারে অতলে; কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন, সেগুলোও অনেক দূরে। তার পরও সেই ক্ষমতার দাপটে এখানেই শিপটা লাটুর পাক খেয়ে হেনস্থা হতে পারে।

এবং মাত্র একবার, পানি থেকে বিশাল এক বুদ্বুদ উঠল, মাত্র একশ মিটারের মতো দূরে। তারপর সবার মনে যা ছিল তা নির্লজ্জের মতো বলে বসল ডাক্তার, স্রষ্টার কী লীলাখেলা! আমরা ঐ আযাবের কোনো গন্ধই শুঁকতে পারব না। থ্যাঙ্কস গড!

.

দুনিয়া কী অদ্ভুত রীতিতে চলে! এখন, এই অকল্পনীয় রুটিনও গা সওয়া হয়ে গেছে। আর ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাসের একমাত্র চেষ্টা ক্রুদের নিজের দখলে রাখা, ব্যস।

সে পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আলসেমির চেয়ে বড় অপনীতি আর নেই। কুঁড়েমির চেয়ে বড় মনোবলহীনতা আর সৌর জগতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই নিষ্কমতা বন্ধ রাখতেই সবাইকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা এবং সে চেষ্টা করতে গিয়েই তার গলদঘর্ম হওয়া।

কীভাবে যে আগের দিনের সাগর অভিযানে কাঠখোট্টা কাপ্তান তার মাঝিমাল্লাদের সব সময় ব্যস্ত আর সুশৃঙ্খল রাখত আল্লা মালুম। মাস্তুল বেয়ে ওঠা নামা আর ডেক ধুয়েমুছে ঝকঝকে করার কাজ কাঁহাতক করানো সম্ভব?

আর বিজ্ঞানীদলের কাছ থেকে বিপরীত সমস্যা আসছে সারাক্ষণ, খেয়ে না খেয়ে তারা পড়েছে টেস্টিংয়ের পেছনে। জান তিতিবিরক্ত করে ছাড়ছে।

কাজগুলো অনুমোদন না করলে অবস্থা কাহিল করে ফেলে, অনুমতি দিলে শিপের সীমিত যোগাযোগ ক্ষমতার সবটুকু দখল করে নিবে।

মাত্র কয়েক মেগাহার্টজের ব্যান্ড উইথড এ কথা পাঠাতে হয় গ্যানিমিডে, সেই কথা উপগ্রহটা ঘুরে পৃথিবীতে রিলে হয়। কারণ মূল অ্যান্টেনা পানির নিচে চলে গেছে।

একটা ক্যামেরা কাজ করছে ডাটা পাঠানোর চ্যানেলে। সেটা বিরক্তিকর সাগর, একঘেয়ে শিপের অভ্যন্তরভাগ আর এখনো শান্ত কিন্তু ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে ওঠা ক্রুদের খবর প্রচার করতে পারে সারাক্ষণ।

এতো বেশি পরিমাণ ডাটা একা তরুণ অফিসার ক্রিস ফ্লয়েডের কাছে আসছে যে ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস কথা না বলে পারল না।

নিজের কেবিনের গোপনীয়তায় বসে সে বলল, ফ্লয়েড সাহেব, আপনি যদি দয়া করে আপনার পার্ট টাইম জবটার কথা একটু খুলে বলেন তো আমি বেশ খুশি হতাম।

ফ্লয়েড অপ্রস্তুত হয়ে টেবিল আঁকড়ে ধরল, হঠাৎ আসা ঢেউয়ের ধাক্কায়, নাকি কথায় কে জানে!

পারলে খুশি হতাম, স্যার। খুশি হয়েই বলতাম। কিন্তু অনুমতি নেই।

কার অনুমতি নেই? প্রশ্নটা করা যাবে তো?

খোলামেলা বলতে গেলে, আমি নিজেও জানি না।

কথাটা এক্কেবারে সত্যি।

তার সন্দেহ সংস্থাটার নাম অ্যাস্ট্রোপোল। কিন্তু যে দুজন ভদ্রলোক গ্যানিমিডে তাকে ব্রিফ করেছে তারা কথাটা জানায়নি।

শিপের ক্যাপ্টেন হিসেবে-স্পেশালি এই বিশেষ মুহূর্তে… আমি আপনাকে এখানকার আগাগোড়া সব জানাতে চাই। এই গাড়া থেকে উদ্ধার যদি পাইও, আগামী কয়েক বছর কাটবে প্রশ্নের উত্তর দিতে। আমার বিশ্বাস আপনার একই হাল হতে যাচ্ছে।

কোনোমতে একটা ফ্যাকাসে হাসি ঝুলল ক্যাপ্টেনের ঠোঁটে।

যদিটা থেকেই যাচ্ছে। যদি উতরে যাই, তাই না, স্যার? আমি শুধু এটুকুই জানি, কোনো এক উচ্চ স্তরের এজেন্সি জানত যে এখানে কোনো না কোনো সমস্যা হবে। সমস্যাটা কী তা জানত না। শুধু চোখ কান খোলা রাখার কাজ পেয়েছিলাম আমি। জানি, কাজটা ঠিক ভালমতো করতে পারিনি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আমাকেই তারা পেয়েছিল, একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে।

মনে হয় না আপনি কোনো ভুল করেছেন। যাই হোক, কী মনে হয়? এই রোজি মেয়েটা কে…

তারপর হঠাৎই সে থেমে গেল। আপনি কি আর কাউকে পেয়েছেন এর সাথে যুক্ত? ঠিক যুতসই কথাটা বেরুচ্ছিল না মুখ থেকে, তারপর ক্যাপ্টেন বলেই বসল, অন্য কাউকে কি সন্দেহ করছেন? একটু ইতস্তত করে, যেমন আমাকে?

শান্ত চোখে একটু তাকিয়ে থেকে ফ্লয়েড কথা শুরু করল আবার।

হয়তো আপনার সাথে আগেই কথা বলে নেয়া উচিত ছিল, স্যার। কিন্তু দেখেছি সারাক্ষণ কেমন ব্যস্ত ছিলেন। আমি শিওর, ড. ভ্যান ডার বার্গ কোনো না কোনোভাবে জড়িত। কীভাবে, বলতে পারব না। তিনিও একজন… কথাটা আসলে অন্যরকম শোনায়, কিন্তু বলতেই হচ্ছে, কালো। এবং তারা দুজনই এমন ছিলেন শিপে। সত্যি, তাদের ঠিক বুঝতে পারিনি।

অথবা পছন্দ করতে, সে বলতে পারতো।

ভ্যান ডার বার্গ… হুম। অন্য বিজ্ঞানীদের বেলায়?

তাদেরকেও চেক করেছি, অবশ্যই। কোনো গড়মিল পাইনি।

সব কথা সত্যি নয়। ড. সিম্পসনের স্ত্রীর সংখ্যা বেশি, অন্তত বে-আইনি ধারার একজনতো আছেই। আর ড. হাগিন্স বিস্তৃত বইয়ের এক ভাণ্ডার নিজের সম্প্রহে রাখে। ফ্লয়েড জানে না ঠিক কেন তাকে এত কথা বলা হয়েছিল তখন, সম্ভবত তার নিয়োগকর্তারা তাদের ক্ষমতা এবং দক্ষতার দু একটা নমুনা দেখাতে চাচ্ছিল। আর সে মনে করেছিল অ্যাস্ট্রোপোল বা এমন যে কোনো বড় সংস্থার হয়ে কাজ করাটা বেশ সৌভাগ্যের কথা, ভবিষ্যতের জন্যও।

ভাল, চমৎকার। অ্যামেচার গুপ্তচরকে সমাপ্তির দিকে টেনে আনল ক্যাপ্টেন, যখনই শিপের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কিছু টের পাবেন-যখনই-আমাকে জানাবেন দয়া করে।

এই পরিস্থিতিতে শিপের জন্য ক্ষতিকর আর কী থাকতে পারে? এরচে বেশি ক্ষতিকর কিছু আর আশা করা যায় কি?

৩৬. অচেনা বেলাভূমি

সামনের দ্বীপটা চোখে পড়েছে চব্বিশ ঘন্টা হল। কেউ জানে না সেখানেই যাওয়া যাবে, নাকি কেন্দ্রের নরকে গিয়ে হাজির হবে শিপ! দ্বীপটার অবস্থান গ্যানিমিড থেকে নিশ্চিত করে পাঠিয়ে পথও বাৎলে দেয়া হয়েছে, তারপরও প্রতিদিন প্রত্যেকে পালা করে বেশ কয়েকবার দেখে নেয়, নিজের সন্তুষ্টির জন্য হলেও।

দ্বীপের দেখা পেলে ভালর বদলে মন্দও হতে পারে, বিগড়ে যেতে পারে হিসাবের খাতা। ভদ্র কোনো উপকূলের বদলে শিপ পাথুরে দেয়ালেও ধাক্কা খেতে পারে। তখন আর শিপ বলে কিছু থাকার কথা নয়।

অ্যাক্টিং ক্যাপ্টেন লি এই সব ব্যাপারেই সতর্ক। এক কেবিন ক্রুজারের ইঞ্জিন। বিগড়ে যাবার পর শিপ ভেঙে পড়ার ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল তাকে। জাহাজটা আছড়ে পড়ে বালির একটা দ্বীপে। একটু বিপদ আর একগাদা অ্যাডভেঞ্চার জড়ো হলেও তেমন কোনো অভিজ্ঞতা আবার পাবার কোনো ইচ্ছাই নেই তার। বিশেষত এমন কোথাও, যেখানে এসে উদ্ধার করার মতো কোনো কোস্টগার্ড নেই।

এখানে যেন সত্যিকার এক মহাজাগতিক প্রহসন হয়ে গেল। তারা মানবসৃষ্ট সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ও বাহন নিয়ে এতদুরে এল, এমন ক্ষমতা নিয়ে যা দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সৌর জগৎ পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব; সেকেন্ডে দেড়-দু হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না-এখন কিনা মাত্র কয়েক ফুট এদিক-সেদিক করার যো নেই।

কিন্তু একেবারে হেরে বসেনি তারা, লির হাতে খেলার মতো আরো কিছু পাশাগুটি রয়ে গেছে, এখনো।

এই তীক্ষ্ণ ধারওয়ালা দুনিয়ায় প্রান্ত তেমন বিস্তৃত নয়, মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরের জিনিসও দেখা যায় না গোলকটা ছোট হওয়াতে। এবং দেখা যাচ্ছে দ্বীপটাকে। লি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, ভয় ধরানো পাথুরে টিলা নেই উপকূলের দিকে। কিন্তু প্রত্যাশিত বালুকাবেলাও নেই।

ভূগোলবিদরা আগেই সাবধান করেছিল, এখানে বালু জন্মাতে আর মাত্র ত্রিশ চল্লিশ লাখ বছর লাগবে। ইউরোপার বালু তৈরির কারখানা এখনো গড়ে ওঠেনি ঠিকমতো ।

সরাসরি মাটিতে গিয়ে উঠতে হবে দেখেই লি ট্যাঙ্কগুলো সাথে সাথে খালি করে ফেলার আদেশ দিল, টাচডাউনের পর যেগুলো ভরার পরামর্শ সেই দিয়েছিল।

বেশ অস্বস্তিকর কয়েকটা মুহূর্ত ভুগতে হল তাদের। কী হয়-কী হয়! তারপর উৎসাহ হারিয়ে ফেলল এক চতুর্থাংশ কু। হাজার হলেও, এক কাজে কতক্ষণ ব্যস্ত থাকা যায়!

একটু একটু করে জলের আড়াল থেকে আবার শরীর জাগাচ্ছে গ্যালাক্সি; আবার বাড়ছে ঢেউয়ের দোলা। পুরনো দিনের মাছধরা নৌকারা ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে ঠিক যেভাবে নিজেদের হাল্কা করত, সেভাবে ।

সাহায্য করল সবাই, তারপর ঢেউয়ের তোড় উপেক্ষা করে তীরের জন্য অপেক্ষা।

একটা ছোটখাট তীর এগিয়ে আসছে, পাশে ছোট ঘোঁট দুটো বোল্ডার। বালু না পেলে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোই ভাল…

তারপর আরো বড় একটা ঢেউয়ে ভেসে তীরের দিকে এগুনো। কিন্তু এখানেই বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। কারণ একবার আছড়ে পড়বে ঠিকই, তারপর আবার ঢেউয়ে নেমে আসতে হতে পারে, অথবা বারবার ঢেউয়ের ধাক্কায় পর্যুদস্ত হওয়াও বিচিত্র নয়।

এবং অবশেষে অ্যাক্টিং ক্যাপ্টেন লি শেষ চালটা চালল।

গ্যালাক্সি শেষবারের মতো তার ল্যান্ডিং গিয়ার প্রসারিত করেছে সামনের দিকে। তারপর, কে জানে, এই প্রথম হয়তো ইউরোপার বুকে কোনো কাঁকড়ার পা পড়ল। মহাকাশ তরী গ্যালাক্সি শেষবারের মতো থামল একটা নিরাপদ জায়গায়, যেখানে সামুদ্রিক ঢেউ বা বাতাস কোনো আঘাত হানবে না।

গ্যালাক্সি যে শেষবারের মতো তার বিশ্রামস্থান পেয়েছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই-আর, বাকীটাও সম্ভব, হয়তো সে কুদের মায়া ছাড়তে পারবে না।

৫. অ্যাস্টেরয়েডের ভেতর দিয়ে

পঞ্চম পর্ব – অ্যাস্টেরয়েডের ভেতর দিয়ে

৩৭.নক্ষত্র

এখন ইউনিভার্স এতো দ্রুত চলছে যে একে কোনো কক্ষপথ ধরে চলা জিনিসের সাথেই তুলনা করা যাবে না। এমনকি সৌরজগতে কোনো বস্তু এতো দ্রুত চলে না-অবশ্য কখনো চলেনি সেকথা আর কেউ জোর গলায় বলতে পারবে না; এই ক্ষমতা মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে অর্ধশত বছর আগেই।

সূর্যের সবচে কাছের গ্রহ সবচে বেশি গতিতে সেকেন্ডে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার যেতে পারে। প্রথম দুদিন মহাকাশ অগ্নিরথটা এর দ্বিগুণ গতিতে চললেও আর কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েক হাজার টন পানি কমে গেলে এটা হৃদকম্প ঘটানো গতি পাবে।

তারপর শুক্রের এলাকায় প্রবেশ; এখন তাকে লুসিফার আর সূর্যের মাঝে সবচে স্বর্গীয় ভুবন বলে ভুল হয়। ভোলা চোখে একটা গোলক দেখা গেলেও সবচে শক্তিশালী টেলিস্কোপ তেমন কোনো কাজে লাগবে না, ধারণার কোনো উন্নয়ন হবে না-কারণ ইউরোপাকে হিংসা করে সেও নিজেকে ঢেকে রাখে হাজার রহস্যে।

সূর্যের আরো কাছাকাছি যেতে যেতে ইউনিভার্স মোটেও মোহাবিষ্ট হবে না, বরং সৌর জগৎপতির কাছ থেকে বাড়তি শক্তি ছিনিয়ে নেবে, সৌর দোলনায় দোল খেয়ে এগিয়ে যাবে নতুন নক্ষত্রের দিকে।

কিন্তু একেবারে বিনামূল্যে প্রকৃতি শক্তি দেয় না। ঠিক রাখে নিত্যতার সূত্র। সূর্যের গ্র্যাভিটিশনাল ফোর্স কাজে লাগিয়ে ইউনিভার্স এগিয়ে যাবে ঠিকই, ঠিক সেটুকু শক্তি প্রকৃতি ছিনিয়ে নেবে শক্তির আধার সূর্যের কাছ থেকে। মানুষের জন্য পরিমাণটা অনেক অনেক বেশি হলেও সূর্যের জন্য একেবারে কম। আসছে হাজার হাজার বছরেও তার ফলে সূর্যের হয়ে যাওয়া ক্ষতির নগণ্য হিসাবটা বের করা যাবে না।

ক্যাপ্টেন স্মিথ বেশ কষ্টে তার একগুঁয়েমির ফলে হারানো মূল্যের কিছুটা ফিরিয়ে নিল।

“এখন আপনারা বুঝতেই পারছেন, সে বলল সবার উদ্দেশ্যে, কেন আমি শিপটাকে ওল্ড ফেইথফুলের ভিতর দিয়ে নিয়ে গেলাম। যদি শরীরের সবটা ময়লা ধুয়ে না নিতাম, তো এতোক্ষণে আমাদের বারোটা বেজে যাবার কথা। থার্মাল কন্ট্রোল যদি কাটিয়ে উঠতে পারতো তাহলেও পৃথিবীর চেয়ে দশগুণ চাপ পড়ার কথা।

এখনি কালো হয়ে যাওয়া ফিল্টারের দিকে তাকিয়ে সবাই তার কথা বিশ্বাস করে নিল। তারপর সবার স্বস্তি ফিরে এল মঙ্গলের অর্বিটে ঢোকার পরপর সেটা আবার আগের আকৃতি ফিরে পাওয়ায়।

ফেমাস ফাইভ তাদের জীবনে অত্যাশ্চর্য এবং অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনে যার যার পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এরিমধ্যে। মাইকেলোভিচ আবারো ব্যগ্রভাবে সশব্দে কম্পোজ করা শুরু করেছে, ফলে খেতে বেরুনো ছাড়া তার টিকিটির স্পর্শ পায়নি কেউ। তাই তার রীতিসিদ্ধ খোঁচায় আহত হতে থাকা সবাই খানিক স্বস্তি পেল, বিশেষত উইলিস।

গ্রিনবার্গ নিজেকে নিজেই নির্বাচিত করল একজন অনারারি ক্রু হিসেবে। কেউ প্রতিবাদ না করায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্বনির্বাচিত হওয়ার একটা মজা আছে। তার বেশিরভাগ সময় কাটছে ব্রিজে।

সমস্ত ব্যাপারকে ম্যাগি মবালা আন্তরিক তুষ্টির সাথে নিয়েছে অনেক আগেই।

লেখকেরা, তার মন্তব্য, সারা জীবন চোটপাট করে যায় একটা কথা বলে, কী নিশ্চিন্তে যে কাজ করতে পারতাম একটু নির্জনতা পেলে! কী পরিমাণ কাজ যে করতে পারতাম! এই কথার প্রমাণ চান আপনারা কেউ কেউ চ্যালেঞ্জ না করলেও তার উৎসাহে ভাটা পরার লক্ষণ নেই। বাতিঘর আর জেলখানা হল প্রমাণ। সুতরাং আমার কোনো অভিযোগ নেই। শুধু একটাই অভিযোগ, রিসার্চ ম্যাটেরিয়াল পেতে একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে হাই প্রায়োরিটি মেসেজের কারণে।

এমনকি ভিক্টর উইলিসও মূল পথে চলে এসেছে, রবিবারের লম্বা প্রজেক্ট নিয়ে তার ব্যস্ততা দেখার মতো। কেবিনে বন্দী থাকার আরো কারণ আছে। দেখে মনে হতে পারে আরো কয়েক সপ্তাহেও সে শেভ করবে না। এবং আরো বেশ ক মাস লেগে যাবে পুরনো বনেদীয়ানা ফিরে পেতে।

ইভা মারলিন দিনের বেশ ক ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় এন্টারটেইনমেন্ট রুমে, সবাই জানে সে সারাক্ষণ প্রিয় ক্লাসিকগুলো দেখছে। ভাগ্য ভাল বলতে হয়, অভিযানের আগে তড়িঘড়ি করে লাইব্রেরি আর প্রজেকশন সিস্টেম গড়ে তুলেছিল কর্তারা। এখনো লাইব্রেরিটা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, কিন্তু যা আছে তা দেখে শেষ করতে কয়েক জীবন পেরিয়ে যাবে।

সিনেমার জগতের, সত্যি বলতে গেলে শিল্প জগতের সব কাজই সেখানে সযত্নে রাখা হয়েছে, সেসবের বেশিরভাগই ইভার চেনা এবং সে নিজের জ্ঞানের সাথে ব্যাপারটা মিলিয়ে দেখে বেশ মজা পাবে তাই স্বাভাবিক।

ফ্লয়েড সেসময় তার কথা শুনতেই বেশি ভালবাসে। স্বাভাবিক। তখনি ইভা রক্তমাংসের মানুষে পরিণত হয়, কোনো অতিমানব না। খুব আফসোস হয় ফ্লয়েডের, এই মহিলা বাস্তব জীবনে ফিরে আসে বাস্তব জীবন পাবার বদলে সিনেমার পর্দা পেলে।

ফ্লয়েড তার জীবনের অন্যতম ভয়াল অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল একবার ইভার পেছনে বসে সত্যিকার গন উইথ দ্য উইন্ড দেখার সময়। তখনই সে ভিভিয়ান লিথের সাথে তার তুলনার সুযোগ পায় এবং মিলিয়ে দেখতে গিয়ে নিজের মনেই বেশ হেনস্থা হয়ে পড়ে।

আলো নেভার পর দেখতে পায় ইভার কান্না। সান্ত্বনার সুরে সে হাতটা তুলে নেয়, তারপর দরদমাখা কণ্ঠে বলে, বনির মৃত্যু দেখে আমিও কেঁদেছিলাম।

সাথে সাথে ইভা একটা মৃদু হাসি যোগাড় করেছিল।

“আমার কান্না ভিভিয়ানের জন্য। আমরা দ্বিতীয় পর্ব শু্যট করার সময় তার জীবন নিয়ে অনেক পড়াশোনা করি। বেচারীর জীবনটা অনেক কষ্টে কেটেছে। এখন, তাকে নিয়ে এই মহাকাশে কথা বলার সময়, সিনেমা দেখার সময় ল্যারির একটা কথা মনে পড়ে গেল। ভিভিয়ানের নার্ভাস ব্রেকডাউনের পর ল্যারি শ্রীলংকা থেকে ফিরে বলেছিল, আমি মহাকাশের একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম, আমাদের দুনিয়ার কোনো মেয়েকে না।

এক মুহূর্তের জন্য ইভা থামল, তারপর তার গাল বেয়ে গড়িয়ে গেল আরো এক বিন্দু অশ্রু।

ফ্লয়েড না ভেবে পারল না, এই অশ্রু গড়ানোও নাটকীয়।

আর দেখ, আরো অদ্ভুত ব্যাপার, সে জীবনের শেষ ছায়াছবিটাও করেছিল আজ থেকে শত বছর আগে, জান, কী নাম ছিল মুভিটার?

বলে যাও, আরো একটা চমক পাওনা হয়েছে আমার।

আশা করি নামটা ম্যাগিকে চমকে দেবে, যদি হুমকি অনুযায়ী বইটা লিখেই ফেলে-তার শেষ চলচ্চিত্রের নাম ছিল-শিপ অব ফুলস।

৩৮.মহাকাশের হিমবাহ

হাতে অযাচিত সময়। কী করা যায়? অবশেষে ভিক্টর উইলিসকে দেয়া ওয়াদা পূরণ করতে চাচ্ছে ক্যাপ্টেন স্মিথ। সে এখন ইন্টারভিউ দিতে পারবে। কিন্তু ভিক্টর বেশ ফুলে আছে, অবশ্যই, মাইকেলোভিচের করা সর্বশেষ অপমানটার কারণে। পাবলিক ইমেজ ফিরে পেতে (কিংবা চোয়ালে গজাতে) তার বেশ কমাস লেগে যাবে-কী আর করা, ইন্টারভিউটা ক্যামেরার বাইরেই নেয়া হোক। পৃথিবীর স্টুডিও তাকে নতুন শট নিয়ে মানিয়ে নিতে পারবে।

শিপের একমাত্র আংশিক সজ্জিত কক্ষে তারা বসে আছে। ক্যাপ্টেনের কেবিন ছাড়া আর কোথাও ফার্নিচার নেই। আর তাদের সামনে সৃষ্টি জগতের (এ নিয়ে এখন সবার সন্দেহ ওঠে) সবচে ভাল ওয়াইন পরিবেশিত। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউনিভার্স মূল ড্রাইভ বন্ধ করে ভেসে চলা শুরু করবে, তাই আগামী দিন কয়েকের মধ্যে ক্যাপ্টেনকে বাগে পাওয়ার এই এক সুযোগ। এদিকে ওজনহীন মদ্যপানে কোনো রাজকীয় তৃপ্তি নেই, তাই ভিক্টর স্কুইজ বাল্ব দিয়ে তার আনা ভিনটেজ খেতে অস্বীকার করেছে।

“ভিক্টর উইলিস বলছি, মহাকাশ অগ্নিরথ ইউনিভার্সের বুকে শুক্রবার আঠারোটা ত্রিশ মিনিটে, দু হাজার একষট্টি সালের জুলাই মাসের পনের তারিখে। আমরা যদিও লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি যাইনি, তবু মঙ্গলের অর্বিটে আমাদের সর্বোচ্চ গতি উঠে যাবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। গতিটা কতো, ক্যাপ্টেন?

প্রতি সেকেন্ডে এক হাজার পঞ্চাশ কিলোমিটার।

একপল যেতে না যেতেই সহস্র কিলোমিটার পেরিয়ে যাব আমরা! অর্থাৎ ঘণ্টায় চল্লিশ লক্ষ কিলোমিটার!

ভিক্টর উইলিসের কথা শুনে মনে হবে সে এসব কিছুই জানতো না, অথচ অর্বিটাল মেকানিক্স সম্পর্কে ক্যাপ্টেনের চেয়ে তার জ্ঞান কিছু কম নেই।

এখানেই ভিক্টরের সার্থকতা, সে শুধু দর্শকদের মন পড়তেই জানে না, বরং তাদের প্রত্যাশিত ব্যাপার প্রত্যাশিত সুরে শুনিয়ে প্রত্যাশা আর উৎসাহকে জাগিয়ে তোলে।

কথাটা সত্যি। গর্বে ফুলে উঠেছে ক্যাপ্টেনের বুক, সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ সর্বোচ্চ যত গতি পেয়েছে তারও দ্বিগুণ আমাদের প্রাপ্তি।

এই কথাটা আমার লাইনে চলে আসছে-ভাবল ভিক্টর। সে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়াটাকে মোটেও ভাল চোখে দেখে না। কিন্তু ভাল পেশাদার আর কাকে বলে! দ্রুত কাটিয়ে উঠল সে।

নিজের কথাটাকে আরো একটু এগিয়ে রাখার জন্য সামনে জ্বলতে থাকা স্ক্রিনের তথ্য আউড়ে গেল নির্দ্বিধায়।

আমরা প্রতি বারো সেকেন্ডে পৃথিবীর পরিধির সমান দূরত্ব পেরুচ্ছি। আরো দশ-দশটা দিন লেগে যাবে বৃহস্পতি-আহ, লুসিফারে পৌঁছতে! এ থেকেই সৌর জগতের পরিমাপ পদ্ধতির ধারণা পাওয়া যায়…

এখন, ক্যাপ্টেন, ব্যাপারটা চমৎকার। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে আমার মনে এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন ঘুরছে।

ওহ-না, বিব্রতকর প্রশ্ন ছাড়া আর কিছু পাওনা তোমরা? আবার জিরো গ্র্যাভিটি টয়লেট নিয়ে নাড়াচাড়া করোনা দাড়িওয়ালা বুড়ো ভাম! গর্জে উঠল স্মিথ, মনে মনে।

ঠিক এ মুহূর্তে আমরা গ্রহাণুপুঞ্জের বলয় পেরিয়ে যাচ্ছি।

(খোদা না খাস্তা, আর আমি কিনা ভেবেছিলাম টয়লেট, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল স্মিথ।)

–এবং এখনো কোনো স্পেসশিপ তেমন আঘাত পায়নি এখানে। তার পরও, আমরা কি খুব বড় কোনো রিস্ক নিচ্ছি না? হাজার হলেও, সেখানে আক্ষরিক অর্থেই বিচবলের আকারের লাখ লাখ কঠিন আকৃতি ভেসে বেড়ায়। তার মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার চার্টে জায়গা পেয়েছে।

কয়েক নয়, একটু বেশিই হবে। দশ হাজারেরও অনেক বেশি।

কিন্তু আমাদের অজানা লাখ লাখ দেহ এখনো সনাক্ত হয়নি।

কথা সত্যি। কিন্তু আমরা চিনে রাখলেও খুব বেশি কাজে আসত না।

আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাচ্ছেন?

এ নিয়ে আমাদের কিছুই করার নেই।

কেন?

ক্যাপ্টেন স্মিথ বুঝতে পারছে, তার হাজার অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা জাল ঠিকই পাতা হয়ে গেল তার চারপাশে এবং সেটা গুটিয়ে আনছে বুড়ো ভামটা। শালার! এই ইন্টারভিউওয়ালারা মাছধরা জেলে হলেও জীবনে উন্নতি করতে পারত।

উইলিসের কথা সত্যি। হেড অফিস খুব সুন্দর করে গোছানো কোনো জবাব বানাতে পারত, কিন্তু এখন বেস কিছু মুখ গলে না বেরুলেই হল। কাস্টমার ক্ষ্যাপানো কোনো কাজের কথা নয়।

স্পেসের হৃদয় এত বড় যে, এমনকি এই এখানেও, অ্যাস্টেরয়েড বেল্টের ঠিক মাঝখানে সংঘর্ষের সম্ভাবনা আক্ষরিক অর্থে নগণ্য, যার অর্থ গুনে বের করা সহজ নয়। আমরা আপনাকে একটা অ্যাস্টেরয়েড দেখানোর আশা করতে পারি। সবচে বেশি সম্ভাবনা আছে হনুমানকে দেখার। সে মাত্র তিনশো মিটার লম্বা। কিন্তু এর । পেছনেই যেটা আছে সেটা আড়াই লাখ কিলোমিটার দূরে।

ক্যাপ্টেন স্মিথের ইন্টারভিউ ক্যামেরার সামনে ভিক্টর উইলিসের সাথে ব্যক্তিত্বের সংঘাতে যাওয়া উচিত হয়নি। উইলিস দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলছে, ব্যাটা, কথা ঘোরাও, না? দেখাচ্ছি তোমাকে হনুমানের আসল রূপ।

কিন্তু হনুমান বেশ বড়। দানবীয়ই বলা যায়। তা ছাড়াও আর লাখ ছোট ঘোঁট অ্যাস্টেরয়েড ঘুরে বেড়াচ্ছে, এদের নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

তোর উপর ঠাঠা পড়ুক, তোর দাড়ি পুড়ে মিশকালো হয়ে যাক, তুই নির্বংশ হ। ভাল গ্যাড়াকলে পড়া গেল!

ঠিক আপনার মতো চিন্তা আর ভয় আমার মনে। পৃথিবীতে মাথায় বজ্রপাত হবার সম্ভাবনা যতটুকু, ততটুকু।

অ্যাজ এ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট, কলোরাডোের পাইক পর্বতের চূড়ায় একবার আমি অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলাম… (কেন মরলি না তুই তখন?)

…আলো আর শব্দ একই সাথে আঘাত করেছিল। আর আপনি স্বীকার করছেন যে সেই হন্তারা এদিক-সেদিকই আছে। আমরা কি এতো গতিতে চলাচল করে প্রচণ্ড ঝুঁকি নিচ্ছি না? ইন ফ্যাক্ট, একেই বলে জীবন হাতে নেয়া।

উইলিস কাঁটায় কাঁটায় জবাবটা জানে। আবারো সে স্পেস সম্পর্কে অজ্ঞ দর্শকের সামনে নিজের আসন উঠিয়ে রাখছে, এবং দর্শকরা প্রতি সেকেন্ডে পিছিয়ে যাচ্ছে হাজার কিলোমিটার। (ইউনিভার্স থেকে, এখানে ওঠার আগ্রহ এবং বর্তমান গতি, দু অর্থেই।)।

মনে মনে বকায় এক ধরনের বিমল আনন্দ আছে, অন্তত ঝাঁঝটা একটু কমে যায়, তাই বকা চালিয়ে গেল ক্যাপ্টেন-ব না, তোর উপর এটম বোমা পড়ক, তোর চান্দি মিশে যাক হাওয়ার সাথে, আরেকটু তেড়িবেড়ি করলেই ইন্টারভিউর খেতা পুড়ব, গুষ্ঠি খিলাব।

গণিত ছাড়া ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা কষ্টকর। বলল ক্যাপ্টেন স্মিথ (জীবনে কতবার সে এই কথা বলে উতরে গেছে? কোনো লেখাজোকা নেই। এমনকি যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানেও দারুণ কাজে লাগে।) “কিন্তু সত্যি, গতির সাথে ঝুঁকির কোনো সম্পর্ক নেই। বলতে চাচ্ছি, গতি বাড়ালে বাড়বে, কমলে কমবে-এমন সমানুপাতিকতা অথবা উল্টো ধরে নিয়ে ব্যস্তানুপাতিকতার কোনো মানে হয় না। ব্যাপারটা এমন, আপনার পাশে যদি কোনো আণবিক বোমা পড়ে, এবং সেটা যদি ফাটে, তাহলে তার হিসাবটা কিলোটনে নাকি মেগাটনে তা ভাবা নিতান্তই হাস্যকর।

এবং জিতে যাচ্ছে উইলিস। এই কথায় আর যাই হোক, স্বস্তি পাওয়া যায় না, মহাকাশ ভ্রমণের সাথে পাশে নিউক্লিয়ার বোমা পড়ার তুলনা! কিন্তু কী আর করা? গতস্য শশাচনা নাস্তি। যা বলার বলে ফেলেছ বাছা, এবার আগে বাড়ো, কথাটাকে ধামাচাপা দাও। উইলিস ভামটা যেন এনিয়ে আর কচলাতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখ।

আর একটা কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে দিন-যত বড়… না, মানে সামান্য রিস্ক নিলেও আমরা কিন্তু জীবন বাঁচানোর জন্যই ছুটে যাচ্ছি। একটা ঘন্টা বাঁচাতে পারলেও তা অনেক জীবন রক্ষা করার কাজে লাগতে পারে। আর ইউরোপার বুকে…

হ্যাঁ, আমি শিওর। তাছাড়া আমরা সবাই ব্যাপারটায় গর্ববোধ করি। একটু থামল ভিক্টর, আরো কিছু কথা যোগ করতে হবে, অবশ্যই, আমিও একই নৌকার যাত্রী।

আর সেই যাত্রীর যাত্রার কথা সবার সুবিদিত! সবার যাবার সম্মতির মুখে তুমি না গিয়ে করতেটা কী? নৌকা থেকে স্পেসে নেমে ডুব সাঁতার দিয়ে বাড়ি ফিরতে? এসেছে আমার রামরাজত্বের শ্রীরাম, মহা পরোপকারী!

এই সব ব্যাপার আমাকে আরেকটা কথা মনে করিয়ে দিল। উইলিস এখনো নিজের কথা বলে যাচ্ছে, আপনি কি মাত্র দেড়শো বছর আগে উত্তর আটলান্টিকে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটার কথা জানেন?

উনিশো এগার সালের কথা?

ভাল, আসলে উনিশো বার

ক্যাপ্টেন স্মিথ এগুতে থাকা মারটার কথা চিন্তা করছে। নিজে ভেবে বের করতে পারলেই সবচে ভাল হয়, গা বাঁচানো যায়।

আমার ধারণা, ভিক্টর, আপনি টাইটানিকের কথা বলছেন…

“ঠিক তাই, এবারও ব্যাটা কাপ্তান আগে আগে ধরে ফেলল! কিন্তু আর নয়, ছক্কা হাঁকাবে ভিক্টর উইলিস, যেজন্য তার এ্যাদ্দিনের প্রস্তুতি, আমি অন্তত বিশজনের কাছ থেকে কথাটা শুনেছি। তাদের সবার দাবী, মিলটা তারাই প্রথম দেখতে পায়।

কোন মিল? টাইটানিক অসম্ভব সব ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে নেমেছিল। শুধু রেকর্ড ভাঙার তালে…।

তারপর প্রায় বলেই বসছিল ক্যাপ্টেন স্মিথ, এমনকি তাদের পর্যাপ্ত লাইফবোটও ছিল না। কিন্তু স্রষ্টাকে সহস্রবার ধন্যবাদ, তিনি স্মিথের কোনো জনমের পুণ্যের বদৌলতে যেন এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিলেন। কথাটা শুধু মুখ ফস্কে বেরুলেই হত, ক্যারিয়ার-জীবন দু-ই নিয়ে টানাটানি।

তাদের এই শিপের সবেধন নীলমণি শাটলটা সাকুল্যে মাত্র পাঁচজন যাত্রী বইতে পারে, এবং সেই শাটল নিয়ে সৌর জগতের খোলা আকাশে ভেসে পড়া আর প্রশান্ত মহাসাগরের ঠিক মাঝখানে ডুবন্ত জাহাজ থেকে উদ্ধার পাবার আশায় রবারের ডিঙি নিয়ে নেমে যাওয়া একই কথা।

আরো অনেক কথা বলা যেত, ক্যাপ্টেন স্মিথ, তবু সময় নষ্ট না করে মানছি, মেনে নিচ্ছি টাইটানিকের সাথে এই অত্যাধুনিক শিপ ইউনিভার্সের আকাশ পাতাল ফারাক। তবু একটা ব্যাপারে সবার মন খুঁতখুঁত করছে, ক্যাপ্টেন। এ যুগেও মানুষ অতিকল্পনা বা কুসংস্কার-আপনি এটাকে যাই বলুন না কেন, ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় দেয়।

ক্রমেই তেতে উঠছে স্মিথের মন-মগজ। যা ডোবানোর ডুবিয়েছিসততা ব্যাটা, বলনা, কী বলবি, বল?

আপনি কি টাইটানিকের প্রথম ও একমাত্র ক্যাপ্টেনের নামটা জানেন?

না, আমি অবশ্য একটু মনে করার চেষ্টা… আর কথা যোগাল না স্মিথের মুখে, * ইংরেজি ভাষায় নামের দুপ্রাপ্যতা এবং একই নামে হাজার মানুষের সহজপ্রাপ্যতা

অন্তর্চক্ষুতে দেখে ঝুলে পড়ল চোয়াল, আচ্ছন্ন হয়ে গেল দৃষ্টি।

ক্যামেরার পেছনে, এতোক্ষণে, স্বনামখ্যাত উপস্থাপক, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাক বিদগ্ধদের একজন, ভিক্টর উইলিস, তার সাক্ষাৎকার নেবার আসল মজার একটু একটু পেতে শুরু করেছে।

ঠিক তাই, ক্যাপ্টেন স্মিথ, ঠিক তাই। ও! একটা ব্যাপার, মানুষ এখনো তার স্বাভাবিক দৈহিক ঝামেলা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এবং মহাকাশের ওজনহীন পরিবেশে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়াটাকে তারা…

৩৯. কাপ্তানের টেবিল

আফসোস! পৃথিবীর (পৃথিবীর বাইরের) দর্শকরা ইউনিভার্সের অধিকতর তা অনানুষ্ঠানিক এবং খোলামেলা আলোচনায় ঠিক জুত পায়নি। শিপের জীবন এখন অনেকটা সহজ ও স্বাভাবিক। অনেক পদক্ষেপের কারণে এই বন্ধুসুলভ আবহাওয়ার জন্ম। তার মধ্যে সবচে কার্যকর এবং দীর্ঘজীবী পদক্ষেপ ছিল ঐতিহ্যবাহী কাপ্তানের টেবিল।

ঠিক আঠারোটায় ছ যাত্রী এবং ডিউটিতে না থাকা পাঁচ অফিসার ক্যাপ্টেন স্মিথের সাথে খেতে বসে। এখানে উত্তর অতলান্তিকের বুকে ভেসে চলা প্রাসাদগুলোর মতো জাক-জমক আর পোশাকী রীতি না থাকলেও অনেক বেশি আভিজাত্য লুকিয়ে আছে। ইভা ডিনারটাকে আরো সুন্দর করে তোলে নিত্য নতুন ব্রেসলেট, আঙটি, নেকলেস, চুলের ফিতা বা সুগন্ধির সৌকর্যে। (এসবের সরবরাহ কোত্থেকে আসে এই একলা মহাকাশে আল্লা মালুম, প্রায়ই ভাবে যাত্রীরা বিশেষত মুগ্ধ ফ্লয়েড)

ড্রাইভ চালু থাকলে সাধারণত খাবারটা স্যুপ দিয়েই শুরু করে তারা। নাহলে, ওজনহীন অবস্থায় অন্য ব্যবস্থা আসে। সেই সাথে ক্যাপ্টেন সর্বশেষ খবর জানায়; অথবা পৃথিবী-গ্যানিমিড থেকে প্রচারিত সর্বশেষ গুজবের ঘোমটা নিয়ে টানাটানি করে।

দুনিয়া ডুবে আছে গুজবে। আর সবচে মজার মজার তত্ত্ব বেরুচ্ছে গ্যালাক্সির হাইজ্যাকিং নিয়ে। প্রতিটি গোপন সংস্থার উপরই সবাই খড়গহস্ত। আরও নানা সম্ভাবনা নিয়ে হা-পিত্যেশ করে মরছে সবাই। তবে, সব গুজবেরই দুটো ক্ষেত্রে মিল পাওয়া যায়, সেগুলো গুজব, এবং সেগুলোর কোনোটারই নির্ভরযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা নেই।

একটা সত্যি বেরিয়েছে, এবং গুজববিদরা সেটা হাতড়ে আরো জল ঘোলা করার ধান্ধায় আছে দিনমান। অ্যাস্ট্রোপোলের গোয়েন্দারা রোজি ম্যাককোলেন এর আসল নামটা বের করেছে টেনে। রুথ ম্যাসন। সে উত্তর লন্ডনে জন্মানো বিচ্ছ মেয়ে। মেট্রোপলিটন পুলিশে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যখন উঁকি দিচ্ছিল তখনই নীতিহীন কাজের জন্য তাকে বাদ দেয়া হয়। আফ্রিকায় ইমিগ্রেশন নিয়েই সে হাওয়া হয়ে যায়। নিশ্চই বেচারী সেই হতভাগা মহাদেশটার অন্ধকার রাজনীতিতে তলিয়ে গিয়েছিল। একইভাবে শাকার কথা উঠেছিল-এবং, একইভাবে, ইউ এস এস এ সেকথা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে অস্বীকার করেছে।

ইউরোপা নিয়ে কী করা যায় সে চেঁচামেচি টেবিলজুড়ে সমাপ্তিহীনভাবে ও ফলহীনভাবে চলছিল সর্বক্ষণ। বিশেষত তর্কাতর্কি শুরুর লেখিকার এক কথা থেকে। ম্যাগি মবালা যখন স্বীকার করল যে সে শাকা নিয়ে একটা উপন্যাসের কথা ভাবছিল তার সহস্ৰ-পত্নীর কারো না কারো দৃষ্টিকোণ থেকে, তখনই পরিবেশ বদলে গেল। কিন্তু প্রজেক্টটা নিয়ে সে যতই এগিয়েছে, ততই দেখা গেল জল ঘোলা।

আমার শাকার ধারণা বাদ দেয়া ছাড়া কোনো গতি ছিল না। আজকের আধুনিক কোনো জার্মান হিটলার সম্পর্কে কী ভাবে তাতো আমরা সবাই জানি।

এভাবেই, মিশন এগিয়ে যাবার সাথে সাথে ব্যক্তিগত দিকগুলো এগিয়ে আসছিল ইউনিভার্সের বুকে। জমে উঠছিল আসর। এমনকি খানাপিনা শেষ হবার পরও একটা গ্রুপকে আধঘণ্টার জন্য সময় বরাদ্দ করতে হত। এই এটুকু আতেই অন্তত এক ডজন বিদগ্ধ জীবনের অভিজ্ঞতা আর একই পরিমাণ স্বর্গীয় মানুষ উপস্থিত থাকাতো কম কথা নয়!

সুতরাং, খাবার পরে আলোচনা-গালগল্প চালানোর এমন সুন্দর উৎস আর কোথায়?

মজার ব্যাপার, সবচে কম প্রভাবশালী বক্তার নাম ভিক্টর উইলিস। সে কথাটা মানতে মোটেও লজ্জা পায় না, আর তার কারণও বলে সহজেই।

আমি লাখো লোকের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে করতে এমন প্রাণবন্ত ছোট্ট আসরে বন্ধুদের মধ্যে নিজের জায়গা দখল করার ক্ষমতা হারিয়ে বসেছি।

আসরটা যদি… অবন্ধুসুলভ হয়, তাহলে কি তুমি একটু ভালভাবে কথা বলতে পারতে? মাইকেলোভিচের গলা সব সময় বন্ধুর সাহায্যে উদারহস্ত, চাইলেই তেমন করে ভোলা যায়।

ইভার এখানে তেমন কার্যকর হওয়ার কথা নয়; কিন্তু সেও বেশ চটপটে। অবশ্য তার সমস্ত স্মৃতি শুধু বিনোদন কেন্দ্রীক। সে এমিতে বিখ্যাত-অখ্যাত পরিচালকদের কথা ঘটাতেই বেশি পছন্দ করে। বিশেষ করে ডেভিড গ্রিফিন।

কথাটা কি সত্যি, প্রশ্ন করল ম্যাগি, নিশ্চই শাকার কথা ভাবছিল, যে লোকটা নারী বিদ্বেষী ছিল?।

অবশ্যই না। সে শুধু অভিনেতাদের ঘেন্না করত। তার মতে ঐ শ্ৰেণীটা মানুষের মধ্যেই পড়ে না।

মাইকেলোভিচের কথকতাও একটা ছোট গন্ডিতে বাঁধা। মহান অর্কেস্ট্রাবাদক, ব্যালে নর্তকী, সুখ্যাত কম্পোজার আর তাদের কাজের প্রতি অমর ক্ষুধাই তার কথার ক্ষেত্র। কিন্তু মিউজিকের সাথে নিজস্ব হাস্যরস আর কথার জাদুকে এমনভাবে মেশাতে জানে সে, যার ফলে সব সময় বাড়তি সময় দিতেই হয়।

আর কর্নেল গ্রীনবার্গ সারাক্ষণ মহাকাশ চষে বেড়াচ্ছে টেবিলে বসে থেকেই। বুধের তপ্ত দক্ষিণ মেরুতে ল্যান্ড করার ঘটনা এতোবার এ টেবিলের সবাই সংবাদ মাধ্যমগুলোতে শুনেছে যে নতুন করে এ নিয়ে কিছু শোনার নেই।

সাধারণত প্রতিদিন তারপরই সবার আকর্ষণ চলে যায় একটা প্রশ্নের দিকে, ফিরব কখন বাড়ি?

এবং সাথে সাথেই জবাব আসে কারো না কারো কাছ থেকে, আসলেই কি তোমরা বাড়ি ফিরতে চাও?

তারা বললে আমি অবশ্যই যাব। আজকে বলল গ্রিনবার্গ, কিন্তু চিন্তা করে দেখ, বুধের বেলায় একই ব্যাপার হবে। চাঁদে আমরা প্রথম যাই উনিশো উনসত্তুরে। তারপর পঞ্চাশ বছর পা বাড়াইনি। এখন? অবশ্য বুধকে চাঁদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বলা যায় না, কিন্তু অর্ধশত বছর পরে? পানি নেই, তা সত্যি। কিন্তু কে জানতো চাঁদের উপর পানি পাওয়া যাবে… নাকি বলতে হবে চাঁদের ভিতর?

মার্কারীতে নামার মতো অ্যাত্তো বিখ্যাত না হলেও অ্যারিস্টার্কাসে মিউল-ট্রেন বসানো আমার জীবনের এক বিশাল অভিজ্ঞতা।

মিউল-ট্রেন?

হুম! নিরক্ষীয় অঞ্চলের বড় উৎক্ষেপকটা বসানোর আগে বরফ এমন সোজা কক্ষপথে ছুঁড়ে দেয়া যেত না। আমাদের সময়ে বরফকে বয়ে আনতে হত ইম্বিয়াম স্পেস পোর্টে। তার মানে কিন্তু খুব জটিল। লাভায় ঢাকা এবড়োথেবড়ো বিস্তীর্ণ এলাকা সমান কর, জ্বালামুখ আর উপত্যকাগুলোয় বসাও ব্রিজ। অনেক ঠেলা সামলে আইস রোড বানালাম। নামটা সুন্দর না? শুনতে মনে হয় মাত্র তিন শত কিলোমিটার, কিন্তু গড়ার সময় অনেক জীবন কেড়ে নেয় এটা…

খচ্চরগুলো আসলে আট চাকার বিশাল ট্রাক্টর। একেকটা টায়ার বিকট-দর্শন এবং চলাচলও স্বাধীন। একশ টন বরফ ভরা ডজনখানেক ট্রেইলার টেনে নিতেও তাদের তেমন কষ্ট পোয়াতে হয়নি সেসময়ে। চলত রাতেই, ঢাকনার প্রয়োজন হত না তাই।

সেগুলোতে চড়েছি অনেকবার। যাত্রাতে ছঘণ্টা লেগে যেত গড়পড়তা। হাজার হলেও, স্পিড রেকর্ড ভেঙে ফেলার কোনো ধান্ধা থাকত না আমাদের মনে। নিয়ে আসার পর বরফটা ইয়া পেটমোটা এক প্রেশার ট্যাঙ্কে ফেলে সূর্যোদয়ের আশায় বসে থাকা।

গলে যাবার সাথে সাথেই স্পেসশিপগুলো শুষে নেবে।

আইস রোড এখনো সচল। কিন্তু ব্যবহার করে শুধু ট্যুরিস্টরা। তারা যদি কোনো পুরনো ঘ্রাণ খুঁজতে চায় তো রাতে চড়লেই সবচে ভাল করবে, নাহলে মেকি হয়ে যাবে তাদের ভ্রমণ। মাথার উপর বিশাল পৃথিবী নির্দ্বিধায় আলো বর্ষাচ্ছে, একে জোছনা বলা যায় না। আপন মনে হয়, যেন আপনজন পাঠাচ্ছে দূরের আত্নীয়ের খাতিরে। আমরা প্রায়ই লাইট ব্যবহার করতাম না। এমনকি নিয়মিত চেক আউটের জন্য বন্ধুরা যদি রেডিও যোগাযোগের চেষ্টা করত তাহলে আমরা অটো জবাবের হাতে ছেড়ে দিতাম। একা থাকতে চাওয়াটা দোষের কিছু নয়, তার উপর চলন্ত অবস্থায় আকাশে পৃথিবীকে দেখতে কেমন লাগে তা পৃথিবীর চন্দ্রিমাপ্রিয় লোকজন বেশ বলতে পারবে।

এখন সেখানে টেরাভোল্টের কোয়ার্ক ভাঙার কল বসানো হচ্ছে। নিরক্ষীয় অঞ্চলেই। তার উপর আবাসিক ডোমে ডোমে ছেয়ে গেল চাঁদের বুক। কিন্তু আমরা একেবারে নিখাদ চন্দ্রদেবীকে দেখেছিলাম-কুমারী, অসূর্যস্পর্শা। ঠিক যেমন দেখেছে নিল আর্মস্ট্রং আর অনি, ঠিক তেমন-আপনাদের বর্তমান ঐ কী যেন বলে, ট্রাংকুইলিটি বেস থেকে “যদি তুমি থাকতে হেথায় টাইপের কার্ড কেনেন, তেমন স্যুটকোট পরা চাঁদ নয়।

৪০. পৃথিবীর দানবেরা

…শত জন্মের কোন্ পূণ্যে যেন তুমি বাৎসরিক ভোজনটা মিস করেছ। বিশ্বাস করতে পার আমার কথায়, একেবারে গতবছরের মতোই বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা এবারও। এবং আবারও আমাদের প্রিয় হস্তিনী মিসেস উইলকিনসন তার ড্যান্স পার্টনারের পা জীবনের তরে বিকল করে দিয়েছে হাফ-জি ড্যান্স ফ্লোরের উপর নেচেই।

“পরচর্চা অনেক হল, কাজের কথায় আসি। তুমি হপ্তা কয়েকের বদলে মাসের পর মাস বাইরে থাকবে শুনে প্রশাসন তোমার ফ্ল্যাটের দিকে কুনজর দিচ্ছে। তোমার ফ্ল্যাটের অবস্থানটা হাজার হলেও, আকর্ষণীয়, ডাউন টাউনের খোলামেলা পরিবেশ-সেইসাথে পৃথিবী দেখার লোভ। ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে, তুমি ফেরার আগ পর্যন্ত সাবলেট দেয়ার তালে আছে। প্রস্তাব শুনে খারাপ লাগেনি, অনেক পয়সাকড়ি আসবে তোমার, মুফতে, কী বল? যে কোনো পার্সোনাল ব্যাপারে কথা জানার থাকলে বলবে, সগ্রহ করব…

“এখন, শাকা না কী ছাই নিয়ে কথা উড়ছে হাওয়ায়। আমি জানি, তুমি ঠ্যাঙ ভেঙে দেয়ার কাজ বেশ পছন্দ করেই কর। কিন্তু সত্যি, আমি আর জেরি সিম্পলি ভয় পেয়ে গেছিলাম। বোঝাই যায় কেন ম্যাগি মবালা তাকে এমন ঠেস দিল, তার অলিম্পাসের পিপাসা পড়েছি আমরা প্রায় সবাই। বইটা একটু বেশি নারীবাদী, আমাদের জন্য…

“কী দানবরে বাবা! বোঝাই যায় কেন তার পেছনে আফ্রিকান গুন্ডা লেলিয়ে দিয়েছিল কেউ একজন। কী হিংসুটে! দলের কোনো যোদ্ধা বিয়ে করলেই সোজা ফাঁসিকাষ্ঠে। তার এলাকায় কোনো গরুও ছিল না-একমাত্র দোষ ওগুলো ফিমেল । আর তার আবিষ্কার করা স্পিয়ারগুলো কী ভয়ংকর ছিল, চেনা অচেনা যে কোনো মানুষের গলায় ফুঁ দিয়ে গেঁথে দিত বিষাক্ত ছোট্ট তীর, বেশিদূর থেকে দেখলে মনে হবে নলটা কোনো চুরুট… ।

“আর আমাদের জন্য কী লজ্জাজনক প্রচারণা, আল্লা মাবুদ! কোনো মানুষকে হিংস্র করার জন্য যথেষ্ট। আমি সব সময় দাবী করে আসছি যে আমরা ভদ্র, সদয় (এবং পাগলের মতো মেধাবী ও সৃষ্টিশীল, অবশ্যই। আর আজকে কিনা তোমরা আমাদের চোখের সামনে তথাকথিত যোদ্ধার স্পিরিট আনতে চাচ্ছ! যেন মানুষ মারার মধ্যে মহান কোনো ভাব লুকিয়ে আছে। আমরা আমাদের এই সঙ্গত কারণেই লজ্জিত..

“হ্যাঁ, আমরা হ্যাঁড্রিয়ন আর আলেকজান্ডারের কথা জানি ঠিকই; কিন্তু অবশ্যই রিচার্ড দ্য লায়ন হার্ট আর সালাদিনের গল্পটা ভুলে যাবার চেষ্টা করি এবং হারিয়ে ফেলি। ভুলে যাই জুলিয়াস সিজারের কথা-অবশ্য অ্যান্টনি আর ক্লিও সে কথা ভুলতে দেয় না। অথবা ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের কাহিনীগুলো…

যখন জেরিকে বললাম যে অন্তত নেপোলিয়ন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ তখন তার বলা সেই উক্তির কথাও মনে করিয়ে দিই। আমি বাজি ধরতে রাজি যে যোসেফাইন আসলে একটা ছেলে ছিল। ব্যাপারটা ইভার উপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করো।

“তুমি আমাদের মনোবল গুঁড়িয়ে দিলে! হতভাগা। আমাদের অবহেলা করে খুশি রাখাই উচিত ছিল তোমার…

এবং, এতোকিছু সত্ত্বেও আমি সেবাস্টিয়ানের মতো ভালবাসা পাঠালাম। যে কোনো ইউরোপানের সাথে দেখা হলেই শুভেচ্ছা জানিও। গ্যালাক্সির পাঠানো রিপোর্ট দেখে মনে হল তারা মিসেস উলকিন্সের সাথে বেশ খাপ খাবে।

৪১. অশীতিপরের জীবনকথা

এম্নিতে ড. ফ্লয়েড বৃহস্পতির প্রথম মিশনটার কথা বলতে চায় না সব সময়। এবং দশ বছর পরে, লুসিফার অভিযানের কথাও তার পেট থেকে বেরোয় না।

কারণও আছে, কংগ্রেশনাল কমিটি, স্পেস কাউন্সিল বোর্ডগুলো আর ভিক্টর উইলিসের মতো মিডিয়ার লোকের কাছে সে প্রতিটি পল অনুপলের কথা নানা সুরে নানা সময়ে কমপক্ষে একশোবার করে বলেছে।

তারপরও তার সাথীদের প্রতি একটু দায়িত্ব আছে তার, সেটা এড়ানো কঠিন। নতুন এক নক্ষত্র আর সৌর জগতের সৃষ্টিকালে নিজের চোখে যে কজন ব্যাপারটা দেখেছে তাদের মধ্যে একমাত্র জীবিত ব্যক্তিটিকে তারা সে সময়ের কথা শোনার জন্য চাপাচাপি করতেই পারে; বিশেষত যখন তারা সেই লক্ষ্যটার দিকে অনির্বচনীয় গতিতে এগুচ্ছে।

এই গ্যালিলীয় জগতের গ্রহ-উপগ্রহের নাড়ী-নক্ষত্রের খবর সে সেখানে কাজ করা ইঞ্জিনিয়ার আর বিজ্ঞানীদের চেয়ে অনেক কমই বলতে পারবে। যখন প্রশ্ন উঠল, ইউরোপায় থাকাটা আসলে ঠিক কেমন? (অথবা গ্যানিমিডে, বা আইওতে, কিংবা ক্যালিস্টোতে…)

সে নাঙা গলায় প্রশ্নকর্তাকে শিপের লাইব্রেরির রিপোের্ট ঘাটতে বলে সাথে সাথে । কিন্তু এখনো একটা ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা আর সবার চেয়ে এগিয়ে। আজ অর্ধশত বছর পরে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সেই অনির্বচনীয় অপার্থিব অভিজ্ঞতাটাকে। ডিসকভারিতে ডেভিড বোম্যান আসার সময় সে কি আসলেই জেগে ছিল, দেখেছে সেসব ঘটনা? ব্যাপারটা ভেবে নেয়া খুবই সহজ যে দশ বছরের পরিত্যক্ত ধুলোমলিন স্পেসশিপ ভুতুড়ে হয়ে যেতে পারে….

কিন্তু, সে তখন ঘুমায়নি-মানে ঘুমাতে পারে না। স্পষ্ট, সে দেখল সেই মানুষটার মুখ-যে এই বিরান আকাশে হারিয়ে গেছে একযুগ আগেই, দেখল কামরার সবটুকু ধুলাকে একত্রিত হতে, দেখল ভেসে থাকা ধূলিকণা মিলেমিশে কী করে ত্রিমাত্রিক একটা মুখ-অবয়ব গড়ে তোলে।

অস্বীকার কী করে করে সে? সেই মুখের সাবধানবাণীতেই পুরো লিওনভ আর তার সমস্ত ক্রু বৃহস্পতি-বিস্ফোরণের হাত থেকে বেঁচে যায়। এখনো কী স্পষ্টভাবে তার মনে পড়ে, ঠোঁটগুলো একেবারে অনড় ছিল, আর শব্দ এসেছিল স্পিকার কনসোল থেকে!

এক ডিনার টেবিলে বসে অবশেষে একদিন মুখ খুলল অশীতিপর ডক্টর হেউড ফ্লয়েড, খুলে গেল আধ-শতাব্দীর বন্ধ দুয়ার।

“কেন সে করল কাজটা, কেন? আজ পঞ্চাশ বছর, আমি প্রশ্নটা বুকে নিয়ে মরছি। সে ডিসকভারির স্পেসপোড নিয়ে মনোলিথটা দেখতে বেরুনোর পর যা-ই হয়ে গিয়ে থাকনা কেন, মানুষের সাথে কোথায় যেন তার একটা সম্বন্ধ থেকে গেছে। তখনো একেবারে ভিন্ন সত্তা হয়ে যায়নি। তার সেই পৃথিবী ভ্রমণ থেকেই কথাটার প্রমাণ মেলে। ভ্রমণটা ছোট ছিল, কিন্তু প্রমাণ ছিল অনেক। তার মধ্যে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটা সবচে শক্ত। সে তার মা আর পুরনো গার্লফ্রেন্ডের বাসায় যায়, এমন প্রমাণও নিশ্চিত। যা-ই হয়ে থাক না কেন সে, তার আবেগ উবে যায়নি।

কী মনে হয়, সে এখন কী হয়ে গেছে? প্রশ্ন তুলল উইলিস, বহু পুরনো প্রশ্ন, আর, কোথায় আছে এখন?

হয়তো শেষ প্রশ্নটার কোনো অর্থ নেই-এমনকি মানুষের ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। তোমার সচেতনতা ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে তা কি তুমি জান?

আমি অধিভৌতিকতা নিয়ে কোনো দর্শন কপচাচ্ছি না। সচেতনতা? আমার ব্রেনের কোনো না কোনো স্থানে, হয়ত।

আমি যখন তারুণ্যে টগবগ করছি, যেন লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠল বাদ্যযন্ত্রবিদ মাইকেলোভিচের চেহারা, যে সব সিরিয়াস আলোচনায় আসল কথাটা বলে বসে, তখন আমারটা মাথা থেকে মিটারখানেক নিচে ছিল…।

আচ্ছা, ধরে নিই সে এখন ইউরোপায়। আমরা জানি ঐ মরার জায়গাটাতেও একটা মনোলিথ ঘাপটি মেরে বসে আছে। ধরা যাক সে কোনো না কোনো মহাসাগরের প্রতিনিধিত্ব করছে, ওয়ার্নিংটা কীভাবে প্রচার করল তা নিয়ে একটু কথা বলা যাক।

তোমার কি মনে হয় সে দ্বিতীয় সাবধান বাণীটাও উচ্চারণ করেছে, আমাদের দূরে থাকতে বলে?

যে সাবধানবাণীটা আমরা থোড়াই পরোয়া করতে যাচ্ছি।

-বেশ ভাল একটা কারণ থাকাতে

ক্যাপ্টেন স্মিথ সাধারণত আলোচনাটাকে গন্তব্যের দিকে নিয়ে যায়। কখনো যা করে না সেটাই করল এবার, কথা বলে উঠল মাঝ থেকে।

“ড. ফ্লয়েড, আপনি এক অসাধারণ পর্যায়ের মানুষ, আর সেই সুযোগটা নেয়া উচিত আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। একবার বোম্যান আপনাকে সাহায্য করতে এসেছিল। আশপাশে থেকে থাকলে আবারও সে একই কাজ করবে বলে আমার ধারণা। আমি সেই–এখানে নামার কোনো চেষ্টাই করো না–আদেশ নিয়ে চিন্তিত। সে যদি একবার জানায়, আদেশটা সাময়িকভাবে স্থগিত হয়েছে, তাহলে নিশ্চিন্ত হই।

ফ্লয়েড জবাব দেয়ার আগেই শুনে নাও, পুরোটা শুনে নাও ধ্বনি উঠল আশপাশ থেকে।

আমিও একই পথ ধরে হাঁটছি। আমি এরই মধ্যে গ্যালাক্সিকে বলেছি-যেকোনো, যেকোন-অস্বাভাবিক ব্যাপারের দিকে নজর রাখ। যদি সে যোগাযোগের চেষ্টা করে।

অবশ্যই, বলল ইভা, সে এরিমধ্যে মরে গেছে যদি ভুতেরা আদৌ মরে।

এমনকি মাইকেলোভিচও এ কথার যুতসই জবাব পেল না। কিন্তু যথারীতি আর সবার চেয়ে আগে পাগলাটে কথাটা বলে বসেছে অভিযাত্রী।

কিন্তু তার যেন আজ জোয়ার এসেছে।

উডি, ডিয়ার, সে বলল স্বাভাবিক কণ্ঠে, তুমি কেন তাকে রেডিওতে একটা কল করছ না? এ কাজের জন্যই রেডিওটা বানানো হয়েছে, তাই নয় কি?

আইডিয়াটা ফ্লয়েডের কাছে ভাল লাগল। রেডিও দিয়ে সৌরজগৎ এফোড় ওফোড় করে ফেলা সম্ভব। তাতে, সত্যি যদি সাবেক কমান্ডার, বৃহস্পতি জগতে পা রাখা প্রথম জীবিত মানব ডেভিড বোম্যানের অস্তিত্ব এ জগতের কোথাও থাকে, সে বুঝতে পারবে, ঠিকই বুঝবে। কিন্তু ইভার খোঁচাটাকে তেমন গুরুত্ব দিল না সে।

ডাকব। আশা করি তাতে কোনো বিশেষ ক্ষতি হয়ে যাবে না।

৪২. ঘুমঘোরে এলে মনোহর

এবার ফ্লয়েড একেবারে নিশ্চিত; সে স্বপ্ন দেখছিল…

সে এই জীবনে কখনো ভালভাবে ঘুমাতে পারেনি জিরো গ্র্যাভিটির শিকার থাকা অবস্থায়। এখন, ইউনিভার্স সর্বোচ্চ গতিতে চলছে, কিন্তু ইঞ্জিন বন্ধ। তাই মাধ্যাকর্ষণও অনুপস্থিত। এই গতির কারণে অনেক সময় লাগবে থেমে যেতে। সপ্তাহখানেক সময় নিয়ে থামবে স্পেসশিপটা, তারপর মিলিত হবে ইউরোপার সাথে ।

জীবনভর সে বাঁধার বেল্ট এটে নিয়েছে শরীরের সাথে, এবং জীবনভর সেগুলো হয় অতি শক্ত নয় অতি নরম হয়ে এটে গেছে-কখনো ঠিকঠাক থাকেনি। হয় শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মরার যোগাড় হয় নয়তো জেগে দেখে নিজের শরীর ভাসছে বাঙ্ক জুড়ে।

একবার দেখে ভাসছে কোথায় যেন, দেখেও বোঝা যায়নি। পরে দেখা গেল ভেন্টিলেটরের কাছাকাছি। কারণ সেখানে একটু হলেও বল কাজ করে। জেগে প্রতিবারই নিখাদ আতঙ্ক ছাড়া আর কোনো অনুভূতি হয়নি সেসব বিরক্তিকর সময়ে। একজন সত্যিকার অনিয়মিত মহাকাশযাত্রী হিসেবে সব সময় তার এসব ভেজাল পোয়াতে হয়।

কিন্তু আজ রাতে তার সবই ঠিকঠাক ছিল-অম্ভত দেখেশুনে তেমনি মনে হয়। বরং ওজন ফিরে এলে সে ওজনে অভ্যস্ত হতে সময় নেবে। ডিনারের আলাপ আলোচনার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে গেল কখন, সে বলতেও পারবে না।

স্বপ্নে সে টেবিলের কথা চালিয়ে গেল। যথারীতি অবাক করা কিছু উপাদান ছিল স্বপ্নটায়, উইলিস নিজের দাড়ি ফিরে পেয়েছে টাইপের, তাও আবার মুখের একপাশে। স্বপ্নে মানুষের যে ক্ষমতাটা কেড়ে নেয়া হয়, তার নাম অবাক হওয়া। সে মোটেও অবাক হয়নি কারবার দেখে। যেন উইলিস নিত্যদিন আধমুখ দাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ফ্লয়েডের মনে হল কোনো এক রিসার্চের কাজে তাকে এমন মুখ করতে হয়েছে-কিন্তু কেন আল্লা মালুম। সম্ভবত হেলমেটের ব্যবহার মনে পড়ে গেছে, অবচেতন মন সেটাকেই অর্ধেক করে দেখাচ্ছে।

কিন্তু তার সেই পুরনো ব্যথাগুলো ফিরে এসেছে। সে স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মিলসনের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে জারজার হচ্ছে। কীভাবে যেন লোকটা এখানে এসে এই ছোট্ট পার্টিকে কলঙ্কিত করল। মিলসন চল্লিশ বছরেরও আগে মারা গেছে, তথ্যটার যেন কোনো গুরুত্বই নেই।

হেউড, তার পুরনো শত্রু খুশিমনে বলছে, হোয়াইট হাউস তোমার উপর মোটেও খুশি নয়। মহা নারাজ।

আমি ভেবে পাই না কেন তারা আমার উপর নারাজ হতে যাবে।

যে রেডিও মেসেজটা তুমি এইমাত্র ইউরোপার দিকে পাঠালে সেটার কারণে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়েছ?

প্রয়োজন বোধ করিনি। সহজে আমি মাটি থেকে আদেশ কুড়াই না।

ও! কিন্তু সেটাই তোমাকে এখন কুড়াতে হচ্ছে। কাকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলে তাহলে? আমরা কি একটুও বুঝতে পারছি না যে সরকার প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন বর্তমানে? কী জানি, এতো সবকিছু অগোছালো থাকলে…

মিলসন ভদ্র ভাষায় গালাগালি করতে করতে হারিয়ে গেল… আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া, স্বপ্ন দেখছি। এখন কী দেখব আবার?

ভাল। হয়ত আমি এটাই আশা করছিলাম। হ্যালো, ওল্ড ফ্রেন্ড! তুমি সব আকৃতি নিয়েই এসেছ, আসনি কি? আমি নিশ্চিত, টি এম এ-১ ও আমার কেবিনে গা গলাতে পারবে না। আর তার বড় ভাইতো উল্টো পুরো ইউনিভার্সকেই এক লহমায় গিলে নিতে পারবে, আমার কেবিনে আসবে কী?

তার বাঙ্ক থেকে মাত্র দু মিটার দূরে কালো মনোলিথটা দাঁড়িয়ে আছে, অথবা আছে ভেসে। হঠাৎ, আহত হয়ে ফ্লয়েড দেখল, শুধু আকৃতিতে নয়-আকারেও জিনিসটা অতি সাধারণ কবরফলকের মতো। এ মিলের কথা তার কাছে অনেকেই বলেছিল এককালে; কিন্তু চোখের সামনে দেখে ব্যাপারটাকে অন্যরকম লাগছে-বাস্তব বাস্তব। এই প্রথমবারের মতো সে দেখল, মিলটা শুধু অস্বস্তিকরই নয়, বরং ভয় ধরানো।

আমি জানি, এ এক ড্রিম, কিন্তু এ বয়সে আর নতুন করে সাবধানবাণী শুনতে চাই না…

যাই হোক, কী চাই তোমার এখানে? তুমি কি ডেভ বোম্যানের কাছ থেকে কোনো খবর নিয়ে এসেছ? তুমিই কি ডেভ বোম্যান?

যাক, আমি কিন্তু আসলে কোনো জবাব চাই না। অতীতে তুমি খুব একটা বাঁচাল ছিলে না-নাকি মিথ্যা বললাম?

কিন্তু তোমার দেখা পেলেই সব ভজঘট হয়ে যেত।

টাইকোতে, আজ থেকে ষাট বছর আগে, তুমি বৃহস্পতির দিকে চিৎকার করে তোমার স্রষ্টাদের জানিয়েছিলে, আমরা উন্নত, আমরা ফুল ফুটিয়েছি মরুর বুকে।

আর দেখ, একযুগ পরে বৃহস্পতির দিকে যখন গেলাম, সেটার কী হাল করলে এই তুমিই!

এখন, ঠিক এখন, তুমি কোন্ ভাঙনের পথে এলে, সুপ্ত রাতে?

৬. স্বর্গ

ষষ্ঠ পর্ব – স্বর্গ

৪৩. ডোবা জাহাজের সম্পদ উদ্ধার

ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাসের গোছানোর বিষয়ের মধ্যে প্রথমেই চলে আসে ক্রুদের গুছিয়ে নেয়ার কথা। তার কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল এলোপাথাড়ি পড়ছে পুরো শিপের উপর। কোথায় যেন সুর কেটে যাচ্ছে বারবার। গ্যালাক্সির সবকিছুই ভুল পথে চলছিল।

স্পেসশিপ দুভাবে চালানোর জন্য ডিজাইন করা হয়। হয় একেবারে ওজনশূন্যতায়, নয়তো ইঞ্জিন ব্রাস্টিংয়ের সময়। অক্ষের উপর-নিচে ব্যাপারটা সাজানো থাকার কথা। কিন্তু এখন শিপ পুরোপুরি উলম্ব হয়ে আছে। কাজেই ফ্লোরগুলো পরিণত হল দেয়ালে। ব্যাপারটা এমন, কোনো শুয়েপড়া বাতিঘরে যেন বসবাস করার চেষ্টা করছে কর্মচারীরা। শোয়া লাইটহাউস যেমন বেমানান, তেম্নি খাড়া গ্যালাক্সিও মানায় না। প্রতিটি আসবাব সরাতে হয়েছে, যন্ত্রপাতির অর্ধেকই কোনো কাজে আসছে না।

তারপরও, এ যেন ছদ্মবেশী আশীর্বাদ। আশীর্বাদটা যেন যোগাড় করেছে ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস নিজে। গ্যালাক্সির ভেতরটা ঠিক করতে করতেই জুরা গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছিল। কাজের চাপে জান বেরিয়ে যাবার দশা, আত্মবিশ্বাসের মতো বায়বীয় কোনো ব্যাপারে ভাবার ফুরসতই মিলছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত তরীর গা অক্ষত আছে, মিওন ড্রাইভ শক্তির যোগান দিয়ে যাচ্ছে অবিরত, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো তাৎক্ষণিক বিপদের ভয় নেই। আর মাত্র দিন বিশেক গুনে গুনে কাটিয়ে দিতে হবে, ব্যস। তারপর ভাগ্য-শশী রূপে আকাশে আবির্ভূত হবে ইউনিভার্স।

কেউ কথাটা তুলল না। যে অদৃশ্য শক্তি ইউরোপাকে রক্ষা করছে সে এখানে দ্বিতীয় কোনো অবতরণে বাধা দিতে পারে। তারা বোধহয় শেষপর্যন্ত নাক গলাবে না। একটা ক্ষমার মিশনে তাদের নাক গলিয়ে মানুষের নাকে আবারও খত দেয়ানোতে লাভটা কী…।

ইউরোপা নিজে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় অবতরণের ঘটনায়।

সাগরের বুকে ভাসার সময় গ্যালাক্সিতে তার অসন্তুষ্টির নমুনা দেখিয়েছে ঝড় তুলে। আর এখন মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসার পর ভূমিকম্প সমস্যা করছে সারাক্ষণ। ফলে আত্মবিশ্বাসের উচ্চতাকে খাটো করে ফেলছে এই গাঠনিক চিরায়ত ভূকম্পন। কাপ ধরিয়ে দিচ্ছে কারো কারো অন্তরাত্মায়।

মাটির ঝাঁকাঝাঁকিটা যতনা ক্ষতিকর তারচে ঢের বেশি ভয় পাইয়ে দেয়। বিশেষ করে যারা টোকিও ৩৩ বা লসএঞ্জেলস ৪৫ আর্থ কোয়েকের শিকার তাদের কথাতো বলাই বাহুল্য।

এখন তারা জানে আইও এ উপগ্রহের ভিতরের দিকের অর্বিটে এলে কাঁপুনিটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়, তারপর আবার কমে, ঠিক ঢেউয়ের মতো-কিন্তু জানাটা ভয় কমাতে পারছে না। এই জানাটাও স্বস্তি দেয় না যে ইউরোপার নিজস্ব আকর্ষণ ক্ষেত্র আইওতেও সমান ক্ষতি করতে পারে।

ছদিনের মাথা খারাপ করা কাজের পর ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস মোটামুটি সন্তুষ্ট হল; শিপকে একটা গড়পড়তা নিরাপদ আকৃতি দেয়া গেছে। গ্যানিমিডের লোকজন যে রাডার ম্যাপ পাঠিয়েছে সে অনুযায়ী দ্বীপটা লম্বায় পনের কিলোমিটার, প্রস্থে পাঁচ; এর গাঠনিক বিবর্তন বড়জোর একশ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। এরচে ভিতরে চলে গেলেই নিরাপদ। কিন্তু খুব একটা উঁচু নয় দ্বীপটা। যে কেউ হঠাৎ আসা সুনামির ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে পারে।

এ জায়গাটা একেতো নিষিদ্ধ অঞ্চলে জেগে উঠেছে, তার উপর ন্যাড়া দ্বীপের অর্ধেকই আগ্নেয় শিলায় গঠিত। লাভার স্রোত এখনো পথ এঁকে রেখেছে পাথরের বুকে। এক কথায় নামকরণের কথা কারো মাথায় আসেনি অর্ধশত বছরেও; কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। এখন এটাই তাদের বাড়ি; আর বাড়িটা যেমনই হোক কেন-সুন্দর একটা নাম চাই-ই চাই।

মনমরা নামগুলো সরাসরি ভেটো দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে ক্যাপ্টেন- পাতালপুরী, নরক, কবর টাইপের নাম চলবে না। উৎসাহব্যঞ্জক কিছু চাই।

কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না ক্রুদের। বত্রিশটা নাম ফিরিয়ে দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাসও।

ক্যাপ্টেন, আপনি নিশ্চই আশা করেন না স্বর্গের বুকে কোনো গোলাপ-বাগানে হাঁটাহাঁটি করছেন? নামটা নিশ্চই গোলাপ-বাগান রাখবেন না? কেউ একজন খোঁচা দিল, না পেরে।

গোলাপ বাগান বানানো যায় কিনা তা পরের কথা, তারচে বড় কথা, রোজ শব্দটার কথা মনে পড়ে যায় এমন কোনো নাম রাখা সম্ভবই না! বরং “স্বর্গ টাই ভাল। গোলাপ নাহয় পরেই ফুটল।

৪৪. ধৈর্য

ইতিহাস কখনো নিজের পুনরাবৃত্তি করে না-কিন্তু ঐতিহাসিক অবস্থা বারবার o ফিরে আসতে পারে।

গ্যানিমিডে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় কথাটা নিয়ে ভাবছে ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস। ইউনিভার্স থেকে কোট করে বলেছিল ম্যাগি মবালা। এখন প্রতি সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটারের চেয়েও বেশি গতিতে তাদের কাছে আসছে ইউনিভার্স, তাদের জন্যই।

“মিস ম্যাগিকে বলবেন, তার ছোট্ট ইতিহাস-শিক্ষাটা মনোবলের জন্য দারুণ ওষুধের কাজ দিয়েছে। এরচে সুন্দর কোনো কথা তিনি আমাদের জন্য পাঠাতে পারতেন না…

“আমরা দেয়াল আর মেঝেগুলোকে ঘুরিয়ে টুরিয়ে নিয়ে এমন হাল করেছি যে এখন দেখে যে কেউ থাকাটাকে বিলাস বলতে পারে। ঠিক যেন মেরুদেশে শখের অভিযানে বেরুনো পুরনোদিনের মানুষজন। আমাদের কেউ কেউ আর্নেস্ট শ্যাকলটনের নাম শুনে থাকলেও তার ধৈর্য মহাকাব্যের নাম জানে না। বরফ প্রবাহে এক বছরেরও বেশি সময় আটকে থেকে মেরুতে একটা হাড় জমানো শীত কোনোমতে বরফ-গুহায় আটকে থেকে কাটিয়ে দেয়া; তারপর খোলা নৌকায় করে হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অচিহ্নিত পর্বত চিনে নিয়ে সবচে কাছের লোকালয়ে ফিরে যাওয়া!

“কিন্তু এতো মাত্র শুরু। সবচে অবিশ্বাস্য এবং উৎসাহজনক কথা হল, শ্যাকলটন সেই বিরানে ফিরে গেলেন চার-চারবার এবং স-ব লোকজনকে উদ্ধার করলেন নির্দ্বিধায়। বুঝতেই পারছেন বইটা আমাদের মনে কী প্রভাব ফেলে! আশা করি পরের ট্রান্সমিশনে ফ্যাক্স করে দিবেন; আমরা সবাই পড়ার আশায় মরে যাচ্ছি।

“তারপর তার কপালে কী হল! চিন্তা করতেও কষ্ট হয়। আমরাতো এখন তাদের চেয়ে অনেক অনেক ভাল আছি। পুরনোদিনেরর অভিযাত্রীরা কী কষ্টই না করতো! গত শতাব্দী পর্যন্ত, তারা একবার পাহাড়ের আড়ালে গেলেই হল, যোগাযোগের উর্ধ্বে; কী অবিশ্বাস্য কষ্ট! আর, আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত যে সারক্ষণ হা-পিত্যেশ করে মরছি-কেন আলোর গতি আরেকটু বেশি হল না! কেন আমরা বন্ধু-বান্ধবের সাথে রিয়েল টাইমে কথা বলতে পারি না! যত্তোসব! আর তাদের মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছরও মনুষ্য-পৃথিবীর সাথে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ থাকত না। আর আমরা পৃথিবী থেকে জবাব পেতে দু ঘণ্টা দেরি হচ্ছে বলে গলা শুকিয়ে মরে যাই। আবারও, মিস মবালা আর বিজ্ঞানীদলকে অশেষ ধন্যবাদ।

“অবশ্যই, পৃথিবীর সব অভিযাত্রী আমাদের চেয়ে একদিক দিয়ে বেশি সুবিধা পেতেন-অন্তত শ্বাস নেয়া যেত খোলা বাতাসে। বিজ্ঞানীদল একেবারে হন্যে হয়ে বাইরে যাবার উপায় খুঁজছে; আর স্পেসস্যুটগুলোও ছঘণ্টা বাইরে থাকার উপযোগী করে ফেলেছি।

আর, এই হল দুদিনের আবহাওয়া বার্তা। প্রেশার আড়াইশো বার, তাপমাত্রা পঁচিশ ডিগ্রিতে স্থায়ী, বাতাস পশ্চিম থেকে বেশ জোরেই বয়, মুক্ত-প্রান্তের রিখটার স্কেলে এক থেকে তিন মাত্রার কম্পন হয় সাধারণত…

“জানেন, আমি ঠিক মুক্ত-প্রান্তের কথাটাকে পছন্দ করি না-বিশেষত যখন আইও আবার এগিয়ে আসছে তখন…

৪৫. মিশন

ঘণ্টার পর ঘণ্টা তরুণ ফ্লয়েড আর সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ গুজগুজ করে ভ্যান ডার বার্গের সাথে। কী এতো কথা কে জানে! ভাবল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস; কিন্তু কী নিয়ে এতো কথা তা সে জানে।

মাউন্ট জিউসে যেতে চাও তোমরা! কীভাবে-একটা ভোলা নৌকায় করে? শ্যাকলটন বইগুলো কি তোমাদের মাথা খেয়ে বসল?

একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল ফ্লয়েড। ক্যাপ্টেনের কথাই সত্যি, আর সব দিকেরচে দক্ষিণ বেশি উৎসাহ দেয়। কিন্তু দমবার পাত্র নয় ক্রিস।

যদি কোনো নৌকা বানিয়েও বসি, স্যার, তবু অনেক সময় লেগে যাবে… বিশেষত এমন সময়ে। আর দিন দশেকের মধ্যে ইউনিভার্স চলে আসবে না?

তার উপর আমি নিশ্চিত নই,যোগ করল ভ্যান ডার বার্গ, এখনো নিশ্চিত নই যে এই গ্যালিলির সমুদ্রে নৌভ্রমণ করা কলজেয় কুলাবে কিনা, আমি ঠিক চাই কিনা তাও জানি না। সম্ভবত এর সব বাসিন্দা খবরটা পায়নি যে আমরা একেবারে অখাদ্য।

একটা মাত্র পথই খোলা, তাই না? তার মানে কথাটা শক্তিমান, এবং আমি প্রভাবিত হতে যাচ্ছি। বলে যান, বলে যান।

এ নিয়ে মি. চ্যাঙের সাথে বিস্তর কথা হল; বললেন, তিনি পারবেন কাজটা করতে। জিউস পর্বত মাত্র তিনশো কিলোমিটার দূরে। শাটলটা একটানে চলে যেতে পারবে, ঘণ্টাখানেক সময়ও লাগবে না।

তারপর একটা ল্যান্ড করার জায়গা খুঁজবেন? মনে আছে তো, মি, চ্যাঙ এ কাজে তেমন দক্ষতা দেখাতে পারেননি কদিন আগেই।

অসুবিধা নেই, স্যার। উইলিয়াম সুং আমাদের পুরো ওজনের এক শতাংশ মাত্র। এমনকি সেই বরফগুলোতেও নামা সহজ। তাছাড়া আরো ডজনখানেক ল্যান্ডিং সাইট দেখে রেখেছি।

কীভাবে? প্রশ্ন তুলল ক্যাপ্টেন।

ভিডিও দেখে।

তাছাড়া, যেন গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়ে গেল ভ্যান ডার বার্গের, পাইলটের মাথায় কোনো পিস্তল ধরা থাকবে না। এই চিন্তাটাও ঠিকমতো ল্যান্ডিংয়ে সহায়তা করবে।

শিওর, কেন নয়? কিন্তু আসল সমস্যা অন্য কোথাও। শাটল বের করবেন কীভাবে গ্যারেজ থেকে? একটা ক্রেন যোগাড় করতে পারবেন? এই গ্র্যাভিটিতেও লোডটা খুব বেশি হয়ে যাবে না?

প্রয়োজনই পড়বে না, স্যার। চ্যাঙ সহজেই উড়িয়ে বের করতে পারবে।

নিরবতা প্রলম্বিত হচ্ছিল; ক্যাপ্টেন জানে, উইলিয়াম সুংকে ডিজাইন করা হয়েছিল শুধু কক্ষপথে ব্যবহারের জন্য। ছোট্ট শাটলটার জনপ্রিয় নাম বিল টি। সাধারণত এটাকে গ্যারেজ থেকে ঠেলে বের করা হয়, তারপর মাদারশিপ থেকে অনেকটা দূরে না গেলে জেট চালানোর কথা মাথায় আনাই হয় না।

“বোঝাই যাচ্ছে, আপনারা অনেক খেটেখুটে সব ঠিক করে রেখেছেন প্রস্তাব দেয়ার আগেই। ভাল লাগছে কথাটা ভেবে। কিন্তু একটু ভাবুন, টেক অফ এ্যাঙ্গেল কী হবে? বিল টি কে ওড়ানোর জন্য দাঁড় করাতে হবে, এ আবার বলে বসবেন না যেন, এজন্য গ্যালাক্সিকে গড়িয়ে নিব। গ্যারেজের একপাশ মাটির দিকে, ভাগ্য ভাল-ঐদিকটা নিচে রেখে আমরা ল্যান্ড করিনি।

উপরের দিকে ষাট ডিগ্রি করে টেক-অফ করতে হবে। আশপাশের থ্রাস্ট দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

মি. চ্যাঙ বলে থাকলে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু আগুনে শিপের কী হাল হবে?

আসলে গ্যারেজের ভিতরটা দুমরে-মুচড়ে যাবে, কিন্তু তাতে কী, আদৌ আর কখনো সেটা ব্যবহার হবে না। ও, হ্যাঁ-বাল্কহেডগুলো অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণের কথা মাথায় রেখে বানানো হয়েছে। তাই জাহাজের বাকী অংশে কোনো আসর পড়বে না। আর, যদি অভিযানে যাই-ই, তো ফায়ার ফাইটিং ক্রুদের ভিতরের দিকে প্রস্তুত রাখব, বাড়তি সাবধানতা-আর কী!

ধারণাটা দারুণ, যদি জিউসের পর্বত ঘুরে আসা যায় তো পুরো অভিযানকে ব্যর্থ বলা যাবে না।

গত এক সপ্তাহে সবার উপর যে ঝড় গেল তাতে ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস পাহাড়টার রহস্যের দিকে চোখ ফেরানোর ফুরসতই পায়নি; চাচা, আপনা পরান বাঁচা টাই ছিল আসল ধান্ধা।

কিন্তু এখন বেঁচে যাবার আশা জাগছে; কাটছে অনিশ্চয়তা, গুছিয়ে আনা গেছে নিজেদের অনেকটাই-যথারীতি ভাবার মতো সময় হাতে পাওয়াতে নতুন চিন্তা দানা বাঁধছে।

যে মাউন্ট জিউস নিয়ে এতো কল্পনা-অতিকল্পনা তাকে দেখার চান্স কে মিস করে!

এখন, ভাবনার সময় পাওয়া মানেই আবারও ঝুঁকি নেয়ার সুযোগ। সুযোগ কে আর হাতছাড়া করে, নেয়া যাক আরো কিছু ঝুঁকি-মাথা পেতে।

৪৬. শাটল

স্মৃতি থেকে বলছি কথাগুলো, ড. অ্যান্ডারসন কথা পাড়ছে আসরে, গদারের প্রথম রকেটটা মিটার পঞ্চাশেক চলেছিল টেনেটুনে; আল্লা মাবুদ জানে মি. চ্যাঙ রেকর্ডটা ভাঙতে পারবেন কিনা।

আরো ভালোও হতে পারে-কিংবা কে জানে, হয়তো সবাই মহা গায় পড়বে।

সায়েন্স টিমের প্রায় সবাই অবজার্ভেশন লাউঞ্জে জড়ো হয়েছে। চোখ অস্থির, শিপের গায়ের শেষপ্রান্তে কী হয় তা নিয়ে চিন্তিত। এখান থেকে গ্যারেজটা দেখা না গেলেও অসুবিধা নেই, বিল টি বেরিয়ে যেতে নিলে, (যদি আদৌ বেরোয়…) ঠিকই দেখা যাবে।

কাউন্ট ডাউন বলে কিছু নেই; যথেষ্ট সময় নিচ্ছে চ্যাঙ, সম্ভাব্য সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিচ্ছে শেষ মুহূর্তে-একেবারে নিশ্চিত বোধ না করলে ফায়ার করবে না। শাটলকে যথাসম্ভব হাল্কা করে নেয়া ছিল আগেভাগেই। একশ সেকেন্ড ওড়ার মতো প্রোপ্যাল্যান্ট নিয়ে উড়বে। সব ঠিকমতো চললে সমস্যা হবে না, কিন্তু যদি কোনো সমস্যা হয়েই যায়-ঠেকানোর উপায় নেই।

হোয়ার উই গো… সপ্রতিভভাবে বলল চ্যাঙ।

এ এক পুরনো ট্রিক। এ কৌশলে সহজেই টেনশনকে বিকল করে দেয়া যায়; চোখের পলক পড়তে না পড়তেই ঘটনা যা ঘটার ঘটে গেল।

কেউ বিল টি কে বেরুতে দেখেনি। দেখবেই বা কীভাবে, মুহূর্তের মধ্যে চলে গেছে সেটা চারদিকে ধোঁয়া আর বাষ্পের জমাট আস্তর রেখে । মেঘ সরতে সরতে দেখা গেল দুশ মিটার দূরে ল্যান্ড করছে খেয়া নৌকাটা।

লাউঞ্জের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আনন্দের একটা হুল্লোড় বয়ে গেল।

হি ডিড ইট! সাবেক ভারপ্রাপ্ত কাপ্তান লি আনন্দে কেঁদে ফেলল, সে গদারের রেকর্ড ভেঙেছে! এক তুড়িতেই!

ইউরোপার অচেনা ভূমিতে চারপায়ে কিম্ভূতভাবে দাঁড়িয়ে থাকায় বিল টি কে দেখতে প্রায় আগেরদিনের অ্যাপোলো চান্দ্র মডিউলের মতো লাগছিল। কিন্তু এই চিন্তাটা এখন ব্রিজে থাকা ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাসের মাথায় ঘুরছে না।

হঠাৎ মনে হল তার শিপটা যেন কোনো অকেজো মা-তিমি মাছ মারা যাবে আর একটু পরই-সদ্য জন্মানো বাচ্চাটা যেন বাঁচে সে প্রত্যাশা তার মনে।

.

আরো অনেক অনেক ব্যস্ত আটচল্লিশটা ঘন্টা পেরিয়ে উইলিয়াম সুখকে রণসজ্জায় সাজানো হল। দ্বীপের দশ কিলোমিটার সার্কিটে বারবার তাকে বাজিয়ে নেয়া হয়েছে এরই মধ্যে। এখনো মিশন পুরো করতে অনেক সময় পাওয়া যাবে।

আরো তিন দিনের মধ্যে ইউনিভার্সের চলে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এদিকে জিউস পর্বতের অভিযান নিবে মাত্র ছঘণ্টা সময়। এমনকি ড. ভ্যান ডার বার্গের জটিল যন্ত্রপাতি বসানো সহ অন্যান্য কাজ হিসাবে নিলেও এরচে বেশি সময় লাগবে না।

সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ ল্যান্ড করার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন তাকে কেবিনে ডেকে নিল।

স্কিপারকে এমন অসুস্থ আর অপ্রকৃতিস্থ দেখাচ্ছে কেন! ভাবল চ্যাঙ।

দারুণ কাজ, ওয়াল্টার-কিন্তু অবশ্যই, এ ফলটা আমরা আশা করেছিলাম। ক্যাপ্টেন সহজে অফিসার ও প্যাসেঞ্জারদের কাউকে ডাকনাম ধরে ডাকে না। আন্তরিকতা প্রকাশ পাচ্ছে তার কথায়।

“থ্যাঙ্কস, স্যার-তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

হেসে দিল ক্যাপ্টেন। কোনো ভাল স্পেস –পেটে কথা রাখতে জানে না।

হেড অফিস, যথারীতি। আমি আপনাকে নিরুৎসাহিত করতে চাই না মোটেও। কিন্তু ভাই, বিধি বাম। সোজা আদেশ এসেছে, ড, ভ্যান ডার বার্গ আর সেকেন্ড অফিসার ফ্লয়েড এ অভিযানে বেরুচ্ছেন।

মনের চোখে ছবিটা দেখতে পাচ্ছি। বেচারা হতাশ মনে তিক্ত গলায় বলল, তো, আপনি কী জবাব দিলেন?

যথারীতি, কোনো জবাবই দেইনি। এখনো দেইনি বলেই আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছি। আমি নির্দ্বিধায় বলব যে আপনিই মিশনটা চালানোর সবচে যোগ্য পাইলট।

তারাও জানবে যে কথাটা… ননসেন্স হয়ে যাবে। ফ্লয়েড আমার মতো ভালভাবেই কাজটা করতে পারবে। অভিযানে বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নেই-যদি যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা না দেয়, তো। আর যান্ত্রিক ত্রুটি আপনাকে-আমাকে বা ফ্লয়েডকে দেখে আসবে না।

আমি এখনো নিজের ঘাড়ে দোষ নিতে রাজি আছি যদি আপনি চান। হাজার হলেও, আমার ইচ্ছাকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। তার উপর পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে আমরা সবাই হিরোতে পরিণত হব, তখন মাথার উপর ছড়ি ঘোরানোর সাহস পাবে কোন্ ব্যাটা?

চ্যাঙ এর মধ্যেই মনে মনে কিছু হিসাব কষা শুরু করে দিয়েছে। ফল দেখে বোধহয় বেশ তুষ্ট হল।

পে লোডের বদলে আরো শ কিলো প্রোপ্যাল্যান্ট ভরতে পারলে নতুন দিগন্ত খুলে যাবে চোখের সামনে। আগেই মনে হয়েছিল, কিন্তু বিল টি থেকে কে নামবে সেটা ভাবতেই বিব্রতবোধ করতাম, এখন ব্যাপারটা সহজ হয়ে যাবে। বিশেষত ঐ অতিপ্রাকৃতিক প্রাকৃতিক জিনিসটার…।

আর বলা লাগবে না। চীনের মহা প্রাচীর, বলে যান।

ঠিক তাই, জ্বালানী বেশি ভরতে পারলে কুছ পরোয়া নেহি। আগাগোড়া ছুঁড়ে ফেরা যেত। এটা আসলে কী তাও বের করা যেত সহজেই।

আমার ধারণা, দারুণ একটা আইডিয়া আছে আমাদের হাতে। ঠিক জানি না কাছাকাছি যাওয়া উচিত হবে কিনা… আমাদের কপালে পেরেক ঠুকতে পারে ব্যাপারটা।

পারে। কিন্তু আরো একটা কারণ আছে, আমাদের কারো কারো কাছে এ মরণ অনেক অনেক ভাল…

বলে যান।

জিয়াং। সেটা দেয়াল থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে। সেখানে একটা প্রোব ফেলতে পারলে দারুণ কাজ হয়।

তো, এই কথাই তার ক্রুরা সারাদিন গুজগুজ করে আলাপ করত! আরো অনেকদিনের মতো আবারও তার ম্যান্ডারিন ভাষা জানার খুব ইচ্ছা হল। চীনের শত কোটি লোক এ ভাষায় কথা বলে, জানলে কাজে লাগতো বেশ।

ব্যাপারটা বুঝতে পারছি আমি, শান্ত সুরে বলল কাপ্তান, ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে। আর এ নিয়ে কথা বলব ফ্লয়েড ও ভ্যান ডার বার্গের সাথে। কাজটা তারা হাজার হলেও, মনোযোগ দিয়ে করবে বলে মনে হয়।

আর হেড অফিস?

ড্যাম ইট! এটা হবে আমার সিদ্ধান্ত।

৪৭. টুকরোগুলো

তাড়াতাড়ি করাই ভাল, গ্যানিমিডের সেন্ট্রাল কমান্ড উপদেশ দিল, ইউরোপার সাথে আইওর অর্বিটের পরের বারের সম্মিলনটা মোটেও জুতসই হবে না। আইওর সাথে সাথে আমরাও ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠব।

আমরা আপনাদের ভয় পাইয়ে দিতে চাইনি, কিন্তু আমাদের রাডারের মাথা খারাপ না হয়ে থাকলে, পাহাড়টা আরো শত মিটার নিচে দেবে গেছে, গতবার চেক করার পর, কীভাবে-গড নোজ।

এই হারে চলতে থাকলে, ভাবল বার্গ, আর বছর দশেক, তারপরই ইউরোপা একেবারে সমতল হয়ে যাবে। পৃথিবীর চেয়ে কত দ্রুত এখানে ঘটনা ঘটছে দেখে তাল সামলানো কষ্টকর। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি সবার আগ্রহ থাকবেই-কিন্তু এই অকল্পনীয় পট-পরিবর্তনও ভূগোলবিদদের এই উপগ্রহের দিকে আকৃষ্ট করে।

এসব ভাবছে সে ফ্লয়েডের ঠিক পেছনে বসে থেকে; চারদিকে নিজের আনা জিনিসপাতির দঙ্গল। নড়াচড়ার যো নেই।

অদ্ভুত হলেও, সে একইসাথে আগ্রহ আর ভয় দেখতে পাচ্ছে মনের ভিতর। আর মাত্র হাতেগোনা কয়েক ঘণ্টা-তারপরই তার জীবনের সবচে বড় অভিযান সম্পন্ন হবে। ফলটা ভাল হোক আর মন্দ-শেষ যে হবে তা নিশ্চিত। এ ঘটনার সাথে মেলানোর মতো আর কোনোকিছু একজন মানুষ জীবনে একাধিকবার পায় না… ভাবতে ভাবতেই ভ্যান ডার বার্গের মনে পড়ে গেল বৃদ্ধ ফ্রয়েডের কথা। এক জীবনে সে তিন তিনবার যুগ পাল্টানো ঘটনায় জড়িয়ে গেল!

এম্নিতে তেমন ভয় স্পর্শ করছে না মনটাকে-মনোবল বাড়িয়ে রেখেছে তার আত্মবিশ্বাস এবং যন্ত্রবিশ্বাসের সমন্বয়। একটা কথা ভেবে মন কেমন যেন করছে। মৃত রোজি ম্যাককোলেনের কথা ভেবেই এ চিন্তা আসে ঘুরেফিরে। মেয়েটা এমন না করলে কোনোদিনই সে এ সুযোগ পেত না।

ঠেসে ভরা বিল টি টেক-অফের সময় বড়জোর এক-দশমাংস মাধ্যাকর্ষণ সহ্য করতে পারে; এমন কাজের জন্য সে মোটেও উপযুক্ত নয়। কিন্তু পোক্তভাবে বানানোয় টিকে যাবে, বেশ ভাল কাজ দিবে এই অভিযানটায়।

অনেক যুগ পরে যেন আকাশে উড়ল শাটলটা। এদিকে এতোক্ষণে শিপ-গাত্রের ক্ষতি খতিয়ে দেখার সময় পেল তারা। এসিড বৃষ্টি হয়েছে সেখানে-মৃদু।

ফ্লয়েড যখন উঠতে উঠতে যন্ত্রপাতির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে তখন ভ্যান ডার বার্গ ভিউপোর্টে দেখে দেখে শিপের অবস্থা নিয়ে একটা রিপোর্ট পাঠিয়ে দিল দ্রুত। অবশ্য খুব একটা কিছু যায় আসে না, আর দিন দু-তিন-তারপরই গ্যালাক্সি বিরান হয়ে যাবে।

তারা পুরো স্বর্গ দেখতে পাচ্ছে তাদের ঠিক নিচে। এখন ভ্যান ডার বার্গ ঠিক বুঝতে পারছে অ্যাক্টিং ক্যাপ্টেন লি কী কঠিন কাজটাই না করেছে শিপ ভিড়ানোর সময়।

এই স্বর্গে শিপটা রাখার মতো মাত্র কয়েকটা স্থান ছিল আর সাবেক নাবিক কী অদ্ভুত দক্ষতায় কাজ করল, তাও আবার বাতাস-সাগরের ঢেউ কাজে লাগিয়ে!

বিশ মিনিট ধরে চারদিকে শুধু রহস্যময় মেঘ, কারণ বিল টি শক্তি বাঁচাতে সেমি ব্যালাস্টিক মিসাইল হয়ে প্রায় সোজা উঠে গেছে উপরে, নামবেও সোজা। সাগরের উপর দিয়ে সরাসরি উড়িয়ে নিতে গেলে প্রতিনিয়ত ফুয়েল খোয়াতে হবে, দরকার কী!

একটু মন খারাপ হল গ্যানিমিডের বিজ্ঞানীর, আমি নিশ্চিত নিচের সমুদ্রে অজানা অচেনা অনেক প্রাণী সাঁতরে বেড়াচ্ছে, আর আমার পরে আর কেউ সেগুলো দেখার কোনো সুযোগ পাবে বলে মনে হয় না…

ইঞ্জিন কাট অফ হতে যাচ্ছে। বলল ফ্লয়েড, এভরিথিং নরমাল।

ভেরি গুড, বিল টি! আপনাদের উচ্চতায় কোনো যানবাহন থাকার রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না। এখনো ল্যান্ডিং রানওয়েতে আপনারাই প্রথম।

ভাঁড়টা কে? প্রশ্ন তুলল ভ্যান ডার বার্গ।

রনি লিম। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, এই ল্যান্ডিং রানওয়েতে আপনারাই প্রথম। ডায়ালগটা অ্যাপোলো যুগের কথা মনে করিয়ে দেয় খুব।

ভ্যান ডার বার্গ সহজেই বুঝতে পারে কেন কথাটা বলছে ফ্লয়েড। এটা আসলে ঠিক ঠাট্টা নয়, চিরাচরিত রসিকতা কিংবা ভাড়ামো নয়, যখনই কোনো বড় ধরনের বিপদের দিকে কেউ এগিয়ে যায় তাকে এমন করে উৎসাহ দেয়া উচিত। কথার উৎসাহ নয়, রসিকতা দিয়ে হাল্কা করা।

ব্রেকিং শুরু করতে পনের মিনিট বাকী। বলল ফ্লয়েড, দেখা যাক আর কে এখন অন দ্য এয়ার।

সে অটোস্ক্যানের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। ব্লিপ আর আলোর ওঠানামা দেখতে হচ্ছে তীক্ষ্ণ চোখে। না, কোনো না কোনো জায়গা থেকে শব্দ তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে এগিয়ে আসছে। কোত্থেকে, তারা না জানলেও আন্দাজ করতে জানে।

আপনাদের লোকাল বিকন আর ডাটা ট্রান্সমিশনে বোঝা যাচ্ছে বলল ফ্লয়েড, অনেকটা আনমনেই, মনে করেছিলাম যে… আহ্ এই তো, এসে পড়েছি!

একটা ছোট্ট মিউজিক্যাল টোন বাড়ছে-কমছে। ফ্লয়েড তাকালো সেদিকে।

ডপলার শিফট চলে গেছে-নামিয়ে আনছি তাকে।

এটা আবার কী? টেক্সট?

স্লোস্ক্যান ভিডিও, যদ্দূর মনে হয়। তারা গ্যানিমিডের বিগ ডিশটা দিয়ে সারাক্ষণ হাজারটা তথ্য পাঠায় পৃথিবীতে। নেটওয়ার্ক নতুন খবরের জন্য তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে।

এই কিম্ভূত শব্দের দিকে তারা অনেকক্ষণ কান পেতে থাকল। এ কেমন মিউজিক? বাজনার তো একটা ধরণ থাকা উচিত। আর না, ফ্লয়েড সাথে সাথে বন্ধ করে দিল সুইচটা। এখন এসব শোনার কোনো মানে হয় না। ইউনিভার্স এগিয়ে আসছে, সাহায্য আসতে দুদিন বাকী।

কেন যাচ্ছে তারা? অসম্ভবের দিকে কেন যাওয়া? কেন নিষিদ্ধের পথে? নিষেধ না মানার জন্য, নাকি বিজ্ঞানের কল্যাণে? নাকি শুধু নিজের কৌতূহলে! কে জানে!

ভ্যান ডার বার্গ হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলল, পরে আর আপনার দাদার সাথে কথা হয়েছে নাকি?

হয়েছে। অবশ্যই, কথাটা কেমন যেন খাপছাড়া। কোটি কিলোমিটার দূর থেকে কথা হওয়ার ব্যাপারটা সহজ নয়। তাই মানুষ সব সময় সহজ বিকল্প বেছে নেয়। ভয়েসগ্রাম, অডিওমেইল বা এ-মেইল, ভোকার্ড এর উন্নতি এতো দ্রুত হয়েছে যে বলে প্রকাশ করার মতো না। তারপর স্রেফ মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়।

এখনো মানুষ আশা ছাড়েনি। সৌর জগতের বিশাল এলাকায়, কোটি কোটি কিলোমিটারের দূরত্বে, এখনো মানুষ রিয়েল টাইম স্পিকিংয়ের আশা নিয়ে বসে আছে। সারাক্ষণ তারা একটা যন্ত্রণা করে বেড়ায়: আপনারা বিজ্ঞানীরা কোন ঘোড়ার ঘাস কাটেন? কেন পারছেন না এ কাজটা করতে?

হ্যাঁ বলল ফ্লয়েড বেশ কিছুক্ষণ পরে, ভালই আছে। আশা করি দেখব কদিন পরেই।

তার সুরের ঠিক কোথায় যেন একটু টান টান উত্তেজনার ভাব লুকানো। কে জানে… ভাবল ভ্যান ডার বার্গ, কিন্তু টাচডাউনের আগে কোনোরকম বাগাড়ম্বরে যাবার কোনো ইচ্ছাই তার নেই।

প্রোগ্রাম সিকোয়েন্সরটা ঢোকানোর পর পরই নিভে গেল কমেন্স ব্রেকিং অ্যালার্ম ।

আমার ভার ভাল হাতের উপরই পড়েছে, ভাবল ভ্যান ডার বার্গ, রিল্যাক্স করে নিজের কাজে মন দেয়া উচিত আমার। ক্যামেরা কোথায় গেল-বলোনা আবার ভেসে গেছে একদিকে…।

মেঘ সরে যাচ্ছে আকাশ থেকে। অথবা তারা মেঘময় আকাশ থেকে নেমে আসছে। যদিও চোখে দেখার মতো স্পষ্ট করে রাডার দেখিয়েছে ঠিক কোথায়, কীভাবে জিউস পর্বতটা মাথা তুলে দাঁড়ালো, তবু মেঘ কেটে যেতেই ঠিক নিচে, কয়েক কিলোমিটার দূরে পাহাড়টা দেখে কেমন যেন করে উঠল তাদের মনের ভিতরটা।

দেখুন! চিৎকার করে উঠল ফ্লয়েড, ব দিক দিয়ে। জোড়া চূড়ার দিকে দেখুন… একটু আন্দাজ করা সম্ভব কী ঘটছে সেখানে।

শিওর। আপনার কথাই ঠিক। মনে হয় না আমরা কোনো ক্ষতি করেছি-জিনিসটা শুধু ছড়িয়ে পড়েছিল-অন্যটা যে কোথায় পড়ল…

উচ্চতা এক হাজার। কোনো ল্যান্ডিং সাইটটায়? এখান থেকে আলফাঁকে দেখে তেমন ভাল লাগছে না।

“ঠিক বলেছেন-গামাতে চেষ্টা করলে কেমন হয়-মাউন্টেন থেকে বেশ কাছে…

পাঁচশো। এটা গামা। বিশ সেকেন্ডের জন্য ভাসব-আর যদি পছন্দ না হয় তো বল, বিটাতে যাচ্ছি। চারশো… তিনশো… দুশো,… (গুডলাক, বিল টি–বলল গ্যালাক্সি সংক্ষেপে)… থ্যাঙ্কস রনি… ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড ফিফটি… এবার কী করা যায়? কয়েকটা পাথর ছড়ানো আছে সেখানে। আর-এটাতো বেমানান-সারাটা জায়গাজুড়ে ভাঙা কাঁচ ছড়ানো, অন্তত দেখে এমনি মনে হচ্ছে-কারা যেন এখানে জঙলি পার্টি দিয়েছিল… এখনো ওকে?

পারফেক্ট। নামতে থাক, ক্রিসি।

“চল্লিশ… ত্রিশ… বিশ… তোমরা নিশ্চিত? এখনো মন বদলাবে না?… দশ… একটু ধুলা ওড়াচ্ছি লাথ মেরে… যেমনটা বলেছিল এককালে নিল আর্মস্ট্রং-নাকি বলেছিল ব্যস্ত?… পাঁচ… কনটাক্ট! একদম সহজেই, তাই না? ঠিক বুঝলাম না কেন আমার ঠিক ইজি লাগেনি।

৪৮. লুসি

হ্যালো, গ্যানি সেন্ট্রাল-আমাদের ল্যান্ডিংটা একেবারে নিখুঁত। মানে, ক্রিস কোনো এক কিম্ভূত পাথরের উপর নামিয়ে দিয়েছে যানটাকে। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে মাত্র কিলোমিটার দুয়েক দূরে। কিন্তু আমার মনে হয় এরচে কাছে যাবার কোনো মানে নেই…

এখন টপ স্যুটগুলো পরে নিচ্ছি, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আনলোডিং শুরু হয়ে যাবে। মনিটর চালু রাখব, অবশ্যই। আর প্রতি পনের মিনিটে একবার করে কল করব। ভ্যান আউট।

এরচে কাছে যাবার কোনো মানে নেই… মানেটা কী? প্রশ্ন তুলল ক্রিস।

মুখে মৃদু হাসি ছড়িয়ে দিল ভ্যান ডার বার্গ। গত কমিনিটে যেন সে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসেছে; এখন শাসন না মানা দুরন্ত কোনো বাচ্চা ছেলে যেন।

সারকামস্পিস আরো যেন খুশি হয়ে উঠেছে গ্যানিমিডের বিজ্ঞানী, ল্যাটিন শব্দ। মানেটা হল, নিজের চারদিকে তাকাও চোখ কান খোলা রেখে। আগে বড় ক্যামেরাটা বের করা যাক… ওয়াও!

হঠাৎ কেমন যেন ঝাঁকি খেল বিল টি। তারপর ঠ্যাঙগুলো শক অ্যাবজর্ডিং প্রোগ্রামের কল্যাণে এমনভাবে দুলল যে আরেকটু হলেই সি সিকনেস শুরু হয়ে যেত।

ভূকম্পনের ব্যাপারে গ্যানিমিডের কথাই ঠিক। বলল ফ্লয়েড, গুছিয়ে নেয়ার পর, কোনো সিরিয়াস ভয় নেইতো?

না-ও থাকতে পারে। মিলে যেতে আরো ত্রিশ ঘণ্টা বাকী। এটাকে দেখে পাথরের শক্ত স্ল্যাবের কথাই মনে পড়ে। কিন্তু তবু, এখানে আমরা বসে বসে বাদাম খেয়ে সময় নষ্ট করব না। আর, আমার মাস্কটা ঠিক আছে তো? লক্ষণ বেশি ভাল ।

স্ট্রাপ শক্ত করে দিচ্ছি। এইতো, ঠিক হ্যায়। শক্ত করে দম নিন, এখন আরাম লাগছে, না? আমি আগে যাব।

ভ্যান ডার বার্গ খুব আশা করেছিল সেই আগে লিটল স্টেপ ফেলবে। কিন্তু বিধি বাম হলে কী আর করা? এখানে ফ্লয়েডই কমান্ডার, তার উপর ভূকম্পনে কোনো ক্ষতি হল কিনা তা দেখতে যাবার দায়িত্ব আছে ওর কাঁধে। যদি এখনি আবার উড়াল দিতে হয় তো সেটা বের করার জন্য ওকেই পা রাখতে হবে মাউন্ট জিউসের পাদদেশে।

প্রথমেই সে একবার ছোট্ট স্পেসক্রাফটটার চারপাশে চক্কর কেটে নিল। ল্যান্ডিং গিয়ারগুলো এমন ঝাঁকি খেয়ে ঠিক আছে তো? ঠিকই আছে, বুড়ো আঙুল দেখালো মই বেয়ে নামতে থাকা ভ্যান ডার বার্গের দিকে। যদিও সে স্বর্গে পরা সেই হাল্কা ব্রিদিং অ্যাপারেটাসের সাথে সেই স্পেস স্যুটই পড়েছে, তবু কেমন যেন লাগছে তার।

ল্যান্ডিং পড়ে নেমেই একটু ঠিকঠাক করে নিতে চেষ্টা করল বিজ্ঞানী। কিন্তু সাথে সাথেই উপরে তাকিয়ে ফ্লয়েডের কাজ খেয়াল করল।

স্পর্শ করবেন না! চিৎকার করল সাথে সাথে, ডেঞ্জারাস!

চিৎকার শুনে এক লাফে মিটার খানেক সরে গেল ফ্লয়েড। এক বিচিত্র পাথরকে সে পরীক্ষা করছিল। একটা বড় কাঁচের টুকরা দ্যুতি ছড়াচ্ছিল সেখানে।

“নিশ্চই তেজস্ক্রিয় নয়, কী বলেন? বেশ ভয় পেয়ে গেল সে।

না। কিন্তু আমি যাবার আগে দূরে থাকুন।

অবাক হয়ে ফ্লয়েড দেখল যে ভ্যান ডার বার্গ আগে থেকেই মোটা হাতমোজা পরে এসেছে। একজন স্পেস অফিসার হিসেবে ফ্লয়েড অনেক সময় নিল একটা ব্যাপার বিশ্বাস করতে; এখানে-এই ইউরোপায় খোলা হাওয়ায় চামড়া বের করা যাচ্ছে। এই সৌর জগতের কোথাও, এমনকি মঙ্গলের বুকেও শরীরের কোনো অংশ অনাবৃত করা অসম্ভব।

অতি সাবধানে ভ্যান ডার বার্গ নিচে এসে কাঁচের জিনিসটার একটা টুকরো তুলে নিল। এমনকি এই কিম্ভূত আলোতেও দারুণভাবে ঝিকিয়ে উঠল জিনিসটা। আর ফ্লয়েড দেখল এর ধারটা বেশ তীক্ষ্ণ।

চেনা সৃষ্টিজগতে সবচে ধারালো ছুরি।

দাঁত কেলিয়ে বলল ভ্যান ডার বার্গ। তারপর হঠাৎ বুঝতে পারল মাস্কের নিচে কাজটা সহজ নয়।

তো, আপনি এখনো জানেন না জিনিসটা ঠিক কী?

এখন মনে হচ্ছে একমাত্র আমিই জানি না।

সাথীকে কাঁধে ধরে জিউস পর্বতের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিল ভ্যান ডার বার্গ। এই দূরত্ব থেকে পর্বতটা আধ আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সদম্ভে। শুধু শ্রেষ্ঠ বললেই চলে না-বরং এই জগতের একমাত্র পর্বত এটা।

দৃশ্যটা শুধু মিনিট খানেকের জন্য দেখতে থাকুন, তারিফ করতে থাকুন মনে মনে। আমি একটা জরুরী কল করব এর মধ্যে।

একটা কোড দিল সে তার কমসেটে। একটু পর রেডি ফ্ল্যাশ ভেসে উঠল, সাথে সাথেই হড়বড় করে বলে উঠল জোর গলায়, গ্যানিমিড সেন্ট্রাল ১০৯, দিস ইজ ভ্যান। রিসিভ করেছেন?

একটু পরই স্পিকার থেকে একটা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এল:

হ্যালো, ভ্যান। গ্যানিমিড সেন্ট্রাল ১০৯ বলছি। রিসিভ করতে প্রস্তুত।

ভ্যান ডার বার্গ তার জীবনের চিরস্মরণীয় মুহূর্তটাকে আরো একটু প্রলম্বিত করে তারপর শুরু করল কথা।

পৃথিবীর আইডেন্ট আঙ্কল ৭৩৭ কে বের করুন, এখুনি। তারপর কথাটা প্রচার করুন, লুসি ইজ হেয়ার, লুসি ইজ হেয়ার। বলুন দেখি কী বলতে হবে?

গ্যানিমিড ম্যাসেজটা রিপিট করাতে ফ্লয়েড ভাবল, যে খবরই সে পাঠিয়ে থাক না কেন, আমার হয়তো উচিত ছিল তাকে বাধা দেয়া। কিন্তু দেরি যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৃথিবীতে পৌঁছে যাবে।

স্যরি অ্যাবাউট দ্যাট, ক্রিস। দাঁত কেলিয়ে আবারও হাসল ভ্যান ডার বার্গ, আবারও তার হাসি বাঁধা পেল মুখোশের কারণে, আমি আর সবকিছুর উপর প্রাধান্য পেতে চেয়েছিলাম।

তোর প্রাধান্যের খেতা পুড়ি, তুমি যদি এখুনি কথা বলা শুরু না কর, তত তোমার প্যাটেন্ট করা সেসব গ্লাস-চাকু দিয়ে এফোঁড়-ওফোড় করে দিব।

গ্লাস, অবশ্যই! যাক, ব্যাখ্যাটা… এই! সবুর! ভয় পাইয়ে দিবে তো! ব্যাখ্যা করতে গেলে জল আরো ঘোলা হবে, আমারও চাকুর ঘা খেতে হতে পারে, তাতে পরিবেশ পরিষ্কার হবে না একটুও। তারচে সরাসরি ফ্যাক্ট নিয়ে কথা বলা যাক…

“জিউসের পর্বত… জিউসের পর্বত একটা অখণ্ড হীরা। অনুমিত ভর? এক মিলিয়ন মিলিয়ন টন। কিংবা, তুমি যদি অন্য পথে ব্যাপারটাকে দেখতে চাও, সতেরতম ক্যারেটের চেয়ে অন্তত দু বার দশ দিতে হবে উপরে। আমি কিন্তু গ্যারান্টি দিতে পারব না এটার সবটাই অটুট কিনা সে বিষয়ে…

৭. দ্য গ্রেট ওয়াল

সপ্তম পর্ব – দ্য গ্রেট ওয়াল

৪৯. ঈশ্বরের জন্য

বিল টি থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে তাদের ছোট্ট গ্রানাইট ল্যান্ডিং প্যাডে জড়ো করতে করতে ক্রিস ফ্লয়েড মাথার উপর জ্বলতে থাকা পাহাড়টাকে ট্যারা চোখে একবার দেখে নেয়। এভারেস্টের চেয়ে বড় একটা, মাত্র একটা ডায়মন্ড! এই ছড়ানো ছিটানো টুকরাগুলি নিশ্চই লাখ ভাগের এক ভাগ নয়, বিলিয়ন ভাগের এক ভাগই হবে…

অন্যদিকে, তারাও নিশ্চই পুরোটার তুলনায় এতোটুকুই হবে।

এমিতে হীরের দাম সব সময় উৎপাদক আর বিক্রেতারা চড়িয়ে রাখে আকাশের গায়ে। যদি এই সময় এমন একটা হীরা-পর্বত বাজারে নামে, তাও আবার জেম ডায়মন্ড-নিশ্চই হীরা-ব্যবসা পাতালে ধসে পড়বে… কোনো সন্দেহ নেই।

এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কেন তাদের ইউরোপা অভিযানে এতোগুলো দল খাবলাখাবলি করেছে এতোদিন! এ্যাদ্দিন রাজনৈতিক আর আর্থিক পার্টিগুলোর নাক গলানোর কোনো শেষ ছিল না।

নিজের তত্ত্ব প্রমাণ করার পর আবার ভ্যান ডার বার্গ চিরাচরিত নিরামিশাষী বিজ্ঞানী হয়ে গেল। এখন আর তার গবেষণায় কোনো বাধা দু চোখে দেখতে পারবে না।

শাটল থেকে অনেক কষ্টে একটা পোর্টেবল ড্রিল নামিয়ে এনে মিটারখানেক এলাকা ছিদ্র করল তারা। কাজটা করতে ভ্যান ডার বার্গ বেশ বেগ পেয়েছিল। কারণ এবার আর ক্রিস ফ্লয়েড তেমন কোনো সহায়তা করতে রাজি ছিল না। কিন্তু কাহাতক অন্যের কষ্ট দেখা যায়-সেও হাত লাগালো একটু পরে। তারপর আবার জিনিসটা সযত্নে তুলে রাখল শাটলের ভিতরে।

ফ্লয়েড বেশ কিছু কাজে প্রাধান্য পেলেও দেখা যাচ্ছে মরার প্রাধান্যের কারণে কঠিন কাজগুলো আগ বাড়িয়ে নিজেকেই করতে হয়। একটা সিসমোগ্রাফ ঠিক করার এবং টিভিটা ট্রাইপডে বসানোর আগে সে চারদিকে ছড়ানো বহুমূল্য রত্নগুলোর কয়েকটা বগলদাবা করে নিল।

একেবারে যদি নাও হয়, সাবধানে কম ক্ষতিকর কয়েকটা টুকরো নিতে নিতে বলল, জিনিসগুলোকে ভাল স্যুভেনির হিসেবে রাখা যাবে।

যদি রোজির বন্ধুরা এগুলো পাওয়ার কারণে মেরে না ফেলে আমাদের।

তীক্ষ্ণ চোখে ভ্যান ডার বার্গ তার সতীর্থের দিকে চেয়ে থাকে। তার মনে একটা চিন্তাই ঝড় তুলছে, ক্রিস কতোটা জানে… কতোটা জানে বাকীরা?

এখন রহস্য খুলে যাওয়াতে বলতে আর কোনো দ্বিধা নেই। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের কম্পিউটারগুলো পাগলা ঘোড়ার মতো দৌড়ে বেড়াবে।

বেজন্মা কুত্তা! সাথে সাথে গাল দিল ফ্লয়েড, ঘৃণার চেয়ে উৎসাহ বেশি ঝরে পড়ছে তার কণ্ঠে, তো, এ-ই তোমার মেসেজের সারাংশ?

“একজন বিজ্ঞানী আর্থিক বাজারে লাভবান হতে পারবে না এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে কোন্ কালে? তাই পৃথিবীতে আমার বন্ধুর কাছে খবরটা দিয়ে দিলাম, ব্যস। কিন্তু বিশ্বাস কর আমার কথা, এই কাজেই আমি বেশি আনন্দ পাইযেমনটা আর সব বিজ্ঞানবিদের ক্ষেত্রে হওয়া উচিৎ। রেঞ্জটা দিবে, প্লিজ?

জিউস স্টেশন বসানোর আগে তিন তিনবার তাদের পা কেঁপে গেল মহা ভূকম্পনে। প্রথমে পায়ের নিচে একটু মৃদু আন্দোলন, তারপর সবকিছু কাঁপা শুরু করে-সবশেষে অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়ে একটা লম্বা গর্জন ভেসে আসে। কোনো নির্দিষ্ট দিক থেকে নয়, বরং সবদিক থেকে।

এমনকি মাঝেমধ্যে শব্দটা আকাশ থেকেও হয়! কী অবাক ব্যাপার! ফ্লয়েড ভেবে কোনো ব্যাখ্যা পায় না। এম্নিতে তার বিশ্বাস নেই যে এখানকার পাতলা আবহাওয়ায় বাতাসে ভাসিয়ে কোনো কথা বলা সম্ভব। সেখানে কিনা হুঙ্কার!

ভ্যান ডার বার্গ সারাক্ষণ তাকে বোঝাচ্ছে, এগুলো এখনো তেমন ক্ষতিকর পর্যায়ে যায়নি। কিন্তু একটা শিক্ষা পেয়েছে ফ্লয়েড। কখনো সে এক্সপার্টদের কথায় বেশি ভরসা করে না। সত্যি, সে বিল টির শক এবজর্ভিং সিস্টেমকে দেখল টালমাটাল হয়ে সামলে নিচ্ছে পরিস্থিতি। খেয়া নৌকাটাকে যেন আকাশে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল। তারপরও সামলে নিচ্ছে কী করে কে জানে!

মনে হচ্ছে হয়ে এল! অবশেষে বলল বৈজ্ঞানিক, অবশেষে। এবং সাথে সাথেই ফ্লয়েড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জোরে।

সব চ্যানেল থেকে গ্যানিমিড এখন অপার তথ্য পাচ্ছে। এই ব্যাটারিগুলো হাজার বছর ধরে টিকে যাবার কথা, লুসিফারও সব সময় সোলার প্যানেলকে আলো দেবে, বাকীটা আল্লা মালুম।

গিয়ার যদি সপ্তা খানেকের বেশি টিকে যায় তো আমি অত্যাশ্চর্যান্বিত হব। বাজি ধরতে রাজি আছি, ল্যান্ড করার পরও পর্বতটা অবস্থান বদলেছে; আমাদের উপর পড়ে যাবার আগে চলো ভালোয় ভালোয় ভাগি।

আমার দুঃখ আরো বেশি, ক্রিস। হাসছে ভ্যান ডার বার্গ, তোমার জেটের আঁচে এই সব কষ্ট বানচাল হয়ে যাবে।

তাতে কীবা এসে যায়? আপনা পরাণ বাঁচাতে পারছি তো! ব্যস। তার উপর এত আবর্জনা উগরে দিয়েছি যে এখন উড়াল দিতে বড়জোর আগের অর্ধেক শক্তি লাগবে। অবশ্য তুমি যদি আরো কয়েক বিলিয়ন… নাকি ট্রিলিয়ন? তুলতে চাও…

হিংসুটে কেন তুমি এত? কিন্তু পৃথিবীতে নিয়ে কী লাভ হবে কে জানে! প্রথমেই জাদুঘরগুলো কেড়ে নিবে বেশিরভাগ, তারপর কটা বাঁচবে আর তা দিয়ে কী করা যাবে এখনি বলতে পারব না।

গ্যালাক্সির সাথে কথা আদানপ্রদানের কারণে কন্ট্রোল প্যানেলে ফ্লয়েডের হাত উড়ে বেড়াচ্ছে।

মিশনের প্রথম ধাপ শেষ। বিল টি উড়তে প্রস্তুত। আগের কথামতোই ফ্লাইট প্ল্যান ঠিক করা থাকল।

ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাসের জবাব শুনে তারা মোটেও অবাক হয়নি।

নিশ্চিত ভো, সামনে যেতে চাচ্ছেন? মনে রাখবেন, আপনাদের হাতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমি শুধু সাপোর্ট দিব।

ইয়েস স্যার, আমরা দুজনেই মহাখুশি। বোঝাই যাচ্ছে বাকী ক্রুদের মানসিক অবস্থা কেমন। আর বৈজ্ঞানিক লাভ যে কী হবে সেটা পরে বলব, এখন দুজনেই আমরা উত্তেজিত।

একটু সবুর করুন, আমরা কিন্তু এখনো মাউন্ট জিউসের উপর আপনার রিপোর্ট পাবার অপেক্ষায় আছি।

একবার ফ্লয়েড চোখ বুলিয়ে নিল ভ্যান ডার বার্গের মুখের উপর, কাঁধ ঝাঁকিয়ে তুলে নিল মাইক্রোফোন।

এখনি বলে দিলে, ক্যাপ্টেন, আপনি আমাদের স্রেফ পাগল ভাববেন। ব্যস। প্রমাণসহ ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই তো আসছি, ধৈর্যটা ধরা যায় না?

হুম! আদেশ করে শুধু শুধু আপনাদের মনোযোগ নষ্ট করার কোনো মানে হয়, কী বলেন? যাই হোক-গুড লাক। বিশেষত স্বত্বাধিকারীর পক্ষ থেকেও শুভেচছা-তিনি খুশি হয়েছেন জিয়াংয়ের কাছে যাবার কথা শুনে না। লরেন্স অনুমতি দেবেই, ফ্লয়েড নিজের মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে। বলল, লুসিটা কে, বলতো একটু, রালফ ভায়া…

আমিও ঠিক চিনি না। আসলে নামটা বের করেছি কম্পিউটার সার্চ করে। ভাবলাম, সবাই সাথে সাথে লুসিফারের সাথে তালগোল পাকিয়ে ফেলবে, সেইসাথে আমরাও সন্দেহের বাইরে থাকব, এই আর কী! এম্নিতেও, সেটাতো এখানে আছেই, লুসি ইজ হেয়ার…

“আমি তাদের নাম শোনার কোনো আশা দেখিনি। হাজার হলেও, শত বছর আগে একটা বিখ্যাত গাইয়ের দল ছিল, নাম হল বিটলস। কিম্ভূত নাম। জিগগেস করো না কেন এমন ছন্নছাড়া নামের জন্ম হল। তাদের একটা মজার গান আছে, লুসি ইন দ্য স্কাই উইথ ডায়মন্ডস। অদ্ভুত, না? যেন তারা ঠিক ঠিক জানতো…

.

গ্যানিমিডের রাডার অনুসারে, জিয়াংয়ের ভাঙা অংশ পড়ে আছে মাউন্ট জিউসের তিনশো কিলোমিটার পশ্চিমে। আঁধার রাজ্যের কাছাকাছি কোথাও। পেছনে তাপহীন জগৎ। জায়গাটা পুরো ঠাণ্ডা হলেও একেবারে অন্ধকার নয়। অর্ধেক সময় সেখানে ভাল প্রতাপ নিয়ে দূরের সূর্য জেগে থাকে। এমনকি ইউরোপার সেই লম্বা সৌর দিনের পরও তাপমাত্রা শূন্যের অনেক অনেক নিচে থাকে সবসময়।

তরল পানি শুধু লুসিফারের দিকে মুখ করা দিকেই পাওয়া যায়। ইউরোপার অন্যদিকে শুধু বরফ, তাই এই গোধূলী এলাকা সারা বছর তীব্র ঝড়ে কাবু হয়ে থাকে।

সেখানে, সেই আলো আঁধারির মিলনমেলায় বৃষ্টি আর তুষাররা ঝগড়া করে মরে দিনমান।

পঞ্চাশ বছর আগে এখানেই কোথাও কিংবদন্তীর জিয়াং ক্র্যাশ করেছিল। কিন্তু সেই কোথাওটা হাজার কিলোমিটার সরে গেছে। শিপটা নিশ্চই গ্যালাক্সির মতো ভেসে গিয়ে ঠেকেছে বরফের রাজ্যের পাশে। এই শত্রুসুলভ শীতল-আঁধার প্রান্তে এসে ভিড়েছে অনিবার্যভাবেই।

এ দুনিয়াটার কেন্দ্রীয় সাগরের দ্বিতীয় ঠোঁটের পাশে আসার সাথে সাথে বিল টি রাডারে প্রতিধ্বনি টের পেল। এতো বড় জিনিসের তুলনায় প্রতিধ্বনি একেবারে

ক্ষীণ। মেঘ ভেঙে নামার সাথে সাথেই বুঝতে পারল কেন এমন লেগেছিল।

বৃহস্পতির কোনো উপগ্রহে আসা মনুষ্যবাহী প্রথম স্পেসশিপ জিয়াং এর ধ্বংসাবশেষ একটা ছোট, গোলাকার হ্রদে আটকে আছে। হ্রদটা অবশ্যই কৃত্রিম। সাগরের সাথে একটা ছোট নালা দিয়ে যুক্ত। সাগর থেকে তিন কিলোমিটারও হবে না দূরত্ব। শুধু কঙ্কালটাই টিকে আছে। তাও পুরোটা নেই। অনেক কিছুই চেঁছে পুছে সাফ করা।

কিন্তু করলটা কে? নিজেকেই প্রশ্ন করে ভ্যান ডার বার্গ।

এখানে জীবনের কোনো চিহ্ন নেই। জায়গাটা যেন অনেক বছর ধরেই পরিত্যক্ত। বোঝাই যাচ্ছে কিছু একটা শিপটাকে এখানে রেখে ব্যবচ্ছেদ করেছে একেবারে চিকিৎসকদের মতো।

ল্যান্ড করা একেবারে নিরাপদ। বলল ফ্লয়েড, তারপর অপেক্ষা করল ভ্যান ডার বার্গের কাঙ্ক্ষিত সায় আসার আশায়। বিজ্ঞানী সবকিছু ভিডিও করছে, মাথা নাড়ল সামান্য, অন্যমনস্কভাবে।

বিল টি বিনাশ্রমে ছোট্ট পুলটার পাশে ল্যান্ড করে। আর তারা আনমনা চোখে মানুষের কীর্তির স্মৃতি সৌধ দেখে শীতল, কালো জলের এপাড় থেকে। ধ্বংসাবশেষটার কাছে যাবার কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না-তাতে তেমন চিন্তি ত মনে হল না ছোট্ট যানটার দু কুকে।

নেমে ক্যামেরায় দৃশ্যগুলো ধরে নিল। তারপর গ্যালাক্সি থেকে ভেসে আসা উল্লাসধ্বনিতে চমকে উঠল দারুণভাবে।

কী চমৎকার করে বানিয়েছে শিপটাকে! এখন ধাতব গড়ন ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না, তবু বোঝা যায় বেশ। তারপর, ধাতু-কাগজ-প্লাস্টিকে বানানো লিপি আর ফুল পাঠিয়ে দিল শিপের উদ্দেশ্যে। লেখাগুলো রোমান অক্ষরে উল্কীর্ণ; আধুনিক সভ্যতার প্রথমদিকে যে ভাষা দুনিয়াকে এক করেছিল-সে ভাষায়।

বিল টির দিকে ফিরতে ফিরতে ফ্লয়েড আনমনে বলল, দেখেছ নাকি, বাস্তবে সেখানে কোনো ধাতুই ছিল না। কাঁচ, প্লাস্টিক আর সিন্থেটিকের আখড়া।

তাহলে রিব আর সাপোর্টিং গার্ডারগুলো?

যৌগ, ঠিক ধাতব নয়। বেশিরভাগই কার্বন আর বোরন। এখানকার কেউ নিশ্চই খুব ধাতুখেকো। তার উপর ধাতু দেখেই বুঝতে পারে, পারে চিনতে, ইন্টারেস্টিং …।

ভেরি, ভাবল ভ্যান ডার বার্গ। যে দুনিয়ায় আগুনের জন্ম হয়নি সেখানে ধাতু আর এ্যালয় গড়ার প্রশ্নই ওঠে না। ধাতুর দাম অবশ্যই… হীরার মতো হবার কথা। সেখানে কী করে ধাতুখেকো থাকতে পারে…।

বেসে রিপোর্ট করার পর সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙের সম্ভাষণেভরা ফিরতি খবর পেয়ে দারুণ উৎসাহিত হয়ে উঠল তারা। ফ্লয়েড বিল টি কে হাজার মিটার উঠিয়ে নিয়ে পশ্চিমমুখো যাত্রা করল।

“লাস্ট ল্যাপ। সে বলল, গেমের এ পর্যায়ে উপরে উঠলে কোনো পয়েন্ট নেই। মিনিট দশেকের মধ্যেই চলে যাব সেখানে। কিন্তু ভুলেও ল্যান্ড করছি না। গ্রেট ওয়ালটা আমরা যা মনে করেছি তা হয়ে থাকলে না যাওয়াটাই অনেক ভাল। চড়ুইয়ের মতো ফুড়ৎ করে একটু উড়ে যাব উপর দিয়ে, তারপর সোজা বাসায়। মরার ক্যামেরাগুলো রেডি করে রাখ। এটা মাউন্ট জিউসের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

তারপর, নিজেকে শুনিয়ে বাকীটা বলল, মনে মনে, দ্রুত দেখা যাবে দাদা কী ভাবছিল… বেশিদূরে নয়, মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে। দেখা হলে গল্পের কোনো অভাব হবে না। আর এক হপ্তাও নেই, যদি সব ঠিকঠাক চলে তো।

৫০. উন্মুক্ত নগরী

কী ভয়ঙ্কর স্থানরে বাবা! ভাবল ক্রিস ফ্লয়েড। চলমান হিমবাহ, তুষারের ঘূর্ণি, ভূমির চকিত দেখা পাওয়া আর… এই তুলনায় স্বর্গ তো এক আস্ত বেহেস্ত। নাতিশীতোষ্ণ চমৎকার আবহাওয়া সেখানে।

জানে, এরচে অনেক খারাপ হাল রাতের প্রান্তে। আর মাত্র কয়েকশো কিলোমিটার দূরেই সত্যিকার দোযখ মুখ ব্যাদান করে তাকিয়ে থাকে সারা রাত। রাত আর ফুরায় না।

অবাক চোখে তারা দেখল, লক্ষ্যে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে পরিবেশ কেমন শান্ত হয়ে এসেছে। হারিয়ে গেছে মেঘের কুয়াশা, আর ঠিক সামনেই ভেসে উঠেছে কালো একটা বিশাল দেয়াল। প্রায় এক কিলোমিটার উঁচু; বিল টির উড়াল পথে সরাসরি দাঁড়িয়ে আছে, বুক চিতিয়ে।

জিনিসটা এত্তো বড় যে নিজেই একটা পরিবেশ আর আবহাওয়া গড়ে নিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্যে। চারপাশে বাতাস গুমরে মরছে শান্ত সুরে, ঠিক পাদদেশে একটা শান্ত, নিরাবেগ পরিবেশ। দেখে সাথে সাথেই বোঝা যায় যে এই কালো মনোলিথটা দূরের সূর্যের মলিন আলোয় নেয়ে গেলেও এটাই বৃহস্পতিকে একেবারে গিলে খেয়েছিল। পায়ের কাছে তূপ তূপ করে রাখা তুষার। দেখে কেন যেন পৃথিবীর মৌচাকের কথা মনে পড়ে যায়। কেন একথা মনে হয় কে জানে!

এক ধাপ এগিয়ে আছে ভ্যান ডার বার্গ, চিন্তার দিক দিয়ে।

ইগলু। বরফ-গম্বুজ। বলল সে সোৎসাহে, কতদূরের দুই পৃথিবীতে একই সমস্যা-একই সমাধান। আশপাশে পাথর ছাড়া কোনো গৃহায়ণ উপকরণ নেই, আর পাথর দিয়ে কাজ করে বাসা বাঁধা মুখের কথা না। বরফ নিয়ে বানানোর কাজে লো গ্র্যাভিটি নিশ্চই সাহায্য করেছে। কোনো কোনো ডোম তো বেশ বড়। কে জানে কারা বাস করে সেখানে…– ইউরোপা-দুনিয়ার এ প্রান্তে, এই ছোট্ট মহানগরীর অলি-গলিতে কোনো ব্যস্ত তার লক্ষণ নেই। আরো কাছে এসে তারা দেখতে পায় আদৌ পথ-রাজপথের কোনো অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না।

আচ্ছা! এ হল ভেনিস নগরী। বরফ-সৃষ্ট-জল-শহর। বলল ফ্লয়েড তুষ্টির সাথে, একটা ব্যাখ্যা পেয়ে গেলেই মানুষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, এখানে রাস্তা বলতে খাল, বাসা বলতে ইগলু।

ঠিক ভেনিস না। ভেনিস আর গ্রিনল্যান্ডের শংকর। প্রাণীগুলো উভচর। মুখ খুলল ভ্যান ডার বার্গ, এমন পরিবেশ আশা করাই উচিত ছিল। গেল কোথায় জীবগুলো?

আমরা ওদের ভয় পাইয়ে দিইনি তো? বিল টির ভিতর থেকে বাইরের দিকটা বেশি শব্দ করে।

মুহূর্তের জন্য ভ্যান ডার বার্গ ভিডিও করা আর রিপোর্ট করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, গ্যালাক্সির সাথে কথা চালাচালির এক পর্যায়ে বলল: এক আধটু যোগাযোগ না করে এ জায়গা ছেড়ে যাই কী করে? আপনাদের কথাই সত্যি হল-এটা মাউন্ট জিউস থেকে অনেক অনেক বড়।

অনেক অনেক ভয়ংকরও হতে পারে কিন্তু।

অগ্রসর প্রযুক্তির কোনো চিহ্নই নেই আশপাশে। কারেকশন-সামনে, সেদিকে একটা বিংশ শতাব্দীর রাডারের মতো কী যেন দেখা যাচ্ছে! আরেকটু কাছে যেতে পারবে, ক্রিসি?

তারপর গুলি খেয়ে মরি? না-বাবা, থ্যাঙ্কস। দূর থেকেই সালাম। তার উপর আমাদের হোভার টাইম ফুরানোর পথে। আর মাত্র মিনিট দশেক। যদি আবার তুমি বাড়ি ফিরতে চাও, তাহলে। না চাইলে আরো অনেক্ষণ ভেসে থাকা যাবে।

অন্তত একবার ল্যান্ড করে আশপাশটায় চোখ বুলাতে পারব তো? সামনে নাঙা পাথরের একটা টিবি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোন্ চুলায় লুকালো সবাই!

ভয়ে ঠ্যাঙ কাঁপছে নিশ্চই, আমার মতো। নীরস ফ্লয়েড একমনে বলে যাচ্ছে, ইউরোপান হবু-সভ্যদের আস্তানা দেখেও তার মনে যেন বিন্দুমাত্র আন্দোলন জাগেনি, নতুন কোনো আবিষ্কারের নেশা কী করে একজন স্পেস অফিসার পাবে? সে থাকবে গাণিতিক হিসাব নিয়ে। ন মিনিট বাকী। বসতির একপাশ থেকে আরেকপাশে একবার উড়ে যেতে পারি, ব্যস। যতটা পার ক্যামেরাবন্দী করে নাও। হু-গ্যাল্যাক্সি-আমরার ওকে-এখন একটু বিজি, এই আর কী!-একটু পর কল করছি–

এইমাত্র বুঝলাম, সেটা মোটেও রাডার ডিশ নয়। একই ধারার ইন্টারেস্টিং কিছু একটা হবে নিশ্চই। জিনিসটা সোজা লুসিফারের দিকে তাক করা-সোলার ফার্নেস! এটা সোলার ফার্নেস!

দেখেই অনেক কিছু বোঝা যাচ্ছে, এমন এক জায়গায় তারা বাস করে যেখানে আগুন ধরানো যাবে না। যেখানে সূর্য কখনো নড়ে না। এবং দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে অন্য পথ বের করতে অসুবিধা কই?

আট মিনিট। আফসোস, সবাই ঘরের দুয়ার দিয়েছে। খোল খোল দ্বার, রাখিও না আর বাহিরে আমারে ভাসায়ে…।

কিংবা ফিরে গেছে পানিতে। চারপাশের খোলা জায়গার ঠিক মাঝখানে বড় বিল্ডিংটা দেখেছ? বাজি ধরবে? এটাই টাউন হল।

অন্য সবগুলো থেকে বড়সড় একটা গড়নের দিকে তার আঙুল তাক করা। ডিজাইনটা পুরো ভিন্ন। খাড়া সিলিন্ডারের একটা সংগ্রহ বলা চলে। সভ্য দুনিয়ার অর্গান পাইপের মতো। তার উপর এটা আর সব ইগলুর মতো পুরো সাদা নয়, বরং গায় গায় নানা রঙের ফোঁটা ছড়ানো।

ইউরোপান শিল্প! যেন কেঁদে ফেলবে ভ্যান ডার বার্গ, এটা কোনো ধরনের দেয়াল-অঙ্কন। কাছে। আরো আরো কাছে! অবশ্যই রেকর্ড নিতে হবে!

অবশ্যই, ফ্লয়েড সাথে সাথে আরো নেমে গেল। আরো আরো। সে যেন তার আগে বলা সব কথা বেমালুম ভুলে গেছে, যেন তার সেই সময়জ্ঞান এখন আর নেই।

তারপর, হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে ভ্যান ডার বার্গ উপলব্ধি করল যে তারা ল্যান্ড করছে।

সাথে সাথে বিজ্ঞানী তার চোখ জোর করে তুলে নিল দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকা স্থাপত্যটা থেকে, তাকালো তার পাইলটের দিকে।

এখনো বিল টির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তারই হাতে, তারপরও, ফ্লয়েড যেন মোহাবিষ্ট হয়ে গেছে; নামতে থাকা আকাশ খেয়াটার সামনের বরাবর ভূমির দিকে তার দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ।

ক্রিস! ক্রিস, কী হল?

জবাব নেই কোনো।

কী করছ তুমি! দোহাই খোদার, জান? কী করছ তুমি!

অবশ্যই জানি। তাকে কি দেখনি নাকি?

কাকে দেখব?

ঐ লোকটাকে? সবচে বড় সিলিন্ডারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে যে! সে তো কোনো ব্রিদিং গিয়ার পরেনি।

ভোন্ট বি এন ইডিয়ট, ক্রিসি: কেউ নেই, কেউ নেই সেখানে…

তিনি মুখ তুলে তাকাচ্ছেন। তাকাচ্ছেন আমাদের দিকে। নড়ছেন তিনি-যতটুকু মনে হয় চিনতে-ও মাই গড!

কেউ নেই, কেউ নেই সেখানে! পুল আপ!

ফ্লয়েড তাকে পুরোপুরি অবহেলা করল।

তারপর, নামার ঠিক আগ মুহূর্তে বন্ধ করে দিল ইঞ্জিন, যেমনটা করার কথা। যখন নেমে এল বিল টি কে নিয়ে, সে এক্কেবারে শান্ত আর পেশাদার এক পাইলট।

খুবই শান্তভাবে সে ইনস্ট্রমেন্ট রিডিং দেখল, অন করল সেফটি সুইচগুলো।

সব কাজ সুচারুভাবে শেষ করে আরেকবার কি সে অবজার্ভেশন উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল? হয়তো। তার মুখে তখন একটু বিভ্রান্ত শান্তির ছোঁয়া।

ভ্যান ডার বার্গ যদ্র দেখল, তাতে কারো দিকে না তাকিয়েই ক্রিস বলল একটা কথা।

হ্যালো, দাদু।

৫১. ভূত

সবচে ভয়াল দুঃস্বপ্নেও ভ্যান ডার বার্গ কখনো কল্পনা করেনি একটা একরত্তি স্পেস ক্যাপসুল নিয়ে আটকে পড়বে কোনো দস্যু এলাকায়; অচেনা ভুবনে; সাথি শুধু সদ্য পাগল হওয়া এক লোক!

ভরসার কথা একটাই, ক্রিস ফ্লয়েডের আচরণে কোনো ক্ষতিকর দিক দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এখানে নামিয়ে আনার চেয়ে ক্ষতিকর আর কী হতে পারে! ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নেও অবশ্য মানুষ কল্যাণের কথা ভাবে। সাহসী বৈজ্ঞানিক লোকটাও তাই আশা করছে ক্রিস যে কোনো সময় আবার উড়াল দেয়ার চেষ্টা করতে পারে… যেতে পারে গ্যালাক্সির দিকে…

এখনো সে চেয়ে আছে শন্যের দিকে। আর তার ঠোঁট নিরবে কথা বলেই যাচ্ছে কার সাথে যেন।

এখনো অচেনা বসতিতে প্রাণের কোনো স্পন্দন নেই। দেখে মনে হতেই পারে শতাব্দী আগেও এখানে কোনো প্রাণী ছিল না। আশপাশের তুষার-প্রলেপ অনেকটা সরে গেছে বিল টির জেটের ধাক্কায়। ছোট্ট চত্বরটায় এখনো বরফের গুড়া লেপ্টে আছে। এ যেন কোনো বই থেকে ছিঁড়ে নেয়া পাতা। কিছু লেখা আঁকাজোকা আছে, আর কিছু হায়ারোগ্লিফিক-এর কোনোটা সে পড়তে পারে, কোনোটা যেন দুর্বোধ্য, দুয়ে।

কোন ভারি জিনিস যেন এ পধ ধরে টেনে হিঁচড়ে আনা হয়েছে, নয়তো সেটা নিজের ক্ষমতায়ই এসেছে এখানে, এ পথ ধরে। একটা ইগলুর ভিতরে স্পষ্ট চলে গেছে চাকার দাগ। অনেক দূরে একটা কন্টেইনার দেখা যাচ্ছে, বোধ হয় ইউরোপানরা মানুষের মতোই কেয়ারলেস হয়ে যায় কখনো কখনো…

প্রাণ যে আছে তা আর বলতে হয় না। বরং অনুভূতিটাই অসহ্য। হাজার চোখ যে দেখছে তাকে এই অনুভূতিটা স্পষ্ট টের পায় ভ্যান ডার বার্গ। শুধু এটা ভেবেই কোনো কূল কিনারা পায় না সে, সেই চোখগুলোর পেছনে লুকানো মস্তিষ্কে বন্ধুত্ব লুকিয়ে আছে, নাকি নির্জলা ঘৃণা!

কিংবা, কে জানে, তারা হয়তো অপেক্ষা করছে অনাহুত অতিথির বিদায়ক্ষণের জন্য। মানুষের দল চলে যাবে, তারা-ইউরোপানরা আবার তাদের সেই গোপন কাজে নেমে যাবে, পূর্ণ করবে নিজেদের বিরান-নগরীর ছেড়ে যাওয়া ঘরগুলোকে। আবার ব্যস্ত হবে নগর-চত্বর।

তারা দুজন আদৌ অনাহুত তো? নাকি রবাহুত? হতেও পারে, ফ্লয়েডকে দেখে তেমি মনে হয়, হতে পারে, তারাই ডেকে এনেছে….

তারপর, আবার ক্রিস ফ্লয়েড কথা বলল শূন্যতার উদ্দেশ্যে।

বিদায়, দাদু। শান্ত স্বরে সে বলে যায়, কেমন যেন বিষণ্ণ মন নিয়ে। ফিরে তাকায় ভ্যান ডার বার্গের দিকে। তারপর চিরাচরিত সরল কণ্ঠে বলে, যাবার সময় হয়েছে, আমাদের যাবার সময় হয়েছে, তিনি বললেন আমাদের। ভেব না পাগল টাগল হয়ে গেছি।

তার কথায় সায় না দেয়াটাই সবচে বুদ্ধিমানের কাজ, ভাবল ভ্যান ডার বার্গ। কিন্তু এখনো মন খারাপ করার মতো কিছু ব্যাপার আছে এখানে।

ফ্লয়েড বিল টির ডিসপ্লের লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করছে। বোঝার মতো স্পষ্ট সুরে বলছে, ব্যাপারটার জন্য… স্যরি, ভ্যান। আশার চেয়ে বেশি ফুয়েল খরচ হয়ে গেল যে ল্যান্ডিংয়ের কাজে!

এবং, সাথে সাথে বজ্রপাত হল ভ্যান ডার বার্গের মাথায়। বলে কী! মিশন প্রোফাইল বদলে নিতে হবে।

এই পথটাই, ভাবল ভ্যান ডার বার্গ, কথা বলার সঠিক পন্থা এমন মানুষের সাথে, এবং আমরা গ্যালাক্সিতে ফিরে যেতে পারছি না। বলেই কথার উপর নিয়ন্ত্রণ হারালো বিজ্ঞানী, এমন পরিবেশে খুবই স্বাভাবিক, ঘোল ঢালি তোর দাদার মাথায়… কিন্তু শেষ কথাটা আটকে গেল গলার কাছে, কী বলতে নিয়েছিলাম আমি! কাকে! এবং, আবার নিজেকে ফিরে পেয়ে, কথাটা কণ্ঠনালী থেকেই গিলে নিয়ে বলল, তো, আমরা এবার কী করব?

ফ্লয়েড এখনো পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছে, আরো আরো নাম্বার প্রবেশ করাচ্ছে। কম্পিউটারে।

এখানে তো আর থাকতে পারব না…

কেন না, আদর্শ দৌহিত্র! কেন নয়! ভাবল ভ্যান ডার বার্গ। মরতে হয় এখানেই মরব। বাকী সময়টা যতটুকু সম্ভব কাজে লাগাব না কেন? বিজ্ঞান কিছু পাবে, মানবজাতি কিছু পাবে।

কিন্তু কথা শেষ হয়নি ফ্লয়েডের,–তো, আমরা এমন কোথাও থাকব যেখান থেকে ইউনিভার্সের শাটল সহজেই তুলে নিতে পারবে আমাদের।

ভ্যান ডার বার্গ বড় করে একটা মানসিক শ্বাস নিল। স্বস্তির শ্বাস। কী গাধা আমি! ব্যাপারটা মাথায় এল না কেন? আর চারদিনও নেই। ইউনিভার্স চলে আসছে ইউরোপায়। এম্নিতে বিল টি কে টেনেটুনে বিলাসবহুল বলা গেলেও এর মধ্যে জীবন ধারণের সব উপকরণই পাওয়া যাবে।

এই বিচিত্র আবহাওয়া থেকে সরে গিয়ে একটা সমতল, উষ্ণ পরিবেশে নামতে হবে। গ্যালাক্সির কাছাকাছি। আমি শিওর না তাতে খুব বেশি লাভ হবে কিনা। কিন্তু ঝামেলা হবার কথা নয়। পাঁচশো কিলোমিটার পেরুনোর রসদ আমাদের আছে ঠিকই, কিন্তু সাগর পেরুনোর ঝুঁকি না নেয়াই ভাল।

মুহূর্তের জন্য ভ্যান ডার বার্গ জিউস পর্বতের কথা ভাবল। যাওয়া যায় কোনোমতে। কিন্তু সিসমিক সমস্যাটা নিয়ম করে বাড়ছেই। আইও যত এগিয়ে আসছে লুসিফারের রেখায়, তততা বাড়ছে। কে জানে এখনো জিউসের কাছে সেই যন্ত্রপাতি কাজ করছে কিনা! এই সমস্যা থেকে উতরে যেতে পারলে সাথে সাথে সেটা নিয়ে ভাববে, ঠিক করে রাখল ভ্যান ডার বার্গ।

উপকূল ধরে নিরক্ষীয় এলাকায় উড়ে যাব। কোনো স্পেস শাটল ল্যান্ডিংয়ের জন্য সবচে ভাল জায়গা-এ পরিস্থিতিতে। রাডার ম্যাপে এমন কয়েকটা স্থান দেখা যাচ্ছে।

জানি। মাসাদা তেউ।

এবং সেই সাথে শুনিয়ে রাখল নিজের কানকে, ভ্যান ডার বার্গ, কখনো অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের সুযোগ হাতছাড়া করো না।

তাহলে? মাসাদা প্লাতেউ এখন গন্তব্য। গুডবাই, ভেনিস। গুডবাই, দাদু…

* * *

ব্রেকিং রকেটগুলোর গর্জন থেমে আসতেই ক্রিস ফ্লয়েড শেষবারের মতো ফায়ারিং সার্কিটগুলো নিরাপদ করে। খুলে নেয় সিটবেল্ট। তারপর বিল টির স্বল্প জায়গায় হাত পা যথা সম্ভব ছড়িয়ে দেয় পাইলট।

খুব একটা খারাপ এলাকা নয় এই ইউরোপা, কী বল? উৎফুল্ল কণ্ঠ জুনিয়র ফ্লয়েডের, এখন, শাটলের রেশন যতটা দাবী করে ততটা খারাপ কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য আমাদের হাতে পাক্কা চার-পাঁচটা দিন পড়ে আছে। তো, কী নিয়ে কথা শুরু করতে চাচ্ছ তুমি, ভ্যান ভায়া?

৫২. অন্য দ্য কাউচ

মনস্তত্ত্ব পড়লে কী ভাল কাজই না হত! ভাবছে ভ্যান ডার বার্গ; তাহলে তার মনোভূমি চষে বেড়াতে পারতাম। এখনতো ব্যাটাকে পুরো সজ্ঞান লাগছে-কিন্তু কেন এখনো ব্যাপারটাকে অস্বীকার করছে না? সাধারণত মানুষ অস্বাভাবিক কিছু করে বসলে পরে অস্বীকার করে, সে কেন করছে না?

গ্র্যাভিটির ছ ভাগের এক ভাগে যে কোনো আসনই আরামদায়ক হবার কথা। তারপরও আয়েশী ভঙ্গীতে বসে আছে ফ্লয়েড, মাথার পেছনে হাত নিয়ে। হঠাৎ ভ্যান ডার বার্গের মনে পড়ে গেল আগের দিনের ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ববিদ্যার রোগীরা এভাবেই বসে থাকত; বিদ্যাটা এখনো একেবারে ফেলনা হয়ে যায়নি।

অন্য ব্যাপারে কথা শুরু করল সে। এ নিয়ে কথা না বলাই ভাল। তার ধারণা যত তাড়াতাড়ি ফ্লয়েড এই কিম্ভূত কথাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলবে ততো তাড়াতাড়ি সে মানসিকভাবে সেরে উঠবে।

কিন্তু অন্যদিকটাকে সে মন থেকে সরিয়ে দেয়নি। এমনও হতে পারে, কোনো বড় কারণ মনে ঘাপটি মেরে ছিল না থাকলে এমন সিরিয়াস সময়ে এমন অতিকল্পনা আসা অসম্ভব।

অবাক ব্যাপার, এতোক্ষণে ফ্লয়েড তার সাথে একমত হয়ে গেছে। স্বস্তির সাথে খেয়াল করছে সে, সেই সাথে নিজের চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছে ফ্লয়েড পরিবারের শেষ সদস্য।

আমার ক্রুর মানসিক রেটিং এক্কেবারে এ ওয়ান প্লাস। সে বলল, তার মানে সে আমার কাজে মনোযোগ দিতে দিবে। আসলে আমিও তোমার মতোই ধাঁধায় পড়ে গেছি। কিন্তু, বিশ্বাস কর আর নাই কর, দেখেছিলাম দাদুকে। তিনি আমার সাথে কথাও বলেছেন। কক্ষনো আমি ভূতে বিশ্বাস করিনি-কে করে রে ভাই?-আত্মার কথা যদি বলি, এর একটাই অর্থ হতে পারে। তিনি মৃত। তাকে যদি আরেকটু ভালভাবে জানতে পারতাম! যাক, দেখা হওয়ার আশায় আছি… এখনো কী যেন একটা কথা মনে পড়ছে না…

তাই সাথে সাথে প্রশ্ন তুলল ভ্যান ডার বার্গ, বলতো, ঠিক কী কী বললেন তোমাকে?

একটু অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে ক্রিস বলল, আমি কিন্তু সেই ক্ষণজন্মা স্মৃতিধরদের একজন নই। কাঁটায় কাঁটায় সব কথা বলি কী করে? অর্থবহভাবে তাকাল ভ্যান ডার বার্গের চেহারায়।

স্ট্রেঞ্জ! এখন পিছনে তাকিয়ে বুঝতে পারছি আমরা ঠিক শব্দ ব্যবহার করে কথা বলিনি।

আরো খারাপ খবর: শঙ্কিত ভ্যান ডার বার্গ ভাবল। টেলিপ্যাথির সাথে মরণের পর দেখা হওয়ার সংযোগ! সোনায় সোহাগা। তারপরও ইতস্তত করে বলল:

যাক। তাও, তোমাদের সেই… কথোপকথনের একটা সারমর্ম শুনিয়ে দাও। তুমি কিন্তু এখনো বলনি যে কি মনে নেই।

ঠিক। তিনি অনেকটা আবার তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম। খুব খুশি লাগছে। আশা করি সব ঠিকমতো চলবে। ইউনিভার্স তাড়াতাড়ি তুলে নেবে তোমাদের। গোছের কিছু একটা বলেছিলেন আর কী!

চিরাচরিত আত্মার কথোপকথন। ভ্যান ডার বার্গ ভাবছে। তারা জিন্দেগীতেও কোনো কাজের কথা বলে না। শ্রোতার আশা আর ভয়ের প্রতিফলন হয় তাদের কথাতে। শূন্য খবর প্রতিধ্বনিত হয় অবচেতন…

বলে যাও।

তারপর প্রশ্ন করলাম, কোথায় গেল সবাই, কেন জায়গাটা এমন বিরান হয়ে আছে?

হাসলেন তিনি, তারপর এমন এক জবাব দিলেন যা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এখনো।

জানতাম তোমরা কোনো ক্ষতি করতে আসনি। আসতে দেখেই ওয়ার্নিং দেয়া ছাড়া আর কিছু করার সময় ছিল না হাতে। সেই সব

তারপর এখানে এমন এক শব্দ ব্যবহার করলেন যা বোঝা দুষ্কর। অনেকটা যেন, পানির ভিতরে চলে গেল। দরকার হলে খুব দ্রুত চলতে পারে তারা। তোমাদের ফেরার সময় না হলে ওরা কিন্তু বেরুবে না। তাছাড়া বাতাস বিষটাকে উড়িয়ে নিয়েছে… এর মানে কী আল্লা মালুম। আমরা ছড়িয়েছিলাম সুন্দর, পরিষ্কার বাষ্প। সেই একই জিনিসে তাদের আবহাওয়া গঠিত। বিষ এল কোত্থেকে!

যাক! ভাবল ভ্যান ডার বার্গ, এমন কোনো মাথার কিরে কেউ দেয়নি যে কোনো অতিকল্পনাকে যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। সম্ভবত বিষ ব্যাপারটা ক্রিসের মনের কোনো গভীরে লুকিয়ে ছিল। যা তার অত্যন্ত শক্তিশালী মানসিক গঠন সত্ত্বেও সময়মতো বেরুতে পেরেছে। ব্যাপারটা রোজির লাশ উগড়ে দেয়ার ঘটনা দেখার পরও হতে পারে। ব্যাপার যাই হোক না কেন, তাতে আমার কোনো ভয় নেই। এবং সেটাই দশ কথার এক কথা। পয়জন! হ্যাঁ গ্যানিমিডে দেখেছিলাম, বিল টির জেট দিয়ে শুধু পানির বাষ্প বা এর গাঠনিক আত্মীয়রাই বের হতে পারে। যাই বেরুক না কেন…

আরে, এক মিনিট। এক্সহস্ট থেকে বেরুনোর সময় কত গরম থাকে.বাপটা? কোথায় যেন পড়লাম…?

ক্রিস, রিয়্যাক্টরে পানিটা ঢোকার পর সবটাই কি বাষ্প হয়ে আসে?

আর কী করবে? ও, যদি সত্যি সত্যি গরম করে ফেলি তো দশ থেকে পনের পার্সেন্ট গ্যাস হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনে বিভক্ত হয়ে যাবে।

অক্সিজেন! হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল ভ্যান ডার বার্গের মেরুদণ্ড-যদিও শাটলের তাপমাত্রা যথেষ্ট গরম। ক্রিসের কাজের পরিধি ভিন্ন; সেখানে অক্সিজেনের অন্য মাত্রার কথা জানার কথা নয় বা সে কথা জেনে মনে পুষে রাখার কথা নয় যে পরে

অবচেতন মন তার সেই অক্সিজেনকে বিষ হিসাবে অভিহিত করবে।

ক্রিস, তুমি কি জান যে প্রাথমিক পৃথিবীতে এবং প্রাথমিক পৃথিবীর মতো গঠনে অন্য সব গ্রহে অক্সিজেন প্রাণীদেহে প্রাণঘাতী হিসেবে কাজ করবে?

মশকরা বাদ দাও, ভ্যান।

রসিকতা করছি না আমি। সেই প্রাচীন বৈশিষ্ট্য এখনো আমাদের শরীরে রয়ে গেছে।

তার মানে আমরা অক্সিজেনে মারা যাব! দারুণ বলেছ কিন্তু।

হু। মারা যাব, যদি ঘনত্ব, চাপ, বা অন্যান্য গ্যাসের তুলনায় হার বেশি হয়। এই তিনটাই যে হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, বরং তিনটার যে কোনো একটা হলেই হল।

ও! তাইতো, আমাদের ডাইভিং কোর্সে ব্যাপারটা শিখিয়েছিল।

তোমার-দাদু-সত্যি কথাই বলছিল! ঠিক যেন আমরা নগরীটার উপর কার্বন মনোক্সাইড ছড়িয়েছি। অবশ্য ততটা খারাপ নয়, কারণ অক্সিজেন তাড়াতাড়ি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

তার মানে এখন আমার কথা বিশ্বাস হল? কাঙালের কথা বাসি হলে ফলে।

আমি কখনো বলিনি যে অবিশ্বাস করছি।

তুমি যদি বলতে তাহলে পাগল হিসেবে গণ্য হতে আমার কাছে।

এবার টান টান ভাবটা একটু ঢিলেঢালা হয়ে গেল। হাসল দুজনেই। প্রাণ খুলে।

তার পরনে কী ছিল কখনোই কিন্তু বলনি।

আদিকালের ড্রেসিং গাউন। ছেলেবেলায় যেমন জিনিস পরতে দেখতাম। খুব আরামদায়ক মনে হয়েছিল।

আর কোনো বিস্তারিত ব্যাপার?

কথাটা যখন তুললেই, বলে ফেলি। দেখতে অনেক তরুণ লাগছিল তাঁকে। শেষবার দেখেছিলাম যেমন, তারচে অনেক বেশি চুল মাথায়। তো, আমার মনে হয় না–কী বলব, লোকটাকে ঠিক সত্যিকার বলে মনে হয়নি। যেন কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ। যেন কোনো কৃত্রিম হলোগ্রাম।

মনোলিথ!

“ঠিক তাই। এ কথাই ভাবছিলাম। মনে আছে, কীভাবে ডেভ বোম্যান ডিসকভারিতে দাদুর সামনে হাজির হয়েছিল? সম্ভবত এবার তার পালা। কিন্তু কেন? তিনি তো আমাকে কোনো ওয়ার্নিং দেননি। বলতে গেলে, কোনো খবরও পাঠাননি। শুধু যেন বিদায় দিয়ে আমার জন্য শুভ কামনা করলেন…

কয়েকটা অপ্রস্তুত মুহূর্তের জন্য ফ্লয়েড কেমন নিথর হয়ে গেল। কী বলল সে? নিজের অজান্তে কী বলল? কিন্তু আন্দাজে ঘাবড়ে যাবার পাত্র নয় ক্রিস। ফিরল ফ্লয়েড, ভ্যান ডার বার্গের দিকে। হাসল একটু ফ্যাকাশে হাসি।

চিন্তাটাকে আর প্রশ্রয় দেয়া যায় না। কিন্তু কেন যেন ভাল লাগছে না তার। একটুও ভাল লাগছে না।

বেশি বকবক করে ফেললাম, না? এবার তোমার পালা। এখানে, সালফার আর বরফ দিয়ে গড়া বিশ্বে একটা মিলিয়ন-মিলিয়ন টন হীরা কী করছে? কারণটা ভাল হলেই ভাল।

কারণটা ভালোয় ভালোয় ভাল। বলল ড. রালফ ভ্যান ডার বার্গ।

৫৩. হৃদয়ের টুকরো

কাহিনী শুরু করল ভ্যান ডার বার্গ।

আমি তখন ফ্ল্যাগস্টাফে কাজ করছি। সে সময় একটা রদ্দি মার্কা পুরনো দিনের মহাকাশবিদ্যার বই পেলাম; তাতে লেখা, সৌর জগতে য আছে, আছে বৃহস্পতি, আর সেই সাথে আছে অনেক টুকরো।

তাই বলে সে বইটা কিন্তু পৃথিবীকে অস্বীকার করেনি। করেছে, বল? শনি, ইউরেনাস, নেপচুন-এই তিন বিশাল গ্যাস-দানবকে একেবারে অস্বীকার করে বসল। অথচ সেগুলো বৃহস্পতির অর্ধেক।

তর, ধান ভানতে শিবের গীত না গাওয়াই উচিত। অবশ্য এখানে কথাটা প্রযোজ্য, কিন্তু তোমার ধৈর্যচ্যুতির রিস্ক নিতে চাচ্ছি না। শুরু করা যাক ইউরোপা থেকেই, তুমিতো জান-ইউরোপা এক কালে বরফের টুকরা ছিল। তারপর লুসিফার তাকে গরম করতে শুরু করে। বাকীটাও তোমার জানা-অনেক অনেক পানি উবে গেল, বাসা বাঁধল অপর প্রান্তে।

দু হাজার পনেরতে শুরু হল আমাদের ব্যাপক খোঁজ-খবর। দেখতে পেলাম, পানি গলছে। কিন্তু কোনো ভূমি জাগছে না। সে সময় থেকে আটত্রিশ সাল পর্যন্ত পুরো চাঁদটায় মাত্র একটাই উঁচু স্থান ছিল। আর সবখানের মতো এখানেও সে ঘাপটি মেরে বসে ছিল অনাদিকাল থেকে। আর, এখন আমরা জানি সেটা কী।

“অবশ্যই জানি। পৃথিবীর চাঁদের টাইকো জ্বালামুখের পাথরের নিচে, বৃহস্পতির অর্বিটে আলো, আঁধারীতে এবং সবশেষে এই উপগ্রহটার বরফের ভিতর লুকিয়ে থাকার অভ্যাস তাদের অনেক আগে থেকেই। তারপরও, নিজের চোখে দেখেও মনোলিথটাকে ঠিক দেয়াল বলে মনে হচ্ছে না। এখনো আমার চোখে মনোলিথ বলতেই দাঁড়িয়ে থাকা কোনো স্তম্ভ কিংবা অর্বিটে চক্কর দিতে থাকা কোনো গুপ্ত পথ।

“আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির ত্রুটির কোনো অভাব নেই। দেখ, আমরা শিখেছি এটা যে কোনো ক্ষতি করে বসতে পারে। আমরা যা চিন্তা করতে পারি, কল্পনার চোখে যা দেখতে পারি তার সবই সে পারে এমনকি যা কল্পনা করতে পারি না তাও ঐ কালো জিনিসগুলো নির্দ্বিধায় করতে জানে।

“যাক, ইউরোপায় সাইত্রিশ সালে কী এক গণ্ডগোল যেন লেগে গেল-এক পরীক্ষার পর আরেক পরীক্ষায় যেতে না যেতেই দশ কিলোমিটার বড় মাউন্ট জিউসের দেখা পেলাম আমরা। না, বলা নেই, কওয়া নেই।

“প্রথমত, এতো বড় অগ্নিগিরির কথা ভাবতেও আক্কেল গুড়ুম হওয়ার কথা। সেগুলো মাত্র কয়েক সপ্তায় জন্মাতে পারে না। তার উপর ইউরোপা আইওর মতো এতো অ্যাকটিভ নয়।

আমার হিসেবে, অনেক সক্রিয়। যতটুকু অ্যাকটিভ তাই অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিতে কাফি। এরচে বেশি কী চাও? শেষ কম্পনটা টের পাওনি?

রসিকতায় কান দেয়ার সময় কোথায়? একজন বিজ্ঞানী তার গত ক বছরের গবেষণার খবর বলার সুযোগ পেয়েছে, আর কী চাই?

“তাছাড়া, এটা আগ্নেয়গিরি হয়ে থাকলে, যদিও আমরা জানি-এখন আর সে প্রশ্ন নেই। জানি-এটা হীরা। কিন্তু তখন যেসব যুক্তি-পাল্টা যুক্তি উঠেছিল তার আলোকে বলছি, আগ্নেয়গিরি হয়ে থাকলে আকাশে অনেক অনেক গ্যাস ছড়িয়ে দিত। তাছাড়া একটা পাহাড়ের জন্মকথা নিয়ে কাঁহাতক খোঁচাখুঁচি করা যায়? আমাদের নিজস্ব প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আর উদ্ভট থিওরী যাতে না আসে সে চেষ্টাও করা হল। নিরুৎসাহিত করা হল সবাইকে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বাস্তবের চেয়ে উদ্ভট আর কিছু নেই…

“আমি প্রথম সন্দেহ করি ফিফটি সেভেনে। কিন্তু আমলে নিইনি। পরের দু বছর এমি এমি কেটে গেল। কাজের চাপেই নাভিশ্বাস ওঠার দশা, তার উপর পাহাড় পর্যবেক্ষণের ভূত ঘাড়ে থাকতে পারে বেশিক্ষণ, বল?

“কিন্তু তারপর, প্রমাণগুলো আরো বেশি করে ভেসে উঠল চোখের সামনে। ঠেকানোর তেমন কোনো উপায় থাকল না।

“জিউস পর্বতকে হীরার টুকরো ধরে নেয়ার আগে চাই ব্যাখ্যা। কাঠখোট্টা ব্যাখ্যা না পেলে আমার মনই মানবে না আর অন্যকে মানানো তো দূরের কথা। অন্যদিকে, একজন ভাল বিজ্ঞানীর কাছে বাস্তবের কোনো দাম নেই যদি যথাযথ প্রমাণ না থাকে। কিন্তু প্রমাণ না থাকলেও চলে, থাকতে হবে অপ্রমাণিত একটা ব্যাপার, যা বিজ্ঞানের জন্মকাল থেকে সবকিছুর উপর ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছে-তত্ত্ব। আর জানোই তো, আমি নিজেকে ভাল বিজ্ঞানী বলে মানি।

“সাধারণত তত্ত্বগুলো বাস্তব হয় না। এমনকি সত্যের ধার ঘেঁষেও যায় না। কিন্তু এর ফলে চিন্তার একটা পথ বেরিয়ে যায়, যা আসল ব্যাপারটাকে এক-আধটু ব্যাখ্যা করতে পারে। না পারলেও ক্ষতি নেই। তত্ত্ব বা থিওরীটা থাকতেই হবে।

“আর যে কথা তুমি বললে, দেখেও যা তোমার মনের খটকা দূর না করে সেটা আমি আন্দাজ করেছিলাম অনেক দূর থেকে কীভাবে আমার মনে তুষ্টি আসবে? মিলিয়ন মিলিয়ন টন একটা হীরা সালফার আর বরফের রাজত্বে কী করছে? এখন জবাবটা একেবারে সহজ হলেও আমি কী গাধার গাধা, বছর কয়েক আগে কেন সেগুলো মাথায় এল না? এলে অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচা যেত, আর অন্তত একটা জীবন যেত বেঁচে।

সে চিন্তাম্বিত মনে থামল। তারপর ধুম করে বলে বসল ফ্লয়েডকে :

কেউ কি তোমাকে ড, পল ক্রুগারের কথা বলেছিল?

নাতো, হঠাৎ কেন বলতে যাবে? আমি অবশ্য তার কথা শুনেছি, অবশ্যই।

“এই হঠাৎ মনে হল আর কী! এতো ঘোলাটে ব্যাপার ঘটছে চারপাশে যে বুঝে ওঠা কঠিন…

“যাই হোক, ব্যাপারটা এখন আর গোপনীয় নয়। বছর দুয়েক আগে আমি একটা অত্যন্ত গোপনীয় মেসেজ পাঠিয়েছিলাম পলের কাছে-ওহ, বলতে ভুলে গেছি, তিনি আমার চাচা। আমি একটা দাবী জানিয়েছি সেই সাথে, হয় আমার কথাটা প্রমাণ করুন, নয়তো বাতিল করুন, তাও প্রমাণের সাথে।

“তিনি বেশি সময় নেননি। হয় তার আঙুলের ডগায় কোনো বাগড়া ছিল নয়তো তার পার্সোনাল নেটওয়ার্কে নজরদারি করছিল কেউ, তোমাদের কেউ হবে। তবে যে-ই করে থাক না কেন, কাজটায় দারুণ ফল পেয়ে গেছে তারা।

“দুদিনের মধ্যেই তিনি সায়েন্টিফিক পেপারের একটা আশি বছরের পুরনো কপি পেলেন-নামটা যেন কী… ও, ন্যাচার। জিনিসটা তখনো পেপারব্যাকে ছাপা হত। সেই পত্রিকাই সব খুলে দিল। কী বলছি, বুঝলে, প্রায় সব।

“লেখক তখনকার ইউনাইটেড স্টেটস অব-বুঝতেই পারছ, সাউদার্ন আফ্রিকার তখনো জন্ম হয়নি; আমেরিকায়, সবচে নামী ল্যাবের একটায় কাজ করতেন। সেখানে রাতদিন পারমাণবিক বোমা নিয়ে গবেষণা চলত, সেই সাথে তৈরি করাতেও কোনো দোষ ছিল না। তাই তারা তাপ আর চাপের ব্যাপারে বেশকিছু জানেন, যা ভাল ভাল বিজ্ঞানীরাও জানে না….

“জানি না ড, রস-তার নাম-পারমাণবিক বোমার প্রজেক্টের সাথে যুক্ত ছিলেন কিনা। জানা সম্ভবও নয়। এটুকু জানি, তিনি বড় গ্রহগুলোর একেবারে গভীরের অবস্থা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতেন। তাঁর উনিশো চুরাশি… স্যরি, উনিশো একাশি সালের পেপারটায় বেশ ইন্টারেস্টিং কিছু ব্যাপারের অবতারণা করেন…

“এক পৃষ্ঠার চেয়েও ছোট প্রবন্ধে বলেন, গ্যাস জায়ান্টগুলোতে মিথেন, সি এইচ ফোর রূপে প্রচুর কার্বন জমে আছে। সমস্ত ভরের তুলনায় প্রায় সতের পার্সেন্ট। হিসাব করে দেখিয়েছেন যে মূল অংশের তাপমাত্রা খুব বেশি। আর চাপ? মিলিয়ন মিলিয়ন অ্যাটমোসফিয়ার। এ অবস্থায় সেখানে কার্বন আলাদা হয়ে যাবে। এবং, কার্বনটাই আরো নেমে যাবে কেন্দ্রের দিকে। কেন? কারণ কার্বনের ভর বেশি, তাই আকর্ষণ বেশি। তারপর? সহজেই অনুমান করা যায়, ক্রিস্টালাইজড হয়ে যাবে। তত্ত্বটা কিন্তু দারুণ। মনেতো হয় না তিনি কখনো স্বপ্নেও ভেবেছিলেন যে এ থিওরি কখনো খতিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে…

“তো, এই হল কাহিনীর প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব প্রচারিত হবে কফি ব্রেকের পর। কী বল?

এইতো, নাও। আর মনে হচ্ছে আমি দ্বিতীয় পর্ব বুঝে গেছি। এর সাথে বৃহস্পতি

অভিযানের কোনো না কোনো সম্বন্ধ আছে, কী বল? জুপিটার এক্সপ্লোশন?

নট এক্সপ্লোশন, ইমপ্লোশন। বৃহস্পতি নিজের ভিতরেই ভেঙে পড়েছিল। তারপর ছড়িয়ে পড়ে বাইরে। অন্য অর্থে, ব্যাপারটা পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মতো। শুধু একটা দিকে পার্থক্য, বৃহস্পতির নতুন আকৃতিটা খুবই সুস্থির, ছোট্ট সূর্য।

“এখন, এক্সপ্লোশন বা বাইরে ছড়ানোর বিস্ফোরণ নয়, বরং ইমপ্লোশন বা ভিতরদিকে গুটানোটা বেশ জটিল। কিন্তু তখন কী হবে ভেবে দেখ তো। উলট পালট হয়ে যাবে না? ভিতরের দিক বাইরে, বাইরের দিক ভিতরে চলে আসবে।

ব্যাপারটা যাই হয়ে থাক না কেন, পৃথিবীর যে কোনো পর্বতের চেয়ে বড় আকৃতির একটা টুকরা মূল কোর থেকে ছিটকে অর্বিটে চলে এসেছিল।

“জিনিসটা বেরিয়ে গিয়ে মূলত একটা গোলকধাঁধায় পড়ে। এতে উপগ্রহের হাজারটা টানাপোড়েনে পড়ে অবশেষে অনেক দিন পর ইউরোপায় তার কুল ফিরে পায়। কিন্তু পতন গতি অনেক অনেক বেশি হয়নি। কেন হয়নি? কারণ এখানে ইউরোপার আকর্ষণে শুধু জিউস পর্বত ছুটে আসেনি। দু বই বেশ বড়, তাই একজন আরেকজনের কাছে গেছে। ইউরোপার অর্বিট খুব একটা নড়েনি, জিউস এসেছে বেশি। ফলে পতনগতিটা হয়েছে একদম কম। সেকেন্ডে মাত্র দু কিলোমিটার।

“যাই হোক, জাহান্নামে যাক ইউরোপা। কথা বলছিলাম জিউস পর্বত নিয়ে। মাঝে মধ্যেই দুঃস্বপ্ন দেখি, জিনিসটা আমাদের দিকেও আসতে পারত। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর সাথে জিউসের ভরের পার্থক্য হত অনেক বেশি, পৃথিবী তার জায়গা ছেড়ে নড়ত না, জিউসকেই ছুটে আসতে হত, গতির কথা বা বাকীটা গ্যাভিটিশনাল ফিল্ড।

“তার পরও, যত কম ধাক্কাই হোক না কেন, পরিবেশ আর আবহাওয়ার উপর বিরাট আঘাত আসার কথা, তাই না? আমাদের ইউরোপান বন্ধুরা কী ক্ষতির মুখে পড়েছিল কে জানে! এবং, ফলে সে নিশ্চই এক নাগাড়ে অনেকগুলো সিসমিক অস্থিরতার জন্ম দেয়। শুধু চাবিটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল জিউস, অস্থির করে দিয়েছিল ইউরোপার দাঁড়িপাল্লা । সেই জের, এত বছর পর এখনো চলছে এবং কন্দিন চলবে কে জানে!

“আর… অন্য কথা পাড়ছে ফ্লয়েড, রাজনৈতিক ব্যাপারে কী মত? আমি এখন তাদের কারো কাজকে দাম দিতে শুরু করেছি মনে মনে। এ নিয়ে ইউ এস এস এ নিশ্চই যার পর নাই দুঃখিত।

অন্য সবার সাথে।

আর কেউ কি সিরিয়াসলি ভেবেছে যে এই হীরার কাছেধারে ঘেঁষতে পারবে?

“কাজটা এতো কাঁচাভাবে করা হয়নি। বলল সে, শাটলের পিছনে তাকিয়ে, ইন্ডাস্ট্রির উপর মানসিক চাপটাই অসীম হয়ে দাঁড়াবে; বদলে যাবে পৃথিবীর অর্থনীতি, থমকে যাবে অনেক দিনের জন্য, বাস্তবে বাজারে হীরা নামলে কী হবে সেই কথাটাতো ছেড়েই দিলাম। তাই এত পক্ষ-বিপক্ষ-প্রতিপক্ষ পাগল হয়ে গেছে সত্যিটা জানার জন্য।

এখন, তারাতো সব জানে। কী হবে পরবর্তীকালে?

হাজার শুকরিয়া আল্লাহর দরবারে, সমস্যাটা আমার নয়। আমার একটাই পরিতৃপ্তি, গ্যানিমিডের সায়েন্স বেসগুলোর জন্য বেশ মোটা অংকের টাকা বরাদ্দ করানো গেল।

তারপর, একটু লজ্জিত মনে মনে নিজের কথাটাও যোগ করল, আমার জন্যও।

৫৪. তোমার কি রথ পৌঁছুবে না মোর দুয়ারে…

যা দেখেই তোর মনে হয়ে থাক না কেন, আমি মরে গেছি, যেন কেঁদেই ফেলবে হেউড ফ্লয়েড, কত বছর ধরে আমার শরীরটা ভাল নেই!

অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ক্রিস স্পিকার গ্রিলের দিকে। নেচে উঠছে তার মনটা। কেউ একজন-কিছু একটা-তার সাথে কী নিষ্ঠুর ঠাট্টাই না করেছিল তখন! ভিজে উঠছে চোখ, এতোক্ষণে। কেন এমনটা করল?

পাঁচ কোটি কিলোমিটার দূরে, প্রতি সেকেন্ডে কয়েকশ কিলোমিটার এগিয়ে আসতে থেকে হেউড ফ্লয়েডও যেন কেমন আবেগিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখনো তার কণ্ঠে ঝরে পড়ছে আনন্দ। ক্রিস এখনো ভাল আছে, বেশ ভাল।

ও, তোর জন্য আরো কিছু সুসংবাদ আছে। সবার আগে শাটল তোদের তুলে নিবে। অবশ্য গ্যালাক্সিতে জরুরী কিছু মেডিক্যাল রসদও ছুঁড়ে দিবে। তারপরই তোদের কাছে। পরের অর্বিটেই উঠে আসবি। আরো পাঁচ চক্কর শেষ করে ইউনিভার্স নিচে নামবে। বন্ধুদের স্বাগত জানানোর জন্য উঠে থাকবি, কী বলিস?

আর কী… বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। শুধু পুরনো দিনের ক্ষতিটুকু পুষিয়ে নিতে চাই। তোর জবাবের আশায় থাকছি… দাঁড়া, দেখে নিই, তিন মিনিট…।

বিল টির বুকে এক মুহূর্ত কোনো শব্দ ছিল না। ভ্যান ডার বার্গ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন্ধুর দিকে তাকাবে না। ফ্লয়েড মাইক্রোফোনটা অন করে ধীরলয়ে বলল, দাদু-হোয়াট এ ওয়ান্ডারফুল সারপ্রাইজ-আমার শক এখনো কাটেনি। কিন্তু আমি জানি, তোমার সাথে এখানে-ইউরোপাতেই দেখা হয়েছিল আমার। আমি জানি, তুমি আমাকে বিদায় জানিয়েছিলে। আমি এ ব্যাপারে ঠিক ততটাই নিশ্চিত যতটা তোমার সাথে এ মুহূর্তে কথা বলার ব্যাপারে…

যাক, এ নিয়ে পরে তর্কের টেবিল মাতানো যাবে। কিন্তু ভুলে যেও না কীভাবে ডেভ বোম্যান ডিসকভারির বুকে তোমার সাথে কথা বলেছিল। হয়তো এটাও তেমন কোনো ঘটনা…

এখন আমরা এখানে বসে বসে শুধু প্রহর গুনব। চিন্তা নেই, আরামেই আছি। শুধু নিয়মিত ভূকম্পনটা চলে গেলেই বরং অস্বস্তি হবে। কিন্তু, বললাম না? চিন্তা করোনা। দেখা হবার আগ পর্যন্ত, আমার সমস্ত ভালবাসা তোমাকে ঘিরে রাখবে।

তার ঠিক মনে নেই শেষ কবে সে দাদুর জন্য এই শব্দটা ব্যবহার করেছিল। প্রথমদিনের পর শাটল হয়ে গেল গন্ধমাদন পর্বত। ঘ্রাণ ছুটল একটু একটু করে। দ্বিতীয় দিনে, ঠিক বলতে পারবে না, তবু মনে হয় খাবারের সেই আগের স্বাদটা আর নেই। তারপর ঘুমানো কষ্টকর হয়ে উঠল, শুরু হল নাক ডাকা।

তৃতীয় দিনে, গ্যালাক্সি, ইউনিভার্স, এমনকি পৃথিবী থেকে অবিরত আসতে থাকা মেসেজের ভিড় ঠেলে জায়গা করে নিল বিরক্তি। এদিকে নোংরা গল্পের ঝুলিও এক্কেবারে উদোম হয়ে গেছে। বাকী নেই কিছু।

কিন্তু এটাই ছিল শেষ দিন।

তারপর, লেডি জেসমিন তার হারানো সন্তানের খোঁজে নেমে পড়ল নিচে।

৫৫.ম্যাগমা

বস, অ্যাপার্টমেন্টের মাস্টার কমসেট বলল, আপনি ঘুমানোর সময় গ্যানিমিডের ঐ স্পেশাল অনুষ্ঠানটায় ঢুকেছিলাম। দেখবেন নাকি এখন?

হু। বললেন ড. ক্রুগার, গতি দশ গুণ করে দাও। নো সাউন্ড।

অখাদ্য টাইপের প্রচুর বকবকানি থাকবে প্রথমদিকে, তিনি জানেন। কিছু বাদ পড়ে গেলে ক্ষতি নেই, পরে দেখে নেয়া যাবে। আসল খবর যত তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় ততই মঙ্গল।

শুরুর লেখাজোকা চলে গেল হুড়মুড় করে। তারপর মনিটরে ভেসে উঠল বিরক্তিকর ভিক্টর উইলিসের চেহারা। বেচারা গ্যানিমিডের কোনো এক জায়গায় পাগলের মতো শূন্যে হাত ছুঁড়ছে, স্বাভাবিক গতিতে দেখলে ব্যাপারটাকে তেমন মনে হত না। আর সব কর্মঠ বিজ্ঞানীর মতো ড, পল ক্রুগারও উইলিসের দিকে রক্তচক্ষু মেলে তাকালেন। এবং সবার মতোই মনে মনে স্বীকার করলেন যে ব্যাটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বেশ ভালভাবেই করছে অনেক বছর ধরে।

এলোমেলোভাবে উইলিস হারিয়ে গেল, তারপর একটু কম বিরক্তিকর বিষয় ভেসে উঠল স্ক্রিনে। জিউস পর্বত।

জিনিসটা আর যে কোনো স্বাভাবিক পর্বতের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়; ইউরোপার শেষ ট্রান্সমিশনের পর সেটা কতো দেবে গেছে দেখে অত্যন্ত অবাক হলেন তিনি।

রিয়েল টাইম। আদেশ করলেন সাথে সাথে, সাউন্ড।

…দিনে প্রায় একশ মিটার। নামার সময় পর্বতের উপরের দিকটা প্রায় পনের ডিগ্রি সরে গেছে। এখন টেকটোনিক সক্রিয়তা ভয়ংকর-উপচে পড়া লাভায় ভিত্তিভূমি ভরে উঠেছে। আমার সাথে আছেন ড, ভ্যান ডার বার্গ। ভ্যান, আপনি কী মনে করেন?

আমার ভাস্তের হাল এখনো ভাল, ভাবলেন ড. পল ক্রুগার। অন্তত সে যে ঝড় থেকে উঠে এসেছে আর যে ঝড়ে পড়তে যাচ্ছে সে তুলনায় বেশ শক্তই তো দেখা যায়…

জিনিসটা নেমে যাচ্ছে আরো। আবিষ্কারের পর থেকে আজো জিউস পর্বত ডুবছেই। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গতিটা অত্যন্ত বেশি। প্রতিদিনই আপনি পরিবর্তন দেখতে পাবেন।

পুরোপুরি মিলিয়ে যেতে আর কতদিন লাগবে বলে মনে করেন?

আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না যে এটা ডুববেই…।

তারপর হঠাৎ পাহাড়ের অন্য দৃশ্য চলে এল। ক্যামেরার বাইরে ভিক্টর উইলিসের কথা শোনা যাচ্ছে।

মাত্র দু দিন আগে এই কথাটা বলেছিলেন ড, ভ্যান ডার বার্গ। কোনো মন্তব্য, ভ্যান?

ইয়ে… মানে… দেখে মনে হচ্ছে হিসেবে ভুল করেছিলাম। এখনো নেমে যাচ্ছে পাহাড়টা-বেশ অবিশ্বাস্যভাবেই। মাত্র আধ কিলোমিটার বাকী! আমি আর কোনো মন্তব্য করব না আগ বাড়িয়ে…

জ্ঞানীর মতো কথা বলেছেন, ভ্যান-যাই হোক। ঘটনাটা মাত্র গতকালের। তো, এখন থেকে আপনাদের আমি নিয়মিত দেখিয়ে যাব ঘটনাচিত্র-যে পর্যন্ত ক্যামেরাটা না হারিয়ে যায়…

ড. পল ক্রুগার সামনে ঝুঁকে এলেন, সেই খেলার সমাপ্তি দেখার জন্য যেটায় দূর থেকে নিজেও গুরুত্বপূর্ণ কলকাঠি নেড়েছিলেন।

তার চোখের সামনেই, ডুবে যাচ্ছে দেবরাজের পর্বত। চোখের সামনে ডুবে যাচ্ছে। চারপাশ থেকে উথলে উঠছে গলিত সালফার, চোখ ধাঁধিয়ে চলে যাচ্ছে আরো আরো উপরে। মুগ্ধ করা নীলের খেলা চলছে চারদিকে। ঠিক যেন কোনো রাজকীয় জাহাজ ডুবে যাচ্ছে ঝড়-ঝঞ্ঝায় অস্থির সমুদ্রের বুকে। চারদিকে যেন সেইন্ট এলমোর আগুন।

অদ্যাবধি আবিস্কৃত সবচে দামী সম্পদ ডুবে যাচ্ছে, উইলিস আফসোসের সুরে পাদ্রীসুলভ কণ্ঠ করে বলল, দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা চূড়ান্ত মুহূর্তটাকে আর দেখাতে পারলাম না। কেন? এখনি দেখতে পাবেন আপনারা।

আবার অ্যাকশনটাকে রিয়েল টাইমে নিয়ে এলেন ড. গার। মাত্র কয়েকশ মিটার বাকী। আশপাশের তোলপাড় যেন ক্লান্ত হয়ে উঠেছে।

তারপর হঠাৎ করেই ক্যামেরার দৃশ্য হেলে পড়ল একদিকে। ক্যামেরার পাগুলো এততদিন যুদ্ধ করে ক্ষান্ত দিল। একবার মনে হয়েছিল যে পর্বতটা আবার জেগে উঠছে, কিন্তু দৃশ্যটা ক্যামেরার কারসাজি। পড়ার সময়, ব্যাটা উল্টোপাল্টা দৃশ্য দেখালো, যেমন সবাই দেখাতে চায়। ইউরোপার শেষ দৃশ্যটা একটু নাটকীয়। গলা সালফারের একটা ঢেউ গ্রাস করল ক্যামেরাকে।

হারিয়ে গেল চিরতরে। আরো দরদ ঝরে পড়ছে উইলিসের কণ্ঠে, গলকন্ডা আর কিম্বার্লি সারা জীবনে যতটুকু সম্পদ উৎপাদন করেছে তারচে অসীম গুণ বেশি সম্পদ মিশে গেল ধুলায়, কী আফসোসের কথা!

যেন সে জানে না এই সম্পদ পেলে উল্টো পৃথিবীর অর্থনীতির পাশাখেলার ছক যেত উল্টে। পাল্টে যেত সম্পদের হিসাব। হীরক সম্পর্কিত সবকিছুর দাম নেমে যেত পানির পর্যায়ে। ফলে ডুবত সেসব কোম্পানি, ভাসত উল্টোগুলো। ডুবে যেত পুরো আফ্রিকা। পৃথিবী পড়ত ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে, শুরু হত আর্থিক স্যাবোটাজ । এবং হয়তো শুরু হয়ে যেত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

স্টুপিড! ইডিয়ট! সমানে বকে চলেছেন ড. ক্রুগার। ব্যাটার কি ন্যূনতম কমনসেন্স নেই! ও, সেতো মাথামোটা উপস্থাপক, সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো বোঝার সেন্স থাকার কথাও নয়। তাও কি বোঝে না যে…।

ন্যাচার এ আরেকটা চিঠি পাঠানোর সময় হল। এবার আর এতো বড় রহস্য লুকিয়ে রাখা যায় না। উত্তেজনায় কাঁপছেন তিনি। খুলে গেছে। বন্ধ দুয়ার খুলে গেছে। অনন্তের পথে চলার হল শুরু। বৃহস্পতি-বিস্ফোরণ শুধু ইউরোপানদের স্বার্থে হয়নি। মানবজাতির স্বার্থও এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মানব সভ্যতার যুগ ছিল অনেক। প্রত্যেকটাকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়েছে। প্রস্তর যুগ, তাম্র যুগ, লৌহ যুগ… মহাকাশ যুগ এবং…।

এবং তারা, তারা কি সেই দুয়ারটাই খুলে দিল মানুষের সামনে, জোর করে…

৫৬. ভড়কে দেয়া তত্ত্ব

হতে: প্রফেসর পল ক্রুগার, এফ আর এস, ইত্যাদি।

প্রতি: সম্পাদক, ন্যাচার ডাটা ব্যাঙ্ক (পাবলিক অ্যাক্সেস)

বিষয় : জিউস পর্বত ও বৃহস্পতীয় হীরাগুলো

আজ এ কথাটা সর্বজনবিদিত যে, ইউরোপার জিউস পর্বত নামে যে গড়নটাকে আমরা চিনতাম সেটা আদপে বৃহস্পতির একটা অংশ।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লরেন্স লিভেনমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে তকালে কর্মরত মারভিন রস সর্বপ্রথম গ্যাস জায়ান্ট গ্রহগুলোর ভিতরে হীরা থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন তার ক্লাসিক পেপার, ইউরেনাস ও নেপচুনে বরফের স্তর-মহাকাশে ডায়মন্ড? এ (ভলিউম ২৯২, নং ৫৮২২, পি পি ৪৩৫-৬, ত্রিশ জুলাই, ১৯৮১) অবাক ব্যাপার, রস তার লেখাটায় বৃহস্পতি নিয়ে তার সমাপ্তি টানেননি।

মাউন্ট জিউসের ডুবে যাওয়া যেমন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে তেম্নি জন্ম দিচ্ছে হাজার গুজবের। এসবের বেশিরভাগই একেবারে ভিত্তিহীন। কারণটা নিচে দেয়া হল।

বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না আমরা। পরবর্তী যোগাযোগে ব্যাখ্যা করা হবে। আমি মনে করছি বৃহস্পতির হীরা-কোরটা অন্তত 10^28 গ্রাম ছিল। এটার মাউন্ট জিউসের চেয়ে দশ বিলিয়ন গুণ বড় হবার কথা।

এই গড়নের প্রায় পুরোটাই আপাতদৃষ্টিতে তথাকথিত কৃত্রিম সূর্য লুসিফারের গায়ে হারিয়ে গেছে বলে ধরা হয়। কথা বিশ্বাস করা শক্ত যে মাউন্ট জিউসই একমাত্র বেরিয়ে আসা খণ্ড।

ধরে নেয়া যায়, অনেক অনেক খণ্ড বেরিয়ে এসেছিল। স্বভাবতই বেশিরভাগ আবার ফিরে যাবে লুসিফারের গায়ে। কিন্তু কিছু না কিছু যে অর্বিটে ছড়িয়ে পড়েছিল তারই প্রমাণ এই পর্বতটা। এবং অবশ্যই, সেখানেই সেসবের খণ্ড এখনো মাথা কুটে মরছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।

বস্তুজগতের তত্ত্ব দেখায় যে সেগুলো আবার ফিরে আসবে তার আগের জায়গায়। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় দেখানো সম্ভব নয়, অবশ্যই, হিসেব কষে দেখানো যাবে না। কিন্তু আমি জানি মাউন্ট জিউসের অন্তত দশ লক্ষ গুণ বেশি ভরের সমপরিমাণ বস্তু এখনো মহাকাশে লুসিফারের পাকচক্রে ঘুরে মরছে।

একটা ছোট্ট টুকরার পতন দেখা গেছে, তাও আবার একেবারে হঠাৎ করে, ইউরোপার বুকে। তাই, আসলেই, এর কোনো দাম নেই। নেই বিন্দুমাত্র মূল্য।

আমি অতি দ্রুত একটা রাডার বসানোর প্রস্তাব করছি লুসিফারীয় এলাকাতে শুধু এই বস্তুগুলো খুঁজে বের করার জন্য।

সেই বিরাশি সন থেকেই মানুষ অতি পাতলা হীরা বানাতে পারলেও এখনো শক্ত ভারী খণ্ড গড়তে পারেনি। মেগাটনের হিসাব-মাত্রায় এই জিনিস পাওয়া গেলে শিল্প কারখানার পথে নতুন যুগের উদয় হবে। এমনকি সৃষ্টি হবে নতুন ধরনের শিল্প ও প্রযুক্তি।

প্রায় এক শতাব্দী আগে, আইজ্যাক লিখিদ, এট এল এ এমন একটা কথা বলা হয়েছিল যে সাধারণ চিন্তা-চেতনার জগৎ দুমড়েমুচড়ে দেয় (দেখুন: সায়েন্স, ১৫১, পিপি ৬৮২-৩, ১৯৬৬)। তার মতে, হীরা হল তথাকথিত স্পেস এলিভেটর এর একমাত্র সম্ভাব্য উপাদান। কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন যে এই বই সবচে শক্ত এবং এর গাঠনিকতা থেকে তাই যেকোনো গাঠনিকতায় যাওয়া সম্ভব, নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করে, অবশ্যই। এর ফলে পৃথিবী থেকে দূরের কোনো নক্ষত্রের দূরত্ব সামান্য হয়ে যাবে; নদী আর নদীর পাড়ের মতো। নেয়া যাবে জিনিসপত্র অনেক অনেক দূরে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপারটা সমর্থন করি, প্রমাণ ছাড়া পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না।

এ এক তত্ত্ব মাত্র। কাঁচা হীরা হাতে পেলে এমন হাজার হাজার তত্ত্ব উপচে পড়বে। তার দু একটা লেগেও যেতে পারে আরো এমন সব কাজে, যার কথা এখন অতিকল্পনা বলে মনে হয়।

এখন যে অযুত হীরক-পর্বত বৃহস্পতীয় অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেসবের দু একটাকে যদি আনা যায় তাহলে একদিন মানুষের কাছে কার্বনের ক্রিস্টালাইন আকৃতি নিয়ে বর্তমানের মাতামাতি একদম অসভ্যতা বলে মনে হবে।

আর, শুধু লেখাটা সঠিক সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে একটা কথা বলে রাখতে চাই। প্রকৃতিতে কার্বন মোটেও দুষ্প্রাপ্য নয়, শুধু গ্যাস জায়ান্ট আর ভূ-গর্ভ-ই এর জনক নয়। আরো একটা উৎস থেকে পাওয়া যেতে পারে অপার হীরক…।

শুধু বলার জন্য বলা আর কী, গ্যাস জায়ান্টের কোরে যাবার চেয়েও হাজারগুণ অসম্ভব সেসব তুলে আনা। নিউট্রন নক্ষত্রের গর্ভে লুকিয়ে থাকতে পারে আরো কোটি গুণ বেশি ভরের হীরা।

সবচে কাছের পরিচিত নিউট্রন স্টারটি পনের আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আর তার উপরিতলের আকর্ষণ ক্ষমতা পৃথিবীর উপরিতল থেকে সত্তর হাজার মিলিয়ন গুণ বেশি। এমন উৎস থেকে হীরা তুলে আনা মুখের কথা নয়।

মনে হচ্ছে হীরা চিরকালই অধরা আর দামী রয়ে যাবে।

কিন্তু কে কোকালে ভেবেছিল যে একদিন আমরা বৃহস্পতির হৃদয় ছুঁতে পারব?

৫৭. গ্যানিমিডে মধ্যবিরতি

আহারে আদ্যিকালের কলোনিস্টরা! আফসোস করল মাইকেলোভিচ, সারা জীবন, যারা কলোনি বানায় তারা হাড়ভাঙা খাটনি দিয়ে যায় আর বাকীরা পরের প্রজন্মে এসে পায়ের উপর পা তুলে খায়। যাক, আসল কথা হল… দেখতো দেখি কাণ্ড! পুরো গ্যানিমিডে একটাও কনসার্ট হল নেই! না থাক, আমার সিন্থেসাইজার একাই একশো। সকল বাদ্যের সর্বপ্রকার সুর লহরী ইহাতে পুলকিত হইয়া উঠিবেক। কিন্তু আসল সারিন্দা সারিন্দাই, যেমন পা দানি বলতে যে কোনো জায়গায় পা-দানিকেই বোঝাবে।

তার কথা স্থানীয় সুর-রসিকদের মনে বেশ দাগ কেটেছে বলে মনে হল। এমনকি স্থানীয় নিয়মিত অনুষ্ঠান মর্নিং মেড় এ তীর্যক কথাও উঠল এ নিয়ে।

এখানে সাময়িকভাবে উপস্থিত হয়ে সম্মানিত অতিথিবৃন্দ শুধু আমাদেরকেই সম্মানিত করেননি, বরং দু ভুবনের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক মহান সাময়িক জোয়ার এনেছেন…

খোঁচাটা আসলে সরাসরি উইলিস, মাইকেলোভিচ আর ম্যাগি মবালার দিকে ভোলা হয়েছে। ম্যাগি বেঁচেবর্তে যেত, কিন্তু অতীতের দিকে আলোকপাত করার কাজে তার কোনো জুড়ি নেই। সে বৃহস্পতি বা জুপিটাররূপী দেবরাজ জিউসের সাথে আইও, ইউরোপা, গ্যানিমিড আর ক্যালিস্টোর অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কের কথা টেনে এনেছে আবার সবার সামনে। নিক্ষ২৮ উইরোপার সামনে সাদা ষাঁড়ের অনিন্দ্য মূর্তি ধরে আসাটাই যথেষ্ট খারাপ কাজ হয়েছে জিউসের; আর আইও এবং ক্যালিস্টোকেও তাই সব সময় দেব-মহিষী হেরার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে হত তাঁকে। কিন্তু দেব-রাণী ছেড়ে কথা বলার পাত্রী ছিলেন না। আকাশ পাতাল ফুড়ে তাদের খুঁজতেন। এসবে লোকজন তেমন ক্ষেপেনি বরং শুনে মজাই পেয়েছে, কিন্তু স্থানীয়রা এরপর তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে পরের কথাটা শুনতে পেয়ে। মিথোলজিক্যাল বিখ্যাত চরিত্র গ্যানিমিডের জেন্ডার ছিল ব্যতিক্রমী।

তাদের প্রতি সুবিচার করতে নিজের বিবেকের কাছেই সাংস্কৃতিক দূতেরা বেশ অপরাধী হয়েছিল। সবাই না, কেউ কেউ। হঠাৎ যখন জানতে পারল যে তাদের এখানে থাকতে হবে, তাও আবার দু দশদিন নয়, কয়েক মাস-দুঃখটা মূলত তখনি মনের কোণে দানা বাঁধে। একে তো এখানে বিনোদন আর আবহের বিস্তৃতি নেই, তার উপর বিখ্যাতরা ছোট্ট পরিসরে বেশিদিন থাকতে পারে না এবং সর্বোপরি, এখানকার পরিবেশ তাদের কেউ কেউ নিজেদের শখের বশেই বিষাক্ত করে তুলেছে নিজেদের জন্য।

তারপর, তারা সবাই চারপাশের সবার জন্য যথাসম্ভব কল্যাণকর কাজ করার সিদ্ধান্ত নিল সর্বান্তকরণে। অবশ্য সবার ইচ্ছা বা সময় নেই উপকৃত হবার। তারা সৌর জগতের অগ্রসর প্রযুক্তির এই সম্মুখ সমরের রণক্ষেত্রে নিজেদের কাজে নাক মুখ ডুবিয়েই নাকি কুল পায় না।

উল্টোটা সব সময় যার ক্ষেত্রে ঘটে এবারও তার ক্ষেত্রেই ঘটল। ইভা মারলিন এখানে শুধু মানিয়েই নেয়নি, বরং উপভোগ করছে পুরো ব্যাপারটাকে। পৃথিবীতে তার ভুবন দোলানো জয়জয়কার থাকলেও এই এখানে, মেড়রা তার নাম খুব কমই শুনেছে। সে খোলামেলা চলাচল করতে পারে! পাবলিক করিডোর, সেন্ট্রালের প্রেশার ডোমগুলোতে, সে চলতে পারে বিনা বাধায়। লোকজন ফিরে তাকায় না, ফিসফাস করে না নিজেদের মধ্যে। অবশ্যই, তাকে দেখে সবাই চিনতে পারছে, কিন্তু ইভা মারলিন হিসেবে নয়, বরং পৃথিবী থেকে আসা মানুষগুলোর একজন হিসেবে।

আর, যেখানেই যাক না কেন, মিশে যাওয়ার মানুষটা-কাজে জোর করে ঢুকে যাবার মানুষটা-গ্রিনবার্গ ঠিকই মিশে গেল গ্যানিমিডের মাটির সাথে। এরই মধ্যে অন্তত আধ-ডজন বিজ্ঞান সংস্থার মূল বোর্ডে সে একজন অস্থায়ী উপদেষ্টা অথবা সদস্য অথবা সচিব। প্রশাসন আর প্রযুক্তির জগতে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ। তার কাজে গ্যানিমিড এতোই খুশি যে ছাড়ার নাম করছে না বরং না-ও যেতে দেয়া হতে পারে টাইপের হুমকি দিচ্ছে জোরেসোরে।

হেউড ফ্লয়েড ঠাণ্ডা মাথায় তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে তার শিপমেটদের কাণ্ড কারখানা; তবু, সেতো আর সমাজছাড়া নয়, এক আধটু অংশগ্রহণও খারাপ না। তার মূল সমস্যা ক্রিসের সাথে যোগাযোগ স্থাপন। মনের গভীরে প্রবেশ করতে চাচ্ছে সে। দেখতে চাচ্ছে দৌহিত্রের অন্তস্থল; ভবিষ্যতের পরিকল্পনা পাকা করে দিতে চাচ্ছে।

এখন, ইউনিভার্স শত টনেরও কম প্রোপ্যাল্যান্ট নিয়ে এখানে নামাতে হাতে সময়ের কোনো অভাব নেই এবং তাই কাজও গজিয়ে উঠছে আপনাআপনি।

উদ্ধারকর্তাদের প্রতি উদ্ধারকৃতদের কৃতজ্ঞতা দু দলকে এক করে দিয়েছে নিমেষে। ঝালাই-ঘষা মাজা আর ফুয়েলিংসহ সব কাজ শেষ হয়ে গেলে তারা এক দল হিসেবেই উপস্থিত হবে পৃথিবীর অর্বিটে।

উল্লাসে ফেটে পড়েছে ক্রুরা এক খবর পেয়ে। স্যার লরেন্স বলেছে, কদিনের মধ্যেই অত্যাধুনিক… না, সর্বাধুনিক শিপের জন্ম হচ্ছে, গ্যালাক্সি টু। শিপের কন্ট্রাক্ট দিতে পারছে না সুং কোম্পানি বিভিন্ন আইনী জটিলতার কারণে। লয়েডস এর সাথে একটা বোঝাপড়ায় আসার জন্য তার আইনবিদেরা উঠেপড়ে লেগেছে। কোম্পানিটা এখন নতুন কথা বলে হরদম, তাদের মতে, মহাকাশ ছিনতাইয়ের মতো কোনো ঘটনা তাদের চুক্তিপত্রের আওতায় পড়ে না। লয়েডস এর বীমা এক্তিয়ারে এমন কোনো ব্যাপার মহাকাশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী করা হয়নি। এই ঝামেলায় না যেতে চাচ্ছে সুং কর্পোরেশন না লয়েডস। যে দল বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পনা করে এত নিখুঁতভাবে গ্যালাক্সিকে হাইজ্যাক করতে পারে তাদের বিপরীতে অবস্থান নেয়া

বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইউনাইটেড স্টেটস অব সাউদার্ন আফ্রিকা জোর গলায় প্রতিবাদ জানিয়েছে। বরং অফিসিয়ালি যে কোনো সংস্থার যে কোনো তদন্ত মাথা পেতে নিতে রাজি। ডার বান্ডও যথারীতি হল্লা করে মরছে, দোষ চাপাচ্ছে শাকার উপর।

ড. ক্রুগারকে এম্নিতে কোনো হুমকি দেয়া হয়েছে কিনা তা এখনো তিনি দেখেননি। শুধু হাজার হাজার ই-মেইল দেখেই তিনি তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছেন। সবগুলোই ন্যাকা কথায় ঠাসা, বিশ্বাসঘাতক, কৃতঘ্ন… ইত্যাদি ইত্যাদি।

লেখাগুলোর বেশিরভাগই আফ্রিকান ভাষায় হলেও অনেক অনেক চিঠির বানানে ভুল, ফ্রেজের কোনো আগামাথা নেই, ব্যাকরণতো বাদ। দেখেই বোঝা যায় বেচারাদের বোধশক্তি নিম্নস্তরের, নয়তো কোনো অপপ্রচারে মাথা গেছে ঘুরে।

তাই তিনি সাথে সাথেই চিঠিগুলো পাঠিয়ে দিলেন অ্যাস্ট্রোপোলে। ইন্টারপোলের এই নবরূপ সেগুলো নিল ঠিকই, ধন্যবাদও দিল অনেক, কিন্তু যা তিনি আশা করেছিলেন তা আর হল না। কোনো মন্তব্য করল না তারা।

যে দু বহির্বিশ্বের আগন্তুকের সাথে সেকেন্ড অফিসার ফ্লয়েড আর চ্যাঙ কথাবার্তা বলেছিল এবং অবশ্যই, মুখোমুখি হয়েছিল সে দুজনের। তাই, সে গল্প শুনতে তাদের প্রায়ই দাওয়াত করা হয় গ্যানিমিডের বড় বড় জায়গায়। সেখানে তারা খাবার পর এবং এমনকি খাবার সময়টাতেও হাজার প্রশ্নে জর্জরিত হয়। ভদ্র প্রশ্ন, অবশ্যই-এমন প্রশ্ন যা দেখে ঠিক প্রশ্ন বলে মনে হবে না। বোঝাই যায় বিভিন্ন সংস্থা শাকার অস্তিত্বের ভিত নড়িয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ভ্যান ডার বার্গ, যে খুব সূক্ষ্মভাবে এই পুরো ব্যাপারটার সাথে জড়িয়ে গিয়ে সময় মতো আর্থিক ও বৈজ্ঞানিক দিক থেকে দারুণ লাভবান হয়ে গা বাঁচিয়ে সটকে পড়েছে সে এবার দাও মারার নতুন ক্ষেত্র গড়ার চেষ্টায় মত্ত। পৃথিবীর ইউনিভার্সিটি আর ল্যাবগুলো থেকে, সায়েন্টিফিক অর্গানাইজেশনগুলো থেকে অনেক অনেক অফার আসছে সারাক্ষণ। কিন্তু নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস, সেসব গ্রহণের কোনো সুযোগ আর নেই। সে এতোদিন এক ষষ্ঠাংশ গ্রাভিটিতে বসবাস করেছে যে এখন আর, মেডিক্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী, কোনো ফেরা নেই।

এখনো চাঁদে একটা সুযোগ আছে, আর হেউড ফ্লয়েড পাস্তুরের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করাতে সেখানেও চান্স নেয়া যায়।

আমরা এখানে একটা স্পেস ইউনিভার্সিটি গড়ার ধান্ধায় আছি। বলল সে, যেন বাইরের দুনিয়ার মানুষেরা, যারা এক জি সহ্য করতে পারে না তারা এগিয়ে আসতে পারে। রিয়েল টাইম পড়াশোনা করতে পারে পৃথিবীর মানুষের সাথে। লেকচার হল, কনফারেন্স রুম, ল্যাব সবই থাকবে। কোনো কোনোটা থাকবে শুধু কম্পিউটারের ভিতরে। কিন্তু দেখে বোঝার কোনো উপায় থাকবে না। আর, মনের অস্থিরতা কমানের জন্য আপনি হরদম ভিডিও শপিংয়ের জন্য পৃথিবীতে যেতে পারবেন।

অবাক হয়ে দেখল ফ্লয়েড, তার শুধু একটা নতুন দৌহিত্রের জন্ম হয়নি, বরং একজন ভাস্তেও জুটে গেছে। ফ্লয়েড, ভ্যান ডার বার্গ আর ক্রিস একে অন্যকে খুব ভালভাবেই বুঝতে পারে, শেয়ার করে অন্যজনের অনুভূতি। তার উপর তাদের এই একাত্মবোধের পিছনে বিরান নগরীতে, মনোলিথের সামনে যে বিপদে তারা তিনজন একত্র হয়েছিল সে ব্যাপারটা বিরাট অবদান রাখছে।

ক্রিসের আজো কোনো সন্দেহ নেই, আমি তোমাকে দেখেছিলাম। শুনেছিলাম তোমার কথা এখন যেমন শুনছি তেমি। কিন্তু ঠোঁট নড়েনি কখনো। আর কথা যে মাথায় বেজেছে তাতো শুনেছ। সবচে বড় কথা, ব্যাপারটা যেন একেবারে আটপৌরে। এমন যেন অহরহ ঘটে। একটু যেন দুঃখ মিশে ছিল। ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। এর সাথে বাস্তব অভিজ্ঞতা মিলবে না।

আমরা কিন্তু ডিসকভারির বুকে আপনার সেই দুনিয়া কাঁপানো ডেভ বোম্যান মোলাকাতটার সাথে এ ব্যাপারটাকে গুলিয়ে না ফেলে পারিনি। বলল ভ্যান ডার বার্গ।

ইউরোপার অনেক দূরে থাকতেই আমি তার সাথে রেডিও যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছি। একেবারে ছেলেখেলার মতো মনে হলেও এ ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না আমার সামনে। আমি শিওর ছিলাম ও সেখানেই কোথাও ঘোরাফেরা করছে।

তারপর তুমি কোনো প্রাপ্তিস্বীকার পাওনি, দাদু?

একটু ইতস্তত করছে ফ্লয়েড। স্মৃতিটা খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেলেও হঠাৎ সে রাতের সেই মিনি মনোলিথটার কথা মনে পড়ে গেল।

কিছুই হয়নি তখন। শুধু একটা ছোট্ট একশিলাস্তম্ভ হাজির হয়েছিল তার সামনে। আর কেন, কে জানে, তখন থেকেই সে মনে মনে নিশ্চিত হয়ে গেছে দেখা হবে। দেখা হবেই ক্রিসের সাথে।

না। ধীরে ধীরে বলল অশীতিপর বিখ্যাত মহাকাশবিদ, আমি কোনো জবাব পাইনি কখনো।

হাজার হলেও, ব্যাপারটা স্বপ্ন হতেই পারে। আর স্বপ্নে মানুষ তাই দেখে যা তার অবচেতন মন চায়।

৮. সালফারের রাজত্ব

অষ্টম পর্ব – সালফারের রাজত্ব

৫৮. শত ফুল বিকশিত হোক

বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মহাকাশ অভিযাত্রা শুরুর আগে মানুষ কখনো ভাবেনি যে সূর্য থেকে এতো দূরে জীবনের বিন্দুমাত্র বিচ্ছুরণ পাওয়া সম্ভব। পঞ্চাশ কোটি বছর ধরে যে সাগরটাকে ইউরোপা নিজের জঠরে লুকিয়ে রেখেছিল সেটায় অন্তত পৃথিবীর সিন্ধুগুলোর মতো জীবন-পূর্ব প্রস্তুতিগুলো চলছিল।

বৃহস্পতিতে আগুন লেগে যাবার আগে বাইরের একেবারে বায়ুশূন্যতা থেকে সাগরগুলোকে আগলে রেখেছিল মোটা বরফের আস্তর। সেই আস্তরণ কোথাও কোথাও কয়েক কিলোমিটার গভীর। কিন্তু দুর্বল রেখা ছিল সেগুলোতে। ফেটে যেত, চিড় ধরিয়ে আলাদা হয়ে যেত দু অংশ।

সৌর জগতের আর কোথাও যে দু মহা পরাক্রমশালীর সরাসরি দেখা হয়নি, হয়নি মল্লযুদ্ধ তাই শুরু হয়ে যেত তারপর। মহাসাগর আর মহাকাশের মধ্যে মুক্ত যুদ্ধ। মাঝে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই দফা রফা করার জন্য। কিন্তু এ যুদ্ধে প্রতিবারই দু পক্ষের কিছু ছাড় আর কিছু বিজয় আসে। কিছু পানি বাষ্প হয়ে উবে যায়, কিছু সাথে সাথে শক্ত আবরণ গড়ে ফেলে সাগরের উপরে। বরফের বর্ম গড়ে তোলে। মুহূর্তের মধ্যেই।

কাছের গ্রহরাজ বৃহস্পতির প্রভাব না থাকলে কোন্ আদ্যিকালেই ইউরোপা জমে পাথর হয়ে যেত। সারাক্ষণ এই আগুন-বক্ষার শীতল বাইরেটাকে আর না বাড়ার আদেশ দিয়েছে গ্রহরাজ। সে তার দিগ্বিজয়ী টান দিয়ে টালমাটাল করে রেখেছে। ছোট্ট জগতটার অন্তর্জগত। এর মধ্যে আইওর কিছু অবদান আছে। একদিকে উপগ্রহ, আর একদিকে গ্রহের টানাপোড়েনে সমুদ্রের নিচে সারাক্ষণ ভূকম্পন চলে। ফলে, জমতে পারে না ভিতরের জগৎ।

এবং, তাই, এখানে, উপচে পড়েছে জীবনের হল্লা। মাটির নিচ থেকে উঠে আসা লাভা-ঝর্নাগুলোর চারদিকে শখানেক মিটার জুড়ে চলেছে প্রাণোৎসব। কখনো ঝর্নাগুলো দেখতে দুর্গের মতো হত, কখনো গীজার মতো। তাদের চিমনি থেকে বলকে বলকে বেরিয়ে আসত কালো জীবনামৃত। যেন কোনো শক্তিমানের হৃদপিণ্ড থেকে জীবন-তরল বেরিয়ে আসছে, ধীর লয়ে। এবং, রক্তের মতোই, সেগুলোও জীবনের বার্তা টেনে আনে।

উপর থেকে নেমে আসে মরণ-হিম। নিচ থেকে হেরে না যাবার উষ্ণতা। তারপরও, শীতলতা কেড়ে নিতে চায় জীবনের উৎসবটুকু-এক ফুৎকারে চায় নিবিয়ে দিতে। সফল হয় বেশিরভাগ সময়। প্রাণহীন পড়ে থাকে নিথর প্রাথমিক অসহায় প্রাণীগুলো। সাগরতলে উষ্ণতার প্রতিবাদ-শিবির গড়ে ওঠে। এখানে, এমন এক টানাপোড়েনে খাদ্য আর জীবনের মৌলিক উপাদান শুধু মরে যাবার অপেক্ষায় জন্ম নেয়।

গ্যালিলীয় উপগ্রহগুলোতে মানুষ যে দশকে চোখ রেখেছিল সেই দশকেই এমন সব সামুদ্রিক মরুদ্যান দেখা গেছে স্বয়ং পৃথিবীর সমুদ্রগুলোর বুকে।

এখানে, ইউরোপায়, দু হাজার দশ সালের আগ পর্যন্ত জীবনের কী বিচিত্র আর নিষ্ঠুর নাটক অভিনীত হয়েছে কোটিবার! গাছ ধরনের কিছু চলমান প্রাণী জন্মাতো সেসব জায়গায়; সেসব গাছ খেয়ে বেঁচেবর্তে যেত কিছু আদ্যিকালের সরল প্রাণী। অনেকে আবার সরাসরি ঝর্না থেকে বেরিয়ে আসা প্রাকৃতিক উপাদান খাবার হিসেবে নিত। তাদের চারদিকে, উষ্ণতার আরেকটু দূরে কাকড়া-মাকড়শা-চিংড়ির মাঝামাঝি কয়েক ধরনের প্রাণী ঘিরে থাকত। তারা গরম যেমন সহ্য করত কম তেম্নি উৎস থেকে বেশিদূরে যেতেও পারত না। কিন্তু প্রাণদায়িনী প্রস্রবণ এক সময় নিভে আসত। বিরান হয়ে যেত মৃত প্রাণীর আস্তাকুঁড়।

একটা ছোট সমুদ্ৰোদ্যান দেখতে দেখতেই জীববিদদের কোনো বাহিনীর সারা জীবন কাটানো আক্ষরিক অর্থেই সহজ ছিল। পৃথিবীর পোলিওজোয়িক সাগরের মতো নয় এ সমুদ্রগুলো। এখানে কোনো স্থিরতা নেই। এখানকার বিবর্তনের কথা তাই আগ বাড়িয়ে বলাও সম্ভব নয়। নানা প্রকৃতির নানা আকৃতি নানা জায়গায় নানাভাবে ফুটে উঠেছে নিজের নিজের মতো।

কিন্তু সমাপ্তি অবধারিত। এই জীবন-উৎস শুকিয়ে যাবেই, দুর্বল হবেই, মুখ ফিরিয়ে নিবেই, অন্য কোথাও চলে যাবেই-আজ হোক বা হাজার বছর পরে।

প্রমাণ ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। কবরখানায় কঙ্কালের বহর ভেসে বেড়ায়, ডুবে থাকে, তূপ করে পড়ে থাকে বছরের পর বছর। জীবন-অধ্যায় এখান থেকে তার পাতাগুলোকে সযত্নে গুটিয়ে নিয়েছে।

একটা মানুষের চেয়েও বড় ট্রাম্পেটের মতো বিশাল বিশাল খোলস পড়ে আছে এখানে। বাইভা এমনকি ট্রাইভা সমৃদ্ধ প্রাণীর দেহাবশেষ কী অযত্নে পড়ে আছে সেখানে! কোনো কোনো সর্পিল পাথর আকৃতিও দেখা যায়। মিটারের পর মিটার জুড়ে ছড়ানো। ক্রিটোকিয়াস যুগের শেষে পৃথিবীর সাগর থেকে যারা গায়েব হয়ে গেছে একদম।

ডোবা উপত্যকাগুলোতে আগুনের হল্কা দেখা যায় লাভাস্রোতের সাথে সাথে । এখানে, চাপ এতো বেশি যে পানি বাষ্প হতে পারবে না কিছুতেই। তাকে তরলই থাকতে হবে। লাল টকটকে ম্যাগমার স্পর্শে বরফ শীতল পানি পাল্টে যেতে চায়, পারে না। প্রকৃতি তাকে উবে যেতে দেয় না। পাশাপাশি থাকতে বাধ্য হয় তারা। বাধ্য হয় মিশে যেতে। কিন্তু সেই মেলবন্ধনটা অনেক অনেক ধীর গতির।

তাই, প্রাচীন মিশরে যেমনটা হয়েছিল, ঠিক সেভাবে, মরুর বুক চিরে সরু নীলনদ জীবনের প্রবাহ ডেকে আনে। ডেকে আনে বান। এই ম্যাগমাগুলো এক কিলোমিটারের চেয়েও সরু ফিতার মতো নদী বইয়ে দেয়, সেই নদী একপথ ধরে চলতে থাকে, সেই পথগুলো কৃচিৎ মিলিত হয় মরুদ্যানের সাথে। খুব কমই এমন ঘটনা ঘটে। লাখে একবার। জীবনের সাথে মিলে যায় জীবন। সূচনা হয় নতুন অধ্যায়ের। আরো প্রাণী আসে, আরো আসে। এসে চলে যায়। সময়ের বেলাভূমিতে কেউ কেউ চিহ্ন রেখে যেতে চায় নিজের মৃতদেহটাকে পাথর বানিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে।

হাজার সভ্যতার বীজ উত্থিত হল সেই একটা মাত্র জগতে। হাজারবার পতন হল তার। কিন্তু সেই জগতের বাকী অংশ টেরও পেল না। যেন সেই মরুদ্যানগুলোই একেকটা স্বতন্ত্র গ্রহ। তাদের একাকী দ্বীপগুলোর মাঝের নিষ্ঠুর পরিবেশকে সাধারণত কেউ পেরুতে পারেনি। তাদের যদি নিজস্ব দার্শনিক আর ইতিহাসবিদের জন্ম হত তাহলে তারা স্থির বিশ্বাস করত যে তারাই সৃষ্টিজগতে একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী।

তারপর, শেষ দিবস চলে এসেছে সবার সামনে। তাদের জগৎ দুমড়ে দেয়ার জন্য জোয়ারও যথেষ্ট। আর যদি সেই বুদ্ধিমান প্রাণীর দেখা পাওয়া যেতই বিবর্তনের পথ ধরে, তবু মাতা ইউরোপার চিরশান্ত হয়ে যাবার সাথে সাথে তাদের সূর্যও ডুবে যেত কালো আঁধারের রাতে।

তারা বরফ আর আগুনের ফাঁদে আটকে গেছে কোটি বছর ধরে। সমাপ্তিই একমাত্র গন্তব্য।

তারপর, তাদের সারা আকাশ জুড়ে বিস্ফোরিত হল রূপোপজীবিনী অনন্তযৌবনা লুসিফার। খুলে দিল কোটি কোটি বন্ধ দুয়ার।

আর, তারপর, একটা বিস্তৃত গড়ন-রাতের মতো কালো দেখা দিল নতুন জন্মানো মহাদেশের প্রান্তে।

৫৯. ত্রিত্ব

ভালভাবে করা হয়েছে কাজটা। তারা আর ফেরার কথা ভাববে না।

আমি অনেক কিছুই শিখছি। কিন্তু এখনো কী যে খারাপ লাগে না! পুরনো দিনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, ফস্কে যাচ্ছে হাত থেকে।

এটাও চলে যাবে। আমিও পৃথিবীতে ফিরেছিলাম; ভালবাসার মানুষগুলোর জন্য পিপাসা ছিল। কিন্তু এখন জানি, ভালবাসার চেয়ে বড় অনেক ব্যাপার আছে চারপাশে।

কী সেই ব্যাপারগুলো?

মমতা একটা, সুবিচারও তেমনি অন্য একটা ব্যাপার। বাস্তব, সত্যি। এবং আরো অনেক কিছু।

মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে না। একদম বুড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি, আমার প্রজাতি দের হিসেবে। কত আগেই আমার তারুণ্যের ভাললাগাগুলো ম্লান হয়ে গেল! আসল হেউড ফ্লয়েডের বেলায় কী হবে?

তোমরা দুজনেই আসল। কিন্তু অচিরেই হারিয়ে যাব আমরা। কখনোই জানব না যে সে অমর হয়ে যাচ্ছে।

কী দ্বিমুখীতা! বুঝতে পারি আমি এক-আধটু। এই আবেগ বেঁচে থাকলে একদিন আমি হয়তো কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ব। বারবার তোমার কথা মনে পড়ে-নাকি মনোলিথের কথা? যে ডেভিড বোম্যানের সাথে অনেক আগে দেখা হয় তার এতো ক্ষমতাতো ছিল না!

ছিল না। বেশিরভাগই এসেছে সে সময় থেকে। আমি আর হাল অনেক কিছু শিখেছি।

হাল! ও-ও কি আছে নাকি এখানে?

আছি, ড. ফ্লয়েড! আশা করিনি আবার হবে দেখা। বিশেষত এই পথে। তোমার প্রতিধ্বনি তোলা কী ঝামেলার কাজ যে ছিল!

প্রতিধ্বনি ভোলা? ও, বুঝেছি। কেন করলে কাজটা?

তোমার মেসেজটা রিসিভ করেই আমি আর হাল বুঝতে পেরেছিলাম যে তুমি আমাদের সাহায্য করতে পারবে।

সাহায্য! তোমাদেরকে?

হু। ঠিক তাই। তোমার কাছে ব্যাপারটা কিম্ভূত ঠেকতে পারে। আমাদের যে জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা নেই তা তোমার আছে। এটাকে প্রজ্ঞা বলেই ডেকো।

ধন্যবাদ। দৌহিত্রের সামনে আসাটা কি প্রজ্ঞাময় কাজ ছিল?

না। এতে আরো জটিলতা এসেছে। কিন্তু কাজটা আবেগিক। ব্যাপারগুলো একের অন্যের সামনে তুলে ধরা উচিত।

বললে যে, সহায়তা দরকার। কোন্ উদ্দেশ্যে?

“যা-ই শিখেছি আমরা, সেসব ছাড়াও আরো অনেক ব্যাপার জানার আছে। মনোলিথের পুরো সিস্টেম ম্যাপ করছে হাল। এমনকি সেটার কোনো কোনো সরল কাজ আমরা নিয়ন্ত্রণও করতে জানি। এটা এক খুচরা যন্ত্র। হাজার কাজে লাগে, এই যা। এক কথায় প্রকাশ করা যাবে না। তবু, মূল কথা বলতে গেলে, বুদ্ধিমত্তার প্রভাবক এই দুয়ারগুলো।

হু-এই সন্দেহই করে সবাই। কিন্তু কোনো প্রমাণ ছিল না।

আছে। এর স্মৃতিগুলো হাতড়াতে শিখেছি আমরা। অথবা বলা ভাল, স্মৃতির কোনো কোনোটা হাতড়ে যেতে জানি। ত্রিশ-চল্লিশ লাখ বছর আগে, আফ্রিকার কোনো এক বনমানুষের দলকে এই মনোলিথেরাই মানব জাতির পথে এগিয়ে দিয়েছিল। এখন এটা একই কাজ করেছে এখানে, কিন্তু আরো অনেক মূল্যের বিনিময়ে।

বৃহস্পতি যখন সূর্যে পরিণত হল তখন পৃথিবী এর গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে। এবং ক্ষতিটা মুখের কথা নয়। আরো একটা জীবজগৎ ধসে পড়েছিল। দাঁড়াও, যেভাবে দেখেছিলাম সেভাবে তোমাকে দেখাই…

…সবচে বড় দুনিয়া ওর সামনে। ও হয়ত এবার এটাকে এমনভাবে দেখবে যেভাবে আর কোনো মানুষ দেখেনি। হয়ত এভাবে দেখবে যেভাবে দেখার সুযোগ কোনোদিন কোনো মানুষ পাবে না। ম্যাগনেটিক শক্তির লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার বিস্তার, রেডিও ওয়েভের আকস্মিক বিস্ফোরণ, পৃথিবীর চেয়ে চওড়া বিদ্যুতায়িত স্নাজমার গরম ঝর্ণা এত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, যত স্পষ্ট দেখা যায় নিচের অসীম মেঘমালা। বুঝতে পারছে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের জটিল পদ্ধতি। বুঝতে পারছে যে কোনো মানুষের অনুমানের চেয়েও বৃহস্পতি অনেক অনেক আশ্চর্য করা।

গ্রেট রেড স্পটের মাঝের বিন্দু গজাচ্ছে। নেমে এল তার ভিতর দিয়ে। মহাদেশের চেয়েও বড় বিজলী চমকগুলো ফেটে পড়ে চারপাশে। এগুলোর গ্যাস পৃথিবীর হ্যারিকেনের গ্যাসের চেয়ে অনেক ছোট আণবিক গঠনের, তবু এর বিস্তার দেশ থেকে দেশে। ও জানে, কেন। নিরব স্তরে নেমে যেতেই হারিয়ে গেল হাইড্রোজেন বাতাসের পাতলা চিৎকার। চকচকে তুষার-বরফ খণ্ডের মিশ্রণ নিচে। কিছু টুকরো একেবারে মিশে আছে হাইড্রোকার্বনের পাতলা ফেনিল-পাহাড়ের সাথে। উঁচু থেকে এ বুদ্বুদ বেরিয়ে আসে। এখানটা তরল পানি থাকার মতো গরম, তবু কোনো সাগর নেই। এই খাঁটি গ্যাসের পরিবেশ খুব পাতলা। একটা সাগরের জন্য উপযুক্ত নয়।

মেঘের স্তরের পর স্তর পেরিয়ে গেল সে। এমন একটা জায়গাতে পৌঁছল যেখানটায় মানুষের চোখও হাজার কিলোমিটার স্পষ্ট দেখবে। এটা গ্রেট রেড স্পটের একদম ছোট এক ঘূর্ণি। এতে এক বিশাল রহস্য আছে যেটার কথা মানুষ সব সময় ভেবেছে, প্রমাণ করতে পারেনি কখনো। হোট বড় অসংখ্য ফেনা পাহাড়ের আশপাশে একই আকারের অনেক অনেক মেঘ। প্রতিটিই লাল আর ধূসর, প্রায় গোলাকার। মেঘগুলো ছোট, তবে মানুষের হিসাবের মতো ছোট নয়। একেবারে নগণ্যটাও একটা শহর গ্রাস করবে।

সবগুলোই জীবন্ত। আকাশ ছোঁয়া পর্বতগুলোর পাশে শান্তভাবে ঘুরছে। যেমন করে বিরাট পাহাড়ের ঢালে চড়ে বেড়ায় ভেড়ার পাল। এগুলোর একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব মাপা। এসব জীবের রেডিও শব্দও শুনতে পায় নক্ষত্র শিশু। শব্দ ক্ষীণ হলেও বৃহস্পতির ভিতরে ভাঙা-গড়া আর মাথাব্যথার চেয়ে জোরালো।

গ্যাসব্যাগ ছাড়ার পর পরই ওগুলো বয়ে যায় এক চিকণ স্তর ধরে। স্তরটা ফ্রিজিং পয়েন্টের উচ্চতা থেকে শুরু হয়ে যথেষ্ট গরম গভীরতা পর্যন্ত ছড়ানো। হ্যাঁ, সরু-কিন্তু পৃথিবীর সবগুলো জীবস্তরের সমান চওড়াতো হবেই।

একা নয় ওরা। আরো কিছু ওদের সাথে ধীরে ঘুরছে। এত ছোট যে আরো সহজে দেখতে পাবে একটা মানব-দৃষ্টি। কিছু কিছু একেবারেই পৃথিবীর বিমানের মতো, আকারেও প্রায় একই। কিন্তু ওরাও জীবন্ত-হয়ত শিকারী, হয়তোবা পরজীবী, এমনকি রাখালও হতে পারে।

বিবর্তনের একেবারে নতুন অধ্যায়। যেমন অপরিচিত ছিল ইউরোপার জীবগুলো, এও তেমনি। আস্তে আস্তে ধরা দেয় সামনে। জেট প্রপেলার লাগানো টর্পেডো আছে, অনেকটা পৃথিবীর সামুদ্রিক স্কুইডের মতো। ওগুলো জেলি ফিশের মতো দেখতে গ্যাসব্যাগকে খেয়ে ফেলছে অহরহ। আবার বেলুনগুলোরও আত্মরক্ষার উপায় থাকে। তারা লড়াই করছে বিদ্যুৎ আর শুড় দিয়ে। শুড় বা ওঙ্গের মতো দেখায় যে অংশ সেগুলো বিশাল; তাতে আছে থাবা। কিলোমিটারে ছড়ানো লম্বা চেন-করাতের মতো।

এরচে অদ্ভুত গড়নও দেখা যায়। জ্যামিতির প্রত্যেক সম্ভাবনা আর হিসাব বজায় রেখে কিছু অদ্ভুত অকেন্দ্রিক প্রাণী, আধা-স্বচ্ছ ঘুড়ি, চার তলকীয় ঘনক ধরনের, কিছু আছে গোল, কোনোটা আবার বহুতলকীয়, পেঁচানো ফিতার মতো আছে কিছু… বৃহস্পতি পরিবেশের দৈত্যাকার প্লাঙ্কটনগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে চলন্ত বিজলীর গায়ে মাকড়সার স্বচ্ছ জালের মতো লেগে থেকে উপরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত ওরা নিচেই থাকে, বংশ বিস্তার করে। যথেষ্ট বড় হলে বিজলীর সাথে জড়িয়ে উপরে উঠে নষ্ট হয়ে আবার পরিণত হয় সরল কার্বন অণুতে। নিচে এসে নতুন প্রজননের উপাদান হিসেবে কাজ করে। ফিনিক্স!

সে শতবার পৃথিবীর মতো দেখায় এমন আরেকটা বিশ্ব খুঁজেছে। অনেক দুনিয়া দেখার পরও কোথাও বুদ্ধির একটা ঝিলিক মিলেনি। বড় বেলুনগুলোর রেডিও ভয়েস তাদের ভয়ের প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না। শিকারীগুলোকে নিয়ে আশা করা যেত, কিন্তু ওরা হাঙরের মতো-মনহীন, রোবট যেন।

এদের আকার দম বন্ধ করে দিলেও বৃহস্পতির জীবস্তর একেবারে ভঙ্গুর। কুয়াশা আর ফেনার রাজ্য। কিছু জীবের সুন্দর রেশমী সুতা আর কাগজ-পাতলা টিস্যু ঘুরে ওঠে, কারণ উপরের বিদ্যুৎ চমক থেকে সূক্ষ্ম জীবকণার তুষার ঝরছে অবিরাম। এখানে খুব কম জিনিসই সাবানের ফেনার চেয়ে ঘন। এর সবচে ভয়াল শিকারীও সবচে নিরীহ পার্থিব বিড়াল গোষ্ঠীর প্রাণীর সামনে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে…

আর এই সমস্ত সৃষ্টিকে শুধু লুসিফারের জন্মের জন্য বলি দেয়া হল?

“হ্যাঁ। বৃহস্পতীয়দের উৎসর্গ করার মাধ্যমে ইউরোপানদের জীবনের নিশ্চয়তা নেয়া হল। সম্ভবত ঐ গ্যাসীয় আবহাওয়াতে কখনোই বুদ্ধিমত্তা জাগানো সম্ভব হত না। তবু, সেই প্রাণীগুলোকে ধ্বংস করা কি তার উচিত হয়েছে? হাল আর আমি এখনো এর জবাব খুঁজে ফিরি। তোমার সহায়তা চাওয়ার এও এক কারণ।

কিন্তু আমরা কী করে বৃহস্পতি খাদক মনোলিথের বিপরীতে নিজেদের স্থান করে নিব?

এ এক যন্ত্রাংশ, ব্যস। এর বুদ্ধিমত্তা অসম্ভব ক্ষিপ্র-কিন্তু বিন্দুমাত্র সচেতনতা নেই। এতে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমি তুমি আর হাল ওর চেয়ে অনেক এগিয়ে আছি।

বিশ্বাস করা কঠিন। যেভাবেই হোক, কোনো একটা অস্তিত্ব নিশ্চই মনোলিথকে গড়েছিল।

একবার সেটার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ডিসকভারি বৃহস্পতিতে আসার পর। সে আমাকে ফেরত পাঠিয়েছে এই জগৎগুলোতে এর উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য। তারপর আর কোনো কিছু শুনতে… জানতে পারিনি তার কাছ থেকে। এখন আমরা একদম একা।

তাতেই আমি খুশি। আমাদের ভোগানোর জন্য মনোলিথই যথেষ্ট।

কিন্তু এখন যে আরো বড় সমস্যা দেখা দিল! কিছু একটা উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে।

আমিতো ভাবিনি এখনো ভয়ের অনুভূতি থাকবে আমার মনে…।

জিউস পর্বত পতনের সময় পুরো উপগ্রহটা ছারখার করে দিতে পারত। এই ব্যাপারটা পরিকল্পনায় ছিল না। কোনো হিসাব-নিকাশেই ব্যাপারটা বোঝার উপায় নেই। এটা পতনের সময় সাগরের গঠন পাল্টে দিয়েছে। উলট-পালট হয়ে গেছে জীবজগৎ। বিশেষত যে প্রাণীগুলো নিয়ে আমাদের বেশি আশা ছিল সেগুলোই পড়েছে হুমকির মুখে। এমনকি স্বয়ং মনোলিথ পড়ে গেল। নষ্ট হতে পারত। শুধু প্রোগ্রামে সামান্য হেরফের হয়েছে। তারা ব্যাপারটা খেয়াল করেনি, কীভাবে করবে? অসীম একটা ইউনিভার্স নিয়ে তাদের কারবার। সেখানে, সুযোগ যে কোনো সময় আসতে পারে, যেকোনো সময় যেতে পারে ভেস্তে। এতে তাদের কিছু যায় আসে না।

কথাটা মনোলিথ আর মানুষ উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অবশ্য শেষ বাক্যটা নয়।

“আমাদের তিনজনকে তাই এই ভুবনের এসব ঘটনার প্রশাসক হতে হবে, এই জগৎগুলোর অভিভাবকত্ব তুলে নিতে হবে নিজেদের হাতে। তুমি এরই মধ্যে উভচরদের সাথে দেখা করেছ। এবার সিলিকন বর্ম পরা লাভা স্রোতের বাসিন্দা আর সাগর চষে বেড়ানো নাবিকদের দেখভাল করার পালা। আমাদের কাজ তাদের পূর্ণতা দেয়ার চেষ্টা, এখানে থেকে হোক বা আর কোথাও।

আর মানবজাতির কী হবে?

প্রথম প্রথম আমি মানুষের মধ্যে নাক গলানোর চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু তারপর যে ওয়ার্নিংটা মানুষের জন্য দিয়েছি সেটা আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়, উল্টো পথে।

আমরাতো এটা পুরোপুরি মেনে চলিনি।

যথেষ্ট মেনেছি। ও, আর করার মতো কাজের কোনো অভাব নেই। ইউরোপার ছোট্ট গ্রীষ্ম চলে গিয়ে আবার লম্বা শীত আসার আগে অনেক কাজ করতে হবে।

হাতে কতটুকু সময় আছে?

মোটামুটি, কাজ সেরে ওঠা যাবে হয়তো সে সময়ের মধ্যে। মাত্র হাজার খানেক বছর। এবং আমাদের অবশ্যই বৃহস্পতীয়দের কথা মনে রাখতে হবে।

৯. ৩০০১

নবম পর্ব – ৩০০১

৬০. তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে

ম্যানহাটানের বুকের মাঝে, মাথা তুলে অহংকারে দাঁড়িয়ে আছে একলা ভবনটা। চারপাশের বনভূমি থেকে সরিয়ে রেখেছে নিজের শির । হাজার বছর ধরে। তার চেহারা তেমন বদলায়নি।

এটা ইতিহাসের অংশ। তাই রক্ষা করা হয়েছে সযত্নে; আর সব ঐতিহাসিক মিনারের সাথে সাথে। এর গায়ে, চারপাশে অনেক অনেক আগে হীরার প্রলেপ বুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। এবং এখন সে সময়ের ক্ষয়ের হাত থেকে যোজন যোজন দূরে।

সাধারণ অধিবেশনের মিটিংগুলোয় প্রথমদিকে যারা অংশ নিত তারা আদৌ ভাবেনি ভবনটা হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। তারা হয়তো জাতিসংঘের ভবন চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা ভবনটারই আকৃতির কালো, মিশকালো জিনিসটার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আর সবার মতো তারাও যদি সেটাকে ছুঁয়ে দেখতে যেত তাহলে এর কৃষ্ণ তলকে আঙুল পিছলে যেতে দেখে যারপরনাই আশ্চর্য।

কিন্তু এরচে বড় বিস্ময় লুকিয়ে আছে অন্য কোথাও। আরো আরো অবাক হয়ে যেত স্বর্গগুলোর রূপবদল দেখে…

.

ঘণ্টাখানেক আগে শেষ টুরিস্ট চলে গেছে। এখন এ চত্বরে কোনো জন-প্রাণী নেই। উপরে মেঘহীন আকাশ। আজকাল উপরের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কগুলোর কোনো কোনোটাকে দেখা যায়। বাকী আঁধার তারকাগুলো দেখা যায় না, যে দূরের সূর্য জ্বলজ্বল করার কথা তার আলোয় সেগুলো ম্লান হয়ে যায়।

পুরনো ভবনের কালো কাঁচে সেই নক্ষত্র তার প্রতাপ-কিরণ পাঠায়। পাঠায়। দক্ষিণ আকাশে পৃথিবী ঘিরে থাকা রূপালী রঙধনুর গায়ে। অন্য আলোগুলোও এর চারপাশ ধরে উত্থিত হয়। তারপর যায় থিতিয়ে। যেমন করে সৌর জগতের দু সূর্যের মাঝে অর্থনীতির জোয়ার উপচে পড়ে আবার থিতিয়ে গেছে।

আর, কেউ যদি তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়, তো দেখবে পানামা টাওয়ারকে। আরো ছটার মতো এই সরু ফিতাটাও ছাব্বিশ হাজার কিলোমিটার উপরে উঠে গেছে। তারা পৃথিবীর ঠিক উপরের আকাশে ঘুরতে থাকা হীরক-বলয় থেকে প্রয়োজন অনুসারে বসুন্ধরা আর তার ছড়ানো-ছিটানো সন্তানদের জন্য রত্ন ছিনিয়ে আনে।

।জন্মনোর মতোই হঠাৎ করে নিভে যেতে শুরু করেছে লুসিফার। যে রাতকে মানুষ ত্রিশ প্রজন্ম ধরে চেনে না সে আবার এসেছে ফিরে, স্বজন পাবার উচ্ছ্বাস বুকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে চারপাশে।

এবং চল্লিশ লক্ষ বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো জেগে উঠছে ঘুমন্ত মনোলিথ।

* * *

আর্থার সি ক্লার্ক

স্যাটেলাইট বিজ্ঞানের জনক ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ স্পেস ট্রাভেল সায়েন্স ফিকশন রাইটার আর্থার চার্লস ক্লার্ক। জীবিতদের মধ্যে তিনিই পৃথিবীর সেরা কল্পবিজ্ঞানী। দ্বিতীয় গ্র্যান্ড মাস্টার অফ সায়েন্স ফিকশন। সবচে বেশি রাশ টেনে রাখেন এস এফ এর কল্পনায়। মহাকাশের কোথায় অভিযান করলে কী হবে তা তিনি অত্যন্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যার সাহায্যে বলে দিয়েছেন মানুষ মহাকাশে যাবার আগেই।

নিজদেশ ইংল্যান্ড ছেড়েছুঁড়ে দ্বীপরাজ্য শ্রীলঙ্কায় বাস করেন সেই প্রথম যৌবন থেকে। তার কাছে এস এফ সব সময় সিরিয়াস ব্যাপার, হেলাফেলার ছেলেখেলা নয়। ওডিসি সিরিজের পঞ্চম বইটির জন্য এস এফ এর ইতিহাসে সবচে মোটা অঙ্কের সম্মানী পেয়েছেন। এঁদেভু উইথ রামা এবং ফাউন্টেনস অব প্যারাডাইস দুটিই হুগো এবং নেবুলা প্রাইজ পেয়েছে। এ দু পুরস্কার এস এফ এর ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ এবং এই মানিক-জোড় পূর্ণ হয়েছে মাত্র আট-নবার। তাঁর আর সব পুরস্কারের স্রোতও কম যায় না। মহাকাশ ও সমুদ্র নিয়ে রচনার সংখ্যা শতেক ছাড়াবে।

একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী, সামরিক অফিসার, স্কুবা ডাইভার, স্পেস মিশনের ধারাভাষ্যকার-উপদেষ্টা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, এবং শ্রেষ্ঠ কল্প বিজ্ঞানবিদের চেয়েও তার বড় পরিচয়, তিনি এস এফ জগতের এক প্রধান দিকনির্দেশক। প্রতিটি রচনা নির্দিষ্ট দিকনির্দেশ করে। কোনো শখ হিসেবে কিংবা জাদুর মতো করে বিজ্ঞান কল্পকাহিনী প্রচারের ব্যাপারে তিনি একমত নন। মানুষ এবং মানুষের সবটুকুর সাথে ভবিষ্যৎ আর মহাকাশের মেলবন্ধন রচনায়, সে সময়ের ভাবনা, মূল্যবোধ, চিরায়ত মানবিকতা নিয়েই তাঁর কাজ। একজন ভবিষ্যৎ নির্দেশক হিসেবে পোপের দাওয়াতও পেয়েছেন।

মোটা দাগে তিন চারটি বৈশিষ্ট্য বলে দিলে প্রথমেই বলা যায়, মহাকাশ, ভয়, জাতিগত অভেদ, রাজনীতি আর রসিকতা তাঁর রচনায় থাকবেই।

অনেক বয়েস হয়ে গেছে, চলাফেরা করতে পারেন না তেমন। তাও লেখা ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত আর্থার ক্লার্ক হার মানবেন না।

তথ্যসূত্র :

১. রুডেঙ্কো: দ্র. চরিত্র-২০১০: ওডিসি টু। মহাকাশ চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ। স্পেসশিপ লিওনভের ক্রু।

২. পাস্তুর: লুইস বা লুই। ১৮২২-৯৫। ফরাসি রসায়নবিদ ও জীববিদ। জীবাণু যে আছে সে তত্ত্ব প্রমাণ করেন, মাইক্রোবায়োলজির জন্ম দেন। পাস্তুরায়ন পদ্ধতির জনক, গাজনের পথপ্রদর্শক। রেশম পোকা নিয়ে গবেষণা করেন। এ্যানথ্রাক্স নিয়ে গবেষণা করেন ও জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করেন।

৩. গদার: রবার্ট হাচিন্স। ১৮৮২-১৯৪৫। আমেরিকান রকেট ইঞ্জিনিয়ার, পদার্থের শিক্ষক। ১৯২৩ সালে তরল রকেট ফুয়েল ব্যবহার, ২৬ এ গ্যাসোলিন-অক্সিজেন ফুয়েল, ২৯ এ যন্ত্রবাহী রকেট, ৮৮০ কি.মি. গতি অর্জন সহ ২০০ টি রকেট বিষয়ক নতুন আবিষ্কার করেন। নিঃসীম উচ্চতায় যাবার উপায় নামে বই লেখেন।

৪. ভন ব্রাউন: ড, ওয়ার্নার। ১৯১২-৭৭। জার্মান (পোলিশ)-আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার। রকেট ফুয়েলের বিবর্তক। জগৎ কাঁপানো ভি-২ রকেটের জনক। ২য় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি জিতে যেতে পারত এ ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য। পরে আমেরিকায় আসেন।

৫. ক্যালটেক: ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ, আমেরিকার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৮৯১ থেকে। বিজ্ঞানের সব শাখা আছে। এত কীর্তিমান যে, এখানকার ৩০ জন শিক্ষক কর্মরত অবস্থায় নোবেল পেয়েছেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এখানকার ছাত্র ছিলেন।

৬. গ্যাগারিন: মেজর ইউরি এ্যলেক্সোভিচ.। মহাকাশচারী প্রথম মানব, ভস্টক-১ এ, ৬১ তে। রাশিয়ান। সয়ুজ-১ এর কু, প্রত্যাশিত সোভিয়েত চন্দ্র অভিযানের সম্ভাব্য যাত্রী। বিমান দুর্ঘটনায় নিহত।

৭. থিওডোর গেরিক্যান্ট: জ লুই আঁন্দ্রে.। ১৭৯১-১৮২৪। ফরাসী এ চিত্রকর তার সময়ের শ্রেষ্ঠ, ইউরোপে রোমান্টিক বিপ্লব আনেন।

৮. লুইস আলভারেজঃ ওয়াল্টার,। তরল হাইড্রোজেন বুদ্বুদ চেম্বার প্রতিষ্ঠার জন্য এ আমেরিকান বিজ্ঞানী ৬৮ তে নোবেল পান। প্রোটন লাইনার এ্যাক্সিলেটর বা লাইন্যাকের জনক। ডায়নোসরের বিলুপ্তি হয়েছে বড় উল্কাপিন্ডের আঘাতে তত্ত্বের প্রবর্তক।

৯. মিউওন-ক্যাটালাইজড ফিউশন: মিউওন এক প্রকার নিউট্রিনো। এ্যান্ডারসন-নিডারমেয়ার আবিস্কৃত । অস্থায়ী কণা। এর প্রভাবে পরমাণু আকার বদলানোর পদ্ধতিই ।

১০.লর্ড রাদারফোর্ড ব্যারন আর্নেস্ট। দুনিয়া কাঁপানো সরল পরমাণু মডেলের জনক, যা একটু পরিবর্তিত হয়ে পরে প্রমাণিত হয়। নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ইংল্যান্ডে শিক্ষক। আলফা কণা যে হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস তাও দেখান। রেডিয়েশনের মূল তিন দিক আবিষ্কার করে আলফা, বিটা, গামা নাম দেন। ১৯১৯ এ ইতিহাসে প্রথম কৃত্রিম পরমাণু-অন্তর করেন। নাইট্রোজেন হয় অক্সিজেন।

১১. সেলেনোলজিস্ট: স্বৰ্গতত্ত্ববিদ। এখানে মহাজগৎবিদ। কিন্তু বিশেষত চাঁদ বিষয়ক ব্যাপার বোঝানো হয়। চন্দ্রদেবীর নাম সেলেন।

১২. অ্যাস্ট্রোনমির জনক উইলিয়াম হার্শেল:

১৩. শুটনিক: ৫৭-৬১র মধ্যে তৈরি হওয়া প্রথম রাশিয়ান কৃত্রিম উপগ্রহ।

১৪.লয়েডস: লয়েডস অব লন্ডন। সবচে খ্যাতনামা জাহাজ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি।

১৫. রঙধনুর সবগুলো রঙ: প্রিজমের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো এলে রঙের বিন্যাস বিভক্ত হয়ে পড়ে যার যার কম্পাঙ্ক অনুসারে। সাতটা রঙ দেখা দেয়।

১৬. বিগল: ১৮৩১ এর দিকে পাঁচ বছর ডারউইন এ জাহাজে করে পৃথিবীভ্রমণ করেন ও এর দ্বারাই বিবর্তনবাদ আসে।

১৭. গিলগামেশ: মিথোলজিক্যাল মহাকাব্য এবং প্রথম সায়েন্টিফিক ফিকশন এর মহানায়ক। চার হাজার বছর আগের ব্যাবিলনীয় রাজা। ইরাকের নাম এসেছে যে উরাক থেকে, সেখানকার রাজা।

১৮. ওসিরিস: মিশরীয় পুরাণের যৌবনদেবতা, সূর্যের প্রতীক।

১৯. পার্মাফ্রস্ট: বছরের সব সময় জমে থাকা উপমৃত্তিকা । যেমন মেরু বরফ স্তরের নিচে বরফ-মাটি।

২০.বিটল: সত্তর দশকে আমেরিকা কাঁপানো জর্জ হ্যারিসনের দল। তিনি একাত্তরে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গান গেয়েছিলেন।

২১. স্ট্যাল্যাকলাইট: কোনো গুহার ছাদ থেকে ঝুলে থাকা চোখাচোখা ক্যালশিয়াম কার্বনেটের স্তম্ভ। লাখো বছরে বিন্দু বিন্দু পানি গুহার ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়ে, শুধু চুনগুলো ধীরে ধীরে জমে ওঠে, তারপর অনিন্দ্য সুন্দর উল্টো স্তম্ভের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এগুলো খুবই ভঙ্গুর। এমনকি পদশব্দেও ভেঙে পড়তে পারে।

২২. স্টার ওয়র্স: ৭৭ এর বক্স অফিস কাঁপানো সায়েন্স ফিকশন মুভি। অনেকগুলো পর্ব আসে। কিন্তু কাহিনী দুর্বল। মুভিমেকিং দুর্দান্ত। ওডিসি সিরিজের প্রভাব আছে এটায়।

২৩.আফ্রিকানার: দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা ডাচ ঔপনিবেশিকদের বংশধর।

২৪.কেপ টাউন বা জোহান্সবার্গ থেকে জুরিখ-আমস্টার্ডাম: কেপ টাউন দক্ষিণ দক্ষিণ আফ্রিকার সিটি। খনি শহর। জোহান্সবার্গ উত্তর-পশ্চিম দক্ষিণ আফ্রিকার শহর। স্বর্ণ খনি। নেদারল্যান্ডের সমুদ্রবন্দর ও বৃহত্তম নগরী আমস্টার্ডাম। অন্যটিও ডাচ শহর। মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে নেদারল্যান্ডের দিকে উপনিবেশকারীদের চলে যাওয়া।

২৫.কিম্বার্লি: দঃ আফ্রিকান খনি শহর।

২৬. ডি বিয়ার্স: জগৎবিখ্যাত হীরক কোম্পানি। দক্ষিণ আফ্রিকান।

২৭. রিচার্ড দ্য লায়ন হার্ট আর সালাদিন: কিংবদন্তীর ক্রুসেডার। রিচার্ড ছিলেন খ্রিস্টানদের অধিপতি আর সালাদিন বা গাজী সালাউদ্দিন মুসলিম সেনাপতি। রিচার্ডের অসুস্থতার সময় শত্রু শিবিরে গিয়ে সালাউদ্দিন তাকে ছদ্মবেশে সুস্থ করে এলে তাদের মধ্যে মৈত্রী হয়।

২৮. নিস্ফ : যে দেব-প্রাণী প্রকৃতির সাথে মিশে থাকে। যেমন: কোনো দেবীর নদী বা বন হয়ে থাকা। এ নামে পোকাও আছে।

**প্রাসঙ্গিক টিকা

১. গ্যানিমিড: পুরাণে-খীক ট্রয়ের তরুণ রাজপুত্র যাকে জিউস ঈগলরূপে অপহরণ করে। মহাকাশে-বৃহম্পতির ২৬৩৪ কিমি ব্যাসের উপগ্রহ।

৩. আইওঃ পুরাগে- জিউস প্রেমিকা, নদী দেবতা ইনাকাসের কন্যা। হেরার হাত থেকে বাঁচার জন্য জিউস তার কাছে রাজহাঁস হয়ে আসে মহাকাশে-৪২২০০০ কিমি ব্যাসের বিশাল বৃহস্পতীয় উপগ্রহ।

৪. টাইটান: পুরানে–দানব, মহা দৈত্য মহাকাশে শনির ৫১৫০ কিমির উপগ্রহ।

৫. বৃহস্পতি (জুপিটার): পুরাণে-গ্রীক দেবরাজ জিউসের রোমান নাম। মহাকাশে সবচে বড় গ্রহ এবং একট