নিজের লোকদের মনোবল বৃদ্ধি করতে, বাবর আর হুমায়ূন দু’জনে কোদাল হাতে নিয়ে তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাটি কাটে। সেটা ঝুড়িতে ভর্তি করে সেই ঝুড়ি কাঠের জোয়ালের দুপাশে ঝুলিয়ে গড়ের উপরে উঠে যায়। তিনদিন পরে গড় সন্তোষজনক উচ্চতা লাভ করে। মাটির এই বেষ্টনীর পেছনে গাড়িগুলোকে পরস্পরের সাথে ভালো করে বাঁধা হয় এবং তাদের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় যত্ন করে নির্ধারিত অবস্থানে কামানগুলো ষাড় দিয়ে টেনে আনা হয়। প্রতিটা কামানের পাশে ভারী পাথরের গোলার একটা স্তূপ তৈরি করা হয় এবং তূর্কী গোলন্দাজের দল তাদের লোকদের নিয়ে গোলাবর্ষণের কুচকাওয়াজ করে। কামারের নেহাইয়ের আওয়াজ এবং অসংখ্য কণ্ঠস্বরের মিশ্রিত কোলাহল- শঙ্কিত আর উত্তেজিত শিবিরের চারপাশে গুঞ্জন তোলে।
বাবুরীকে পাশে নিয়ে বাবর ঘোড়ায় চেপে শিবির পরিদর্শনে বের হলে, কণ্ঠস্বরগুলো নিমেষের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় এবং সৈন্যরা মাথা নত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বাবুরী বাবরের দিকে ঝুঁকে আসে। “সর্বশেষ খবর অনুযায়ী দিল্লীর সেনাবাহিনী যদিও আর মাত্র তিন মাইল দূরে অবস্থান করছে। কিন্তু এখনও তাদের ভিতরে আক্রমণ করার কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।”
“কিন্তু নিদেন পক্ষে- আমাদের সংবাদদাতারা যদি ঠিক খবর নিয়ে এসে থাকে অসন্তোষ দানা বাঁধছে এবং ইবরাহিম তার সৈন্যদের বেতন দিতে কার্পণ্য করছে এই অভিযোগে প্রতিদিন শিবির ত্যাগের সংখ্যা বাড়ছে। আর ভবিষ্যত পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করতেও সে গড়িমসি করছে। একতাবদ্ধ বাহিনীর চেয়ে দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীকে পরাস্ত করাটা সহজ এবং আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাদের হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্ররোচিত করা সম্ভব।”
“সত্যি কথা।”
“ইবরাহিমের জানা উচিত যে আরো অপেক্ষা করলে মনোবল ভেঙে যাবে এবং অভিযোগ আর কোন্দলের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং সম্ভবত তাতে শিবির ত্যাগের ঘটনাই কেবল বাড়বে।”
“কিন্তু আমরা বিলম্বের কারণ যতোই ব্যাখ্যা করি এবং আমাদের লোকেরা যতোই শৃঙ্খলাবদ্ধ হোক না কেন তাদের বেশিদিন আর সামলে রাখা যাবে না।”
“একটা ঝটিকা হামলার পরিকল্পনা করো, যাতে সে আমাদের আক্রমণ করে।”
“কবে?”
“আগামীকাল। সামরিক মন্ত্রণা সভা আহ্বান করো।”
*
পরের দিন সূর্যাস্তের ঘণ্টাখানেক আগে, বাবর তার বিশাল কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায়, তার বাছা বাছা চারহাজার সৈন্যকে অর্ধেকই যার অশ্বারোহী তীরন্দাজ। জড়ো হতে দেখে এবং তারপরে সেনাপতিদের চিৎকার আর ঘোড়ার চিহি রব, নাক ঝাড়ার আওয়াজের মাঝে, যেনো ঘোড়াগুলোও তাদের আরোহীদের উত্তেজনা আর স্নায়বিক চাপ অনুভব করতে পারছে। তারা সারিবদ্ধ হয়ে নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলে বিভক্ত হয়ে রওয়ানা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়। তারা প্রস্তুত হতেই বাবর পরিখা আর বেষ্টনীর ভিতর দিয়ে তার এই ক্ষুদ্র বাহিনীকে নিয়ে শিবির থেকে বের হয়ে এসে বৃত্তাকারে ঘুরে পশ্চিম দিক থেকে সুলতান ইবরাহিমের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। বাবর অস্তমিত সূর্যের দিক থেকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাতে ঘোড়ার খুরের ঘায়ে সৃষ্ট ধূলোর মেঘ আর সূর্যের শেষ রশ্মির আভা মিলেমিশে প্রতিপক্ষকে আক্রমণকারীদের সঠিক সংখ্যা অনুধাবন করতে বাধা দেয়। সুলতান ইবরাহিমের ছাউনির পশ্চিম দিকের সীমারেখার মাইলখানেকের ভিতরে উপস্থিত হতে, বাবর তার লোকদের দাঁড় করায় এবং বাবুরীর দিকে ঘুরে তাকায়। “তুমি কি কিছু শত্রুকে বন্দি করার জন্য সৈন্যদের দায়িত্ব দিয়েছো?”
“হ্যাঁ, আমি নিজে সেই দলের নেতৃত্ব দেবো।”
“তাহলে চলো শুরু করা যাক।”
“চুড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য নিজেকে হেফাজত করবেন।”
হাতের একটা ইশারায় বাবর আক্রমণ শুরু করার আদেশ দেয়। তার কালো ঘোড়ার পেটের চকচকে চামড়ায় গোড়ালী দিয়ে খোঁচা দিয়ে সে দ্রুত তার লোকদের থেকে সামনে এগিয়ে যায়। শীঘ্রই তাকে একশ গজ সামনে থেকে ঘোড়া দাবড়াতে দেখা যায়। সে বুঝতে পারে তার ভিতরে কোনো ভয় কাজ করছে না। কেবল ধাবমান ঘোড়ার গতিময়তার শিহরণ এবং এখনও যুবক বয়সের মতো বলশালী অনুভব করার আনন্দ। তারপরে বাবুরীর শেষ কথাগুলো তার মনে পড়ে: তার নিয়তি নির্ধারক চুড়ান্ত যুদ্ধ এটা না, কেবল তাকে ত্বরান্বিত করার জন্য একটা হামলা। তাকে নিজের অসহিষ্ণুতা আর উদ্দীপনার রাশ দমন করতে হবে এবং তাকে অনুসরণকারী যোদ্ধারা যাতে তার কাছ থেকে আদেশ গ্রহণ করতে পারে সেই সুযোগ তাদের দিতে হবে। সে ঘোড়ার গতি কমাবার ফাঁকে সামনে ইবরাহিমের বিভ্রান্ত লোকদের অস্ত্রের খোঁজে হুড়োহুড়ি করতে দেখে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে ঘোড়ায় চড়ে বসেছে এবং তার সৈন্যদের লক্ষ্য করে তীরের প্রথম ঝাপটা উড়ে আসতে শুরু করেছে।
নিমেষের ভিতরে বাবরের কালো ঘোড়াটা তাকে শত্রুদের মাঝে নিয়ে হাজির করে এবং সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে যুদ্ধের উন্মাদনায় আলমগীর দিয়ে ডানে বামে নির্বিচারে আঘাত হানতে থাকে। যুদ্ধটা তার কাছে মুহূর্তের ভিতরে পরস্পর সংযুক্ত চিত্রকল্পের একটা ঝাপসা কোলাজে পরিণত হয়: নীল পাগড়ি পরিহিত এক হিন্দুস্তানী তার ঘোড়ার খুরের নিচে পিষ্ট হয়ে যায়। মুখের ক্ষতস্থান থেকে, যা দিয়ে ভেতরের দাঁত দেখা যায়। গলগল করে রক্ত ঝরে পড়ে; একটা বাদামী রঙের তাঁবু সহসা সামনে ভূতের মতো দেখা যেতে সে তাঁবুর সাথে যাতে তারা জড়িয়ে না যায় সেজন্য নিজের ঘোড়ার মুখ সরিয়ে নেয়; বাতাস কেটে একটা রণকুঠার উড়ে এসে তার পাশের একটা ঘোড়ার গলায় আমূল বিদ্ধ হতে, সেটা ধীরে তার আরোহীর দেহ নিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়তে একটা ভোঁতা শব্দ ভেসে আসে।