বাবার কথা মনে হলো, আমার জায়গায় সে হলে কি করতো? এখানেই লোকটাকে খুন করতো নিশ্চিত। পুরুষ মানুষ, পুরুষ মানুষের মত আচরণ করো, তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। সেরকম কিছুই কি করা উচিৎ আমার? মেরে ফেলবো লোকটাকে? তাহলে অবশ্য এই সমস্যার সমাধান হবে। শুধু স্মৃতি হিসেবে ক্যাথির মনে থেকে যাবে সে-এই যা। একসময় স্মৃতিটা ভুলেও যাবে। ইচ্ছে করলে এখানেই কাজটা করতে পারি আমি। পার্কের পুকুরে চুবিয়ে মারতে পারি তাকে। দেহ অসাড় হয়ে আসা অবধি শক্ত করে পানির নিচে মাথাটা চেপে ধরে রাখলেই হবে। কিংবা তার পিছু নিয়ে মেট্রো রেল স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে সুযোগমতো ধাক্কা দিয়ে লাইনের ওপরে ফেলে দিয়েও কাজ সারা যায়। লোকে ভাববে আত্মহত্যা করেছে। কিংবা নির্জন কোন রাস্তায় পেছন থেকে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে ঘিলু বের করে ফেলতে পারি।
হঠাৎ করেই ক্যাথির শিঙ্কারের শব্দ বেড়ে গেল। উত্তেজনার চরম মুহূর্তে আছে নিশ্চয়ই এখন…পরক্ষণেই কানে এলে পরিচিত হাসিটা। ডাল ভাঙার শব্দ হলো এসময়। গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসছে দুজনে।
লুকিয়ে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর হাত দিয়ে ডালপালা সরিয়ে বেরিয়ে এলাম আড়াল থেকে। চোখা ডাল লেগে বেশ কয়েক জায়গায় ছিলে গেছে।
দু’চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে এখন। রক্তাক্ত হাত দিয়েই চোখের পানি মুছলাম।
পার্ক থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম উদ্দেশ্যহীনভাবে। নিজেকে ঘরপালানো কোন অভিমানী কিশোর মনে হচ্ছে।
.
৪.৬
“জিন-ফিলিক্স?”
রিসিপশন ডেস্ক ফাঁকা। আমার ডাক শুনেও কেউ বেরুলো না। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে গ্যালারিতে ঢুকেই পড়লাম।
শূন্য করিডোরগুলো পেরিয়ে অ্যালসেস্টিসের সামনে পৌঁছে গেলাম একটু পর। ছবিটার দিকে তাকিয়ে আবারো সেই আগের অনুভূতিই হলো। এখনও অ্যালিসিয়ার এই শিল্পকর্মের রহস্য অধরাই রয়ে গেছে আমার কাছে। ছবিটার মাধ্যমে কোন একটা বার্তা তো আলবত দিতে চাইছে সে, কিন্তু সেটা কি?
এ সময় হঠাৎই একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করে চমকে উঠলাম, আগে চোখে পড়েনি। ছবিতে অ্যালিসিয়ার পেছনে অন্ধকারে একটা ছায়াবয়ব দেখা যাচ্ছে, তবে খুব ভালো করে খেয়াল না করলে বোঝাই যাবে না যে ওখানে কেউ আছে। নিশ্চয়ই এই লোকটাই অ্যালিসিয়ার ওপর নজর রাখা সেই আততায়ী।
“কি চাই আপনার?”
চমকে উঠলাম কণ্ঠস্বরটা শুনে। পেছনে ঘুরে দেখি জিন-ফিলিক্স দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে খুব একটা খুশি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। “এখানে কেন এসেছেন?”
কেবলই কি আবিষ্কার করেছি সেটা তাকে বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। শেষ মুহূর্তে। কেন যেন মনে হচ্ছে সে বিষয়টাকে সহজভাবে নেবে না।
বরং হাসলাম তার উদ্দেশ্যে। “আরো কয়েকটা প্রশ্ন ছিল আমার। এখন কি সময় দিতে পারবেন?”
“আপনাকে যা বলার সব তো বলেছিই। আর আবার কি প্রশ্ন?”
“আসলে নতুন কিছু তথ্য জানতে পেরেছি।”
“কী রকম তথ্য?”
“এই যেমন গতবার যখন আমাদের দেখা হয়েছিল, তখনও জানতাম না অ্যালিসিয়া আপনার গ্যালারি ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছিল।”
এবারে জবাব দেয়ার আগে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল জিন-ফিলিক্স। “কি বলছেন এসব?” দাঁতে দাঁত চেপে বলল অবশেষে।
“ভুল কিছু তো বলিনি?”
“এসবের সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”
“আমি অ্যালিসিয়ার সাইকোথেরাপিস্ট। আমার উদ্দেশ্যে আবারো তাকে স্বাভাবিক জগতে ফিরিয়ে আনা, সেজন্যে প্রথমে তাকে কথা বলাতে হবে। এখন তো মনে হচ্ছে সে চুপ থাকলেই আপনার জন্যে সুবিধে।”
“কি বোঝাতে চাচ্ছেন?”
“অ্যালিসিয়া আপনার গ্যালারি ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছিল, এটা যদি কেউ না জানে তাহলে তার ছবিগুলো যতদিন ইচ্ছে নিজের কাছে রাখতে পারবেন আপনি।”
“আমাকে কিসের জন্যে দোষারোপ করছেন, বুঝতে পারছি না।”
“আপনাকে মোটেও দোষারোপ করছি না আমি। যা সত্য সেটাই বলছি কেবল।”
হাসলো জিন-ফিলিক্স। “সেটা দেখা যাবে। আমি আমার আইনজীবীর সাথে কথা বলবো। আপনার নামে গ্রোভে লিখিত অভিযোগও করবো।”
“আমার মনে হয় না আপনার সেরকম কিছু করা উচিৎ হবে।”
“কেন?”
“কারণ এখনও আমি বলিনি যে অ্যালিসিয়ার গ্যালারি ছেড়ে দেয়ার কথাটা কিভাবে জেনেছি আমি।”
“আপনাকে যে-ই কথাটা বলে থাকুক না কেন, ভুল বলেছে।”
“অ্যালিসিয়া ভুল বলেছে?”
“কিহ?” কয়েক মুহূর্তের জন্যে একদম থমকে গেল জিন-ফিলিক্স। “মানে…মানে ও কথা বলেছে?”
“অনেকটা সেরকমই। আমাকে অ্যালিসিয়া তার ডায়েরিটা পড়তে দিয়েছেন।”
“ওর… ডায়েরি?” কয়েকবার চোখ পিটপিট করলো সে, যেন তথ্যটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। “অ্যালিসিয়া ডায়েরি লেখে, এটা তো জানতাম না।”
“ডায়েরি তো ব্যক্তিগত জিনিস, এ ব্যাপারে না জানাটাই স্বাভাবিক। গ্যাব্রিয়েল মারা যাবার আগ দিয়ে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে আপনাদের, সেই ব্যাপারে বিস্তারিত লেখেছে সে ডায়েরিতে।”
ইচ্ছে করেই আর কিছু বললাম না। আসলে বলার দরকারও ছিল না। পরিস্থিতি কিছুটা গুমোট হয়ে উঠেছে। জিন-ফিলিক্স একদম চুপ।
“আপনার সাথে শিঘ্রই যোগাযোগ করব আমি।” একবার হেসে বেরিয়ে এলাম গ্যালারি থেকে।
সোহো স্ট্রিটে ওঠার পর জিন-ফিলিক্সের সাথে ওভাবে কথা বলার জন্যে কিছুটা খারাপই লাগলো। কিন্তু কাজটা ইচ্ছে করেই করেছি আমি। আসলে দেখতে চাইছিলাম যে কথাগুলো শোনার পর তার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। কিছু একটা তো নিশ্চয়ই করবে সে।