সময় নষ্ট করার কোন সুযোগ নেই। সত্যিকারের অ্যালিসিয়া হারিয়ে গেছে।
আর তাকে খুঁজে বের করবো আমি।
১.৬ প্রফেসর ডায়োমেডেসের অফিসটা
১.৬
প্রফেসর ডায়োমেডেসের অফিসটা হাসপাতালের সবচেয়ে পুরনো এবং জরাজীর্ণ অংশে অবস্থিত। কোণায় কোণায় ঝুল আর মাকড়সার জাল। করিডোরের দুটো বাতি কোনমতে জ্বলছে কেবল। দরজায় ঠকঠক করার কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে তার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
“ভেতরে এসো।”
হাতল ঘোরাতে শব্দ করে খুলে গেল দরজাটা। ধক করে প্রথমেই নাকে এসে লাগলো ভেতরের অদ্ভুত গন্ধ। গোটা হাসপাতালের বাকি অংশের চাইতে একদম ভিন্ন। অ্যান্টিসেপ্টিক বা ব্লিচের ঘ্রাণের কোন বালাই নেই। বরং অর্কেস্ট্রা পিটে নানারকম বাদ্যযন্ত্রের মিশেলে যেরকম গন্ধ হয়, সেরকম। ভেতরের আধো অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতে কিছুটা সময় লাগলো। বিশাল পিয়ানোটা দেখে থমকে গেলাম আবারো। আর যা-ই হোক, হাসপাতালে এ রকম কিছু আশা করিনি। বিশটারও বেশি মিউজিক স্ট্যান্ড ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা ঘরটার আনাচে কানাচে। একটা টেবিলে গাদা করে রাখা হয়েছে স্বরলিপির কাগজ, আরেকটু হলেই সিলিং ছোঁবে। অন্য টেবিলটায় শোভা পাচ্ছে ভায়োলিন, ওবো আর একটা বাঁশি। সেগুলোর পাশে কাঠের ফ্রেমের বিশাল হার্পটা আসলেও দর্শনীয়।
মুখ হা করে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
হেসে উঠলেন ডায়োমেডেস। “বাদ্যযন্ত্রগুলো দেখে খুব অবাক হয়েছে, না?” ডেস্কের পেছনে বসে আছেন প্রফেসর।
“এগুলো সব আপনার?”
“হ্যাঁ। সঙ্গিত আমার শখ বলতে পারো। নাহ, শখ না, নেশা।” নাটকীয় ভঙ্গিতে একবার বাতাসে হাত নাড়লেন তিনি। এটা যে তার একটা অভ্যাস, তা বুঝে গেছি। অর্কেস্ট্রার পরিচালক যেরকম হাত নাড়ে, ঠিক তেমনি যে কোন কথা সহজভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্যে অঙ্গভঙ্গির সহায়তা নেন ডায়োমেডেস। “একটা শখের সংগীতের দল আছে আমার, যে কেউ যোগ দিতে পারে দলটায়। স্টাফ, রোগি সবার জন্যে দরজা খোলা। সঙ্গিত হচ্ছে চিকিৎসার সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার,” এটুকু বলে থামলেন প্রফেসর, পরক্ষণেই গানের সুরে বলেন, “সবচেয়ে হিংস্র প্রাণীটাকেও শান্ত করে তুলতে পারে সঙ্গিত, কি বলো?”
“ঠিক বলেছেন।”
“হুম।” আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ডায়োমেডেস। “পারো নাকি?”
“কি পারি?”
“কোন কিছু বাজাতে?”
মাথা কঁকালাম। “সঙ্গিত বিষয়ে বিশেষ ‘অজ্ঞ’ আমি। ছোটবেলায় স্কুলে থাকতে কয়েকদিন রেকর্ডার বাজিয়ে দেখেছিলাম, ওটুকুই।”
“তাহলে তো স্বরলিপি পড়তে পারো? সেটাও কম কি। ভালো। যে কোন একটা বাদ্যযন্ত্র বেছে নাও, আমি বাজানো শেখাবো তোমাকে।”
হেসে আবারো মাথা ঝাঁকালাম। “আসলে আমার ধৈৰ্য্য একদমই
“তাই নাকি? সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে ধৈর্য্যের কোন কমতি থাকলে কিন্তু চলবে না। জানো, তরুণ বয়সে আমি অনিশ্চয়তায় ভুগতাম যে পেশা হিসেবে কোনটা বেছে নেবো। সংগীতশিল্পী, ধর্মযাজক নাকি ডাক্তার?” আবারো হাসলেন ডায়োমেডেস। “আর এখন দেখো, একইসাথে তিনটা কাজই করছে।”
“তা বটে।”
“তুমি জানো”–মহুর্তের মধ্যে কথার বিষয়বস্তু পাল্টে ফেললেন তিনি-”ইন্টারভিউয়ের পর গ্রোভে তোমাকে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা কিন্তু আমারই ছিল। তোমার পক্ষে বেশ শক্তভাবেই কথা বলেছিলাম। কেন জানো? বলতে সমস্যা নেই-তোমার মধ্যে নিজের ছায়া খুঁজে পেয়েছি আমি, থিও। কে জানে, হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে দেখা যাবে গ্রোভ তুমিই পরিচালনা করছে।” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। “যদি ততদিন টেকে আরকি প্রতিষ্ঠানটা।”
“আপনার সন্দেহ আছে সে ব্যাপারে?”
“রোগির সংখ্যা খুব একটা বেশি না। সে তুলনায় স্টাফ প্রচুর। ট্রাস্টের সাথে মিলে আমরা চেষ্টা করছি খরচ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার। বুঝতে পারছো কি বলছি? সার্বক্ষণিক তদারকি করা হয় আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপ। এরকম পরিস্থিতিতে কি আর চিকিৎসার কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়, বলো? উইনিকট একটা কথা বলেছিল না? যে ভবনের লোকেরা নিজেরাই আগুন নেভাতে ব্যস্ত, তারা কিভাবে অন্যের সাহায্য করবে?” ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন ডায়োমেডেস, হঠাৎই যেন বয়স বেড়ে গেছে তার। এরপর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতন ফিসফিসিয়ে বললেন। “আমার ধারণা ইউনিট ম্যানেজার স্টেফানি ক্লার্ক গ্রোভ বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে। ট্রাস্ট থেকেই কিন্তু বেতন দেয়া হয় তাকে। খেয়াল করলে তুমি নিজেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।”
কেন যেন মনে হলো প্রফেসর ডায়োমেডেস একটু বেশিই দুশ্চিন্তা করছেন ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু তিনি যে অবস্থানে আছেন, এরকমটা হতেই পারে। ইচ্ছে করেই চুপ থাকলাম কিছুক্ষণ, ভুল কিছু বলে তার মেজাজ বিগড়ে দিতে চাচ্ছি না। একটু পর মুখ খুললাম।
“অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন ছিল আমার।”
“অ্যালিসিয়া বেরেনসন?” অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন ডায়োমেডেস। “ওর ব্যাপারে কি?”
“তাকে কিরকম থেরাপি দেয়া হচ্ছে সেসম্পর্কে কৌতূহলী আমি। আলাদা করে থেরাপি দেয়া হয় তাকে?”
“না”
“কোন কারণ আছে?”
“সেই চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সন্তোষজনক ফলাফল না পাওয়ায় বন্ধ করে দেয়া হয়।”
“কেন? কে দেখতো ওকে? ইন্দিরা?”
“না।” মাথা ঝাঁকালেন ডায়োমেডেস। “আমি নিজেই দেখতাম অ্যালিসিয়াকে।”