- বইয়ের নামঃ প্যারাডাইস লস্ট
- লেখকের নামঃ জন মিলটন
- প্রকাশনাঃ দি স্কাই পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, কবিতা
প্যারাডাইস লস্ট
০১ম সর্গ
প্যারাডাইস লস্ট – জন মিলটন
অনুবাদ : সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ
প্রথম সর্গ
হে কাব্যকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তুমি আমাকে প্রথমে বল আদি মানবের সেই ঐশ্বরিক আনুগত্যের অভাব বা ঈশ্বর-বিরোধিতার কথা, সেই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফলের কথা যা মর্ত্যলোকে নিয়ে আসে মৃত্যু আর যত সব দুঃখ এবং পরিশেষে স্বর্গচ্যুতি। পরে এক মহামানবের সহায়তায় সেই হারানো স্বর্গ আবার পুনরুদ্ধার করে মানুষ। তুমি বল সেই ওরেব বা সিনাই পর্বতের শিখরদেশের কথা যার উপর থেকে ঈশ্বর আদি মানবজাতির মেষচারণরত মোজেসকে দেখে প্রথম সৃষ্টির বীজটিকে অঙ্কুরিত করে তোলার রহস্যটি শিখিয়ে দেন। যার ফলে সৃষ্টিহীন শূন্যতার মধ্য থেকে স্বর্গ-মর্ত্যের প্রথম উদ্ভব হয়। একথা যদি তোমার ভাল লাগে তো বল সিডন পাহাড় আর জেরুজালেমের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মিলোয়া নদীর কথা।
তারপর আমি এক দুঃসাহসী সঙ্গীত রচনার জন্য তোমার সাহায্য প্রার্থনায় তোমাকে আবাহন করব যে সঙ্গীতের সুরলহরী আওনিয়ান পর্বতের শিখরদেশকে ছাড়িয়ে যেতে পারে স্বচ্ছন্দে। গদ্যে বা পদ্যে আজও পর্যন্ত যা রচিত হয়নি কখনো, সেই সঙ্গীতের মধ্যে আমি তা রচনা করব। হে দেবী, যেহেতু তুমি মন্দির বা ধর্মপ্রতিষ্ঠানের থেকে ভক্তজনের অন্তঃকরণের সততা ও শুচিতাকে বেশি মূল্যবান মনে করো, আমার প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে এ বিষয়ে চালনা করো আমাকে উপযুক্ত নির্দেশদানের দ্বারা। কারণ কোন কিছুই অপরিজ্ঞাত নয় তোমার। কারণ তুমি আদিকাল হতে বিরাজিত আছ, সৃষ্টিহীন বিশাল শূন্যতার গভীরে কপোতসুলভ এক গম্ভীর প্রশান্তির সঙ্গে শক্তিশালী দুটি বিরাট ডানা বিস্তার করে বসেছিলে এবং ধীরে ধীরে সকল সৃষ্টিকে সম্ভত করে তোল তুমি। আমার মধ্যে যা অন্ধকার এবং অপরিজ্ঞাত রয়ে গেছে, তার উপর প্রজ্ঞার আলোকপাত করে তাকে আলোকিত করে তোল। আমার মধ্যে যা কিছু অশক্ত ও অবনমিত আছে তাকে এক দৃঢ় ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত করে তুলে ধরো যাতে আমি যত সব বিশৃঙ্খলাময় ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে ঈশ্বরের বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি এবং মানবজাতির কাছে পরিজ্ঞাত করে তুলতে পারি ঈশ্বরের রীতিনীতিগুলিকে।
স্বর্গলোকের কোন কিছুই লুক্কায়িত থাকতে পারে না তোমার দৃষ্টিপথ থেকে। এমন কি নরকের গভীর অন্ধকার গহ্বরের তলদেশ পর্যন্ত প্রতিভাত ও পরিদৃশ্য হয়ে ওঠে তোমার দৃষ্টির সম্মুখে। প্রথম বল, কোন্ কারণে আমাদের আদি পিতামহগণ ঈশ্বরের অনন্ত অনুগ্রহলাভে ধন্য হয়েও স্বর্গসুখ হতে বিচ্যুত হয়ে পড়ল? কেন তারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরম স্রষ্টা ও বিধাতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল? কেন তারা তার আদেশ লঙঘন করে চরম অংযমের পরিচয় দিল? কে তাদের এই জঘন্য বিদ্রোহে প্রথম প্ররোচিত করল? শয়তানরূপী নারকীয় সর্পই কৌশলে মানবজাতির আদিমাতাকে প্রতারিত করে হিংসা আর প্রতিশোধ বাসনার উদ্রেক করে তার মনে। বল, কখন কোন সময়ে মানবজাতির আদিপিতা একদল বিদ্রোহী দেবদূতসহ তার মদমত্ততার জন্য বিচ্যুত হয় স্বর্গলোক থেকে।
এই সব বিদ্রোহী দেবদূতদের সহায়তায় আমাদের আদিপিতা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সমকক্ষতা অর্জন করার এক উদ্ধত উচ্চাভিলাষে মত্ত হয়ে ঈশ্বরের স্বর্গরাজ্য ও সিংহাসন অধিকার করতে চায়। এই উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে এক অন্যায় অধমোচিত যুদ্ধ ঘোষণা করে সে দর্পভরে। এর জন্য সর্বশক্তিমান ঈশ্বর স্বর্গলোক থেকে জ্বলন্ত অবস্থায় নরকের অতল গহ্বরের মধ্যে সরাসরি ফেলে দেন শয়তানদের। তারই জন্য এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশের সম্মুখীন হতে হয় আমাদের আদিপিতাকে। ঈশ্বর বিরোধিতার এক চরম শাস্তিস্বরূপ জ্বলন্ত নরককুণ্ডের মধ্যে পরাভূত ও শৃঙ্খলিত অবস্থায় আবদ্ধ থাকতে হয় তাকে। পূর্ণ নয় দিন যাবৎ তাকে দলের সকলের সঙ্গে সেই জ্বলন্ত নরককুণ্ডে মৃত্যুহীন এক যন্ত্রণায় জীবনযাপন করতে হয়।
কিন্তু তার এই সর্বনাশা নরকভোগ আরও বাড়িয়ে দেয় তার ক্রোধের মাত্রাকে। কারণ হারানো স্বর্গসুখ আর দীর্ঘায়িত জীবনযন্ত্রণার ভাবনা পীড়িত করতে থাকে তাকে। চারদিকে তার স্লান দু’চোখের বিহ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দীর্ঘায়িত দুঃখকষ্টের বিপুলতাকে প্রত্যক্ষ করে ভীত হয়ে ওঠে সে। তথাপি সেই ভীতির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ওঠে তার সহজাত অহষ্কার আর বদ্ধমূল ঘৃণার অনমনীয়তা। চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায়, সে দেখতে পায় শুধু এক বিরাট চুল্লীর মত জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের দ্বারা আকীর্ণ এক অন্ধকার কারাগার। সেই অগ্নিশিখার মধ্যে কোন আলো নেই। সেই অগ্নিশিখার এক অন্ধ আভায় শুধু বেশি করে প্রকটিত হয়ে ওঠে ঘনীভূত অন্ধকারের ভয়াবহতা। সে আভায় সে দেখতে পেল শুধু অন্তহীন দুঃখকষ্টের ছায়াচ্ছন্ন বিস্তার। সেখানে নেই কোন শান্তি বা বিদ্রোহের ন্যুনতম অবকাশ, নেই কোন ক্ষীণতম আশার আনাগোনা। সেখানে আছে শুধু অন্তহীন যন্ত্রণার নিদারুণ প্রদাহ আর জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের নারকীয় দীপ্তির দুঃসহ দীর্ঘতা।
ঈশ্বরের বিধানে এই চির-অন্ধকার নরকপ্রদেশটি বিদ্রোহীদের কারাগাররূপে নির্দিষ্ট হয়েছে। সেই নরকপ্রদেশটি ছিল আয়তনে বিশাল। তা ঈশ্বর ও তাঁর স্বর্গরাজ্য থেকে যত দূরে, তার কেন্দ্র হতে পরিধিও ছিল তত দূরে। হায়, যে স্থান থেকে তারা বিচ্যুত হয়েছে, যে স্থানে আগে তারা বাস করত, সে স্থান হতে এ স্থান কত পৃথক, কত নিকৃষ্ট! ওখানে তার সঙ্গে তার পতনের সঙ্গীরা বিক্ষুব্ধ অগ্নিপ্রবাহে অভিভূত হয়ে বসে আছে তারই মত।