- বইয়ের নামঃ দ্য এইট
- লেখকের নামঃ ক্যাথরিন নেভিল
- প্রকাশনাঃ বাতিঘর প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর
দ্য এইট
কুইনদের বিনিময়
কুইনরা কখনও দরকষাকষি করে না।
–থ্রু দি লুকিং-গ্লাস
লুইস ক্যারোল
.
সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া
শরৎকাল ১৭৯১
তুষার ঢাকা প্রান্তর দিয়ে তিনঘোড়ার গাড়িটা ছুটে চলেছে। রিগার পর থেকে তুষারের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে আগের গাড়িটা পাল্টে এই তিনঘোড়াবিশিষ্ট চওড়া আর উঁচু গাড়িটা নিয়েছে তারা। ঘোড়াগুলোর লাগামে বেশ কয়েকটি সিলভার রঙের বেল লাগানো।
পিটার্সবার্গ থেকে মাত্র পনেরো-ষোলো মাইল দূরে এই জায়গায় এখনও গাছে গাছে ঝুলে রয়েছে হলুদ রঙের পাতা। আংশিক তুষারাবৃত ক্ষেতে কৃষকের দল এখনও কাজ করে যাচ্ছে দিন-রাত, যদিও বাড়ি-ঘরের ছাদে তুষার জমতে জমতে ভারি হয়ে আসছে ক্রমশ।
ফারের বালিশে গা এলিয়ে দিয়ে অ্যাবিস বাইরের গ্রাম্য এলাকা দেখে যাচ্ছেন। ইউরোপিয়ান জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবে ইতিমধ্যে নভেম্বরের ৪ তারিখ এসে গেছে, ঠিক এক বছর সাত মাস আগে মন্তগ্লেইন সার্ভিস উত্তোলন করে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখার কাজটা করেছিলেন তিনি।
কিন্তু এখানে এই রাশিয়াতে প্রচলিত আছে গ্রেগরিয়াঁন ক্যালেন্ডার, সেটার হিসেবমতে আজ অক্টোবরের তেইশ তারিখ। বিভিন্ন দিক থেকে রাশিয়া পিছিয়ে আছে, ভাবলেন অ্যাবিস। এই দেশটি এমন এক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে যা ইউরোপের অন্য কোনো দেশ করে না। এটা তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে যেসব কৃষককে ক্ষেতে কাজ করতে দেখছেন তাদের জামাকাপড় বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে একইরকম আছে। তাদের রীতিনীতিরও কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে তার মনে হলো না। কালো চোখের এইসব দোমড়ানো মোচড়ানো মুখগুলো তাদের গাড়িটার দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। অশিক্ষিত আর কুসংস্কারগ্রস্ত তারা। যে হাতিয়ার দিয়ে কাজ করছে সেটা হাজার বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষেরা তৈরি করে গেছিলো। প্রথম পিটারের শাসনকাল থেকে তারা মনে হয় দাড়ি-গোঁফ আর চুল কাটে নি।
তুষার ঢাকা প্রাঙ্গনের উপর দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট পিটার্সবার্গের বিশাল গেটটা। গাড়ির চালক রাজকীয় রক্ষীদের সাদা রঙের ইউনিফর্ম পরে আছে, আসন থেকে নেমে ঘোড়াগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে গেটটা খুলে দিলো সে। শহরের ভেতর দিয়ে আসার সময় অ্যাবিস দেখেছেন নেভা নদীর তীরে গম্বুজ আর চুরি মাথায় সাদ তুষার চকচক করছে। বাচ্চারা বরফের মাঠের উপর স্কেটিং করছে মনের আনন্দে। কুকুরে টানা জে চলে যাচ্ছে তাদের পাশ দিয়ে। হলুদ রঙের চুল আর নোংরা জামাকাপড় পরা শিশুরদল ডাকপিয়নের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে এক সা ভিক্ষা পাবার আশায়। গাড়িটা আবার চলতে শুরু করলো।
বরফাচ্ছাদিত নদীটা পার হতেই অ্যাবিস তার সঙ্গে থাকা ট্রাভেলিং কেস আর নক্সা করা কাপড়টার উপর হাত বুলালেন। হাতের জপমালাটি স্পর্শ করে সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা সেরে নিলেন তিনি। সামনে যে তিক্ত আর গুরুদায়িত্ব আছে সেটা উপলব্ধি করলেন। শুধুমাত্র তিনিই এই মহাক্ষমতাধর জিনিসটা অর্পণ করেছেন সঠিক হাতে। এইসব হাত লোভ আর উচ্চাকাঙ্খি লোকজনের কবল থেকে একে সুরক্ষিত করবে। অ্যাবিস ভালো করেই জানেন এটা তার মিশন। জন্মের পর থেকেই তাকে এ কাজের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে। এটা হস্তান্তর করার জন্য সারাজীবন ধরে তিনি অপেক্ষা করে গেছেন।
পঞ্চাশ বছর পর আজ শৈশবের সেই বন্ধুর সাথে দেখা করবেন তিনি। ফিরে গেলেন সেই অতীতে, যখন ভ্যালেন্টাইনের মতোই উচ্ছল আর প্রাণবন্ত ছিলো তার বন্ধু সোফিয়া অ্যানহল্ট-জারবেস্ট। এই বন্ধুকে তিনি সুদীর্ঘ অনেক বছর ধরে স্মরণ করে আসছেন। যৌবনের সময়গুলোতে গভীর অনুরক্ত হয়ে প্রায় প্রতি মাসেই তাকে চিঠি লিখতেন নিজের সিক্রেটগুলো জানিয়ে। যদিও তাদের দু’জনের চলারপথ ভিন্ন হওয়ায় তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তারপরও সোফিয়াকে এখনও পোমারানিয়ায় প্রজাপতির পেছনে ছুটতে থাকা সোনালি চুলের কোনো চপল বালিকা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না তিনি। হ্যাঁ, পোমারানিয়ায় ছিলো তার মা-বাবার বাড়ি।
ঘোড়াগাড়িটা নদী পেরিয়ে শীতকালীন প্রাসাদের দিকে ছুটে যেতেই অদ্ভুত এক অনুভূতি বয়ে গেলো অ্যাবিসের মধ্যে। সূর্যকে আড়াল করে দিয়ে একগুচ্ছ মেঘ চলে গেলো। তিনি ভাবতে লাগলেন তার বন্ধু কি ধরণের মানুষ হবে, কারণ এখন তো সে আর পোমারানিয়ার সেই ছোট্ট সোফিয়াটি নেই। এখন তাকে সমগ ইউরোপে চেনে ক্যাথারিন দ্য জার নামে। সমগ্র রাশিয়ার সম্রাজ্ঞি।
.
সমগ্র রাশিয়ার সম্রাজ্ঞি ক্যাথারিন দ্য গ্রেট বসে আছেন তার ড্রেসিং টেবিল, আয়নার সামনে। তার বয়স বাষট্টি, উচ্চতা গড়পরতার চেয়ে একটু কম কেন ভারি শরীর, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আর ভারি চোয়াল। তার শীতল-নীল চোখ জোড়া সচরাচর বেশ প্রণোচ্ছল থাকে, আজ সকালে একেবারেই ফাঁকা আর মলিন দেখাচ্ছে, কান্নার করণে লালচে হয়ে আছে কিছুটা। দুই সপ্তাহ ধরে নিজের ঘরে বন্দী হয়ে আছেন তিনি। এমনকি পরিবারের লোকজনের সাথেও দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তার ঘরের চারদেয়ালের বাইরে পুরো প্রাসাদের পবিবেশ থমথমে। শোকে মুহ্যমান সবাই। দুই সপ্তাহ আগে, অক্টোবরের ১২ তারিখে জাসি থেকে আগত কালো পোশাকের এক দূত জানিয়ে গেছে কাউন্ট পোটেমকিন মৃত্যুবরণ করেছেন।