- বইয়ের নামঃ দ্য কোয়েস্ট
- লেখকের নামঃ উইলবার স্মিথ
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
দ্য কোয়েস্ট
১. উঁচু পাহাড়ের ঢাল
দ্য কোয়েস্ট – উইলবার স্মিথ
অনুবাদ – শওকত হোসেন
লেখকের উৎসর্গ:
স্ত্রী মোখিনোসোকে
অনুবাদকের উৎসর্গ:
এদেশের রহস্য-সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট শ্রদ্ধেয় জনাব শেখ আব্দুল হাকিম (হাকিম ভাই)-কে
*
উঁচু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এল দুটি নিঃসঙ্গ অবয়ব। পথ চলায় জীর্ণ ফারের পোশাক ওদের পরনে, শীতের কবল থেকে বাঁচতে মাথার চামড়ার হেলমেটের কানের ফ্ল্যাপ চিবুকের নীচে বেঁধে রেখেছে। মুখে দাঁড়িগোঁফের জঙ্গল, রোদে পোড়া চেহারা। পিঠে বইছে সামান্য সম্বলটুকু। এখানে আসতে গিয়ে বেশ ধকল পোহাতে হয়েছে, তাড়া করে ফিরেছে ওদের যাত্রাটুকু। পথ দেখালেও কেন এখানে এসেছে ওরা তার কোনও ধারণা নেই মেরেনের, এখানে আসার কোনও ইচ্ছেও ওর ছিল না। ওর পেছন পেছন আসা বুড়ো মানুষটারই জানা আছে সেটা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ঝেড়ে কাশার কোনও লক্ষণ চোখে পড়েনি তার ভেতর।
মিশর ছেড়ে আসার পর এপর্যন্ত অনেকগুলো সাগর, হ্রদ আর বিরাট বিরাট নদী পেরিয়েছে ওরা, বিস্তৃর্ণ, নিবিড় বন জঙ্গল, প্রান্তর পেছনে ফেলে এসেছে। বিচিত্র ও হিংস্র সব পশু-পাখীর দেখা পেয়েছে; দেখেছে তারচেয়েও অদ্ভুত ও বিপজ্জনক মানুষ। অবশেষে পাহাড়সারির মাঝে এসেছে ওরা, তুষার-ঢাকা চূড়ার সুবিশাল বিশৃঙ্খল, মুখ ব্যাদান করে থাকা গহ্বর, যেখানে ক্ষীণ হাওয়ায় শ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে পড়েছিল। শীতে পটল তুলেছিল ওদের ঘোড়াগুলো, একটা আঙুলের ডগা খুইয়েছে মেরেন। পুড়ে কালো হয়ে গেছে, গা জ্বালানো তুষারে পচেছে। তবে ভাগ্য ভালো, তলোয়ার ধরার বা বিশাল ধনুক থেকে তীর ছোঁড়ার কাজে লাগা আঙুল খোয়ায়নি।
শেষ খাড়া ক্লিফের কিনারে এসে থামল মেরেন। পাশে এসে দাঁড়াল বুড়ো। স্নো টাইগারের চামড়া দিয়ে বানানো তার পরনের ফারের কোট, মেরেনের উপর। হামলে পড়ার পর একটা মাত্র তীর ছুঁড়ে ওটাকে খতম করেছিল মেরেন। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নদী আর নিবিড় সবুজ বনে ঘেরা অচেনা এক দেশের দিকে চেয়ে রইল ওরা।
পাঁচ বছর, বলল মেরেন। পাঁচ বছর ধরে চলার উপর আছি আমরা। আমাদের চলা কি তবে শেষ হলো, ম্যাগাস?
হ্যাঁ, মেরেন, অতদিন হয়নি বোধ হয়? জানতে চাইল তাইতা, তুষার শুভ্র
ভুরুর নিচে পরিহাসের ছলে ঝলকে উঠল ওর দুই চোখ।
জবাবে পিঠ থেকে সোর্ড স্ক্যাবার্ড নামিয়ে চামড়ায় আঁকা দাগগুলো দেখাল সে। প্রত্যেকটা দিনের হিসাব রেখেছি আমি, ইচ্ছে করলে গুনে দেখতে পারেন, বলল ও। তাইতাকে অনুসরণ করেছে ও, আয়ুর অর্ধেকের চেয়ে বেশি বার প্রাণ বাঁচিয়েছে তার, কিন্তু এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারবে না মানুষটা সত্যি সিরিয়াস নাকি স্রেফ ওর সাথে ঠাট্টা করে চলেছে। আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দেননি, সম্মানিত ম্যাগাস। আমাদের যাত্রা শেষ হয়েছে?
না, হয়নি। মাথা নাড়ল তাইতা। তবে একটা ব্যাপারে স্বস্তি পেতে পারো। অন্তত ভালো একটা সূচনা করতে যাচ্ছি আমরা। এবার সামনে চলে এলো সে, ক্লিফের শরীর থেকে বের হয়ে আসা একটা সংকীর্ণ চাতাল ধরে আগে বাড়ল।
কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে চেয়ে রইল মেরেন। তারপর ওর রুক্ষ সরল সুদর্শন চেহারায় বিষণ্ণ হালছাড়া হাসি ফুটে উঠল। বুড়ো শয়তানটা কী কোনওদিনই থামবে না? পাহাড়ের উদ্দেশে প্রশ্ন করল ও, তারপর স্ক্যাবার্ড ফের কাঁধে ফেলে অনুসরণ করল ওকে। ক্লিফের নিচে এসে শাদা কোয়ার্ট পাথরের একটা টিলা পাশ কাটাল ওরা। ঠিক তখনই আকাশ থেকে ভেসে এল একটা কণ্ঠস্বর। স্বাগতম, পর্যটক! অনেকক্ষণ হলো তোমাদের অপেক্ষা করছি!
বিস্ময়ে থমকে দাঁড়াল ওরা, চোখ তুলে মাথার ওপরের চাতালের দিকে তাকাল। শিশুসুলভ একটা অবয়ব বসে আছে ওখানে, দেখে এগার বছরের বেশি হবে বলে মনে হলো না। ছেলেটা পরিষ্কার দৃষ্টিসীমায় থাকলেও ওকে অগে দেখতে না পাওয়াটা বেশ অস্বাভাবিক, চড়া রোদের আলো তাকে স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলে, শাদা কোয়ার্ট পাথরে ঠিকরে যাচ্ছে। উজ্জ্বল শাদা আভা ঘিরে রেখেছে তাকে, চোখ ঝলসে দিচ্ছে। বিদ্যা আর প্রজননের দেবী সরস্বতীর মন্দিরের পথ দেখিয়ে তোমাদের নিয়ে যেতে আমাকে পাঠানো হয়েছে, সুরেলা কণ্ঠে বলল ছেলেটা।
মিশরিয় ভাষায় কথা বলছ তুমি! মহাবিস্ময়ে বলে উঠল মেরেন।
মৃদু হেসে নির্বোধ মন্তব্য ফিরিয়ে দিল ছেলেটা। দুষ্টু বাঁদরের মতো বাদামি চেহারা, কিন্তু হাসিটা এত সুন্দর, পাল্টা না হেসে পারল না মেরেন।
আমার নাম গঙ্গা। বার্তাবাহক। চলো! আরও বেশ অনেকটা পথ বাকি। উঠে দাঁড়াতেই নগ্ন কাঁধের উপর ঘন চুলের বেনুনী লুটিয়ে পড়ল। এই শীতেও স্রেফ একটা নেংটি পরে আছে। নগ্ন ধড় গাঢ় চেস্টনাট রঙের, কিন্তু পিঠের উপর উটের কুঁজের মতো একটা কুঁজ বইছে সে। ভূতুড়ে, ভীতিকর। ওদের মুখের ভাব লক্ষ করে ফের হাসল ছেলেটা। এর সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাবে তোমরা, আমাদের মতোই, বলল সে। চাতাল থেকে লাফ দিয়ে নেমে তাইতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। এই দিকে।
পরের দুটো দিন নিবিড় বাঁশ বনের ভেতর দিয়ে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল গঙ্গা। অসংখ্যা মোচড় আর বাঁক নিয়েছে পথ, সে না থাকলে কয়েক শো বার পথ হারাতে হতো ওদের। যতই নিচে নামছে, ততই উষ্ণ হয়ে উঠছে হাওয়া; এক সময় ফারের পোশাক খুলে মাথা উন্মুক্ত রেখেই পথ চলতে পারল ওরা। তাইতার চুল শীর্ণ, ঋজু, চকচকে; মেরেনের চুল গাঢ়, ঘন, কোঁকড়া। দ্বিতীয় দিন বাঁশ বনের প্রান্তে পৌঁছাল ওরা, নিবিড় জঙ্গলের দিকে চলে যাওয়া রাস্তা ধরল। এখানকার গাছপালা মাথার উপর মিলে সূর্যের আলো আড়াল করেছে। জমিনের সোঁদা গন্ধ ও পচা গাছের স্যাঁতসেঁতে গন্ধে ভারি হয়ে আছে পরিবেশ। মাথার উপর দিয়ে ঝলমলে পাখীর ঝক দ্রুত উড়ে যাচ্ছে। কিচিমিচির আওয়াজ করছে ক্ষুদে বাঁদরের দল। মগ ডালে জমায়েত হয়েছে ওরা। ফুলে ভরা লতাপাতায় ভেসে বেড়াচ্ছে অপূর্ব, রঙিন নানা রকম প্রজাপতি।