- বইয়ের নামঃ রক্তমাখা ছোরা
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প
রক্তমাখা ছোরা
০১.
কাঁসার ঘণ্টার মত বেজে উঠল জোরাল কণ্ঠস্বর টুউউউ বিইইই…
কে? চমকে উঠল কিশোর।
শোনার জন্যে রবিন আর মুসাও কান পাতল।
…অর নট টুউউউ বিইইই…
রবিন বলল, কে জানি পদ্য বমি করছে!
জুনের চমৎকার রোদেলা দিন। হাতে কাজকর্ম নেই। বনের ভেতরে বেড়াতে এসেছে তিন গোয়েন্দা। সাথে করে খাবার নিয়ে এসেছে, লাঞ্চটা এখানেই সারবে। খাবার খুলে সবে খেতে বসেছে, এ সময় এই কাণ্ড!
দ্যাট ইজ দা কোয়েশ্চেন… বলে চলেছে কণ্ঠটা।
না না, পদ্য নয়, ভুরু কুঁচকে বলল কিশোর। হ্যামলেটের ডায়ালগ। তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য, আত্মহত্যা করতে চলেছে হ্যামলেট।
মনে হয় কোন হতাশ অভিনেতার কাজ।
অভিনেতা না ছাই, মুসা বলল। আমার তো মনে হচ্ছে পাগল।
গমগম করে উঠল কণ্ঠটা, টু ডাই, টু স্লীইইপ-নো মোর!…
অবাক কাণ্ড! রবিন বলল। কিন্তু…
চলো তো দেখি। উঠে পড়ল কিশোর। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল নদীর দিকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে অনুসরণ করল রবিন।
কণ্ঠটা বলছে, ফর ইন দ্যাট স্লীপ অভ ডেথ হোয়াট ড্রীমস মে কাম…
এবার সত্যি সত্যি গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার! মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি।
নদীর একটা বাঁকের কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। সামনে একটা কাঠের সেতু। ঝুলে রয়েছে যেন নদীর ওপর, যে কোন মুহূর্তে ঝুপ করে খসে যেতে পারে। খুঁটিগুলোর অবস্থা করুণ। সেতুর মাঝের অনেক কাঠ নেই, কিছু কিছু জায়গা থেকে সরে গিয়ে ঝুলছে, নাড়া লাগলেই খুলে পড়ে যেতে পারে। দুপাশে দড়ির রেলিঙ।
নদীতে তীব্র স্রোত। মাথা খারাপ না হলে ওই সেতু দিয়ে এখন নদী পারাপারের চেষ্টা করবে না কোন মানুষ।
কিন্তু লোকটার বোধহয় মাথাই খারাপ। সব চুল সাদা। কালো পোশাক পরনে। দাঁড়িয়ে রয়েছে সেতুর মাঝখানে। চোখ আরেক দিকে।
বলল, ফর হুউউ উড বিয়ার দা হুইপস অ্যান্ড স্করনননস অভ টাইম…
বদ্ধ উন্মাদ! ফিসফিসিয়ে বলল রবিন। বলে কি শুনছ!
দুহাত ওপরে তুলে ফেলেছে লোকটা। চলার গতি বাড়াল কিশোর। বলল, শুনছি। হ্যামলেট এ-সময় জীবন শেষ করে দেয়ার কথা ভাবে…
হোয়েন হি হিমসে মাইট হিজ কোয়ায়েটাস মেইক উইথ…
কি করার ইচ্ছে ওর? বুঝতে পারছে না রবিন।
জানি না…
আ বেয়ার বড়কিন!
বেয়ার বডকিনটা আবার কি জিনিসরে বাবা! মুসার প্রশ্ন।
সেতুর দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে কিশোর। একটা ড্যাগার! ছুরি! লোকটা সত্যিই কিছু করবে!
চেঁচিয়ে উঠল মুসা, না, কিছু করবেন না, স্যার! সব ঠিক হয়ে যাবে!
চমকে ফিরে তাকাল লোকটা। তিন গোয়েন্দাকে দৌড়ে আসতে দেখল। মুখে অসংখ্য ভাঁজ। বয়েসের। চেহারা বিধ্বস্ত, কিন্তু মাথার চুল সব ঠিক আছে, এলোমেলো নয়। একঘেয়ে গলায় বলল, আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। নিজের হাতেই জীবন দিয়ে দেব আমি।
ঝট করে একটা ছুরি বের করল। তুলে আনল বুকের ওপর।
কিশোর বুঝল, সেতুতে চড়ার সময় নেই। নদীর কাদাটে ঢাল পাড়ে ধপ করে বসে পিছলে নেমে গেল একটা খুঁটির কাছে।
ইনটু দা গ্রেট এভারলাসটিং আই কমেন্ড মাই স্পিরিট! ভারী গলায় চিৎকার করে উঠে ছুরিটা বুকে বসাতে তৈরি হলো লোকটা।
নাআআআ! গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
নড়বড়ে খুঁটিটা দুহাতে চেপে ধরল কিশোর। গায়ের জোরে ঝাঁকাতে শুরু করল। কাঁচম্যাচ করে দুলে উঠল পুরানো সেতু। তাল সামলাতে না পেরে তাড়াতাড়ি একদিকের দড়ির রেলিঙ আঁকড়ে ধরল লোকটা। ঝুলে থাকা কয়েকটা তক্তা খসে পড়ল পানিতে।
ঝাঁকিয়েই চলেছে কিশোর। মড়াৎ করে ভাঙল সেতুর একটা বীম, পুরানো আরেকটা বীম ভার রাখতে পারল না, ভেঙে গেল ওটাও। বিকট শব্দ করে ঝটকা দিয়ে পড়ে গেল সেতুর একপ্রান্ত। দড়িটড়ি কোন কিছু ধরেই আর কাজ হলো না। সামলাতে পারল না লোকটা। ঝপাং করে পড়ল পানিতে। ছুরিটা তখনও ধরে রেখেছে শক্ত করে।
ডুবে যাওয়ার আগে লোকটার রক্ত পানি করা চিৎকার প্রতিধ্বনি তুলল নদীর দুই তীর আর পাহাড়ে। মাঝপথে থেমে গেল চিৎকারটা, যেন গলা টিপে থামিয়ে দেয়া হলো। আতঙ্কিত চোখে মুসা দেখল, তীব্র স্রোত লোকটাকে ভাসিয়ে নিয়ে আসছে তার দিকে।
চলে যাবে! মরবে! পাথরে গিয়ে বাড়ি খাবে!
মুসার চিৎকার কানে পৌঁছল কিনা বোঝা গেল না, তবে কোনমতে মা তুলল লোকটা। বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও! সাঁতার জানি না…! নাকে মুখে পানি ঢুকে গেল বোধহয় ওর।
প্রায় একই সঙ্গে পানিতে ডাইভ দিল তিন গোয়েন্দা। মাথা তুলল লোকটা, আবার ডুবে গেল। এরই মাঝে পলকের জন্যে নজরে পড়ল তার আতঙ্কিত দৃষ্টি। তীব্র স্রোত ঠেলে তার কাছে পৌঁছল ওরা। হাত বাড়িয়ে কাধ ধরতে গিয়েও ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নিল মুসা। মুখ সরাল। আরেকটু হলেই তার গাল চিরে দিয়েছিল চুরির তীক্ষ্ণ ফলা।
কাছেই তো যেতে পারছি না! বলল সে।
শান্ত হোন, স্যার! অনুরোধ করল কিশোর! হাত নাড়বেন না। চুপচাপ ভেসে থাকার চেষ্টা করুন।
আমি…আমি…সাঁতার… আবার পানির নিচে ডুবে গেল লোকটার মাথা।
লোকটা সহযোগিতা করতে পারবে না, চিন্তা করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে, বুঝল মুসা। হঠাৎ চার হাত পায়ে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে আগে বাড়ল, লোকটার বুক জড়িয়ে ধরল। লাথি মেরে, ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল যেন লোকটা, ছুরি নাচাল অনিশ্চিত ভঙ্গিতে।