- বইয়ের নামঃ এ হলিডে ফর মার্ডার
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, গোয়েন্দা কাহিনী
এ হলিডে ফর মার্ডার
১. স্টিফেন প্ল্যাটফর্মের উপর
০১.
২২ শে ডিসেম্বর।
স্টিফেন প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কোটের কলারটা উঁচু করল। স্টীম ইঞ্জিনের ধোঁয়া আকাশে বাতাসে আর কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে প্ল্যাটফর্ম। এখন সমস্ত কিছু নোংরা আর ধোঁয়া ধোঁয়া।
হঠাৎ এই পরিবর্তন স্টিফেনকে একটু চিন্তান্বিত করে তুলেছে। যেমন নোংরা দেশ–তেমনি নোংরা শহর। এই প্রথম তার লণ্ডনের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া হল, এখানকার দোকান, রেস্তোরাঁ, সুবেশা মহিলারা সমস্ত কিছু মলিন হয়ে গেছে। মনে করা যাক এখন সে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে গেছে।.স্বদেশে ফেরার জন্য কিছুক্ষণের জন্য সে উতলা হয়ে উঠল। রোদ ঝলমলে আকাশ…ফুলের বাগান…সুন্দর ঠাণ্ডা বাতাস–আর এখানে আছে শুধু অগণিত মানুষের ভিড় এবং কয়লার ধোয়া আর গাদাগাদি ব্যস্ততা।
কিছুক্ষণের জন্য সে চিন্তা করল। তারপর দরকারের কথা মনে পড়ল। সে বহুবছর ধরে প্ল্যান করে আসছে।
সে ইচ্ছা স্বল্পস্থায়ী, সে নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করল : কী জন্য? এতে তার কোন লাভ আছে? আর কেনই বা অতীতের দিকেমনোসংযোগ করা? সে কেন সমস্ত মুছে ফেলতে পারছে না? এ-সমস্ত কিছুই কী দুর্বলতা? সে বাচ্চা ছেলে নয় যে সে খেয়ালের বশে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার বয়স এখন চল্লিশ। সে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
যে কাজের জন্য ইংল্যাণ্ডে আসা সেই কাজ সে করবেই।
সে ট্রেনে উঠে করিডোর দিয়ে যেতে যেতে বসবার জায়গার সন্ধানে চারিদিকে তাকায়। একটির পর একটি কামরা পার হয়ে যায় সে। ট্রেনটা যাত্রী বোঝাই, তিন দিন বাকী আছে খ্রস্টমাস আসতে।
সে হঠাৎ দক্ষিণ আমেরিকার মুক্ত অরণ্যের জন্য উতলা হয়ে ওঠে। নির্জন সূর্যস্নাত একখণ্ড জমির জন্য।
পরক্ষণেই কামরার দিকে দেখতে গিয়ে তার দম বন্ধ হয়ে যায়। এই মেয়েটি আর সমস্ত মেয়ের থেকে আলাদা। কালোচুল, বিবর্ণ চোখে গভীরতা, নিশীথ রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন নিঃস্তব্ধতা। সুখের না হলেও অহংকার করার মতো ছিল সেই চোখ। এইসব রসকষহীন লোকগুলোর মধ্যে বসে থাকা মেয়েটার মানায় না। তার মধ্যে ইংল্যাণ্ডের এই জায়গা; যেখানে কোনো আনন্দ নেই–সেই জায়গায় যাওয়াটা তার ঠিক নয়। অন্য জায়গা হলেও তাকে ভালোই মানাতে, তৃতীয় শ্রেণীর কামরার এক কোণে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা তার ভালো দেখায় না।
সে একজন পর্যবেক্ষক। মেয়েটির পরণে কালো কোট এবং মলিন স্কার্ট, সস্তা ফেব্রিকের দস্তানা। রংচটা জুতো এবং বহুদিনের পুরোনো হাতব্যাগ–কোনো কিছুই তার নজর এড়িয়ে গেল না। তা সত্ত্বেও তার শরীরে সৌন্দর্য্য এতটুকু ম্লান হয়নি। ভারী সুন্দর এবং আশ্চর্য মেয়ে সে…
এত মানুষের ভিড়ে, ঠাণ্ডা কুয়াশায় সে কী করছে? সে চিন্তা করল মেয়েটি কে? আমাকে জানতেই হবে এখানে সে কী করতে এসেছে? হ্যাঁ, আমায় অবশ্যই জানতে হবে…
জানলার ধারে কুঁকড়ে বসে থাকা পিলার তখন চিন্তা করছিল, কী আশ্চর্যরকম গন্ধ ইংরেজদের গায়ে।
হুইসেল দেওয়া হয়ে গিয়েছিল একটা উচ্চ কণ্ঠস্বর কী যেন বলল। একসময় ট্রেনটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে আরম্ভ করল। যাত্রা আরম্ভ মেয়েটি তার পথে এগিয়ে চলেছে।
তার বুক ধড়ফড়ানি বাড়তে লাগল। সমস্ত কিছু ঠিক ঠিক বলবে তো? সে যে কাজে যাচ্ছে তাতে সে অসফল হবে না তো? নিশ্চয়ই এত বেশী সতর্কতার সঙ্গে সে চিন্তা করছিল। যে কোনো চরম অবস্থার জন্য তৈরী সে। তাকে সফল হতেই হবে…সফল সে হবেই।
মেয়েটি সরল সাদাসিধে শিশুর মত চারপাশে দেখল–সমস্ত লোকগুলোর মধ্যে সাতজন…এই ইংরেজরা কীরকম মজার লোক। তারা সবাই বড়লোক। তাদের জুতো জামাকাপড় সব দামী…ওঃ? সে সবসময় শুনে এসেছে ইংল্যাণ্ড খুব ধনী দেশ, কিন্তু তারা সুখী নয়।
ঐ যে করিডোরে একজন সুপুরুষ লোক দাঁড়িয়ে আছে–পিলার ভাবল সে খুব সুন্দর। তার গায়ের রঙ তামাটে, টিকালো নাক, চৌকো কাধ সে পছন্দ করে। সে তাকে সামনাসামনি একবারও দেখেনি, কিন্তু সে বেশ ভালো করেই জানে, প্রায় প্রতিক্ষণই সে তাকে দেখেছে। আর ঠিক কী ভাবেই বা সে দেখেছে?
মেয়েটি খুব একটা আগ্রহ দেখালো না। তাদের দেশে পুরুষেরা মেয়েদের দিকে দেখে আচমকা চোখ পড়ে যাবার মতো, অযথা দেখে না দেখার ভান করে। তাই ভয় হয় লোকটি বোধহয় ইংরেজ না। পিলার ঠিক করল, যা হোক সে তাকে সত্যিকারের ইংরেজ বলে মেনে নেবে। লোকটিকে তবু ভালো বলতে হয়, সে একজন আমেরিকানও হতে পারে।
সে চিন্তা করল লোকটিকে অনেকটা চিত্রাভিনেতাদের মতো দেখতে। সে পাশ্চাত্য ছায়াছবিতে যেমন দেখেছিল।
প্রথম রাত্তিরের আহারের ডাক পড়তেই কামরায় সেই সাতজন যাত্রী ডাইনিংকারের দিকে চলে যেতেই সেখানে মরুভূমির নির্জনতা এবং শান্ত ভাব লক্ষ্য করল পিলার। খোলা জানালা দিয়ে লণ্ডনের দক্ষিণ শহরতলীর দৃশ্য চোখে পড়ল তার। ওপারে দরজা খোলার আওয়াজ হওয়া সত্ত্বেও পিলার ফিরে দেখল না। যেমন ভাবে জানালার উপর চোখ রেখে পিছনে হেলান দিয়ে বসেছিল সেই ভাবেই বসে রইল। পিলার অনুভব দিয়ে বুঝল যে, নিশ্চয়ই করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তার সঙ্গে কথা বলার জন্য কামড়ায় ঢুকেছে।