- বইয়ের নামঃ বৌরাণীর বিল
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. প্রথম আষাঢ়ের নববর্ষা
প্রথম আষাঢ়ের নববর্ষা।
কলকাতা শহরে বর্ষাটা এবারে বেশ দেরি করেই নেমেছে। তাপদগ্ধ ধরিত্রী যেন জলস্নান করে জুড়িয়ে গিয়েছে। মেঘলা ভিজে আকাশে সন্ধ্যার তরল অন্ধকার যেন ঘন হয়ে চাপ বেধে উঠেছে। ঘরের মধ্যে কিরীটী আর সত্যজিৎ মুখোমুখি দুজনে দুটো সোফার ওপরে বসে। সত্যজিৎ তার বক্তব্য শেষ করে এনেছে তখন; দীর্ঘ উনিশ বছরের ব্যবধানে দুটো হত্যা। প্রথমটি স্ত্রী, উনিশ বৎসর পরে তার স্বামী। এবং দুটি হত্যারই অকুস্থান বৌরাণীর বিলের মধ্যে সেই দ্বীপ। দ্বীপটির মধ্যে আছে একটি বিরাম কুটির—তার চারপাশে ফুলের বাগান। দ্বীপটিকে ওখানকার লোকেরা ‘নন্দন কানন’ বলে।
আরো আশ্চর্য কি জানেন মিঃ রায়! নন্দন কাননের মধ্যে একটি শাখাপ্রশাখা বকুল বৃক্ষ আছে, সেই বকুল বৃক্ষের তলাতেই দুটি মৃতদেহ পাওয়া যায়।
কিরীটী মৃদু স্বরে বলে, Queer coincidence!
তাই। জবাব দেয় সত্যজিৎ।
কিরীটী ঘরের মধ্যে জমাট বেধে ওঠা আবছা আলো-আঁধারের দিকে তাকিয়ে আর একবার সত্যজিতের বর্ণিত কাহিনীটা প্রথম থেকে ভাবতে শুরু করে।
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আর ইহজগতে নেই। তিনি নিহত।
পিতা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর নিহত হওয়ার সংবাদটা কন্যা সবিতাকে যেন একেবারে কয়েক মুহূর্তের জন্য অসাড় ও পঙ্গু করে দিল। ক্ষণপূর্বে পাওয়া তারবার্তাটা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে হস্টেলের কমনরুমের বারান্দায় অসহায় স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থাকে সবিতা।
আজই মাত্র কলেজের গ্রীষ্মের ছুটির বন্ধ হলো।
কাল রাত্রের ট্রেনে সবিতা বাড়ি যাবে, দুপুরে সে বাবাকে একটা তারও করে দিয়েছে তার যাত্রার সংবাদ দিয়ে। কয়েকটা আবশ্যকীয় জিনিসপত্র কিনবার জন্য মার্কেটে গিয়েছিল সবিতা, হস্টেলে ফিরে আসতেই হস্টেলের দারোয়ান তারটা তার হাতে দিল। একটু আশ্চর্যই হয়ে গিয়েছিল সবিতা হঠাৎ এসময় একটি তার পেয়ে। হঠাৎ তার এলো কেন? ভয়ে ও সংশয়ে তারটা খুলে পড়তেই মূহর্তে যেন সবিতা একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গাঘাতে একেবারে অসাড় হয়ে গিয়েছে।
তারটা করেছেন নায়েব কাকা বসন্ত সেন। মর্মঘাতী তার।
Baboomahashaya Killed! Come Sharp!
Naeb-Kaka-Basanta
নায়েব কাকা যে ওকে তার করেছেন ওর তারটা যাওয়ার আগেই, তার প্রেরণের সময়টা দেখেই সবিতা সেটা বুঝতে পারে।
বিমূঢ় হতচকিত ভাবটা কতকটা সামলে নিয়ে সবিতা তার হাতঘড়িটার দিকে তাকাল; সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা তখন সবেমাত্র। ইচ্ছা করলে এবং কিছু ক্ষণের মধ্যে রওনা হতে পারলেই তো অনায়াসেই সে আজকের রাত্রের ট্রেনটাই ধরতে পারে। ট্রেন তো সেই রাত সাড়ে নটায়। এখনো পুরো দুটো ঘণ্টা সময় ওর হাতে আছে। হ্যাঁ, যেমন করেই হোক আজকের রাত্রের ট্রেনটাই ওকে ধরতে হবে। সবিতা সহসা যেন জোর করেই মনের ও দেহের অসহায়, বিমূঢ় পঙ্গু অবস্থাটাকে ঝেড়ে ফেলে, আর মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে বারান্দাটা পার হয়ে সোজা দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। এবং সিঁড়ি অতিক্রম করে সোজা একেবারে এসে দোতলার বারান্দার শেষপ্রান্তে হস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট মিসেস ব্যানার্জীর ভেজানো দ্বারের সামনে এসে দরজার গায়ে মৃদু আঘাত করল।
মিসেস ব্যানার্জী ঘরের মধ্যেই ছিলেন, মৃদুকণ্ঠে আহ্বান জানালেন, কে, ভিতরে এসো।
সবিতা দরজা ঠেলে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল।
সবিতার চোখমুখের দিকে তাকিয়ে মিসেস ব্যানার্জী যেন বেশ একটু বিস্মিত হন, ব্যাপার কি সবিতা! কি হয়েছে? অসুখ করেনি তো?
নিঃশব্দে কোন কথা না বলে সবিতা ক্ষণপূর্বে পাওয়া তারটা মিসেস ব্যানার্জীর দিকে এগিয়ে দিল।
বিস্মিতা মিসেস ব্যানার্জী রুদ্ধ নিঃশ্বাসে তারটা পড়ে সবিতার মুখের দিকে তাকালেন, কখন পেলে এ তার?
এই কিছুক্ষণ আগে দারোয়ান দিল–
হুঁ!
আমি আজকের রাত্রের গাড়িতেই যেতে চাই মিসেস ব্যানার্জী!
আজ রাত্রের গাড়িতেই যাবে, কটায় গাড়ি জান কিছু?
হ্যাঁ, জানি।
বেশ, পার তো যাও।
সবিতা আর দ্বিরুক্তি না করে সুপারিনটেনডেন্টের ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
কোনমতে একটা সুটকেসের মধ্যে কিছু জামা-কাপড় নিয়ে একটা ট্যাক্সি ডাকিয়ে সবিতা ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে বললে, শিয়ালদহ স্টেশন!
একটা সেকেণ্ড ক্লাসের টিকিট কেটে সবিতা যখন ট্রেনের একটা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় এসে উঠে বসল, গাড়ি ছাড়তে তখন আর মাত্র মিনিট সাতেক বাকি।
গাড়িতে সে ছাড়াও আরো চারজন যাত্রী ছিল। একটা বার্থ খালি।
একটু পরে সে বাথটাও একজন অল্পবয়সী যুবক গাড়ি ছাড়বার ঠিক মিনিট চারেক আগে এসে অধিকার করল।
গাড়ি ছাড়ল।
একটা গুমোট গরমে এতক্ষণ কামরাটা যেন ঝলসে যাচ্ছিল, গাড়ি ছাড়বার সঙ্গে সঙ্গেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে চলমান গাড়ির খোলা জানালা-পথে একটা তৃপ্তির পরশ দিয়ে গেল।
স্টেশন ইয়ার্ডের আলোগুলো ক্ৰমে একটা দুটো করে গাড়ির ক্রমবর্ধমান গতির সঙ্গে পিছিয়ে পড়ছে।
হারিয়ে যাচ্ছে আলোগুলো পশ্চাতের অন্ধকারে একটি দুটি করে।
জ্যৈষ্ঠের একেবারে গোড়ার দিক। এবারে একদিনের জন্যও কালবৈশাখী এখনও দেখা দেয়নি কে জানে কেন!