- বইয়ের নামঃ ডট কম রহস্য
- লেখকের নামঃ অনীশ দেব
- বিভাগসমূহঃ অপরাধ, রোমাঞ্চকর গল্প, ভূতের গল্প
ডট কম রহস্য
অনিন্দ্যসুন্দরের অপমৃত্যু (নভেলেট)
‘মৃত্যুর সময়ে বয়স কত হয়েছিল? বাহান্ন—তাই তো?’ দেবদূত সূর্যকান্ত প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ—বাহান্ন’। শ্রান্ত স্বরে জবাব দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরী। তাঁর মনে হল, সেই এসে থেকে যেন শুধু প্রশ্নেরই জবাব দিয়ে যাচ্ছেন।
‘মৃত্যুর কারণ?’ দেবদূত বলে চলল।
‘হার্ট অ্যাটাক। অন্তত আমার তাই ধারণা।’ অনিন্দ্যসুন্দর উত্তর দিলেন।
‘হুম।’ দেবদূতকে যেন সামান্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হল, ‘এইবারে শেষ প্রশ্ন। খাতায় লেখা আছে, হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক কারণ, যে-কোনও একটায় দাগ দিন: আত্মোৎসর্গ, দুর্ঘটনা, রক্তচাপ, কায়িক শ্রম, নির্বুদ্ধিতা, খুন ইত্যাদি। এখানে দেখছি ”খুন” শব্দটায় টিক মার্ক দেওয়া আছে।’
অনিন্দ্যসুন্দর সোজা হয়ে উঠে বসলেন ‘খুন?’
‘হ্যাঁ,’ সুর্যকান্ত বলল, ‘খাতার এই পাতাটা আপনার নামে। এখানে তো দেখছি, খুনই বলা আছে। অবশ্য আমার ভুল হলে আপনি ধরিয়ে দেবেন বইকী। আপনি তো খুনই হয়েছেন, তাই-না, মিস্টার চৌধুরী?’
‘না, মানে, আমি তো সেরকম ভাবিনি। আমি…।’
‘তার মানে, আপনি যে খুন হয়েছেন, তা আপনি জানেন না?’ সহানুভূতির সুরে বলল সূর্যকান্ত।
‘না, এ-আমি স্বপ্নেও ভাবিনি!’
সূর্যকান্ত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল: ‘হ্যাঁ, কখনও-কখনও যে এরকম হয় না তা নয়। তবে খুন হলে বেশিরভাগ লোকই সেটা বুঝতে পারে। অন্তত শেষ মুহূর্তে হলেও টের পায়। এধরনের খুনের খবর যে কীভাবে মোলায়েম করে ভাঙতে হয়, তা আমি আজও শিখলাম না।’
‘এ আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।’ বেশ কয়েকবার এই কথাটা আপনমনে উচ্চারণ করলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘আপনাকে আঘাত দেওয়ার জন্যে দুঃখিত, মিস্টার চৌধুরী। তবে জানবেন, এখানে এসবে কিছু যায় আসে না।’
‘মনে আছে, আমি স্টাডি-রুমে বসেছিলাম। হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎ এক সাংঘাতিক যন্ত্রণায় আমার ঘুম ভেঙে যায়…ঠিক বুকের ভেতর…তারপর আর কিছু ভেবে ওঠার সময় পাইনি।’
‘এছাড়া আরও একটা কথা এখানে লেখা আছে,’ খাতায় চোখ বুলিয়ে সূর্যকান্ত বলল, ‘আঘাতটা আপনার হার্টেই লেগেছিল, মিস্টার চৌধুরী। আপনারই কাগজ-কাটার ছুরি দিয়ে আপনাকে আঘাত করা হয়েছে…পিঠে…।’
‘এতো রীতিমতো পৈশাচিক,’ বিস্মিত সুরে বলে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘আমার কাগজ-কাটার ছুরিটা কী সুন্দর…ওটার হাতলটা সত্যিকারের হাতির দাঁতের তৈরি…কে এ-কাজ করেছে?’
‘তার মানে? কে কী কাজ করেছে?’
‘কে আমাকে খুন করেছে?’
‘সেকী! আমি কী করে জানব?’
‘আপনি না জানলে, কে জানবে! আমি তো ভেবেছি আপনার ওই নরকের খাতায় সব খবরই লেখা আছে।’
‘এটা নরকের খাতা নয়।’
‘সে যাই হোক, বলুন, কে আমাকে খুন করেছে?’
‘মিস্টার চৌধুরী!’ কঠোর স্বরে বলে উঠল সূর্যকান্ত, ‘প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ইত্যাদিকে এখানে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না—এটা আপনার জানা উচিত।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি এমনিই জানতে চাই।’
‘আপনাকে কে খুন করেছে, আমি জানি না, মিস্টার চৌধুরী। আমি দেবদূত হতে পারি, তাই বলে সবজান্তা নই। কারও সম্পর্কে আমরা সমস্ত তথ্য জানতে পারি তার মৃত্যুর পর। তখনই তার নামে খাতা তৈরি হয়। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার খুনের জন্যে যে দায়ী তার মৃত্যুর পর সব তথ্য আমার হাতে আসবে, তখন সহজেই আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।’
‘সেটা কবে?’
‘যদি খুনি ধরা পড়ে এবং তার ফাঁসি হয়, তা হলে—বলতে পারেন, খুব শিগগিরই জানতে পারব। আর খুনি যদি সেরকম চালাক হয়ে থাকে এবং পুলিশের চোখে ধুলো দিতে পারে, তা হলে অনেক বছরের ধাক্কা।’
‘অতদিন আমি অপেক্ষা করতে পারব না! আমি এক্ষুনি জানতে চাই।’ অনিন্দ্যসুন্দর উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে শুরু করলেন।
‘মিস্টার চৌধুরী, আমি দুঃখিত…।’
‘এখানে এমন কেউ নেই, যিনি সব জানেন?’
‘অবশ্যই আছেন, দেবরাজ। উনি সব জানেন।’
‘তা হলে তাঁকেই জিগ্যেস করুন।’
‘অসম্ভব। এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তাঁকে বিরক্ত করতে পারি না। মিঃ চৌধুরী, বসুন।’
কিন্তু সে-কথায় কর্ণপাত করলেন না অনিন্দ্যসুন্দর, পায়চারি করেই চললেন। তারপর হঠাৎই সূর্যকান্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি বলেছিলেন, এখানে আমি সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারব?’
‘নিশ্চয়ই।’ গভীর আশ্বাসের সুরে বলল সূর্যকান্ত।
‘কে আমাকে খুন করেছে সেটা না-জানতে পারলে কী করে আমি সুখে-শান্তিতে থাকব বলতে পারেন?’
‘তাতে অসুবিধেটা কী আমি তো বুঝে উঠতে পারছি না, মিস্টার চৌধুরী!’
বেশ চেষ্টা করে নিজেকে গুছিয়ে নিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, তারপর সোনার চেয়ারে আবার বসলেন। শান্ত স্বরে বলতে শুরু করলেন, ‘সূর্যকান্তবাবু, দয়া করে বলবেন, আপনার খাতায় আমার পেশার জায়গায় কী লেখা আছে?’
‘আপনি রহস্য-গোয়েন্দা গল্পের লেখক ছিলেন।’
‘ঠিক তাই। সুন্দর সান্যাল ছদ্মনামে আমি পঁচাত্তরটা রহস্য উপন্যাস লিখেছি—তার একডজনেরও বেশি সিনেমা হয়েছে—এ ছাড়া অসংখ্য ছোট গল্প তো আছেই। এ থেকে কিছু আঁচ করতে পারছেন, সূর্যকান্তবাবু?’
‘না, মানে, ঠিক…।’
‘এখনও বুঝতে পারছেন না?’ অনিন্দ্যসুন্দর প্রায় ধৈর্য হারালেন: ‘আমি কে, না, প্রখ্যাত রহস্যকাহিনীকার সুন্দর সান্যাল, বিগত তিরিশ বছর ধরে যে শুধু প্রশ্ন করে গেছে, কে খুন করেছে? এবং বারবার তার উত্তরও দিয়েছে। আর, এখন! আমি নিজেই খুন হলাম অথচ জানি না, কে আমাকে খুন করেছে!’