বিশাল একটা ডোরাকাটা বলদ গাছের ফাঁকে ঢুকে পড়ল হঠাৎ, এস্তা হরিণীর মত ছুটতে শুরু করল। পিছু নিয়েছে আমার স্টিলডাস্ট গেল্ডিং। ধেয়ে আসা বড়সড় একটা ডাল এড়িয়ে গেলাম মাথা নিচু করে, কিন্তু ছোট একটা সপাটে আঘাত করল মুখে; সঙ্গে সঙ্গে চোখে পানি চলে এল। ছয় ফুট উঁচু ঝোঁপের দিকে ছুটছে বলদটা, স্টিলডাস্টও পিছু ছাড়ছে না। মাথা নিচু করে এগোচ্ছি আমি, তারপরও নাকে-মুখে গাছের ছোট ছোট শাখার সংঘর্ষ হচ্ছে, কাঁটা বিঁধছে চ্যাপসে। ঝোঁপের ওপাশে খোলা জায়গায় একটা ল্যারিয়েট বের করে ছুঁড়ে দিলাম। বলদের শিঙে মালার মত জড়িয়ে গেল ফাসটা।
এবার প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল ওটা, কোন কিছুরই পরোয়া করছে না। কিন্তু ঘোড়ার কৌশল আর শক্তির কাছে হার মানতে হলো ওটাকে। দুটো চক্কর খাইয়ে মাটিতে আছড়ে ফেললাম বলদটাকে। মুহূর্ত খানেক মাত্র, ঝট করে উঠে দাঁড়াল ওটা, ছুটে এসে মারমুখী আক্রমণ চালাল, বলদটা বিশাল, যোলো হাতের চেয়েও বেশি উঁচু হবে, ওজন অন্তত আঠারোশো পাউন্ড•••এ মুহূর্তে দারুণ খেপে গেছে।
মাথা নিচু করে ছুটে এল ওটা। শেষ মুহূর্তে পাশ কাটিয়ে গেল স্টিলডাস্ট। আর মি. বলদ প্রপাত ধরণীতল! ভারসাম্য হারিয়ে ধুলোয় আছড়ে পড়ল ওটা।
সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল বলদটা সারা শরীর কাঁপছে, রক্ত লাল চোখে তাকাল চারপাশে। এ মুহূর্তে, এতই খেপে আছে যে সামনে যাই পড়বে, সেটার সঙ্গে লড়াই করবে। কিন্তু কোন সুযোগ দিলাম না ওটাকে। ঘোড়াকে তুমুল বেগে ছুটিয়ে দিলাম। দড়িতে টান পড়তে পিছু পিছু ছুটতে বাধ্য হলো ওটা।
খোলা জায়গায় পালের কাছে আসার পর দড়িতে ঢিল দিলাম। ছোটাছুটিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বলদটা, লড়াই করার খায়েশও মিটে গেছে। বাঁধন খুলে দিতে গরুর দলে ভিড়ে গেল ওটা।
রাউন্ড-আপ মানেই অমানুষিক খাটুনি। গরম, ঘাম বা ধুলোর অত্যাচারের মধ্যে বেয়াড়া বলদের পেছনে পাল্লা দিয়ে ছুটতে হয়, ঘোড়াগুলোর নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। একটা একটা করে বলদকে ঝোঁপ থেকে বের করে আনছি আমরা, খোলা জায়গায় এনে করালে আটকে রাখছি। বুড়ো কয়েকটা মসিহর্ন অবশ্য তেমন সমস্যা করছে না। অন্য গরুর সঙ্গে থাকতে পারলেই সন্তুষ্ট এরা, জায়গা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
ডোরাকাটা বলদটা ঝোপে ফিরে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে, কাউ হাউসে নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে। ওটাকে খেদিয়ে অন্য গরুর সঙ্গে ভিড়ে থাকতে বাধ্য করলাম।
পিস্তলবাজ হোক আর ভবঘুরে হোক, রাউন্ড-আপ বা পাঞ্চিঙে ট্যাপ সত্যিই দক্ষ। আমাদের যে-কারও সমান খাটছে ও।
পুবাকাশে ফ্যাকাসে আভা দেখা দেওয়ার আগেই বেডরোল ছেড়ে উঠে পড়ি আমরা, সূর্য উঠতে উঠতে চলে যাই ঝোঁপঝাড়ের গভীরে। একদিনে তিন-চারটে ঘোড়া বদল করি প্রত্যেকে, কিন্তু লোকের বদল হয় না কখনও। মটরশুটি আর মাংস জোটে সকালের নাস্তায়; দুপুরেও তাই; মহিলারা যদি খোশমেজাজে থাকে তাহলে রাতে কেক বা সরগ্যাম জোটে-কর্ন থেকে তৈরি হয় জিনিসটা।
তৃতীয়দিন সকাল হলো ধূসর আকাশে মেঘে ছেয়ে, কিন্তু কেউই খেয়াল করিনি আমরা। দুটো দিন হাড়ভাঙা খাটুনি গেছে, অথচ হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। সাধারণত বাড়িতে ঘুমই আমি। টেক্সাস হাউজের একটা অংশে বাবা আর আমি থাকি, অন্য পাশে অটম্যানরা থাকে। বুচার্ডের বউ-বাচ্চাদের জন্যে দুটো কামরা ছেড়ে দিয়েছি আমরা, বাইরে অন্যদের সঙ্গে থাকছি দু’দিন ধরে।
বেডরোল গুটিয়ে মাথায় হ্যাট চাপালাম। কাউহ্যান্ডরা ঘুম থেকে উঠে সবার আগে হ্যাট চাপায় মাথায়। তারপর পায়ে বুট গলিয়ে দিলাম।
মেয়েরাও উঠে গেছে। রান্নাঘর থেকে বাসন-কোসনের শব্দ আসছে। বেড়রোল ছেড়ে পানির কলের কাছে চলে গেল ট্যাপ, একটা বালতিতে পানি ভরে হাত-মুখ ধুলো। আমিও পরিষ্কার হয়ে নিলাম। খেয়াল করলাম বরাবরের মতই মেজাজ খিচড়ে আছে ওর-সকালে যা হয়–আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা ভিন্নরকম-সকাল সবসময় সুন্দর, সতেজ এবং একটা দিনের শুরু। শুভ মুহূর্ত। তবে এ নিয়ে ওর সঙ্গে তর্ক করার ইচেছ নেই।
বাড়িতে ঢুকলাম নাস্তা করার জন্যে। আজকের আয়োজন ভিন্ন-মাংস আর মটরশুটি ছাড়াও ফ্রায়েড পেঁয়াজ রয়েছে।
সঙ্গে সর্বক্ষণ ব্রিডল রাখি আমি, জ্যাকেটের ভেতরে পুরে রাখি যাতে খানিকটা উষ্ণ থাকে ওটা। ঠাণ্ডা বা বৃষ্টির দিনে আগুনে খানিক সেঁকে নিই, তাহলে ব্রিডল পরার সময় চমকে ওঠে না ঘোড়া। আজ অবশ্য তেমন ঠাণ্ডা পড়ছে না, তবুও সাতসকালে যাতে ঘোড়ার মুড খারাপ হয়ে না যায়, সেজন্যে জ্যাকেটের ভেতরে রেখেছি ওটা। ঘোড়ার মতিগতির ওপর সারাদিনে কাউহ্যান্ডদের কাজ নির্ভর করে অনেকাংশে।
অবশ্য এমনিতেও খোশমেজাজে থাকবে না ঘোড়াটা..কখনও ছিলও না।
দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেয় বসে পড়েছি আমরা। ইলেন খাবার পরিবেশন করছে। সামনে এসে বড়সড় বাটি থেকে থালায়, খাবার তুলে দিচ্ছে। ট্যাপের থালায় খাবার তুলে দিতে একটু বেশি সময়ই যেন লাগল ওর।
নীরবে খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেললাম আমরা। শেষে আমার পাশে চলে এল কার্ল, সিগারেট রোল করার সময় জানতে চাইল: কখনও লিয়নের ওদিকে গেছ?
না।
আমি আর তুমি যাব…একটু চক্কর দিয়ে আসি। কি বলো?