বৃষ্টির ছাট লাগছে চোখে মুখে। প্রতিবার বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে সঙ্গে গুলি খাওয়ার আশঙ্কায় কুঁকড়ে যাচ্ছে ও। বজ্রের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে পাহাড় চূড়া, পোড়া গন্ধ নাকে লাগছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল কেড্রিক। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে ও। এক সময় টনটনিয়ে উঠল চোখজোড়া।
মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ, ছুঁচোর কেত্তন চলছে পেটে। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। ভয়? আতঙ্ক? এভাবে আর পড়ে থাকা যায় না। অসীম ধৈর্যের সঙ্গে সামনে বাড়ল কেড্রিক। রিজের প্রান্ত বরাবর বহু বছরের বাতাসের হামলায় অদ্ভুত আকৃতি নিয়েছে একটা জুনিপার আর অন্যান্য গাছপালার ঝোঁপ; সেটার উদ্দেশে এগিয়ে গেল।
বাতাসের শব্দ ছাড়া কোনও শব্দ নেই। কিছু দেখার উপায় নেই। পল ভাবছে, ক্লিফ-হাউস আর কতদূর! খুনীর আগেই ওখানে পৌঁছুতে পারবে? নাকি মাঝপথেই খুনীর চোখে ধরা পড়ে যাবে? আচমকা অগ্নিশিখা অন্ধকার ছিন্নভিন্ন করল, আগুন লাগল যেন কেড্রিকের কাঁধে। কিছু না ভেবেই গড়ান দিল ও, সরসর করে দশ বার ফুট নীচে একগাদা শুকনো ডালপালার স্তুপে পড়ল।
সময় নষ্ট করল, না খুনী। আচমকা ব্রিজের মাথায় তার বিশাল ছায়া দেখা গেল। ফাঁদে পড়া জন্তুর মতো গুটিসুটি হয়ে সাবধানে পিস্তলের ট্রিগার, টিপল পল কেড্রিক।
প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি খেলো ছায়ামূর্তি। পরমুহূর্তে গর্জে উঠল স্পেন্সর পয়েন্ট ফাইভ-সিক্স। বুলেটের আঘাতে কাছের একটা ডাল উড়ে গেল। আগে গুলি করতে পেরেছে বলেই এ-যাত্রা বেঁচে গেছে, বুঝতে পারল কেড্রিক। আবার গুলি, করল ও। তারপর স্বেচ্ছায় পেছনের অন্ধকারে গড়িয়ে পড়ল। অনেকটা নীচে এসে থামল, হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল। তারপর উঠেই আবার ঝাঁপ দিল অন্ধকারে, হাত ভাঙা বা মাথা ফেটে যাওয়ায় ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও। এখন খুনীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানোটাই জরুরী। আচমকা বিদ্যুৎ চমকে উঠল। এবং ভেলকিবাজির মতো গর্জল স্পেন্সার। ওর গতিবিধি লোকটা খেয়াল রাখছে কীভাবে, খোদা মালুম! চারদিকে বৃষ্টির মতোই বুলেট পড়ছে। প্রায় নির্ভুল গুলি করছে লোকটা, বেশিক্ষণ ফাঁকি দেয়া যাবে না।
দু’কাঁধে আগুন জ্বলছে, কিন্তু চোটটা, মারাত্মক না, সামান্য চামড়া ছড়ে গেছে, বুঝতে পারছে না কেড্রিক। মেরুদণ্ড বেয়ে গড়িয়ে নামছে তরল পদার্থের ধারা। রক্ত? পানি?
ঘুরে পেছনে সরে গেল কেড্রিক। আরেকটা গুলি ছুটে এল। কিঞ্চিৎ বাঁ দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল ওটা। সঙ্গে সঙ্গে আবার বামে চলে এল ও। মুহূর্তে একটু আগের অবস্থানের কাছে মাটিতে গাঁথল একটা বুলেট। অনুসন্ধানী গুলি ছুঁড়ছে খুনীক্রমশ দূরত্ব কমিয়ে আনছে!
এক কদম পিছনে সরতে গিয়ে হোঁচট খেলো কেড্রিক, ধপাস করে আছড়ে পড়ল। চোখের পলকে মাথার ওপর দিয়ে বিশ্রী শব্দ তুলে, ছুটে গেল এক ঝাক বুলেট। গুলি ভর্তি একটা বেল্ট আছে লোকটার কাছে, নয়তো পকেট ভর্তি করে গুলি নিয়ে এসেছে।
উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল কেড্রিক। হঠাৎ হাতের তালুতে মসৃণ পাথরের ছোঁয়া অনুভব করল। ভালো করে চারপাশে হাত বোলাল ও। পাথর নয়, মাটি আর নুড়ি।
রাস্তা! একটা রাস্তায় এসে পড়েছে ও! নিশ্চয়ই ক্লিফ-হাউসের দিকে গেছে।
সাবধানে হাতড়ে হাতড়ে এগোতে শুরু করল কেড্রিক। হঠাৎ বাম দিকে পাথর গড়ানোর শব্দ পেয়ে আন্দাজে ট্রিগার টিপে দিল। তারপরই ডিগবাজি দিয়ে সরে গেল ও। পরক্ষণে একটু আগের অবস্থানে পর পর তিনটে গুলি এসে লাগল। আবার গুলি করল পল, আবার; গুলি করছে আর দৌড়চ্ছে।
বিদ্যুৎ চমকাল ফের। পেছনে তাকাতেই ট্রেইলে বিশাল এক ছায়ামূর্তি দেখতে পেল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। দৈত্যাকৃতি, চকচকে এবং কালো। অগ্নিশিখা তেড়ে এল ওদিক থেকে। বুলেটের ধাক্কা খেলে কেড্রিক। সামলে নিল নিজেকে, আবার ট্রিগার টিপল।
তারপর আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াল। রাস্তা ধরে এগোল সামনে। হঠাৎ দেখল চোখের সামনে ফাঁকা-ট্রেইলটা এখানে চুলের কাটার মূতো বাঁক নিয়েছে। আর এক কদম এগোলেই হয়েছিল। আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠতেই মুক্তির উপায় দেখতে পেল পল কেড্রিক। নীচে ধূসর শাদা অ্যাপলুসাটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে।
ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল কেড্রিক। কিছুদূর নামতেই একটা চাতালে পৌঁছুল ও। এবং তারপর হাতে লাগল ক্লিফ-হাউসের অমসৃণ, পাথুরে দেয়াল। দেয়াল হাতড়ে এগোল কেড্রিক। দরজা খুঁজে পেতে অসুবিধে হলো না। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ও। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। দরজার কবাট টেনে দিল ও।
বাতাস আর বষ্টির অত্যাচারের পর ঘরটাকে যেন খোদার আশীর্বাদ বলে মনে হচ্ছে। একটানে মাথা থেকে ভেজা টুপি খুলে ফেলল পল কেড্রিক। বর্ষাতিটাও খুলে নিল গা থৈকে। খুনী ভাবতেও পারবে না এ জায়গার কথা ও জানে। আগে থেকে জানা না থাকলে এই ঝড়-তুফানের রাতে এটা খুঁজে পেত না।
কামরার একটু সামনে এগোতেই একটা পর্দার মুখোমুখি হলো পল, কেড্রিক। প্রথম ঘরকে ভেতরের ঘর থেকে আলাদা করেছে এটা। পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে একটা বাংকের ওপর বসল পল। বর্ষাতি আর টুপি বিছানায় রেখে বাম হোলস্টারের পিস্তল বের করতে গিয়ে দেখল হোলস্টার খালি। ডান হাতের পিস্তলে এ পর্যন্ত পাঁচবার গুলি করেছে ও। সহসা দুলে উঠল পর্দাটা, এক ঝলক বাতাস ঢুকে পড়ল ঘরে। তারপর সব কিছু স্থির। এসেছে খুনী! পাশের কামরায়!