কালো অশুভ প্রেতাত্মার মতো সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে হগব্যাক। কিছুটা সর্পিল কিছুটা খাড়া ট্রেইল তীক্ষ্ণ ছুরির মতো রিজের ওপর দিয়ে গেছে। খাড়াই ধরে উঠতে শুরু করল ওরা। খাড়া পিচ্ছিল পথ ধরে উঠতে গিয়ে হাঁপাচ্ছে ঘোড়া দুটো। ট্রেইলে দুদুবার গ্রর পায়ের ছাপ দেখতে পেল কেড্রিক, আনকোরা নতুন, বড়জোর ঘণ্টা খানেক আগের।
রিজের চূড়ায় পৌঁছে পেছনে তাকাল কেড্রিক আর শ্যাড। নেমে পড়ল স্যাডল থেকে। এবার একটু কষ্ট করতে হবে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল পল, পায়ে হেঁটে এগোতে হবে।
নীচের দিকে, মাঝামাঝি দূরত্বে বিদ্যুৎ চমকাল, মুহূর্তের জন্যে আলোর বন্যায় ভেসে গেল চারদিক। চিৎকার করে উঠল লরেডো, সাবধান, পল! ডানে, ওপরে…!
ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কেড্রিক। সঙ্গে সঙ্গে একটা রাইফেল গর্জাল। ওর পাশে পাথরে খাবলা বসাল বুলেট। পাথরকুচি ছিটাল চোখেমুখে। পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল পল। কিন্তু ওটা বর্ষাতির নীচে। আবার গর্জে উঠল, রাইফেল। উপর্যুপরি পাঁচটা বুলেট ধেয়ে এল। আশ্চর্য দ্রুততার সঙ্গে গুলি ছুঁড়ছে শত্রু।
কেড্রিকের পেছনে একটা আহত ঘোড়া আর্তনাদ করে উঠল, খানখান হয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধতা। লরেভোর সাবধান বাণী রাইফেলের প্রচণ্ড গর্জনে চাপা পড়ে গেল। পরমুহূর্তে লাফিয়ে ওঠা ঘোড়ার সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে পাথুরে দেয়ালের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিল ও।
পাহাড়ী ছাগলের মতো অনায়াসে ট্রেইল ধরে ছুট দিল ওর অ্যাপলুসা। আবার রাইফেলের শব্দ হলো। ঝট করে মাটিতে শুয়ে পড়ল কেড্রিক।
শ্যাড? ঠিক আছ তো?
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর কর্কশ অথচ শান্ত কণ্ঠে জবাব এল, একটা গুলি লাগিয়ে দিয়েছে ব্যাটা! অবশ্য মারাত্মক কিছু নয়।
আমি যাচ্ছি ওকে ধরতে। একা থাকতে পারবে?
পারব। তবে যাবার আগে পা-টা একটু বেঁধে দিয়ে যাও।
বৃষ্টিতে ভিজে চকচক করছে পাথর। হগব্যাক রিজের চূড়ায় ঘন কুয়াশা। পাথরের আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। বর্ষাতির সাহায্যে বৃষ্টি থেকে গা বাঁচিয়ে লরেডোর পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। শ্যাডের কপাল ভালো, গুলিটা মাংস ফুড়ে বেরিয়ে গেছে, হাড় ভাঙে নি।
১৭. ব্যান্ডেজ বেঁধে
ব্যান্ডেজ বেঁধে কনুইয়ের মতো উঁচু হয়ে থাকা একটা পাথরের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ইতিউতি তাকাল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। সামনে নিকষ কালো আঁধার। পাহাড়ের নীচে কোথাও ওদের ঘোড়া দুটো আছে। একটা সম্ভবত মরতে বসেছে, অন্যটা খোঁড়া হয়ে গেছে।
চারদিকে কালো অন্ধকার। আকাশ-ছোঁয়া পাথুরে দেয়াল, বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল। এই আঁধারে একজন খুনী হন্যে হয়ে খুঁজছে ওদের। অবিশ্বাস্য তার হাতের টিপ তিনশো গজ দূর থেকে বিদ্যুতের ক্ষণিক আলোয় পলকের জন্যে দেখেই দুদুবার শিকার প্রায় ঘায়েল করে এনেছিল! পরের গুলিতেই হয়তো প্রাণ হারাতে হবে। শত্রুর ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। পরিস্থিতি এখন স্পষ্ট। বাঁচতে চাইলে লোকটাকে খুঁজে বের করে হত্যা করতে হবে।
আলবৎ, শুষ্ক কণ্ঠে বলল লরেডো শ্যাড, শালাকে ধরতেই হবে। তবে সাবধান। স্পেন্সারে ব্যাটার হাত দেখেছ তো?
হগব্যাক রিজ থেকে তাড়াতাড়ি নেমে যাওয়া দরকার তোমার, জোর দিয়ে বলল কেড্রিক, এখানে থাকলে শীত আর বৃষ্টির হামলায় নির্ঘাত পটল তুলবে!
ও নিয়ে ভেব না, সংক্ষেপে জবাব দিল লরেডো। আমি হামাগুড়ি দিয়ে নীচে চলে যাব। কপাল ভালো হলে তৈমার অ্যাপালুসাকে পেয়ে যেতে পারি, ওটার স্যাডলব্যাগে খাবার, আর কফি আছে, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু আমি ফেরার আগে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করো না। হাসল শ্যাড। জলদি ফিরো। একা একা খাওয়াআমার পছন্দ না।
বর্ষাতির পকেটে হাত ঢুকিয়ে পিস্তল দুটোর বাঁট আঁকড়ে ধরল কেড্রি। রাইফেল স্যাডল স্ক্যাবার্ডে রয়ে গেছে। নিপুণ এক শিকারীকে শিকার করতে যাচ্ছে ওঁ। আপন ঘাটিতে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছে সশস্ত্র মার্কসম্যান। অস্ত্রের নাম: স্পেন্সর পয়েন্ট-ফাইভ-সিক্স!
বিদ্যুৎ চমকাল, কিন্তু এবার কোনও গুলি তেড়ে এল না। তবে, সন্দেহ নেই, কাছেপিঠেই আছে লোকটা, ওদের খুঁজছে। এখন আর ইস্তফা দেবে না সে, ফিরে যাবে না। ওদের হত্যা করার এটাই তার শেষ সুযোগ। তার হাইডআউটের ঠিকানা ফাঁস হয়ে গেছে, ওরা পালালে তার নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। এতদিন এখানে রয়ে যাওয়ায় একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেছে, কিছুতেই এখান থেকে নড়তে রাজি নয় লোকটা।
একটা ঝোঁপের আড়াল নিয়ে পাথরের নীচ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল পল কেড্রিক। বিদ্যুৎ চমকাল, সামনে একটা বোল্ডারের স্তূপ দেখতে পেল ও। এগোল সেদিকে। বাতাসে, পতপত করছে বর্ষাতির কিনারা, উড়ে যেতে চাইছে মাথার টুপি। ডান হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে নিয়েছে পল, বর্ষাতির নীচে লুকিয়ে রেখেছে।
এগিয়ে চলল ও। আবার বিদ্যুৎ চমকাল। ঝলমল করে উঠল চারদিক। সঙ্গে সঙ্গে মাটির সঙ্গে মিশে গেল পল। কিন্তু স্পেন্সার ঠিক গর্জে উঠল। উত্তপ্ত পাথর কুচি যেন, হুল ফোঁটাল চোখেমুখে। গড়িয়ে সরে গেল কেড্রিক, গুলি করবে কি, দুহাতে চোখ পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে।
বৃষ্টি আর বাতাসের হাহাকার ধ্বনি ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। হঠাৎ বহুদূর থেকে মেঘের গুরুগুরু গর্জন ভেসে এল, পাহাড়ের গায়ে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলল সে শব্দ 18 ফের বিদ্যুৎ চমকালে হগব্যাকের চূড়া বরাবর সামনে তাকাল কেড্রিক। অবিরাম বৃষ্টির আক্রমণে ইস্পাতের মতো চকচক করছে পাথরগুলো। নীচে নেমে এসেছে মেঘের দল, মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। চারপাশে কুয়াশা ভাসছে, হিম অশরীরী হাত বোলাচ্ছে গালে। মরা পাইন গাছের শাদা কঙ্কাল আঙুল তুলে আকাশকে যেন অভিযুক্ত করছে।