কাঁধ ঝাঁকাল কেড্রিক, টুপি তুলে নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে এল। ইতিমধ্যে উধাও হয়েছে ডরনি শ। বারান্দায় এসে কেড্রিক দেখল সামান্থা ফক্স তখনও বসে, বইয়ের ওপর দিয়ে ধূলি-ধূসর রাস্তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
টুপি হাতে থমকে দাঁড়াল কেড্রিক। মাস্ট্যাংয়ে এসেছ কদিন হলো, ম্যাম?
চোখ তুলে তাকাল সামান্থা, অনেকক্ষণ ধরে জরিপ করল ওকে, তারপর বলল, এই তো কয়েকদিন। কিন্তু এরই মধ্যে, কাকে পছন্দ করা উচিত আর কাকে ঘৃণা, শিখে ফেলেছি। পর্বতমালার দিকে একনজর তাকিয়ে আবার কেড্রিকের দিকে ফিরল সামান্থা। এই দেশটাকে আমি পছন্দ করি, ক্যাপ্টেন, আমার কথা বুঝতে পারছ?
আমি শহুরে মেয়ে, শহরেই জন্ম, বেড়ে ওঠা; কিন্তু এখানে আসার পর লাল পাহাড়, মেসা, মরুভূমি আর ইন্ডিয়ান পনি দেখে-বিশ্বাস করো, এ দেশের প্রেমে পড়ে গেছি! এখন মনে হয় এটাই আমার দেশ। ইচ্ছে করছে চিরদিন এখানে থেকে যাই। অবাক দৃষ্টিতে আবার সামান্থাকে জরিপ করল কেড্রিক। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সামান্থাকে ওর ভালো লেগেছে। মাঝে মাঝে আমারও এ-রকম ইচ্ছা করে। কিন্তু কী যেন ঘৃণা করার কথাও বলছিলে? এই-দেশকে পছন্দ করো, এবার বল, ঘৃণা করো, কাকে?
যারা দেশটার ক্ষতি করছে। এদের কেউ এখানেই জন্ম নিয়েছে, কেউ ভিনদেশী, একসঙ্গে হাত মিলিয়ে, নিরপরাধ কিছু লোককে ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত করে তাদের জমিজমা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছে অথচ ওরাই সত্যিকার মানুষ, ওদের মাঝে ঘোরপ্যাঁচ বা জটিলতা নেই। বিস্ময়ের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে কেড্রিকের, রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল ও। তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, মিস ফক্স। আমি এখানে নতুন এসেছি বটে, কিন্তু এমন কারও দেখা তো পাই নি!
আবার সহজ শান্ত দৃষ্টিতে কেড্রিকের দিকে তাকাল সামান্থা ফক্স। বই বন্ধ করে আস্তে আস্তে উঠে দাড়াল, তারপর পা বাড়াল দরজার দিকে। তাই নাকি, ক্যাপ্টেন? ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল সে। ঠিক জানো? এই মুহূর্তে তোমাকেই তো তাদের একজন বলে মনে হচ্ছে আমার! কথা শেষ করেই ঘরে ঢুকে, পড়ল মেয়েটা।
সামান্থার গমনপথের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কেড্রিক। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ পড়ল। অবশেষে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দা থেকে নেমে এল ও। কী বোঝাতে চাইল মেয়েটা? ওকে সে কতখানি চেনে? কী করে ওর সম্পর্কে এরকম অদ্ভুত ধারণা জন্ম নিল তার মনে? অস্বস্তি, বিরক্তি বোধ করছে কেড্রিক। পিটার্সের ক্রুদ্ধ চেহারা মনে পড়তেই নতুন উপাদান যোগ হলো ওর ভাবনায়। জন গুন্টারের ভাগ্নী হওয়া সত্ত্বেও সামান্থা ফক্স পিটার্সের মতো কথা বলছে কেন? তবে ওদের মতামত যে ভিন্ন সূত্র থেকে জন্ম লাভ করেছে তাতে সন্দেহ নেই।
চিন্তিত মনে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় উঠে এল কেড্রিক, থেমে এদিক-ওদিক তাকাল।
এখনও পশ্চিমা পোশাক পরে নি ও। ফ্ল্যাট-ক্রাউন, ফ্ল্যাট ব্রীমের টুপি রয়েছে মাথায়, পরনে নিখুঁত ছাঁটের ধূসর স্যুট, পায়ে কালো পশ্চিমা তোর বুট। মোড়ে দাঁড়িয়ে ধীরে সুস্থে সিগারেট রোল করে ঠোঁটে ঝোলাল ও, দেশলাই জ্বেলে ধরাল। দুচোখে সতর্ক দৃষ্টি।
রাস্তার প্রতিটি মানুষ, নারী-পুরুষ একাধিকবার দেখছে ওকে। ওর মিলিটারি-সুলভ ঋজুতা, চওড়া কাঁধ, প্রশান্ত চেহারা আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে ওকে। হাতের কাজের কথা ভুলে গিয়ে কর্মব্যস্ত রাস্তার সীমাহীন উত্তেজনায় নিজেকে হারিয়ে ফেলল কেড্রিক। অসংখ্য নারী-পুরুষ যেন অজানা কারণে একই স্রোতে মিশে গেছে এখানে এসে।
আর কিছু না হোক, পশ্চিম যেন মানুষের অপরূপ এক মিলন ক্ষেত্র। সোনা, নতুন জমি আর রোমাঞ্চের অন্বেষায় অভিযাত্রীরা আসছে এখানে; আসছে জুয়াড়ী আর পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশার নারী, চোর-ডাকাত, বন্দুকবাজ, গরু-চোর, ঘোড়াচোর, মাইনার, কাউহ্যান্ড, ফ্রেইটার আর ভবঘুরে। সব রকম মানুষের উপস্থিতি রয়েছে রাস্তায়।
সবাই প্রকাশ্যে কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে রেখেছে। প্রয়োজনে ওগুলো ব্যবহার করবে ওরা। খালিহাতে মারপিট করার মতো লোকও আছে এখানে, যদিও সংখ্যায় কম।
আচমকা দীর্ঘদেহী এক লোক জনস্রোত থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল। কেড্রিক তাকাতেই চোখাচোখি হলো ওর সঙ্গে। নিঃসন্দেহে, এতক্ষণ মদ গিলছিল লোকটা, এখন ঝামেলার খোঁজে বেরিয়েছে। বেছে নিয়েছে কেড্রিককে। হঠাৎ উত্তেজনার আঁচ পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল পথিকেরা। দেখতে দেখতে ভিড় জমে উঠল।
আচ্ছা? দুপা ফাঁক করে দাঁড়াল লোকটা। শার্টের হাতা গুটিয়ে কনুই অবধি তোলা, পেশীবহুল দুটি লোমশ হাত দেখা যাচ্ছে। তুমিও ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছ! আমাদের জমি দখল করতে চাও! হঠাৎ সশব্দে হেসে উঠল লোকটা। কিন্তু এখন খুনীর বাচ্চাটা সঙ্গে নেই, তোমাকে পিটিয়ে লাশ করব আমি। কই, লাগো।
মুখের ভেতরটা খটখটে লাগছে, কিন্তু কেড্রিকের দৃষ্টি স্থির। ডান হাতে, সিগারেট ধরে ঠোঁটে ঝোলানোর ভঙ্গি করল ও। দুঃখিত আমার কাছে পিস্তল নেই, আর থাকলেও শুধু শুধু তোমাকে হত্যা করতাম না। জমির ব্যাপারে ভুল হচ্ছে তোমার। কোম্পানির দাবীই বৈধ।
তাই নাকি? এক কদম সামনে বাড়ল লোকটা, পিস্তলের বাঁট স্পর্শ করল তার হাত। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আবাদী জমি গড়েছি আমরা, সেখান, থেকে বৌ-বাচ্চাসহ আমাদের উত্থাত করে পথে বসানোকে বৈধ বলছ?