অন্ধকারে আক্ষরিক অর্থেই হাতড়ে হাতড়ে এগোচ্ছে পল কেড্রিক। ও নিশ্চিত, বালির-রেখাঁটি পানির স্রোতেই তৈরি হয়েছে, ক্যানিয়নে পানির উপস্থিতির প্রমাণ রয়েছে, ক্লিফের কিনারা দিয়ে উপচে কিংবা কোনও ফোকর গলে এসেছে পানি। ফাঁকটা বের করতে হবে। এগিয়ে চলল কেড্রিক, অসংখ্য বোল্ডারের জটলায় এসে পড়েছে ও, এঁকেবেঁকে বালি রেখা ধরে কোথায় যাচ্ছে জানে না।
দুবার থামল পল, পেছনে গিয়ে টুপির সাহায্যে পায়ের ছাপ মুছে ফেলল। অন্ধকারে কাজ হলো কিনা বোঝার উপায় নেই; তবে ফাঁকটা সরু, ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম। দশ মিনিটের মতো চিপা গলি দিয়ে এগোনোর পর হঠাৎ আবার খাড়া দেয়ালের মুখোমুখি হলো ও। ঢাল বেয়ে, ঝোঁপঝাড় আর পাথরচাইয়ের ভেতর দিয়ে আরেকটা দেয়ালের সামনে এসে পড়েছে।
মাথার ওপর, নাগালের বাইরে ক্লিফের গায়ে একটা নচ দেখতে পেল পল কেড্রিক। ওই ফোকরটা দিয়েই সম্ভবত বালির রেখাটা নেমে এসেছে। এবার সত্যি সত্যি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল কেড্রিক। অ্যাপলুসাকে রেখে. ক্লিফের দেয়ালহাতড়ে ফাটল খুঁজতে শুরু করল।
বাঁ দিকে কিছুই পাওয়া গেল না। বার কয়েক পঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। ক্যানিয়নের মুখ থেকে কোনওরকম শব্দ আসছে না। এটা বক্স ক্যানিয়ন হলে ইয়েলো বাটের লোকদের অজানা থাকার কথা নয়। সেক্ষেত্রে অন্ধকারে ভেতরে ঢোকার ঝুঁকি না নিয়ে ভোরের অপেক্ষা করবে ওরা। রাতের অন্ধকারে এখানে চমৎকার প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। তবু বলা যায় না, প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে লোকগুলো, এই মুহূর্তেও ছুটে আসতে পারে।
ফিসফিস করে ঘোড়াকে সান্ত্বনা দিয়ে দেয়াল ঘেষে এবার ডানে এগোল কেড্রিক। খানিকটা এগোনোর পর হঠাৎ দেখল পায়ের নীচের মাটি ঝুপ করে নীচে নেমে গেছে। একটা গহ্বরে নেমে এল পল। ঠাণ্ডা, সঁতসেঁতে একটা ভাব এখানে। কাছেপিঠে ঝর্না আছে হয়তো, যদিও পানি গড়ানোর শব্দ পেল ও।
গহ্বরে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডার মধ্যেও দরদর করে ঘামছে ক্যাপ্টেন কেড্রিক। অনড় দাঁড়িয়ে কান খাড়া করল ও, ঘামে ভেজা মুখ মুছল। আচমকা বাতাসের মৃদু ছোয়া লাগল মুখে।
চমকে উঠল কেড্রিক। নতুন আশা জাগল বুকে। ঘুরে দঁাড়িয়ে অদম্য উৎসাহে পাহাড়ী-দেয়ালে সন্ধান চালাল, কিন্তু আকস্মিক হাওয়ার উৎস খুঁজে পাওয়া গেল না। এবার আরও সাবধানে এগোল ও হঠাৎ বুঝতে পারল নীচের শক্ত মাটি সামান্য খাড়া হয়ে উপর দিকে উঠে গেছে। পায়ে পায়ে ক্লিফের চূড়ার দিকে এগোল পল কেড্রিক, হাতে রাইফেল ধরা।
ঢালের মাথায় এসে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল কেড্রিক। ক্যানিয়নের মুখের কাছে ধূসর বালির রেখা এখান থেকে ফিকে দেখাচ্ছে। এখানে হঠাৎ ঈষৎ বাঁক নিয়েছে ক্যানিয়ন, তারপর কানাগলির মতো শেষ হয়ে গেছে। গলির শেষ মাথায়, ওপরে ক্লিফের কিনারায় একটা নচ। খাড়া একটা ঢাল ক্লিফের চূড়া থেকে নেমে এসেছে। ওখানে রিমের ওপর বাতাসে কোনও কারণে আলোড়ন উঠেছিল হয়তো, সেজন্যেই ওঁর মুখে ছোঁয়া লেগেছে। কেড্রিক লক্ষ্য করল টালটা অসম্ভব খাড়া, ওটা বেয়ে উঠতে গেলে ধস নামকে, এবং তাতে প্রচণ্ড শব্দের সৃষ্টি হবে, ব্যর্থ হয়ে যাবে ওর পালানোর চেষ্টা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ঘেরাও করে ফেলবে ওকে। তা ছাড়া, এতক্ষণে হয়তো রিমের ওপর পাহারা বসানো হয়ে গেছে।
কেড্রিক ঘুরতেই হঠাৎ পা হড়কে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাঁচার সহজাত প্রবৃত্তির বশেই একটা ঝোঁপের গোড়া আঁকড়ে ধরল। অতল খাদে পড়ে প্রাণ হারানোর হাত থেকে বেঁচে গেল এ-যাত্রা। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে শক্ত জায়গায় উঠে দাঁড়াল ও, একটা নুড়ি পাথর ছুঁড়ে দিল নীচের দিকে। অনেকক্ষণ পর ওটার পতনের শব্দ কানে এল পনের থেকে বিশ ফুট গভীর হবে গর্তটা। দেয়ালের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে ঢালের গোড়ায় এসে দাঁড়াল কেড্রিক, নতুন একটা জিনিস ধরা পড়ল চোখে।
বৃষ্টির পানির তীব্র স্রোত মাটির ওপর প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি করেছে এখানে, ফলে চওড়া একটা ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে; হয়তো গিরিখাদের দিকেই গেছে ওটা। এই খাদে আত্মগোপন করার মতো একটা জায়গা না থেকে পারে না। চট করে আবার অ্যাপলুসার কাছে ফিরে এল কেড্রিক।
ঢালটা খাড়াভাবে খাদের তলদেশে নেমে এসেছে। নীচে এর্সে ঘাড় কাত করে ওপরে তাকাল কেড্রিক। কমপক্ষে পনের ফুটের মতো নীচে দাঁড়িয়ে আছে ও মাথার ওপর খাদের সমান প্রশস্ত এক টুকরো তারা-জ্বলা-আকাশ দেখা যাচ্ছে। খাদের সংকীর্ণ তলদেশ ধরে অ্যাাপালুসা নিয়ে আরও নীচে নামতে শুরু করল পল কেড্রিক। খানিক দূর এগোনোর পর দেখল, খাদের দুপাশের দেয়ালের ওপর জন্মানো ঝোঁপঝাড় আর আগাছায় মাথার ওপরের ফাঁক ঢাকা পড়ে গেছে।
চারদিকে অপার্থিব নিস্তব্ধতা। শীত শীত করছে। আরও এগোল পল কেড্রিক। পানির তীব্র স্রোত বাক নিয়ে খাদের দেয়ালে একটা গুহা তৈরি করেছে, কাছে এসে ভেতরে ঢুকে পড়ল ও। গুহার শেষ প্রান্তে একটা ছোট গর্তে পানি জমে আছে। অ্যাপলুসাকে পানি খাওয়ার জন্যে ছেড়ে দিল পল। এক নিঃশ্বাসে সবটুকু পানি সাবাড় করল ঘোড়াটা।
ক্যান্টিন থেকে দুটোক পানি খেলো, কেড্রিক। তারপর অ্যাপলুসার পিঠ থেকে স্যাডল নামিয়ে একমুঠো ঘাস দিয়ে ওটার শরীর দলাইমলাই করে দিল। তারপর ঘোড়াকে বেঁধে রেখে কম্বল বিছিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। ভাবছে ও। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে, এরপরও যদি ধরা পড়তে হয়, গোলাগুলি করা ছাড় উপায়ান্তর থাকবে না এবং তাতে প্রাণহানী ঘটবেই।