আপনি কি মঠাধ্যক্ষ মোরিওকে চেনেন? খুব আমুদে মানুষ।
হ্যাঁ, তার শাশ্বত শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা আমি শুনেছি; পরিকল্পনাটি আকর্ষণীয়, কিন্তু মোটেই। সম্ভবপর নয়।
গৃহকত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থেকেও আন্না পাভলভনা কোনো রকমে জবাব দিল, আপনি তাই মনে করেন বুঝি? পিয়ের কিন্তু এবার দ্ৰতাবিরুদ্ধ কাজ করে বসল। প্রথমে এক মহিলার কথা শেষ হবার আগেই তার কাছ থেকে চলে এসেছিল, আর এখন যে চলে যেতে চাইছে তাকে ধরে কথা শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাথা নুইয়ে দুই পা ছড়িয়ে সে বোঝাতে শুরু করে দিল কেন সে আবের পরিকল্পনাকে অলীক কল্পনাবিলাস বলে মনে করে।
আন্না পাভলভনা হেসে বলল, এ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।
যুবকটির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সে আবার গৃহকত্রীর কর্তব্য পালনে তৎপর হয়ে উঠল। সব দিকে তার চোখ, সর্বত্র তার কান; যেখানেই আলোচনায় ঢিল পড়ছে সেখানেই সে বাড়িয়ে দিচ্ছে তার সাহায্যের হাত। সুতো-কলের ফোরম্যান যেমন কারখানার কাজ চালু করে দিয়ে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখে-কোথায় একটা টেকো থেমে গেছে, বা কাঁচ-কাঁচ করছে, অথবা যতটা শব্দ হওয়া উচিত তার চাইতে বেশি শব্দ করছে, এবং সেখানেই ছুটে গিয়ে যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখে বা ঠিক মতো চালিয়ে দেয়, ঠিক তেমনই আন্না পাভলভনাও বৈঠকখানায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখনো বা নীরব, আবার কখনো অতিমাত্রায় সরব কোনো দলের কাছে আলোচনার যন্ত্রটাকে আবার যথাযথভাবে চালু করে তুলছে। কিন্তু এসব কাজকর্মের মধ্যেও পিয়েরকে নিয়ে তার উদ্বেগটা বেশ স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠছে। পিয়ের যখনই মর্তেমায়ের দলের কাছে অথবা মধাধ্যক্ষের দলের কাছে যাচ্ছে তখনই মহিলাটি তার উপর কড়া নজর রাখছে।
পিয়ের লেখা-পড়া শিখেছে বিদেশে; রাশিয়াতে এসে আন্না পাভলভনার পার্টিতেই সে প্রথম যোগ দিল। সে জানত, পিটার্সবুর্গের সেরা সব গুণীজনরাই সেখানে হাজির থাকবে, তাই খেলনার দোকান কৌতূহলী শিশুর মতো কোনদিক রেখে কোনদিকে যে তাকাবে তাই ঠিক বুঝতে পারছে না, মনে ভয় পাচ্ছে কোনো কুশলী আলোচনা ও মন্তব্য না অশ্রুত থেকে যায়। সমবেত সকলের মুখে যে আত্মবিশ্বাস ও সুষ্ঠু অভিব্যক্তি তার চোখে পড়েছে তাতে সর্বক্ষণই একটা গম্ভীর কিছু শুনবার আশাই সে করছে। শেষপর্যন্ত সে মোরিওর কাছে গিয়ে হাজির হল। এখানকার আলোচনাটা তার বেশ মনোগ্রাহী বলে মনে হল; তাই অন্য সব যুবকদের মতোই সেও তার নিজের মত প্রকাশ করবার মতো একটা সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
*
অধ্যায়-৩
আন্না পাভলভনার পার্টি পুরোদমে চলছে। চারদিকে (সুতো কলের) টেকোগুলো অবিশ্রান্তভাবে গুনগুন করে চলেছে। একমাত্র ব্যতিক্রম খালাটি। তার চিন্তাক্লিষ্ট শুকনো মুখ এই ঝলমলে জমায়েতের মাঝখানে একান্তই বেমানান। শুধু আর একটি বয়স্কা মহিলা তার পাশে বসে আছে। তাছাড়া বাকি সব লোক তিনটে দলে ভাগ হয়ে জমে গেছে। একটি দল প্রধানত পুরুষরাই রয়েছে; তারা বসেছে মঠাধ্যক্ষকে ঘিরে। প্রধানত যুবকদের আর একটা দল প্রিন্স ভাসিলির মেয়ে সুন্দরী প্রিন্সেস হেলেন এবং বয়সের তুলনায় একটু মোটাসোটা খুবই সুন্দরী গোলাপবর্ণ ছোট্ট প্রিন্সেস বলকনস্কায়াকে ঘিরে বসেছে। তৃতীয় দলটা গড়ে উঠেছে মর্তোমাৎ ও আন্না আন্না পাভলভনাকে কেন্দ্র করে।
ভাইকোঁত সুদর্শন যুবক; নরম চোখ-মুখ, মার্জিত আচরণ; নিজেকে খ্যাতিমান মনে করলেও ভদ্রতার খাতিরে যে দলে বসেছে তার সঙ্গেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। আন্না পাভলভনারও সমবেত অতিথিদের সামনে দর্শনীয় বস্তু হিসেবেই তাকে উপস্থিত করেছে। হোটেলের কুশলী পরিবেশকারী যেভাবে একটি বিশেষ সুখাদ্য পরিবেশন করে, আন্না পাভলভনাও সেইভাবে প্রথমে ভাইকোঁতকে ও পরে মঠাধ্যক্ষকে বিশিষ্ট খাদ্যবস্তু হিসেবে পরিবেশন করছে। মর্তোমার্তের দল সঙ্গে সঙ্গেই দুক দএনঝিনের হত্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিল। ভাইকোঁত বলল যে, দএনঝিন তার নিজের উদারতার জন্যই মারা গেছে; তার প্রতি বোনাপার্তের বিদ্বেষেরও তো বিশেষ কারণ ছিল।
আন্না পাভলভনা খুশি হয়ে বলল, তা তো বটেই। সে বিষয়ে সব কথা আমাদের বলুন ভাইকোঁত।
ভাইকোঁত যে অনুরোধটি রাখতে রাজি সেটা বোঝাবার জন্য সে সহৃদয় হাসি হেসে মাথাটা নোয়ালো। সে কাহিনী সকলকে শোনাবার জন্য আন্না পাভলভনা সকলকে ডেকে একত্র করল।
জনৈক অতিথির কানে ফিসফিস করে বলল, দুকের সঙ্গে ভাইকোঁতের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। আরেক জনকে বলল, কথক হিসেবেও ভাইকোঁত চমৎকার। আর তৃতীয়জনকে বলল, একেবারে সেরা মহলে যে তার চলাফেরা।
গল্প বলবার জন্য তৈরি হয়ে ভাইকোঁত ঈষৎ হাসল।
প্রিয় হেলেন, তুমি এখানে এসে বস, যে সুন্দর তরুণী প্রিন্সেসটি অন্য একটি দলের মধ্যমণি হয়ে কিছুটা দূরে বসেছিল, আন্না পাভলভনা তাকেও কাছে ডাকল।
প্রিন্সেস হাসল। অপরূপ সুন্দরী নারীর মুখের যে হাসিটি নিয়ে সে প্রথম এই ঘরে ঢুকেছিল সেই অপরিবর্তনীয় হাসিটি মুখে নিয়েই নিয়েই সে উঠে দাঁড়াল। পাটকরা সাদা পোশাকের ঈষৎ খসখস শব্দ তুলে, শুভ্র কাঁধ, চকচকে চুল, ঝলমলে হীরের দ্যুতি খেলিয়ে, প্রিন্সেস কারো দিকে না তাকিয়ে শুধু হাসিটি বিতরণ করে এগিয়ে চলল। সেকালের ফ্যাশান অনুসারে নিজের সুন্দর দেহ, সুঠাম কাঁধ, পিঠ ও বুককে সে এমনভাবে খুলে রেখেছে যাতে সকলেই সে-সবের প্রশংসা করার সুযোগ পায়। দেখে মনে হয়, আন্না পাভলভনার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে যেন একটা নাচঘরের ঝলকানি তার সঙ্গে নিয়ে চলেছে। হেলেনের রূপ এতই মোহময়ী যে তার চালচলনে কোনোরকম বাঁচালতার চিহ্ন তো ছিলই না, বরং দেখে মনে হল নিজের সন্দেহাতীত বিজয়িনী রূপ সম্পর্কে সে যেন কিছুটা সংকোচগ্রস্ত। যে চায় তার রূপের প্রভাবকে খাটো করতে, কিন্তু পারে না।