নতুন কেউ এলেই আন্না পাভলভনা তাকে বলছে, আমার খালার সঙ্গে তো আপনার এখনো দেখাই হয়নি, অথবা আমার খালাকে কি আপনি চেনেন না? আর খুব গম্ভীর হয়ে তাকে সেই বৃদ্ধ মহিলাটির কাছে নিয়ে হাজির করছে। টুপিতে মস্ত বড় একটা ফিতের বো পরে মহিলাটি ঘরের মধ্যে বসে আছে; ধীরে ধীরে প্রতিটি অতিথির নাম ঘোষণা করেই আন্না পাভলভনা সেখান থেকে চলে যাচ্ছে।
অতিথিরা কেউই এই বুড়ি খালাটিকে চেনে না, চিনতে চায় না, তাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না; তবু প্রত্যেকেই তাকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছে, আর আন্না পাভলভনা নীরবে, বিষণ্ণ আগ্রহের সঙ্গে সেটা লক্ষ্য করছে। খালাও প্রত্যেকের সঙ্গেই সেই একই কথা বলছে, সেই একই পারস্পরিক স্বাস্থ্যের কথা, আর মহামান্যা সম্রাজ্ঞীর স্বাস্থ্যের কথা, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আজ তিনি অনেকটা ভালো আছেন। ভদ্রতার খাতিরে বিরক্তি প্রকাশ থেকে বিরত থাকলেও সকলেই এই বিরক্তিকর কর্তব্যটি পালন করে সেখান থেকে সরে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচছে এবং সারা সন্ধ্যা আর সে জায়গা মারাচ্ছে না।
তরুণী প্রিন্সেস বলকনস্কায়া জরির কাজ-করা ভেলভেটের থলেতে কিছু কাজের নমুনা নিয়ে এসেছে। তার সুন্দর ছোট ঠোঁটের উপরে ঈষৎ গোঁফের রেখা চোখে পড়ছে; ঠোঁটটি দাঁতের তুলনায় কিছুটা ছোট হলেও তাতেই তাকে সুন্দর মানিয়েছে; বিশেষ করে দুটো ঠোঁট যখন মাঝে মাঝে মিলে যায় তখন তাকে বড়ই সুন্দর দেখায়। অন্য সব মনোরমা স্ত্রীর মতোই তার এই টি-উপরের ঠোঁট ছোট হওয়ার জন্য মুখটা অর্ধেক খুলে থাকা–এই ত্রুটিই যেন তার পক্ষে একটি বিশেষ সৌন্দর্যের লক্ষণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সুন্দরী তরুণীটিকে দেখে সকলের মুখই জ্বলজ্বল করে উঠল–শীঘ্রই তো সে মা হবে, অথচ কেমন প্রাণ-শক্তি ও স্বাস্থ্যে ভরপুর, কেমন অনায়াসে এই ভার সে বহন করে চলেছে। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটালে, তার সঙ্গে কথাবার্তা বললে বৃদ্ধ ও মন-মরা যুবকরাও মনে করে তারাও বুঝি তার মতোই জীবন ও স্বাস্থ্যে ভরপুর হয়ে উঠেছে। যারাই তার সঙ্গে কথা বলে, প্রতিটি কথার পরে তার উচ্ছল হাসি ও সাদা দাঁতের ঝলকানি দেখতে পায়, তারাই মনে করে যে সে দিনটাতে তাদের মন-মেজাজও ভালো হয়ে উঠেছে।
ছোট্ট প্রিন্সেসটি হাল্কা অথচ দ্রুত পা ফেলে ফেলে কাজের থলেটা হাতে ঝুলিয়ে টেবিলের চারদিকে পাক খেয়ে সুন্দরভাবে পোশাকটা ছড়িয়ে রুপোর সামোভারটার পাশে একটা সোফায় এমনভাবে বসল যেন সে যা কিছু করছে তাতে যেমন সে নিজে, তেমনই অন্য সকলেই খুব খুশি। থলের জিনিসগুলি বের করে সকলকে ডেকে সে ফরাসিতে বলল, আমার কাজগুলি নিয়েই এসেছি। দেখুন আনেৎ, আশা করি আমার সঙ্গে আপনি ইয়ারর্কি করেন নি। চিঠিতে লিখেছিলেন, নেহাত্র ছোটখাট অনুষ্ঠান হবে, আর তাই দেখতেই পাচ্ছেন কী রকম বাজে পোশাক পরে আমি এসেছি।
আন্না পাভলভনা জবাব দিল, যাই পর না কেন তবু তুমি অন্য সকলের চাইতে সুন্দরী।
জনৈক জেনারেলের দিকে ফিরে সেই একই সুরে প্রিন্সেস ফরাসিতেই বলল, আপনি কি জানেন যে আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে? সে তো যাচ্ছে নিজেকে খুন করতে। আপনিই বলুন, এই হতভাগা যুদ্ধে কি লাভ? প্রিন্স ভাসিলির দিকে ঘুরে সে জিজ্ঞাসা করল; তারপর জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই সে তার মেয়ে সুন্দরী হেলেনের দিকে মুখ ফেরাল।
প্রিন্স ভাসিলি আন্না পাভলভনাকে বলল, এই ছোট প্রিন্সেসটি কী মিষ্টি!
তার পরেই এসে হাজির হল মজবুত গড়নের একটি শক্ত-সমর্থ যুবক। চুল ছোট করে ছাঁটা, চোখে চশমা, পরনে হাল্কা রঙের কেতাদুরস্ত ব্রিচেস ও বাদামি ড্রেস-কোট। এই যুবকটি ক্যাথারিনের সমকালীন বিখ্যাত জমিদার কাউন্ট বেজুকভের অবৈধ সন্তান। জমিদারবাবুটি এখন মুমূর্ষ অবস্থায় মস্কোতে দিন কাটাচ্ছে। যুবকটি এখনো সামরিক বা বেসামরিক কোনো চাকরিতেই যোগ দেয় নি, কারণ এই সবেমাত্র সে বিদেশ থেকে ফিরেছে; বিদেশেই সে লেখাপড়া শিখেছে; এখানকার সমাজে এই তার প্রথম আবির্ভাব। বৈঠকখানার নিম্নতর মর্যাদার অধিকারী লোকের মতোই মাত্র একটুখানি ঘাড় নেড়েই আন্না পাভলভনা তাকে অভ্যর্থনা জানাল। কিন্তু এই নিচু মানের অভ্যর্থনা সত্ত্বেও পিয়েরকে ঘরে ঢুকতে দেখেই মহিলাটির মুখের উপর উদ্বেগ ও আতঙ্কের এমন একটা ছায়া নেমে এল যেন সেই মানুষটি এই ঘরের তুলনায় অনেক বড়, যেন এ ঘরে তাকে মানায় না। ঘরে সমবেত অন্য সকলের চাইতে এই যুবকটির চেহারা অবশ্যই বড় মাপের; কিন্তু মহিলাটির উদ্বেগের কারণ অন্য; যুবকটির মুখের ভাব লাজুক অথচ সপ্রতিভ, কিন্তু পর্যবেক্ষণশীল ও স্বাভাবিক ভাবটিই তাকে বৈঠকখানার অন্য সকলের চাইতে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
যুবকটিকে খালার কাছে নিয়ে যেতে যেতে তার সঙ্গে শঙ্কিত দৃষ্টি বিনিময় করে আন্না পাভলভনা বলল, মঁসিয় পিয়ের যে একটি অসহায় পঙ্গু মানুষকে দেখতে এখানে এসেছেন তাতে ভারী খুশি হয়েছি।
যেন কাউকে খুঁজছে এমনিভাবে চারদিকে তাকাতে তাকাতে পিয়ের বিড় বিড় করে কি যে বলল কিছুই। বোঝা গেল না। খালার কাছে যেতে যেতেই সে স্মিত হাসি হেসে মাথা নিচু করে ছোট প্রিন্সেসকে অভিবাদন জানাল; যেন তার সঙ্গে পরিচয়টা বেশ ঘনিষ্ঠ।
আন্না পাভলভনার ভয়টা অকারণ হয়; মহামান্যা সম্রাজ্ঞীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে খালা যে লম্বা বক্তৃতা দিল তার কোনো জবাব না দিয়েই পিয়ের তার দিক থেকে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। আন্না পাভলভনা তাকে আটকে দিয়ে সভয়ে বলে উঠল :