এই নববিধানগুলিকে খণ্ডন করে ইতিহাসের পূর্বতন ধারণাকে হয়তো রক্ষা করা যেত, কিন্তু সেটাকে খণ্ডন করে না ইতিহাসের ঘটনাবলিকে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ফলরূপে দেখা একেবারেই অসম্ভব বলে মনে হল। কারণ কতকগুলি বিশেষ গৌগোলিক, জাতিতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক কারণের ফলেই যদি কোনো বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং কোনো বিশেষ জাতির স্থানান্তর গমন ঘটে, তাহলে কোনো ব্যক্তিবিশেষের স্বাধীন ইচ্ছাকে ওই দুইয়ের কোনো ঘটনার কাণে বলেই ধরা যায় না। অথচ সংখ্যাতত্ত্ব, ভূগোল, রাজনীতিভিত্তিক অর্থনীতি, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ও ভূতত্ত্বের বিধানগুলি যখন পূর্ববর্তী ইতিহাসের মূল ধারণাগুলিরই সরাসরি বিরোধিতা করে, তখনো ইতিহাসের নতুন ধারার পাশাপাশি পুরোনো ধারার অনুসরণও সমানভাবেই চলতে থাকে।
প্রাকৃতিক দর্শনে প্রাচীন ধারা ও নব্যধারার এই সংঘর্ষ দীর্ঘদিন ধরে বেশ জোরালোভাবেই চলতে লাগল। প্রাচীন ধারার পক্ষ সমর্থন করে ধর্মতত্ত্ব নব্যধারাকে আঘাত করল। কিন্তু সত্যই যখন জয়লাভ করল তখন ধর্মতত্ত্ব নতুন ভিত্তিভূমির উপরেই আসর জাঁকিয়ে বসল।
ইতিহাসের প্রাচীন ও নব্যধারার মধ্যেও সেই একই তীব্র, দীর্ঘ সংঘর্ষ আজো চলেছে, আজো ধর্মতত্ত্ব প্রাচীন ধারাকে সমর্থন করে নব্যধারাকে আঘাত করছে।
উভয়ক্ষেত্রেই ঘটছে চরম উত্তেজনা ও সত্যের অপমৃত্যু। একদিকে আছে ভীতি ও যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা হর্মরাজিকে হারাবার আশঙ্কা, আর অন্যদিকে আছে ধ্বংসের নেশা। প্রাকৃতিক দর্শনের ক্রমবর্ধমান সত্যের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করেছে তারা ভেসেছে, সে সত্যকে স্বীকার করার অর্থই ঈশ্বরে বিশ্বাস, সৌরজগতের সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাস, এবং সন্ন্যাসিনীর পুত্র জোসুয়ার অলৌকিক ঘটনাবলিতে বিশ্বাসের ধ্বংস। কোপার্নিকাস ও নিউটনের বিধানের সমর্থকদের, যেমন ভলতেয়ারের মনে হয়েছিল সে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিধানাবলি ধর্মকে ধ্বংস করেছে। তাই মাধ্যাকর্ষণ বিধানকে ধর্মবিরোধী অস্ত্ররূপে ব্যবহার করা হয়েছিল।
ঠিক অনুরূপভাবেই এখন মনে করা হচ্ছে যে আত্মা ও সৎ অসতের তত্ত্ব এবং তার উপর প্রতিষ্ঠিত সব রাষ্ট্র ও গির্জার ধারণাকে নষ্ট করবার, একমাত্র পথই হলে অনিবার্যতার বিধানকে মেনে নেয়া। ভলতেয়ারের মতোই আজকের দিনের অনিবার্যতা বিধানের অবাঞ্ছিত সমর্থকরা সেই বিধানকেই ধর্মের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে হাতে তুলে নিয়েছে, যদিও জ্যোতির্বিজ্ঞানে মাধ্যাকর্ষণ বিধানের মতোই ইতিহাসের ক্ষেত্রে অনিবার্যতা বিধানও সেই সব ভিত্তিভূমিকে ধ্বংস করার পরিবর্তে আরো শক্তিশালীই করে তুলেছে যার উপর গড়ে উঠেছে রাষ্ট্র ও গির্জার শাসনব্যবস্থা। সেদিন যেমন জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, আজো তেমনই ইতিহাসের ক্ষেত্রে, পরিদৃশ্যমান ঘটনাসমূহের মাপকাঠি হিসেবে একটি নিঃশর্ত কিছুকে স্বীকার করা বা না করারই গোটা মতো-পার্থক্যের ভিত্তিস্বরূপ। জ্যোতির্বিজ্ঞানে সেটা ছিল পৃথিবীর স্থাবরত্ব, আর ইতিহাসে সেটা হচ্ছে ব্যক্তির স্বাধীনতা-স্বাধীন ইচ্ছ।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে পৃথিবীর জঙ্গমত্বকে স্বীকার করায় বিপদ ছিল তার ফলে পৃথিবীর স্থাবরত্ব ও গ্রহ নক্ষত্রের জঙ্গমত্বের প্রত্যক্ষ অনুভূতিকে অস্বীকার করতে হত, তেমনই ইতিহাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্বকে স্থান, কাল ও কার্যকারণের অধীন করায় বিপদ হয়েছে, স্বীয় ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ অনুভূতির অস্বীকৃতি। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন নব্যধারায় বলা হয়েছিল, একথা সত্য যে পৃথিবীর জঙ্গমতাকে আমরা অনুভব করি না, কিন্তু তার স্থাবরতাকে স্বীকার করলে আমরা পৌঁছে যাই একটা স্ববিরোধিতায়, আর তার জঙ্গমত্বকে স্বীকার করলে আমরা পাই বিধান, তেমনই ইতিহাসের ক্ষেত্রে নব্যধারায় বলা হয়, এ কথা সত্য যে আমাদের পরনির্ভরতা সম্পর্কে আমরা সচেতন নই, কিন্তু ইচ্ছার স্বাধীনতাকে স্বীকার করলে আমরা পৌঁছে যাই একটা স্ববিরোধিতায়, আর বহির্জগতের উপর, স্থান, কাল ও কার্য কারণের উপর নির্ভরতাকে স্বীকার করলে আমরা পাই বিধান।
প্রথম ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়েছিল একটি অবাস্তব স্থাবরতাকে পরিহার করে একটি অননুভূত জঙ্গমতাকে স্বীকার করা, বর্তমান ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে প্রয়োজন হয়েছে এমন একটি স্বাধীনতাকে পরিহার করা যার কোনো অস্তিত্ব নেই, আর এমন একটি পরনির্ভরতাকে স্বীকার করা যার সম্পর্কে আমরা সচেতন নই।
[সমাপ্ত]