.
অধ্যায়-১০
সুতরাং বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের হ্রাসবৃদ্ধি, এবং কার্যকারণ শৃখলের উপর নির্ভরতার হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গেই স্বাধীনতা ও অনিবার্যতা সম্পর্কে আমাদের ধারণার হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটে থাকে। ফলে এমন কোনো মানুষকে নিয়ে যদি আমরা আলোচনা করি যার সঙ্গে বহির্জগতের যোগাযোগটা আমাদের ভালোভাবে জানা, যার কাজ ও তার বিচারের মধ্যেকার সময়ের ব্যবধানটা অনেক বেশি এবং যেখানে কাজটার কারণ সম্পর্কে আমরা খুবই অবহিত, সে-ক্ষেত্রে আমরা পাই সর্বোচ্চ অনিবার্যতা ও নিম্ন স্বাধীনতার ধারণা। বাইরের পরিবেশের উপর যে মানুষের নির্ভরতা খুবই কম, যার কাজ সংঘটিত হয়েছে খুবই সম্প্রতিকালে, এবং যার কাজের কারণ জানাটা আমাদের সাধ্যের অতীত, সেক্ষেত্রে আমরা পাই সর্বনিম্ন অনিবার্যতা ও সর্বোচ্চ স্বাধীনতার ধারণা।
অবশ্য এ দুয়ের কোনোক্ষেত্রেই পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা পূর্ণ অনিবার্যতার ধারণা আমরা পাই না।
অনিবার্যতা নিয়মের সম্পূর্ণ অধীন এবং কোনোরকম স্বাধীনতাবিহীন একটি মানুয়ের কাজের কথা কল্পনা করতে হলে আমাদের অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে অসীমসংখ্যক স্থানসম্পর্কে, অসীম দীর্ঘকাল এবং অসীম কার্যশৃঙ্খলের জ্ঞান আমাদের আছে।
আবার সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং অনিবার্যতা নিয়মের অধীন নয় এরকম একটি মানুষকে কল্পনা করতে হলে আমাদের কল্পনা করে নিতে হবে যে স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে সে সম্পূর্ণ একা এবং কার্যের উপর নির্ভরতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যা আমাদের জানা তাকে বলি অনিবার্যতা নিয়ম, আর যেটা আমাদের কাছে অজ্ঞাত তাকে বলি জীবনশক্তি। জীবনের মূল কথা যতটা জানি তার বাইরে অজ্ঞাত অবশিষ্টাংশ যা থাকে তাকেই ভাষায় বলা হয় জীবনশক্তি। সে-রকম ইতিহাসের ক্ষেত্রেও যা আমাদের জানা তাকে বলি অনিবার্যতা নিয়ম, যেটা অজ্ঞাত তাকে বলি স্বাধীন ইচ্ছা। মানবজীবনের নিয়ম সম্পর্কে যতটা আমাদের জানা তার বাইরে অজ্ঞাত অবশিষ্টাংশ যা থাকে ইতিহাসের দিক থেকে তাকে ভাষায় বলা হয় স্বাধীন ইচ্ছা।
.
অধ্যায়-১১
কালানুগ বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ এবং কারণের উপর নির্ভরশীল মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার প্রকাশকেই ইতিহাস পরীক্ষা করে দেখে, অর্থাৎ বুদ্ধির বিধানের দ্বারা ইতিহাস এই স্বাধীন ইচ্ছার সংজ্ঞা নিরূপণ করে, আর সেই কারণেই ইতিহাস একটি বিজ্ঞান। একটি স্বাধীন শক্তি সৌরজাগতিক বস্তুসমূহকে পরিচালিত করে–একথা স্বীকার করা জ্যোতির্বিজ্ঞানের পক্ষে যতটা প্রয়োজন, মানুয়ের স্বাধীন ইচ্ছা ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রভাবিত করে এ-কথা স্বীকার করাও ইতিহাসের দিক থেকে ততটাই প্রয়োজন। আবার এটাকে সত্য বলে ধরে নিলে বিধানের অস্তিত্ব অর্থাৎ যে-কোনো বিজ্ঞানের সম্ভবনাকেই তো অস্বীকার করতে হয়। একটি মাত্র বস্তুও যদি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে তাহলে তো কেপলার ও নিউটনের বিধানসমূহকেই গড়ে তোলা সম্ভব নয়। একটি মাত্র কার্যও যদি স্বাধীন ইচ্ছায় পরিচালিত হয় তাহলে তো কোনো ঐতিহাসিক বিধানেরই অস্তিত্ব থাকে না, সজ্ঞস হয় না কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে একটি ধারণা গড়ে তোলা।
ইতিহাসের বিচারে মানুষের ইচ্ছা চলে একটি রেখা ধরে–সে রেখার একপ্রান্ত থাকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঢাকা, আর অন্যপ্রান্তে মানুষের ইচ্ছার একটা চেতনা স্থান, কাল ও কার্য-কারণের শৃঙ্খলের মধ্যে কাজ করে চলে। এই কর্মক্ষেত্রটি যত বেশি আমাদের চোখের সামনে প্রসারিত হয়, ততই তার বিধানাবলি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। এ-সব বিধানকে আবিষ্কার করা ও তাদের সংজ্ঞা নিরূপণ করাই ইতিহাসের সমস্যা। এই বিধানের সন্ধান দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। এ কাজে ইতিহাসের পুরোনো পদ্ধতি যেভাবে কাজ করে চলেছে তারই পাশাপাশি চলেছে তার নতুন পদ্ধতি গড়ে তোলার কাজ।
সব মানবিক বিজ্ঞান এই পথেই এগিয়ে চলেছে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পৌঁছে গণিতশাস্ত্র বিশ্লেষণের পথকে পরিহার করে অতি সূক্ষ্ম, অজ্ঞাত বস্তুর সমন্বয়ের পথে পা রেখেছে। কার্য-কারণের তত্ত্বকে পরিহার করে গণিতশাস্ত্র বিধানের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করেছে। অন্যভাবে হলেও চিন্তার এই একই পথ ধরে এগিয়ে চলেছে অন্য সব বিজ্ঞান। নিউটন যখন মাধ্যাকর্ষণ বিধানের সংজ্ঞা দিল তখন সে একথা বলল না যে সূর্য বা পৃথিবীর আকর্ষণের শক্তি আছে, সে বলল, বৃহত্তম থেকে ক্ষুদ্রতম প্রতিটি বস্তুই পরস্পরকে আকর্ষণ করে।
প্রকৃতিবিজ্ঞানসমূহও সেই একই কাজ করে : কারণের প্রশ্নকে পরিহার করে তারা সকলেই বিধানের সন্ধানে ফেরে। ইতিহাসও সেই একই পথের পথিক। ব্যক্তিবিশেষের জীবনের ঘটনার বিবরণ না হয়ে ইতিহাসের বিষয়বস্তু যদি হয় জাতিসমূহ ও মানুষের গতিকে জানা, তাহলে কার্য-কারণের তত্ত্বক একপাশে সরিয়ে রেখে ইতিহাসকেও খুঁজে ফিরতে হবে স্বাধীন ইচ্ছার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশসমূহকে নিয়ন্ত্রণকারী বিধানকে।
.
অধ্যায়-১২
কোপারনিকাসের বিধান আবিষ্কৃত ও প্রমাণিত হবার পর থেকে সূর্যের বদলে পৃথিবীটা ঘোরে এই সত্যের স্বীকৃতিই প্রাচীন মানুষের বিশ্বতত্ত্বকে ধ্বংস করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। সে বিধানকে অপ্রমাণ করতে পারলে হয় তো গ্রহ উপগ্রহের গতির পুরোনো ধারণাকে অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হত, কিন্তু সেটাকে অপ্রমাণ না করে টোলোমির বিশ্বতত্ত্বে বিশ্বাস রাখা ছিল একান্তই অসম্ভব। তবু কোপার্নিকাসের বিধান আবিষ্কৃত হবার পরেও অনেককাল পর্যন্ত টোলোমিয় বিশ্বতত্ত্বের পঠন পাঠন চলেছিল। যেসময় একটিমাত্র মানুষ প্রমাণ করে দিল যে জন্ম ও অপরাধের সংখ্যা গাণিতিক বিধানের অধীন, এবং রাষ্ট্রের স্বরূপ নির্ধারিত হয় কতকগুলি ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার দ্বারা, এবং জমির সঙ্গে মানুষের কতকগুলি সম্পর্কের ফলেই মানুষ এক দেশ থেকে দেশান্তরে পাড়ি জমায়, তখন থেকেই সে-সব তত্ত্বের উপর গড়ে তোলা ইতিহাসের মূল ভিত্তিই ধ্বংস হয়ে গেল।