আমাদের চৈতন্যের এই জবাব বুদ্ধির অধিন নয়। স্বাধীনতার এই অভ্রান্ত ও অখণ্ডনীয় চেতনা পরীক্ষা ও যুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, ব্যতিক্রমবিহীনভাব সব চিন্তাশীল লোকই এটাকে স্বীকার করে, সব মানুষই অনুভব করে, এই চেতনা ছাড়া মানুষের কোনো ধারণাই সম্ভব নয়। মানুষ এক সর্বশক্তিমান, সর্বকল্যাণময় ও সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের সৃষ্টি। মানুষের স্বাধীনতার চেতনা থেকে অদ্ভুত যে পাপের ধারণা সেটা কী? এটাই ধর্মশাস্ত্রের প্রশ্ন।
সেই একই উৎস থেকে উদ্ভূত আর একটি প্রশ্ন, সমাজে মানুষের দায়িত্ব কী? এটা আইনের প্রশ্ন।
সহজাত চরিত্র এবং উদ্দেশ্যের প্রতিক্রিয়ার ফলে মানুষ কাজ করে। স্বাধীনতার চেতনা থেকে উদ্ভূত ন্যায় অন্যায়ের জ্ঞান কী, বিবেক কী? এটা নীতিশাস্ত্রের প্রশ্ন।
জাতি হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে তার অতীত জীবনকে কীভাবে দেখা হবে-স্বাধীন সত্তা হিসেবে, না পূর্বনির্ধারিত কর্মের অধিকারী রূপে? এটা ইতিহাসের প্রশ্ন।
.
অধ্যায়-৯
ইচ্ছার স্বাধীনতা অথবা অনিবার্যতার সমাধানের ব্যাপারে জ্ঞানের অন্য সব শাখার তুলনায় ইতিহাসের কিছুটা সুবিধা রয়েছে : ইতিহাসের ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার মূল কথার পরিবর্তে অতীতে তার প্রকাশকে নিয়েই আলোচনা করা হয়।
এ ব্যাপারে বিমূর্ত বিজ্ঞানের তুলনায় পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের যে ভুমিকা, অন্যসব বিজ্ঞানের তুলনায় ইতিহাসেরও সেই ভূমিকা।
ফলে ইচ্ছার স্বাধীনতা ও অনিবার্যতার মধ্যে বিরোধ ধর্মশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র এবং দর্শনশাস্ত্রের বেলায় যে সমাধানের অতীত রহস্য হয়ে দেখা দেয়, ইতিহাসের বেলায় তা হয় না। ইতিহাস পর্যালোচনা করে মানুষের সেই জীবনকে যেখানে এই দুটি পরস্পরবিরোধী ধারা আগে থেকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে। যদিও জীবনের বাস্তবক্ষেত্রে প্রতিটি ঘটনা অংশত স্বাধীন এবং অংশত বাধ্যতামূলক হয়ে দেখা দেয়, তবু প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনা, মানুষের প্রতিটি কাজকেই সেই বিরোধিতা ছাড়াই স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা যায়। স্বাধীনতা ও অনিবার্যতা মিলিত হতে পারে, এ দুটি ধারণার মূল কথাই বা কী, সে সমস্যার সমাধান করতে হলে ইতিহাস বিজ্ঞানকে অন্য সব বিজ্ঞানের চাইতে একটা আলাদা পথ ধরতে হবে। অনেক মানুষের অথবা মানুষ বিশেষের কোনো কাজের বিচার যখন করতে বসি তখন আমরা সব সময়ই সেটাকে দেখি অংশত মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা এবং অংশত অনিবার্যতা নিয়মের ফলরূপে। মানুষের দেশান্তরে গমন এবং মানুষের আক্রমণ, অথবা তৃতীয় নেপোলিয়নের নানা বিধান, অথবা একঘণ্টা আগে বেড়াতে বেরিয়ে একজন লোকের কোনো একটা পথকে বেছে নেয়ার কথাই বলি না কেন কোথাও কোনো স্ববিরোধিতার কথা আমাদের মনে আসে না। এসব কাজের মধ্যে কতটা স্বাধীনতা থাকে, আর কতটা থাকে অনিবার্যতা তা আমাদের কাছে খুবই পরিষ্কার। যে দৃষ্টিকোণ থেকে একটা কাজকে বিচার করা হয় তদনুসারেই স্বাধীনতা ও অনিবার্যতা আনুপাতিক হারের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে, তবে সেটা সবসময়ই ঘটে বিপরীতক্রম অনুসারে।
ধর্ম, মানুষের সাধারণ জ্ঞান, আইনশাস্ত্র, এবং ইতিহাস–সকলেই স্বাধীনতা ও অনিবার্যতার এই সম্পর্ককে একভাবেই বোঝে। সকলক্ষেত্রেই স্বাধীনতা ও অনিকবার্যতার এই হ্রাস-বৃদ্ধি তিনটি শর্তের উপর নির্ভর করে :
১. কাজটি যে করে বাইরের জগতের সঙ্গে সেই মানুষটির সম্পর্ক।
২. কালের সঙ্গে তার সম্পর্ক।
৩. সেই কাজের কারণের সঙ্গে তার সম্পর্ক।
১. মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের তুলনায় যে মানুষটি জলে ডুবে যাচ্ছে তার ক্ষেত্রে অবশ্যই কাজের স্বাধীনতার তুলনায় অনিকবার্যতার পরিমাণ অনেক বেশি। অনুরূপভাবেই যে মানুষ নির্জনে একাকী বাস করে তার তুলনায় যারা ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে বাস করে, অথবা যারা পারিবারিক, কর্মস্থলঘটিত, বা ব্যবসাঘটিত দায়িত্ব দ্বারা আবদ্ধ, তাদের কাজে অবশ্যই স্বাধীনতা কম, অনিকবার্যতাই বেশি।
২. দ্বিতীয় বিবেচনার বিষয় সময়ের পরিবেশ। এই বিচারেই আজকের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ মানুষের তুলনায় প্রথম আদিম মানুষের পতনের ক্ষেত্রে তার স্বাধীনতা ছিল অনেক কম। সেই একই কারণে যেসব মানুষ কয়েক শতাব্দী আগে বাস করত তাদের জীবনযাত্রায় ও কাজে তারা ছিল সাম্প্রতিককালের মানুষের জীবনযাত্রার তুলনায় অনেক কম স্বাধীন।
৩. বিবেচনার তৃতীয় বিষয়টি হলে : কার্য-কারণের যে সীমাহীন শৃঙ্খলের মধ্যে প্রতিটি ঘটনা বিধৃত তার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত। সেই কার্যকারণ শৃঙ্খলার নিয়মে মানুষের প্রতিটি কাজ পূর্ববর্তী ঘটনার ফলস্বরূপ তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তী ঘটনার কারণস্বরূপ।
শারীরবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও ইতিহাসের বিধানগুলির সঙ্গে আমাদের পরিচয় যত বেশি হবে, আলোচ্য কাজটি যত সরল হবে, এবং কর্তার চরিত্র ও মানসিক গঠনের জটিলতা যত কম হবে, তত আমাদের কাজের এবং অন্য সকলের কাজের অনিবার্যতা বৃদ্ধি পাবে আর স্বাধীনতা হ্রাস পাবে।
এই তিনটি শর্তের উপরই মানুষের অপরাধের দায়িত্ব এবং ক্ষমার প্রশাসন নির্ভর করে। যে লোকের কাজের বিচার করা হয় তার পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের হ্রাস-বৃদ্ধি, কাজটি করা এবং সে বিষয়ে তদন্তের মধ্যে সময়ের হ্রাস-বৃদ্ধি, এবং সেই কাজের কারণ-শৃঙ্খলার জ্ঞানের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে।