ঐতিহাসিক ব্যাক্তিদের যে সব ইচ্ছার প্রকাশ ঘটনাবলীর সঙ্গে আদেশরূপে সম্পর্কিত সেগুলিকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে ইতিহাসকাররা ধরে নিয়েছে যে ঘটনাগুলি ঐসব হুকুমের উপরেই নির্ভরশীল। কিন্তু ঘটনাবলী এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচার করে আমরা দেখেছি যে সেই সব ব্যক্তি ও তাদের আদেশই ঘটনার উপর নির্ভরশীল।
এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে আমরা ইতিহাসের দুটি মূল প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিতে পারি :
(১) ক্ষমতা কি? (২) কোন শক্তি জাতিসমূহকে পরিচালিত করে?
(১) ক্ষমতা হচ্ছে কোনো বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে অন্যদের এমন একটা সম্পর্ক যার ফলে সেই লোক কোনো সম্মিলিত কাজের ক্ষেত্রে যত বেশি মতাতম, ভবিষ্যদ্বাণী ও সমর্থন প্রকাশ করে সেই অনুপাতে কম অংশ নেয় সেই কাজে।
(২) জাতিসমূহ পরিচালিত হয় ক্ষমতার দ্বারা নয়, বুদ্ধিহত কাজের দ্বারা নয়, বা দুইয়ের যোগফলের দ্বারাও নয় (যদিও ইতিহাসকাররা তাই মনে করে), তাদের পরিচালিত করে সেই সমগ্র জনগণের কর্মধারা যারা এমনভাবে একত্র হয় যে যারা সেই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে সবচাইতে বেশি অংশ নেয় তারাই নিজেদের মাথায় বহন করে সবচাইতে কম দায়িত্ব এবং বিপরীতক্রম।
নীতিগতভাবে ঘটনাকে ঘটায় তারা যাদের করায়ত্ত ক্ষমতা : কিন্তু যেহেতু দৈহিক শক্তির দিক থেকে ঘটায় তার যারা সেই ক্ষমতাকে মেনে চলে। কিন্তু যেহেতু দৈহিক কর্ম ছাড়া নৈতিক কর্ম অচিন্ত্যনীয়, তাই কোনো ঘটনার কারণ এ দুইয়ের কোনোরটাই নয়, প্রকৃত কারণ এই দুই শক্তির মিলন। অথবা অন্য কথায়, যে ঘটনার বিচার আমরা করছি তার ক্ষেত্রে কারণের ধারণাটাই প্রযোজ্য নয়। শেষপর্যন্ত আমরা একটা অন্তহীন চক্রে পৌঁছে। যাই। বিদ্যুৎ তাপ সৃষ্টি করে, আকার তাপ বিদ্যুৎ সৃষ্টি করে। পরমাণু পরস্পরকে আকর্ষণ করে, আর বিকর্ষণও করে। তাপ ও বিদ্যুতের এবং পরমাণুর পারম্পরিক প্রতিক্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে আমরা বলতে পারি না এটা কেন ঘটে, আমরা বলি যে এই ঘটে কারণ অন্যকিছু ভাবাই যায় না, কারণ এটাই হতে বাধ্য, আর এটাই নিয়ম। ঐতিহাসিক ঘটনার বেলায়ও এই কথাই প্রযোজ্য। যুদ্ধ এবং বিপ্লব কেন ঘটে আমরা জানি না। শুধু জানি, যে কোনো একটা কাজ করতে হলে মানুষ এমনভাবে নিজেদের গড়ে তোলে যেখানে সকলেই অংশ নিতে পারে, আর আমরা বলি, এটা এইরকমই হয়, কারণ অন্য কিছু ভাবাই যায় না, অথবা অন্য কথায়, এটাই নিয়ম।
.
অধ্যায়-৮
যদি বাইরের ঘটনা নিয়ে ইতিহাসের কারবার হত তাহলে এই সরল ও সহজ নিয়ম প্রতিষ্ঠা করাই যতেষ্ট হত, এবং আমাদের যুক্তিতর্কেরও অবসান ঘটত। কিন্তু ইতিহাসের নিয়ম মানুষকে নিয়ে। একটি পরমাণু বলতে পারে না যে আকর্ষণ-বিকর্ষণের নিয়মকে সে অনুভব করে না, আর তাই সে নিয়মটা অসত্যম, কিন্তু ইতিহাসের বিষয় যে মানুষ পরিষ্কার বলে দেয় : আমি মুক্ত, স্বাধীন, কাজেই কোনো নিয়মের অধীন নই।
অঘোষিত হলেও মানুষের ইচ্ছাশক্তির এই সমস্যা ইতিহাসের প্রতিটি ধাপে অনুভূত হয়।
সব চিন্তাশীল ইতিহাসকারই নিজের অজ্ঞাতে এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। ইতিহাসের সব স্ব-বিরোধিতা ও অস্পষ্টতা, ইতিহাস-বিজ্ঞানের সব ভ্রান্ত পদক্ষেপের মূলেই রয়েছে এই সমস্যা সমাধানের অভাব।
প্রতিটি মানুষের যদি ইচ্ছার স্বাধীনতা, অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ যদি নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতে পারত, তাহলে তো সব ইতিহাসই হয়ে যেত অসংলগ্ন আকস্মিক ঘটনার একটি শ্রেণীমাত্র।
হাজার বছরের মধ্যে যদি দশ লক্ষের মধ্যে একটি মানুষও স্বাধীনভাবে অর্থাৎ নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতে পারত, তাহলে তো মানবজাতির কাজকর্ম সংক্রান্ত নিয়মকে লঙ্ঘন করে সেই মানুষের একটি মাত্র কাজই সমগ্র মানবজাতির উপর প্রযোজ্য সেই নিয়মের অস্তিত্বকেই অসম্ভব করে তুলত।
মানুষের সব কর্মের বিধায়ক হিসেবে যদি একটিমাত্র নিয়ম থাকে তাহলে তো স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছুই থাকতেই পারে না, কারণ মানুষের ইচ্ছার বহু প্রাচীন সমস্যটির মূলেই আছে এই স্ব-বিরোধিতা।
সমস্যাটা হচ্ছে : ধার্মিক, ঐতিহাসিক, নৈতিক বা দার্শনিক–যে দৃষ্টিকোণ থেকেই মানুষকে দেখি না কেন, সর্বত্রই দেখতে পাই এমন একটি বাধ্যতামূলক নিয়ম–অন্য সবকিছুর মতোই মানুষও যার অধীন, কিন্তু অন্তরের ভিতর থেকে যখন তাকে দেখি তখনই বুঝি যে আমরা মুক্ত, স্বাধীন। এই বোধ থেকেই নিজেকে জানার সূত্রপাত, সে জানা বুদ্ধিবহির্ভূত, এমনকি বুদ্ধি নিরপেক্ষ। বুদ্ধি দিয়ে মানুষ নিজেকে দেখে, আর বোধি দিয়ে মানুষ নিজেকে জানে। এই আত-জ্ঞান ছাড়া কোনো দেখা বা বুদ্ধির প্রয়োগের কথা চিন্তা করাই যায় না। কোনো কিছু বুঝতে হলে, দেখতে হলে, তা থেকে সিদ্ধান্ত টানতে হলে প্রথমেই মানুষকে জীবিত প্রাণী হিসেবে নিজেকে বুঝতে হবে। সে যে ইচ্ছা করতে পারে, নিজের ইচ্ছা-শক্তি সম্পর্কে সে যে সচেতন, একমাত্র এই বোধ দ্বারাই সে নিজেকে জীবিত প্রাণীরূপে জানতে পারে। যে ইচ্ছা তার জীবনের মূলকথা তাকে মানুষ স্বাধীন বলেই জানে। তুমি বলতে পার : আমি স্বাধীন নই। কিন্তু এই তো আমি আমার হাতটা তুললাম, আবার নামিয়ে নিলাম। সকলেই বোঝে যে এই যুক্তিবিহীন জবাব ইচ্ছার স্বাধীনতার পক্ষে একটি অখণ্ডনীয় প্রমাণ।