.
অধ্যায়-৬
সময়ের অধীন নয় বলে একমাত্র দেবতার ইচ্ছার প্রকাশই বহু বর্ষ বা শতাব্দীব্যাপী ঘটনা-শৃঙ্খলের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে, একমাত্র দেবতাই পারে তার ইচ্ছার দ্বারা মানুষের অগ্রগতির দিক-নির্দেশ করতে, কিন্তু মানুষ কালের অধীন, আর যা-কিছু ঘটে তাতে সে নিজেই অংশগ্রহণ করে।
প্রথম শর্ত অর্থাৎ কালের কথা বলতে গিয়ে আমরা দেখি, কিছু পূর্বঘোষিত আদেশ ছাড়া কোনো আদেশই কার্যকর করা যায় না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমরা যখন বলি যে নেপোলিয়ন তার সৈন্যদের যুদ্ধে যাবার আদেশ দিয়েছিল, তখন সেই একটি হুকুমের মধ্যে পর পর অনেকগুলি আদেশকে একত্রিত করে থাকি। নেপোলিয়ন একদিনেই রাশিয়া অভিযানের আদেশ দেয়া না, তা দিতে পারে না। আজ হয়তে আদেশ করেছে ভিয়েনা, বার্লিন ও পিটার্সবুর্গে অমুক-অমুক চিঠি লেখা হোক, কাল অমুক-অমুক হুঁকাম ও নির্দেশ জারি করেছে স্থলবাহিনীকে, নৌবহরকে, কমিসারিয়েটকে, ইত্যাদি ইত্যাদি–লক্ষ লক্ষ হুকুমের এক আনুপূর্বিক শৃঙ্খলের ফলে ফরাসি বাহিনী রাশিয়াতে ঢুকেছে।
নেপোলিয়ন তার সমগ্র রাজত্বকালে ইংলেন্ড অভিযানে এত সময় ও প্রচেষ্টা ব্যয় করল না, অথচ পুরো রাজত্বকালে সে পরিকল্পনাকে কখনো কার্যকর না করে বাস্তব ক্ষেত্রে রাশিয়াতে অভিযান শুরু করল-তার কারণ প্রথম ক্ষেত্রে তার আদেশগুলি বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মিলল না, কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মিলে গেল।
কোনো আদেশকে নিশ্চিতরূপে কার্যকর করতে হলে সেটা এমন হওয়া চাই যাকে কার্যকর করা সম্ভব। কিন্তু কোনটাকে কার্যকর করা যাবে আর কোনটাবে যাবে না সেটা জানা তো অসম্ভব, লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিয়ে নেপোলিয়সের রামিয়া অভিযানের ক্ষেত্রেই যে একথা সত্য শুধু তাই নয়, সরলতম ঘটনার ক্ষেত্রেও তাই, কারণ উভয়ক্ষেত্রেই লক্ষ লক্ষ বাধা এসে তাকে কার্যকর করার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিটি কার্যকর আদেশ অকার্যকর অনেক হুকুমের মধ্যে একটিমাত্র। ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন সব অসম্ভব আদেশই অকার্যকর থেকে যায়। মাত্র স্বল্পসংখ্যক সম্ভবপর আদেশই কার্যে রূপায়িত হয়।
বস্তৃত, যারা আদেশ করে যারা আদেশ তামিল করে তাদের সম্পর্কটাই ক্ষমতা নামক ধারণার মূল কথা।
আমরা দেখেছি, কোনো আদেশ একমাত্র তখনই কার্যকর হয় যখন একটি ঘটনা-শৃঙ্খলের সঙ্গে সেটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এই মূল যোগসূত্র থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে যারা আদেশ করে আসল কাজে তারাই অংশ নেয় সব চাইতে কম, তাদের কর্মপ্রচেষ্টা কেবলমাত্র আদেশ করার ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ থাকে।
.
অধ্যায়-৭
যখন কোনো ঘটনা ঘটতে থাকে তখন সে সম্পর্কে মানুষ তাদের মতামত ও মনোভাব ব্যাক্ত করে থাকে, আর যেহেতু অনেক মানুষের সম্মিলিত কাজের ফলেই ঘটণাগুলি ঘটে, কোনো না কোনো মত বা মনোভাব আংশিকভাবে হলেও পূর্ণ হয়েই থাকে। যখন ঘোষিত কোনো একটি অভিমত পূর্ণ হয় তখন সেটাকেই ঘটনার পূর্ববর্তী আদেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেক লোক একটা কাঠের গুঁড়িকে টানছে। কীভাবে কোথায় সেটাকে টেনে নেওয়া হবে সে সম্পর্কে নানা জনে নানা কথা বলছে। কাঠটাকে টেনে নেওয়া হয়ে গেলে যে কোনো একজনের কথামতোই সেকাজটা হয়েছে। তাহলে তার আদেশমতোই কাজটা সম্পন্ন হল। এখানেই আমরা পাই আদেশ ও ক্ষমতার প্রাথমিক রূপ।
একটা বৃহত্তর জনসমাবেশ যখন একই লক্ষ্যে একটা কাজ করে তখন তাদের মধ্যে এই মতভেদ আরো স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। জ্ঞাত বা অজ্ঞাত যে কারণেই হোক ফরাসিরা নিজেদের ডোবাতে ও খুন করতে শুরু করে দিল। সেই সঙ্গে লোকে এও বিশ্বাস করল যে ফ্রান্সের গৌরব ও ইংল্যান্ডের নিচতার অনেক বড় বড় বুলি আওড়াতে লাগল। ইতিহাস আমাদের বুঝিয়েছে যে এসব কথাই অর্থহীন ও পরস্পরবিরোধী, যেমন বিরোধ থাকে নিজের অদিকার রক্ষা ও মানুষকে হত্যার মধ্যে, এবং ইংল্যান্ডকে ছোট করা ও রাশিয়াতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করার মধ্যে।
প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়ালে একটি সহজ প্রশ্নই দেখা দেয় : এটা কেমন করে সম্ভব যে, লক্ষ লক্ষ মানুষ সম্মিলিতভাবে অপরাধ করে–যুদ্ধ করে, নরহত্যা করে, ইত্যাদি?
ইওরোপের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের বর্তমান জটিল ব্যবস্থার মধ্যে রাজা, মন্ত্রী, পার্লামেন্ট, অথবা সংবাদপত্রের বিধান, নির্দেশ, অথবা আদেশ ছাড়া কোনো ঘটনার কথা কি কল্পনা করা যায়? রাজনৈতিক ঐক্য, দেশাত্মবোধ, শক্তি-সাম্য, অথবা সভ্যতার দ্বারা সমর্থিত নয় এমন কোনো সম্মিলিত কর্ম-প্ৰয়াস কি থাকতে পারে? কাজেই প্রতিটি ঘটনা অনিবার্যভাবেই কোনো ঘোষিত ইচ্ছার সঙ্গে মিলে যায়, একজন বা বহুজনের ইচ্ছার ফলরূপে প্রতিভাত হয়। জাহাজ যেদিকেই চলুক না কেন যে ঢেউ ভেঙে সেটা অগ্রসর হয় তাকে তো সবসময় জাহাজের সামনেই দেখা যাবে। জাহাজের যাত্রীদের কাছে সেই ঢেউই তো একমাত্র প্রত্যক্ষ গতি। জাহাজ যখন একদিকে চলে তখন একই ঢেউ থাকে তার সামনে, আবার জাহাজের গতি যখন মাঝেমাঝেই পাল্টে যায় তখন সামনের ঢেউয়ের গতিও যায় পাল্টে।
যখনই যে ঘটনা ঘটে তখনই মনে হয় যে ঠিক ঐ ঘটনাটিই ছিল পূর্বদৃষ্ট ও আদেশমাফিক। জাহাজ যে দিকেই যাক জলস্রোত সফেন তরঙ্গে একদিকেই চলতে থাকে, দূর থেকে মনে হয় জলস্রোত যে নিজের বেগে চলছে তাই নয়, জাহাজের গতিও নির্ধারণ করছে।