ক্ষমতার উৎস যদি দৈহিক অথবা নৈতিক গুণাবলির মধ্যে না থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই অন্যত্র খুঁজতে হবে-খুঁজতে হবে ক্ষমতার অধিকারীর সঙ্গে জনগনের সম্পর্কের মধ্যে।
ক্ষমতা হচ্ছে জনগণের সেই সম্মিলিত ইচ্ছা যা ঘোষণার দ্বারা অথবা মৌন সম্মতির দ্বারা নির্বাচিত শাসকগণের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতা যদি শাসককে হস্তান্তরিত জনগনের সম্মিলিত ইচ্ছাই হয়, তাহলে পুগাচেভ কি জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধি ছিল? যদি তা না হয়, তাহলে প্রথম নেপোলিয়ন কেন তা হল? তৃতীয় নেপোলিয়ানকে যখন বোলনে বন্দী করা হল যাদের সে গ্রেপ্তার করেছিল?
যে রাজপ্রসাদের বিপ্লবে অনেক সময় মাত্র দুজন কি তিনজন লোক অংশ গ্রহন করে তার দ্বারাই কি একজন নতুন শাসকের হাতে জনগণের ইচ্ছকে হস্তান্তরিত করা হয়? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কি জনগণের ইচ্ছাকে বিজয়ীর হাতে তুলে দেওয়া হয়? ১৮০৮ সালে কি রাইন রাষ্ট্রসংঘের ইচ্ছাকে হস্তান্তর করা হয়েছিল নেপোলিয়নকে। ১৮০৯ সালে ফরাসিদের সঙ্গে যোগ-সাজসে আমাদের সেনাবাহিনী যখন অস্ট্রিয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করতি গিয়েছিল, তখন কি রীশ জনগণের ইচ্ছাকে সর্মপণ করা হয়েছিল নেপোলিয়নের হাতে?
এই সব প্রশ্নের তিনটি জবাব সম্ভব? হয় ধরে নিতে হয় (১) জনগণের ইচ্ছাকে সর্বদাই নিঃশর্তভাবে হস্তান্তর করা হয় পছন্দ-মতো শাসক বা শাসকদের হাত, সুতরাং প্রতিটি নতুন শক্তির আবির্ভাব, একদা ক্ষমতাসীন শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিটি সগ্রামই প্রকৃত ক্ষমতার বিরুদ্ধাচরণ বলে পরিগণিত হওয়া উচিত, অথবা (২) জনগণের ইচ্ছাকে হস্তান্তর করা হয় কতকগুলি নির্দিষ্ট ও পূর্বজ্ঞাত শর্ত অনুসারে, আর তাতেই প্রমাণ হয় যে ক্ষমতাকে খর্ব করা, তার বিরুদ্ধাচরণ করা, এমন কি তাকে ধ্বংস করা শাসকগণ কর্তৃক তাদের উপর আরোপিত শর্তাবলীকে উপেক্ষা করারই ফল, অথবা (৩) জনগণের ইচ্ছাকে শর্তসাপেক্ষে শাসকদের হাতে তুলে দেয়া হয় কিন্তু সে শর্তগুলি থাকে অজ্ঞাত ও অনির্দিষ্ট, আর শাসকগণ কর্তৃক সেইসব অজ্ঞাত শর্তাবলীকে কমবেশি পূরণ করার ফলেই আবির্ভূত হয় বিভিন্ন শক্তি, দেখা দেয় তাদের সংঘর্ষ ও পতন।
আর এই তিন পথেই ইতিহাসকাররা শাসকদের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে থাকে। অবশ্য তাদের মধ্যেও মত পার্থক্যের অভাব নেই। একেক দল একেকভাবে সেই সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে। সেই সবরকম ইতিহাসকে যদি একসূত্রে বাঁধা যায়, নতুনতম ইতিহাসকাররা তাই করে থাকে, তাহলে আমরা পাব রাজা-রাজড়া ও লেখকদের ইতিহাস, জনগণের জীবনের ইতিহাস নয়।
.
অধ্যায়-৫
একটা জাতির জীবন অল্প কয়েকটি মানুষের জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, কারণ ওইসব মানুষ ও জাতির মধ্যে যোগসূত্রটা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।
জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা কয়েকটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসক ব্যাক্তিত্বের হাতে হস্তান্তরই সেই যোগসূত্রের ভিত্তি-এ মতবাদ ইতিহাসের কষ্টিপাথিরে সমর্থিত হয়নি। অবশ্য এই মতবাদকে অখণ্ডনীয় মনে হয় কারণ জনগণের ইচ্ছায় হস্তান্তরের ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখা যায়নি, কারণ সেটা কখনো ঘটেনি। যাই ঘটুক না কেন এবং যে লোকই পুরোভাগে এসে দাঁড়াক না কেন, এই মতবাদ সবসময়ই বলতে পারে যে অমুক লোক নেতৃত্বে এসেছে কারণ সম্মিলিত ইচ্ছাকে তার হাতেই তুলে দেয়া হয়েছিল। ঐতিহাসিক প্রশ্নাবলির যে উত্তর এই মতবাদ দিয়ে থাকে সেটা সেই লোকের উত্তরেরই অনুরূপ যে গোচারণ ক্ষেত্রের বিভিন্ন অংশের গুণাগুণ অথবা চালকের মনোগত ইচ্ছার দিকে নজর না দিয়ে একদল গরু-মোষের গতি-পথ লক্ষ করেই বলে দেয় যে-জন্তুটি সকলের পুরোভাগে আছে সে যেদিকে যাব পুরো দলই যাবে সেদিকে।
পুনরাবর্তী জন্তুটি যেপথে চলে গোটা দল সেই পথেই যায়, অন্য জন্তুগুলির সম্মিলিত ইচ্ছা দলনেতার উপরেই অর্পিত হয়। এই হল এক শ্রেণীর ইতিহাসকারের অভিমত। আসলে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের হাতে জনগণের ইচ্ছাকে সমর্পণের মতটা কথার মারপ্যাঁচ মাত্র- প্রশ্নটাকেই অন্য কথায় ঘুরিয়ে বলা হয়। ঐতিহাসিক ঘটনাগুলিকে কে ঘটায়? ক্ষমতা। ক্ষমতা কাকে বলে? একজনের হাতে ন্যস্ত জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছাই ক্ষমতা। কোন শর্তে জনগণের ইচ্ছাকে একজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়? একমাত্র শর্ত হল, সেই মানুষটি জনগণের ইচ্ছাকে প্রকাশ করবে। অর্থাৎ, ক্ষমতা মানেই ক্ষমতা : অন্য কথায়, ক্ষমতা এমন একটা শব্দ যায় অর্থ আমরা বুঝি না।
মানুষের ব্যাপারে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ স্বীকার না করে ক্ষমতাকে ঘটনার কারণ হিসেবে গণ্য করতে পারি না।
অভিজ্ঞতার দিকে থেকে দেখলে ক্ষমতা কোনো একজনের মনোবাসনার প্রকাশ এবং অন্যের দ্বারা সে বাসনা পূর্ণ করার মধ্যেকার সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়।
সে সম্পর্কের শর্তাবলিকে বোঝাতে হলে মানুষের পরিপ্রেক্ষিতে–দেবতার নয়–সেই বাসনা প্রকাশের ধারণাটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
দেবতা যদি কোনো আদেশ ঘোষণা করে প্রাচীন ইতিহাসের বর্ণনামতো তার ইচ্ছাকে প্রকাশ করে, তাহলে সে ইচ্ছার প্রকাশ হবে কালনিরপেক্ষ, কোনো কারণের দ্বারা সেটা ঘটবে না, কারণ দেবতাকে ঘটনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা যায় না। কিন্তু যে আদেশ মানুষের ইচ্ছার প্রকাশ, যা কালের অধীন এবং পরস্পর সম্পর্কিত-সেক্ষেত্রে ঘটনার সঙ্গে সেই আদেশের যোগসূত্রকে বোঝাতে হলে আমাদের নতুন করে জানতে হবে : (১) যা কিছু ঘটে তার শর্ত : ঘটনা এবং ঘোষণা প্রচারকারী উভয়কেই কালের অধীন হয়ে চলতে হয়, এবং (২) যে মানুষ আদেশ করে এবং যারা সে আদেশ তামিল করে তাদের যোগসূত্রের অনিবার্যতা।