.
অধ্যায়-৩
একটা ট্রেন চলেছে। একজন প্রশ্ন করল : এটাকে কে চালাচ্ছে? চাষী বলল, শয়তান চালাচ্ছে। আর একজন বলল, চাকাগুলো ঘুরছে বলেই গাড়িটা চলছে। তৃতীয় একজন বলল, বাতাসে যে ধোঁয়া উড়ছে সেটাই গাড়ির চলার কারণ। চাষীর কথা অকাট্য। তার ব্যাখ্যা পুর্ণাঙ্গ। তাকে খণ্ডন করতে হলে প্রমাণ করতে হবে যে শয়তান বলে কিছু নেই, অথবা অন্য চাষীকে বলতে হবে যে শয়তান নয় একজন জার্মান গাড়িটা চালাচ্ছে। একমাত্র তখনই স্ব-বিরোধিতার ফলে তারা বুঝতে পারবে যে তাদের দুজনেরই ভুল হয়েছে। একমাত্র সে ধারণার দ্বারা গাড়ির গতিকে ব্যাখ্যা করা যায় তা হচ্ছে গতির উপযুক্ত একটি শক্তির ধারণা।
একমাত্র জনগণের অভিযানের উপযুক্ত একটি শক্তির ধারণার দ্বারাই সে ঘটনার ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
অথচ সেই ধারণাটাকে তুলে ধরতে গিয়ে বিভিন্ন ইতিহাসকার এমন বিভিন্ন ধরণের শক্তির উল্লেখ করেছে যা অভিযারে পক্ষে উপযোগী নয়। কেউ সেটাকে দেখে নায়কের সহজাত শক্তির মধ্যে, ঠিক যেভাবে গাড়ির বেলায় চাষী দেখে শয়তানকে, কেউ বা সেটাকে দেখে নানা শক্তির সম্মিলনের মধ্যে, চাকর ঘূর্ণনের মতো, অন্যরা তাকে দেখে বুদ্ধিগত প্রভাবের মধ্যে, বায়ুতাড়িত ধোয়ার মতো। যতদিন পর্যন্ত লেখা হবে আলাদা আলাদা ইতিহাস, সিজার, আলেক্সান্দার, লুথার অথবা ভলতেয়ার, যারই হোক না কেন, যতদিন কোনো ঘটনার অংশগ্রহণকারী সব, সব মানুষের ইতিহাস লেখা হবে, ততদিন একটা শক্তিকে মেনে না নিলে মানুষের অগ্রগতির বর্ণনা করা অসম্ভব। আর ইতিহাসকারদের জানা একমাত্র ধারণাই তো সেই শক্তির ধারণা।
মানুষ সম্পর্কে বিচার করতে বসে এখনো পর্যন্ত ইতিহাসবিজ্ঞানের অবস্থা বাজার প্রচলিত অর্থ-নোট ও মুদ্রার মতো। জীবনীগ্রন্থ এবং বিশেষ জাতীয় ইতিহাস হচ্ছে নোটের মতো। যতদিন পর্যন্ত কেউ সে নোটের নিরাপত্তার প্রশ্ন না তুলছে ততদিন পর্যন্ত তাদের ব্যবহার করে চলে, কারো কোনো ক্ষতি না করে তাদের উদ্দেশ্যও সার্বিকভাবে সাধিত হতে পারে। নায়কদের ইচ্ছা কেমন করে ঘটায় সে প্রশ্ন যদি ভুলে যাওয়া যায় তাহলে থিয়ের্স লিখিত ইতিহাসের অনুরূপ সব ইতিহাসই হৃদয়গ্রাহী ও শিক্ষণীয় হতে পারে, এমন কি কিছুটা কাব্যের ছোঁয়াও তাতে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু নোট যখন অধিক সংখ্যায় ছাপা হয়, অথবা মানুষ যখন তার বিনিময়ে সোনা কিনতে চেষ্টা করে, তখনই যেমন নোটের প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে তখনই সন্দেহ দেখা দেয় যখন অনেক বেশি ইতিহাসের প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে তখনই সন্দেহ দেখা দেয়, তেমনই ওইসব ইতিহাসের বই লেখা হয়, অথবা সরল মনে যখন কেউ প্রশ্ন করে বসে; কোন শক্তি বলে নেপোলিয়ন একাজ করেছিল?–অর্থাৎ প্রচলিত নোটের বিনিময়ে কেউ যখন বোধ্যতার প্রকৃত সোনা অর্জন করতে চায়।
সার্বিক ইতিহাস ও সাস্কৃতিক ইতিহাসের লেখকরা হচ্ছে সেই সব লোকের মতো যারা নোটের ত্রুটিগুলো বুঝতে পেরে তার জায়গায় এমন ধাতু দিয়ে মুদ্রা তৈরি করতে চায় যাতে সোনার আপেক্ষিক গুরুত্ব অনুপস্থিত। তাতে মুদ্রার ঠুনঠুন আওয়াজ হতে পারে, কিন্তু তার বেশি কিছু কাজে আসবে না। নোট হয়তো নির্বোধ লোকদের ঠকাতে পারে, কিন্তু খারাপ ধাতুর যে মুদ্রার ঠুনঠুন শব্দ ছাড়া কোনো মূল্য নেই তা দিয়ে কাউকেই ঠকানো যায় না। সোনা যেমন একমাত্র তখনই সোনা যখন শুধু বিনিময়ের ক্ষেত্রে নয়, সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নির্ভরযোগ্য, তেমনই সার্বিক ইতিহাসকাররা একমাত্র তখনই মূল্যবান হয়ে উঠবে যখন তার ক্ষমতা কি?-ইতিহাসের এই মৌলিক প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে। সার্বিক ইতিহাসকাররা দেয় সে প্রশ্নের পরস্পরবিরোধী জবাব, আর সাংস্কৃতিক ইতিহাসকাররা প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গিয়ে জবাব দেয় অন্য কোনো প্রশ্নের। আর নকল সোনার বলে মেনে নেয় অথবা সোনা চেনেই না, তেমনই সার্বিক ইতিহাসকাররা, এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসকাররা,মানুষের মৌলিক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য, এবং যে সাধারণ পাঠকের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাঠে রুচি আছে তাদের মধ্যে কারেন্সি নোটের মতোই কাজ করে।
.
অধ্যায়-৪
একটি জাতির ইচ্ছাকে একজন নির্বাচিত মানুষের ইচ্ছাধীন করা এবং সেই মানুষটির ইচ্ছাকে দেবতার অধীন করার যে দৈব ব্যবস্থা প্রাচীনরা বিশ্বাস করত তাকে পরিত্যাগ করার ফলে স্ববিরোধিতাকে এড়িয়ে ইতিহাসের পক্ষে একটা পাও চলা সম্ভব নয় হস্তক্ষেপের প্রাচীন বিশ্বাসে ফিরে যাওয়া, আর না হয় যে শক্তি ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে ঘটায় এবং যাকে বলা হয় ক্ষমতা তার তাৎপর্যের একটা নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া।
প্রথমটাতে ফিরে যাওয়া অসম্ভব, কারণ সে বিশ্বাসকে ধ্বংস করা হয়েছে, কাজেই ক্ষমতা বলতে কি বোঝায় সেটা ব্যাখ্যা করা একান্তভাবে প্রয়োজন।
নেপোলিয়ন আদেশ দিল, একটা সেনাবাহিনী গড়ে তুলে যুদ্ধে যাও। একাজে আমরা এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে ছলক্ষ মানুষ কেন নেপোলিয়নের কথামতো যুদ্ধে গেল সে প্রশ্ন করাটাও আমাদের কাছে অর্থহীন মনে হয়। তার হাতে ক্ষমতা ছিল, তাই সে যা আদেশ করেছে তাই করা হয়েছে। যদি আমারা বিশ্বাস করি যে ঈশ্বরই তাকে ক্ষমতা দিয়েছিল তাহলে ব্যাখ্যাটা খুবই সন্তোষজনক হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে সেটা স্বীকার করা হল না তখনই একজস মানুষ অপরের উপর যে ক্ষমতা বিস্তার করে আসলে সেটা কি তা নির্ধারণ করাটা জরুরি হয়ে পড়ে। এটা দুর্বলের উপর সবলের দৈহিক শক্তি প্রয়োগের ব্যাপার হতে পারে না-হারকিউলিসের মতো দৈহিক শক্তির উপরেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, কারণ নেপোলিয়নের মতো যে সব নায়কের নৈতিক গুনাগুন সম্পর্কে যথেষ্ট মতভেদের অবকাশ আছে তাদের কথা ছেড়ে দিলেও ইতিহাসই আমাদের জানিয়েছে, যে একাদশ লুই অথবা মেটারনিক লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর শাসন ক্ষমতা চালিয়েছে তাদের কারো কোনো বিশেষ নৈতিক গুণ ছিল না, বরং সাধারণভাবে বলা যায়, যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে তারা শাসন করেছে তাদের যে কোনো একজনের তুলনায় তার ছিল নৈতিক দিক থেকে দুর্বলতর।