এটাকে ঐতিহাসিক বিবরণের প্রতি বিদ্রূপ–তার একটা হাস্যকর চিত্র বলে মনে করলে ভুল করা হবে। পরন্তু সেই যুগের বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্মৃতিকথার সংকলক ও ইতিহাসের লেখক থেকে আরম্ভ করে সাধারণ ইতিহাসের লেখক ও সংস্কৃতির নব ইতিহাসের লেখক পর্যন্ত এসব প্রশ্নের যেসব পরস্পরবিরোধী উত্তর দিয়েছে অথচ প্রশ্নের মীমাংশা করতে পারেনি তারই একটা অত্যন্ত বিবরণ এখানে দেয়া হল। এসব উত্তর এত অদ্ভুত ও অবাস্তব মনে হবার আসল কারণ, আধুনিক ইতিহাস বধির লোকের মতো এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে যা কেউ জিজ্ঞাসা করেনি।
মানবতার ও জনগনের অগ্রগতির বিবরণ দেওয়াই যদি ইতিহাসের উদ্দেশ্য হয় তাহলে তো প্রথম প্রশ্নই হচ্ছে কোন সে শক্তি যা জনগণকে পরিচালিত করে? এই প্রশ্নের উত্তরে আধুনিক ইতিহাস যত্ন সহকারে হয় বলেছে যে নেপোলিয়ন ছিল মস্ত প্রতিভা, অথবা যোড়শ লুই ছিল অহংকারী, অথবা কিছু লেখক কিছু বই লেখেছে।
এই সব সত্য হতে পারে, মানুষ সেটা মেনে নিতেও প্রস্তত, কিন্তু প্রশ্ন তো সেটা নয়। এইসব উল্লেখযোগ্য হত যদি আমরা এমন একটি স্বয়ম্ভু ঐশ্বরিক শক্তিকে স্বীকার করতাম যিনি নেপোলিয়ন, লুই ও লেখকদের মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহকে পরিচালিত করেন, কিন্তু আমরা তা স্বীকার করি না, আর তাই নেপোলিয়ন, লুই অথবা লেখকদের কথা বলার আগেই এসব লোকের সঙ্গে রাষ্ট্রসমূহের অগ্রগতি ও আন্দোলনের সম্পর্কটা আমাদের বুঝিয়ে দেয়া দরকার। ঐশ্বরিক শক্তির পরিবর্তে অন্য কোনো শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে, সে শক্তি কী দিয়ে গঠিত তা আমাদের বুঝিয়ে বলতে হবে, কারণ ইতিহাসের সমস্ত আকর্ষণই সেই শক্তিতে নিহিত। ইতিহাস যেন ধরেই নিয়েছে যে এই শক্তি স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনজ্ঞাত। কিন্তু এটাকে জানা বলে মনে করবার একান্ত ইচ্ছা স্বত্ত্বেও বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ পাঠের পরে এ সন্দেহ না জন্মাতে পারে না যে সত্যি সত্যি এটা সকলের জানা কি না।
.
অধ্যায়-২
কোন শক্তি জাতিসমূহকে পরিচালিত করে? জীবনীমূলক ইতিহাসকার এবং বিভিন্ন জাতির ইতিহাসকার এই শক্তিকে নায়ক ও শাসকদের জন্মগত শক্তি বলে মনে করে। তাদের বিবরণ অনুযায়ী সব ঘটনাই ঘটে নেপোলিয়ন, আলেক্সান্দার, বা অন্য কোনো ব্যক্তির ইচ্ছানুসারে। তাদের এ ধারণা সন্তোষজনক হতে পারত যদি প্রতিটি ঘটানার মাত্র একজন করে ইতিহাসকার থাকত। কিন্তু যে মুহূর্তে বিভিন্ন জাতি ও ভাবধারার ইতিহাসকার একই ঘটনার বিবরণ দিতে শুরু করে, তখনই তারা একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ে, কারণ এই শক্তিকে যে তারা শুধু ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বোঝে তা নয়, অনেক সময়ই বোঝে সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধীভাবে। এক ইতিহাসকার বলে ঘটনাটি ঘটিয়েছে নেপোলিয়নের শক্তি, আবার অন্যজন বলে ঘটিয়েছে আলেক্সান্দারের শক্তি, অন্য কেউ কোনো তৃতীয় ব্যক্তির নাম করে। তাছাড়া, একই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন শক্তির কথাও তাঁরা বলে। যেমন বোনাপার্তপন্থী থিয়ের্স বলে, নেপোলিয়নের গুণাবলি ও প্রতিভার ওপরেই তার শক্তি প্রতিষ্ঠিত। প্রজাতন্ত্রপন্থী লাফ্রে বলে, সে শক্তির ভিত্তি চালাকি ও জনগণকে প্রবঞ্চনা। সার্বিক ইতিহাসের সে সব লেখকের কারবার সব জাতিকে নিয়ে তারা তো বিশেষজ্ঞ ইতিহাসকারদের মতকে ভ্রান্ত বলেই মনে করে। তারা নায়ক বা শাসকদের কোনো জন্মগত শক্তিকে স্বীকারই করে না, তারা মনে করে, বিভিন্ন লক্ষ্যে পরিচালিত বহু শক্তির ফলই সেই শক্তি যা ঘটনাকে ঘটায়। একটি যুদ্ধ অথবা একটি জাতির অধীনতার বর্ণনা দিতে গিয়ে সাধারণ ইতিহাসকার তার কারণের অনুসন্ধান করে সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বহু মানুষের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্যে, কোনো একটি মানুষের শক্তির মধ্যে নয়। ১৮১৩-র অভিযান অথবা বুরবন-বংশের পুনঃ প্রতিষ্ঠার বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশেষজ্ঞ ইতিহাসকাররা স্পষ্টই বলে যে আলেক্সান্দারের ইচ্ছাই এইসব ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সার্বিক ইতিহাসকার জার্ভিনাস প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছে যে ওই দুটি ঘটনার পিছনে রয়েছে আলেক্সান্দারের ইচ্ছা ছাড়াও আরো অনেক কিছুযেমন স্তিন, ম্যাটার্নিক, মাদাম দ্য স্তায়েল, তালেরাদ, ফিকটে, চাতুব্রিয়াদ, ও অন্যদের কাজকর্ম। এইভাবে তাদের মধ্যে বিরোধিতা একান্তই স্পষ্ট। আর একটি তৃতীয় শ্রেণীর ইতিহাসকার আছে–তথাকথিত সংস্কৃতির ইতিহাসকার-যারা এই শক্তিকে একটা স্বতন্ত্র কিছু বলে মনে করে। এই শক্তির মধ্যে তারা আবিষ্কার করে সংস্কৃতিকে-মানসিক ক্রিয়াকলাপকে। তাদের মতে, কতগুলি ব্যক্তির আচরণের দ্বারা যদি ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, তাহলে অমুক-অমুক মানুষ অমুক-অমুক বই লিখেছে এই তথ্যের দ্বারা কেন তার ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে না? তাদের মতে, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পিছনেই তো কাজ করে মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তার ফসল। কিন্ত মানুষের বুদ্ধির সঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনাকে সংযুক্ত করার যত চেষ্টাই তারা করুক, সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা বোঝা খুব সহজসাধ্য নয়। ফরাসি বিপ্লবের নির্মম হত্যাকাণ্ড কি মানব-সাম্যের ফল হতে পারে? অথবা নিষ্ঠুর যুদ্ধ ও নরহত্যা মানুষকে ভালোবাসার ফল?
কিন্তু এইসব ইতিহাসকারের সুকৌশল যুক্তিকে মেনে নিলেও-ভাবধারা নামক কোনো অস্পষ্ট শক্তি জাতিকে পরিচালিত করে একথা মেনে নিলেও-ইতিহাসের মৌলিক প্রশ্নেও উত্তরটা তবু বাকি থেকেই যায়। পূর্বেকার দুটি শক্তি-নরপতিগণের ক্ষমতা এবং উপদেষ্টাও অন্য লোকের ক্ষমতার সঙ্গে আর একটা নতুন শক্তি-ভাবধারার শক্তি-যুক্ত হল মাত্র। নেপোলিয়নের ক্ষমতা ছিল, তাই ঘটনা ঘটেছিল, এটা বোঝা হয়তো সম্ভব, কিন্তু চেষ্টা করলে এটাও হয়তো বোঝা যায় যে নেপোলিয়ন ও অন্য কিছু শক্তি একত্র হয়ে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, কিন্ত Le Contract Social নামক একখানি বইয়ের প্রভাবে ফরাসিরা পরস্পরকে ডুবিয়ে মারতে শুরু করে দিল, বিনা ব্যাখ্যায় এটা বোঝা যায় না। কিন্তু এ ধরনের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গুণগুণ যাই হোক না কেন, আর একদিক থেকে সে ইতিহাস খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে নানা ধর্মীয়, দার্শনিক ও রাজনৈতিক মতবাদের চুল-চেরা বিচারের পরে যে মুহূর্তে তারা কোনো সত্যিকারের ঐতিহাসিক ঘটনা-যেমন ১৮১২ সালের অভিযানের বর্ণনা দিতে বসে তখনই তারা সেটা কোনো শক্তি প্রয়োগের ফল বলে বর্ণনা করে–পরিষ্কার বলে যে সে অভিযানটি নেপোলিয়নের ইচ্ছার ফলে ঘটেছে। আর সে কথা বলে সাংস্কৃতিক ইতিহাসকাররা অজান্তে নিজেদের মতেরই বিরোধিতা করে বসে, তারাই দেখিয়ে দেয়, যে নতুন শক্তি তারা উদ্ভাবন করেছে তা ইতিহাসের ঘটানাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না, ইতিহাসের ব্যাখ্যা একমাত্র সেই শক্তি দিয়েই করা যেতে পারে যাকে তারা স্বীকার করে না।