১৭৮৯-তে প্যারিসে একটা উত্তেজনা দেখা দিল : সেটা বেড়ে চলল, ছড়িয়ে পড়ল, এবং মানুষের পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে এগিয়ে চলার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করল। কয়েকবার সে গতি হল পূর্বমুখী, পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী একটা পাল্টা অগ্রগতির সঙ্গে তার সংঘর্ষ বাধল, ১৮১২-তে সেটা পৌঁছল চূড়ান্ত লক্ষ্য মস্কোতে, তারপর একটা অদ্ভুত মিল রেখে শুরু হল প্রত্যাঘাত, আর আগের মতোই মধ্য ইওরোপের জাতিগুলি তাতে যোগ দিল। প্রতি আন্দোলন প্রথম আন্দোলনের যাত্ৰাস্থল প্যারিসে পৌঁছে মিলিয়ে গেল। সেই বিশ বছরকালের মধ্যে অগণিত শস্যক্ষেত্রে চাষ-আবাদ হল না, অসংখ্য ঘর-বাড়ি পুড়ল, বাণিজ্যের গতি পরিবর্তিত হল, লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশ ছাড়ল, কেউ নিঃস্ব হল, প্রেমধর্মে বিশ্বাসী লক্ষ লক্ষ খৃস্টান পরস্পরকে হত্যা করল।
এসবের অর্থ কি? এসব কেন ঘটল? কিসের জন্য মানুষ ঘর পোড়াল, মানুষকে খুন করল? এসব ঘটনার কারণ কি? কোন শক্তি তাদের দিয়ে এসব করাল? সেই সময়কার স্মৃতিস্তম্ভ ও ঐতিহ্যর মুখোমুখি হয়ে মনে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে এই সব ন্যায্য প্রশ্নই তো উচ্চারিত হয়। এইসব প্রশ্নের জবাবের আশায় মানুষের সাধারণ বুদ্ধি তো ইতিহাসবিজ্ঞানের দিকেই চোখ ফেরায়, কারণ জাতি ও মানুষকে নিজেকে চিনতে শেখানোই তো ইতিহাসের লক্ষ্য।
ইতিহাস যদি প্রাচীনদের ধ্যান-ধারণাকে অক্ষুণ্ণ রাখত তাহলে সে বলত মানুষদের পুরস্কার বা শাস্তি দিতে ঈশ্বরই নেপোলিয়ানকে শক্তি দিয়েছেন, দৈব উদ্দেশ্যকে পূর্ণ করতে তার ইচ্ছাকে পরিচালিত করেছেন, সেক্ষেত্রে এই উত্তরই হত স্পষ্ট ও পূর্ণ। লোকে নেপোলিয়াসের দৈব তাৎপর্যে বিশ্বাস করতে পারে, নাও করতে পারে, কিন্তু যে বিশ্বাস করে তার কাছে তকালীন ইতিহাসের কোনো কিছুই দুর্বোধ্য ঠেকবে না, বা কোনো স্ব-বিরোধিতাও তার চোখে পড়বে না। কিন্তু আধুনিক ইতিহাস তো জবাব দিতে পারে না। মানুষের ব্যাপারে দেবতার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের প্রাচীন ধারণাকে বিজ্ঞান স্বীকার করতে পারে না, আর তাই ইতিহাসকে অন্য জবাব দিতে হয়।
এইসব প্রশ্নের জবাবে আধুনিক ইতিহাস বলে : তুমি জানতে চাও এই আন্দোলনের অর্থ কি, তার কারণ কি, আর কোন শক্তি এইসব ঘটনা ঘটিয়েছে। শোনো : ষোড়শো লুই ছিল অত্যন্ত অহংকারী ও আত্মবিশ্বাসী মানুষ, তার এই-এই রক্ষিতা ছিল, এই-এই মন্ত্রী ছিল, আর ফ্রান্স সে খুব খারাপভাবে শাসন করছিল। তার বংশধররাও ছিল দুর্বল মানুষ, আর খারাপ শাসনকর্তা। তাদেরও ছিল এই-এই প্রিয়পাত্র, আর এই-এই রক্ষিতা। তাছাড়া, কিছু লোক সেইসময় কিছু বই ও লিখেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্যারিসের প্রায় ডজন দুই লোক বলতে শুরু করল যে সব মানুষই স্বাধীন ও সমান। তার ফলেই সারা ফ্রান্স জুড়ে মানুষ একে অন্যকে হত্যা করল। সেই সময়ে ফ্রান্স জুড়ে মানুষ একে অন্যকে আঘাত করতে লাগল, ডুবিয়ে মারতে লাগল। তারা রাজাকে হত্যা করল, আরো অনেককে হত্যা করল। সেই সময়ে ফ্রান্সে একজন প্রতিভাধর মানুষ ছিল-নেপোলিয়ান। সে সর্বত্র সকলকে জয় করল–অর্থাৎ সে অনেক মানুষ মারল, কারণ সে ছিল একটি মহৎ প্রতিভা। যে কারণেই হোক সে গেল আফ্রিকাবাসীদের মারতে, আর এত ভালোভাবে, এত সুকৌশল ও সুচিন্তিতভাবে তাদের মারল যে ফ্রান্সে ফিরে এসে সে যখন আদেশ জারি করল যে সকলকেই তাকে মানতে হবে, তখনই সকলেই তার বশ্যতা স্বীকার করল। সম্রাট হবার পরে সে আবার গেল ইতালি, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সে সেখারকার মানুষদের মারতে। সেখানে সে অনেককে মেরে ফেলল। রাশিয়াতে আলেক্সান্দার নামে একজন সম্রাট ছিল, ইওরোপে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে এই মনস্থ করে সে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল। ১৮০৭-এ সে হঠাৎ তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করল, কিন্তু ১৮১১-তে তাদের মধ্যে আবার বিবাদ বাধল, আবার তারা অনেক লোক মারতে শুরু করল। নেপোলিয়ান ছয় লক্ষ সৈন্য নিয়ে রাশিয়ায় প্রবেশ করল, মস্কো দখল করল, তারপর হঠাৎ সে মস্কো থেকে পালিয়ে গেল, আর সম্রাট আলেক্সান্দার স্তিন ও অন্যান্যদের পরামর্শে ইওরোপের এই শান্তি বিঘ্নকারীরা বিরুদ্ধে গোটা ইওরোপকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলল। নেপোলিয়ানের মিত্রপক্ষের লোকেরা হঠাৎ তার শত্রু হয়ে গেল, তাদের সেনাবাহিনীও তার বিরুদ্ধে এগিয়ে এল। মিত্রশক্তি নেপোলিয়ানকে পরাজিত করল, প্যারিসে প্রবেশ করল, নেপোলিয়ানকে সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য করল, এবং তাকে এলবা দ্বীপে পাঠিয়ে দিল। অবশ্য তার সম্রাট উপাধিটা কেড়ে নিল না, তাকে সর্বপ্রকার সম্মানও দেখাল, যদিও পাঁচ বছর আগে এবং এক বছর পরে সকলেই তাকে দেখত একজন সমাজচ্যুত দস্যুর মতো। তারপর যে ষোড়শ লুই ছিল এতদিন ফরাসি ও মিত্রশক্তির পরিহাসের পাত্র সেই আবার শাসন-কর্ততে ফিরে এল। আর নেপোলিয়ন তারই ওল্ড গার্ডদের সামনে চোখের জল ফেলতে ফেলতে সিংহাসন পরিত্যাগ করে নির্বাসনে চলে গেল। তার পর সুকৌশলী রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিবদরা (বিশেষ করে তালেবাদ) ভিয়েনাতে আলোচনায় বসল, এবং তাদের আলোচনার দ্বারা কোনো জাতিকে সুখী, কোনো জাতিকে দুঃখী করে দিল। হঠাৎ কূটনীতিবিদ ও রাজাদের মধ্যে লড়াই বাধার উপক্রম দেখা দিল, উভয় পক্ষের সেনাদলকে যুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয় আর কি, এমন সময় এক ব্যাটেলিয়ান সৈন্য নিয়ে নেপোলিয়ান এনে হাজির হল ফ্রান্সে, আর যে ফরাসিরা তাকে ঘৃণা করত তারাই সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে আত্মসমর্পন করল। মিত্রপক্ষের নরপতিরা ক্ষেপে গিয়ে আবার ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দিল। প্রতিভাধর নেপোলিয়ানকে পরাজিত করল, আর তখনই হঠাৎ তাকে একটা দস্য বলে চিনতে পেরে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে পাঠিয়ে দিল। আর সেই নির্বাসিত লোকটি তার বড় আদরের প্রিয় ফ্রান্স থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধীরে ধীরে সেই পাহাড়ের বুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেল, আর তার মহৎ কার্যাবলিকে রেখে গেল অনাগত মানুষের জন্য। কিন্তু ইওরোপে আবার প্রতিক্রিয়া দেখা দিল, নরপতিগণ আর একবার প্রজাদের উপর উৎপীড়ন চালাতে লাগল।